অনুষ্টুপের রবীন্দ্রনাথ Volume II
 9788185479941

Table of contents :
Title Page
Copyright Page
সূচি
অ তি থি স ম্পা দ কে র ক থা
অনুষ্টুপের রবীন্দ্রনাথ : দ্বিতীয় খণ্ড প্রসঙ্গে
প্রা ক ক থ ন
রবীন্দ্রায়ন তথা রবীন্দ্রযান
রবীন্দ্রনাথ ও টমসন পত্রাবলির ভূমিকা
গানের ভিতর দিয়ে
‘নবীন’- স্মৃতি ও রবীন্দ্রনাথের নৃত্য-ধারা
রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মপরিচয়’ : চোরাটানের ইতিহাস [তৈমুর রেজা]
‘নিশীথে’ চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ: [মনুজেন্দ্র শ্যাম]
আত্মার আত্মীয় : রবীন্দ্রনাথ ও নীলরতন [শ্যামল চক্রবর্তী]
সংকট সভ্যতার, সংস্কৃতির : কবির দৃষ্টিতে [উদয়নারায়ণ সিংহ]
গোরা : জর্জ এলিয়ট ও রবীন্দ্রনাথ [প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস ]
পাঠ ও প্রতিক্রিয়া [প্রণবেশ রায়]
লেখকের উত্তর [প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস]
প্রসঙ্গ : রক্তকরবী
‘রক্তকরবী’ ও স্মৃতিলোক: [তপোব্রত ঘোষ]
‘রক্তকরবী’ শিশিরকুমার এবং একটি জিজ্ঞাসা [অনিল মুখোপাধ্যায়]
রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী : তথ্য ও তত্ব: [প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস]
রক্তকরবী : কয়েকটি তথ্য [শঙ্খ ঘোষ]
প্রসঙ্গ রক্তকরবী : একটি বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে [আশিসকুমার চক্রবর্তী]
‘রক্তকরবী’ প্রসঙ্গে বিতর্ক: [প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস]
‘রক্তকরবী’ প্রসঙ্গে বিতর্ক: [শঙ্খ ঘোষ]

Citation preview

অনুষ্টু পের রবীন্দ্রনাথ

দ্বি তী য় খ ণ্ড

প্রাতিস্বিকের রবীন্দ্রনাথ

অ নু ষ্টু পে র র বী ন্দ্র না থ দ্বি তী য় খ ণ্ড প্রাতিস্বিকের রবীন্দ্রনাথ সম্পাদক অনিল আচার্য অতিথি সম্পাদক সমীর সেনগুপ্ত

অনুষ্টু প ২ই নবীন কু ণ্ডু লেন কলকাতা ৭০০ ০০৯

Supported by the Grant from Department of Culture, Govt. of India অনুমতি ব্যতিরেকে এই বইয়ের কোনো অংশের মুদ্রণ ও পুনর্মুদ্রণ বা প্রতিলিপিকরণ আইন অনুযায়ী করা যাবে না৷ Anustuper Rabindranath Volume-II A collection of writings from Anustup : a Bengali Quarterly since 1966 সম্পাদক অনিল আচার্য অতিথি সম্পাদক সমীর সেনগুপ্ত সম্পাদনা সহযোগিতায় সন্দীপন সেন, অরুণ কর্মকার প্রচ্ছদ রাতু ল চন্দ রায় প্রথম প্রকাশ অগস্ট ২০১২ প্রকাশক লিটেরেচার আর্ট, ন্যাশনাল কালচার এডু কেশন অ্যান্ড রিসার্চ সোসাইটি-র পক্ষে আনন্দকু মার চক্রবর্তী ও অনুষ্টু প-এর পক্ষে আশিস ঘোষ ২ই নবীন কু ণ্ডু লেন, কলকাতা-৭০০ ০০৯ বর্ণবিন্যাস কমল পাঁজা, অনুষ্টু প মুদ্রণ বেঙ্গল ফোটোটাইপ কোম্পানি ৪৬/১ রাজা রামমোহন সরণি, কলকাতা-৯ ISBN 978-81-85479-94-1

সমীর সেনগুপ্ত-র উদ্দেশে

সূচী অতিথি সম্পাদকের কথা অনুষ্টু পের রবীন্দ্রনাথ : দ্বিতীয় খণ্ড প্রসঙ্গে প্রা ক ক থ রবীন্দ্রায়ন তথা রবীন্দ্রযান [অরুণা হালদার] রবীন্দ্রনাথ ও টমসন পত্রাবলির ভূ মিকা [উমা দাশগুপ্ত] গানের ভিতর দিয়ে [সুপূর্ণা দত্ত] ‘নবীন’-স্মৃতি ও রবীন্দ্রনাথের নৃত্য-ধারা [রমা চক্রবর্তী] রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মপরিচয়’ : চোরাটানের ইতিহাস [তৈমুর রেজা] ‘নিশীথে’ চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ: [মনুজেন্দ্র শ্যাম] আত্মার আত্মীয় : রবীন্দ্রনাথ ও নীলরতন [শ্যামল চক্রবর্তী] সংকট সভ্যতার, সংস্কৃ তির : কবির দৃষ্টিতে [উদয়নারায়ণ সিংহ] গোরা : জর্জ এলিয়ট ও রবীন্দ্রনাথ [প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস ] পাঠ ও প্রতিক্রিয়া [প্রণবেশ রায়] লেখকের উত্তর [প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস] প্রসঙ্গ : রক্তকরবী ‘রক্তকরবী’ ও স্মৃতিলোক: [তপোব্রত ঘোষ] ‘রক্তকরবী’ শিশিরকু মার এবং একটি জিজ্ঞাসা [অনিল মুখোপাধ্যায়] রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী : তথ্য ও তত্ব: [প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস] রক্তকরবী : কয়েকটি তথ্য [শঙ্খ ঘোষ] প্রসঙ্গ রক্তকরবী : একটি বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে [আশিসকু মার চক্রবর্তী] ‘রক্তকরবী’ প্রসঙ্গে বিতর্ক: [প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস] ‘রক্তকরবী’ প্রসঙ্গে বিতর্ক: [শঙ্খ ঘোষ]

অ তি থি স ম্পা দ কে র ক থা এই রকম একটি অসামান্য প্রবন্ধ সংকলন সম্পাদনার দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব আমার মতো শৌখিন রবীন্দ্রর্চ্চাকারকে দেওয়ায় প্রথমেই অনুষ্টু প-এর সম্পাদক অনিল আচার্যকে কৃ তজ্ঞতা জানাই৷ অনেক কিছু জানা হল পুরোনো অনুষ্টু প অনেক ঘাঁটা গেল–তার মূল্য আমার কাছে কম নয়৷ ৪৫ বছরের অনুষ্টু প থেকে এই প্রথম খণ্ডে নির্বাচন করা হয়েছে ত্রিশটি প্রবন্ধ৷ আরও বেশ কিছু প্রবন্ধ আমাদের আন্তরিক ইচ্ছা সত্ত্বেও এখানে অন্তর্ভুক্ত করা গেল না শোভন সোমের বেশ কয়েকটি মূল্যবান রচনা বই হয়ে বেরিয়ে গেছে–এবং এখনও বাজারে আছে এই অবস্থায় সেগুলি পুনরায় ব্যবহার করা আমাদের কাছে সংগত বলে মনে হল না৷ কয়েকটি লেখা খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ তবু যা এখানে উপস্থিত করা হল তার মূল্যও নিতান্ত কম হবে না৷ রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে এই প্রবন্ধগুলি অকৃ ত্রিমভাবে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রচিত আধুনিক পাঠকের একটি বিশেষ ধরনের প্রয়োজন এরা মেটাতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস৷ পঞ্চাশ বছর আগেকার পাঠক রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক কোনো রচনার কাছ থেকে যা চাইতেন এখনকার পাঠক তার চেয়ে একটু অন্য রকম করে চান–তার কারণও আছে৷ রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে একেবারে প্রথম যুগের আলোচনা ছিল মূলত ‘রবীন্দ্রদর্শন’ নামক বিষয়ের আলোচনা৷ রবীন্দ্রনাথ কেমনভাবে উপনিষদসমূহকে তাঁর চিন্তার বিকাশে ব্যবহার করেছেন তাঁর জীবনদেবতার ধারণার মধ্যে কোন কোন পূর্বসূরীর কী ধরনের চিন্তা অনুস্যূত হয়ে আছে তাঁর মৃত্যুচিন্তার মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকার সংগীত কিভাবে ধ্বনিত হয়ে উঠেছে এই সব বিষয় নিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রথম যুগের র্চ্চাকারগণ ভাবিত ছিলেন৷ যেমন তাঁর শতবর্ষের বছরে প্রকাশিত হয়েছিল ড. শশীভূ ষণ দাশগুপ্তের উপনিষদের পটভূ মিকায় রবীন্দ্রনাথ প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায়ের ক্লাসিক আলোকে রবীন্দ্রনাথ চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনমৃত্যুর ছন্দে ছন্দে রবীন্দ্রনাথ সুনন্দ দত্তর রবীন্দ্রকাব্য ভাষা ড. সুধীরকু মার নন্দীর রবীন্দ্রদর্শন অন্বীক্ষণ৷ পরের বছর বেরিয়েছিল প্রবোধচন্দ্র সেনের ভারতপথিক রবীন্দ্রনাথ ড. মনোরঞ্জন জানার রবীন্দ্রনাথ (কবি ও দার্শনিক)৷ তার পরের বছর (১৩৭১ব.) বেরিয়েছিল সুনীলচন্দ্র সরকারের রবীন্দ্রশিক্ষাদর্শন ও সাধনা অমূল্য সরকারের রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যতত্ত্ব ড. বিষুপদ ভট্টাচার্যের কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ৷ আরও উদাহরণ স্তূ পাকার করা যায় কিন্তু তার বোধহয় প্রয়োজন নেই আমরা যা বলতে চাচিছ তা এই ক’টি দৃষ্টান্ত থেকেই প্রতিপাদিত হবে৷ এই পুস্তকগুলির আন্তরিক মূল্য আমরা

একেবারেই অস্বীকার করছি না করবার কোনো উপায়ও নেই কারণ এই গ্রন্থগুলি আমাদের রবীন্দ্রর্চ্চার ভিত্তিভূ মি কিন্তু আজকের দিনে কেউ রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে চাইলে তিনি এইজাতীয় বিষয়ের কথা ভাববেন না এইজাতীয় গ্রন্থনামও নির্বাচন করবেন না৷ গত পঞ্চাশ-ষাট বছরে আরও প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অজস্র স্মৃতিকথা এই ধারাটিও শেষ হয়ে এসেছে বলেই মনে হয়–তাঁর প্রয়াণের পর সত্তর বছরেরও অধিক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে তাঁর বিষয়ে মূল্যবান স্মৃতিকথা লেখার মতো মানুষ আর বিশেষ কেউ জীবিত আছেন বলে মনে হয় না৷ আর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বিষয়ে অজস্র তথ্যসম্ভার৷ প্রভাতকু মারের চার খণ্ড রবীন্দ্রজীবনী প্রশান্তকু মারের ন-খণ্ডে অসমাপ্ত রবিজীবনী চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত চার খণ্ডে আনন্দবাজার পত্রিকায় রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ নেপাল মজুমদারের ছ-খণ্ডে ভারতের জাতীয়তা আন্তর্জাতিকতা ও রবীন্দ্রনাথ ১৯১২ থেকে ১৯৪১ সময়কালে ইংলন্ডের পত্রপত্রিকায় তাঁর বিষয়ে যত লেখা প্রকাশিত হয়েছে তার সংকলন–এসব মহাগ্রন্থ ছাড়াও মহাকবির জীবনের নানাদিক নিয়ে অজস্র লেখকের অজস্র বই প্রকাশিত হয়েছে স্মৃতিকথাগুলিতেও তথ্য আছে পর্বতপ্রমাণ৷ তাঁর গানগুলিকে কালক্রমে সাজানো হয়ে গেছে প্রায় সমস্ত অচলিত সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থাবলিতে মুদ্রিত হয়ে গেছে৷ তাঁর সমগ্র ইংরেজি রচনাও চার খণ্ডে একসঙ্গে পাওয়া যায়৷ ১৯১২ সালে জাহাজে বিলেতে যেতে যেতে গীতাঞ্জলি-র কবিতাগুলি যে খাতাটিতে অনুবাদ করেছিলেন তিনি যেটি তিনি রোটেনস্টাইনকে উপহার দিয়েছিলেন সেই খাতাটির অবিকল প্রতিরূপও বেরিয়ে গেছে গীতাঞ্জলি-র ইংরেজি অনুবাদে ইয়েটস কতখানি সংশোধন করেছিলেন তা নিয়ে শৌখিন পাঠককে আর বিশেষজ্ঞের মুখে ঝাল খেতে হবে না তিনি নিজেই মিলিয়ে দেখে নিতে পারবেন৷ তাঁর প্রায় সমগ্র চিত্রাবলি পুস্তকাকারে বেরিয়ে গেছে তাঁর গানের রেকর্ডের আর্কাইভও নাকি তৈরি হচেছ বলে শুনতে পাই৷ শুধু চিঠিপত্রের ক্ষেত্রেই আমরা এখনও তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জিততে পারিনি৷ সেখানে এখনও তিনি আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে আছেন তাঁর বহু চিঠিপত্র এখনও পড়ে আছে পাণ্ডুলিপি আকারে৷ ছোটোবেলা শ্রী-ঘিয়ের একটা বিজ্ঞাপন দেখতু ম–সেই যে দাড়িওয়ালা দাদুর এক হাতে হুঁকো অপর হাতে মোটা একটা দড়ির একটা প্রান্ত অন্যদিক ধরে প্রাণপণে টান দিচেছ তাঁর নাতিনাতনির দল দাদু একাই একটা দিক অবহেলায় টেনে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন নাতিনাতনিদের সম্মিলিত চেষ্টা তাঁকে হেলাতে পারছে না৷ চিঠিপত্রের ব্যাপারে এখনও সেইভাবেই এগিয়ে আছেন তিনি আমরা এখনও তাঁর বহু চিঠিপত্র ছেপে উঠতে পারিনি৷

তাও যদি বলি রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি হবার জন্যে আজ আমরা অনেকটা প্রস্তুত অন্তত তাঁকে সহ্য করে নেবার মতো বর্মচর্ম আমরা বানিয়ে ফেলতে পেরেছি তাহলে বোধহয় খুব বাড়িয়ে বলা হয় না৷ অন্তত আজ আর তিনি হঠাৎ আস্তিনের ভেতর থেকে একটা ছবি বের করে বলে উঠতে পারবেন না ‘কী বললে আমি নূড আঁকিনি? দ্যাখো তো এই ছবিটা? কবিতায় তো লিখেছিই গানেও গেয়েছি–তোমরা ধরতে পারোনি সে কি আমার দোষ? আমার পরে তো আজ অবধি কত হাজার গান লিখলে তোমরা কই কেউ লিখেছ কি এমন একটা লাইন*: ‘‘আজ বুকের বসন ছিঁড়ে ফেলে দাঁড়িয়েছে এই প্রভাতখানি?’’ হুঁ:--’ বলে দাড়ির ফাঁকে মুচকি হেসে বলবেন ‘তোমরা এখনো নগ্ন বলতে ন্যাংটো বোঝো আমাকে ধরতে তোমাদের আরো দেরি হবে হে–’ দেরি হোক কিন্তু আমরা চেষ্টা করে যাচিছ নানাদিক থেকে৷ এই সংকলনগ্রন্থে তার কিছু পরিচয় রইল৷ এই ভূ মিকা লেখবার আগে ভেবেছিলাম পরবর্তী রচনাগুলির সঙ্গে পাঠকের একটু পরিচয় করিয়ে দেব এই পরিসরে কিন্তু এখন মনে হচেছ তার কি কোনো প্রয়োজন আছে? রচনাগুলি তো রইলই তারা তো এসে দাঁড়িয়েছেই পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করতে সম্মিলিতভাবে তারা কী করতে চায় সেটাই পাঠকের কাছে তু লে ধরা ভালো–যে রবীন্দ্রনাথের একটি আধুনিক ব্যাখ্যা আমরা নির্মাণ করতে চাই বিভিন্ন দিক দিয়ে তাঁকে হূদয়ে ধারণ করতে চাই তাঁর যতগুলি সম্ভব দিককে আমরা একসঙ্গে দেখতে চাই–এই ব্যাপারে আমরা প্রত্যেকেই একেকজন পিকাসো হতে চাই৷ পিকাসো যেমন যে কোনো বস্তুকে একই সঙ্গে নানাদিক থেকে দেখতে চাইতেন আমরাও তেমনি রবীন্দ্রনাথকে একই সঙ্গে নানা দিক থেকে দেখতে চাই তাঁর প্রায় সবগুলি প্রধান দিকে তিনি ঠিক কী করেছিলেন তা আমরা মোটামুটি হাতের নাগালে এনে ফেলেছি এখন এখন আমরা অনেকটা প্রস্তুত৷ আমরা এখন বোধহয় বুঝতে পেরেছি যে রবীন্দ্রনাথ বলতে শুধু সীমা আর অসীম নয় শুধু জীবনদেবতা আর মৃত্যুচেতনা নয় ঔপনিষদিক ভাবনা আর কালিদাসের সঙ্গে মিল খুঁজে তাঁর সহস্রাংশকেও বোঝা যায় না৷ আমাদের প্রপিতামহের সমসাময়িক হলেও তিনি আমাদের মতোই এখনকার কালের মানুষ বেঁচে থাকার মহিমা ও বেঁচে থাকার মালিন্যগুলিকে আমাদের মতোই একই সঙ্গে অতিক্রম করেছিলেন তিনি৷ তাঁকে আমাদের মতো করে বুঝতে গেলে তাই আমাদের নতু ন করে তাঁর দিকে তাকাতে হবে আনাচেকানাচে খুঁজতে হবে নতু নভাবে ডেটা-কালেকশন করতে হবে৷ সেই নতু নভাবে তাঁকে সন্ধান করবার কিছু কিছু পথের আভাস রইল এই সংকলনে৷ কখনো কখনো মনে হয় গত পঞ্চাশ-ষাট বছরের চেষ্টায় আমরা হয়তো তাঁর উত্তরীয়ের প্রান্ত ধরে ফেলতে পেরেছি৷ আবার কখনো মনে হয় সত্যিই কি আমরা কয়েক

পা-ও এগিয়েছি তাঁর দিকে? নাকি আমাদের সমস্ত মধ্যবিত্ত প্রস্তুতিকে তাচিছল্য করে তিনি রয়ে গেছেন একই রকম সুদূর ও ধরাছোঁয়ার অতীত জানলার বাইরে সন্ধ্যাতারার মতো? সমীর সেনগুপ্ত ৭ ডিসেম্বর ২০১১

অনুষ্টু পের রবীন্দ্রনাথ

অনুষ্টু পের রবীন্দ্রনাথ : দ্বিতীয় খণ্ড প্রসঙ্গে প্রা ক ক থ ন ১ ১৯২৬-এর নভেম্বরে তিনি লিখেছিলেন ‘শূন্য তাহার পূর্ণ করিয়া ধন্য করুক সুরে’৷ এর পর দু বছরও কাটল না ১৯২৮-এর জুনে ব্যাঙ্গালোরের ব্যালাব্রুয়িতে বসে লিখলেন শেষের কবিতা-র শেষ কবিতা যেখানে আবার সেই এক প্রার্থনা–‘শূন্যেরে করিব পূর্ণ এই ব্রত বহিব সদাই’৷ ১৩১২-র শ্রাবণে বোলপুরে বসে লিখলেন আলোর প্রার্থনা ‘আমার ঘরে হয় নি আলো জ্বালা/দেউটি তব হেথায় রাখো বালা’৷ এর দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক পরে জীবনের শেষ হেমন্ত ঋতু তে রোগশয্যা থেকে তাঁর লেখনীতে আবার সেই আলোর আবেদন ‘আলোকের পথে প্রভু দাও দ্বার খুলে/আলোক-পিয়াসী যারা আছে আঁখি তু লে’৷ জীবনের শেষ প্রহরের এক বৈশাখে লিখলেন ‘সবচেয়ে সত্য করে পেয়েছিনু যারে/ সবচেয়ে মিথ্যা ছিল তারি মাঝে ছদ্মবেশ ধরি’৷ তার পনেরো মাস পরে এল তাঁর জীবনের সর্বশেষ কবিতা যেখানে আবার সেই সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব–‘বিচিত্র ছলনাজাল’ ও ‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ’ থেকে মুক্ত হবার আর্তি–‘সত্যেরে সে পায়/আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে’৷ শূন্য-পূর্ণ আলো-আঁধার সত্য-মিথ্যা–এই দ্বন্দ্বে তিনি লিপ্ত ছিলেন আজীবন দেখতে চেয়েছিলেন কু হেলিকা ভেদ করে যে সত্য প্রকাশিত হয় তার অমৃত রূপ৷ যত দিন গিয়েছে তাঁর এই দ্বন্দ্ব তত তীব্র হয়েছে–লিখেছেন ‘এ আমির আবরণ সহজে স্খলিত হয়ে যাক’৷ মংপুতে বসে মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেছিলেন ‘নিজের কাছ থেকে নিজের যে মুক্তি সেই দুর্লভ মুক্তির জন্য চেষ্টা করি৷ সে চেষ্টা প্রত্যহ করতে হয় তা না হলে আবিল হয়ে ওঠে মন৷’ আর এখানেই আমাদের সবার ব্যক্তিগত রবীন্দ্রনাথ ‘প্রাতিস্বিকের রবীন্দ্রনাথ’৷ ব্যক্তিজীবনে আমরাও কি অনবরত আমাদের হয়ে ওঠার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে থাকি না? আর কে না জানে প্রত্যেক বাঙালির কাছে সে লড়াইয়ের সঙ্গী রবীন্দ্রনাথ৷ শঙ্খ ঘোষ যেমন বলেছেন রবীন্দ্রনাথের গান নিজেকে রচনা করে তু লবার গান এক বিরামহীন আত্মদীক্ষার গান–আঁধার রাতে একলা পাগল যখন হাহাকার করে আর্তনাদ করে ‘বুঝিয়ে ণ্ঠে

দে বুঝিয়ে দে’ তখন সে হাহাকার আমাদের কণ্ঠেও প্রতিধ্বনিত হয় কারণ আমাদের পেছনে যে জীবন পড়ে রয়েছে সে জীবন অপচয়ের অক্ষমতার অপূর্ণতার৷ আর তাই ‘প্রাতিস্বিকের রবীন্দ্রনাথ’ যিনি আমাদের প্রাত্যহিকতায় লগ্ন হয়ে আছেন যাঁকে আশ্রয় করে আমরা নিজেদের রচনা করে তু লি৷ অথচ কী আশ্চর্য তাঁকে কি আমরা ভালো করে চিনি? তাঁর কত ভু ল মূর্তি রচনা করেছি আমরা তা কি আমরা নিজেরাই জানি? তথাকথিত রবীন্দ্রভক্তদের তু লিতে আঁকা তাঁর শান্ত সমাহিত ঋষিসুলভ মূর্তির আড়ালে কোথায় চাপা পড়ে গেছে তাঁর নিরন্তর নিজেকে গড়ে তোলার সংগ্রাম সে খবর কি আমরা রাখি? সমীর সেনগুপ্ত যাকে বলেছেন তাঁর অবিরত বেড়ে-ওঠা আর হয়ে-ওঠা? আমরা কি জানতে চাই যে তিনি শুধু ‘সত্য মঙ্গল প্রেমময়’-র কবি নন? গীতাঞ্জলি-পর্যায়ের সর্বকল্যাণময় ঈশ্বরচিন্তার আড়ালে পৃথিবীর কু ৎসিত হিংসার যে ছবি আঁকা রয়েছে তা কি আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি? ‘জগৎ পারাবারের তীরে ছেলেরা করে মেলা’–এই পঙক্তির পাশেই আমরা যখন পড়ি ‘ঝঞ্ঝা ফিরে গগনতলে তরণী ডু বে সূদুর জলে মরণ-দূত উড়িয়া চলে’–তখন আমরা কি কখনো ভেবে দেখি যে এ কবিতা লেখা হয়েছিল এমন এক সময়ে যখন তাঁর প্রিয়তমা মাতৃ হারা কন্যা রেণুকা অন্তিম শয্যায় শায়িত? আমরা কি খেয়াল করি যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমরক্ষেত্রে বসে এই কবিতারই ইংরেজি অনুবাদ যখন পড়েছিলেন উইলফ্রেড আওয়েন তখন এ কবিতায় বর্ণিত হিংসার বাতাবরণ তাঁকে সম্পূর্ণ এক নতু ন অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছিল? আমরা কি কখনো মনে রাখি যে তিনি শুধু পূজা বা প্রেমের গানের রচয়িতা নন বা শুধু ‘প্রেমানন্দ’ বা ‘প্রসাদবারি’-র কবি নন? পেলব কোমলতা বা আবিষ্ট রোম্যান্টিক মোহাবেশ ছাড়িয়ে তিনিই যে বারবার নানাভাবে জীবনের গোপন গহীন আদিম অন্ধকার কু ঠু রির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটানোর চেষ্টা করেছেন তা কি আমরা সব সময়ে মনে রাখি? চতু রঙ্গ উপন্যাসে শচীশ আর দামিনী যে রাতে গুহায় রাত্রিবাস করেছিল সে রাতের বর্ণনায় রোঁয়াহীন সাপের মতো বুনো জন্তু যখন তার বীভৎস খিদে নিয়ে পাঠকদের সামনে হাজির হয় তখন আমরা কি লালাসিক্ত আদিম কামনার ছবিই তাতে দেখি না যেমনটা বলেছেন পূর্ণেন্দু পত্রী? আরও আরও কতভাবে মানুষের আদিম কামনার ছবি তিনি তু লে ধরেছেন তা কি আমরা সর্বদা খেয়াল করি? ঘরে বাইরে উপন্যাসে সন্দীপের ‘অসংকোচ পৌরুষের’ আগুনের সামনে বিমলাকে ‘জালে পড়া হরিণী’ বা ‘পতঙ্গিনী’ বলে বর্ণনার মধ্যে যে অবধারিত যৌন খিদের পরিচয় আছে তা কি আমরা চেয়ে দেখি? শেষের কবিতা-য় ঝরনা প্রজাপতি মলমল আর চন্দনের উপস্থিতিই আমরা দেখি লক্ষ করি কি যে কেতকী মিত্তিরের চোখে ‘ছুরির ঝলক’ বা তার অনাবৃত বুক ও বাহু আর দেহের ওপর ‘সাপের খোলসের মতো ফু রফু রে আবরণ’? বোঝার চেষ্টা করি কি যে শেষের কবিতা শুধু প্রেমের উপন্যাসই নয় কামনারও বটে? যোগাযোগ-এ মধুসূদনের

শোবার ঘরে ‘পুরো বহরের একটা নিরাবরণ মেয়ের ছবি’ বা মোতির মা-র চোখ দিয়ে দেখা অন্ধকার গুহার মুখে দাঁড়ানো কু মুদিনী ‘যেখানে একটা অজানা জন্তু লালায়িত রসনা মেলে গুড়ি মেরে বসে আছে’ –এ সবের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আমাদের কী বলেছেন তা কি আমরা এখনও সঠিক বুঝেছি? মধুসূদনের সঙ্গে রাত্রিযাপনের পরের সকালে কু মুদিনীর যে অশুচিতার বোধ শরীরকে ‘মাংসপিণ্ড’ ভেবে তার আত্মধিক্কার ‘মাছ-মাংসের দরে মেয়ে বিক্রি’-র অনুভূ তি এসবের মধ্যে প্রেমহীন দৈহিক ক্ষু ধা ও ভোগের উৎকট উৎসবের বর্ণনা আমরা খুঁটিয়ে জেনেছি কি? শারীরিক বাসনা ও উদগ্র লালসার যে ছবি তিনি আমাদের সামনে এঁকে দিয়ে গেছেন সেই বীভৎসতার কোনো খোঁজ কি আমরা রাখি? রক্তকরবী-তে অন্ধকারের কানা রাক্ষস বা মকরের দাঁতের হিংস্র লোলুপতার যে ছবি তিনি এঁকেছেন আজকের এই উত্তর-আধুনিক যুগেও কি ধনতান্ত্রিক সভ্যতার উন্মত্ত লোভের ছবি আমরা কেউ তার থেকে ভালো আঁকতে পেরেছি? যে অগ্রহায়ণ মাসে তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু তার দু-দশক পরে আরেক অগ্রহায়ণে তিনি যখন গান লেখেন ‘অনেক কথা বলেছিলেম কবে তোমার কানে কানে’ তখন সে গানের আড়ালে যে এক বিরহবিধুর পুরুষের ছবি লুকিয়ে আছে তার সন্ধান আমরা সহসা পাই কি? মৃত্যুর দেড় বছর আগে লিখলেন কবিতা যার নাম ‘রূপ-বিরূপ’৷ যিনি রূপ ও অরূপের সাধনা করে গেছেন বলেই আমরা ভাবতে পছন্দ করি তাঁর লেখনীতে বিরূপ–সে খবর আমরা রাখতে চাই? ‘যৌবনের কু সুমপ্রগলভ বনপথ’ ‘ধ্যানমগ্ন পর্বত’ বা ‘স্মৃতিলেখা ছন্দে’-র পথ পেরিয়ে এসে তিনি ‘যা পরুষ যা নিষ্ঠু র উৎকট যা’–তাকেও আমাদের সামনে রেখে গেছেন সে কথা আমরা ক’জন বুঝতে চাই? জীবনের শেষ বেলায় এসে মন দিলেন ছবি আঁকায়–আমাদের সামনে উপস্থিত করলেন আঁধারের এক বিচিত্র জগৎ–আদিম জান্তব খণ্ডিত এক জগৎ–যার অবরুদ্ধ অন্ধকার আর কাটাকু টির নকশা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আধুনিক জীবনের মালিন্য অস্থিরতা আর উৎকট বীভৎসতাকে ইউরোপীয় মডার্নিস্টরা আমাদের যা দেখিয়েছেন৷ আমরা নিজেরাই কি ঠিকঠাক জানি যে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যে গ্লানি যে দৈন্য যে অবদমিত লালসা আর যে জান্তব খিদে নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি তার সবটু কু নিয়েই তিনি বারবার আমাদের সামনে এসেছেন? আর সকলের মতো তিনিও লড়েছেন বিধ্বস্ত হয়েছেন আবারও উঠে লড়েছেন? আর এই লড়াইয়ের পথে তাঁর সামনে এসেছেন জ্যোতির্ময় পুরুষ অলখ পথের পথিক যিনি আসেন সবার আড়ালে নিশার মতো নীরব হয়ে সবার দিঠি এড়ায়ে৷ সেই অনিঃশেষ প্রাণের নিরন্তর সাধনা আমাদের শিখিয়েছেন তিনিই: প্রভু মোচন করো ভয় সব দৈন্য করহ লয় নিত্য চকিত চঞ্চল চিত করো নিঃসংশয়

সংশয়-পারাবার থেকে নিঃসংশয়ের দিকে এই যাত্রার পথে তিনিই তো আমাদের সঙ্গী৷ ‘কঠিন বাধা-লঙ্ঘনে’তিনি আমাদের ত্রাতা৷ আমাদের সব আকাঙ্ক্ষা সব স্বপ্ন সব হতাশা সব নিরাশা সব সাধনা সব সংগ্রাম–আমাদের জীবনের সবটু কু তে জড়িয়ে আছেন তিনি– রবীন্দ্রনাথ৷ আমাদের সবার ব্যক্তিগত রবীন্দ্রনাথ প্রাতিস্বিকের রবীন্দ্রনাথ৷

২ প্রথম খণ্ডের ভূ মিকায় ‘অনুষ্টু প’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের সংকলনটির প্রয়াত অতিথি সম্পাদক সমীর সেনগুপ্ত একটি বিভাজন করেছিলেন৷ অনুষ্টু প-এ প্রকাশিত প্রবন্ধসমূহ পাঠ করে তাঁর মনে হয়েছিল প্রথম খণ্ডটির বিষয় হোক ‘সাম্প্রতিকের রবীন্দ্রনাথ’ অর্থাৎ সাম্প্রতিকের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্র-মূল্যায়ন৷ দ্বিতীয় খণ্ডটির প্রেক্ষিত তিনি ভাবলেন অন্যরকমভাবে৷ তাঁকে নিয়ে যত রকম চিন্তাভাবনা হয়েছে হয়েছে বিতর্ক তার চিন্তাভাবনা ও অনুভবের যে বিস্তৃ ত বিশাল ভু বন ও জীবনের আবর্ত যা প্রায় প্রাত্যহিক ও প্রতিনিয়ত সেটাই তাঁর পরবর্তী খণ্ডের ভাবনা৷ স্বাভাবিকভাবে বিভাজনের যৌক্তিকতা ও তার অর্থ নিয়ে নানা প্রশ্ন৷ আর হয়তো রবীন্দ্রনাথের বিশালত্ব নিয়ে বিমোহিত বাঙালির প্রতিক্রিয়া শেকসপিয়র সম্পর্কে ম্যাথু আর্নল্ড-এর চতু র্দশপদী-তে বিধৃত হতে পারে : Others abide our question, thou art free৷ সপ্রশ্নে এই প্রশ্নাতীত ব্যক্তিত্বের সর্বব্যাপী বাঙালি-সত্তার পরিব্যাপ্তি যে বিশ্বজনীনতাকে স্পর্শ করে৷ সে-সব নিয়েই আমাদের এই প্রাতিস্বিকের রবীন্দ্রনাথ৷ আমরা তো বলতেই পারি ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো৷’ যে যোগসূত্র ধরেই প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের মতো ব্যক্তিমানুষের ভাবনা-চিন্তা৷ রবীন্দ্রনাথকে বিচার করার ক্ষেত্রে আলোচকরা নানারকম দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন৷ এইসব দৃষ্টিভঙ্গিজাত রচনাগুলি এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ পাঠকের বোঝবার সুবিধার জন্য এখানে ‘প্রাতিস্বিক’ শব্দটির ব্যাখ্যা বিশেষ প্রয়োজন৷ প্রথমত বলে রাখা ভালো যে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ ‘প্রাতিস্বিক’ শব্দটি গৃহীত হয়নি৷ ‘প্রাতিস্বিক’ শব্দটি গৃহীত হয়েছে সংসদ বাংলা অভিধান ও সংসদ সমার্থশব্দকোষ-এ৷ সংসদ বাংলা অভিধানের বয়ান অনুসারে ‘প্রাতিস্বিক-বিণ’ ১) প্রত্যেকের স্বকীয় ব্যক্তিগত ২) সর্বসাধারণের নয় এমন (প্রাতিস্বিক ধর্ম প্রাতিস্বিক বিশ্বাস) [সং.প্রতি+স্ব+ইক্*]৷ সমার্থশব্দকোষ-এ ‘নিজস্ব’ শব্দটির প্রয়োগ হয়েছে মূলত প্রাতিস্বিক শব্দটি বোঝাতে৷ এই ‘নিজস্ব’ মতামতও তৈরি হয়েছে ভিন্ন যুক্তি এবং নানান তথ্যের সমাহারে৷ আর এই ‘প্রাতিস্বিকতা’ আবার জন্ম দিয়েছে বিভিন্ন মতামতের৷ এই খণ্ডে যেসব বিতর্ক হয়েছে সেখানে একজন সমালোচক যখন রবীন্দ্রনাথকে কু ম্ভীলকবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত করেছেন অন্য সমালোচকরা রবীন্দ্র-নিন্দার সেই প্রাতিস্বিক ভাবনা মানছেন না৷ আবার রক্তকরবী প্রসঙ্গে সমালোচকের তথ্যগত বিভ্রান্তি তু লে ধরে কবি ও রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছেন আগে থেকে একটি ধারণা পোষণ করে তদনুযায়ী যুক্তি খুঁজলে সমালোচকের

তাঁর যুক্তির সপক্ষে ভু ল তথ্য চয়ন করার প্রবণতা থাকে অনেক বেশি৷ আর ভু ল তথ্য মূল বক্তব্যকে ভু ল পথে পরিচালিত করতে পারে৷ যেমনটি ঘটেছে সমালোচক প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে৷ এইসব তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রর্চ্চার বিভিন্ন ধারার সম্মিলন ঘটেছে দ্বিতীয় খণ্ডে৷ অনুষ্টু পের রবীন্দ্রনাথ ২য় খণ্ডে অরুণা হালদার থেকে শুরু করে উদয়নারায়ণ সিংহ পর্যন্ত অংশটিতে রবীন্দ্র প্রসঙ্গের বহু বিষয় নিয়ে আলোচনার সন্নিবেশ ঘটেছে৷ রবীন্দ্রায়ন রবীন্দ্রনাথ ও টমসন পত্রাবলির ভূ মিকা রবীন্দ্রনাথের ‘গানের ভিতর দিয়ে’ বা চিকিৎসাবিদ্যা ও চিকিৎসক প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ প্রভৃ তি রচনার মধ্যে নিজস্ব মত থাকলেও তা কোনো বিতর্কের জন্ম দেয়নি৷ রবীন্দ্রনাথের আত্মপরিচয় এবং সংকট সভ্যতার সংস্কৃ তির প্রবন্ধ দুটি প্রসঙ্গে আরও আলোচনা হতে পারে৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে গোরা জর্জ এলিয়ট ও রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধটি থেকেই৷ রবীন্দ্রনাথ গোরা উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে কীভাবে জর্জ এলিয়টকে অনুকরণ ও অনুসরণ করেছিলেন ইত্যাদি প্রসঙ্গে প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের মতামত পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত নাও হতে পারে৷ অনুষ্টু পের এক পত্রলেখক দীর্ঘ পত্রে এই ধারণার প্রতিবাদী বিশ্লেষণ করেছেন৷ আর বিতর্কের সূচনা অনুষ্টু পের রবীন্দ্রনাথ-এর ২য় খণ্ডের দ্বিতীয় পর্বের রচনা থেকে তৃ তীয় পর্বে রক্তকরবীতে সূচিত হয়েছে৷ বিতর্কের পরিসমাপ্তি ঘটেছে শঙ্খ ঘোষের প্রত্যুত্তর দিয়ে যা লিপিবদ্ধ হয়েছে এই খণ্ডের শেষ রচনায়৷ এই প্রাতিস্বিক ভাবনাগুলি নির্দেশ করেছে এক সত্যের সন্ধান৷ সেই সত্য অনুধাবন করার জন্য বার বার যেমন রবীন্দ্রনাথকে পড়তে হবে তেমনই পড়তে হবে এইখণ্ডে সংগৃহীত প্রবন্ধসমূহ৷ সন্দীপন সেন অনিল আচার্য

রবীন্দ্রায়ন তথা রবীন্দ্রযান অরুণা হালদার অবতরণিকা প্রাসঙ্গিক একটি উক্তি দিয়ে এ লেখা শুরু করছি৷ লেখাটি হলো এই যদযদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তুত্তদ্দেবেতর জনঃ স যৎ প্রমাণং কু রুতে লোকস্তুদনুবর্ত্ততে৷৷ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ যিনি তিনি যে প্রকার আচরণ করেন অন্যেরা তাঁকে অনুসরণ (অনুবর্তন) করেন৷ বক্ষ্যমান এই শ্লোকটি শ্রীমদভগবদগীতাতে দেওয়া আছে৷ অর্থ বোধ করি কিছু কঠিন নয়৷ কিন্তু সদুঃখে বলতে হয় ভারতের মাটিতে এই উক্তির খুব সার্থকতা পাওয়া যায় না৷ কেন যায় না তার কারণও রবীন্দ্ররচনায় রাজা ও রানী নাটকে ত্রিবেদী পুরোহিতের উক্তি থেকে বোঝা যায়৷ ত্রিবেদীর বক্তব্য ছিল তাঁর বেদ সিন্দুর চন্দনে লিপ্ত ও প্রায় অপাঠ্য৷ ভারতীয় মননে উচ্ছ্বাস খুব বেশি৷ কাজ বা ক্রিয়াশীলতা তদনুপাতে এমনই কম৷ আর, যাও বা আছে সেটাও ভারতীয় মানসে ভয় বা ভক্তি সহকারে চাপা দেওয়া হয়ে থাকে৷ ভারতীয় মানস আরব মানস থেকে পৃথক৷ তাঁদের মতে পির ওড়েন না৷ তাঁর মুবিদ বা শিষ্যগণ তাঁকে ওড়ান৷ অপরদিকে ভারতীয় গুরুবাদ মৌখিক যাই বলুন না কেন আত্যন্তিক ভাবেই গুরুমুখী৷ এমনকি নিজে কিছু না করেও শুধুমাত্র সদগুরু প্রভাবে ভবার্ণব পার হতে পারেন এমন ধারণাও তাঁদের ছিল বা এখনও আছে বলাই সংগত৷ আমাদের সকল শ্রদ্ধা ভক্তির ভাষা হলো নৈষ্কর্ম্য৷ অবশ্য ঠিক নৈষ্কর্ম্য বলাও সংগত হয় না৷ কারণ যত কাজে ফাঁকি পড়ে ততই তার অনুষঙ্গ বাড়ে নানারকম পূজা ও উপচার সংগ্রহের সমারোহে৷ আমাদের শ্রদ্ধা ভক্তি প্রদর্শনের উপায় হলো আড়ম্বরপূর্ণ মাল্যদান এবং অবশ্যই বিলম্বিত এবং বিড়ম্বিত ভাষণ৷ এরূপ ব্যবস্থার জন্য যে সমারোহ প্রয়োজন সেটাও খরচসাপেক্ষ৷ সেটাতে আমরা কিন্তু মনে দ্বিধা করি না৷ একবারও বাস্তবে আমাদের মনে হয় না যে এই বুভু ক্ষর দেশে যেখানে মানুষ বা পশু কেহ খাদ্য ঠিকমতো পায় না, তাদের কাছে টিভির বক্তৃ তা বা তথাকথিত কর্তাব্যক্তিদের ভাষণে কী এসে যায়? ডিমক্রেসি কথাটা আছে ঠিকই কিন্তু সে ব্যাপারটা একপ্রকার স্বৈরতন্ত্র বা ব্যুরোক্রেসি মাত্র৷ যেখানে মানুষ মানবিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়নি বা জাগ্রতই হয়নি সেখানে ডিমক্রেসি কথাটা নিরর্থক মাত্র৷ কিন্তু অস্মদ্দেশীয় স্বৈরতন্ত্রের দিক থেকে আমরা কী প্রকার দৃঢ় ভাবনা করতে অভ্যস্ত! সে ভাবনায় মোটে স্থিতিস্থাপকতা থাকে না৷ একদিকে থাকে অহংবোধের

চরম আর অন্যদিকে থাকে একপ্রকার আত্মসন্তুষ্টি৷ এই কারণে হচ্ছে হবে হয়ে যাবে এইরূপ একটা মনোভাব আমাদের জাতীয় নেতাদের ও কর্তৃপক্ষের মনে দৃঢ়ীভূ ত৷ সাধারণ মানুষ কষ্ট পেতেই অভ্যস্ত৷ সাধারণত অভাব এত বেশি যে তাদের ভাবনাচিন্তা করাও স্বতন্ত্রভাবে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়৷ ‘কোনও মতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ রাখ বাঁচাইয়া’ এইরূপ মনোভাবসহ দুঃখী ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ তারা এক আশ্রয় খুঁজে পায় কোনো ভগবানের কল্পনায় এবং অবশ্য আশ্রয় পেয়ে যায় একপ্রকার অপব্যাখ্যায়৷ সে ব্যাখ্যা হলো এ জন্ম থেকে পূর্বজন্ম বা পরজন্ম-সম্মত ব্যাখ্যা৷ তার একদিকে পুরুষাকার হীনতা বা দৈবের উপর বিশ্বাস৷ আর অপরদিকে ভাগ্যকে স্বীকার করে কর্মবিমুখতা, এই হলো আমাদের জাতীয় জীবনের মূল্যবোধের আশ্রয়৷ দার্শনিক মতের কর্মবাদ ভারতীয় চিন্তাভাবনার ভিত্তি বলা চলতে পারে৷ পূর্বোক্ত বিশ্লেষণের পথে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া যায় না৷ সে পথের বাধা হলো বাস্তবিকতা এবং অবশ্যই আধুনিকতা৷ এই সত্যের পথে পদচারণা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন৷ সত্যকে পরিহার করতে পারেননি বলেই তাঁকে লিখতে হয়েছিল, এবার ফিরাও মোরে হে কল্পনে রঙ্গময়ী ...এবং সত্যকার পথ তাঁকে নিজস্ব নিয়মে বার করতে হয়েছিল৷ সে পথ ছিল তাঁর সংসারে পুত্রকন্যার জন্য, গ্রামীণ জীবনে কৃ ষকের জন্য এবং আরও প্রসারিত হওয়া কর্মক্ষেত্র তিনি আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠা করেন শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে৷ এই প্রসারণের কাজে বোধ করি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সহযোগী হয়েছিলেন তাঁর সহধর্মিণী স্বয়ং৷ তিনি নিজে অসুস্থ থেকেছেন প্রায়ই৷ তা সত্বেও তিনি রবীন্দ্রনাথ সহ কী গ্রামীণ জীবনে কী কলকাতায় অথবা শান্তিনিকেতনে কবির সংসার জীবনের আশ্রয়ীভূ ত ছিলেন বলা চলে৷ নিজের গহনা দিয়ে দেন স্বামীর কর্মযজ্ঞের জন্য৷ অতি অল্প বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়৷ পাঁচটি সন্তানের মাতা এই নারীকে রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রধানতম আশ্রয় বলা অসংগত হবে না৷ প্রায় সত্তর বৎসর বয়সে রবীন্দ্রনাথের বীথিকা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়৷ তাতে ‘নিমন্ত্রণের চিঠি’ হিসাবে একটি আশ্চর্য কবিতা আছে৷ রবীন্দ্রনাথ সকল সময়ে জীবনপ্রেমিক ছিলেন এবং ছিলেন খাদ্যরসিকও৷ পত্নীকে দিয়ে মানকচু র জিলাপিও তিনি প্রস্তুত করিয়েছেন৷ পত্নীও সেটি মেনে নিতেন কৌতু ক সহ৷ সংসারে তাঁর শান্তির অভাব ছিল না অর্থাভাব সত্বেও৷ সুগৃহিণী পত্নী তাঁকে তাঁর পুত্রকন্যাকে তথা আত্মপরিজনদেরও স্নেহের আশ্রয় ও শান্তি দিতে পেরেছিলেন স্বল্পদিনের জীবনেও৷

এই পত্নীর কথা স্মরণ করেই রবীন্দ্রনাথ মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেছিলেন এক একজনা থাকে যাকে শুধু কিছু বলা যায়৷ আর এই পত্নীর উদ্দেশেই লেখা দীর্ঘ একটি কবিতা৷ কবির পত্নীবিয়োগ হয় যখন, তখন তিনি মাত্র ৪১ বৎসরের৷ স্ত্রীও মাত্র ঊনত্রিশ বৎসর বয়সে গতাসু হন৷ কবির ‘নিমন্ত্রণের চিঠি’ কবিতাটি শেষ হয় এইভাবে৷ আকাশে চু লের গন্ধটি দিও পাতি এনো সচকিত কাঁকনের রিনিঠিন আনিও মদির স্বপ্নমধুর রাতি আনিও গভীর আলস্যঘন দিন তোমাতে আমাতে নিবিড় মিলিত একা– স্থির আনন্দ মৌন মাধুরীধারা মুগ্ধ প্রহর ভরিয়া তোমারে দেখা তব করতল মোর করতলে হারা৷ মৎস্যাশী মার্জার যেমন সর্বত্র মৎস্যগন্ধ সন্ধান করে সেইরকম কিছু অধিক অনুসন্ধানী তথাকথিত গবেষক আছেন৷ তাঁরা সর্বত্র রবিঅনুরাগিণীদের খোঁজে ফেরেন৷ যে অন্তর এমনভাবে স্মৃতির প্রিয়জন সত্তাকে জাগরুক রাখে, তাকে বুঝতে হলে একটু ভাবতে হয়৷ রবীন্দ্রনাথ সর্বত্রই ভাস্বর এবং উজ্জ্বল চেতনায় সমৃদ্ধ৷ তাঁর বিরহব্রতও তেমনই স্নিগ্ধ ও ভাবসমৃদ্ধ এ-বিষয়ে সংশয় জাগে না৷ এছাড়া কবি যে অন্যরকম হতে পারতেন তা আমাদের মনে আসে না৷ অথচ আজ গবেষণার নামে রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে কাদম্বরী দেবী এবং ১৯২৪-এ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে যেরকম ভাবে কবির নিজস্ব চিত্তগহনের আলোকে ম্লান ছায়াতে ভরে তোলা হয়েছে তার মধ্যে আর যাই থাকু ক সত্য বা সততা নেই৷ সততার নামে যা আছে তা হয়েছে কু ৎসা ও অপপ্রচার৷ যাঁরা কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে তাঁর সস্নেহ গভীর সম্পর্কটু কু কে প্রেম বা রোমান্স বলে মনে করেন তাঁদের ‘নষ্টনীড়’ গল্পটি আর একবার পড়ার জন্য বলি৷ কবি সম্পূর্ণ নিরাসক্তি সহ চারু ও অমলের সম্পর্কটিকে দেখেছেন ও বর্ণনা করেছেন৷ এখানেই তিনি একদিক দিয়ে নিজেকে মুক্ত করেছেন বলে আমরা মনে করতে পারি৷ এমনিতে দুটি এই প্রায় সমবয়সি মানুষের দেবর ও ভ্রাতৃ জায়ার মধ্যে একটি অতি নিবিড় মধুর সম্পর্ক ছিল৷ সেটা রোমান্স নাও হতে পারে এ বোধটাও যে অনেকের নেই৷ কোনো কোনো গবেষক (?) প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথের প্রেমে বঞ্চিত হবার ফলে রবীন্দ্রনাথের বিবাহোত্তর কালে এই ভ্রাতৃ জায়া আত্মহত্যা করেন৷ রবীন্দ্রনাথের বিবাহের মাত্র কয় মাস পরেই এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে রটনাটাও মুখরোচক

হয়েছিল৷ আমরা ভেবে দেখি না যে কাদম্বরী দেবীর মতো তেজস্বিনী নারীর শিল্পবোধও ছিল জাগ্রত৷ তাঁর স্বামী এবং রবীন্দ্রনাথের নতু ন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ থিয়েটারের সমঝদার ছিলেন এবং থিয়েটারের অভিনেত্রীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও ছিল বলে জানা যায়৷ সুতরাং বিস্ময়ের কারণ নাই যদি কাদম্বরী স্বামীর ব্যবহারের মধ্যে কোনো আঘাত পেয়ে থাকেন এবং সেই কারণে নিজেকে স্বামীর অবাঞ্ছিত জেনে প্রাণত্যাগ করেন–এটা বেশি স্বাভাবিক মনে হয়৷ রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই এই সমবয়সি আত্মীয়া ও বান্ধবীর মৃত্যুতে খুব বিচলিত হয়েছিলেন৷ সে কথা তিনি নিজ-লেখাতেও গোপন করেননি৷ ছেলেবেলা গ্রন্থে তা বিধৃত আছে এই বলে যে কৈশোরে মাকে হারানোর শোক তাঁকে আঘাত করেছিল ঠিকই কিন্তু প্রকৃ ত শোক তিনি অনুভব করলেন কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু নিয়ে৷ তাঁর কবি মন এ শোককে দীর্ঘকাল অন্তরে লালন করেছে বলাই ভালো৷ তবে তিনিও বলতে পেরেছিলেন–‘বলো শান্তি বলো শান্তি দেহ সাথে সব ক্লান্তি পুড়ে হোক ছাই৷’ বহুকাল পরে এলাহাবাদে আত্মীয় গৃহে নতু ন বউঠানের চিত্র দেখে তিনিই বলেন ‘তু মি কী কেবলি ছবি শুধু পটে লিখা৷’ তিনি জানেন শোক আসে চলেও যায়৷ যা ছিল শোক তা ক্রমে শান্তিতে পরিণত হয়৷ অন্তত রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেই তাই হয়েছে৷ ছিন্নপত্র-এ তিনি সেই কথাই বলেছেন৷ তাঁর প্রথম জীবনের শোক ক্রমশ শান্তিতে পরিণত হয়েছে৷ এবং বিস্মিত হতে হয় যখন তিনি লেখেন যে তিনিও আর সেই প্রথমতম শোককে চিনতে পারেন না৷ এই যে স্বাভাবিক জীবনবোধ এর থেকে কবি কখনও বিচ্যুত হননি বলে আমরা মনে করি৷ এরজন্য কবিকে আমরা শুধুমাত্র রোমান্টিক বলে মনে করি না৷ তাঁর কবিত্ব ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে এক সেতু বন্ধন ছিল সেটা হলো তাঁর জীবনবোধ বা জীবনায়ন৷ রবিজীবনে বাস্তবিক উত্তরায়ণ দক্ষিণায়নের মতো সতত একটা গতি বিদ্যমান৷ রবির আলোতে পরিক্রমা আছে–দক্ষিণায়ন ও উত্তরায়ণের পথে বিবর্তন আছে৷ কিন্তু এ পথ পরিক্রমা সর্বদা নূতন, কোথাও তা পুরাতনের বিজৃম্ভণ মাত্র হতে পারেনি৷ রবীন্দ্রনাথ জন্মেই রবীন্দ্রনাথ হননি৷ তাঁকে অসামান্য প্রয়াসে এবং অপরিসীম বাস্তববোধ সহ প্রতিক্ষণে শিল্পীসচেতন একটা মাত্রাবোধ রাখার অভ্যাস করতে হয়েছে৷ এইখানে তাঁর সঙ্গে তাঁর সমসাময়িক বহু গুণীজ্ঞানী ব্যক্তির ভিন্নতা ধরা পড়ে৷ ধরা পড়ে তাঁর স্বগৃহে মহান পিতৃ দেবতা এবং অসামান্য কৃ তী ভ্রাতৃ গণের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য৷ অথচ তিনি তো এইসব মানুষের ছায়ায় ও স্নেহে পরিবর্ধিত৷ তৎসত্বেও তিনি নিজেই এক মহীরূহ হয়ে উঠেছেন৷ বহুজন হিতায় চ বহুজন সুখায় চ তিনি কোনো সম্প্রদায় সৃষ্টি করেননি৷ অথচ তাঁকে ঘিরে এক জ্যোতির্বলয় গড়ে উঠেছে৷ তার মধ্যে সমবেত হয়েছে বহু জ্ঞানীগুণী স্ব-স্ব প্রতিভার প্রতিশ্রুতিসহ৷ ঠা

বস্তুত প্রতিভা নিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ যদি করে তাহলেও তার মানুষ হয়ে ওঠার ব্যাপারটা সহজাত প্রতিভা দ্বারা মাত্র সম্পন্ন হয় না৷ বরঞ্চ সেটা উপরি পাওনা৷ আসল হলো কঠিন পরিশ্রম সাপেক্ষতা যাকে আমরা application বলি৷ এটা ঠিক যে রবীন্দ্রনাথ নিজ স্বপ্রবৃত্তি নিয়ে জন্মেছিলেন৷ তাছাড়া তাঁর বাতাবরণও তাঁর অনুকূ ল ছিল৷ বিধাতার মতো পিতার নির্দেশে তাঁর অন্য ভ্রাতাদের মতো তিনিও পরিচালিত হয়েছেন৷ মাতৃ হীন এই কিশোর প্রায় এক নিঃসঙ্গতার মধ্যে দিয়ে নিজেকে গড়ে তু লেছেন৷ কাব্যশক্তি তাঁকে মুক্তি দিয়েছে৷ কৈশোরে সঙ্গী হিসাবে তিনি পেয়েছেন তাঁর নতু ন বউঠানকে৷ বিবাহ হয়েছে ২২ বৎসর বয়সে এবং বালিকা বধূর অনেকাংশ পরিণতিসাপেক্ষ হবার দায়িত্ব পড়ে তাঁরই উপরে৷ আশৈশব তাঁদের গৃহে কতকগুলি বিশিষ্ট নিয়ম-পদ্ধতির মধ্য দিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন৷ সেই পরিবেশে গান শেখা ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞান প্রভৃ তির পাঠ নেওয়া তাঁদের আবশ্যিক ব্যাপার ছিল৷ স্কু লে তিনি যাননি বা যেতে চাননি ঠিকই৷ কিন্তু গৃহে গৃহস্বামীর বলবৎ নির্দেশ মেনে তিনি নিজেই সুদীক্ষিত, সুশিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন বলে আমরা মনে করতে পারি৷ এর মধ্যে তাঁর কবিত্বশক্তির স্ফু রণ দেখা দেয়৷ জল পড়ে পাতা নড়ে থেকে বৈষ্ণব কবিতার রসাস্বাদনও সম্ভব হয়৷ রবীন্দ্রনাথের যে পরিবেশে জন্ম হয়, সে পরিবেশ তৎকাল-পরিপ্রেক্ষিতে গড়পড়তা যে পারিবারিক জীবন তা থেকে ভিন্ন ছিল৷ পিতা নিজেই ছিলেন আদি ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগী সভ্য৷ রামমোহনের ভাবশিষ্যই তাঁকে বলা যায়৷ তাঁর মধ্যে বৈষ্ণব ভক্তিবাদ ও সুফি ভাবনার সঙ্গে ঔপনিষদীয় একপ্রকার একেশ্বরবাদ গৃহীত হয়ে সজীব হয়ে উঠেছিল৷ তার সাথে যুক্ত হয় সুফি কবি বিশেষ হাফেজের কবিতার অনুশীলন৷ নিজে তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থ হিসাবে সাংসারিক সকল দায়িত্ব সুষ্ঠু ভাবে গ্রহণ ও পালন করতেন৷ তাঁর সকল কাজ একরকম ছকে বাঁধা না হলে তাঁর স্বস্তি হতো না৷ বিবাহাদি কার্যে তিনি উপস্থিত না থাকলেও তাঁর কাছে এমনভাবে পরিকল্পনা করে নিতে হতো যে নিপুণ সেনাপতির মতো তিনি যথাযথ নির্দেশ দিতে পারতেন৷ তাঁর জ্যেষ্ঠ চার পুত্রের অসাধারণ মেধা ও বিকাশ তাঁর অজানা ছিল না৷ দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রত্যেকেই কৃ তী৷ চতু র্থজনা বীরেন্দ্রনাথ ঠাকু র৷ তিনি বলেন্দ্রনাথ ঠাকু রের পিতা এবং প্রফু ল্লময়ী দেবীর স্বামী৷ প্রফু ল্লময়ী ও নীপময়ী দেবী দুই ভগিনী ছিলেন৷ নীপময়ীর সন্তানেরা, যেমন প্রতিভাদেবী সংগীতজগতে একটি বিশিষ্ট নাম৷ প্রফু ল্লময়ী দেবী পরে সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করেন৷ বীরেন্দ্রনাথ অসামান্য গণিতবিদ ছিলেন৷ পরে মস্তিষ্ক আর স্বাভাবিক কাজ করত না৷ দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রতিভাবান পুরুষ ছিলেন৷ তিনি একভাবে বাংলা টাইপরাইটার যন্ত্রের নির্দেশ প্রথম দেন৷ হেমেন্দ্রনাথ স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে অবহিত ছিলেন এবং ঠাকু রবাড়ির মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা তিনি করতেন৷ সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম যুগের আই সি এস হিসাবে পত্নী জ্ঞানদানন্দিনীকেও শিক্ষিতা করে তোলেন ও পুত্র কন্যাদ্বয়কে মাতাসহ ইংলন্ডে রেখে দেন৷ ঠা

এই ঠাকু রবাড়ির মহিলারাই পারসিক স্টাইলে শাড়ি ও অঙ্গাবরণ ব্লাউস প্রভৃ তি পরিধান শুধু নিজেরাই করেননি ভদ্ররুচির বাঙালি মহিলাদেরও সে বিষয়ে অবহিত করেছেন৷ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী অশ্বারোহণে প্রাতভ্রমণেও যেতেন জানা যায়৷ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সংগীত পারদর্শিতা ছিল৷ তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতবিদ ও অভিনয়কলা বিশারদ ছিলেন৷ তাঁর পত্নী অল্প বয়স থেকে বালক রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি থেকে স্নেহযত্নে এই মানুষটিকে একটা আশ্রয় দেন৷ তিনি সাহিত্য বুঝতেন এবং কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর অনুরাগী পাঠক ছিলেন৷ ভাতৃ জায়া ও দেবরের সম্পর্কটি অতি গভীর ও ঘনিষ্ঠ ছিল বলা যেতে পারে৷ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ একদিক দিয়ে আর্থসামাজিক জীবনে অগ্রগামী ছিলেন৷ কিন্তু অন্যদিকে তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থ হিসাবে জীবনের সকল নিয়ম এবং সামাজিক-সাংসারিক সকল দায়িত্ব পালন ও জমিদারি চালনার মতো কাজও নিপুণভাবে করতেন৷ তাঁর প্রতি পুত্রকেই জমিদারির কাজ করতে হয়েছে৷ তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সর্বাধিক সময় দিয়ে এ কাজ করেছেন৷ এই কাজের মধ্য দিয়ে তিনি গ্রামীণ মানুষকে কাছে পেয়েছেন৷ তাদের সুখদুঃখ বুঝেছেন৷ অনেক সময় পিতার অপ্রীতিও তাঁকে মানতে হয়েছে৷ এই গ্রামীণ জীবনে থেকেই রবীন্দ্রনাথ নিজ সংসারটি গঠন করেছেন৷ সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য নানা উদ্ভাবনা করেছেন৷ শিক্ষক নির্বাচন করেছেন৷ আর সে কাজ ছাড়াও পল্লি উন্নয়ন, গ্রামীণ ব্যাংক কৃ ষিঋণ ও সমবায় নিয়ে হাতে-কলমে ভাবনা ও কাজ করেছেন৷ আজকের দিনের কমিউনিটি প্রোজেক্ট-এর স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথকে বলা যেতে পারে৷ বান্দুং সম্মেলনের বহু পূর্বকালে রবীন্দ্রনাথ ভারতবাসী সহ পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য নানা দেশ পরিক্রমা করেছেন৷ বস্তুত, স্বামী বিবেকানন্দ ও তার পরে মহাত্মা গান্ধি ব্যতীত এরকম সর্বজনগ্রাহ্য মানুষ দেখা যায় না৷ স্বামী বিবেকানন্দ ও গান্ধিজি দুজনাই কতকটা একদর্শী মনোভাবনায় যুক্ত ছিলেন বলে তাঁদের মতবাদ সর্বত্র গৃহীত হতে পারেনি৷ অপরদিকে শিক্ষিত মানস সহজেই আধুনিক মানুষ হিসাবে মানবিকতা সমৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছিল৷ রবীন্দ্রনাথই করতে পেরেছিলেন আধুনিকতা ও মানবিকতার ঘোষণা৷ সকল দেশের ও সকল মানুষের অগ্রগতি ও মুক্তির সঙ্গে জড়িত আছে ভারতের ও ভারতীয়দের সর্বাঙ্গীন পরিপূর্ণতা–একথা তিনি বলেছিলেন৷ এ ক্রিয়া সম্ভব হয়–সতত সম্প্রসারণশীল চেতনা দ্বারা এবং বহুলোকের সঙ্গে একত্র হওয়ার অনুশীলন-পর্যবেক্ষণ দ্বারা৷ কবি তা করেছিলেন শেষ জীবন পর্যন্ত৷ আর, সে কাজের শুরু হয় প্রথমবার ইয়োরোপ যাবার কাল থেকে৷ মানুষ তাঁর কাছে একটা বড়ো রহস্য৷ মানুষকে তিনি নানাভাবে দেখেছেন ও জেনেছেন৷ ততই তাঁর চিত্ত হয়েছে সম্প্রসারিত৷ মানুষের দান গ্রহণ, মানুষকে ভালোবাসা, এসব কাজ তাঁর পক্ষে একটা অবশ্য কর্তব্য ছিল৷ গৃহের সীমা থেকে বহির্বিশ্বে তিনি ঠা

সহজে পরিক্রমা করতে পেরেছিলেন৷ এই যে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠা, এটার একটা চলমান ইতিহাস আছে৷ কবির জীবনে ব্রহ্মনিষ্ঠ পিতার সাহচর্য একটা অবলম্বন ছিল৷ তাঁর বহু লেখাতে তাই ঈশ্বরও পিতৃ কল্প এবং তাঁর বহু রচনায় এই পিতৃ প্রতিমা কবির জীবনকে সর্বদাই আত্মোত্তরণে সহায়তা করেছে৷ একদিকে বিরাট হিমালয়, অন্যদিকে এই পিতৃ সত্তা–দুই-এ মিলে তাঁর মধ্যকার ভাবগম্ভীর চিত্তভূ মির নির্মাণ হয়েছে৷ মহর্ষি নিজেও গান করতেন ও গান বুঝতেন৷ গুরুদ্বারের ভজনের মধ্যে তিনি গানে যোগ দিতেন৷ রবীন্দ্রনাথের গানও তিনি শুনতেন৷ কবির রচনার ও গানের আগ্রহী শ্রোতা হিসাবে তিনি তরুণ কবিকে পুরস্কারও দিয়েছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথ কোনো দিনই অর্থ সাচ্ছল্যের মধ্যে মানুষ হননি বা তা চাননি৷ তবে প্রয়োজনমতো অর্থ তিনি পারিবারিক সদস্য হিসাবেই পেতেন৷ মহর্ষির ব্যবস্থানুসারে তাঁর দুইটি কন্যার বিবাহের ব্যয়ভার এস্টেট থেকে দেওয়া হয়৷ দুটি বিবাহের কোনোটাই সুখের হয়নি৷ এরই মধ্যে তিনি ১৯১৩ সালে সুইডেন থেকে নোবেল প্রাইজ পান৷ সে টাকা দেন বিশ্বভারতীর উন্নয়ন কাজের জন্যে৷ ১৯০২ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয়৷ কবিপত্নী দীর্ঘকাল পীড়িত থেকে অবশেষে মৃত্যুমুখে পতিত হন৷ রবীন্দ্রনাথ পাখা হাতে রুগণ স্ত্রীকে বাতাস করে ঘুম পাড়ানোর প্রয়াস করতেন৷ পাঁচটি শিশুসহ এই রোগজীর্ণা মাকে রবীন্দ্রনাথই দেখতেন৷ আমরা অনুভব করতে পারি কবি কোথাও গজদন্তমিনারবাসী কবি নন৷ তিনি সতত মানুষের দুঃখসুখ নিজ দুঃখসুখ সহ মিলিয়ে নিয়ে চলতেন৷ তাঁর পত্নীকে লেখা চিঠিগুলিতে ছোটো বউকে তিনি ভাই ছুটি সম্বোধন করেছেন৷ তাদের উভয়ের স্নিগ্ধোজ্জ্বল চিত্র আমাদের আনন্দ দেয়৷ গোড়ায় গলদ গ্রন্থের চন্দরের উক্তি এখানে স্মরণীয়৷ চন্দরের পত্নী জানাচ্ছেন তিনি না থাকলেও তো স্বামীর জন্য রান্না করে পাঠিয়েছেন নিয়মিত ভাবেই৷ তাতে স্বামী বলছেন–বড়বৌ যে বৎসর তোমার সঙ্গে আমার বিবাহ হয় সে বৎসর কি কলকাতা শহরে রাঁধুনী বামুনের মড়ক হয়েছিল? কবিকে নিজের দাম্পত্য জীবনে শান্ত ও সহিষ্ণু পাওয়া যাবে মনে হয়৷ কবিপত্নী কিন্তু এই যশস্বী স্বামীকে বেশি দেখার সুযোগ পাবার আগেই ১৯০২ সালে মৃত্যুমুখে পতিত হন৷ কবিকে তাঁর সকল কাজে গৃহে ও গ্রামে এবং শান্তিনিকেতনে তিনিই অবলম্বন দিতেন৷ গহনা দিয়েছিলেন খরচ চালাবার জন্য৷ প্রথম যুগের ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের বালকদের ভরণপোষণ চালাতেন কবি এবং সে কাজগুলো করতে হতো কবিপত্নীকেই৷ নিজের অসুস্থ শরীর নিয়ে দুই কন্যার বিবাহ দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন মৃত্যুর আগে৷ কিন্তু তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই প্রথম গতাসু হন মধ্যমা কন্যা রেণুকা ও তারপর জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা৷ বিহারীলাল চক্রবর্তীর পুত্র শরৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে এ বিবাহ খুব সুখশান্তির হয়নি৷ দুইটি কন্যাই যক্ষ্মাগ্রস্ত হয়ে মারা যান৷ দ্বিতীয় জামাতাকে তিনি খরচ দিয়ে বিদেশে ঠা

ট্রেনিং নিতে পাঠান৷ সে জামাতা যথারীতি শান্তিনিকেতনে কাজ করেননি৷ তৃ তীয় জামাতা সহ কনিষ্ঠা কন্যার মিলিত জীবন সুখের হয়নি৷ সেই উত্তাপ কবিকেও স্পর্শ করত৷ কয়েক বৎসরের মধ্যে কনিষ্ঠপুত্র শমীন্দ্রনাথও মারা যান৷ বেড়াতে গিয়ে সেখানে কলেরা হয়ে শমীর মৃত্যু হয়েছিল৷ কবির লেখা ‘শেষ প্রতিষ্ঠা’ কবিতাটি এখানে উল্লেখনীয় মনে হয়৷ শমীর চলে যাবার শোককে তিনি বিশ্বের মধ্যে যেন মিলিয়ে দেখতে চেয়েছেন–বলেছেন, শেষ প্রতিষ্ঠা এই কথা সদা শুনি, ‘গেছে চলে’, ‘গেছে চলে’৷ তবু রাখি ব’লে বোলো না, ‘সে নাই’৷ সে কথাটা মিথ্যা, তাই কিছুতেই সহে না যে, মর্মে গিয়ে বাজে৷

মানুষের কাছে যাওয়া-আসা ভাগ হয়ে আছে৷ তাই তার ভাষা বহে শুধু আধখানা আশা৷ আমি চাই সেইখানে মিলাইতে প্রাণ যে সমুদ্রে ‘আছে’ ‘নাই’ পূর্ণ হয়ে রয়েছে সমান৷

রবীন্দ্রনাথকে যেন সমস্তক্ষণ জীবনের প্রস্তুতি নিতেই হয়েছে৷ ঘরে বা বাইরে সর্বত্রই তাঁকে সদাজাগ্রত থাকতে হয়েছে৷ যে কারণেই হোক এই কবিকে ভারতবর্ষের বেশি লোক ভালো চিনতেন না৷ অপরদিকে বঙ্গভূ মিতে শিক্ষিত সজ্জনগণ রবীন্দ্র-কবিতা এবং রবীন্দ্রনাথের চেহারা নিয়ে ব্যঙ্গ রসিকতা করতেন৷ তাই তাঁর সুইডেন থেকে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির কথাটা এদেশীয় মানুষকে শ্লাঘার বিষয় বলে আগ্রহী করেনি৷ বরঞ্চ অবহেলা যাকে করা চলে তার এই অভ্যুদয় মেনে নেওয়া সহজ হয়নি৷ লেখক মাত্রই নিজলেখাকে এভাবে ব্যঙ্গ বিদ্রুপের চোখে দেখাটাকে ভালো মনে নিতে পারেন না৷ কবিও তা পারেননি৷ তাই যখন তাঁকে সম্মান না জানানোর জন্য সুরেশ সমাজপতি প্রমুখ নেতাগণ ও কিছু সাহিত্যিক শান্তিনিকেতনে যান, তখন তিনি একটি গান রচনা করে গেয়েছিলেন৷ গানটি সময়োচিত শুধু নয় এটি ছিল তাঁর প্রত্যুত্তরও–পূর্বকৃ ত অবহেলার এবং পরবর্তী কালের সমাদরের৷ তাঁর সেই বিখ্যাত সংগীত হলো ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’৷ ব্যাপারটা সত্যই

লজ্জাকর ছিল যে, কবির প্রতিভাকে এদেশের লোক স্বীকার করেনি, তাঁর সেই নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির পরই তাঁর কদর হলো৷ সদুঃখে বলা যায় এরূপ মনোভাব রবীন্দ্রনাথের কাল থেকে এখনও বর্তমান৷ শ্বেতদ্বীপী মানুষকে দেখলে আমাদের হীনম্মন্যতা জাগে৷ এটা কিন্তু সদ্য জাগ্রত আফ্রিকায় নেই৷ রবীন্দ্রনাথের এই মনোভাব ছিল না৷ মানুষকে তিনি মানুষ হিসাবে দেখতেন–সাদা বা কালো মানুষ হিসাবে তারতম্য হতো না তাঁর ব্যবহারে৷ নোবেল প্রাইজ পাবার পরেই রবীন্দ্রনাথ তার Sir উপাধি বা knighthood পরিত্যাগ করেন৷ তিনি সতত সময়ের অনুকূ লে আস্থা রেখে চলতেন৷ কোথাও সেজন্য তাঁর বাধা হতো না৷ বালক কবির কবিতা হিন্দুমেলায় পঠিত হয়৷ তখন থেকে তিনি এগিয়ে এলেন ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ করার পরিকল্পনায়৷ রাখিবন্ধন করা হলো– সাধারণ্যের মধ্যে কবিও নেমে গেলেন৷ সময়োচিত রচনার মাধ্যমে দেখা যাবে কবি তাঁর স্থান কাল পাত্রোপযোগী ভাবনা দ্বারা কত প্রভাবিত হতেন এবং কখনো উচিত যা বুঝতেন তা থেকে বিচ্যুত হতেন না৷ শান্তিনিকেতনের স্থায়ী বিদ্যালয়ে প্রথম পর্বে ইংরাজ রাজপুরুষেরা একটা ধারণা করেছিলেন যে, শান্তিনিকেতন আসলে দুষ্ট দুঃশীল এবং অবশ্যই ইংরাজবিরোধী মনোভাবের একটা কেন্দ্রীভূ ত সংস্থা৷ শুধু ব্রিটিশ মনোভাবই নয়– এরূপ একপ্রকার মনোভাব সাধারণ লোকে এবং সেই সময়কার সমস্ত মানুষের মনেও ছিল বলে মনে করা যেতে পারে৷ এটা যেন একপ্রকার দুষ্ট দুঃশীল ছেলেদের জন্য Juvenlie কোনো সংস্থার মতো৷ ব্যাপারটা তাৎপর্যপূর্ণ নিশ্চয়ই৷ কবি ইতোমধ্যে কালীমোহন ঘোষ প্রমুখ কিছু শিক্ষিত বিপ্লবী মনোভাব যুক্ত মানুষকে এনে শান্তিনিকেতনে স্থিত করেছেন৷ তাঁদের কর্মসংস্থানও করে দিয়েছেন৷ কালীমোহন ঘোষকে শিক্ষা-সংক্রান্ত ট্রেনিং নেওয়ার জন্য বিদেশেও পাঠানো হয়৷ দুষ্ট ও চঞ্চল বালক হিসাবে সৈয়দ মুজতবা আলী ও ভান্ডারে নামে এক মহারাষ্ট্রীয় তরুণও আশ্রমবাসী হয়৷ কবি সজ্ঞানে এ শিক্ষাসত্রকে Reformatory ভাবেননি৷ যে-কোনো হিংসাত্মক কাণ্ড বা চিন্তা তাঁকে ক্লেশ দিত৷ হিংসার নানা রূপও আছে৷ কবি এ হিংসার বক্রগতিকে তাঁর লেখার শুরু হওয়া থেকে প্রায় শেষ অবধি অনুভব করেছেন৷ তাঁর কলমের দ্বারা তিনি যা প্রতিবাদ করেছেন তা সতত সাধারণ্যে বোধগম্য হয়নি৷ কিন্তু কবি মনীষী হিসাবে তিনি সত্যই সময়োচিত কর্তব্যে কখনো অবহেলা করেননি৷ সেটা হিন্দুমেলা হোক, রাখিবন্ধন হোক, বঙ্গভঙ্গ রদের কবিতা হোক, এগুলি সহ শেষাবধি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত কবির অন্তরে যে হিংসাকে স্বীকৃ তি দিয়ে অতিক্রম করে স্পৃহা ও সাধনা ছিল তা বুঝতে পারা যায়৷ ‘আফ্রিকা’ কবিতাটির বিশেষ তাৎপর্য আছে৷ কবি না লিখে পারেননি দানব পক্ষীদের কথা৷ ফিনল্যান্ড আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর প্রকৃ ত প্রতিবাদমূলক মনোভাব ছিল৷ ১৯৩০-এ ঠি

সোভিয়েত ভ্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর রাশিয়ার চিঠি ও শেষ পর্যায়ের রচনাতে সভ্যতার সঙ্কট-এ দুইটি রচনা রবীন্দ্ররচনার ক্ষেত্রে দুটি স্তম্ভের মতো বিদ্যমান৷ বিশ্বশান্তির ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ রমাঁ রলাঁ ও বারবুসের সহযোগী৷ প্রায় অবসন্ন বৃদ্ধাবস্থাতেও তাঁর জাগ্রত মন নিয়ে তিনি প্রতিবাদ করেন Miss Rathbone-এর পত্রের৷ য়োনে নোগুচিকে লেখা পত্রে জাপানের দ্বারা চীন আক্রমণের বিরোধিতা সূত্রে তিনি যা বলেন তা বিশ্বশান্তির পথে প্রগতিসূচক বলেই গৃহীত হবে৷ একাজ তিনি নূতন করেননি৷ পূর্বেও বুয়র যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা কবিতায় তিনি এ মনোভাব ব্যক্ত করেছেন৷ সর্বত্র তাঁর হাতিয়ার হলো লেখনী৷ চীনের ইতিহাসে ব্রিটিশ-বিরোধী আফিমের ব্যবসার বিরুদ্ধে তিনিই তৎকাল-পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছিলেন৷ এগুলি একটি মালা গাঁথার মতো পাওয়া যায় এবং বিশ্বশান্তির পরিপ্রেক্ষিতে এক পরাধীন দেশের কবির মহৎ প্রয়াস হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে৷ কবির জন্ম ১৮৬১ তে৷ মৃত্যু ১৯৪১-এ৷ একই দশকে জন্মগ্রহণ করেন স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩) এবং মহাত্মা গান্ধি (১৮৬৯)৷ এই তিনজনই ভারতীয় জীবনের তাৎপর্যপূর্ণ বহু ঘটনার সাক্ষীও থেকেছেন৷ প্রথম দুইজনার রচনার মধ্যে জানা যায় যে শত শত ব্রিটিশবিরোধী যুবক বিশেষ করে শিক্ষিত বঙ্গসন্তান একদিকে রবীন্দ্রনাথ-এর কবিতা ও স্বামী বিবেকানন্দের রচনাতে প্রবুদ্ধ ও জাগ্রত হয়েছে৷ শ্রদ্ধেয় গোপাল হালদারের ভাষায়–বিবেকানন্দকে যেন আগুন বলে বলা হয়েছে৷ কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত সহ তাঁরা জেনেছেন যে তাদের জীবন যেন মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত৷ ফাঁসির মঞ্চে তাঁরা গেছেন অকু তোভয়ে কণ্ঠে নিয়ে রবীন্দ্রসংগীত৷ অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই বিপ্লবী পন্থার অনুমোদন যে করতেন না সেটাও বোঝা যায় তাঁর চার অধ্যায়, বাঁশরী এবং অবশ্যই ঘরে বাইরে উপন্যাস পড়লে৷ ঘরে বাইরে গ্রন্থটিও এরূপ বিপ্লবাত্মক মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে যেরূপ আর্থ-সামাজিক অবস্থা ব্যবস্থার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী সে কথাও বিধৃত হয়ে আছে৷ বিমলা নিখিলেশের যে অন্তর্নিহিত ট্রাজেডি তা একপ্রকার অবশ্যম্ভাবী ছিল৷ কবি এ গ্রন্থেও নষ্টনীড়-এর মতো সযত্নে একটা গার্হস্থ্য সমস্যাকে তৎকালীন সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখেছেন৷ চার অধ্যায় ও বাঁশরী-তে তথাকথিত বিপ্লবাত্মক মনোভাবনার পোষক ও ধারক বৃহৎ মাপের কিছু মানুষের কথাও আছে৷ চার অধ্যায়-এর নায়ক অথবা বাঁশরী-র সন্ন্যাসী এই জাতীয় চরিত্র৷ কবি নিপুণভাবে এসব চরিত্রের ব্যর্থতা অঙ্কিত করেছেন৷ তাঁর লেখার মধ্যে একটিই ভাষা প্রকটিত হয়েছে যে এভাবে স্বাধীনতা আসে না৷ তেমনই তিনি বুঝেছিলেন ও বোঝাতে চেয়েছিলেন যে কোনো গরিব দেশের পক্ষে–অন্নবস্ত্রের প্রতিকূ ল সমস্যা যেখানে প্রবল, সেইখানে বাহুল্য করে সস্তায় লভ্য বিদেশি কাপড় শুধুমাত্র বিদেশি বলে জ্বালিয়ে দিয়ে স্থায়ী লাভ হতে পারে না৷ কারণ, প্রয়োজন ও আর্থিক অনটন বেশি

থাকায় মানুষ বস্ত্র পোড়ানোর মতো কাজে সায় দিতে পারে না বা পারেনি৷ পারেননি স্বয়ং কবিও৷ আর ওই সময়কার বিপ্লবী কর্মী নেতাদের মধ্যে যে স্বধর্মচ্যুতি দেখা দিয়েছিল– সন্দীপ চার অধ্যায়-এর অন্তরালস্থিত নেতা বাঁশরী-র সন্ন্যাসী এঁরা আমাদের তৎকাল পরিপ্রেক্ষিতে খুব অপরিচিত নন৷ এই অবস্থা ব্যবস্থার মধ্যে শ্রীঅরবিন্দ ধর্মগুরু হয়ে ওঠেন৷ তাঁর নিকট সহযোগী নিবেদিতার মঠ মিশন থেকে নির্বাসন হয়৷ অবশ্য স্বামী বিবেকানন্দই সে ব্যবস্থার উদ্যোগ নেন৷ অপরাপর বিপ্লবী নায়কদের মধ্যে আছেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতু ষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ এবং অপরাপর ভ্রাতু ষ্পুত্রগণ যেমন গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথও৷ এঁদের বিপ্লবী মনোভাব ব্যক্ত হয় তাঁদের শিক্ষা ও জীবনসাধনায়৷ সুরেন্দ্রনাথ ঠাকু র-কৃ ত বিশ্বমানবের লক্ষ্মীলাভ গ্রন্থ একটি দিগদর্শনকারী গ্রন্থ বলা যেতে পারে এদেশে৷ এঁদের সহযোগী হিসাবে আমরা পাই ভগিনী নিবেদিতাকে৷ তাঁর গৃহ ও কর্মপদ্ধতি ছিল বিপ্লব সাধনার ক্ষেত্রও৷ এই সর্বাত্মক ও ব্যাপক বিপ্লবী অভিযানের একটা সার্থক আধ্যাত্মিক দিক ছিল৷ তার স্থায়ী ফলই কবির অন্বিষ্ট ছিল৷ তিনি জানতেন ও বুঝেছিলেন হিংসা দিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব, সৃষ্টি করা অসম্ভব৷ ওই যুগের কয়েকজন চিহ্নিত বিপ্লবকর্মীও কবির কাছাকাছি এসেছিলেন এবং শান্তিনিকেতনেও ছিলেন৷ দুটি নাম এখানে স্মরণীয়–একটি হলো সামশ্রমীর অন্যটি ব্রহ্মবন্ধু উপাধ্যায়৷ ইনি অন্তর্জীবনেও বিপ্লবী ছিলেন৷ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং পরে আবারও হিন্দুত্বে ফিরে এসেছিলেন৷ স্বয়ং নিবেদিতাও বিপ্লবী মনোভাব সহ জগদীশ বসুকে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে অভিষিক্ত দেখতে উদ্যোগী হয়েছিলেন–সেটা তিনি করেছিলেন ভারতের স্বাধীন সত্তার উপযোগিতা হিসাবে৷ অনেক সময় এই নিবেদিতা চরিত্র রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থে কোনো-নাকোনো ভাবে এসেছে৷ একদিকে বিশ্বমাতৃ কারূপিণী আছেন গোরা-য় আনন্দময়ী চরিত্র এবং অপরদিকে তাঁর পূজারি হিসাবে স্বয়ং গোরা৷ এ গোরা সত্যই গোরা৷ এক সৈনিকের সন্তান হিসাবে আনন্দময়ী নানা সাংসারিক বাধা সত্বেও তাকে কী করে লালন-পালন করেন সে বড়ো আশ্চর্য ব্যাপার৷ তবে স্বগৃহে তিনি থাকতেন কোনো অচ্ছু তের মতোই৷ গোরাকে ভালোবেসে তিনি একপ্রকার আত্মিক মুক্তিলাভ করেন৷ সুচরিতা সহ গোরার মিলন অনিবার্য হয়ে ওঠে একপ্রকার আধ্যাত্মিক সম্ভাবনা সহ৷ আনন্দময়ী সেটাও উপলব্ধি করেন৷ আমাদের মনে রাখা দরকার যে কবি এ-সকল রচনার মধ্য দিয়েই তাঁর দেশমাতৃ কার পূজারাধনা পূর্ণতর তপস্যার মতো করে তু লেছেন৷ হিন্দুমেলার সময় থেকে আরম্ভ করে কবি দীর্ঘ সত্তর বর্ষ ধরে নানাভাবে দেশভারতী ও বিশ্বভারতীর সেবায় নিজে ব্যাপৃত থেকেছেন৷ তাঁর কোনো কাজই তাই অসংলগ্ন নয়৷ প্রতিটি কাজকর্ম একটা বৃহৎ কর্মযজ্ঞ দ্বারা উদ্বোধিত৷

বিশ্বভারতী বিদ্যাকেন্দ্র তাঁর বিশ্ববাসীকে দেওয়া উপহার ও আহ্বান৷ বস্তুত এ আহ্বান খুব সফলতা প্রাপ্ত হতে পারেনি৷ কেন যে পারেনি তার কারণ বলা শক্ত৷ রবীন্দ্রনাথ তো একক শক্তি সহ এই মহাযজ্ঞ বেদী স্থাপন করেন৷ তাঁর পরে আর ঋত্বিক কেউ ছিলেন কিনা বা আছেন কিনা এখনও আমরা তা জানি না৷ রবীন্দ্রনাথ তো একটা ধর্মসম্প্রদায় খুলে বসেননি৷ তিনি চেয়েছিলেন মানবিকতার সৃজনাত্মক প্রকাশ ও বিকাশ৷ এটা যদি মঠ বা মিশন হতো মনে হয় আরও কিছুদিন সেই উত্তাপও থাকতেও বা পারত৷ কিন্তু সে ব্যাপারটা হতো রবীন্দ্রায়ন বিরোধী এবং সেটা রবীন্দ্রযানও হতে পারত না৷ যে অন্য দুটি লোকের বা মহামানবের কথা রবীন্দ্রনাথ সহ একই দশকে মনে রাখতে পারি তাঁরা স্বামী বিবেকানন্দ এবং মহাত্মাজি নিজে৷ দুজনারই সম্প্রদায় আছে৷ মঠ মিশন আছে এবং আছে আশ্রম ও ব্যাপক সূত্রযজ্ঞাদির মতো অনুষ্ঠানও৷ এগুলির ধার্মিক আধ্যাত্মিক রূপ দেওয়া ব্যর্থ হলেও তাই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে৷ অন্যদিকে রবীন্দ্রানুসারী ব্যক্তিমাত্রকেই স্ব-স্ব সত্তার অধিকারী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চেয়েছিলেন৷ কোনো সাম্প্রদায়িক ছায়ায় তিনি মানুষ গড়তে চাননি, এই হলো আমাদের মতো লোকের চেতনায় রবীন্দ্রায়নের এবং অবশ্যই রবীন্দ্রযানের বিশিষ্টতা৷ বস্তুত রবীন্দ্রনাথকে বেশিটাই রোমান্টিক কবি বলে পরিচয় দেওয়া হয়ে থাকে৷ তাঁর উপন্যাস অপেক্ষা কাব্য ও কবিতা বেশি পঠিত হয়েছে ও এখনও হয়৷ অথচ রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সময়োচিত নানা রচনা এবং আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য সহ লেখা, উপন্যাসগুলি অত বেশি তাঁর পরিচায়ক বলে গৃহীত হয় না৷ নিজ মনে প্রশ্ন উঠেছে–কেন এই ভাবে তাঁর ব্যাপক পরিচয় হলো না? আমার কাছে একটাই উত্তর৷ রবীন্দ্রনাথ প্রতিটি রচনায়, কাব্যে উপন্যাসে বা প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে সতত একই নীতি অনুসরণ করেছেন৷ সে নীতি হলো বাস্তবতা এবং সেই বাস্তবতার অতি ব্যাপক রূপ৷ তাঁকে যখন আধুনিক কবির দল অবজ্ঞার চোখে দেখেন তখন তিনিও তার প্রত্যুত্তরে আধুনিকতার তথাকথিত রূপকে আত্মসাৎ করেছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন যা কিছু নূতন ও আধুনিক তা নিশ্চয় গ্রাহ্য৷ কিন্তু শুধু আধুনিকতাই তো কাব্য হয় না৷ শুধুমাত্র পচা কাঁঠালের ভূ তি থাকলেই তো আধুনিক কবিতার রূপ মেলে না৷ তিনিই বলতে পেরেছিলেন ঐ দেখ ওটা আধুনিকতার ভূ ত মুখেতে যোগায়–স্থূলতার জয় ভাষা জানি অমরার পথহারা কোনও দূত জঠর গুহায় নাহি করে যাওয়া আসা

কবির এই সতত বক্ষ্যমান ব্যঙ্গোক্তিও পরিশীলিত কৌতু ক মিশ্রিত যে রোমান্টিক বেদনা সেটাই তাঁর কাব্যেও উপজীব্য তথা উপন্যাসের প্রাণধর্ম এবং অন্যান্য রচনার গতিশক্তি৷ কোথাও তা যেমন আড়ষ্ট নয়– তেমনই কোথাও তার কবিপ্রাণ-ধর্ম বিঘ্নিত হয়নি৷ সেইজন্য এই কবি-পরিক্রমার রবীন্দ্রায়ন কখনো যেন দক্ষিণায়নের অভিমুখে যায়নি৷ প্রতিটি গ্রন্থেই তা সে কাব্যগ্রন্থ বা গদ্যরচনা যাই হোক না কেন কবি সর্বদাই উত্তরোত্তর উত্তরণের পথে চলেছেন৷ এজন্য তাঁর প্রতি রচনাই বিভিন্ন স্বাদের বিশিষ্টতায় সমুজ্জ্বল অথচ তা বাস্তবের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হলেও অচল হয়ে থাকে না৷ কোনো-না-কোনো ভাবে দেশকালকে স্বীকার করেও সে রচনা দেশকাল পাত্রাতীত রূপে বিদ্যমান৷ একবার কোনো ব্যক্তির লেখায় পড়েছিলাম রবীন্দ্ররচনা রামায়ণ মহাভারত-এর মতো কাল্পনিকধর্মী বা বহুপঠিত নয়৷ রামায়ণ-মহাভারত-এর নানা কাহিনির যে নবতর রূপ আমরা রবীন্দ্ররচনার মধ্যে পরিবেশিত হতে দেখি তার দ্বারা তাঁর রচনা সেমি-ক্লাসিক বা নিও-ক্লাসিক পর্যায়ীভূ ত৷ যেমন কর্ণ কু ন্তী সংবাদ, গান্ধারীর আবেদন অথবা কচ ও দেবযানী-র মতো দীর্ঘ রূপের কবিতাগুলির আবেদন তো চিরন্তন মনে হয়৷ একটা বড়ো কথা আমাদের মনে রেখে রবীন্দ্ররচনার পাঠ ও সে পাঠের ফলশ্রুতি গ্রহণ করতে হয়৷ সেই কথাটা হলো রবীন্দ্রনাথেরই কথা– তোমার কীর্তির চেয়ে তু মি যে মহৎ তাই তব জীবনের রথ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার বারম্বার– রবীন্দ্রনাথ কোনো এক রচনায় শেষ হয়ে যান না৷ তীব্র আকাঙ্ক্ষা সহ আমরা প্রতীক্ষা করি উত্তরণের–যা অশেষ এবং অমোঘও৷ এই যুক্তি অনুসারে ঘরে বাইরে উপন্যাসে নিখিলেশকে বিদ্রোহীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়৷ এই নিয়মেই বিস্ময়কর ভাবে রচিত হয় ‘শেষের কবিতা’র কবিতাটি৷ তার মধ্যেই চমকিত হয়ে পাওয়া যায় দুর্লভ মণিমুক্তোর মতো কয়েকটি পঙক্তি– যে আমারে দেখিবারে পায়– অসীম ক্ষমায় ভালমন্দ মিলায়ে সকলি ভালোবাসার জগতে এর চেয়ে বড়ো উক্তি আর হয় না৷ অথচ রোমান্টিক প্রেম ব্যর্থ নয় তার দিকেও কথা আছে–

তোমারে যা দিয়েছিনু তা তোমারি দান গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়৷ ‘সত্যই শেষের কবিতা-য় লেখক একটা মর্মভেদী সত্য আবিষ্কার করেছেন৷ সংসারে সমাজে পরিবারে শত-শতবার এই রোমান্টিক প্রেম সহ বাস্তবের অভিঘাত অভিব্যক্ত হয়ে চলছে৷ মানুষেরা তা নিয়ে ঝগড়া করে হয় পরস্পরকে অভিযোগে ক্ষু ণ্ণ করে কিন্তু সে তো কোনো গ্রন্থিমোচন নয়৷ রবীন্দ্রনাথ সেই গ্রন্থিমোচন করে তার সম্ভাব্য সৃষ্টিকু শল রূপ দেখতে ও দেখাতেও পেরেছেন৷ তাঁর লাবণ্য তাই বলতে পারে– মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই শূন্যেরে করিব পূর্ণ এই ব্রত বহিব সদাই বস্তুত এই প্রতিক্ষণের সৃষ্টিকু শলতাই রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব প্রাণধর্ম তথা সচেতন গৃহীত কবিধর্মও বটে৷ বস্তুত রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন এক আশ্চর্য সময়ে অবস্থিত ভারতবর্ষে৷ সময়ানুকূ ল তথা প্রতিকূ ল বহু সংঘর্ষ সমন্বয় দিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্বের তথা তাঁর সেই ব্যক্তিত্বের প্রকাশভঙ্গির অক্ষু ণ্ণ প্রকাশমানতা আমাদের স্পর্শ করে৷ এদিক দিয়ে রবীন্দ্ররচনা যেন কোনো খণ্ডকাল সাপেক্ষই নয়, তা যেন চিরকালীন বলে মনে হয়৷ আমাদের সকলের পরিচিত জগৎকে তা স্পর্শ করে থাকে অথচ স্পর্শাতীত কোনো সত্যকে বা সত্তাকে আমাদের চোখের সামনে এবং চেতনার গোচরে এনে দেয়৷ এই সত্যানুসরণ অথবা সত্যানুচারণই যেন মনে হয় রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রাণ তথা সেই সাহিত্যচর্চার অন্তরে প্রবেশ করার একমাত্র উপায়৷ পূর্বোক্ত প্রণালীতে আমরা রবীন্দ্ররচনার মর্ম গ্রহণ করার সময় রবীন্দ্রায়নের কতকগুলি ধাপ যেন চোখে দেখতেও পাই৷ অবশ্য মানতেই হয় যে কবির জীবনারম্ভ হয় কতকগুলি সুবিধার মধ্য দিয়ে৷ একাই তার মধ্যে ছিল মোটা একপ্রকার সচ্ছলতা৷ বিশাল পরিবারে এক ভৃ ত্যতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মাতৃ হীন অবস্থায় এই কিশোর দিনাতিপাত করেছেন৷ নিজেই নিজের অন্তরের ক্ষু ধার জন্য সুধা আহরণ করেছেন–জল পড়ে পাতা নড়ে দিয়ে কাব্য শুরু হয়েছে৷ জীবনের অভাব অভিযোগ কখনো জীবনের সমগ্র রূপের চাইতে তাঁর কাছে বড়ো হয়ে দেখা দেয়নি৷ হয়তো সেই কারণেই অনায়াস সারল্যে তিনি অর্জিত ক্ষমতার প্রয়োগে সিদ্ধকাম হতে পারেন৷ তাঁর ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’, ‘এবার ফিরাও মোরে’ এবং ‘বলাকা’, ‘পূরবী’র দ্বিধাবিভঙ্গ জীবনাশ্রিত কাব্যরূপ এত স্বচ্ছন্দ যা আমাদের জীবনের ধর্মকেও প্রাণবন্ত করে তোলে৷ অপরদিকে তাঁর শোকের কবিতাগুলি যেমন ‘স্মরণ’ এবং তারও আগে মানসী, সোনার তরী-র কিছু কবিতাও এ প্রসঙ্গে তু লনীয়৷ ‘রাহুর প্রেম’, তারকার

আত্মহত্যা’ প্রভৃ তি কবিতায় যারা আমিষগন্ধ খোঁজেন তাঁরাও কিন্তু সত্যকে প্রাপ্ত হন না, অথচ অশালীন একপ্রকার অনুসন্ধিৎসা তাঁদের এই কবির যথার্থ কবিতা-স্বাদ গ্রহণে বাধামাত্র জোগায়৷ আবার গীতাঞ্জলি অথবা উৎসর্গ-এর ঐকদেশীক কবিতাগুলির প্রাণ হলো একপ্রকার ভক্তি ও আত্মনিবেদনের অনুশীলন৷ অনুসৃজন৷ এসব ক্ষেত্রে গভীর আধ্যাত্মিক একপ্রকার অনুভূ তিকে কবি যেন নিজের ও পাঠকের কাছেও স্বচ্ছ ও স্পষ্ট করে তু লেছেন৷ এখন কেউ যদি প্রশ্ন করেন রবীন্দ্রনাথ মিস্টিক না রোমান্টিক তার উত্তরে আমরা কি বলতে পারি তাই দেখা যাক৷ রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নিয়ে কৌতু ক করতেও যে পারতেন সে প্রমাণ আছে৷ তিনি নিজেকে বলতেন যে তিনি ‘জন্ম রোমান্টিক’ এবং ‘রসতীর্থ পথের পথিক’ বলেই গীতাঞ্জলি-র কবিতাগুলি বর্তমানে Christian Hymns হিসাবে গৃহীত ও গীত হয় ঠিকই৷ কিন্তু কবি যখন তা লেখেন তখন তিনি যে-কোনো আধ্যাত্মিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এই গীতাবলী রচনা করেন তা তো নয়৷ যদিও পরবর্তীকালে দেখা গেছে যে প্রথম মহাযুদ্ধে হতাহত বহু সৈনিকের কাছে গীতাঞ্জলি-র কপি ছিল৷ একজনার মা রবীন্দ্রনাথকে পত্র দিয়ে জানিয়েছিলেন যে তার পুত্রের কাছে কবির গীতাঞ্জলি-র কবিতা ছিল সান্ত্বনাস্বরূপ৷ এই স্বীকৃ তি একদিক দিয়ে নোবেল প্রাইজ পাবার স্বীকৃ তির চাইতেও অনেক বেশি গভীর ও মর্মস্পর্শী বলে মনে করি৷ আমরা যারা একান্ত সৌভাগ্যবশত রবীন্দ্ররচনার বেশিরভাগ পড়ার সুযোগ পেয়েছি এবং তাঁর বিশিষ্ট নিজভাষায় অর্থাৎ তাঁর মাতৃ ভাষা বাংলায় পড়তে পেরেছি আমরা সত্যই রবীন্দ্রায়নের ধাপগুলি দেখে পড়ে মানে বুঝে নিতে পারি৷ এই পর্যায়ে বুঝতেও পারা যায় যে সত্যই রবীন্দ্রচর্চা কতটা আমাদের শিক্ষিত মানসকে প্রভাবিত করে রেখেছে৷ আমরা প্রথমাবধি বলে এসেছি যে রবীন্দ্রনাথ কবি হয়েই জন্মগ্রহণ করেননি৷ তিনি কবি ও মনীষী হয়ে ওঠেন প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সংঘর্ষ ও সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে, এইটাই বড়ো কথা৷ তাঁর পারিপার্শ্বিক তাঁকে সহায়তাও করেছিল৷ জন্মাবধি অনেকগুলি সন্তানের মাতা তাঁর মা খুব মনোযোগ কারও প্রতি দিতে পারেননি৷ তার একটা বড়ো কারণও ছিল৷ সে হলো তাঁর অখণ্ড এক পিতৃ সত্তা৷ ঠাকু র পরিবারে যা কিছু হতো তার মধ্যে একটাই তন্ত্র৷ সেটি হল পিতৃ তন্ত্র–কর্তা বাবা বা কর্তা দাদামশায়ের অবস্থান৷ রবীন্দ্রনাথের নানা কবিতায় স্বদেশপ্রেম ও ভাগবত প্রেমের ক্ষেত্রেও কবিতার সূত্রে এই পিতৃ প্রধানতা ঘুরে ফিরেই এসে গিয়েছে৷ মহর্ষি আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্য৷ তিনি রামমোহনের ধারায় একেশ্বরবাদী৷ তবে তিনি সুফি ভাবনায় ও হাফেজ পঠনে অভ্যস্ত৷ তিনি উপবীতের ব্যবস্থা মানতেন–বৈদিক ও উপনিষদীয় নানা মন্ত্র একত্রিত করে ব্রাহ্মধর্ম-সংক্রান্ত উপাসনা পদ্ধতি প্রস্তুত করে নেন৷

তাঁর প্রবর্তিত মাঘোৎসব আদি ব্রাহ্মসমাজের এক বিশিষ্ট উৎসব৷ তাঁর নিজ সিদ্ধিলাভের দিনটাই হলো সামগ্রিকভাবে শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীর উদ্বোধন দিবসও৷ পুত্রের কর্মযজ্ঞের কথা মনে রেখে জেনে বুঝে তিনি দানপত্র করে বোর্ড অফ ট্রাস্টির হাতে শান্তিনিকেতনের সম্পত্তি উৎসর্গ করে দেন৷ সেই ছিল তাঁর আশীর্বাদ এবং কবি পুত্রের তপস্যাও মেশানো৷ ব্রহ্মচর্যাশ্রমের জন্য প্রথমদিকে মৃণালিনী দেবী রন্ধন করে দিতেন বলে জানা যায়৷ কর্মযজ্ঞের সঙ্গে সঙ্গে এখানে গড়ে ওঠে প্রার্থনা মন্দির, বিদ্যালয়, লাইব্রেরি, গ্রাম-উন্নয়ন পরিকল্পনা (শ্রদ্ধেয় কালীমোহন ঘোষের ব্যবস্থাপনায়) এবং মাঝে মাঝে অনুষ্ঠিত গ্রামীণ মেলা৷ সম্ভবত কবির মনে হিন্দুমেলার কথাও ছিল৷ দিনে দিনে তাঁর কর্মশক্তির নানা দিকের উদ্বোধন এই শান্তিনিকেতনকে আশ্রয় করেই মুক্তি পেয়েছিল৷ প্রথমযুগের শিক্ষকগণ খুবই স্বল্প বেতন সহ কবির এই শিক্ষায়তনে কাজ করেছেন৷ ধীরে ধীরে এখানে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা হয়েছে৷ যোগ দিয়েছেন বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী, আচার্য সিলভাঁ লেভি, অধ্যাপক লেসনী এবং হ্বিটারনিটস, স্টেলা ক্রমরিশ প্রমুখ দেশি ও বিদেশি মনীষীগণ৷ এখানেই অভ্যুদয় হয়েছে নন্দলাল বসু ও শান্তিদেব ঘোষ এবং অন্যান্য প্রসিদ্ধ গায়ক-গায়িকাদের৷ শিল্পী অবনীন্দ্রনাথকে সামনে রেখেও শান্তিনিকেতনে গড়ে উঠেছে এক বিশিষ্ট ধারার চিত্রভাষা৷ এখানকার শিল্পীরাই নন্দলাল সহ সিস্টার নিবেদিতার ব্যবস্থাপনায় ও লেডি হ্যারিংহামের অর্থানুকূ ল্যে অজন্তার চিত্রগুলি কপি করতে যান৷ আচার্য অবনীন্দ্রনাথ ও নন্দলাল বসু স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কীর্তিমান হয়ে সুখ্যাত হয়ে ওঠেন৷ শান্তিনিকেতনের কলাভবনের শিল্পীরা একটা বিশিষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন৷ তার সঙ্গে আসে সংগীতভবন৷ বালক-বালিকা তথা তরুণ-তরুণীর মধ্যে একত্রাবস্থান সহ সংগীত ও নৃত্যচর্চা এক বিশিষ্ট পরিকল্পনা৷ সন্দেহ নাই যে সেই পরিকল্পনা সহ রবীন্দ্রনাথকে তৎকালীন সমাজের কিয়দংশ গ্রহণ না করে পারেনি৷ এই এক্সপেরিমেন্ট দ্বারা সমাজ ও সংসার তৎকাল পরিপ্রেক্ষিতে অনেকখানি অগ্রসর হয়ে গেছিল বলা যায়৷ এই সঙ্গে ছিল সংগীত ও অভিনয় সহ নতু ন একপ্রকার কলাশিল্পের অভ্যুদয়৷ এর মধ্যে বর্ধিত হয়েছে ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস৷ যোগ দিয়েছেন ভারতের ও বহির্ভারতের বহু ছাত্রছাত্রী৷ এর মধ্য দিয়ে সমাজ ও সংস্কারও করা হয়েছে৷ প্রথমদিকে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণেতর ছাত্রদের খাওয়ার ব্যবস্থা ভিন্ন ছিল৷ পরে তা উঠে যায় এবং একই স্থানে সকলের খাবার ব্যবস্থা হয়৷ স্বপাকাহারী বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয় মুসলমানকে খাওয়ার ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন এমন ব্যাপারও উল্লেখিত হয়েছে৷ অভিনয় যে একটা প্রবল ও স্থায়ী হাতিয়ারের মতো তাও বোঝা গেল যখন দেখা গেল যে স্বাভাবিক অভিনয় নিপুণতা সহ তরুণ-তরুণীদের নৃত্য গীত ও মঞ্চাভিনয়ের মধ্য দিয়ে একটা নূতন যুগ সৃষ্ট হতে পারল৷ এতদ্বারা মিশ্র জাতির বহু প্রকার বিবাহও স্বীকৃ ত হয়ে গেল–ভারতীয়দের মধ্যে তো

বটেই ভারতীয় অভারতীয়দের মধ্যেও বিবাহ হলো৷ স্বয়ং কৃ ষ্ণ কৃ পালানী ও মীরাদেবীর কন্যা নন্দিতার যে বিবাহ তাতে কবি উপস্থিত ছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথের পালিতা কন্যা পুপে দিদি বা নন্দিনীর বিবাহ হয় স্বঘরে স্বজাতির পাত্র সহ৷ সেখানেও কবি উপস্থিত থাকেন৷ সুইডিশ মহিলা হৈমন্তীদেবী ও অমিয় চক্রবর্তী দীর্ঘকাল এখানেই বাস করেছেন বিবাহোত্তর কালে বিদেশযাত্রার আগে৷ ছাত্রছাত্রীদের লিস্ট বাড়িয়ে তো লাভ নেই৷ শান্তিনিকেতনের একটা নিজস্ব সুর হলো৷ সেই সুরও শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রী দেশে-বিদেশে সকলেই গ্রহণ করতে পারল৷ তারা বলতে পারলেন সত্যই ‘আমাদের শান্তিনিকেতন আমাদের সব হতে আপন৷’ এইখানে পাঠ গ্রহণ করেছেন জওহরলালের কন্যা ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী৷ দেশ-বিদেশ থেকে সমাগত বহু শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রশিক্ষণ দিয়ে গিয়েছেন এখানে৷ এসেছেন পিয়ার্সন এবং এলমহার্স্ট৷ এঁরা ভালোবেসেছেন কাছাকাছি পল্লী উন্নয়নের কাজ এবং বস্তুত এলমহার্স্ট-এর সহায়তায় তাঁর পত্নীর (বাগদত্তা) অর্থ আনুকূ ল্যে সংগ্রহ হয় গ্রামোন্নয়ন ব্যবস্থাপত্র৷ এখান থেকে ছাত্রেরা জাপান, (বিশ্বরূপ বসু) আমেরিকা (সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় জামাতা কবির) সন্তোষ ভঞ্জ প্রমুখেরা দেশবিদেশের নানা স্থানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে আসেন৷ বর্তমানে যতদূর জানি এলমহার্স্টের প্রবর্তিত একটি শান্তিনিকেতন ধারায় স্কু ল ডার্টিংটন হলে চলছে৷ জাপানে অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান আছে৷ কবি চেয়েছিলেন যেন এই শান্তিনিকেতন বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার সহ যুক্ত থাকে ও সকল দেশের সংস্কৃ তির আদানপ্রদান যাতে হয় সেদিকে তাঁর লক্ষ ছিল৷ তিনি তাঁর পরাধীন দেশের ও মানুষদের কথা ভোলেননি৷ তাঁকে দেশে-বিদেশে বারবার নানাভাবে লাঞ্ছনাগ্রস্ত হতে হয়েছে৷ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সূত্রে এদেশের মানুষেরা এবং কিছু ভিন্ন ভাষার লেখকেরা ঈর্ষা অনুভব করেছেন৷ আবার ইয়োরোপের পশ্চিমের একটি দেশ থেকে কাগজে ছাপা হয়েছিল যে কোনো ভারতীয় সত্যকার কখনো এ পুরস্কার পেতে পারে না৷ এঁর নিশ্চয় আর্যরক্ত আছে৷ কবি দেখেছিলেন এটা কিন্তু এর অর্থবোধ করে বিচলিতও হননি৷ তাছাড়াও খ্যাতি অখ্যাতির আড়ালে ইংরাজ লেখক এবং নোবেল পুরস্কার কমিটির চিঠিপত্রের আদানপ্রদানের ভিত্তিতে বোঝা যায় একজন এশিয়বাসী ভারতীয়কে স্বীকৃ তি দিতে ইয়োরোপের কতরকমের বাহানা করতে হয়েছে৷ বর্তমানেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতার অনুবাদ সহ পুনর্জীবিত হয়েছেন প্রায়৷ এখন বলা হচ্ছে যে কবির ইংরাজি অনুবাদই ঠিক হয়নি৷ অন্য কথাটাও অনুক্ত থাকে না যে কবি ইংরাজি জানতেন না এরূপ ভাবের কথা৷ অথচ আমরা ম্যাকমিলন প্রকাশিত অনুবাদ পড়েছি৷ তাতে সুললিত স্বচ্ছন্দ ভাষা অনেকক্ষেত্রে বাইরের স্বচ্ছন্দ ভাষাই স্মরণ করিয়ে দেয়৷ বর্তমানের এক নামী ও বিদেশে খ্যাতিপ্রাপ্ত লেখকের মতে রবীন্দ্রনাথ নাকি নোবেল পুরস্কার পাবার পর থেকে

সেই কারণেই নষ্ট হয়ে যান৷ তাঁর প্রতিভা ছিল না৷ এস্থলে আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিতারই উল্লেখমাত্র করতে পারি– কে কেমন বোঝে অর্থ তাহার কেহ বলে এক কেহ বলে আর ভালোয় মন্দে আলোয় আঁধারে দিয়াছ মিশি– তবু ওগো দেবী করি নিশিদিন পরাণ পণ চরণে দিয়েছি আনি মোর জীবনের সকল শ্রেষ্ঠ সাধের ধন ব্যর্থ সাধন খানি৷ এই রবীন্দ্রনাথই বলতে পারেন–‘ক্ষু দ্র যাহা তু চ্ছ তাহা নয়–সত্য যেথা কিছু আছে বিশ্ব সেথা বয়’৷ একদিকে চলেছে তাঁর দিনরাত্রির কাব্য অপরদিকে চলেছে শিক্ষা নিয়ে নানারকমের প্রস্তুতি ও বই লেখা৷ সৃষ্টিকু শল রচনা তো শেষ পর্যন্তই তিনি কঠিন পরিশ্রমের দ্বারা প্রস্তুত করতেন৷ বস্তুত একজন ভারতীয় তথা বঙ্গসন্তান যে এরূপ কঠিন পরিশ্রম করতে পারতেন এটা আমাদের কাছে বিশেষ আশ্চর্য ব্যাপার বলে মনে হয়েই থাকে৷ নিজের রচনাকে নির্মমভাবে সংশোধন ও পরিমার্জন করা তার স্বধর্ম ছিলই৷ তদুপরি সেসব লেখার প্রকাশনা তিনি দেখতেন যাতে ঠিক হয় সেইজন্য৷ প্রত্যুষে উঠে সূর্যোপাসনা ও ধ্যান দিয়ে তাঁর দিবারম্ভ হতো৷ সারাদিনের ঘটনার বৈচিত্র্য তো ছিলই৷ আর ছিল অগণিত মানুষের পরিচিত অপরিচিত নানা লোকের গমনাগমন এবং কবিসহ আলোচনার ব্যবস্থা৷ কবি কারোকে বিমুখ করতেন না৷ বয়স্ক মানুষ হিসাবে তাঁর এভাবে ক্লেশ নিশ্চয় হতো৷ কবি সেটু কু বরদাস্ত করতেন৷ শান্তিনিকেতনে খুব মশা ছিল একসময়৷ কবি লেবুর তেল নামক একটা তেল মেখে বসে থাকতেন যাতে মশা না কাটে৷ অপরদিকে তাঁর পোশাকে কোথাও শুঁয়োপোকা রয়ে গেছিল৷ সেই বিষাক্ত কীটের দংশনে কবির হাত দগদগে ঘায়ে ভরে যায়৷ কবি নিঃশব্দে তা সহ্য করেছিলেন৷ মনে হয় শরীরকে অসাধারণ ভাবে সংযত করার একটা অনায়াসপটু শক্তি ছিল৷ এ শক্তিকে আধ্যাত্মিক বলে ব্যাখ্যা দিতে চাই না৷ রবীন্দ্রনাথ কোথাও জীবনে ধর্মগুরু হয়ে ওঠেননি৷ তিনি যে তা হতে পারেননি এটা আমাদের পরম সৌভাগ্য৷ তাঁকে গুরুদেব সম্বোধন করা হলেও তিনি ধর্মগুরু ছিলেন না কোনোদিন৷ তাঁর বক্তব্য তিনিও পদযাত্রী হিসাবে সহযাত্রীদের সাথে এক পথে চলেছেন আবার ভিন্ন পথেও তাঁর যেতে বাধা ছিল না৷ পথ চলাতেই তাঁর আনন্দ ছিল সে কথা বারবারই বলেছেন৷ ‘যাত্রী আমি ওরে’ যিনিই বলেন তাঁকে অজস্র রকমের কার্যকারণের

সামঞ্জস্য রাখতে হয়৷ পুত্র হিসাবে ভ্রাতা হিসাবে পতি ও পিতা হিসাবে, জমিদার হিসাবে মানবকল্যাণকামী একজন সংগঠক হিসাবে এবং সর্বোপরি এক পরাধীন দেশের মানুষ হয়েও বিশ্ব-মানবিকতা প্রবুদ্ধ এক আধুনিক মানুষ হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ৷ রলাঁ, আইনস্টাইন সহ তাঁর আত্মিক যোগাযোগ লক্ষ করার মতো৷ অপরদিকে গান্ধিজিকে মহাত্মা নামটি তিনি দেন৷ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনিক্স স্কু লের ছেলেরা প্রথমে শান্তিনিকেতনে আশ্রমযুক্ত হয়৷ তাদের ছিল কঠোর কৃ চ্ছ্রসাধন, থাকা-খাওয়া সর্বত্র৷ তাছাড়া গান্ধিজি নিজের মলমূত্রাদি নিজে সাফ করার শিক্ষা দিয়েছিলেন৷ এসব ছেলেরা তাই করত৷ পরের দিকে আশ্রমে একদিন ছুটির ব্যবস্থাও হয় ডোম ও মেথর প্রভৃ তির৷ সেদিন ছাত্রসহ গুরুগণ যেমন নন্দলাল নিজে বার হতেন ও সমগ্র আশ্রমের পায়খানা সাফ করতেন৷ পল্লি-উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যেও খানা ডোবা প্রভৃ তির জল বীজাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা হয়েছিল৷ শ্রীনিকেতনে ডেয়ারি বেকারি এসব তো ছিলই, তদুপরি সেখানে ক্রাফট সেন্টারড এডু কেশন-এর ব্যবস্থা হয়৷ এখানে তাঁতে চলত কাপড় বোনা, কাঠের কাজ এবং অবশ্যই চামড়ার কাজ করানোর ব্যবস্থা ছিল৷ অভিনয় ও নৃত্য-সম্পন্ন হতে পারল স্ত্রীলোক ও পুরুষের একত্র হয়ে তা সম্পন্ন করার মধ্যে৷ রবীন্দ্রনাথ নিজে প্রতি অভিনয়ে উপস্থিত থাকতেন তো বটেই৷ তাছাড়াও তিনি এবং দিনেন্দ্রনাথ ঠাকু রও নাটকে যোগ দিতেন৷ রবীন্দ্রনাটকে প্রায় এক আত্মসচেতন দাদাঠাকু রের কথা লক্ষ করা যায়৷ প্রায় রবীন্দ্রনাথ এই পাঠ নিতেন৷ আরও অনুভব করার মতো কথা হল এই বিরাট বিশাল কর্মপ্রবাহের একটা ছন্দ ও গতি ছিল৷ বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রবণতা সমন্বয় ও সৌষম্য তাঁর এই বিশাল কর্মধারাকে নিয়ন্ত্রিত করেছিল৷ এই রবীন্দ্রনাথকে আমরা বিশ্বসভাতে ভারতের প্রতিভূ হিসাবে দেখি৷ আবার স্বগৃহে গৃহপতি হিসাবে রবীন্দ্রনাথ অনন্য৷ মাত্র ৪১ বৎসর বয়সে তাঁর পত্নী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু হয়৷ পাঁচটি সন্তানের তিনজনা অল্প সময়ের ব্যবধানে কালগ্রাসে পতিত হয়৷ শেষ বয়সে মীরাদেবীর পুত্রও জর্মনিতে যক্ষ্মারোগের চিকিৎসা করানোর কালে মৃত্যুমুখে পতিত হন৷ এইসব ব্যক্তিগত শোক ছাড়াও তাঁর কাছাকাছি বহুমানুষের বিরহ বেদনা তিনি বহন করেছেন৷ তাঁর সমগ্র জীবনসাধনার মধ্যে উদ্ভাসিত হয়ে আছে জীবনানন্দ– প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে প্লাবিত করিয়া নিখিল দ্যুলোকে ভূ লোকে তোমারি অসীম অমৃত পড়েছে ঝরিয়া৷ রবীন্দ্রনাথকে শুধু রোমান্টিক কবি বলা একটা ভ্রান্তি বলে মনে হয়৷ সময়োচিত অমনভাবে লেখনী চালনা করা একমাত্র রবীন্দ্রনাথেই পাওয়া যাবে৷ অথচ তিনি দেশনেতা হননি বা

ধর্মগুরু হতেও চাননি৷ রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কোনো কিছু বলা অতিশয়োক্তি হয় না যে তার কারণ খুব স্পষ্ট৷ সূর্যমুখী পৃথিবীর পরিক্রমাকে আমরা সূর্যের গতি বলে মনে করি৷ যেভাবে উত্তরায়ণ দক্ষিণায়নের কল্পনা করি সেটাও বাস্তব৷ রবীন্দ্রনাথ একদিনে হননি৷ তাঁর গতিপথ বিচিত্র এবং সেই গতিও নিরুদ্দেশ রোমান্টিক গতি নয়৷ বস্তুত রবীন্দ্রনাথের মতো এত স্পর্শকাতর মন ও এরকম সৃষ্টিশীল ও সতত সচেষ্ট ব্যক্তিত্ব ভারতবর্ষের মাটিতে দুর্লভ বলাটা একটু ও অত্যুক্তি হবে না৷ রবীন্দ্রযান রবীন্দ্রচর্চা বা রবীন্দ্রানুসরণ এর কোনোটার দ্বারাই রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় না বা হওয়া যায়নি৷ রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দ ও মহাত্মাজির মতো রবীন্দ্রনাথও একক৷ অনেকটা তিনি রামমোহন অথবা বিদ্যাসাগরের মতো৷ তিনি নিজে স্কু ল করেছিলেন, সংঘ নয় বা আশ্রমও নয়৷ তাঁকে গুরুদেব নাম দেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়৷ স্বীয় জমিদারিতে নিজ পুত্রকন্যার শিক্ষার ব্যবস্থা বিষয়ে তাঁকে ভাবতে হয়েছিল৷ তিনি যে গ্রামে থাকতেন তার উন্নতির পরিকল্পনা তাঁকে করতে হয়েছিল৷ এরই সাথে সাথে তাঁর প্রবন্ধাদির কথাও স্মরণীয়৷ শান্তিনিকেতন তাঁর সৃজিত হলেও সেখানে কোনো ছাঁচ ঢালাই করার ব্যবস্থা তিনি করেননি৷ প্রতি মানুষ প্রতি জীবন তার নিজ নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে এটাই তিনি চেয়েছিলেন৷ যে পথে তা সম্ভব হবে সেটা হলো একপ্রকার আত্মশক্তির প্রয়োগগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তার সার্থকতা বিচারের পর অগ্রগতি৷ যাঁরা রবীন্দ্রচর্চা করেন তাঁরা একটা বিষয় লক্ষ করেন কিনা জানি না–সেটা হলো রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিমুখী প্রতিভা সতত বিচার বিবেচনাশীল৷ এই বিচার-বিবেচনা জীবনের প্রতি কাজে ব্যক্ত হয়ে তাঁকে সত্যই বিজ্ঞানমনস্ক জিজ্ঞাসুও করেছিল৷ কবি নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন–কবিরে পাবে না তার জীবনচরিতে৷ এটাই সত্য কথা৷ তাঁর সমসাময়িক রমাঁ রঁলা, বারবুস ও তারও পূর্বেকার যার তু লনা করলেও রবীন্দ্রায়ন একটা একক পন্থা বলে বোধ হয়৷ সে পথ বহুর এবং বিচিত্রের৷ সে পথে কিছুদূর অনুসরণ মাত্র করা সম্ভব৷ অনুকরণ হবে হাস্যকর৷ এই কারণে অন্তত রবীন্দ্রায়ন অনুভব করা যায় মাত্র, কিন্তু ইচ্ছা করলেই রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় না৷ উক্ত রবীন্দ্রায়নের আর একটা বড়ো দিক হলো কবি নিজ ক্ষমতার সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন৷ কদাপি তিনি তার অপপ্রয়োগ করেননি৷ প্রতিটি লেখা এবং চিত্র সবই তাঁর ঈপ্সিত সৃজনকলা৷ প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি সেগুলিকে সাধ্যমতো মার্জিত ও পরিশুদ্ধ করে তবে প্রকাশ করেছেন৷ রবীন্দ্রায়নের আর একটি বড়ো দিক হলো জীবনে কোথাও পরাঙ্মুখ না হওয়া৷ জীবনই জীবনের শেষ কথা৷ এই জীবনবোধ তাঁকে বিঘ্নে বিপদে শোকে বিষাদে সহযাত্রীর মতো সহায়তা করেছে বলা চলে৷ তিনি জীবন থেকে যা কিছু প্রাপ্তি আহরণ করেছেন৷ তাঁর

পারিবারিক ক্ষেত্র তাঁদের সকলেরই অনুকূ ল ছিল৷ কিন্তু রবীন্দ্রায়ন সম্ভব হলো একজনারই৷ অবশ্য এও সত্য যে দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এরা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে এক একজনা দিকপাল৷ কন্যাদের মধ্যে স্বর্ণকু মারী দেবী শুধু সুশিক্ষিতা ছিলেন না, সুলেখিকাও ছিলেন৷ তাঁর লেখা কয়েকটি উপন্যাস সেই সময় সুখ্যাতি লাভ করে৷ মহর্ষির তৃ তীয় প্রজন্মে পৌত্র পৌত্রীগণের অজস্র কৃ তিত্বও লক্ষ করার মতো৷ এদের প্রত্যেকেরই স্ব-স্ব ক্ষেত্র সুনিবার্চিত এবং তৎকালের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনো ভাবে দেশপ্রেমের আদর্শবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত৷ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আমরা যেমন স্বদেশিয়ানার দ্বারা উদ্বোধিত আসবাব ও ছবির গতি লক্ষ করি, তেমনইভাবে লক্ষ করার মতো বিষয় হলো সুরেন্দ্রনাথ এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকু রের পরিবারের দেশপ্রেমিকতা৷ ভারতীয় চিত্রকলার নব আদর্শ এই সময় একপ্রকার নূতন আন্দোলনের সূচনা করে৷ এর প্রত্যেকটি ব্যাপারের একটা পারম্পর্য বিদ্যমান৷ অথচ একথা সত্য যে ঠাকু রপরিবারের কেহই প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে কখনো সরে থাকেননি৷ সেটা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে রাখিবন্ধন ও তারপর সতত তাঁর শিক্ষার হেরফের প্রবন্ধসমূহের অভিব্যক্তি লক্ষ করলে বোঝা যায়৷ হিন্দুমেলায় কবিতা পাঠ দিয়ে যে ভাবনাকে তিনি গ্রহণ করেন তাকে নানাভাবে বিচিত্ররূপে ব্যক্ত করেছেন লেখায়, কবিতায়, এবং তাঁর বিবিধ ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে৷ শান্তিনিকেতন তাঁর সেই বোধের একটা আত্যন্তিক অভিব্যক্তি বলাই সংগত৷ যে সকল জীবন বিপ্লবী কর্মধারার মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষে পরোক্ষে ইংরাজ সহ সংঘর্ষে অবতীর্ণ তাঁদের বহুজনাকেই তিনি সৃষ্টিধর্মী বিকাশশীল কর্মপদ্ধতির মধ্যে আনয়ন করেন৷ স্বয়ং কালীমোহন ঘোষ, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এবং স্বয়ং শ্রীঅরবিন্দ তথা তাঁর সিস্টার নিবেদিতা সতত রবীন্দ্রনাথের কর্মপদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন৷ নিবেদিতার মতোই রবীন্দ্রনাথও আশা করেছিলেন জগদীশচন্দ্রের প্রতিভাকে জগতের সামনে স্বীকৃ তিপ্রাপ্ত দেখতে পাবেন বলে৷ রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ছিল সর্বাত্মক এক সৃষ্টিশীলতাকে স্বীকার করা৷ তাই তাঁর রাজনীতি ও সমাজদর্শন এবং সামাজিক সংস্কারমূলক সকল কাজকর্মের মধ্যেই এই সৃষ্টিকর্ম লক্ষ করা যায়৷ শিক্ষা শুধু কলাত্মক নয় ক্রিয়াত্মকও হবে৷ সেই ক্রিয়া জীবন থেকে বিচ্যুত হবে না৷ সেইজন্য তাঁকে শিক্ষায়তনের সঙ্গে যুক্ত করতে হয়েছিল গ্রামোন্নয়ন তথা পল্লিমঙ্গল ক্রিয়াকলাপও৷ অবশ্য এর প্রস্তুতিপর্বে তিনি স্বগ্রামের জমিদারিতে কু ঠিবাড়িতে সপরিবারে যখন ছিলেন, তখন থেকেই ভাবনাচিন্তা সহ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন৷ ইংরাজকে তিনি কখনো বিদেশি প্রভু বলে স্বীকার করেননি৷ মানুষকে মানুষ বলেই ধরেছেন এবং অত্যাচারী বলে স্বীকারও করেছেন৷ এই শাসনের বিরোধী আচরণের উপযুক্ত উপায় বলে তিনি গ্রহণ করেন আত্মশক্তির উপায়৷ একমাত্র এই আত্মশক্তির

সাহায্যেই মানুষ হিসাবে ভারতীয় মানুষ জগৎ-সমক্ষে স্বীকৃ তিলাভ করতে পারে বলে তাঁর মনে হয়েছিল৷ আরও একটা সততা তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য৷ সেটা হলো স্থান কাল পাত্রোপযোগী প্রয়োজনমতো কলমের দ্বারা প্রতিবাদ জানানো৷ সেটা শিক্ষার ক্ষেত্রে, তাঁর নিজস্ব স্যার উপাধি ত্যাগ করার মধ্যেও চোখে পড়বে৷ এছাড়াও তিনি গ্রহণ করেছেন মহাত্মাজিকে, কিন্তু সর্বাত্মকভাবে তাঁকে স্বীকার করতে পারেননি৷ আমাদের মনে হয় গান্ধিজি ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটা মৌল পার্থক্য বিদ্যমান ছিলই৷ রবীন্দ্রনাথ আধুনিক মানুষ, বিজ্ঞান সচেতন এবং পরিশীলিত জীববোধের দ্বারা দীক্ষিত৷ মহাত্মাজি সত্যই মহাত্মা ছিলেন কিনা সে বিচার অনাবশ্যক৷ তবে একথা সত্য যে তিনি বহুভাবে তাঁর দেশ কাল ও মানুষের চাইতে অনেক অগ্রসর ছিলেন৷ তিনি শুধু তাই এক ভারতপথিক নন– বিশ্বপথিকও বটে৷ অপরপক্ষে ব্যক্তিগতভাবে মহাত্মাজিকে আমাদের মনে হতে পারে যে তিনি নিবেদিত প্রাণের মানুষ ঠিকই৷ কিন্তু তিনি তাঁর দেশ কাল পাত্রের গণ্ডির মধ্যে সীমায়িত–তাঁর আকৃ তি প্রকৃ তিতে জৈন তীর্থঙ্করের কঠিন কৃ চ্ছ্রসাধন প্রকট৷ তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় যেসব মানুষকে তিনি আনেন তাঁদের একরকম আশ্রমজীবন পালন করতে হয়৷ ব্রহ্মচর্য করতে হয়৷ অবৈজ্ঞানিক মনোভাবনাকে তিনি নানাভাবে প্রশ্রয় দেন৷ এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ যা করেন তাঁর ইচ্ছানুসারে কারোকে জোর করে চাপিয়ে দেন না৷ তাঁর ধারণায় কাজ করতে হবেই এবং সে কাজ হবে সৃষ্টিমূলক–তাতেই মনের জীবনের সংকোচন ও প্রসারণ দুই ঘটে এবং সেটা নির্ভর করে আত্মশক্তির উপর৷ এমন মৌলিক পার্থক্য সত্বেও রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধিজি পরস্পরের অনুরাগ বিশ্বাসী ছিলেন৷ তাঁদের যোগসূত্রও ছিলেন একজন৷ তিনি হলেন এন্ড্রুজ সাহেব৷ নিঃশর্ত মানবিকতা মাত্র গ্রহণ করে রবীন্দ্রনাথ এতবড়ো ক্রিয়াকাণ্ড সমন্বিত আশ্রম চালিয়েছেন তার মূলে ছিল তাঁর সহনশীলতা এবং মানুষকে নিজ নিজ পথে পরিচালিত হবার নিষ্ঠা বা দীক্ষা দান৷ সেদিক থেকে গান্ধিজির সত্যাগ্রহ অসহযোগ আন্দোলন আর্থসামাজিক পরিকল্পনার উপযোগী শিক্ষাদান ও Basic Training-এর সবকিছুর মূলেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য ও কতকটা জোর করা৷ রবীন্দ্রনাথ সত্য শিব সুন্দরের পূজারি৷ গান্ধিজিও সত্য শিব সুন্দরের উপাসক৷ কিন্তু, কৃ চ্ছ্রসাধন মাত্র ব্রহ্মচর্যের বৈপ্লবিক পরিকল্পনা সহ ভারতের তথা পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ এগুলি কষ্টকল্পিত ভাবেই আমাদের মানতে হয়৷ তাছাড়া তাঁর ধার্মিক সাধনার মধ্যে তন্ত্র একটা বড়ো স্থান গ্রহণ করেছিল শেষ দিকে৷ বলতে গেলে তিনি সন্ত মতের লোক৷ অপরপক্ষে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আধুনিক এক বিশ্বপথিক বিজ্ঞান সচেতন মানুষও৷ দুজনাই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কতকগুলি পারিপার্শ্বিক স্বাতন্ত্র্য নিয়েই জন্মেছেন ও সেই পরিবেশের মধ্যেই বর্ধিত তথা দীক্ষিত হয়ে কাজে লেগেছেন৷ মহাত্মাজি যা কিছু

করেছেন বা রবীন্দ্রনাথ যা কিছু করেছেন তা পুরোপুরি তাঁদের স্বকীয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য দ্বারা নিয়োজিত হয়ে করেছেন৷ যে-কোনো কারণেই হোক সৌন্দর্যবুদ্ধি ও সৌন্দর্যসৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের মূল প্রেরণা ছিল৷ অপরপক্ষে গান্ধিজি এ দুটোকে পরস্পর বিরোধী নীতি বলে অনুমিত মনে করতেন৷ ব্যক্তি হিসাবে গান্ধিজি সংকীর্ণতা মুক্ত নন৷ অপরপক্ষে রবীন্দ্রনাথ সতত প্রয়াস করেন নিজেকে সকলপ্রকার সংকীর্ণতামুক্ত রাখার জন্য৷ অবশ্য এ প্রয়াস ব্রহ্মচর্য পালনের মতো ব্যাপার হতে পারেনি এটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্টতা৷ এই কারণেই কবি কখনও শান্তিনিকেতনকে একটা কঠিন ডিসিপ্লিনারি ব্যাপার করেননি৷ এখানে ছিল আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে? এক্ষেত্রে গান্ধিজি ও রবীন্দ্রনাথ স্ব-স্ব প্রাপ্ত পরিবেশ নির্ভর হয়ে পথ চলতে পেরেছেন৷ এই পথ তাঁদের স্ব-স্ব ভালোমন্দের বিশিষ্টতাও অনিবার্য নিয়মে ধরা পড়েছে৷ রবীন্দ্রনাথের উদার দৃষ্টিতে নিবেদিতা, জগদীশ বসু, সুভাষ বসু, প্রত্যেকেই ভারতের বিশিষ্ট মানুষ হিসাবে স্বীকৃ ত৷ অপরপক্ষে গান্ধিজির সঙ্গে মতের অনৈক্য হলেই তার কাছে সে মত বা সেই মতের মানুষ অগ্রহণীয়৷ তা না হলে তিনিও অসাধারণ ও একজন মহামানবও বটে৷ একটু পূর্বকথন দেখা যাক এ ব্যাপারে৷ পূর্বেই বলেছি যে রবীন্দ্রনাথ কতকটা পারিবারিক ক্ষেত্রে সুবিধা ও পরিবেশগত আশ্রয় লাভ করেছিলেন৷ স্বকীয় বিশিষ্টতা সহ তিনি সেগুলির কতকটা অতিক্রম করেন এবং কতকটা তিনি পরিবর্তিত করে গ্রহণ করেন৷ এই কাজে তিনি কখনো অন্য মানুষকে দিয়ে কোনো এক্সপেরিমেন্ট করেননি৷ তা সে ব্রহ্মচর্যের উপরই হোক বা আত্মশুদ্ধিকরণের ব্যাপারেই হোক৷ আত্মনিগ্রহ তথা প্রায়োপবেশন দ্বারা তা লভ্য বলে রবীন্দ্রনাথ মানেন না৷ রবীন্দ্রনাথের গান গান্ধিজির পছন্দ৷ সেই গান শুনে তিনি উপবাস ভঙ্গও করেন৷ কিন্তু সত্যসত্যই সেই গানের প্রভাব তাঁর উপর কতটু কু কাজ করে তা ভেবে দেখার মতো৷ রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যদৃষ্টি গান্ধিজির লক্ষ্য বা উপলব্ধ অন্বিষ্ট একেবারেই নয়৷ এতদসত্বেও দুই বিরোধী সত্তা পরস্পরের প্রতি শেষাবধি আকৃ ষ্ট ও আগ্রহী ছিলেন৷ তাঁদের যোগসূত্র হিসাবে এন্ড্রুজ সাহেবের কথা পূর্বে বলেছি৷ রবীন্দ্রনাথ বংশগতভাবে এদেশের সমাজে অপাঙক্তেয় পিরালী শ্রেণির ব্রাহ্মণ বলে গৃহীত৷ এঁদের সীমিত গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে বিবাহাদি সূত্রে যাঁরা আসতেন তাঁরা পূর্ব সম্পর্ক

ত্যাগ করে আসতে বাধ্য হতেন৷ এর কারণ হিসাবে বলা হয় যে কোনো মুসলমান শাসকের কাছে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ কামদেব ও শুকদেব কাজ করতেন৷ হিন্দু মুসলমান সম্পর্কিত যে অনুদারতা তৎকালীন শাসক সমিতি ও শাসিতদের মধ্যেও ছিল তা বোঝা যেত এবং অনুদারতা দ্বারা তাঁর পোষকতাও হত৷ এই শাসকের ক্ষেত্রেও তাঁর অহিন্দু মুসলমান সভাসদগণের উক্তি অনুসারে শাসক মুসলমান সুলতান দ্বারা এক ভ্রাতা নিগৃহীত হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন৷ অপরজনা পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন কিন্তু কু লরক্ষা করতে পারেননি৷ বর্ণহিন্দু কু শারী বন্দ্যোপাধ্যায় গোষ্ঠীর এই ব্রাহ্মণগণ তখন থেকে ব্রাহ্মণদের সমাজে প্রায় অপাঙক্তেয় হিসাবে থাকতেন৷ বিবাহাদির ব্যাপারেও তাঁদের নানাভাবে অসুবিধা ভোগ করতেও হত৷ কিন্তু সুবিধাও যথেষ্ট ছিল৷ শাসকদের সাথে যোগাযোগ থাকাতে তাঁরা সমাজে অর্থকরী কাজ পেতেন৷ থাকত জায়গির ও শাসক সম্প্রদায়ের আনুকূ ল্য৷ কলিকাতায় আগমন করার পরও এই ঠাকু রপরিবার নিজ বিশিষ্টতা রক্ষা করেন৷ তাঁদের পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল নবাব সরকারের উপযোগী৷ মহর্ষি ও তাঁর পুত্রেরা তখনকার দিনের দরবারি পোশাক (পাগড়ি ও আচকান) পরিধান করতেন এবং ইজের বা পায়জামা পরতেন৷ এঁদের আহারাদিও অন্যরকম ছিল৷ কলিকাতায় নিজ জীবনের কালচার ছাড়াও তাঁরা নিজস্ব কিছু স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছিলেন বলে মনে করা যেতে পারে৷ ব্রাহ্মসমাজের একেশ্বরবাদসহ উপবীত বর্জন করাও এই পরিবারের একটা বড়ো অবদান৷ আদি ব্রাহ্মসমাজের সভাপতি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ স্বয়ং৷ তিনি বহুশ্রুত ব্যক্তি এবং জমিদারও৷ তিনিও প্রায় হিমালয় ভ্রমণ করতেন ও দেশভ্রমণে যেতেন৷ তৎকালেও তিনি চীনদেশে যান বলে জানা যায়৷ স্বগৃহে সংগীতের চর্চা ছিল এবং আরও ছিল আরবি ফারসি ভাষায় লিখিত সাহিত্যের পরিগ্রহণও৷ মহর্ষি নিজে সুফি ভাবনায় শান্তি পেতেন৷ তাঁর রচিত ব্রহ্মসংগীতও আছে৷ পুত্র রবীন্দ্রনাথ সুগায়ক ও সুকবি হিসাবে পিতার কাছে সমাদৃত হয়েছিলেন৷ সেইকালেও তাঁর গৃহে পুত্রকন্যাদের প্রতি কাজে, বিবাহ ব্যাপারে তাঁর মতামতই শ্রেষ্ঠ বলে গৃহীত হতো৷ তিনি ছিলেন সকল ব্যাপারে সর্বোত্তম উচ্চ আদালতের মতো একটা ব্যাপার৷ তাই আমরা আশ্চর্য হই না যখন দেখি এই পরিবারের মধ্যম পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম যুগের আই সি এস হন এবং তাঁর স্ত্রী পুত্র কন্যাকে বিলাতে ব্রাইটনে রাখেন শিক্ষাদীক্ষার জন্য৷ আশ্চর্য হই না জেনে যে এই পরিবারের বধূ হিসাবে কাদম্বরী দেবী ঘোড়ায় চড়ে পতি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সহ প্রাতর্ভ্রমণে বার হতেন৷ বোম্বাই থেকে এই পরিবারের বধূরাই বাঙালি মেয়েদের জন্য বাইরে বেরুবার উপযোগী করে শাড়ি পরার ও তদুপযোগী অন্যান্য পরিচ্ছদ পরিধানের ব্যবস্থা করেন৷ বধূদের ও মহর্ষির পুত্রদের স্ব-স্ব বিশিষ্টতা ছিলই৷ সেই মতো তাঁর ঘরে বাইরে কাজকর্ম করার উদ্যোগ নিয়েছেন৷ মহর্ষি কন্যা স্বর্ণকু মারী–সম্ভবত কলেজীয় ষ্ঠি

শিক্ষালাভও করেন এবং উপন্যাস লেখিকা হিসাবেও তিনি প্রতিষ্ঠিতা৷ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পত্নী কাদম্বরী দেবী সত্যকার গুণী ও গুণগ্রাহিকা বা সমঝদার ছিলেন৷ তিনি বিহারীলাল চক্রবর্তীর পাঠক ছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথকেও সমালোচনা করতেন বোঝা যায়৷ এই প্রায়সমবয়সি বধূ ও দেবর রবীন্দ্রনাথ-এর একপ্রকার সৌহার্দ্য ছিল৷ মাতৃ হীন দুই কিশোর দেবরকে ও ভাগিনেয়কে এই বধূ দেখাশোনাও করতেন৷ রবীন্দ্রনাথের ২২ বৎসর বয়সে আপন পতির কোনো ব্যবহারে মর্মপীড়িত হয়ে ইনি জীবননাশ করেন৷ রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, এই তাঁর প্রথমতম মর্মান্তিক শোক৷ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে অভিনয় জগতের নটনটীদের আলাপ পরিচয় ছিল৷ তিনি নিজেও ভালো অভিনয় করতেন৷ এই সূত্রে আমাদের ধারণা যে কোনো পত্রসূত্রে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মন আকৃ ষ্ট হবার ধারণা করে নিয়ে তিনি মর্মান্তিক অভিমানে আত্মহত্যা করেন৷ মনে হয় মহর্ষিকে সেইসময় যথেষ্ট উদ্বেগ ও ভিতরে বাহিরে উপদ্রব সহ পুলিশি ব্যাপারও সামলাতে হয়েছিল৷ এই কষ্টদায়ক ব্যাপার নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বকে কম বিড়ম্বিত করা হয়নি৷ অথচ রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন৷ তিনি নষ্টনীড় ও চোখের বালি গ্রন্থ রচনা করার কালেই মনে হয় নিপুণ হাতে সার্জারি করে নিজ মর্মকে উদঘাটিত করে দেখিয়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এ শোকও অতিক্রম করে গেছেন৷ সেকথা ছিন্নপত্র গ্রন্থে লিখিত আছে৷ তাঁর জীবনের প্রথম প্রকৃ ত শোক তিনি কালক্রমে সহজভাবে বিস্মৃত হন৷ উক্ত রচনাটিতে সেই কথা বিধৃত আছে৷ তাঁর প্রথম শোকও তিনি ভু লে গেছিলেন৷ শোকের স্থানে এসেছিল বিস্মৃতি ও পরিশেষে শান্তিও৷ এছাড়া তাঁর ‘তারকার আত্মহত্যা’ ও আরও কয়েকটি কবিতায় এই বেদনাকর পরিস্থিতির সঙ্গে পাঠক পরিচিত হন৷ রবীন্দ্রনাথ নিজে প্রকৃ ত এক জীবনপ্রেমী ও জীবনরসিকও ছিলেন৷ প্রিয়জন সন্নিধিকে তাঁর মতো আশ্চর্য সুন্দরভাবে যেমন খুব কম লোক গ্রহণ করতে পারতেন, তেমনই ভাবে বেদনাকর পরিস্থিতিকে তিনি এড়িয়ে না গিয়েও আশ্চর্য এক তটস্থ নীতিসহ নিজেকে পরিচালিত করতে পারতেন৷ আমাদের মতে এটাও সেই রবীন্দ্রযানের বিশিষ্টতা এবং রবীন্দ্রায়নের পথে কবির আত্মানুসন্ধান তথা আত্মাবিষ্কারও বলা যায়৷ এভাবেই তিনি বলতে পারেন ‘হেথা হতে যাও পুরাতন’ অথবা বলেন ‘বলো শান্তি বলো শান্তি দেহ সাথে সব ক্লান্তি পুড়ে হোক ছাই৷’ এই কবিই বলতে পারেন তাঁর প্রথম শোককে প্রায় নির্জিত অবস্থায় এনে যে কখন যেন তিনি ভু লেও গেছেন সেই শোকের আর্তি স্মরণেও নেই৷ যা আছে তা হলো বিস্মৃতিজনিত শান্তি মাত্র৷ এসত্বেও কবি সম্বন্ধে বলা যায় তিনি প্রকৃ ত জীবনকে রঙে-রসে নূতন রূপ দিতে পারতেন৷ প্রসঙ্গত মনে পড়ে তাঁর বিশেষ কয়েকটি কবিতার কথা৷ এর একটি হলো গাজিপুরে লেখা৷ কবি প্রেয়সী-সহ গভীর মিলনের একটি

ঋজু সম্ভোগের আশ্চর্য চিত্র দিয়েছেন৷ তেমনই স্মরণে আসে একটি কবিতাও৷ এখানে তিনি বলেন, আকাশ ধরণীর সীমার শেষে স্বর্গ আসিয়াছে নামি সেখানে মিলেছিনু একদা এসে কেবল তু মি আর আমি বিজনে বসেছিনু আকাশে চাহি তোমার হাত নিয়ে হাতে দোঁহার কারো মুখে কথাটি নাহি নিমেষ নাই আঁখি পাতে সেদিন বুঝেছিনু প্রাণে ভাষার সীমা কোনখানে বিশ্বহৃদয়ের মাঝে বাণীর বীণা কোথা বাজে ...বুঝিনু যবে দোঁহে উঠিনু জেগে কাঁদিনু তু মি আর আমি৷ অন্য একটি কবিতাও এখানে স্মরণীয়৷ সেটি পত্নী বিয়োগের অন্তত তিরিশ বছর পরে লেখা৷ জীবন প্রেমিক কবি সত্যকার জীবনরসিক ভোগীও ছিলেন৷ তাঁর বক্তব্য, শোভন হাতের সন্দেশ পানতোয়া মাছ মাংসের পোলাও ইত্যাদিও যবে দেখা দেয়–সেবা মাধুর্যে ছোঁওয়া তখন তা হয় কী অনির্বচনীয়৷ এখানেই তিনি বলে ওঠেন, গদ্যজাতীয় ভোজ্যও কিছু দিও পদ্যে তাদের মিল খুঁজে পাওয়া দায় তবু জেনো তারা কবির পরম প্রিয়

জেনো বাসনার সেরা বাসা রসনায়৷ খাদ্যরসিক কবিই বলতে পারেন, তবুও স্পষ্ট বলিতে নাহিক দোষ যে কথা কবির গভীর মনের কথা উদর বিভাগে দৈহিক পরিতোষ সঙ্গী জোগায় মানসিক মধুরতা পরিশেষে তিনি বলেছেন মৃত পত্নীর নৈকট্য স্মরণ করে, আকাশে চু লের গন্ধটি দিয়ো পাতি এনো সচকিত কাঁকনের রিনিঠিন আনিও মধুর স্বপ্নমদির রাতি আনিও গভীর আলস্যঘন দিন তোমাতে আমাতে নিবিড় মিলিত একা স্থির আনন্দ মৌন মাধুরী ধারা মুগ্ধ প্রহর ভরিয়া তোমারে দেখা তব করতল মোর করতলে হারা৷ আমাদেরও বক্তব্য যে রবীন্দ্রনাথ জীবনকে সত্যকার স্বাদে গ্রহণ করেছেন৷ তাঁকে যেকোনো সম্পর্কে কাছে পাওয়া একটা অখণ্ড আবিষ্কার৷ তাঁর দুর্ভাগিনী কন্যাকে নিয়ে লেখা কবিতা ‘পলাতকা’ ও ‘ফাঁকি’ কবিতা, শমীর মৃত্যুর পরে লেখা কবিতাও সুখদুঃখের বিবিক্তক্ষণে লেখা৷ এমন অজস্র কবিতা আছে যেখানে কবির মানুষী সত্তা সুপ্রকট, যে সত্তা দুঃখ সুখভোগী মানুষের কাছাকাছি লভ্য৷ শমীর মৃত্যুর পর তাই তিনিই লিখতে পারেন, বোলোনা সে নাই... আমি চাই সেইখানে মিলাইতে প্রাণ যে সমুদ্রে ‘আছে’ ‘নাই’ পূর্ণ হয়ে রয়েছে সমান৷ বাস্তবে সাংসারিক বিয়োগজনিত দুঃখশোক তাঁর মতো খুব কম লোকেই পেয়েছেন৷ তবু এই কবি কদাপি পরাজিত হননি৷ মানবিকতা বোধে তিনি প্রত্যেক মানুষকে প্রত্যেকের মতো করেই কাছে এলে পরে কিছু দিয়েছেন৷ এই বৈচিত্র্য সহ তিনি অসামান্য এক মানুষ

আর শেষ পর্যায়ে এই অপরাজিত কবিই বলেন–এই অপরাভূ ত কবিই জীবনের শেষ পর্যায়ে স্বাভাবিকভাবে বলতে পারেন, হয় যেন মর্ত্যের বন্ধন ক্ষয় বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয় পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয় মহা অজানার৷ রবীন্দ্রবাণী রবীন্দ্রানুসরণ ১৯৬২-১৯৬৪-তে আমার কার্যকাল ছিল লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রিত এক অতিথি অধ্যাপক রূপে৷ ভারত সরকার আমাকে সেখানে পাঠান৷ দীর্ঘ দুই বৎসর সাধারণভাবে সাধারণ্যের মধ্যে থেকেছি৷ ওদেশ ও দেশের লোককে দেখার যথেষ্ট সুযোগও পেয়েছিলাম৷ তাতে করে আমার মনে হয়েছিল মানুষ সর্বত্র একই প্রকার হয়৷ যদি মন স্বচ্ছন্দ থাকে তবে মানুষে মানুষের যোগাযোগ ব্যাহত হয় না৷ সর্বত্র তাই মানুষদের কাছাকাছি পেয়েছি৷ বিশ্বাসভাজন মানুষ হিসাবে শুনেছি সেখানকার মানুষের অভাব অভিযোগ যা দেশপ্রেমিক মানুষের মনেও ক্ষোভের সঞ্চার করেছে৷ আর সুবিধাবাদী তথা সুবিধাভোগী লোক তো সর্বত্রই বিদ্যমান৷ কথোপকথনের মধ্যে একজনা বলেছিলেন আমাদের অবস্থা হচ্ছে, পোষা কু কু রের মুখের কাছে লোভের খাদ্য বেঁধে ঝু লিয়ে রাখা এবং এরূপ কষ্টদায়ক tantalising অবস্থায় কু কু রটা সেই খাদ্যের প্রতি বৃথা ধাবমান হতে থাকে, ঠিক তেমনই আমাদের দেশপ্রেমের একটা শপথ আমাদের চোখের সামনে ঝু লিয়ে রাখা হয়েছে জ্ঞানে অজ্ঞানে আমাদের যাত্রা সেদিকেই৷ কথাটা খুব রুক্ষ ও sarcastic সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু শিক্ষিত রুশ মাত্র রাস্কিনের কথা নিশ্চয়ই জানেন–কিন্তু তাদের মন গ্রহণ করেছে পুশকিনকে৷ পুশকিনকে শুধু জাতীয়-কবি বলা নয় চারণ-কবি বলাই সংগত৷ পুশকিনের ইয়েভগেনি আনউইন এদের জীবনের মন্ত্র রুশী শিক্ষিত সমাজ গ্রহণ করেছে পুশকিনকে৷ সেইভাবে পুশকিনের জীবনী, ডু য়েল লড়া এবং মাদাম পুশকিনের যথেচ্ছ স্বৈরাচারসহ পুশকিন ও তাঁর জীবনযাত্রা যেন তৎকালীন রুশ জীবনের আলেখ্যও৷ মাদাম গনচারোভার দৈহিক সৌন্দর্য ছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ঘোর উচ্ছৃ ঙ্খলতা৷ এর ফলে পুশকিন শেষ পর্যন্ত জর্মান কনসালের সঙ্গে প্রণয়ীজনোচিত ডু য়েল লড়েন ও প্রাণ হারান৷ এ বিষয়ে প্রামাণ্য বইও আছে৷ পুশকিন রুশ জীবনের শিক্ষিত সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে রুশী ঠিক ছিলেন না৷ তাঁর পূর্বপুরুষ আসেন দূর আফ্রিকা থেকে৷ তিনি শ্বেতাঙ্গ ছিলেন না৷ সম্রাট এই কৃ ষ্ণাঙ্গ

আফ্রিকার মানুষকে সাদরে গ্রহণ করেন৷ উত্তর জীবনে পুশকিন পরিবার মূল রুশ জনসাধারণ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান৷ তাঁর লেখাতে যথার্থ তৎকালীন রুশ জীবনযাত্রার পরিচয়ও পাওয়া যায়৷ পুশকিনের সমগ্র জীবন অতি প্রবল টেনশনকে এড়াতে পারেনি৷ এই ব্যাপারটাই তৎকালীন রুশ দেশের বিশিষ্টতা৷ অপরপক্ষে রবীন্দ্রনাথ পরিশীলিত ও একান্তভাবে শিক্ষিত মানবসমাজের উপযোগী লেখক হিসাবে শুধু দেশে না, বিদেশেও স্বীকৃ ত৷ অত্যন্ত দুঃখ ও লজ্জা সহ স্বীকার করতে হয় যে বিদেশে আমাদের রাষ্ট্রদূতাবাসগুলির খোলাখুলি মনোভাব হলো– হিন্দির অনুকূ লে ভারতের অন্যান্য ভাষাকে স্বীকৃ তি না দেওয়া৷ স্বয়ং রাহুল সাংকৃ ত্যায়নও এই মতের সমর্থন ছিলেন৷ তাঁর বিশ্বাস হয়েছিল যে ভারতের ভাষা একটাই– তা হলো হিন্দি৷ দুঃখের কথা এই যে স্বয়ং বারান্নিকভের পুত্র অধ্যাপক ও হিন্দি বিশেষজ্ঞ বারান্নিকভ জুনিয়র মহোদয়ও প্রকাশ্যে এ মতকে সমর্থন করতেন৷ তাঁর বক্তব্য ছিল যে আমরা যারা ইংরেজি বলি আমরা যেন একপ্রকার গুলামি মনোভাব থেকে তা করি৷ প্রাচ্যবিদ্যা বিভাগের স্থানীয় হিন্দি বিশেষজ্ঞগণও তাই করতেন এবং হিন্দিভাষী রিসার্চ কর্মীদের সঙ্গে সেইরূপ মনোভাব নিয়ে মিশতেন৷ হিন্দি বিশেষজ্ঞগণ বলতেন যে বাংলাতে কেবল রবীন্দ্রনাথ আছেন অপরপক্ষে হিন্দিতে কত অধিক কবি মিলবে৷ দুঃখ লাগত এই ভেবে যে ভারততত্ব বিভাগে পড়ার ব্যবস্থা ছিল হিন্দি ও উর্দু দুই ভাষা সহ ভারতীয় ইতিহাস৷ দুই বা ততোধিক ভারতীয় ভাষায় পুরো পঞ্চবর্ষী ক্লাস থাকা সত্বেও এরূপ একটা মনোভাব ছিল যেটা খুব বিজ্ঞানসম্মত মনোভাব ছিল না৷ স্বয়ং বিভাগাধ্যক্ষা ছিলেন বাংলা নভেল বিশেষজ্ঞ৷ তিনি বহুবার ভারতে এসেছেন ও স্ব-স্ব কার্যে শান্তিনিকেতনে এবং আচার্য সুনীতিকু মার সকাশে কাজও করেছেন৷ তাঁরা এরূপ মনোভাবকে উপেক্ষা করতেন৷ ১৯৬১ থেকে রবীন্দ্র রচনাবলী-র আংশিক একটা বৃহদংশ অনুবাদের ব্যবস্থা হয়েছিল৷ আমিও তা দেখেছি৷ প্রাচ্যবিদ্যা বিভাগে তখন আদিপর্ব সমাপ্ত হয়েছিল–সভাপর্বও প্রায় শেষ হয়েছিল৷ লেনিনগ্রাদে এককালে বৌদ্ধ মন্দিরও ছিল শুনেছি৷ দুজনা বিশেষজ্ঞ সহ আমাদের পরিচয় ঘটেছিল৷ দুজনার একজনা ছিলেন প্রাচীন চীনা ভাষা বিশেষজ্ঞ, নাম কশকলোভ৷ অন্যজনার নাম হলো পানক্রাতভ৷ ইনি প্রকৃ ত তিব্বতি বৌদ্ধশাস্ত্র পারঙ্গম ছিলেন৷ কিছুদিন তিনি এক লামার কাছে শিক্ষাধীনও ছিলেন৷ নিকোলাস রোরিখ মহাশয়ের সর্ম্পকিত কিছু মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলাম৷ তাঁরাও বৌদ্ধধর্মকে বিশেষ স্থান দিতেন৷ বলা প্রয়োজন যে রোরিখ চিত্রকর হিসাবে মিস্টিক চিত্রকর ছিলেন৷ তাঁর পুত্রেরা যথাক্রমে জর্জ ও স্বেতোস্লাভ রোরিখ চিত্রকর হিসাবে মিস্টিক চিত্রকর ছিলেন৷ তাঁরা দুজনাই ভারতে সুপরিচিত৷

পূর্বোক্ত বিভাগে কাজ করতে করতে জানি ওই বিভাগীয় অধ্যাপক ছিলেন বৌদ্ধ শাস্ত্রবিদ ওল্ডেনবুর্গ মিনায়েভ শ্চারবাস্কই এবং বারান্নিকভ৷ শেষোক্ত জনা মনে করেন Indology বলা তো শুধুমাত্র সংস্কৃ ত নয়, ভারতীয় সকল ভাষার ব্যাপক চর্চাও অত্যন্ত জরুরি৷ বারান্নিকভ হিন্দু বিশেষজ্ঞ হিসাবে সমগ্র তু লসীদাসের রামচরিত মানস-এর দোহা চৌপাই-সমূহ অনুবাদ করেছিলেন৷ তাছাড়াও তাঁর কাজ আছে জিপসি ভাষার বিশেষজ্ঞ হিসাবে৷ ইয়াগ্নভি ভাষার একখানি বই আমি মাইক্রো ফিলম করে এনে এশিয়াটিক সোসাইটিতে দিয়েছিলাম৷ সুরক্ষিত হয়েছে এমন প্রমাণ আজও আমি পাইনি৷ ইয়াগ্নভি ভাষা ফারসি ভাষার কাছাকাছি৷ এই পূর্বোক্ত পরিপ্রেক্ষিতে আমি পড়াতাম সংস্কৃ ত ও বাংলার ভাষাতত্ব ব্যাকরণ, সিদ্ধান্তকৌমুদীর সূত্র, ও শেখাতাম কম্পোজিশন৷ ছাত্রছাত্রীগণ দশটির অধিক নয় বলে ব্যক্তিগত মনোযোগ দিতে পারতাম! এর মধ্যে ৪টি চীনা ছাত্র অন্যগুলি রুশী৷ তাদের একজন মহিলা এবং আর একজনা জিপসি ছাত্র৷ এই বিভাগে প্রকটরিয়াল ব্যবস্থা ছিল৷ সেই কারণে ব্যক্তিগত ব্যাপার অথবা অতিরিক্ত পানদোষজনিত কোনো ত্রুটি ঘটলে পরে বিভাগীয় সেক্রেটারিকে গিয়ে সেসব সামাল দিতে হত৷ আমাদের চীনা ও রুশী ছাত্রছাত্রীরা রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করতেন৷ তাদের প্রায় সকলেই অনুবাদের কথা ভাবতেন কারণ সেটি খুব লাভজনক ছিল৷ এই সময় অর্থাৎ ১৯৬২-৬৪ পর পর রবীন্দ্রজন্মোৎসব ও বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী আমার সামনে এবং সহযোগিতায় সম্পন্ন হয়৷ কিন্তু তা হলেও এসব ছাত্রছাত্রীগণ যে রবীন্দ্রভাবনায় নিষিক্ত ছিলেন তাও তো নয়৷ এই সময়টা রবীন্দ্রকাব্যের বড়ো অংশের অনুবাদের কাজ গ্রহণ করা হয়েছিল৷ তাছাড়া কয়েকজনা কর্মীও রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের অনুবাদ করেছিলেন মনে পড়ছে৷ প্রসঙ্গত আমার একটাই কথা মনে পড়ত৷ তা হলো রবীন্দ্রনাথ ও শিক্ষিত বাঙালি মন যেমন সহজে একত্রিত হতে পেরেছে তেমনটি অন্য কোনো দেশের মানুষের ও কবির মধ্যে সেরকম সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি৷ রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বলা যায়, উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে রাজদ্বারে শ্মশানে চ য তিষ্টতি স বান্ধব বাঙালি মন তার সকল উৎসব পালন করে রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে৷ তাছাড়াও সকল প্রকার রুচির ব্যাপারে, দুর্ভিক্ষের সময় রাষ্ট্রবিপ্লবের সময় রবীন্দ্রনাথই চিরসাথী৷ শত সহস্র বিপ্লবকর্মী কন্ঠে ধারণ করেছেন রবীন্দ্র-রচনা ও গীতার শ্লোক ভিক্ষায় বার হলেও আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাই৷ ফাঁসির আদেশ-প্রাপ্ত তরুণ অবলীলাক্রমে গেয়ে ওঠেন একলা চলোরে অথবা,

সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান সঙ্কটের কল্পনাতে হয়ো না ম্রিয়মান মুক্ত করো ভয়...... বিবাহ জন্মদিনোৎসব এবং যে-কোনো উৎসবে ও বেদনাকর পরিস্থিতিতেও আমরা আশ্রয় নিয়ে থাকি রবীন্দ্রসংগীতের৷ এখানে সকলেই আমরা সত্যকার রবীন্দ্রানুসারী হয়ে থাকি যদিও ঠিকমতো কেউই আমরা রবীন্দ্রযানী নই৷ তাহলে রবীন্দ্রযান কীরকম? তদুত্তরে বলা যায় সৃষ্টিধর্মী ভাবনা নিয়ে পথ চলার ও সেই পথে আত্মাবিষ্কারই হলো রবীন্দ্রযান৷ রবীন্দ্রনাথ যেভাবে নিজেকে নিজের কাছে, দেশের কাছে ও বিশ্বের কাছে জাগ্রত বিবেক হিসাবে দেখতে পেয়েছেন এটা একটা খুবই কঠিন কাজ৷ তিনি তাঁর সময়কার একজনা বিশ্ববিবেকও বটে৷ দেশের সম্মান অক্ষু ণ্ণ রাখার দায়িত্ব তাঁরই৷ জাপানের চীন আক্রমণের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথই নোগুচিকে পত্র দেন৷ নূতন বিশ্বে আগন্তুক সোভিয়েত ব্যবস্থাকে তিনি একদিকে অনুমোদন করেন৷ আবার অপরদিকে তার গতিপ্রকৃ তিতে তাঁর সংশয়ও বর্তমান ছিল৷ সোভিয়েতের ফিনল্যান্ড আক্রমণের তিনি বিপক্ষে ছিলেন৷ অথচ নাজিবাদ ও ফ্যাসিবাদকে যে তারাই একমাত্র রুখতে পারে একথা তিনিই বুঝেছিলেন৷ যে-কোনো অন্যায় ও অসংগতিকে তিনি নিজে মার্জনা করেননি৷ এইভাবে তাঁর আত্মদর্শন হয়েছে আত্মসমীক্ষণের মধ্য দিয়ে৷ অখণ্ড ধারণায় প্রবাহমান বলে সেটা সহজে চোখে পড়ে না৷ বিশ্ববিবেক অথবা ভারত পথিক সকলে হতে পারে না৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাই ছিলেন৷ অপরদিকে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে যারা এসেছিল তারাও যে সকলে রবীন্দ্রমার্গী তাও তো সত্য নয়৷ একটা খুব আশ্চর্য কথা লক্ষ করার মতো৷ এটা হলো রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি যারা যে-কোনো ভাবে এসেছেন তাঁদের মনে হয়েছে জীবন যেন ধন্য বা পূর্ণতর হয়েছে৷ কবির দান বড়ো বিচিত্র রূপের৷ তা পাওয়া রবীন্দ্রানুসরণ যদি বা কেহ করেন তাঁর পক্ষেও রবীন্দ্রযানী হয়ে ওঠা সহজ হয় না৷ মনে হয় অহর্নিশ তিনি একাত্ম হয়েছেন তাঁর সেই জীবনদেবতা সহ৷ তাঁকেই তিনি সতত আবিষ্কার করেছেন জীবনের প্রতিক্ষণে প্রতিকাজে এবং সতত নূতন রূপে তার অভিব্যক্তিকে গ্রহণ করেছেন৷ তাঁর কাজে এতটু কু কোথাও শৈথিল্য নেই৷ কোনো কাজে আলস্য অবহেলাও নেই৷ ভারতবর্ষের মাটিতে এরূপ শস্য বড়ো সুলভ নয়, বিশেষ করে যে সময় রবীন্দ্রনাথ বিদ্যমান ছিলেন৷ তাঁর প্রাণধর্ম ছিল এক অখণ্ড তপস্যার মতো সৃষ্টিমূলক গতিসত্তা৷ জীবনকে সত্য বলে তিনি জানতেন এই গতি দ্বারা৷ সুতরাং এই গতিসত্তাতে যেভাবে পরিবর্তন সাধিত হয়

তাই তাঁর অন্বিষ্ট ছিল বলা যায়৷ তিনি বাস্তবে কোথাও কোথাও পরিবর্তনমুখী হয়েছেন৷ সেটাও হয়েছেন এই জীবনবোধের গতিসত্তা সাপেক্ষে৷ রোমান্টিক অভিযান তাঁর মনোধর্ম হলেও সতত তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অন্ত রাখেননি৷ বারবার উপকরণ বদল হয়েছে সৃষ্টির মাধ্যমে৷ কিন্তু সৃষ্টিমূলক যে পরিবর্তন, তাকে তিনি অনিবার্য বলেই মনে করতেন৷ কবিতার মধ্য দিয়েই তাঁর উত্তরণ ঘটেছে ‘এবার ফিরাও মোরে হে কল্পনে রঙ্গময়ী’ পড়লে তা বোঝা যায়৷ বিশ্বযুদ্ধের পটভূ মিতে, তারও আগে লেখাতে, বুয়র যুদ্ধের কিংবা আফ্রিকার উপর ইয়োরোপীয় আগ্রাসনের উপর লেখা তাঁর সুচিন্তিত রচনা, সৃষ্টিধর্ম থেকে বিচলিত নয় অথচ নূতনত্বে পরিশীলিত এবং উদ্বোধিত৷ সেইখানেই রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্টতা৷ সে বিশিষ্টতা ব্যক্ত তাঁর কবিতায়, ছোটোগল্পে, চিঠিপত্রে, প্রবন্ধে এবং সর্বোপরি তাঁর রসরচনা মাধুর্যে অব্যাহত সৃষ্টিশীলতার মতোই, হাস্যকৌতু কও তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির সহজাত ও আরো এক মাধ্যম৷ যাঁরা তাঁকে শুধু গুরুদেব অথবা পণ্ডিত মহাশয় সাব্যস্ত করেছেন, তাঁরাও তাঁর সম্যক পরিচয় থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেছেন৷ বুদ্ধিবৃত্তির শেষ কথা হলো প্রসন্ন এক প্রকার কৌতু ক৷ এই প্রসন্ন কৌতু ক সবকিছুকে মার্জনা করে এবং মার্জিত করে৷ এই কথাই সম্ভবত তাঁর প্রাণ ধর্মের ও জীবনদর্শনের শেষ কথা– তবু যেন হেসে যাই যেমন হেসেছি বারে বারে পণ্ডিতের মূঢ়তায় ধনীর দৈন্যের অত্যাচারে সজ্জিতের রূপের বিদ্রূপে ... মানুষের দেবতারে ব্যঙ্গ করে যে অপদেবতা, তারে হাস্য হেসে যাব বলে যাব মূঢ় অপব্যয় গ্রন্থিতে পারে না কভু ইতিবৃত্তে শাশ্বত অধ্যায়৷ অন্যত্রও তিনি বলতে পেরেছেন, দুঃখ পেয়েছি দৈন্য ঘিরেছে অশ্লীল দিনেরাতে হেরেছি কু শ্রীতারে মানুষের প্রাণে বিষ মিশায়েছে মানুষ আপন হাতে ঘটছে তা বারে বারে৷

তবু তো শ্রবণ বধির করেনি কভু বেসুর ছাপায়ে সুর কে দিয়েছে আনি পরুষ কলুষ ঝঞ্ঝায় শুনি তবু চিরদিবসের শান্ত শিবের বাণী৷ এই বাণীর উদভাসকে তিনি প্রতিক্ষণে অনুভব করেছেন৷ কর্মময় জীবনের পরিবর্তিত মাধ্যমে এক থেকে অন্য শিল্পে সহজে উত্তীর্ণ হয়েছেন৷ তাঁর চিত্রকলাও আশ্চর্য ও অপরূপ৷ কোনো এক মনীষী রবীন্দ্রচিত্রায়ণ ব্যাপারটাকে কবির প্রচ্ছন্ন ও অবরুদ্ধ প্রবৃত্তির প্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন৷ সে মন্তব্যও আংশিকরূপে গ্রাহ্য করার মতো৷ রবীন্দ্র চিত্রায়ণও একপ্রকার নবীন শিল্পায়ন৷ তার দ্বারা তিনি নিজ চিন্তাভাবনাকে অগ্রগামী করেছেন৷ সর্বোপরি কবির মানবসত্তাটি অক্ষু ণ্ণ থেকেছে৷ একটি সাধারণ গৃহের সাধারণ সুখদুঃখের অংশ পাবার জন্য তাঁর ইচ্ছা তাঁকে বলিয়েছে, আমি তো ভাবি তোমারও ঘরে ছিল আমারও দাবি হারায়ে ফেলেছি তা ঘুর্ণীবায়ে অনেক কাজ আর অনেক দায়ে রবীন্দ্রনাথ তাই আমাদের মতো মানুষের অনেক আশ্বাস ও সান্ত্বনার স্থল৷ তিনি যে দূরের কেহ নন এই বিশিষ্টতাই তাঁর সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠদান৷ মানুষের জন্য ভারতের জন্য এবং অবশ্যই ভাগ্যবান বাঙালিজনের জন্য যাঁর তাঁর লেখা পড়ার সৌভাগ্য পান৷ পূর্বানুবৃত্তি সংক্ষেপণ রবীন্দ্রনাথ শব্দটির চীনা অনুবাদ হলো মেঘমন্দ্রিত সূর্যদেব (রবি + ইন্দ্র + নাথ)৷ প্রত্যেকটি শব্দ নিজ অর্থে বিশিষ্ট ও ঐশ্বর্যবাচক৷ এমনিতেই রবি বা সূর্য এখনও পর্যন্ত মানব সংস্কৃ তির ইতিহাসে অখণ্ড গৌরবে বিরাজমান৷ মানবজাতির বিজ্ঞানসাধনা শুরু হয়েছে মনে হয় সূর্য ও তার উদয়াস্ত পর্যবেক্ষণ করে৷ আজও এ পৃথিবী সূর্যমুখী৷ সূর্যকে প্রত্যক্ষপরোক্ষে দেবতা বলে উপাসনা করে এমন দেশও আছে৷ ভারতও তার মধ্যে অন্যতম৷ সূর্যসদৃশ রবীন্দ্রনাথও শিক্ষিত মানসে এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী৷ এটা শুধুমাত্র এক শান্তিনিকেতনের ক্ষেত্রে সীমায়িত নয়৷ যত বয়স হয়েছে তিনি তত পৃথিবীর তাবৎ দেশের সম্পর্কিত হয়েছেন৷ নিজের মধ্যে সতত আত্মোত্তরণ ঘটেছে৷ সে অভ্যুদয়ের ইতিহাস তাঁর সমগ্র রচনার অধ্যয়ন থেকে সূচিত হয়৷ বিশ্বের ইতিহাসে এক

অনন্যসাধারণ মানুষ হিসাবে তাঁর অবস্থান৷ তিনি তাই সকল দেশের সকল মানুষের পক্ষেই একটি যুগোপযোগী আশ্চর্য বিশিষ্টতাসম্পন্ন একজন মানুষ৷ তিনি যে গুরুদেব মাত্র নন তিনি যে মহাত্মা নন তিনি যে সুখদুঃখ সমন্বিত একজনা মানুষ একথা আমরা বিস্মৃত হতে পারি না৷ এইটাই তার বৈশিষ্ট্য৷ সেইখানেই তাঁর মহৎ কৃ তিত্ব যে তিনি শেষাবধি মানুষের সহযাত্রী৷ সেই সহযাত্রার পথে সতত তাঁর জীবনপথের বিস্তৃ তি উদ্ভাসিত হয়েছে৷ বিশ্বের তথা বিশ্বমানুষের পরিচয় সূত্রে তিনি একদিকে তাঁর নিজস্ব পথে ক্রমোত্তরণ করে চলেছেন আর অপরদিকে দেশে ও বিশ্বে তাবৎ ঘটনা সহ পরিচয়সূত্রে বোধিলাভ করে চলেছেন৷ আধুনিক ও বিজ্ঞানসচেতন মন নিয়ে তিনি রচনা করেছেন বিশ্ব-পরিচয় এবং শিশুপাঠ্য পুস্তক সহজপাঠ৷ প্রতি ক্ষেত্রেই কবির পদক্ষেপ একটি নূতনত্বের সূচনা করেছে৷ ভাষাতত্বের বিচারেও সেই একই কথা লক্ষণীয়৷ নূতনকে গ্রহণ পরিবেশন তাঁর কৃ তিত্ব৷ আর এসব সত্বেও তিনি বারবার বলেছেন–কবিরে পাবে না তার জীবনচরিতে৷ রবীন্দ্রনাথ আলোর মতো সর্বব্যাপক এক প্রকাশসত্তা৷ প্রকাশ করা এবং অবশ্য প্রকাশিত হওয়া তাঁর কাব্যপ্রাণের প্রেরণা৷ সে কবিতার আলম্বন যাই হোক৷ ঈশ্বরপ্রেম, মানবপ্রেম, প্রকৃ তিপ্রেম প্রতিটিই একভাবে মিলিত-মিশ্রিত রূপ পরিগ্রহ করে পাঠক সমীপে উপস্থিত হয় ও তাকে তত্বভাবে প্রণোদিত করে৷ সৃষ্টিধর্মী শিল্পী হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে কখনো তাই একইরকম বা পুনরাবৃত্তি মনে হয় না, এইটি খুব আশ্চর্যজনক৷ তাঁর কাছে সকল কাজ সকল রচনা এবং সকল প্রকার শিল্পই একপ্রকার নূতন পথ চলার প্রেরণা থেকে উপলব্ধ এবং কোনো না কোনোভাবে নূতনের বার্তাবাহক৷ তাঁর কাছে সতত সত্য একটাই কথা–সেটা হলো, তু মি নব নব রূপে এস প্রাণে এস গন্ধে বরণে গানে আর একটা কথাও রবীন্দ্ররচনায় লক্ষ করার মতো৷ সেটা হলো একটা সত্যম বা ঋতমের সৃষ্টির আনন্দ যে একমাত্র প্রেরণা সেটি তাঁর রচনায় সতত উদ্ভাসিত হয়ে আছে৷ এই ঋতম কথাটি বৈদিক যুগ থেকে মূলনীতিগত ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে আছে৷ একই সাথে যখন বলা হয়েছে সত্যং বদিষ্যামি ঋতং বদিষ্যামি–তখন তার অর্থ নিশ্চয়ই ভিন্ন৷ সত্য যদি বাস্তব ও আশ্রিত চিন্তার সাযুজ্য নির্ণয় করে ঋতম আরো একটা গভীরতর সত্যের কথা আমাদের স্মরণ করায়৷ জীবন ব্যাপারটাই একটা আশ্চর্য ধরনের সংঘর্ষ ও সমন্বয় নিয়ে প্রবাহিত৷ সম্ভবত এই কারণেই রবীন্দ্ররচনায় কাব্য বাদ দিলে এক প্রকার ট্র্যাজেডি বা বিয়োগান্তিকতা বিদ্যমান৷ তা তাঁর যে-কোনো উপন্যাস বা দীর্ঘ কাব্যনাট্যগুলির মধ্যেও প্রকটিত হয়ে আছে৷ এই ঋতম যা poetic justice-এর কারণে ঘরে বাইরে উপন্যাসের নিখিলেশ জীবিত ঘরে ফেরে না অথবা সন্দীপ বিমলাও মিলিত হয় না৷ চার অধ্যায়-এ

এলা ও অতীন্দ্রর tragedy স্বতোদ্ভাসিত৷ শেষের কবিতা, দুই বোন, মালঞ্চ আখ্যায়িকাতে তো বটেই, পূর্বেকার লিখিত চোখের বালিতে ও অথবা যোগাযোগ উপন্যাসেও এ সত্য বর্তমান৷ মানবিক ত্রুটি বিচ্যুতির কারণে যতই আর্থসামাজিক ধারণা ঘটিত হোক না কেন মানুষই হয় তার লক্ষ্য বা উপলক্ষ্য দুই-ই৷ নৈতিক দায়িত্ব মানুষকে ছায়ার মতো অবিচ্ছিন্নভাবে যেন জড়িয়ে থাকে৷ শেষের কবিতা-য় একটা দুর্বল প্রয়াস ঘটিয়েছেন কবি যেটা বিয়োগান্তক হলেও যেন বিশেষ উপভোগ্য মনে হয়৷ অপরদিকে আছে নৌকাডু বি-র মতো, গোরা-র মতো মহৎ কৃ তিত্বসম্পন্ন উপন্যাসও৷ এ দুটিতে কোনো আর্থসামাজিক বিপ্লব সূচিত হলেও তত্তৎ কারণে নৈতিক দায়িত্ব ততটা প্রকটিত নয়৷ যেটু কু আছে সেটু কু দ্বারা উপন্যাসের অথবা চরিত্রগুলির গৌরব কোথাও ক্ষয়িত হয়নি৷ কিন্তু কবি বেদনাকর যে-কোনো পরিস্থিতিসহ ঘটনাকে মোড় ফেরাতে সিদ্ধহস্ত বলা চলে৷ এই কারণে গোরাতে আনন্দময়ী সকল প্রকার বিচারের ঊর্ধ্বে থেকে যান এবং নৌকাডু বির কমলা, হেম ও নলিনাক্ষ আপন আপন মনোজগতের আহ্বান শুনে নিজ নিজ আত্মিক শোধন তথা জয়পরাজয় নির্ণয় করে৷ অবশ্য একটা কথা এখানে বলা বা স্মরণ করা প্রয়োজন যে গোরা-র মতো এমন মহৎ উপন্যাস বর্তমানেও রচিত হয়নি৷ গোরাতে বর্ণিত কার্যকারণশৃঙ্খলা সহ বাস্তব অবাস্তব বহু ঘটনার একত্র সমাবেশ ঘটেছে অথচ কোথাও যেন তার রসভঙ্গ হয়নি৷ অপরদিকে আমরা জানি যে গোরা উপন্যাসের মধ্যে তৎকালের বহুচিত্র বাস্তবে যেন বিধৃত হয়ে আছে৷ গোরার সংকীর্ণতা ও তা থেকে মুক্তিসাধনা আমাদের চোখে পড়ে৷ গোরা-র মুক্তি ভারতীয় মানসের মুক্তি৷ এ মুক্তি দেশকালপাত্রসাপেক্ষ হলেও যেন তার চেয়ে কিছু বেশি বলে মনে করার মতো৷ সকলের চেয়ে আশ্চর্য বলিষ্ঠ চরিত্র আনন্দময়ীর৷ তাঁর নামও সার্থক৷ তাঁর চরিত্র বিস্ময়কর৷ অথচ কোথাও তাঁকে বিসদৃশ বা বেমানান মনে হয় না৷ গোরা তাঁর পালিত পুত্র হিসাবে গভীর স্নেহ লাভ করেছে৷ কিন্তু গোরা যে তাঁর পালিত পুত্র মাত্র একথা মনে করার অবকাশ পাঠকের হয় না৷ তবে এটা আশ্চর্য লাগে যে, গোরা যে পরিস্থিতিতে মানুষ হয়েছে সেই পরিস্থিতিসহ আমাদেরও স্বাভাবিক পরিচয় ঘটে৷ গোরা-তে তথাকথিত ঋতমের উপলব্ধির মতো জীবনের একটা আদর্শ প্রতিফলন ঘটছে মনে হয়৷ গোরা যেন এক জন্মেই কয়েক জন্ম পার হয়ে যায়৷ রবীন্দ্রনাথ জীবন প্রেমিক কবি তথা মনীষী দার্শনিকও ছিলেন বলা যায়৷ বিচিত্র তাঁর গতিপ্রকৃ তি৷ গ্রামের উন্নয়ন থেকে কৃ ষিবিদ্যা তথা কারুশিল্পের ব্যবস্থা করার কথা তিনি নিজ অবস্থার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর কথা ভেবে এবং যেখানে ছিলেন সেই স্থানের কৃ ষকসমাজের অবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিলেন৷ তখন কমিউনিটি প্রোজেক্ট-এর কথাও কেউ শোনেনি৷ শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার হেরফের সহ বিশিষ্ট চিন্তামূলক প্রবন্ধাদি লেখেন এমন সময় ঠে

যখন ইংরাজের প্রদত্ত অশিক্ষা কু শিক্ষা সহ একটা ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজ তৈরি হয়ে উঠেছিল৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে তিনি অন্য রূপ দিতে চেয়েছিলেন–যার ফল কতকটা দেখা যায় বর্তমানের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে–এককালে যেটাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়েছিল৷ ইংরাজের কৃ ত আইনের বারবার তিনি সংশোধন চান বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে একথা স্মরণ রাখা দরকার৷ তাঁর বিশ্বভারতী শুধুই শিক্ষাসত্র ছিল না৷ এখানে তিনি বিশ্বের তাবৎ মনীষীদের আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন, যাতে এদেশের চিন্তাবিদ মানুষ ওদেশের গবেষক পণ্ডিতের ধারা অনুসরণ করে লাভবান হয়৷ তিনি যা চেয়েছিলেন তা হয়নি৷ পাওয়া যায়নি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উপযুক্ত সহায়তা অথবা সহযোগ৷ এটা বোঝা যায় মাদাম লেভির ডায়েরি থেকেও৷ উপস্থিত থাকতেন কবি নিজে এবং ক্ষিতিমোহন সেন সহ বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয়ের মতো পণ্ডিত৷ পড়াতেন ক্লাস নিতেন এন্ড্রুজ, কলিন্স প্রভৃ তি মনীষীগণ৷ ক্লাস নিতেন তৎকালীন সুখ্যাত আর্টিস্ট মহিলাগণ৷ এছাড়া স্বয়ংসম্পূর্ণ ডেয়ারি, তাঁত ও অন্যান্য নানা কারুশিল্পের প্রচলন প্রবর্তন তিনিই করেন৷ তিনি কোনো উৎকট সমাজ সংশোধন করতে চাননি৷ কিন্তু শান্তিনিকেতনে আন্তর্জাতিক বিবাহ থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব মনোনয়নে বিবাহকার্য সুসম্পন্ন হতো৷ এটাও একটা সুপরিকল্পিত সমাজ উন্নয়ন ব্যবস্থা৷ মেয়েদের নৃত্য, ছাত্র ও ছাত্রীদের একত্র সম্মেলক সংগীত ও অভিনয় পরিকল্পিত হয়৷ কবি স্বয়ং সেখানে উপস্থিত থাকতেন৷ নৃত্যের ক্ষেত্রেও এই মিশ্রিত ব্যবস্থা হয়েছিল৷ খাওয়া ছোঁওয়ার ব্যাপার প্রথমদিকে ছিল৷ পরে সাধারণ কিচেনে সকলেই খেতে অভ্যস্ত হন৷ অবশ্য শ্রদ্ধেয় বিধুশেখর শাস্ত্রীর মতো লোকের কথাই পৃথক৷ তিনি মহম্মদ আলিকে হাতে ধরে খানা কামরায় নিয়ে চলেছেন যদিও তিনি খেতেন সম্পূর্ণভাবে স্বপাকে৷ রবীন্দ্রনাথ চাইতেন যার মধ্যে যা শুভ আছে সেই সব গুণ যেন প্রকট হয়৷ আর তার সাথে চাইতেন যেন উপর থেকে কোনো ভাবনা কারো উপর না চাপানো হয়৷ তা সে কারুশিল্প অভিনয় সংগীত নৃত্য এবং চারুকলা এগুলো প্রত্যেকটি সম্পর্কেই সত্য৷ পরিশেষে একটাই কথা আমার মনে হয় তাঁর নিজেরই উক্তিতে আছে এসব সত্বেও ‘কে পারে আমায় ধরিতে– কবিরে পাবে না তার জীবন চরিতে৷’ কিন্তু তাই পাওয়া যায়৷ অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেও তাঁকে পাওয়া যায়৷ রুগণ পত্নীর শয্যাপার্শ্বে জাগ্রত কবি হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করছেন– ইলেকট্রিক পাখার ব্যবস্থা তাঁর হয়নি৷ রুগণ কন্যার জন্য ঔষধ আনার কারণে দাতব্য চিকিংসালয়ে প্রতীক্ষমাণ পিতাকেও দেখা যাবে৷ শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু তাঁকে বিশেষ ক্লেশ দেয়৷ মীরা দেবীর দুর্ভাগ্য সতত তাঁকে কষ্ট দিয়েছে৷ ৪১ বৎসর বয়সের পত্নীহারা কবি আশ্চর্যভাবে জীবনসংগীতকে পরিচালিত করেছিলেন৷ কারোকে কোনো অবস্থাকে ফাঁকিতে এড়িয়ে যাননি এই তাঁর বৈশিষ্ট্য৷ এটা

ঘরে-বাইরে সর্বত্র তিনি পরিপাটিরূপে পালন করেছেন৷ এই নিয়ম তিনি বজায় রেখেছেন তাঁর ভারত ও বিশ্বের নানা সম্পর্কের অনুশীলন পরিশীলনেও৷ সমস্ত জীবন যেন তাঁর এক উজ্জ্বল ও ভাস্বর মহাসংগীতের মতো ঊর্ধ্বমুখী এবং উঠেছে এই আশ্চর্য পৃথিবীকে সর্বত্র স্বীকৃ তি দিয়ে এবং কিছুকে না অস্বীকার করে৷ আরও একটা মহৎ আশ্চর্য স্মরণীয়৷ বুদ্ধদেব বসু তাঁর গ্রন্থে শান্তিনিকেতনকে সব পেয়েছির দেশ বলে উল্লেখ করেছেন–সার্থক এই পরিচিতি, সন্দেহ করি না৷ কথায় বলে কর্ম ও কর্মফল স্বোপার্জিত৷ যদিও বিশেষ রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ এক বিশিষ্ট সুশিক্ষিত সুদীক্ষিত পরিবারের সন্তান হিসাবে কিছু সুবিধাগ্রস্ত হয়েই জীবনারম্ভ করেন৷ তৎসত্বেও তাঁর দিন কেটেছে শৈশব কৈশোরের আদিযুগে নিতান্ত ভৃ ত্যতান্ত্রিক পরিবেশে৷ এইভাবেই তাঁরা গড়ে উঠেছেন৷ এর সাথে যুক্ত হয়েছে ঠাকু রবাড়ির অলিগলি সমন্বিত বিরাট আকার৷ এটা তাঁর মনে অলৌকিকের সাড়া জাগাত৷ যা জাগাত তাঁদের বাগানের অবহেলিত কয়েকটি গাছ৷ এবং ব্রাহ্মধর্মের পিতা নোহসি মন্ত্রের উদগাতাও৷ প্রায় সাকার প্রকাশ তিনি পেয়েছিলেন পিতা মহর্ষির মধ্যে৷ সুফি ভাবনা, সংগীতচর্চা, কসরত, গৃহশিক্ষকের সঙ্গে পাঠগ্রহণ এগুলি সবই নিয়মিতভাবে তিনি গ্রহণ করতেন৷ এটা বাস্তবিক সত্য যে রবীন্দ্রনাথ একজন যুগপুরুষ৷ তাঁর মধ্যে সাড়া পায় বহু নরনারীর ইপ্সিত সাধনা ও প্রয়াস৷ আমরা যা বুঝতে পারি না সে ভাষা আছে তাঁর অধিকারে৷ তাই রবীন্দ্ররশ্মি সর্বত্রব্যাপী রূপে সকল চিত্তকে আনন্দ শান্তি এবং সহায়তা দিয়ে থাকে, প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে উভয়ত৷ যেমন এখন তিনি নাই কিন্তু তাঁর রচনা চিরসুহৃদ রূপে আছে৷ রবীন্দ্রনাথের কথা বলা তো ফু রোবে না৷ যেভাবে হবে যখন হোক ৯/১০ বৎসর বয়স থেকে রবীন্দ্রানুসরণ করে আসছি খ্রিস্টানুশীলনসহ৷ দুটোর মধ্যে বিরোধ কখনো বোধ করিনি৷ তবু যদি আমায় প্রশ্ন করা যায় যে রবীন্দ্ররচনার অনুশীলন পরিশীলন প্রধানতম লক্ষ্য লভ্য কি হয়েছে? তার উত্তর আমার কাছে একটাই৷ এটা হলো একপ্রকার পরিপূর্ণতা–যা তাঁর ছিল–যা তিনি স্বীয় প্রয়াসে সতত লাভ করেছিলেন এবং ঠিক তত্তৎভাবে নিজ মানুষের কাছে উপলব্ধ হতে পেরেছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথ কোথাও পলাতক রোমান্টিক কবি হননি এইটাই আমাদের পরম ভাগ্য৷ তাই আমরা জন্ম থেকে মরণ পর্যন্ত রবীন্দ্রসাহিত্যে অবগাহন করার সুযোগ পাই৷ দুঃখে দুর্বিপাকে বিষাদ সম্পদে তিনি আমাদের চিরসাথী৷ আবার বিদেশে অগণিত অপরিচিতের মনে তিনি অবিসম্বাদী এক মহাজন৷ তাঁর উচ্চারণ দিয়ে শুরু হয় জর্মনির Linguistics Class –তাঁর মোহভঙ্গ হয় ইটালির ফর্মিকী তথা মুসোলিনীর চক্রান্তে৷ তিনি নিজেকে মুক্ত করেন সেই জাল থেকে রমাঁ রঁলার সহায়তায়৷ বিশ্বসভায় বিশ্বকবির পরিক্রমার বিবরণে ঠা

রানী মহলানবিশ জানিয়েছেন যে তাঁদের পাঠানো রিপোর্ট সতত প্রকাশিত হয়নি৷ প্রশ্ন থেকে যায়–সেগুলির কি হল! উত্তর একমাত্র আছে৷ সেটা হলো তথাকথিত চু রি যাওয়া৷ এইকারণে স্বর্গের কাছাকাছি গ্রন্থে মৈত্রেয়ীদেবী এঁদের দায়ী করেন৷ তদুত্তরে রানী চন্দ বিশ্বসভায় বিশ্বকবি গ্রন্থ লিখে যথাসাধ্য এ বিষয়ে আমাদের অবহিত করেন৷ এই দুটি গ্রন্থেই রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত ঘরোয়াভাবে বিদ্যমান৷ ব্যক্তিগতভাবে আমার একটি কথাই মনে হয়৷ তা হলো ‘মক্ষিকাও গলেনাগো পড়িলে অমৃতহ্রদে৷’ রবীন্দ্রনাথ আমাদের মতো মক্ষিকার কাছে অমৃতহ্রদবৎ৷ জগতেও৷ মহর্ষি যে তাঁকে শান্তিনিকেতনের সমগ্র ভার দিয়েছিলেন তা সফল হয়েছিল বহুলাংশে৷ আজও তাই পৌষমেলায় সেখানে মেলা বসে, নানা জিনিসের বিক্রয় হয়৷ সাঁওতাল গ্রামের লোকদের ও বাউল সমাজের নাচগান সহ এ মেলা জমে ওঠে৷ বিক্রিটা হয় তা স্থানীয় বস্তুই হোক বা বিশ্বভারতী কেন্দ্রের প্রস্তুত কিছু হোক৷ এখনও এ স্থান বিদেশি পর্যটকের কাছে তীর্থদর্শন রূপ৷ পূর্বেই আমরা তাঁদের নাম করেছি প্রসিদ্ধ বিদেশি ও মনীষী হিসাবে৷ অপরদিকে ভারতীয় মনীষীরা বহুজনা এখানে তাঁদের কর্মসংস্থান করেছেন–পরে এখানেই থেকেছেন৷ বঙ্গভাষা ও রবীন্দ্রনাথ তাঁদের আপনজন হয়েছেন৷ অথচ বঙ্গভাষা তো সমগ্র ভারতে স্বীকৃ ত হয় না৷ দ্বিতীয় যে কথাটা আমার মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে সেটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত মাত্র৷ তবুও তা পাঠক সমীপে আনয়ন করতে চাই৷ উপনিষদের একটি শ্লোক এখানে স্মরণীয়–সেটি হলো, পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমদুচ্যতে পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে এই দৃষ্টিতে দেখে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ পরিপূর্ণ তাই তাঁর যাকে যা কিছু দেওয়া হয় সেও পরিপূর্ণ৷ এসব সত্বেও যা থাকে তাও পরিপূর্ণ কারণ পূর্ণতা মানেই তাই৷ রবীন্দ্রসকাশে ঘরে পরে নিকট বাহিরে আত্মীয় অনাত্মীয় যাঁরা গেছেন তাঁরা এই বিস্ময়কর এক পরিপূর্ণতার স্পর্শ পেয়ে ফিরেছেন৷ জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা পূর্ণের পদ-পরশ তাদের পরে৷ ৩৪ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, ২০০০

রবীন্দ্রনাথ ও টমসন পত্রাবলির ভূ মিকা উমা দাশগুপ্ত পশ্চিম জগতের সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথের প্রথম নিকট পরিচয় ১৯১২-১৩-তে৷ সেই সময়ে কিন্তু ইংরেজ কবি এবং শিল্পী ইংরেজি অনুবাদে তাঁর রচনা প্রচারের আয়োজন করেছিলেন৷ সেই সময়েই আবার ভারতবর্ষে কিছু ইংরেজ বন্ধু রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম এবং শিক্ষাকর্মের বিশেষ অনুরাগী হয়েছিলেন৷ এইরকমের প্রথম অনুরাগী ইংরেজ বন্ধু ছিলেন এডওয়ার্ড টমসন৷ টমসন নিজেও একজন ইংরেজ কবি৷ ১৯১০ থেকে বাঁকু ড়ায় বাস করছিলেন৷ সেখানকার মেথোডিস্ট মিশন ইস্কু লের ইংরেজ ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন৷ বাঁকু ড়াতে টমসন বাংলা শিখতে শুরু করেন৷ রামপ্রসাদের সাহিত্য থেকে শরৎসাহিত্য পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যধারার সঙ্গে তাঁর কিছু পরিচিতি হয়েছিল৷ কেন্দ্রে ছিল রবীন্দ্রসাহিত্য৷ পরবর্তীকালে টমসন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বাংলার অধ্যাপক নিযুক্ত হন৷ এই সূত্রে ১৯২৪-এ তিনি ভারত ছেড়ে ইংলন্ড ফেরেন এবং সেই সঙ্গে মেথোডিস্ট মিশন পরিত্যাগ করেন৷ মেথোডিস্ট মিশন বা খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার টমসনের পারিবারিক ইতিহাসের অঙ্গ৷ তাঁর পিতাও ছিলেন ভারতবর্ষে ধর্মপ্রচারক৷ ১৮৯৪-তে আকস্মিকভাবে টমসনের পিতৃ বিয়োগ হয়৷ তাঁর তখন মাত্র আট বছর বয়স৷ পরিবারের এই বিপর্যয়ের ফলে টমসনকে অতিদ্রুত কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হয়৷ পিতার মতন তাঁকেও মেথোডিস্ট পাদ্রি হয়ে ভারতবর্ষে আসতে হয়৷ কিন্তু পাদ্রিজীবনে টমসন সুখী ছিলেন না৷ নিজের মতো করে ভারতবর্ষকে জানতে চেষ্টা করেছিলেন, বিশেষ করে ভারতের চিন্তাধারা ও সাহিত্য৷ তিনি বিশ্বাস করতেন ইংরেজ শাসনকর্তারা সেইভাবে ভারতকে জানতে চেষ্টা করেননি৷ তার জন্য ভারতের শিক্ষিত মানুষ ক্ষু ব্ধ৷ টমসন তাঁর পারিপার্শ্বিক জানবার জন্য উৎসুক হয়েছিলেন৷ সেই কারণে বাঁকু ড়াতে থাকাকালীন তিনি প্রকৃ তিকে আপন করে নেন এবং বাংলা সাহিত্যকে তাঁর সাধনার বস্তু করেন৷ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থটির১ ভূ মিকায় লেখেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং নাটকের বিষয়েই আমার এই গ্রন্থ৷ তাঁর কবিতা এবং নাটকের আয়তন প্রায় এক লক্ষ ছত্র৷ এছাড়া নাটকের বাইরে তাঁর অন্যান্য গদ্যরচনা বর্তমানে সংকলিত হচ্ছে৷ কাব্য এবং নাটকের তু লনায় তাঁর সেই গদ্যের পরিধি দ্বিগুণেরও বেশি৷ আমি এই অসম্ভব গবেষণার দায়িত্ব গ্রহণ করেছি একটি

কারণেই৷ আমি এই সমাজের মানুষকে, যাদের মধ্যে আমি আজ বাস করছি, জানতে এবং বুঝতে চাই৷২ ১৯২৪-এ ইংলন্ডে ফিরে গিয়ে এই পঠনপাঠনেই টমসন নিজেকে নিবেদন করেন৷ এই পর্যায়ে বাংলা সাহিত্য, মূলত রবীন্দ্রসাহিত্য, কিছু সংস্কৃ তসাহিত্য, তাঁর পঠনপাঠনে প্রধান স্থান অধিকার করে৷ সেই সঙ্গে আসে ভারতবর্ষের ইতিহাসে তাঁর আগ্রহ এবং নিজস্ব অভিজ্ঞতায় দেখা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সামাজিক ছবি৷ ইংরেজের উপনিবেশ ভারত এবং চিরন্তন ভারত, এই দুই ভারতবর্ষ সম্পর্কেই টমসনের মনে নানা প্রশ্ন ছিল৷ তিনি সতীদাহ নিয়ে লিখেছিলেন, শাক্তপদাবলী বিষয়ে লিখেছিলেন, ঔপনিবেশিক ভারতীয় সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের জীবনকে কেন্দ্র করে নাটক রচনা করেছিলেন, ভারতে ইংরেজ শাসনের ইতিহাস লিখেছিলেন, আবার স্বাধীনতা আন্দোলনের চূ ড়ান্ত সময়ে লিখেছিলেন Enlist India for Freedom (1940) নামক পুস্তিকাটি৷ রবীন্দ্র-বিষয়ক রচনা ছেড়ে দিলে ভারতবর্ষে তাঁর সবচেয়ে নামী গ্রন্থ ১৯২৫ সনে প্রকাশিত সিপাহী বিদ্রোহ বিষয়ে The Other Side of the Medal৷ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে টমসন দুটি প্রধান রচনার লেখক৷ এছাড়া তিনি রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কবিতা অনুবাদ করে আলাদা সংকলনে প্রকাশ করেছিলেন ১৯২৪ সনে A Curse at Farewell বা ‘বিদায় অভিশাপ’ কবিতাটির অনুবাদ, ১৯২৫ সনে দুটি নির্বাচিত কবিতার সংকলন Selections এবং 22 Poems ৷ তাঁর প্রধান দুটি রচনা Rabindranath Tagore His Life and Work (1921) এবং Rabindranath Tagore Poet and Dramatist (১৯২৬)৷ এই দুটি গ্রন্থ ভারতবর্ষে থাকাকালীনই লিখেছেন যদিচ দ্বিতীয় রচনাটি ইংলন্ডে ফিরবার পরে প্রকাশিত হয়৷ এই দু’টি গ্রন্থের আরো দুটি সংস্করণ ক্রমে প্রকাশিত হয়, ১৯২৮-এ Rabindranath Tagore His Life and work দ্বিতীয় সংস্করণ এবং ১৯৪৮ সালে, টমসনের মৃত্যুর দু’বছর পরে, Rabindranath Tagore Poet and Dramatist, দ্বিতীয় সংস্করণ৷ এই দুটি সংস্করণই টমসন নিজে সংশোধন করেন৷ রবীন্দ্রচর্চায় টমসনের এই সাধনা অবিচ্ছিন্ন, ১৯১৩-তে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাতে শুরু এবং টমসনের মৃত্যুর পরে ১৯৪৮-এ প্রকাশিত গ্রন্থটিতে শেষ৷ তখন পর্যন্ত, দেশে বা বিদেশে, এই সাধনার তু লনা মেলেনি৷ টমসন চেয়েছিলেন পশ্চিম রবীন্দ্রনাথকে চিনুক এবং ঠিকভাবে চিনুক৷ হয়তো শেষ পর্যন্ত সেই ঠিকভাবে চেনা হয়নি৷ কিন্তু চিনিয়ে দেবার চেষ্টায় টমসন জীবন উৎসর্গ করেছিলেন৷ ভারতবর্ষে সমালোচকেরা টমসনকে পাদ্রিসাহেব বলে, সাম্রাজ্যবাদী বলে, উদ্ধত পণ্ডিত বলে ধিক্কার দিয়েছিলেন৷ ইংলন্ডে তাঁর বক্তব্যে কেউ তেমনি কর্ণপাত করেননি৷ ভারতবর্ষে টমসন সম্পর্কে এই ধরনের বিরূপ সমালোচনা অস্বাভাবিক নয়৷ এমনকি রবীন্দ্রনাথও

এক সময়ে টমসনের বক্তব্যের তিক্ত প্রতিবাদ করেন৷ তবে কবি ছিলেন বড়োমাপের মানুষ৷ শেষ পর্যন্ত নিজেকে তিক্ততার উপরে তু লে নিতে পেরেছিলেন৷ সব ভু ল বোঝার উপরে টমসনের বন্ধু ত্ব স্বীকার করেছিলেন৷ ১৯৩৪ এর ৬ ফেব্রুয়ারি টমসনকে লেখা একটি পত্রে স্পষ্ট করে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ জানান যে, অনেক বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও টমসনকে তিনি ভারতবর্ষের সত্যকার বন্ধু ছাড়া অন্য কোনোভাবে দেখেননি৷ টমসনের বক্তব্য ছিল রবীন্দ্রনাথকে পশ্চিম ভু ল কারণে বড়ো মনে করেছে৷ ১৯১২-১৩তে ইংরেজ কবি Evelyn Underhill রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে উচ্ছ্বসিত এক প্রবন্ধ লেখেন ''An Indian Mystic'' শিরোনামায়৷ ১৯১৫-এ ইংরেজ কবি Ernest Rhys যে কবিজীবনী প্রকাশ করেন তাতে রবীন্দ্রনাথকে তিনি মরমিয়া সাধক হিসাবে তু লে ধরেন৷ প্রাচ্যের রহস্যের উপরেই ছিল জীবনীর ঝোঁক৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে কবি এবং কবি হিসাবেই তাঁর বিশ্বজনীন আবেদন এই কথাটা টমসন খুব জোর দিয়ে বলতে চেয়েছিলেন৷ টমসন বিশ্বাস করতেন রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে প্রাচ্যের রহস্যময় মরমিয়া সাধনার কথাটা অবান্তর৷ ত্মড়ম্ভব্দ-এর বই আজ আমরা ভু লে গিয়েছি৷ টমসন জানলে খুশি হতেন যে তাঁর রচনা এখন আমাদের আলোচনার বিষয়৷ ১৯৬১-তে রবীন্দ্রনাথের শতবার্ষিকী উৎসবে, কবিভক্ত কালিদাস নাগ টমসনের Rabindranath Tagore His Life and Work গ্রন্থটি নতু ন এক ভূ মিকাসহ পুনঃপ্রকাশ করেন৷ আরো সম্প্রতি, ১৯৮১-তে টমসনের Rabindranath Tagore Poet and Dramatist গ্রন্থটি শঙ্খ ঘোষের সম্পাদনায় পুনঃপ্রকাশিত হয়৷ কিন্তু টমসন সম্পর্কে যে বিরূপ সমালোচনা হয়েছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই, যদিচ কালিদাস নাগ বা শঙ্খ ঘোষের কাজে টমসন সম্পর্কে কোনো বিরূপতা নেই৷ যাঁরা টমসনের কাজ ভালোভাবে জানতেন তাঁদের কাছে গবেষণার সূত্রেই শুনেছি এই বিরূপ সমালোচনার সেরকম কারণ ছিল না৷ টমসনের নিজের লেখা খুঁজলে তাঁর মূল বক্তব্যের কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ বক্তব্যের ভালোমন্দ বিচার না করেও বক্তব্যের উদ্দেশ্য নির্ণয় করা চলে৷ টমসনের শেষ লেখাটি দিয়ে শুরু করি–১৯৪৬-এর কথা–যখন তিনি Rabindranath Tagore Poet and Dramatist (1948) গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্কণের ভূ মিকা লেখেন৷ সেই ভূ মিকায় এতদিনের ব্যবধান সত্বেও টমসন পুনর্বার স্পষ্ট করে দিয়ে যান পশ্চিমের বিচারে তিনি কতটা ক্ষু ব্ধ হয়েছিলেন৷ ১৯৪৮-এর ভূ মিকায় রয়েছে, পশ্চিম রবীন্দ্রনাথকে সাদরে গ্রহণ করে কারণ গীতাঞ্জলি কবিতায় তারা মরমিয়া সাধনার পরিচয় পায়৷ পূর্বের সম্পর্কে পশ্চিম আর কিছু জানতে চায় না৷ ওইটু কু তেই তারা সন্তুষ্ট৷ পূর্বের সাহিত্যকেও তারা সেই দৃষ্টিতে দেখে৷ রবীন্দ্রনাথ যে ভিন্নরকমের মানুষ তারা একটু ও বোঝে না৷ তিনি যে শ্রেষ্ঠ কবি সেটা তাদের চোখে পড়ে না৷ কবিতা গড়ে

তোলায় তাঁর অসাধারণ ব্যুৎপত্তি, জীবনে তাঁর গভীর আনন্দ, ভাষার ব্যবহারে তাঁর অপ্রতিহত শক্তি কিছুই ধরা পড়ে না মরমিয়া সাধনা একবার এসে গেলে৷ বহুমুখী রবীন্দ্রনাথকে পশ্চিমি পাঠক চিনে নেবেন এটাই ছিল টমসনের আবেদন৷ ১৯৪৮-এর একই ভূ মিকার শেষে তাই লেখেন, আমি আশা করব তাঁর কাজের পরিধি এবং শক্তি আমার পাঠকের চোখে পড়বে৷ তাঁরা দেখবেন যে তাঁর কবিতায় নম্র পেলব মাধুর্য ছাড়াও আরো কিছু রয়েছে৷ কবি যে কতটা স্বাধীন মনের অধিকারী ছিলেন পাঠক তা বুঝবেন৷ এই একই কথা টমসন তাঁর ১৯২৬ সংস্করণের ভূ মিকাতেও লিখেছিলেন৷ প্রশ্ন কিন্তু থাকে৷ ১৯২৬-এর বইটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়েছিলেন৷ রবীন্দ্রঅনুরাগীরা রাগ করেছিলেন৷ ইংলন্ডের লোক অবশ্য বইটিকে নিয়ে এমন কিছু মাথা ঘামাননি৷ টমসন এ সবে সামায়িকভাবে হতাশ হলেও তিনি তাঁর রবীন্দ্রনাথকে পরিত্যাগ করেননি৷ নিজের ভু লত্রুটি তিনি স্বীকার করেন৷ আমরা জানি যে বইটির আরো একটি সংস্করণে তিনি ক্রমে মন দেন৷ সেই সংস্করণটির ভূ মিকাতে তিনি জানিয়েছেন যে প্রথম সংস্করণটি থেকে ৩৫ হাজার শব্দ বাদ দিয়েছেন৷ তাছাড়া এতদিনের সাধনায় তাঁর মতামতে যে পরিবর্তন এসেছিল সব কিছুই তাঁর এই সংশোধনে স্থান পায়৷ তবে মূল বক্তব্যে পরিবর্তন আসেনি৷ রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন৷ এই বিচারে টমসন বাঙালি নন, ভারতীয় নন, ইংরেজ নন৷ টমসন কবি এবং রবীন্দ্র-অনুরাগী৷ অনুরাগী টমসন রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী৷ বিশ্বাস করতেন পশ্চিমি বিচারে তা ধরা পড়েনি৷ তার প্রথম কারণটা আমরা ইতিমধ্যেই পেয়েছি৷ ইংরেজরা মরমিয়া রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করে মুগ্ধ হয়েছিলেন৷ প্রাচ্যের কবিকে তাঁরা সেইভাবে দেখবার জন্য প্রায় তৈরি ছিলেন৷ সেই সময় যুদ্ধ আসন্ন, পশ্চিমি সমাজ কিছুটা বিহ্বল৷ তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি যেন তাদের মনকে ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যেতে পেরেছিল৷ কিন্তু গীতাঞ্জলি বাদে এবং ১৯১৩ সালে প্রকাশিত আরো দুটি কবিতার সংকলন বাদ দিলে, রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য যেসব রচনা তখন অনূদিত হয়ে পরপর প্রকাশিত হল সেইগুলির অনুবাদে অনেকের হাত পড়েছিল৷ রবীন্দ্রনাথ নিজে কিছুটা ভয়ে ভয়ে অনুবাদ করেছিলেন৷ শব্দের বদলে সারমর্মে মন দিয়েছিলেন৷ সময়ের অভাবে অনেকটাই অন্যের উপরে ছেড়ে দিয়েছিলেন৷ খুব দ্রুত তাই পশ্চিমের বিদগ্ধ সমাজে তাঁর কবিতার আদর কমে যায়৷ একে যুদ্ধ, তার উপরে টি. এস. এলিয়টের বিশাল প্রভাব৷ এ-সবের মধ্যে পশ্চিম রবীন্দ্রনাথকে হারিয়ে ফেলে৷ তাই টমসনের এত ক্ষোভ৷ যোগ্য অনুবাদে শ্রেষ্ঠ ইংরেজ কবিদের মতনই সম্মান পেতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ৷ টমসন নিজে ইংরেজ কবি৷ তাই তাঁর মনে কেবলই

ইংরেজ কবিদের তু লনা আসত৷ তিনি লিখেছিলেন টেনিসন, ব্রাউনিং এবং ব্রিজেস-এর কাব্যের মেজাজ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তু লনীয়৷ ভিক্টোরিয়া যুগের কবিদের সঙ্গে তাঁর বিচার হতে পারত৷ কিন্তু হলো এলিয়টের সঙ্গে৷ সেখানেই ইংলন্ডের অন্যায়৷ এই দুঃখ টমসনের চিরসঙ্গী হয়ে দাঁড়াল৷ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে টমসনের এই যোগাযোগের ইতিহাস রয়েছে তাঁদের পত্রাবলিতে৷ এখন আমরা এই পত্রবিনিময়ে থেকে তাঁদের বন্ধু ত্বের কাহিনি দেখব৷ আগেই বলেছি টমসন ১৯১০ থেকে বাঁকু ড়ায়৷ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয় ১৯১৩-তে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে৷ সেইবার টমসন প্রথম শান্তিনিকেতনেই যান৷ কিছু পথ সাইকেলে, কিছু পায়ে হেঁটে৷ শান্তিনিকেতনে কবিকে না-পেয়ে তিনি সোজা জোড়াসাঁকোয় যান৷ কবির সঙ্গে সাক্ষাতের সেই দিনটি থেকে আরম্ভ হয় তাঁদের আজীবনের বন্ধু ত্ব৷ সেই বন্ধু ত্ব যেমন সুন্দর তেমন জটিল৷ এই সম্পর্কে টমসন নিশ্চয়ই অগাধ আনন্দ পেয়েছিলেন তাঁর অন্তরে, কিন্তু কষ্টও পেয়েছিলেন যথেষ্ট৷ টমসনের জীবন এমনিতেও সহজ ছিল না৷ বাঁকু ড়ার মতন পাড়াগেঁয়ে সমাজে থেকে, মিশনারিদের মধ্যে পড়ে গিয়ে, তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন৷ তাঁর কবিসত্তা তাই ইংরেজি-বাংলা সাহিত্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল৷ কিন্তু ভু লে গেলে চলবে না যে টমসন ভিন্ন সংস্কৃ তির মানুষ ছিলেন, তাঁর ভাষা–তাঁর সাহিত্য– এমনকি তাঁর প্রাকৃ তিক পরিবেশও একেবারে বিপরীত৷ সম্পূর্ণ পৃথক এই দুনিয়াকে তাই টমসনের অনেকটাই সহ্য করে নিতে হয়েছিল৷ রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন, কিন্তু এতটা নয়৷ ইংরেজিতে অনুবাদ, ইংরেজ সমাজে তাঁর কবিতার প্রচার এ-সবই রবীন্দ্রনাথের কাছে জরুরি হলেও খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না৷ কিন্তু যে-সব ইংরেজ বন্ধু রা তাঁর সাহিত্য এবং শিক্ষাকর্মে নিজেদের সমর্পণ করেছিলেন তাঁদের জীবনের অনেকটাই রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে ভরা ছিল৷ সেই স্থানে আঘাত তাই অসহনীয় হতে পারত৷ অথচ তৎকালীন ভারতীয় সমাজে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে টমসনের সমালোচনা মেনে নেওয়া সহজ ছিল না৷ টমসনের সমালোচনাকে কেন্দ্র করে ঔপনিবেশিক বিচার এসে পড়েছিল সম্পর্কে৷ বন্ধু টমসন শ্রদ্ধায় এবং ভালোবাসায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করছেন এই বিশ্বাস জন্মাল না৷ তার বদলে অনেকের মনে হলো যেন ইংরেজ টমসন বাঙালি তথা ভারতীয় রবীন্দ্রনাথকে বিকৃ ত দৃষ্টিতে দেখেছেন৷ বহুদিন বাদে টমসন নিজেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে ঔপনিবেশিক পরিবেশে বিদেশীয় সমালোচনা অবাঞ্ছনীয়৷ তাঁর অতি প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় বন্ধু ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের মৃত্যুর পরে তিনি বি. বি. সি-তে একটি বেতার ভাষণ দেন৷ সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন যে ব্রজেন্দ্রনাথ অতি নিকট বন্ধু হওয়া সত্বেও রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে তাঁর সমালোচনা গ্রহণ করতে পারেননি৷ তর্কের খাতিরে টমসন ব্রজেন্দ্রনাথকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ নিজেও ওই ধরনের সমালোচনা করতেন এবং জিজ্ঞেস

করেছিলেন তাহলে ব্রজেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা মেনে নিতেন কেন৷ উত্তরে ব্রজেন্দ্রনাথ টমসনকে বলেছিলেন, সমালোচনা করবার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়৷ রবীন্দ্রনাথ জাতি প্রতিষ্ঠার কাজ করছেন তাই সমালোচনা তিনি করতে পারেন৷ সেই বেতারভাষণে টমসন এই বক্তব্য অতি সত্য বলে স্বীকার করেছিলেন৷ এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে টমসন সমালোচনার যোগ্য ছিলেন কিনা৷ তার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে রবীন্দ্রনাথ-টমসন পত্রাবলিতেই৷ তাঁদের এই পত্রবিনিময় শুরু হয় সামান্য একটু বেসুরে ৷ বলতে গেলে ওদের প্রথম সাক্ষাতের পর থেকেই টমসন চাইছিলেন রবীন্দ্রনাথকে একবার বাঁকু ড়াতে নিয়ে যেতে, টমসনের কর্ম এবং বাসস্থলে৷ রবীন্দ্রনাথ কথা দিয়েছিলেন যাবেন কিন্তু ক্রমেই সেই ব্যাপারে সময় চাইতে থাকেন৷ ২ নভেম্বর ১৯১৩ সনের চিঠিতে জানান আগামী জানুয়ারির শেষে যেতে পারেন, তার আগে নয়৷ শর্ত করেন বাঁকু ড়াতে গেলে পর তাঁকে যেন কোনো সভায় না ডাকা হয়৷ ক্রমে তাঁদের বন্ধু ত্বের বিস্তার হয়েছিল ঠিকই কিন্তু টমসনের শত আকাঙ্ক্ষা সত্বেও রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্যন্ত বাঁকু ড়া যাওয়া হয়নি৷ টমসনের স্ত্রী থিয়োডোসিয়ার অপ্রকাশিত স্মৃতিচারণে৩ পাই যে এই কারণে টমসনের আজীবন একটা বেদনা রয়ে গিয়েছিল৷ রবীন্দ্রনাথকে তিনি বাঁকু ড়াতে নিয়ে যেতে পারেননি তাঁর ছাত্রদের কাছে৷ ওঁদের যোগাযোগের দিনগুলির মধ্যে টমসনের সবচেয়ে সুখের স্মৃতি ছিল শান্তিনিকেতনে কাটানো সেই দিনটি, ১৩-১৪ নভেম্বর ১৯১৩ সন৷ এই দিন রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ এসে পৌঁছোয়৷ সেই সময় টমসন উপস্থিত ছিলেন শান্তিনিকেতনে এবং সেই দিনটির বিশদ বর্ণনা লেখা আছে টমসনের কাগজপত্রে৷ ওই দিনেই টমসন হাতে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি অনুবাদের সংশোধনের ভার৷ রবীন্দ্রনাথেরই উৎসাহে এবং অনুরোধে এর শুরু৷ তাই টমসন নির্দ্বিধায় এই কাজে নেমেছিলেন৷ সেই দিনেই ওঁদের মধ্যে একটি সংকলন প্রকাশের পরিকল্পনা জেগেছিল৷ ইস্কু লের পাঠ্যপযোগী কাব্যের সেই সংকলন সম্পাদনা করবেন রবীন্দ্রনাথ ও টমসন দুজনে৷ তবে পরে সেই কাজ একাই টমসন করেছিলেন৷৪ বলতে গেলে টমসন তৎক্ষণাৎ কাজ শুরু করে দেন, এমনই ছিল তাঁর উৎসাহ এই কাজে৷ কিন্তু অল্প দিনের মধ্যে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ কিছুটা নিরুৎসাহ হয়েছেন৷ টমসন যে-সব অনুবাদ সংশোধন করে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছুদিন সেগুলি পড়তে পারেননি৷ তিনি তখন অত্যন্ত ব্যস্ত৷ পৃথিবীর দৃষ্টি এসে পড়েছে তাঁর জীবনে, সাহিত্যের জন্য তাঁর সময় কম৷ এদিকে টমসন পত্রমাধ্যমে প্রায় ঝড়ের বেগে তাঁর কাছে প্রশ্নের পর প্রশ্ন পেশ করে চলেছেন, ইংরেজি অনুবাদে তাঁর কবিতা সংশোধন করে চলেছেন এবং ছোটোগল্প অনুবাদ করবার অনুমতি চাইছেন৷ টমসনকে বন্ধু হিসাবে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ খুশি হয়েছিলেন, বিশেষ ঠ

করে তিনি কবি বলে৷ তাঁদের বন্ধু ত্ব নিবিড় হয়ে উঠবে তাঁরও আশা ছিল৷ ১৯১৩ সনের ২০ নভেম্বর তারিখের চিঠিতে সেইকথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন টমসনকে৷ কিন্তু অনুবাদের ইতিহাসটা ভিন্ন গতিতে চলে৷ গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর অনুবাদের সংশোধন করতে দেন টমসনকে৷ কিন্তু দেবার কয়েকদিনের মধ্যে ক্ষমা চেয়ে লেখেন ১৮ নভেম্বর ১৯১৩ তারিখের এক পত্রে৷ স্বীকার করেন যে সংশোধনে তাঁর মন সায় দিচ্ছে না৷ গীতাঞ্জলি-র কবিতা, মালিনী, তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে লেখা, অনুবাদেও তাই থাকু ক৷ স্বীকার করেন যে আগেই সেই কথা তাঁর টমসনকে জানানো উচিত ছিল৷ অথচ রবীন্দ্রনাথের যে টমসনের অনুবাদ একেবারে পছন্দ হয়নি তাও কিন্তু নয়৷ মাস দুই পরে, ১ জানুয়ারি ১৯১৪ তারিখের চিঠিতে, রবীন্দ্রনাথ লিখলেন টমসনের অনুবাদ তাঁর রীতিমতো ভালো লেগেছে৷ অনুবাদের ব্যাপারে দুটি বিপরীত সিদ্ধান্তের মধ্যে পড়ে গিয়ে টমসন বেশ একটু অনিশ্চিত বোধ করেন৷ ওইসময় বেশ কিছু মাস টমসনের এবং রবীন্দ্রনাথের বিশেষ দেখা হয়নি৷ পত্র মারফতই কথাবার্তা চলেছিল৷ রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ে প্রায়ই ছুটি করে নিচ্ছিলেন নোবেল পুরস্কারের ভিড় সামলানোর ফাঁকে৷ টমসনকে লেখা এই সময়ে একাধিক পত্রে তিনি তাঁর ক্লান্তির উল্লেখ করেছেন৷ টমসনের খুব একা লেগেছিল তাই৷ বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য তাঁর একান্ত কাম্য ছিল, কিন্তু তাঁকে কাছে না পেয়েও তিনি একা একাই রবীন্দ্রনাথের লেখার অনুবাদ, তাঁর বিষয়ে গবেষণা, এ-সব শুরু করে দিয়েছিলেন পূর্ণ উদ্যমে৷ অথচ টমসনের উপর ভিন্ন রকমের অনেক দায়িত্ব ছিল, তাঁর ইস্কু ল-কলেজের চাকরি, সেখানে পড়ানো ছাড়াও ছাত্রভর্তির প্রশাসনিক কাজের চাপ ইত্যাদি৷ তার উপরে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য থেকে তিনি বঞ্চিত৷ সব মিলিয়ে টমসনও কিছুটা ক্লান্ত হয়েছিলেন৷ সেই ক্লান্তি নিয়েই তিনি রবীন্দ্রনাথের কাজে ডু বেছিলেন, কাজের ভালোমন্দ তেমন বিচার করেননি৷ আগেও বলেছি, আবার বলছি, তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল একটাই যোগ্য ইংরেজি অনুবাদের সাহায্যে পশ্চিমে রবীন্দ্রনাথের পুনর্বিবেচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা৷ তবে এই পথ সুগম ছিল না৷ শুধুমাত্র টমসনের দৃঢ়তায় এই প্রচেষ্টা সম্ভব হয়েছিল তার ফলাফল সার্থক না হলেও৷ রবীন্দ্রনাথের দিক দিয়েও বাধা এসেছিল৷ গীতাঞ্জলি-র প্রকাশক ম্যাকমিলন কোম্পানি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে দ্রুত বই চাইছিলেন৷ নানা হাতে অনূদিত গ্রন্থ ম্যাকমিলন কোম্পানির দ্বারা পরপর প্রকাশিত হয়েছিল৷ ১৯১৩ থেকে ১৯২১-এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ২২ টি ইংরেজি সংকলন ইংলন্ডের পাঠকসমাজের হাতে পড়ে৷ এই জিনিস সম্ভব হয়েছিল কবির বন্ধু এন্ড্রুজ এবং পিয়ার্সনের সাহায্যে৷ ১৯১৪ তে, সামান্য কিছু আগে-পরে, এই দুই ইংরেজ যুবক রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারা ও ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে শান্তিনিকেতনে থাকতে আসেন৷ টমসনের বদলে রবীন্দ্রনাথ এঁদেরই ভরসায়

অনুবাদের কাজ চালিয়ে যান৷ অথচ টমসনকেও স্পষ্ট করে বারণ করেন না৷ ম্যাকমিলনের রয়্যালটি থেকে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের অনেক উপকার হচ্ছিল৷ যে দুই ইংরেজ বন্ধু সেই বিদ্যালয়ের কাজে এসেছেন তাঁদের উপরেই অনুবাদের অনেকটা ভার দেওয়া সহজ মনে করলেন রবীন্দ্রনাথ৷ ওঁরা বিনা পারিশ্রমিকেই এই কাজ করবেন৷ কিন্তু টমসন? তাঁর আর্থিক পরিস্থিতিতে কি বিনামূল্যে এই কাজ করা সম্ভব, রবীন্দ্রনাথ ভাবলেন৷ অথচ তিনি রবীন্দ্রনাথের কিছু ছোটোগল্প ইতিমধ্যে খুব সুন্দর অনুবাদ করেছেন, এ কথাও রবীন্দ্রনাথ জানালেন৷৫ এই বিষয়ে তাই রবীন্দ্রনাথ কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারলেন না৷ টমসন এতে কষ্ট পাচ্ছেন বুঝতে পেরে তাঁকে ডেকে পাঠালেন জোড়াসাঁকোতে ১৯১৪-র ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে এক পত্রে৷ সেই ডাকে টমসন এলেন ১ মার্চ তারিখে কিন্তু কথা বলেও ভালো করে বুঝতে পারলেন না তাঁর অবস্থা কী৷ ৪ মার্চ ১৯১৪ তারিখে তাঁর মাকে৬ একটা চিঠিতে সেই দিনটার কথা লিখেছিলেন৷ কখনো কবি চান টমসন অনুবাদ করেন, কখনো বা তা চান না৷ বলেন তাঁর শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের দরুন অনেক ঋণ হয়ে গেছে৷ মায়ের কাছে টমসন দুঃখ করে জানিয়েছিলেন তাঁর পক্ষে কলকাতায় যাতায়াত বেশ খরচ সাপেক্ষ৷ প্রতিবার এক পাউন্ড লাগে, এবারে আরো বেশি লাগল৷ কিন্তু কবির ডাক তিনি উপেক্ষা করেন কী করে? তবে টমসনের এই অনিশ্চয়তা কিছুদিনের মধ্যে কেটে যায় যখন সত্যি সত্যিই রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজন হয় অনেকগুলি ছোটোগল্পের অনুবাদ, ম্যাকমিলন কোম্পানির তাগাদায়৷ রবীন্দ্রনাথ তখন সরাসরিই টমসনকে ডেকে নেন এই কাজে৷ ১৯১৫-র সেপ্টেম্বর মাসে তিনি এই বিষয়ে পর পর চারটি চিঠি লেখেন টমসনকে এবং অনুবাদ করতে শুধুমাত্র অনুরোধ করেন না, ১৯ ডিসেম্বর ১৯১৫-এর চিঠিতে খুব করে ম্যাকমিলনের হয়ে তাড়া দেন৷ সেই পত্রে জানান যে, গল্পগুলি ম্যাকমিলন খুব দ্রুত চাইছেন৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সময় নেই অনুবাদ করবার৷ তাঁর হাতভরা কাজ, অনেক লেখার আছে, অনুবাদের সময় নেই৷ তাই টমসন কি দ্রুত ক’টি গল্প ইংরেজি অনুবাদে তৈরি করে দেবেন?৭ কবির গুণমুগ্ধ টমসন এই অনুরোধ ফেলতে পারেন না৷ জানালেন যে একটি শর্তে তিনি এই কাজে রাজি যে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ বিশ্রাম নেবেন৷ এই সূত্রে লেখা অন্য একটি পত্রে৮ রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন যে, অনুবাদের কাজে আরো তিনি অক্ষম কারণ শরীর তাঁর খুব অসুস্থ হয়েছে৷ টমসনের শর্ত তাই যে কবি সম্পূর্ণ বিশ্রাম করবেন৷ এই ভাবে রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজনে, ম্যাকমিলনের তাড়নায়, টমসন তাঁর সবকিছু দিয়ে নেমে পড়লেন রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প অনুবাদের কাজে৷ প্রকাশিত সংকলনে কিন্তু অনুবাদকের স্বীকৃ তি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি৷ অনূদিত গল্প নির্বাচনের ভার রবীন্দ্রনাথ ম্যাকমিলনের উপর ছেড়ে

দিয়েছিলেন৷ আজ পর্যন্ত তাই টমসনের অনূদিত ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পটি অপ্রকাশিত অবস্থায় রয়েছে তাঁর পারিবারিক কাগজপত্রের মধ্যে৷ অথচ আমরা জানি এই বিশেষ অনুবাদটি রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন পেয়েছিল৷ তাঁর Rabindranath Tagore poet and Dramatist বইটিতে ছোটোগল্প বিষয়ে এই করুণ কাহিনির কোনো উল্লেখই করেননি টমসন৷ এই আঘাত বোধ হয় কঠিন হয়ে বেজেছিল৷ এই বেদনাদায়ক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছিল ১৯১৬ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ জাপানে পাড়ি দেন এবং টমসন যুদ্ধে যোগ দেন মেসোপোটেমিয়াতে৷ এক বছর পরে ওঁদের আবার দেখা হয়৷ টমসন তখন ছুটিতে ফিরেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ফিরে পেয়ে ভীষণ খুশি৷ টমসনকে লেখা একটি কবিতায় তার স্বাক্ষর রয়েছে৷ মেসোপোটেমিয়াতেও টমসন রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়েছিলেন৷ সঙ্গে নিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন গ্রন্থ, বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরাণী এবং বাংলা ব্যাকরণ৷ সেখান থেকেও রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন ১৬ অগাস্ট ১৯১৬ তারিখে যে ফিরে গিয়ে তাঁর অনেক কাজ বাকি৷ মেসোপোটেমিয়ার যুদ্ধের মধ্যে থেকেও তিনি বাংলা চর্চা করে যাবেন৷ যুদ্ধের শেষে ১৯২০-তে মেসোপোটেমিয়ার থেকে ফিরে এসে আর দেরি করেননি টমসন৷ ১২ ডিসেম্বর ১৯২০-র চিঠিতে তিনি রবীন্দ্রনাথকে মহা উৎসাহে লিখলেন যে এবারে টমসন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিপ্লব ঘটাবেন পশ্চিমে৷ সেই সময়ে তিনি তাঁর রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে রচনায় হাত দিয়েছেন৷ সম্প্রতি চিত্রা পড়ে তিনি অভিভূ ত৷ সোজাসুজি তাই লিখলেন, ‘আপনি বড় কবি জানতাম, কিন্তু মার্জনা যদি করেন তো বলি, যা জানতাম তার চেয়েও আপনি বড়৷’ ১৬ অগাস্ট ১৯২০ তারিখের এই একই পত্রে তিনি দুঃখ করে লেখেন, ‘আপনার কবিতা অনুবাদ হয়েছে শুধুমাত্র একটি ধারা থেকে৷ ‘উর্বশী অনূদিত হয়নি অথচ সেই কবিতাটিতে সমুদ্রের গর্জন রয়েছে৷’ টমসনের ইচ্ছা ছিল গদ্য অনুবাদে হলেও রবীন্দ্রনাথের এই বিভিন্নধর্মী কবিতা তিনি পশ্চিমি পাঠকের কাছে এনে দেবেন৷ তারা কবিকে সঠিকভাবে চিনবে৷ এই বৃহৎ কাজে টমসন কিন্তু তাঁর অক্ষমতা স্বীকার করেছেন বারবার৷ রবীন্দ্রনাথকে সমগ্রভাবে বুঝতে পারা কত বড়ো দায়িত্বের কাজ তা তিনি জানতেন না এমন নয়৷ রবীন্দ্রনাথকে লেখা ১৯২০-র ১৬ জুন তারিখের চিঠিতে তিনি বলেই ছিলেন যে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সামান্য নিদর্শন ছাড়া তিনি কিছুই দিতে পারবেন বলে তাঁর ভরসা হয় না৷ তবু পশ্চিমের পাঠক জানুক তারা গতানুগতিকতার পথে কবিকে কতটা ভু ল বুঝেছে৷ অল্প কিছুদিনের মধ্যে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে তিনি আরো বিস্তারিত লেখেন৭ রবির বিষয়ে যত জানছি তত বুঝতে পারছি আমার কাজ কতটা জটিল৷ তাঁর বিষয়ে এতরকম জানা রয়েছে যে কোনো কিছু নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন৷ আমার মতন অনেকেই

জানেন রবীন্দ্রনাথকে৷ আমার চেয়ে বেশিই জানেন৷ কোনো কিছু বলামাত্র তাঁরা অনায়াসে যথার্থ তর্ক জুড়ে দিতে পারেন৷ রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে গ্রন্থ রচনায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ ছিলেন টমসনের সবচেয়ে বড়ো সহায়৷ প্রশান্তচন্দ্র তখন রবীন্দ্ররচনাবলী সংকলন এবং সম্পাদনার কাজ হাতে নিয়েছিলেন, রবীন্দ্রজীবনের খুঁটিনাটি তাঁর নখাগ্রে৷ অনেক সময় নিজের অক্ষমতায় কু ণ্ঠিত হয়ে তাই প্রশান্তচন্দ্রের কাছে টমসন মার্জনা চেয়ে নিতেন৷ ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২১-এর এরকম এক পত্রে টমসন প্রশান্তচন্দ্রকে লেখেন যে তাঁর রবীন্দ্র-বিষয়ক রচনার প্রথম চারটি অধ্যায় প্রশান্তচন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছেন৷ কিন্তু তাঁর ভয় যে এইবারে তাঁদের বন্ধু ত্ব না যায়৷ তিনি নিশ্চিত জানেন যে সূক্ষ্ম কিছু কবিতা তিনি ভালো বুঝতে পারেননি৷ সেইগুলি হয় বাদ দিয়েছেন অথবা সেগুলির প্রতি অবিচার করেছেন৷ তাঁর অনুরোধ, প্রশান্ত যদি দেখে সংশোধন করে দেন৷ স্বীকার করেন প্রশান্তচন্দ্রের কাছে তিনি কত জেনেছেন, নির্লজ্জভাবে প্রশান্তচন্দ্রের বিদ্যাবুদ্ধি ধার করেছেন৷ রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তি জীবনের প্রায় সব তথ্যই তাঁর প্রশান্তের কাছে পাওয়া, তাঁর রচনার প্রথম অধ্যায়টিও অনেকাংশে প্রশান্তর সঙ্গে আলোচনা করেই লেখা৷ গ্রন্থে তিনি তা বারবার স্বীকার করেছেন৷ আবার সসংকোচে লেখেন প্রশান্তকে,

২৬

নভেম্বর ১৯২০ সনে

এবারে ‘মানসী’র উপরে অধ্যায়টি তোমাকে পাঠালাম৷ দেখেছ তো অক্ষম কাজ, তাও করে চলেছি৷ টমসন খুব ভালো করে জানতেন তাঁর কাজে ত্রুটি থাকবে৷ সেই কারণেই বোধ হয় তিনি আজীবন ত্রুটি সংশোধন করে চলেছিলেন৷ তিনি জানতেন এই কাজ সাময়িক হতে পারে না৷ এর পরিপূর্ণতা আসবে আজীবনের ফসলে৷ রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবি৷ ইংরেজি অনুবাদে তা ধরা পড়েনি৷ অনুবাদের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ টমসনের সঙ্গে একমত হয়েছিলেন৷ টমসনের কাছে লেখা ২ ফেব্রুয়ারি ১৯২১-এর চিঠিতে স্বীকার করেছিলেন যে অনুবাদে তিনি নানা অসুবিধা এবং জটিলতা এড়িয়ে চলেন৷ স্বীকার করেছিলেন যে অনুবাদে তিনি পশ্চিমের পাঠককে আসল জিনিসটি দিতে পারেননি, অনুবাদে তাঁর কবিতা অতিরিক্ত সরল করে ফেলেছিলেন৷ যদি টমসন কোনোদিন ওঁর রচনা অনুবাদ করতে প্রবৃত্ত হন, তবে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে খুশি হয়ে সাহায্য করবেন বলে আশ্বাস দেন৷ কিন্তু এই রকমের সহানুভূ তি এবং সহায়তা সত্বেও টমসনের লেখায় রবীন্দ্রনাথ আঘাত পেয়েছিলেন, ব্রজেন্দ্রনাথ টমসনের থেকে সরে গিয়েছিলেন৷ এই মনোমালিন্যের পেছনে তো শুধু অনুবাদের ব্যাপারই ছিল না, অন্য অনেকরকম অভিযোগ ছিল৷ টমসন ধরতে পারেননি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের জগৎ এবং তাঁর কাব্যধর্মের বিশ্লেষণে গলদ ছিল৷ অন্যান্য অভিযোগও ছিল৷ প্রথম গ্রন্থটির কিন্তু প্রশংসা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ তবে নিজে খুব

সংকু চিত বোধ করেছিলেন৷ তিনি টমসনকে লেখেন যে ইংরেজি ভাষায় সাহস দেখানো তাঁর পক্ষে ভু ল হয়েছে৷ বাঙালি কবি, বাংলাতেই তাঁর আসল পরিচয়৷ কবির মনের এই বিষাদের আভাস পেয়ে টমসন উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন৷ জানিয়েছিলেন সবরকম সংশোধন করবার জন্য তিনি তৈরি হয়ে আছেন৷ টমসনের দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অসন্তোষ তীব্র হয়ে ওঠে৷ বাণীবিনোদ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে তিনি মস্ত এক সমালোচনা লিখে ১৯২৭-এ বাংলা ১৩৩৪-এর শ্রাবণ মাসের প্রবাসী-তে১০ সেটি প্রকাশ করেছিলেন৷ ইতিমধ্যে টমসন দেশে ফিরেছেন৷ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক হয়েছেন৷ সেখানে গিয়ে তিনি নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী নিজেকে বাংলা সাহিত্যে নিমগ্ন রেখেছেন৷ ইংলন্ডে তাঁর রবীন্দ্র-বিষয়ক কাজের কোনোই সমাদর হয়নি৷ কিন্তু দেশে বিদেশে অবহেলা সত্বেও টমসনের মন ভারতবর্ষেই থেকে যায়৷ ভারতবর্ষের বিষয়ে তিনি একের পর এক বই লিখে চলেন এবং রবীন্দ্রসাহিত্য বা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের জগৎ তাঁর জীবনের আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়৷ আমরা জানি ১৯২৬-এ Rabindranath Tagore Poet and Dramatist প্রকাশিত হয়৷ তার পরবর্তীকালে বছর পাঁচেক রবীন্দ্রনাথ ও টমসনের মধ্যে পত্র বিনিময় প্রায় বন্ধ ছিল বলা চলে৷ মাত্র দুটি পত্র রয়েছে সেই সময়ের৷ কিন্তু ১৯৩১ থেকে পুনর্বার টমসন-রবীন্দ্রনাথের পত্র বিনিময় শুরু হয়৷ সেই নতু ন পত্রালাপ থেকে মনে হয় যেন ওঁদের মধ্যে সবরকম মনোমালিন্য কেটে গিয়েছিল৷ ওঁরা যেন বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে পরস্পরকে আরো ভালো বুঝতে পেরেছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁর সদ্য প্রকাশিত বইগুলি প্রায় নিয়মিত টমসনকে পাঠাচ্ছেন৷ টমসন ওদিকে তাঁর রবীন্দ্রচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ কবি অমিয় চক্রবর্তী তখন অক্সফোর্ডে৷ তাঁকে সঙ্গে করে টমসন রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটি নতু ন সংকলনে হাত দিয়েছিলেন৷ ম্যাকমিলন কোম্পানি প্রকাশ করবে৷ রবীন্দ্রনাথের এতে খুবই সমর্থন ছিল৷ ৬ জানুয়ারি ১৯৩৪-এর চিঠিতে টমসনকে তাঁর সানন্দ সমর্থন জানিয়েছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথের নিজের পক্ষে এই কাজের ভার নেওয়া এখন আর সম্ভব নয় টমসনকে লিখেছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছিলেন যে তাঁর বিশ বছর আগের ইংরেজি অনুবাদগুলি উপযুক্ত হয়নি৷ ইংরেজি অনুবাদে তাঁর নতু ন কবিতা সংকলনের প্রকল্পে টমসনের সাহায্য চেয়েছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথের কাজে লাগবার জন্য টমসন উন্মুখ ছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথকে নানাভাবে প্রকাশ করবার পরিকল্পনা ছিল তাঁর৷ নতু ন এই কাব্যসংকলন প্রকাশিত হলেই তিনি Times Literary Supplement-এ রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে লিখবেন বলে প্রস্তুত হচ্ছিলেন৷ ২৮ এপ্রিল ১৯৩৪-এ এক পত্রে রবীন্দ্রনাথকে জানিয়েছিলেন যে Times Literary Supplement-এর রচনায় তিনি রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ ছোটোগল্প সম্বন্ধেও বিশেষ জোর দিয়ে লিখবেন৷ তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথের মতন গল্পলেখক পৃথিবীতে বিরল৷ এই রচনায় সেই কথা লিখবেন৷ আরো

লিখবেন তাঁর ক্ষোভের কথা যে রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প যোগ্য সমাদর লাভ করেনি৷ এর একমাত্র কারণ সেগুলি যুদ্ধের কঠিন দিনগুলিতে প্রকাশিত হয়েছিল৷ রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্রে রেখে, তাঁর বিশ্বাসের, তাঁর চিন্তার প্রচার করে টমসন এক আশ্চর্য পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন দুই দেশের আদান-প্রদানে৷ ব্রিটেন এবং ভারতবর্ষের৷ দুই দেশের মানুষের মধ্যে যা কিছু ভালো সব একত্রে মিলবে এই ছিল টমসনের আশা৷ সে ক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে বড়ো আস্থা ছিল রবীন্দ্রনাথের মানবতাবোধে৷ টমসনের কাছে রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র বড়ো কবি ছিলেন না৷ টমসনের রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক নতু ন যুগের দূত৷ তিনি পূর্বের নন, পশ্চিমের নন৷ তিনি মানুষকে ভবিষ্যতের পথ দেখাচ্ছেন৷ রামমোহন তাই করেছিলেন৷ তাঁরই উত্তরসূরী রবীন্দ্রনাথ৷ টমসন লিখেছিলেন মনীষার এই পথ সম্বন্ধে তিনি নিশ্চিত৷ যে মানবতা পূর্ব এবং পশ্চিমকে একত্রে গ্রহণ করে সেই মানবতা ঈশ্বরের৷ তাঁর ১৪ জানুয়ারি ১৯৩৪-এ পত্রে টমসন সে কথাই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে৷ রবীন্দ্রনাথের হয়ে, ভারতের হয়ে টমসন লড়েই গিয়েছিলেন৷ ব্রিটেনে তাই তাঁর বন্ধু র সংখ্যা বাড়েনি৷ ভারতবর্ষেও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন না৷ তবে রবীন্দ্রনাথের বন্ধু ত্ব ফিরে পেয়ে তিনি অনেকটা জোর পেয়েছিলেন৷ আর যাঁর সঙ্গে সখ্যতা অবিচ্ছিন্ন ছিল তিনি হলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ৷ জীবনের প্রান্ত পর্যন্ত টমসনের মন পড়েছিল ভারতবর্ষে আর এই ভারতবর্ষ তাঁর মনে অনেকটাই শান্তিনিকেতনের রূপ নিত৷ ১৯৩৭-৩৮-এ বুদ্ধের জীবন বিষয়ে যখন তিনি তাঁর The Youngest Disciple রচনায় নিযুক্ত তখন ৮ জানুয়ারি ১৯৩৮-এর পত্রে রবীন্দ্রনাথকে জানিয়েছিলেন বুদ্ধের এই জীবনী তিনি অনেকটা শান্তিনিকেতনের পটভূ মিকায় কল্পনা করেছেন, যে শান্তিনিকেতন তাঁর স্মৃতিতে ছিল৷ সেই অপূর্ব শেফালি বনের স্মৃতি, যেখানে কত বছর আগে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি মিলিত হয়েছিলেন৷ শুধুমাত্র শান্তিনিকেতনের প্রকৃ তি নয়, শান্তিনিকেতনের মানব আদর্শও ছিল টমসনের মনে, মানুষ হিসাবে যেখানে মানুষ সম্মান পায় জাতিধর্ম নির্বিশেষে৷ টমসন বিশ্বাস করতেন শান্তিনিকেতনের এই ভিত্তি তৈরি হয় ভারতের তপোবন শিক্ষার ঐতিহ্য দিয়ে৷ ১৫ জুলাই ১৯৩১-এ রবীন্দ্রনাথকে তাই লিখেছিলেন টমসন, বিদেশি কেউ যদি ভারতবর্ষকে জানতে চান তিনি যেন শান্তিনিকেতনে আসেন৷ শান্তিনিকেতন যেমন পরকে আপন করে তারই মধ্যে তপোবনের আদর্শ রয়েছে৷ আগেও বলেছি টমসন খুঁজেছিলেন মিলনক্ষেত্র, বিভেদ নয়৷ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একমত হয়ে তিনি বিশ্বাস করতেন যে ভারতের ব্রিটিশ শাসন দুই দেশের মানুষের মধ্যে পার্থক্য এবং বিরোধের সৃষ্টি করেছে এবং তাতে প্রভূ ত ক্ষতি হয়েছে৷ টমসন তাই প্রায়শ্চিত্তের

পথ খুঁজেছিলেন৷ বৌদ্ধধর্ম এবং খ্রিস্টধর্ম মিলিয়ে মনের মুক্তি পেয়েছিলেন৷ সেই মর্মে সেপ্টেম্বর ১৯৩৭-এ রবীন্দ্রনাথকে এক পত্রে লেখেন,

২৫

ক্রমেই আমার বোধ হচ্ছে যে বুদ্ধ এবং খিস্ট দুজনকেই মানুষের বড়ো দরকার৷ খিস্টধর্মের মানুষগুলি বোধ করি একটু বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে৷ বুদ্ধের করুণা আজ প্রয়োজন৷ আপনার জীবনে যে নানা রঙে রঙিন অথচ মৃদু সৌন্দর্য দেখেছি বুদ্ধের প্রকৃ ত ব্যাখ্যা তার মধ্যেই পেলাম৷ আপনাকে জানা আমার জীবনের আনন্দ৷ এই মিলনে রবীন্দ্রনাথ উৎসাহিত বোধ করেন৷ তিনি টমসনকে লেখেন তাঁরও বিশ্বাস খ্রিস্টের এবং বুদ্ধের যৌথ শিক্ষাতেই মানুষের মঙ্গল৷ তিনি লেখেন,

২৭

অক্টোবর ১৯৩৭-এর চিঠিতে

আপনি জানেন কিনা জানি না, আমার অনেক সময় মনে হয়েছে যে আমরা যদি হিন্দু না হতাম– বড় অর্থে হিন্দুর মধ্যেই যেখানে বৌদ্ধ সেই হিন্দু না হতাম–তাহলে আমি চাইতাম যে ভারতবর্ষ যেন খৃষ্টান হয়৷ আমাদের দুর্ভাগ্য যে পশ্চিমকে আমরা সাম্রাজ্যাবাদী হিসাবেই জানলাম যীশুখ্রিস্টের প্রতিনিধি হিসাবে নয়৷ দুজনের এই মনের মিলে টমসনের ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক সার্থক হয়ে ওঠে৷ এই রকম একটা বন্ধু ত্বের ইতিহাসের জন্য আমরা টমসনের কাছে ঋণী৷ তিনি তাঁর জীবন ও কর্ম গড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে৷ তিনি বলেছিলেন, I have remembered always that Tagore (though his work, having to get past the concealment of an Indian language, came to Judgement in the age of the First World War and of T. S. Eliot) as a writer was the contemporary of the later Tennyson and Browing and of Robert Bridges. In fairness, he must be judged as the Victorian poets are judged, whose world has passed away. Milton's English verse is less than 18,000 lines. Tagore's published verse and dramas amount to 150,000 lines or their equivalent. His non-dramatic prose, novels, short-stories, autobiography, criticism, essays of many kinds, is more than twice as much, and there is also a mass of uncollected material. I make no apology for omissions. ... I have cut down ruthlessly from necessity. I have also cut out my bibliography. ...My own work is nearly finished, and I am able to do, not what a younger man might do but

only what is still possible." (From the preface to Edward Thomson's Rabindranath Tagore, Poet and Dramatist, 1946). 1. Edward Thompson, Rabindranath Tagore Poet and Dramatist, Oxford University Press, 1926. ২. এই প্রবন্ধে যেখানেই ইংরেজি থেকে বাংলার অনুবাদ করা আছে সেগুলি লেখিকার নিজের৷ এগুলি আক্ষরিক অনুবাদ নয়, প্রায়শই ভাবার্থ৷ ৩. টমসনের কাগজপত্রে রয়েছে পুত্র ঐতিহাসিক ই. পি. টমসনের সংগ্রহে৷ এই কাগজপত্রের এখনও কোনো নির্দিষ্ট তালিকা তৈরি হয়নি৷ 4. Anthology of Verse for Indian Schools, ed. with notes by Edward Thompson, Macmillan, London 1915, and Anthology of Verse for Indian Schools, ed, with notes by Edward Thompson, Macmillan, London 1918. ৫. টমসনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্র ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯১৫, ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯১৫, ২৩ জানুয়ারি ১৯১৬, ১১ মার্চ ১৯১৬৷ ৬. টমসনের কাগজপত্রে সংরক্ষিত৷ ৭. আরো কয়েকটি পত্রে তাড়া দেন রবীন্দ্রনাথ৷ দ্রষ্টব্য টমসনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্র ৫ জানুয়ারি ১৯১৩, ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯১৫, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬৷ ৮. পত্রের তারিখ ১৯ ডিসেম্বর ১৯১৬৷ ৯. পত্রের তারিখ ৬ নভেম্বর ১৯২০৷ ১০. প্রবাসী শ্রাবণ ১৩৩৪, পৃ. ৫১৩-১৮ ৩৪ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, ২০০০৷

গানের ভিতর দিয়ে সুপূর্ণা দত্ত অন্যান্য বাংলা গানের মতো রবীন্দ্রনাথের রচিত গানও সুর এবং কথার মেলবন্ধন সুরের সুতোয় কথার মালা৷ সুতো ছিঁড়লে মালাও ছিঁড়বে, আবার শুধু সুতোয় পৈতে হয়, মালা হয় না৷ তাই রবীন্দ্রসংগীতও রবীন্দ্রসাহিত্যের সামগ্রী৷ রবীন্দ্রসাহিত্যের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি তার গানের কথা আলোচিত না হয়৷ অবশ্য রবীন্দ্রনাথ নিজে বলেছেন, শুধায়োনা কবে কোন গান কাহারে করিয়াছিনু দান৷ এরপরে সে নিয়ে আলোচনা করা কথার অবাধ্য হওয়া৷ যা তিনি বারণ করে গেছেন তা করা উচিত কাজ হবে না৷ কিন্তু কোন পর্বের কোন গান তাঁর কোন মানসিকতার অন্তর্গত বা কোন ঘটনায়, কোন দুঃখে, কোন আনন্দে কোন সময়ে গানগুলি উৎসারিত সে নিয়ে আলোচনা অবশ্যই হতে পারে৷ এই আলোচনা বিশেষ ঘটনা, মানসিকতা, যা দিয়ে তৈরি হয়েছে কবির কল্পলোকের জগৎ যেখান থেকে উৎসারিত তাঁর গান৷ আমরা অনেকেই জানি রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান ও পূজার গান তেমন করে আলাদা করা যায় না৷ তার কারণ রয়েছে–কখনো ভাগ্যের, কখনো নিজের দুর্বলতায় বা কখনো নিজের বিবেচনায়৷ সেজন্যে দুই বাহুর মধ্যে ধরা প্রেমের আকু লতা তাঁকে কল্পনায়, ধ্যানে, অন্তরের আহুতিতে জানতে হয়েছে৷ তাই প্রেমই হয়ে উঠেছে পূজা–তাঁর গানে৷ বারে বারে মৃত্যু ও বিচ্ছেদ তাঁর উদ্দীপিত প্রেমের উৎসকে শুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু বিপরীত হয়েছে– প্রেম,তাঁর অজস্র গানে-গানে পূজা রূপ ধরে৷ একান্ত আপন, একান্ত গোপন তাঁর প্রেম এবং পূজার পুণ্য ধূপের ধোঁয়ায় সুরভিত তাঁর গান! সেজন্যে মনে কি তাঁর কোনো আক্ষেপ ছিল না? ছিলো–‘আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী,’ ‘মোরে বারে বারে ফিরালে’, ‘যতবার আলো জ্বালাতে চাই,’ ‘তার হাতে ছিলো হাসির ফু লের হার,’–তাঁর জীবনের বিশেষ চারটি পর্বের চারটি গান৷ এগুলি কবির দুঃখজনিত স্বগতোক্তি৷ আরো এ বিষয়ে গান তাঁর গীতবিতান খুললেই মিলবে৷ তাঁর জীবনের প্রথম পর্ব ও শেষের পর্বের কবিতা, রচনা ইত্যাদি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে৷ মধ্যজীবন নিয়েও আলোচনা হয়েছে অনেক– বিশেষ করে এই পর্বে লেখা গীতাঞ্জলি নিয়ে–সেসব তাঁর মনের ধর্মের ভাব নিয়ে আলোচনা৷ কত দুঃখে যে গানগুলি রচিত সেকথা তেমনভাবে বলা হয়নি৷ কিন্তু হঠাৎ জীবনের মধ্যপর্বে তাঁর গান কেন দিগবিদিক ছড়িয়ে পড়ল সে নিয়ে আলোচনা বোধ হয় কম৷ ধর্মের বাঁধাধরা রাস্তা পার হয়ে নতু ন উপলব্ধ এক ধর্মের কথা তিনি বলতে শুরু

করলেন তাঁর শান্তিনিকেতনের উপাসনা মন্দিরে৷ অনেকটা বুদ্ধের উপদেশের মতন–কিন্তু শুধু শীলের কথাই তিনি বলেননি–মানুষের জীবনে নানা ভু লভ্রান্তি, দুঃখশোক আমাদের নতু ন ব্যথা, যা তিনি উপনিষদের মন্ত্র দিয় ফু টিয়ে তু লেছেন–শান্তিনিকেতন বই সে সাক্ষ্য বহন করছে৷ এই মধ্যপর্বে তাঁর জীবনের প্রধান ঘটনা তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যার মৃত্যু৷ ১২০৮এর মাঘোৎসবের উপাসনায় রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘এই দুঃখই মানুষের একান্ত নিজস্ব৷ বাকি সবই মানুষ লাভ করেছে ঈশ্বরের কাছ থেকে৷ তাই মানুষের মহত্ব হলো দুঃখের দান– যেখানে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন৷’ (রবীন্দ্রনাথ–সুপ্রিয় ঠাকু র)৷ তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পরে পনেরো বছরের গানের মধ্যে তাঁকে ধরার চেষ্টা করা যেতে পারে৷ এরই মধ্যে তাঁর এক কন্যা ও কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যু হয়েছে৷ রবীন্দ্রনাথের এই মধ্যমা কন্যাটি একটু ভিন্ন প্রকৃ তির ছিলেন, জেদি, ছিলেন বসনভূ ষণে নিরাসক্ত৷ মৃত্যুর সময়ে বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘বাবা, ওঁ পিতা নোহসি বলো’–সেই মন্ত্র উচ্চারণের মধ্যেই রেণুকার শেষ নিশ্বাস পড়ে৷ শমীন্দ্রনাথ ছিলেন শিশু অন্যান্য শিশুর মতনই গাছপালার প্রতি তাঁর আকর্ষণ অত্যন্ত প্রবল ছিল৷ প্রকৃ তির কোলে ছয় ঋতু র আবেষ্টনে তাঁর দিন কাটছিল৷ হঠাৎই হলো ছন্দপতন৷ রবীন্দ্রনাথের মানসিক জগতে এ সবের অবশ্যই বিরাট প্রভাব পড়েছিল৷ যাই হোক, তাঁর এই পর্বের গানে পাওয়া যাবে স্বদেশপ্রেম, তখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও দীন-দরিদ্র-দুঃখী সাধারণের প্রতি তাঁর আন্তরিক সহানুভূ তি৷ মানবপ্রেমিক তিনি প্রথম থেকেই–বিশেষ করে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’র পর, কিন্তু বিশ্বমানবতাবোধের জন্ম এই সময়েই৷ সীমা-অসীম-তত্ব নিয়ে ভেবেছেন আগেও, কিন্তু এই সময়ের গানে তার চূ ড়ান্ত প্রকাশ৷ তিনি একসময় নিজেই গেয়েছেন–‘আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে, আমার এ দীপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো’৷ চির বিচ্ছেদের আগুনে তিনি এই পর্বে দগ্ধ হচ্ছিলেন৷ স্ত্রী-কন্যা-পুত্রের মৃত্যু তাঁকে একের পর এক আঘাত হেনেছে, কিন্তু সেইসব শোক তাঁকে জ্বালিয়ে সোনা করে তু লেছিল৷ সেই সোনার আলোর আভা তাঁর এই সময়কার গানে৷ যখন সে জিনিস মানুষ সহজে পায় তার মূল্য সবসময়ে উপলব্ধ হয় না৷ রবীন্দ্রনাথ যে মানুষই ছিলেন এটিই তাঁর বিশুদ্ধ প্রমাণ৷ সেই নিশ্চিত আরামের সংসারটি যখন ভেঙে গেল, তার আঘাত তাঁর অন্তরে গিয়ে প্রবল ঘা দিল৷ তারপরে একে একে এল কন্যা ও পুত্রের মৃত্যুশোক৷ অন্য লোক হলে এই আঘাতে একেবারে ভেঙে পড়তেন সেখানেই রবীন্দ্রনাথ আবার অন্যদের থেকে পৃথক৷ দারুণ শোককে তিনি মানবিকতায়, অনন্তের টানে, প্রেমের পূজার ফু লে বিকশিত করলেন তাঁর গানে৷ উপলব্ধি তাঁর গানে শতধা হয়ে বিভিন্ন ধারায় ছড়িয়ে পড়ল৷ তাঁর সংসারখানি কেমন ছিল? স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ঘেরা একটি ‘শান্তিনিকেতন’৷ জীবনের বিভিন্ন পথে ছুটে বেড়িয়ে এই সংসারটিতে যখন ফিরতেন তখনই দুটি মমতার হাত বাড়িয়ে দিত এই সংসারটিই৷ তাঁর ভগ্নহৃদয়ে এই সংসারখানিই শান্তির প্রলেপ দিয়ে তাঁকে বল জুগিয়েছে, তাঁর সৃষ্টিকে, হাতের অপার শক্তিকে৷ মৃণালিনী

কেমন ছিলেন? সাধারণ, অতিসাধারণ–শিলাইদহে যাবার আগেই এই প্রথম সাধারণের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয়৷ জোড়াসাঁকোর পরিবেশ সে সময়ে কেমন ছিল আমরা সবাই জানি৷ রূপে, গুণে, জ্ঞানে, বিদ্যায়, সংস্কৃ তিতে সে যুগের ইতিহাসে জোড়াসাঁকোর ঠাকু রপরিবার ছিল সবারই ঈর্ষার কারণ৷ পরিবারটি ছিল একটু উন্নাসিকও– এই সব কারণে৷ সেই পরিবারে সাধারণের প্রত্যক্ষ প্রবেশ বলা যেতেই পারে মৃণালিনী দেবীর মাধ্যমে–আর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরই জীবনে৷ মৃণালিনী দেবী সুন্দরী ছিলেন না–কোনো বিশেষ ব্যক্তিত্ব নিয়েও তাঁর জন্ম হয়নি–নেহাতই ঘরণী-গৃহিণী-জননী, কিন্তু সেখানেই তাঁর জয়পতাকা পতপত করে উড়েছে৷ তাঁর মতো সুগৃহিণী, রন্ধনপটিয়সী, স্নেহ-মমতাভালোবাসা শ্রদ্ধায় ভরা মন দুর্লভ৷ শুধু আপন করার ক্ষমতায় তিনি জয় করেছিলেন সেই উন্নাসিক শ্বশুরালয়ের প্রায় সবারই অন্তর৷ দেবেন্দ্রনাথের যে ভ্রাতৃ জায়া–তিনিও মৃণালিনীর উপরোধে ও বিশ্বস্ততায় জোড়াসাঁকোর প্রথম অন্নগ্রহণ করেছিলেন৷ শিলাইদহে যখন সংসার করেছেন–বাড়ির লোকজনের ভালো-মন্দের উপর ছিল মৃণালিনীর তীক্ষ্ণ নজর৷ সে যুগেও তিনি তাঁর বাড়ির লোকজনদের সপ্তাহে একদিন করে ছুটি দিতেন৷ বাড়ির কাজে সেদিন সাহায্য করত তাঁর পুত্রকন্যারা৷ এভাবে লোকজনদের একদিন ছুটি লাভ হতো– বাড়ির ছেলেমেয়েরা স্বাবলম্বী হতে শিক্ষা পেত৷ বিশেষ কিছু রান্না করলে বা মিষ্টান্ন বানালে তিনি তা জমিদারির কাছারি বাড়িতেও পাঠিয়ে দিতেন৷ শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের পত্তনের সময়েও নিজের গহনা বিক্রি করে রবীন্দ্রনাথকে অকু ণ্ঠ সাহায্য করেছেন তাঁর উদার হৃদয়খানি মেলে ধরে৷ একথা লিখেছেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কবির কথা বইটিতে৷ ছেলেমেয়েদের সামলিয়ে প্রায় একেবারে একাই তাঁর সংসারখানি সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতেন, কারণ রবীন্দ্রনাথ বেশিরভাগ সময় কাটাতেন জমিদারি পরিদর্শনে পদ্মাবক্ষে৷ যখন বাড়ি ফিরতেন, দুখানি লক্ষ্মীর হাত তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে থাকত–ভালোবাসা-শ্রদ্ধায়-সেবায় অক্লান্ত৷ স্ত্রী-সন্তানপরিবৃত এই সংসারটি রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করত, প্রলুব্ধ করত, কিন্তু তাঁর সুর বাঁধা ছিল উচেচ, ঊর্ধ্বলোকে৷ সেখান থেকে তাঁর স্ত্রীর জীবিতকালে তাঁরই পার্থিব জীবনে সহজভাবে নেমে আসা সম্ভব হয়নি৷ স্ত্রীর মনে সেইজন্য কোনো ব্যথাবোধ ছিল না এমন নয়–কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করতেন না৷ একথা জানি রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর মৃত্যুর পরের পর্বে৷ রবীন্দ্রনাথের মনেও কম অনুশোচনা ছিল না৷ কিন্তু মৃণালিনী দেবীকে এই দুঃখ ছায়াচ্ছন্ন, ম্লান করতে পারত না–এমনই ছিল তাঁর সহজে ভালোবাসার শ্রদ্ধার ক্ষমতা৷ তিনি, রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী হয়েও নিজেকে কখনো কেউকেটা বলে ভাবেননি৷ সাধারণ হয়েই থেকেছেন সমস্ত ঘরদুয়ার আলো করে৷ তাঁর সেই সহজ-সরল আলোর ধারায় আলোকিত ঠে

হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী জীবন, মনুষ্যত্বের তু ঙ্গে তু লেছিল রবীন্দ্রনাথকে তাঁর নতু ন উপলব্ধিতে৷ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকু র রানী চন্দকে বলেছিলেন ‘রবিকার জীবনী পাওয়া যাবে তাঁর গানে৷’ এই মন্তব্যের স্থূল নানা কল্পনার উদ্দীপনা হবে বলে ভয় পেয়েছেন কেউ৷ অবনীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মর্মের জীবনীর কথা বিশেষ একজনের৷ অবশ্যই– মানুষের মনোজীবন তার বাস্তবজীবনকে অবলম্বন করেই থাকে, তা নয়তো রবীন্দ্রনাথের সীমার থেকে অসীমের যাত্রাও ব্যর্থ হয়ে যায়৷ রবীন্দ্রনাথ অমানুষ ছিলেন একথা ভাবতে খুবই খারাপ লাগে৷ যে ব্যক্তিকে অবলম্বন করে তাঁর পাঁচটি সন্তান হয়েছিল, সুখে দুঃখে জীবন প্রায় কু ড়ি বছর একসঙ্গে জড়ানো ছিল, তাঁর মৃত্যুর পর একমাত্র স্মরণ কাব্যগ্রন্থ এবং প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায় অনুমিত একটি গানেই তাঁর তর্পণ শেষ হয়ে গেছে সারাজীবনের মতন, একথা ভাবলে পর্যন্ত সমস্ত মন বিদ্রোহ করে ওঠে৷ রবীন্দ্রনাথের মনে কি কোনো আলোড়নই এই মৃত্যু তোলেনি? তিনি কি এত নিষ্ঠু র, এতই হৃদয়হীন ছিলেন? সন্তানদের এত সেবা করেছেন, এত ভালোবেসেছেন শুধুই তাঁর নিজের ঔরসে উৎপন্ন বলে, অন্য কারুর ভাগ সেখানে নেই, এতই পিতৃ তান্ত্রিক ছিলেন তিনি? সামান্য জোনাকি, সামান্য স্ফু লিঙ্গ, সামান্য তৃ ণ, সামান্য মানুষের উপর যাঁর এত করুণা, দয়া, এত শ্রদ্ধা ‘তু মি ছোটো হয়েও নওকো ছোটো, জগতে যেথায় যত আলো সবার আপন করে ফেলেছো’–একথা যিনি বলেন, তাঁর বিশ্বময় দয়া, করুণা ভালোবাসা শুধু একটি ব্যক্তিতে এসেই নিঃশেষ? সমস্ত অন্তরাত্মা শিউরে ওঠে মনুষ্যত্বের এই অবর্ণনীয় অবমাননায়৷ খেয়া কাব্যের–‘দিঘি’ কবিতায় বলছেন– ওগো বোবা, ওগো কালো, স্তব্ধ সুগম্ভীর গভীর ভয়ংকর তু মি নিবিড় নিশীথ-রাত্রি বন্দী হয়ে আছো মাটির পিঞ্জর৷ পাশে তোমার ধূলার ধরা কাজেরই রঙ্গভূ মি প্রাণের নিকেতন, হঠাৎ থেকে তোমার ’পরে নত হয়ে পড়ে দেখিছে দর্পণ৷ –রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য মানসীরা আর যাই হন ‘বোবা’ ছিলেন না৷ সাধারণ মানুষই সব সময়ে মনের কথা গুছিয়ে বলতে পারে না৷ ‘তোমার নয়ন আমায় বারে বারে বলেছে গান

গাহিবারে’ গানটিতে বলেছেন–‘ডাক দিয়েছো ঝড় তু ফানে বোবা মেঘের বজ্রগানে৷’ জীবনের প্রায় শেষ পর্বে নৃত্যনাট্য শাপমোচনের রাজার নাম অরুণেশ্বর রানির নাম কমলিকা৷ স্থূল মিল? স্থূল মিল যাতে না হয় তাই বেশ পরিবর্তন৷ শাপমোচনের একটি সংলাপ গদ্যে, ‘অসুন্দরের পরম বেদনায় সুন্দরের আহ্বান৷ সূর্যরশ্মি কালোমেঘের ললাটে পরায় ইন্দ্রধনু, তার লজ্জাকে সান্ত্বনা দেবার তরে৷ মর্ত্যের অভিশাপে স্বগের্র করুণা যখন নামে তখনি তো সুন্দরের আবির্ভাব৷ প্রিয়তমে, সেই করুণাই কি তোমার হৃদয়কে কাল মধুর করেনি?’ –‘ওগো জলের রানী, ঢেউ দিয়োনা দিয়োনা, ঢেউ দিয়োনা গো–আমি যে ভয় মানি’–আরও একটি ‘ও জলের রানী ঘাটে বাঁধা একশো ডিঙ্গি’ জোয়ার আসে থেমে৷ বাতাস ওঠে দক্ষিণমুখে’ কী অসম্ভব স্থূল মিল৷ শেষোক্ত গানটি ‘দালিয়া’ গল্পের নাট্যরূপের সূচনায় সংযোজিত৷ দালিয়ার সঙ্গে সাধারণ ঘরকন্নায় যখন তিন্নির ভালোবাসা তখন তা সচেতন নয়৷ তিন্নি যখন জানল দালিয়াই রাজা সেই সচেতনতায় তার মূর্চ্ছা, কারণ রাজাকেই সে হত্যা করতে এসেছে৷ চেতনহীনতা অজ্ঞানতার সুখ সচেতনতার দুঃখের আগুনে সত্যকে, আনন্দকে পাওয়া৷ –জীবনের শেষতম কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন– লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত৷ সত্যেরে যে পায়– আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে৷ কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে৷ শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে আপন ভাণ্ডারে৷ অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে সে পায় তোমার হাতে শান্তির অক্ষয় অধিকার৷ বিশেষ ব্যক্তি দিয়ে কবিতাটিকে গণ্ডিবদ্ধ করব না, তবে বিশেষ-ব্যক্তিকেই অবলম্বন করে পৃথিবীর সমস্ত প্রবঞ্চিত মানুষই এই কবিতার উদ্দিষ্ট ব্যক্তি বলে মনে করি৷ স্ত্রী-কন্যাপুত্রের মৃত্যুর পর চির-বিচ্ছেদের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ সব উপলব্ধিতে সমৃদ্ধ গানগুলিকে বিভিন্ন ধারায় ধরবার চেষ্টা হয়তো এইভাবে করা যেতে পারে, কারণ মৃণালিনীর মৃত্যুর পর থেকে কন্যা-পুত্রের মৃত্যুর অনুক্রমে রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী পনেরো বছরের গানে রূপকে-সংকেতে-ইঙ্গিতে আমরা এই কয়টি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করি,

(১) মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রেম ও অনাদৃতা জননী রূপটি এক হয়ে গেল৷ জননীরূপী স্বদেশি সহজ স্বচ্ছ ভাষায় প্রকাশ পেল, ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা,’ ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে,’ ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি,’ প্রভৃ তি গানে৷ (২) নিজের ঘরের জননীটি আবার দেখা দিল বিশ্বজননীর ভূ মিকায়–যেখানে বিশ্বের সঙ্গে আত্মীয়তা অনায়াসে স্থাপিত হলো বিশ্বজননীর আঁচল ধরে৷ ‘যা ছিলো কালো ধলো– রঙে রঙে রাঙা হলো’–বর্ণ, জাতি, স্বদেশ-বিদেশ তাঁর চোখে এক হয়ে গেল৷ বিশ্বের সাথে যোগে আর কোনো বাধা রইল না বিশ্ববোধ এইভাবে তাঁর অন্তরে স্থান পেল৷ এই পর্বের গান তার সাক্ষ্য বহন করছে–‘বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছো কেমনে দিই ফাঁকি,’ ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো,’ ‘কত অজানারে জানাইলে তু মি,’ ‘মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্ত দ্বারে,’ ‘সবার মাঝারে তোমারে স্বীকার করিব হে’ ইত্যাদিতে৷ (৩) সীমা অসীম তত্বের উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথের আগে হয়নি তা নয়, ছোট্ট শিশির বিন্দুতে সমগ্র সূর্য প্রতিবিম্বিত হয়–একথা তিনি বলেছেন আগেও৷ কিন্তু এই পর্বেই অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় তাঁর গানে বললেন–‘সীমার মাঝে অসীম তু মি বাজাও আপন সুর,’ ‘আমারে তু মি অশেষ করেছো৷’ বিশেষকে অবলম্বন করেই অসীম অনন্ত হৃদয়ে জেগে ওঠে–এই বোধ তাঁর সম্পূর্ণ হলো৷ (৪) বৈষ্ণব কবিতায়–‘দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়েরে দেবতা’–এই দ্বৈত থেকে অদ্বৈতে যাত্রার কথাও তাঁর এসময়ের গানে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়েছে–‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর’, ‘আমার মিলন লাগি তু মি আসছো কবে থেকে,’ প্রভৃ তিতে৷ (৫) পেছনে পড়ে থাকা মনুষ্য সমাজের প্রতিও তাঁর চোখের আলো হঠাৎ উপচে পড়ল–এই উপলব্ধিও এক নতু ন দিকদর্শন তাঁর জীবনে–‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন,’ ‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে’ ইত্যাদিতে৷ (৬) অসাধারণ কতগুলি ভালোবাসার গান তাঁর এই পর্বের রচনা–‘যেদিন ফু টলো কমল,’ ‘তু মি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে’, ‘এখনো ঘোর ভাঙ্গে না তোর রে মেলে না তোর আঁখি’, ‘কে গো অন্তরতর সে’, ‘ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো আমার মুখের আঁচলখানি’, ‘তু মি ডাক দিয়েছো কোন সকালে’, ‘তোমায় কিছু দেবো বলে চায় যে আমার মন’, ‘হার মানা হার পরাবো তোমার গলে’–একি লিখে শেষ করা যায়৷ ‘বসন্তে আজ ধরার চিত্ত হলো উতলা’, ‘বসন্তে কি শুধু কেবল ফোটা ফু লের মেলা’ –এইসব গানে বসন্তের আনন্দের সঙ্গে তাঁর বেদনাভরা ভালোবাসা মিশে গেছে৷

(৭) এই সময়েই রচিত হয় শারদোৎসব নাটক৷ ‘আমার নয়ন-ভু লানো এলে’ প্রভৃ তি গানে শারদলক্ষ্মীর উদ্বোধন তাঁর অন্তরে৷ সারদার রূপে কার ছায়া ভাসছে সহজেই অনুমেয়৷ শারদোৎসব নাটকের পরের নাম ‘ঋণশোধ’৷ কিসের ঋণ, কার ঋণ–একথা আমাদের একটু ও ভাবাবে না? (৮) ‘ভাঙা পথের রাঙাধুলোয় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন’, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে’–এসব গানে কার আগমনী–গভীর দুঃখে, তাঁর জীবনে? (৯) ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাবো না’, ‘রূপ-সাগরে ডু ব দিয়েছি অরূপরতন আশা করি’–কোন রূপের কথা তিনি এসব গানে বলেছেন? ‘রাজা’-‘অরূপরতন’-‘শাপমোচন’৷ সুতরাং ‘রাজা’ নাটকটির ভাব তাঁর মনে শেষ পর্ব পর্যন্ত বিস্তৃ ত ছিলো৷ রাজার নতু ন ব্যাখ্যার কথা কি কারু মনে পড়বে না? (১০) আর একটি উপন্যাস তিনি বার বার পরিবর্তন করে লিখেছেন তা হলো বউ ঠাকু রাণীর হাট যা তাঁর প্রথম পর্বের লেখা৷ কিন্তু মধ্যপর্বে তার নাট্যরূপ হলো প্রায়শ্চিত্ত পরে পরিত্রাণ৷ কেন এই বার বার পরিবর্তন? তাঁরই গানেই বলা যায় ‘আমার না বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে তোমার ভাবনা তারার মতন রাজে’–৷ (১১) পরিশেষে বলি গীতাঞ্জলি তাঁর এই পর্বেরই রচনা৷ ৩৪ বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা

‘নবীন’- স্মৃতি ও রবীন্দ্রনাথের নৃত্য-ধারা রমা চক্রবর্তী পুরোনো দিনের শান্তিনিকেতনের কথা লিখতে বসে নানা স্মৃতি মনে ভিড় করে৷ তার মধ্যে থেকে, এখনকার এই বসন্তের দিনে, ‘নবীন’ সম্বন্ধে স্মৃতিচারণ করতে আগ্রহ হচ্ছে৷ গুরুদেব ‘নবীন’কে নতু ন গানের মালায় সাজিয়েছিলেন৷ কী অপূর্ব সেই গানগুলি৷ তাঁর কোন গানই বা অপূর্ব নয়৷ তাঁর গানের কথায় অমিয় চক্রবর্তী মহাশয়ের উক্তি মনে পড়ছে, ‘একদিকে ধ্যানোজ্জ্বল আদি হিমাদ্রি, অন্যদিকে মহাচিত্তের অতল প্রকাশ, দুয়ের মধ্যে দিয়ে তাঁর গানের প্রবাহিণী বৃহৎ মানবসংসারের নানা ফসলের সন্ধান নিয়ে বয়ে চলেছে৷’ আর ‘গান তাঁর বাণীর প্রতীক, তাঁর প্রেরণা, প্রাণের সঙ্গে পৃথিবীর সেতু ৷’ প্রাণের সঙ্গে পৃথিবীর সেতু বাঁধা তো তাঁর অব্যাহতই ছিল শেষদিন পর্যন্ত৷ উনিশশো ত্রিশে দীর্ঘ বিদেশ ভ্রমণের পর গুরুদেব শান্তিনিকেতনে ফিরে এলেন৷ তারপরই উনিশশো একত্রিশে প্রথম বড়ো অনুষ্ঠান হলো ‘নবীন’-এর মঞ্চাভিনয়৷ ‘নবীন’ প্রথম কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় ত্রিশে ফাল্গুন তেরোশো সাঁইত্রিশে, উনিশশো একত্রিশের মার্চে৷ দিনদা, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকু র, বেশ অনেক দিন ধরে ‘নবীন’-এর গানের রিহার্সাল দিয়েছিলেন৷ প্রথমে তো মস্ত দল–সবারই জন্য অবারিত দ্বার–যে শিখতে চায় সে-ই এসে শিখতে পারে৷ সব অনুষ্ঠানেই অবশ্য এইরকমই হতো৷ পরে যখন উত্তরায়ণে গুরুদেবের সামনে গিয়ে রিহার্সাল হতো তখন দিনদা দল বাছাই করে ছোটো করে নিতেন৷ ‘নবীন’এর রিহার্সাল নিতে দিনদা আসতেন তাঁর মোটরে করে৷ হর্ন দিতেন বিশেষ বিশেষ জায়গায় পৌঁছে–আমরা সেই হর্ন শুনেই কলাভবনের, এখন যাকে পুরোনো ‘নন্দন’ বলা হয়, হলে গিয়ে হাজির হতাম৷ শিশুবিভাগের কাছে আসতেই ছেলেরা ছুটে গিয়ে তাঁর গাড়িতে চড়াও হতো৷ গাড়ির ভিতরে, আশেপাশে, গাড়ির মাথায় সব ভরে যেত৷ দিনদা তখন শম্বু ক গতিতে এগোতেন৷ খানিকটা গিয়ে ‘এবার তোরা পালা’ বলে তাদের নামিয়ে দিয়ে রিহার্সালে আসতেন৷ তখনকার দিনে শান্তিনিকেতনে মাত্র দুটি মোটরকার ছিল৷ একটি গুরুদেবের, তাঁর বার্ধক্য ও অসুস্থতাহেতু দরকার হতো বলে যদিও খুব কমই সে-গাড়ি তাঁকে ব্যবহার করতে দেখেছি৷ আর অন্যটি ছিল দিনদার–তাঁর বিশাল বপু নিয়ে ঘুরে বেড়াবার অসুবিধা হতো বলে৷

দিনদার কথা মনে হলে মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে৷ তিনি যে কী চমৎকার সহজভাবে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিশতেন, কী আন্তরিক স্নেহ করতেন, তা তাঁকে কাছ থেকে না জানলে বোঝার কথা নয়৷ শান্তিনিকেতনে গিয়ে প্রথম যখন তাঁর কাছে যাই, তার বিশাল বপু, বড়ো বড়ো চোখ, গম্ভীর মুখ দেখে কী ভয়ই হয়েছিল৷ ভেবেছিলাম গান শিখে আর কাজ নেই বাপু! কিন্তু একটু পরিচয় হতেই তাঁর আপন-করা স্নেহময় ব্যক্তিত্ব আমাদের মুগ্ধ করে ফেলল৷ তাঁর গম্ভীর অথচ মধুর কণ্ঠের গান শুনে আশ্চর্য হয়ে যেতাম, কী ভালোই লাগত৷ পরে তিনি যেন আমাদের নিকট বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন৷ ‘নবীন’-এর রিহার্সাল নিতে এসে, দিনদা রোজই নতু ন গানের ঝাঁপি খুলতেন৷ গুরুদেব রোজ নতু ন গান রচনা করতেন আর দিনদাকে ডেকে ডেকে শেখাতেন, আর দিনদা আমাদের শেখাতেন৷ ওধারে বউঠানের, প্রতিমা ঠাকু রের কাছে নাচের রিহার্সালও শুরু হয়ে গিয়েছিল৷ ‘নবীন’-এর গানগুলির মধ্যে, গুরুদেব কয়েকটা গান, সাবিত্রীর গাওয়া হিন্দি ও কর্ণাটক গান থেকে রচনা করেছিলেন৷ সাবিত্রী গোবিন্দ পরে কৃ ষ্ণন কলাভবনের ছাত্রী ছিল৷ কিন্তু গানের জন্যই তার সময় যেত বেশি৷ তখনকার দিনে অবশ্য কোনো এক বিভাগে ভর্তি হলেও অন্য যে-কোনো বিভাগে গিয়ে শিক্ষা পাবার চল ছিল৷ আমরা অনেকেই সেই দলের৷ সাবিত্রীর আশ্চর্য মধুর কণ্ঠস্বর ছিল৷ গান গেয়ে সে সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিল৷ তার মিষ্টি হাসিখুশি স্বভাবও কম আকর্ষণের ছিল না৷ ‘‘বাসন্তী হে ভু বনমোহিনী,’’ ‘‘বেদনা কী ভাষায় রে’’, ‘‘তু মি কিছু দিয়ে যাও,’’ ‘‘বাজে করুণ সুরে’’ ও ‘‘কখন দিলে পরায়ে’’ গানগুলি তারই গান থেকে প্রেরণা পেয়ে, গুরুদেব করে গেছেন৷ মূল গানের কথা ও ভাবকে ছাড়িয়ে তিনি দূর গভীর চলে গেছেন৷ ‘নবীন’-এ সাবিত্রীকে দিয়েই গুরুদেব গানগুলি গাইয়েছিলেন৷ কেবল ‘কখন দিলে পরায়ে’ গানটি নুটু দি, রমা মজুমদার কর গেয়েছিলেন৷ এই গানটি সম্বন্ধে বিশেষ করে বলা যায় যে, মূল গানের সঙ্গে এটির যোগ খুব কম৷ মূল গান ‘কিনহে দেখা কানাহাইয়া প্যারা কি বনসিওয়ালা’’ ঠুংরি অঙ্গের৷ এর মূল সুরের কাঠামো কতকটা এ গানে পাওয়া যায়৷ হিন্দি গানটি দ্রুত লয়ের৷ গুরুদেব ‘কখন দিলে পরায়ে’ গানটি ঢিমে লয়ে মিড়ের কাজ বেশি দিয়ে রচনা করেছিলেন৷ ‘নবীন’-এর সাবিত্রীর গানের যেমন তু লনা ছিল না, তেমনি নুটু দির সুমধুর কণ্ঠ ‘কখন দিলে পরায়ে’ গানটিও অনবদ্য হয়েছিল৷ এই প্রসঙ্গে বুলাদার, প্রফু ল্লচন্দ্র মহলানবিশের বাঁশির সংগতের কথাও ভোলবার নয়৷ বুলাদার বাঁশি যারা শুনেছেন তাঁরাই জানেন উনি কী চমৎকার বাঁশি বাজাতেন, গুরুদেবের গান যেন মূর্ত হয়ে উঠত ওঁর বাজনার মধ্যে৷ তাছাড়া বেশিরভাগই সমবেত সংগীত ছিল৷ গানের ও নাচের দলের প্রত্যেকের নাম মনে নেই৷ যতটা মনে আছে, গানের দলে ছিলেন শান্তিদেব ঘোষ, পিনাকিন ত্রিবেদী, অমিতা সেন, অরুন্ধতী ঘোষ, মন্দিরা গুপ্ত, গোবর্ধন মপারা, রমা মুখার্জি

(চক্রবর্তী), হরপ্রসন্ন, সাগরময় ঘোষ ও আরও অনেকে৷ একক নৃত্যে ‘ওরে গৃহবাসী’ নেচেছিলেন হৈমন্তী চক্রবর্তী, ‘হে মাধবী দ্বিধা কেন’ যমুনা বসু, ‘ফাগুনের নবীন আনন্দে’ লতিকা রায়, ‘মরি হায়, চলে যায় বসন্তের দিন’ রমা মুখার্জি (চক্রবর্তী) অর্থাৎ এই লেখিকা, ‘আজ খেলা ভাঙার খেলা’ Elizabeth Brunner, ‘ক্লান্ত যখন আম্রমলির কাল’ অমিতা সেন, ‘ফাগুন তোমার হাওয়ায়’–(শান্তিদা–?), ‘‘ওরা অকারণে চঞ্চল’’ নন্দিনী ঠাকু র ও দ্বৈত নৃত্য ‘‘সে কি ভাবে গোপন রবে’’ নন্দিতা গাঙ্গুলী ও ললিতা সেন, ‘‘কে দেবে চাঁদ তোমায় দোলা’’ অমিতা সেন ও যমুনা বসু৷ বাকি অনেকগুলি সমবেত নৃত্য ছিল৷ তার মধ্যে জাপানি মেয়ে হোসীর নামও মনে পড়ছে৷ এই জাপানি মেয়েটি তার মিষ্টি স্বভাবগুণে সবার প্রিয়পাত্রী ছিল৷ ছোট্ট পুপে, অর্থাৎ নন্দিনী ঠাকু র পুতু লটির মতোই অপরূপ সুন্দর ছিল৷ সে যে ‘‘ওরা অকারণে চঞ্চল’’ গানটির সঙ্গে নেচেছিল, আমরা সবাই জানতাম গুরুদেব এ গান ওর কথা মনে করেই রচনা করেছিলেন৷ সে যে কী প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিমা, তা বোঝাব কী করে! ‘নবীন’-এর রিহার্সাল যখন বেশ দানা বেঁধে উঠেছে তখন অনেকেই এসে দেখতেন৷ একদিন রিহার্সালে যখন ‘‘আজ খেলা ভাঙার খেলা’’ গানটি হচ্ছে, তখন একটি বিদেশি মেয়ে হঠাৎ ঝড়ের মতো ছুটে এসে নাচতে শুরু করে দিল৷ সবাই হকচকিয়ে গেল৷ কিন্তু গুরুদেব গান থামাবার ইঙ্গিত করলেন না৷ গানও হতে থাকল সেও নেচে চলল৷ সে কী উদ্দাম নাচ, কী আকূ তি ও ভাব-ব্যঞ্জনা৷ গুরুদেবও খুশি হলেন৷ সে তো তখনও জানত না, ছন্দে, সুরে আকৃ ষ্ট হয়েই কী প্রেরণা পেল যে ছুটে এসে নাচতে শুরু করে দিল৷ তার নাচটি এইভাবে, ‘নবীন’-এ যুক্ত হল৷ মেয়েটি হাঙ্গেরিয়ান, নাম Elizabeth Brunner– কলাভবনে যোগ দিয়েছিল৷ তার নাচ যে আমাদের প্রথায় ছিল না, তা বলাই বাহুল্য৷ কিন্তু তার স্বতঃস্ফূ র্ত অভিব্যক্তি ও উদ্দাম গতিছন্দ গানের ভাবটি ফু টিয়ে তু লতে পেরেছিল৷ তখনকার দিনে ঠিক টেকনিকাল নাচ তো ছিল না, মণিপুরি নাচের ঢঙে ভাবনৃত্যই ছিল প্রধান৷ গুরুদেব তাই পছন্দ করতেন৷ পরে নৃত্যনাট্যের যুগে, যখন মণিপুরি কথাকলি ও ভরতনাট্যমেরও বেশ ভালোরকম চল হয়েছিল, তখনও গুরুদেব দৃষ্টি রাখতেন যাতে টেকনিক গানের ভাবকে ছাড়িয়ে না যায়৷ এলিজাবেথের হঠাৎ ঝড়ের বেগে আসরে ঢু কে পড়ে উদ্দাম নৃত্য শুরু করে দেওয়া যেমন চমক এনে দিয়েছিল, তেমনি রমা মুখার্জির একক নৃত্য পরিবেশন করাও তার নিজের কাছেই, কম চমক লাগায়নি৷ সে তো জানে গানের দলেই তার স্থান, সেই ভাবে রিহার্সালও দিচ্ছে৷ বেশ কয়েকদিন রিহার্সাল হবার পর বউঠান তাকে ডেকে বললেন যে তাকে গানের সঙ্গে নাচতে হবে৷ সে তো আকাশ থেকে পড়ল! সে বলল, ‘এ কখনোই হতে পারে না৷’ বউঠান তাঁর শান্ত মাধুর্যে অভয় দিয়ে বললেন ‘দেখই না চেষ্টা করে ভাল না হলে তো আর বলব না৷ তাছাড়া বাবামশাই

দেখবেন তবে তো৷’ সে তো ভেবে অস্থির! কতটু কু ই বা নাচ শিখেছে যে একলা নাচবে! অমিতা যমুনারা কী-চমৎকার নাচে, আর তার পাশে সে! কিন্তু বউঠান যখন বলেছেন চেষ্টা তো করতেই হবে৷ প্রতিমা বউঠানের ছিল আশ্চর্য অধ্যবসায়, সাবলীল নৃত্যে তাকে উতরে দেবেনই, যেন পণ করেছিলেন৷ একদিন বললেন ‘এই তো বেশ হয়েছে৷ আজ বাবামশাইকে দেখাতে হবে৷’ সে খুবই ভয় পেল, তবে একটু নিশ্চিন্তও হলো যে গুরুদেব নিশ্চয় নাকচ করে দেবেন৷ গুরুদেব তো নাকচ করলেনই না, বরং অনেক উৎসাহ দিলেন৷ নিজে উঠে এসে হাত ধরে দেখিয়ে দিলেন৷ গুরুদেবের উৎসাহ পেয়ে কেমন করে যেন তার ভয়টা কেটে গেল৷ শেষ পর্যন্ত নাচটা যে উতরে গিয়েছিল, তা বউঠানের সস্নেহ অক্লান্ত চেষ্টায়৷ ‘নবীন’-এর রিহার্সাল তৈরি হয়ে যাবার পর, কলকাতায় দল নিয়ে যাবার আগে একদিন আশ্রমবাসীদের জন্য লাইব্রেরির বারান্দায় ‘নবীন’ অনুষ্ঠিত হল৷ ‘নবীন’ নাচে-গানে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল৷ আর সব থেকে বড়ো আকর্ষণ ছিলেন গুরুদেব স্বয়ং৷ ‘নবীন’-এর পাঠের অংশটু কু তিনিই পড়তেন৷ কী অপূর্ব তাঁর বলার ধরন, কী অপূর্ব অভিব্যক্তি! তাঁর প্রশান্তিতে উদ্ভাসিত রূপ সবাইকে মুগ্ধ করে রাখত৷ এ অবিস্মরণীয় স্মৃতি৷ ‘নবীন’ প্রথম অনুষ্ঠিত হয় নিউ এম্পায়ারে৷ তখনও এটি সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি বলে আমরা জোড়াসাঁকোর বিচিত্রাভবন থেকেই সেজেগুজে ঢাকা গাড়ি সেডান কারে করে যেতাম৷ তখনকার দিনে নানা নতু ন সম্ভার নিয়ে ‘নবীন’ উপস্থিত হয়ে খুব সাড়া জাগিয়েছিল৷ আর আমরা তো মহাআনন্দে গুরুদেবের সঙ্গে একই বাড়িতে থেকে গৌরব বোধ করতাম৷ সকালের দিকে গুরুদেব ডেকে পাঠিয়ে খানিকক্ষণ রিহার্সাল নিতেন৷ তারপর খানিকক্ষণ গল্প হাসিঠাট্টাও করতেন৷ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার যে কত সহজ ছিল, এখন ভাবলে আশ্চর্য লাগে৷ প্রকৃ ত মহৎ না হলে কি এমন সহজ হওয়া যায়৷ ‘নবীন’-এর প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত নৃত্যধারা সম্পর্কে আমার যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তার ভিত্তিতে কিছু বলে যাওয়া প্রয়োজন আছে বলে মনে করি৷ রবীন্দ্রনাথ যে নৃত্য-ধারা প্রচলন করে গেছেন সেই সম্বন্ধে আলোচনা হওয়া একান্তই প্রয়োজন হয়ে উঠেছে কারণ এখনকার দিনে রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে নাচ যে মাত্রায় অরাবীন্দ্রিক হয়ে উঠছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আমার বক্তব্য অসংগত হবে না৷ রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে নতু ন কিছু বলার নেই৷ কারণ তিনি নিজেই সে বিষয়ে প্রভূ ত পরিমাণ লিখে গেছেন, শিখিয়ে গেছেন, কিন্তু তাঁর প্রচলিত নৃত্য সম্বন্ধে বলার আছে৷ শুধু নৃত্য নয়, বেশভূ ষা, অলংকার, মঞ্চসজ্জা প্রভৃ তি তাঁর সময়ে তাঁর নির্দেশে যা হতো সে

বিষয়েও অবহিত করা দরকার৷ সমগ্রভাবেই তাঁর প্রচলিত ধারা মনে রাখা, মেনে চলা দরকার৷ তিনি যেমন নানা ধরনের সুরে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক গান রচনা করেছেন, যেমন শাস্ত্রীয় সংগীত থেকে নেওয়া অনেক গান আছে, কীর্তনাঙ্গ, বাউলাঙ্গ গানও আছে, সাবিত্রী গোবিন্দের কর্ণাটক গানের থেকেও তেমনি কী অপূর্ব সুর সৃষ্টি করে গেছেন৷ নানাদেশে নানা ধরনের নৃত্যশৈলী দেখেও তিনি প্রেরণা পেয়েছেন, তাও তাঁর লেখা থেকে জানা যায়৷ ‘জাভাযাত্রীর পত্র-এ লিখেছিলেন–এ দেশের উৎসবের প্রধান অঙ্গ নাচ, এখানকার নারকেলবন যেমন সমুদ্রের হাওয়ায় দুলছে, তেমনি সমস্ত দেশের মেয়ে পুরুষ নাচের হাওয়ায় আন্দোলিত৷ এক একটি জাতির আত্মপ্রকাশের এক-একটি বিশেষ পথ থাকে৷ বাংলাদেশের হৃদয় যেদিন আন্দোলিত হয়েছিল সেদিন সহজেই কীর্তন গানে সে আপন আবেগ সঞ্চারের পথ পেয়েছে, এখনও সেটা সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়নি৷ এখানে এদের প্রাণ যখন কথা কইতে চায় তখন সে নাচিয়ে তোলে৷...’ মানুষের জীবন বিপদ-সম্পদ সুখদুঃখের আবেগে নানাপ্রকার রূপে ধ্বনিতে স্পর্শে লীলায়িত হয়ে চলছে৷ তার সমস্তটা যদি কেবল ধ্বনিতে প্রকাশ করতে হয় তাহলে সে একটা বিচিত্র সংগীত হয়ে ওঠে তেমনি আর সমস্ত ছেড়ে দিয়ে সেটাকে কেবলমাত্র যদি গতি দিয়ে প্রকাশ করতে হয় তাহলে সেটা হয় নাচ৷ ছন্দোময় সুরই হোক আর নৃত্যই হোক তার একটা গতিবেগ আছে, সেই বেগ আমাদের চৈতন্যে রসচাঞ্চল্য সঞ্চার করে তাকে প্রবলভাবে জাগিয়ে রাখে৷ কোনো ব্যাপারকে নিবিড় করে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের চৈতন্যকে এইরকম বেগবান করে তু লতে হয়৷ জাভা দেশের স্বতঃস্ফূ র্ত নৃত্যশৈলী গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে গভীর ভাবেই অনুপ্রাণিত করেছিল, তা তাঁর লেখা থেকেই বোঝা যায়৷ তার কারণ তিনিও যে নৃত্যশৈলীর প্রবর্তন করেছিলেন, যাকে তিনি বলতেন ভাবনৃত্য৷ সেও তো এমনই ধারার প্রকাশ৷ মানুষের মনে যে অনুভূ তিই হোক না কেন তার গতিবেগ চৈতন্যে ঘা দেবেই, তাঁর ভাব প্রকাশ করতে ছন্দোময় গতি এসে পড়বে, সেইভাবে অজান্তেই যেন নৃত্যভঙ্গি এসে যায়৷ জাভাদেশের নাচের টেকনিক তিনি গ্রহণ করেননি, কিন্তু তাদের স্বতঃস্ফূ র্ত ভাবাবেগ তাঁকে আকৃ ষ্ট করেছিল৷ গুরুদেবও তো এইভাবেই ভাবনৃত্য প্রচলন করেছিলেন৷ ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী বলেছেন ‘‘ ‘এত রঙ্গ শিখেছ’ গানের সঙ্গে ঢোলক বাজাতে বাজাতে, নাচতে নাচতে রঙ্গমঞ্চে লাফানোকে কতকটা স্বাভাবিক আনন্দ বিকাশের একটা ভঙ্গিমাত্র

বলা যেতে পারে৷ তবে এইসব নাচের মধ্যেই বোধহয় রবিকাকার পরবর্তী নৃত্যকলা বিকাশের অঙ্কু র নিহিত’’৷ এটি হলো ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’র সময়কার কথা৷ ভেবে দেখতে গেলে তখন থেকেই ‘নৃত্য কলা-অঙ্কু র’ বেশ তরতরিয়ে শাখা বিস্তার করে চলল৷ বিশেষ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করল উনিশশো ছাব্বিশের ‘নটীর পূজা’৷ ‘নটীর পূজা’য় নটীর ভূ মিকায় গৌরী ভঞ্জর অভিনয় ও নাচ তো কিংবদন্তী হয়েই গেছে৷ সে নাচও ভাবনৃত্য পর্যায়েই পড়ে যদিও তখনকার শান্তিনিকেতনের মনিপুরি নৃত্য-শিক্ষক গৌরীদিকে কিছু মণিপুরি ছন্দে হাত ও পায়ের কাজ শিখিয়েছিলেন কিন্তু আসল যে অন্তরের ভাবের প্রকাশ, যা প্রায় তু লনাহীন তার সবই গুরুদেব প্রচলিত ভাব-নৃত্যাশ্রয়ী৷ অমিতা সেনের বই আনন্দ সর্বকাজে তে ‘নটীর পূজা’-র সুন্দর বিবরণ আছে৷ অমিতার বইতে পাই ‘নটীর ভূ মিকায় গৌরীদির অপূর্ব নৃত্যটি সেদিনের সকলের মনে স্বর্ণাক্ষরে আঁকা হয়ে আছে৷ কী অনবদ্য অভিনয় গৌরীদির!’ তেরোশো তেত্রিশে শান্তিনিকেতনে পঁচিশে বৈশাখে গুরুদেবের জন্মদিনে কোনার্ক গৃহের সামনে ‘নটীর পূজা’ অভিনয় হয়৷ তারপরে মাঘ মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠানটি হয় জোড়াসাঁকো ঠাকু রবাড়িতে৷ ‘নটীর পূজা’ দেখে সবাই চমৎকৃ ত হয়ে গিয়েছিলেন, এমনটি তো কখনো কল্পনাও করা যেত না৷ অমিতা লিখেছে ‘‘অভিনয় শেষ হল–পর্দা পড়ে যেতেই অবনীন্দ্রনাথ চলে এলেন মঞ্চে৷... সেদিন অবনীন্দ্রনাথ ‘বাহবা বাহবা’ বলে দুচারজনের পিঠ চাপড়ে চলে গেলেন গৌরীদির কাছে৷’’ রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে উপহার পাওয়া একটি আরবি জোব্বা পরে সেজে তিনি সেদিন অভিনয় দেখতে এসেছিলেন৷ সেই জোব্বাটি গা থেকে খুলে গৌরীদিকে পরিয়ে দিয়ে বললেন ‘এই নে তোর নাচের বখশিশ৷’ গৌরীদি অবনীন্দ্রনাথের পায়ে মাথা রেখে প্রণাম করলেন৷ অবনীন্দ্রনাথ গৌরীদিকে আদর করে এগিয়ে গিয়ে নন্দলালকে বললেন ‘তোমার মেয়ে আজ আগুন স্পর্শ করেছে ওকে সাবধানে রেখো৷’ এইরকম ভক্তিরসে উদ্বুদ্ধ হয়ে নাচ কেবল টেকনিকাল নাচের মধ্যে দিয়ে ফু টিয়ে তোলা যায় না–রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত ভাবনৃত্যই তা সার্থক করে তোলে৷ ‘নটীর পূজা’-র পর থেকে রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলি নৃত্যসম্বলিত গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন৷ ‘নটরাজ ঋতু রঙ্গশালা’, ‘ঋতু রঙ্গ’, ‘ঋতু উৎসব,’ ‘শেষবর্ষণ’ প্রভৃ তি৷ এর সবগুলিতেই নাচ ছিল৷ আমি শান্তিনিকেতনে গেলাম উনিশশো ত্রিশে৷ তখন গুরুদেব সেখানে ছিলেন না৷ সেবার তিনি দীর্ঘদিন বিদেশে নানা জায়গায় ঘুরছিলেন, তার মধ্যে তাঁর হিবার্ট লেকচার

দেওয়া Oxford -এ, তাঁর ছবির প্রদর্শনী হলো প্যারিসে, মহাসমারোহে সেখানে তাঁর জন্মোৎসবও হয়েছিল৷ তিনি দেশে ফিরলেন একত্রিশে জানুয়ারি উনিশশো একত্রিশে৷ তারপরে বিপুল উৎসাহে তিনি বসন্তোৎসব করার পরিকল্পনা করলেন, রচনা করলেন ‘নবীন’৷ ‘নবীন’-এ নাচের একটা বড়ো অংশ ছিল৷ তাছাড়া বিশেষ আকর্ষণ ছিল সাবিত্রী গোবিন্দের গান৷ তার অপূর্ব মধুর অথচ ভরাট কণ্ঠস্বর ছিল৷ ‘নবীন’-এর সময় থেকেই আমার নিজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার সুযোগ পেয়েছিলাম৷ ‘নবীন’-এ আমার একটা নাচ ছিল ‘‘মরি হায় চলে যায় বসন্তের দিন’’ গানের সঙ্গে৷ আমাদের গানের রিহার্সাল পুরোদমে চলছে৷ গুরুদেব নিজে উঠে এসে আমার হাত ধরে দেখিয়ে দিলেন কোন লাইনের সঙ্গে কীভাবে নাচতে হবে৷ আমি সসংকোচে নাচছি৷ বেশি দূরে যাচ্ছি না দেখে তিনি বউঠানকে বললেন ‘বৌমা একটা চক (Chalk) নিয়ে এসো তো৷’ বউঠান পুপের ডেস্ক থেকে একটা চক নিয়ে এলেন, গুরুদেব বললেন ‘এইবার এইখানে একটা সেমিসার্কল করে দাও, রমা ঐখান পর্যন্ত এগিয়ে যাবে৷’ তারপর তিনি নিজে উঠে এসে একহাত দিয়ে আমার হাত ধরে দেখিয়ে দিলেন কী করে এগিয়ে গিয়ে আমি ‘‘চলে যায় বসন্তের দিন’’ করব আর ‘‘মরি হায়’’-এর সঙ্গে কীভাবে পিছিয়ে এসে কী করব৷ ‘‘পুলকিত আম্রবীথি’’ বিশেষ করে মনে পড়ে–পুলকিত কথাটা দ্রুত স্টেপ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে যেন বোঝানো হল, শুধু হাতের মুদ্রায় নয়৷ ‘‘পরানে বাজায় বীণা কে গো উদাসীন’ সে যে কী ব্যঞ্জনাময় তাঁর নৃত্যভঙ্গি, বলে বোঝানো যায় না৷ জানি না আমি কতটা সফল হয়েছিলাম৷ গুরুদেবের অনেকখানি সময় নষ্ট হল–আমি খুবই কু ণ্ঠিত বোধ করছিলাম কিন্তু গুরুদেবের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ ছিল না৷ বারে বারে নাচটা করিয়ে নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে তবেই ছাড়লেন৷ আর তিনি যখন বউঠানকে বললেন, ‘বউমা, এ কন্যাটিকে ছেড়ো না,’ তখন আমার ভারি ভালো লাগল, বউঠানও খুব খুশি হলেন৷ তারপর থেকে আমারও ভয়-ভাবনা কমে গেল, আড়ষ্টতাও চলে গেল৷ অমিতাও আনন্দ সর্বকাজে বইতে লিখেছে ‘নবীন’-এ ‘ক্লান্ত যখন আম্রকলির কাল’ গানের সঙ্গে সে নেচেছিল, হাতে ছিল একতারা৷ নাচ তৈরি হবার পরে গুরুদেবকে যখন দেখাতে গেল, তিনি বললেন ‘ক্লান্ত হলে কি এমন নাচের তাল আসে পায়ে? পায়ের ছন্দে শরীরের ভঙ্গিতে ক্লান্তি ফু টিয়ে তু লতে হবে তোর৷...সর্বশরীরে অবসন্নতা ফু টিয়ে তু লতে ঠে

হবে৷’ ওঁর নির্দেশমতো আবার যখন নাচ শুরু করেছি, উঠে এলেন তিনি, আমার হাত থেকে একতারাটি নিয়ে আমায় দেখাতে লাগলেন কীভাবে নাচতে হবে আমায়৷ মুখে বলতে লাগলেন ‘‘আরও নিচু , আরও নিচু হয়ে নাচবি৷ ক্লান্তিতে তু ই যেন মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিস৷ কিন্তু যখন গাইবি ‘সৌরভ ধনে তখন তু মি হে শালমঞ্জরি বসন্তে কর ধন্য’’ তখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুই হাতে একতারাটি যতদূর সম্ভব সবার ঊর্ধ্বে উঁচু তে তু লে ধরবি৷ এখন যে তোকে শালগাছের সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে৷’’ শান্তিদেব ঘোষও ‘নবীন’-এ বাউলাঙ্গ গানের সঙ্গে নেচেছিলেন, তাঁর হাতেও ছিল একতারা৷ শান্তিদার কথায় ‘একতারাটি গানের কোন পংক্তিতে কিভাবে করতে হবে কোথায় নাচের মধ্যে উদ্দামতা আনতে হবে, কোথায় নাচটি মোলায়েম করতে হবে, কোথায় আমি নিচু হয়ে নাচব, এসবেরই নির্দেশ তাঁর কাছে পেয়েছিলাম৷’ এইভাবেই গুরুদেব তাঁর ভাবনৃত্যধারায় আমাদের অনুপ্রাণিত করে চলতেন৷ তাঁর গানের সঙ্গে নাচ যেন টেকনিকসর্বস্ব না হয় সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন৷ প্রথম ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্য অনুষ্ঠিত হয় উনিশশো ছত্রিশে৷ তখন আমি শান্তিনিকেতনের ছাত্রী আর নই, এক গৃহিণী৷ কিন্তু শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তথা গুরুদেবের সঙ্গে, বউঠান ও রথীদার সঙ্গে যোগাযোগ অক্ষু ণ্ণ ছিল৷ গুরুদেব ডেকে পাঠালে এসে গানের দলে যোগও দিয়েছি৷ ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাট্যের অপরূপ রূপান্তর ‘চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য৷’ প্রথম অর্জুন হয়েছিল নিবেদিতা বসু ও প্রথম চিত্রাঙ্গদার ভূ মিকায় ছিল যমুনা সেন৷ নূতন রূপপ্রাপ্তা চিত্রাঙ্গদা হয়েছিল নন্দিতা কৃ পলানী৷ তখন সেখানে মণিপুরি ছাড়া কথাকলি নাচেরও প্রচলন হয়েছে৷ শান্তিদাকে গুরুদেব দক্ষিণে কেরালা কলামণ্ডলম থেকে কথাকলি নাচ শিখে আসতে পাঠিয়ে ছিলেন৷ তাছাড়া কিছুটা শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি নাচ, জাভার কিছু নৃত্যভঙ্গি ইত্যাদি নাচের সঙ্গে মিলিয়ে নাচ তৈরি করা শুরু হয়েছে৷ কিন্তু নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’র মধ্যে মণিপুরি কথাকলির সঙ্গে মিলিয়ে ভাবনৃত্যই মুখ্য ছিল৷ গুরুদেব স্বয়ং নাচেরও নির্দেশ দিতেন৷ আমি ‘সুরঙ্গমা রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষায়তন’-এ একু শ বছর ধরে শিক্ষা-অধিকর্ত্রী ছিলাম৷ শ্রীযুক্ত শৈলজারঞ্জন মজুমদার ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি৷ সে সময় ‘সুরঙ্গমা’র পত্রিকার জন্য আমি যমুনা ও নিবেদিতাকে লিখেছিলাম তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে৷ তাদের উত্তর নিয়ে, আমি যা লিখেছিলাম সেটি এখানে যুক্ত করে দিচ্ছি, তার থেকে রবীন্দ্রনাথের ভাবনৃত্য সম্বন্ধে সঠিক ধারণা হতে পারবে৷

এই সূত্রে একটা কথা বলতে চাই যে আজকাল প্রথম চিত্রাঙ্গদাকে কু রূপা চিত্রাঙ্গদা এবং নূতন রূপপ্রাপ্তা চিত্রাঙ্গদাকে সুরূপা চিত্রাঙ্গদা বলা হয়ে থাকে৷ এই কু রূপা-সুরূপা নামকরণ কে বা কারা, কখনকার থেকে বলতে শুরু করেছেন জানি না, কিন্তু এটা খুব ভালো করেই জানি গুরুদেব স্বয়ং এই নামে ওই দুই চিত্রাঙ্গদাকে অভিহিত করেননি৷ ‘চিত্রাঙ্গদা’ উপাখ্যানেও কি কোথাও লেখা আছে যে প্রথম চিত্রাঙ্গদা কু ৎসিত ছিল? মণিপুরি নৃপ-দুহিতা কু ৎসিত হবেই বা কেন? মণিপুর-নৃপতি পুত্র কামনা করেছিলেন, কিন্তু পেলেন একটি কন্যা৷ তাকে তিনি রাজপুত্রের মতো প্রতিপালন করলেন, কন্যার মতো নয় তাই সে বলতে পারল ‘‘পুরুষের বিদ্যা করেছিনু শিক্ষা/লভি নাই মনোহরণের দীক্ষা’’, বলতে হলো ‘‘মোর মুখে হেরিলনা নারী৷’’ তাই অর্জুনকে জয় করতে ‘‘নারীর ললিত লোভন লীলা’’র জন্য বর প্রার্থনা করতে হল মদনের কাছে৷ এর মধ্যে কু ৎসিত কথাটা উঠল কী করে? আর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ‘নুতন রূপপ্রাপ্তা চিত্রাঙ্গদা’, বিশেষ করে সুন্দরীও বলেননি৷ তবে সুন্দরী চিত্রাঙ্গদা বলতে সুবিধে হতে পারে কথায় কথায়৷ কিন্তু কু ৎসিত চিত্রাঙ্গদা কখনোই বলা চলে না৷ –আর শেষ দৃশ্যে যখন এই প্রথম চিত্রাঙ্গদাই মহিমাময়ী হয়ে উঠে দৃপ্তকণ্ঠে বলে ‘‘আমি চিত্রাঙ্গদা–রাজেন্দ্রনন্দিনী নহি দেবী নহি সামান্যা নারী,’’ তখন কু ৎসিত কথাটা লুকোবে কোথায়? আমি একবার যমুনাকে বলেওছিলাম যে ‘তোমাদের সময়ে তো গুরুদেব কু রুপা বা কু ৎসিত চিত্রাঙ্গদা কখনো বলেননি, তাহলে এ কথাটা এলো কী করে?’ ও বলেছিল ‘আগে তো ছিল না সত্যি, কিন্তু এখন তো এটাই চল হয়ে গেছে৷’ প্রতিবাদ করতেও তাকে বলেছিলাম৷ সে গ্রাহ্য করেনি৷ ও তো বেশি কথা বলার পাত্রী নয়৷ মাস্টারমশাই নন্দলাল বসুর মেয়ে তাঁর মতোই চু প করে থাকতেই ভালোবাসে৷ প্রথম যখন নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদার সৃষ্টি হল তখন গুরুদেব যাঁদের নিয়ে অনুষ্ঠান করিয়েছিলেন, তাঁদের নাম এই দীর্ঘকালের ব্যবধানে খুব কম লোকেরই মনে আছে৷ তখন প্রধান ভূ মিকায় অংশ নিয়েছিলেন যমুনা সেন, তপন বসু, প্রথম চিত্রাঙ্গদা রূপে, নিবেদিতা বসু, তপন ঘোষ হয়েছিলেন অর্জুন ও দ্বিতীয় চিত্রাঙ্গদা রূপে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্রী নন্দিতা কৃ পালানী, তপন গঙ্গোপাধ্যায়, ইনি আর এ জগতে নেই৷ সুরঙ্গমার পক্ষ থেকে যমুনা ও নিবেদিতাকে অনুরোধ করা হয়েছিল যাতে তাঁদের প্রথম অভিজ্ঞতার কথা কিছু বলেন৷

নিবেদিতা, তাঁর স্বভাবজাত নিজেকে অন্তরালে রাখার আবরণ মুক্ত করে বেরিয়ে আসতে চাইলেন না, লিখে পাঠালেন–‘নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা অভিনয়ে আমি প্রথম অর্জুন হয়েছিলাম এবং বহুবার নানান স্টেজে করারও সুযোগ পেয়েছিলাম৷ তার ওপর গুরুদেব আমার অভিনয় ও নাচে খুশি হতেন বলে আমার আনন্দের সীমা ছিল না, তার জন্য আমি ধন্য হয়েছি৷ কিন্তু কোনদিনই কিছু লেখা আমার অভ্যাস নেই বলে আপনার অনুরোধ রাখতে পারলাম না বলে মনে কিছু করবেন না৷’ যমুনা, নেহাতই অনুরোধ এড়াতে না পেরে, একটি ছোট্ট লেখা পাঠিয়েছেন৷ তবু এর গুরুত্বও কম নয়৷ গুরুদেব যে ওঁকে বলেছিলেন, ‘তু ই যে রাজেন্দ্রনন্দিনী সে কথা কখনও ভু লে যাবি না–তোর ভাব ও ভঙ্গিতে যেন সেটা প্রকাশ পায়’–এ কথা নতু ন করে ভেবে দেখার দরকার আছে বৈকি৷ এখনকার দিনে কজনের নৃত্যাভিনয় দেখে মনে হয় যে ঠিক চরিত্রটি ফু টে উঠেছে৷ যমুনা সেন, নন্দলাল বসু মহাশয়ের কন্যা ও নিবেদিতা তাঁর পুত্রবধূ৷ তাঁকে যারা চিনতেন তাঁরা জানেন যে মাস্টারমশাই নিজেকে অন্তরালে রাখতেই ভালোবাসতেন৷ যমুনা, নিবেদিতাও সেইভাবে প্রভাবান্বিত৷ অথচ এঁদের অভিজ্ঞতার মূল্য তো কম নয়৷ এরা প্রকৃ ত অর্থে আশ্রমদুহিতা, শিশুকাল থেকেই গুরুদেবের স্নেহধন্যা৷ এঁদের অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ হওয়াই বাঞ্ছনীয়৷ সেই কথা মনে রেখে, ছোট্ট হলেও যমুনার লেখাটি উপস্থাপন করা হলো৷ গুরুদেবের ব্যক্তিগত শিক্ষায় তাঁর কয়েকটি নৃত্যনাট্যে বিভিন্ন ভূ মিকায় অভিনয় করবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, সেই কারণেই আমাদের সময়ের নৃত্যনাট্য সম্বন্ধে কিছু লিখবার অনুরোধ এসেছে৷ কিন্তু তাঁর শিক্ষার রীতি প্রকৃ তি সম্বন্ধে গুছিয়ে লেখার ক্ষমতা আমার নেই৷ এইটু কু বলতে পারি তাঁর উপস্থিতি এবং ব্যক্তিত্বই সব কিছু সুন্দরভাবে ফু টিয়ে তু লতে সাহায্য করেছে৷ উনিশশো ছত্রিশে যখন প্রথম চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের অভিনয় হয়, তখন গুরুদেব প্রথম চিত্রাঙ্গদার ভূ মিকা রূপ দেবার ভার আমার উপর দেন৷ তারপর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত নানা জায়গায় আমি এই ভূ মিকায় অভিনয় করেছি৷ সে সময়ে শান্তিনিকেতনে মনিপুরী ও কথাকলি নাচ শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে৷ সেই শিক্ষা আমরা সব সময়ে কাজে লাগিয়েছি, কিন্তু কখনই বিশেষ কোন রীতির আঙ্গিক নাচে প্রাধান্য লাভ করেনি৷ নাটকের ভাবকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে৷ যে নাচবে গুরুদেব তার উপর নাচ তৈরি করার ভার অনেকটাই ছেড়ে দিতেন৷ কিন্তু কোন জায়গায় কি রকম ভাব প্রকাশ করতে হবে সেটা তিনি করিয়ে দিতেন৷ একটি ছোট

উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করছি, যেমন চিত্রাঙ্গদার শেষ গান ‘আমি চিত্রাঙ্গদা রাজেন্দ্রনন্দিনী’ করার সময় তিনি একদিন বলেছিলেন ‘‘তু ই যে রাজেন্দ্রনন্দিনী সে কথা কখনও ভু লে যাবি না৷ তোর ভাব এবং ভঙ্গিতে যেন সেটা প্রকাশ পায়৷’’ এই ভাব ঠিক মত প্রকাশ করতে পারলাম কিনা সেটা আমরা ভাবে বুঝতাম তার খুশি অখুশি থেকে৷ তিনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি বুঝলে আবার নতু ন চেষ্টা করতাম, এইভাবেই আমাদের শিক্ষা চলত৷ অবাক হয়ে ভাবি, গুরুদেব চব্বিশ ঘণ্টা সময়টাকে কী করে নিজের আয়ত্তে আনতেন৷ নিজের তো কাজের শেষ নেই, তাঁর প্রাণের আরাম–কবিতা, সে তো আছেই তাঁর চিরসাথী৷ তার মধ্যে গানও রচনা করেছেন–তৎক্ষণাৎ দিনদাকে ডেকে শেখাচ্ছেন নয়তো সুরটা ভু লে যাবেন৷ অন্য কত লেখার তাগিদ তাও সামলাচ্ছেন৷ নিজের লেখা তো আছেই, অবিরাম লোকজন আসছেন, তাঁদের সঙ্গেও কথাবার্তা বলছেন, যদিও শেষের দিকে রথীদা অনেককে আটকাতেন৷ দীর্ঘ সময় ধরে রিহার্সাল নিচ্ছেন, আবার আলাদা করেও নাচ-গান শেখার জন্য, খুঁটিয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন–তারই মধ্যে কে অনুপস্থিত হলো তাও তাঁর চোখে পড়েছে, কেন এল না খোঁজ নিচ্ছেন, যদি অসুস্থ হয়–ওষুধ পাঠিয়ে দু’ছত্র লিখে দিচ্ছেন৷ একবার আমি ও তাতু অনুপস্থিত হয়েছিলাম অসুস্থ হয়ে, গুরুদেব জানতে পেরে ওষুধ পাঠিয়ে দিলেন৷ সঙ্গে এই লেখাটি–

এর কি তু লনা হয়৷ লেখাটি দেখলে এখনও অভিভূ ত হয়ে পড়ি৷ সৈয়দদা, সৈয়দ মুজতবা আলী বলতেন ‘কবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ধরা ছোঁয়ার অতীত, সাধারণ মানুষের ঠি

নাগালের বাইরে৷ (তা কিন্তু ঠিক নয়–র. চ.) কিন্তু আমাদের কাছে তিনি যে ছিলেন স্নেহাসক্ত গুরু, নেহাতই মাটির মানুষ৷ সত্যিই তাঁকে এই ভাবেই পেয়ে ধন্য হয়েছি৷ ৩৪ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, ২০০০

রবীন্দ্রনাথের 'আত্মপরিচয়' : চোরাটানের ইতিহাস তৈমুর রেজা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বঙ্গীয় ১৩১৯ সালের বৈশাখ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকু রের 'আত্মপরিচয়' নামে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয় ।১ এই প্রবন্ধটি তিনি পাঠ করেছিলেন ছাত্রসমাজের অধিবেশনে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে । তাঁর বিশাল প্রবন্ধ সাহিত্যে এই রচনাটির স্থান বিশিষ্ট । সমাজ-রাষ্ট্র প্রসঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির কিছু প্রধান সূত্রের নিশানা এই প্রবন্ধে আছে । বর্তমান প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য : দুটি নিরিখ থেকে 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধটি পড়ে দেখা । গবেষকরা অবশ্য প্রায় ১০০ বছর ধরেই নানাভাবে প্রবন্ধটি পড়েছেন । এসব পাঠের একটি প্রধান ঝোঁক রবীন্দ্রনাথ হিন্দু কি ব্রাহ্ম সেটা বিচার করা । আমাদের প্রথম ধাপ হবে, একজন সমালোচকের ভাষ্য ধরে এই প্রবন্ধের কিছু দরকারি ইশারা দাগিয়ে নেয়া । পরের ধাপে এসব ইশারাগুলো রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিকতার মধ্যে জারিয়ে নেওয়া হবে । এভাবে টেক্সট আর কনটেক্সট মিলিয়ে প্রবন্ধের একটা নতু ন অর্থ সৃষ্টি হবে নিশ্চয়ই । ঘুণাক্ষরেও এমন সন্দেহ মনে রাখা হচ্ছে না যে, এইটিই 'পরমার্থ' । আমরা আসলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে 'আত্মপরিচয়' রচনাটি নতু ন করে লিখতে বসেছি । নতু ন করে লেখার আগে পুরোনো লেখাটি ঝালাই করে নেয়া দরকার । আমরা 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধের মূল কথাগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি । কাকে বলে 'আত্মপরিচয়'---এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব মত রয়েছে । প্রবন্ধের গোড়াতেই তিনি সেটা ফরসা করে বলে নিচ্ছেন । আত্মপরিচয়ের দুই ভাগ-একটি কাঁচা, অন্যটি পাকা । পরিচয়ের পাকা-ভাগ বলতে তিনি বোঝাচ্ছেন সেসব দিক, যা আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরের জিনিস । যেমন, বংশ-পরিচয় বা গায়ের রং । এখানে আমাদের যেমন ইচ্ছা খাটানোর ব্যাপার নেই, তেমনি এগুলো আমরা ঘষে ঘষে উঠিয়ে ফেলতে পারি না । পরিচয়ের অন্য দিকটি আমাদের স্বায়ত্তশাসনের এলাকা । যেমন, শিক্ষা বা স্বভাব । এসব রবীন্দ্রনাথের বিচারে পরিচয়ের কাঁচা-ভাগ । ইচ্ছামতো গড়ে নেয়া চলে, আবার ভেঙে ফেলতেও কসুর হয় না । পরিচয় নিয়ে ভাবতে হবে কেন? কারণ পরিচয়ের সঙ্গে সত্যের যোগ আছে, পরিচয় গোপন করতে নেই । কিন্তু কী বলে নিজের পরিচয় দেয়া কর্তব্য 'তাহা লইয়া অন্তত ব্রাহ্মসমাজে একটা তর্ক উঠিয়াছে' । তর্কটা রবীন্দ্রনাথ নিচ্ছেন বিস্ময়ের সঙ্গে । কারণ ব্রাহ্মসমাজের কেউ কেউ উত্তর দিচ্ছেন, 'আমরা আর কিছু না আমরা ব্রাহ্ম' । কিন্তু এই

উত্তরে রবীন্দ্রনাথের সায় নেই । তিনি ব্রাহ্ম হিসেবে পরিচয় দাখিল করতে নারাজ । পরিচয়ের একটি পাকা দিক থাকে, এই দিকের বরাতেই মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে নাড়ির যোগ । সেকারণেই ব্রাহ্মসমাজের মতো ভুঁইফোড় ব্যাপার তিনি পরিচয় বলে মানবেন না । তাঁর ভাবনা হচ্ছে, 'আমি হয়ত কেবলমাত্র গতকল্য ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা লইয়া প্রবেশ করিয়াছি । ইহার চেয়ে পুরাতন ও পাকা পরিচয়ের ভিত্তি আমার কিছুই নাই? অতীতকাল হইতে প্রবাহিত কোনো একটা নিত্য লক্ষণ কি আমার মধ্যে একেবারেই বর্তায় নাই?' এই নিত্য লক্ষণ ব্রাহ্মসমাজে তালাশ করে লাভ নেই, 'কারণ কোনো বিশেষ ধর্মমত ও কোনো বিশেষ আচার কোনো জাতির নিত্য লক্ষণ হইতেই পারে না' । অতএব, ব্রাহ্মধর্ম রবীন্দ্রনাথের সাময়িক পরিচয় এবং সে-কারণেই পরিচয়ের পাকা ভিত্তি হিসেবে অচল । জাতিগত দিক থেকে তিনি 'অতীতের ইতিহাসে এক জায়গায় বাঁধা' পড়ে আছেন । এই শেকড়ের টান তাজা রাখতেই রবীন্দ্রনাথ নিজের পরিচয় দিচ্ছেন এই বলে যে, 'ঐতিহাসিক দিক দিয়া আমি যে হিন্দু এ সম্বন্ধে আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো তর্কই নাই' । এখানে সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল করা দরকার, 'হিন্দু' কথাটি রবীন্দ্রনাথ বিশেষ অর্থে গ্রহণ করেছেন । হিন্দু বলতে আমরা প্রচলিত অর্থে 'হিন্দু ধর্ম' বুঝে থাকি, রবীন্দ্রনাথ সেই অর্থ মুলতু বি রেখে 'হিন্দু' কথাটি জাতিগত অর্থে বুঝেছেন । এই বিশিষ্ট অর্থেই রবীন্দ্রনাথ বলছেন, 'আমি হিন্দুসমাজে জন্মিয়াছি এবং ব্রাহ্মসম্প্রদায়কে গ্রহণ করিয়াছি--ইচ্ছা করিলে আমি অন্য সম্প্রদায়ে যাইতে পারি কিন্তু অন্য সমাজে যাইব কী করিয়া?' তখন একটা বেয়াড়া প্রশ্ন ওঠে, মুসলমান বা খ্রিস্টান ধর্মমত নিলেও কি হিন্দুসমাজে থাকতে পারি? রবীন্দ্রনাথের সোজাসাপটা জবাব, 'নিশ্চয়ই পারি । ইহার মধ্যে পারাপারির তর্কমাত্রই নাই' । রবীন্দ্রনাথ হিন্দুসমাজকে বেদ-পুরাণ বা সামাজিক প্রথার অন্ধ অনুসরণ অর্থেও গ্রহণ করেন নি । 'জাতিভেদকে যদি হিন্দুসমাজের অনিষ্টকর' বলে মনে হয় তবে জাতিভেদকে অহিন্দু মানতে হবে, ছেলেমেয়ের অসবর্ণ বিয়ে দিলেই কারও হিন্দুত্ব ঘুচে যাবে না । তখন এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, মুসলমান ধর্ম নিয়েও যদি হিন্দু থাকা যায়, জাতিভেদ না মানলে যদি তাকে হিন্দু বলে, এই 'হিন্দু' তবে কী পদার্থ? রবীন্দ্রনাথ তার উত্তরে বলছেন, হিন্দুর সংজ্ঞা হয় না, কারণ 'মানুষের গভীরতম ঐক্যটি যেখানে, সেখানে কোনো সংজ্ঞা পৌঁছিতে পারে না---কারণ সেই ঐক্যটি জড়বস্তু নহে তাহা জীবনধর্মী' । পাশাপাশি বলে রাখছেন, হিন্দুর যেমন সংজ্ঞা নেই, অন্যান্য জাতির ক্ষেত্রেও সংজ্ঞা স্থির করাটা তেমনি অসম্ভব ।

রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের অনেক খুচরো প্রসঙ্গ কেটে-ছেঁটে নিলে মূল প্রসঙ্গগুলো এরকমই দাঁড়াবে । এবার আমরা মনোযোগ দেব 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধটির ওপর একজন সমালোচকের ভাষ্যের উপর ।

প্রথম পর্ব : ফরহাদ মজহারের তফসির রবীন্দ্রনাথের 'আত্মপরিচয়' রচনাটি নিয়ে ফরহাদ মজহার 'রবীন্দ্রনাথের আত্মপরিচয়' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন ।২ রচনাকাল সম্ভবত বঙ্গীয় ১৩৯৯ সন । বৈঠকি ঢঙে রচিত ফরহাদ মজহারের এই প্রবন্ধটি ক্ষু দ্র হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এখানে রবীন্দ্রনাথের সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক ভাবনা নিয়ে মজহারের দৃষ্টিভঙ্গির কিছু মূল্যবান ইশারা পাওয়া যাবে । রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ বইতে এই প্রবন্ধটি সংকলিত হয়েছে । বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষে রবীন্দ্রনাথের যুগন্ধরি ভূ মিকা নিয়ে এই বইতে মজহার কতগুলো মৌলিক প্রস্তাব তু লেছেন । রবীন্দ্রনাথের ওপর রচিত বিপুল সাহিত্যের ভিড়ে এই বইটাকে গুরুতর মানতে হবে । যে প্রবন্ধ নিয়ে আমরা এখানে তর্ক তু লছি তাতে অবশ্য দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে তাঁর কয়েকটি নালিশ আছে । নালিশগুলো একটু তলিয়ে দেখা যাক । রবীন্দ্রনাথ নিজেকে হিন্দু বলছেন, এই প্রসঙ্গটি লক্ষ করে মজহার লিখছেন : রবীন্দ্রনাথ এই কথা বলছেন না যে আমি ব্রাহ্মও নই, হিন্দুও নই, আমি মানুষ । যেটা এই কালের বাঙালিদের কাছে কলিজায় শেলের মতো বাজাবে সেটা হল রবীন্দ্রনাথ এই কথাও বলেন নি যে তিনি বাঙালি । রবীন্দ্রনাথ এতো বিপুল এক ব্যক্তিত্ব যে ধর্ম ও সম্প্রদায়গত পরিচয়ের ওপরে দাঁড়িয়ে তিনি বলবেন আমি মানুষ, এটাই আমার পরিচয় এই ধরনের বড়ো মানুষদের মতো কথাই তাঁকে মানায় । এই কথাই তাঁর কাছে অধিকাংশই আশা করে । মুশকিল হোল, না বললেও ধরে নেয় এটাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন । এই সকল পূর্বানুমান মাথায় রাখলে রবীন্দ্রনাথের কথা কিন্তু বোঝা যাবে না, বরং ভু ল বোঝার সম্ভাবনা বেশি । রবীন্দ্রনাথ নিজেকে ধরে নিয়েছেন যে তিনি ব্রাহ্ম । এই উদ্ধৃ তির মধ্যে কিছুটা নাটকীয়তার গুণ আছে । রেটোরিকসটু কু ছেঁটে নিলে দেখা যাবে, রবীন্দ্রনাথ নিজেকে কেন মানুষ বলে দাবি করেন নি সেটাই এখানে মজহারের মূল আপত্তি । কিন্তু আপত্তিটা এমনভাবে রেটোরিকস-এর ভিড়ে হারিয়ে গেছে যে আপত্তি বলে হঠাৎ চোখে বাধে না ।৩ রেটোরিকস থেকে মূল যুক্তিটাকে বের করে আনতেই একটা সংশয় দাঁড়িয়ে গেল সটান : এখানে মজহার যে অর্থ তৈয়ার করছেন, সেটা কনটেক্সট হারিয়ে ফেলছে না তো?

রবীন্দ্রনাথ প্রাণী হিসাবে মানুষ । মানুষ বলতে আমরা জাত-পাতের ঊর্ধ্বে যে বিশিষ্ট আইডিয়াকে বুঝি সেই অর্থেও তিনি মানুষ । কিন্তু এখানে সেই পরিচয় দেয়া তো প্রাসঙ্গিক নয় । এই প্রবন্ধে তাঁর নিয়ত পরিচয়ের পাকা ভাগটির হদিশ করা । তিনি জাতিগত পরিচয়কেই পরিচয়ের পাকা ভিত্তি হিসাবে আমল করেছেন । কাজেই 'আমি মানুষ' এরকম 'বড়ো মানুষের মতো কথা' এখানে তাঁর বলবার নয় । সেটা বললে এখানে বেখাপ্পা শোনাবে । রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধেই আছে, ''যদি কাহাকে জিজ্ঞাসা করা যায়, 'তু মি কি চৌধুরীবংশীয়', আর সে, যদি উত্তর দেয়, 'না আমি দপ্তরির কাজ করি' তবে প্রশ্নোত্তরে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য হয় না ।'' মানুষের একটি মাত্র পরিচয় হয় না । ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে প্রশ্ন করলে পরিচয় বদলে যায় । অমর্ত্য সেন তাঁর বিপদসংকু ল কেতাব পরিচয় ও হিংসা-র মধ্যে এই সমস্যাটিকে সঠিকভাবেই দাগাতে পেরেছেন বলে মনে হয় । পরিচয়ের বহুত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলছেন

:৪

একই ব্যক্তি একই সময়ে সমষ্টিগুলোর প্রত্যেকটির অন্তর্ভুক্ত এবং প্রত্যেকটিই তাঁকে একেকটি বিশিষ্ট পরিচয় দেয় । এরমধ্যে কোনওটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় বা একক সদস্যভু ক্তির বর্গ বলে ধরা যাবে না । আমাদের অনিবার্যভাবে বহুমাত্রিক পরিচিতির ফলে যে কোনও বিশেষ প্রসঙ্গে আমাদের বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও বন্ধনগুলোর তু লনামূলক গুরুত্ব সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসতে হয় ।৫ পরিচয়ের বহুত্ব নিয়ে স্বয়ং মজহারের যে খুব সন্দেহ আছে এমন মনে হয় না । তিনি সম্ভবত পরিচয়ের 'প্রায়োরিটি'র নিরিখে প্রশ্নটি তু লেছেন । কিন্তু তাতেও সমস্যার মীমাংসা ঘটে না । কারও পরিচয়ের প্রথম 'প্রায়োরিটি' যদি মানুষ হয়, তবুও তাকে কালেভদ্রে অন্য পরিচয় দাখিল করতে হয় । এসব কারণেই একটা সন্দেহ হঠাৎ উঁকি দেয়, মজহার হয়তো এই প্রবন্ধের 'ভাঙা-পাঠ' করছেন । অর্থাৎ টেক্সট নিজের সুবিধা মতো ভেঙে নিয়ে তার মধ্যে অর্থ পুরে দিচ্ছেন । এই সন্দেহটা মনে রেখে প্রবন্ধের পরের কথাগুলো পড়া যাক । রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের মর্মবাণী কী---সেটা বোঝার ক্ষেত্রে মজহারের মতে গুরুত্বপূর্ণ হল 'নিত্য লক্ষণ' । মজহার জানাচ্ছেন, ''তাঁর পুরো বক্তব্যের খুঁটি হচ্ছে এই 'নিত্য লক্ষণ' । একবারই মাত্র পুরো নিবন্ধে শব্দটি ব্যবহার হয়েছে । আর তক্ষু নি তাকে যদি দাগ দিয়ে না রাখা যায় তাহলে রবীন্দ্রনাথের যুক্তিতর্কের মর্মার্থ পিছলে হাতছাড়া হয় ।'' এরপর নিত্য লক্ষণ বলতে কী বোঝাবে সেটা নিয়ে তিনি অনেক যুক্তিতর্ক করেছেন, আমাদের চেনা-জানা মোমবাতি বস্তুটিকে নমুনা হিসাবে নিয়ে অবশেষে তিনি স্থির করছেন,

'নিত্য লক্ষণ' একটি ধারণা বা কনসেপ্ট । মূল কথাটা এরকম দাঁড়াবে/: রবীন্দ্রনাথের নিত্য লক্ষণ বস্তুগত কিছু নয়, এটা ধারণামাত্র । তবে ধারণা হলেও একে ঠিক অসত্য বা মনগড়া বলা চলবে না । এরপর, অতর্কিতে মজহারের বক্তব্য : কিন্তু কেউ যদি বলে নিত্য লক্ষণটাই সত্য আর অনিত্য লক্ষণ অসত্য । মোমের পরিচয় হচ্ছে তার নিত্য লক্ষণে । তার ঠান্ডা আর সাদা অবস্থা বা গরম আর তরল অবস্থা মোমের আসল পরিচয় নয় । রূপান্তর ব্যাখ্যায় আমাদের বুদ্ধির সংজ্ঞায় 'মোম' নামক যেজিনিসের ধারণা আমরা গড়ে নিয়েছি, সেটাই হলো সত্য মোম, সেটাই বাস্তব, সেটাই মোমের 'পুরাতন ও পাকা পরিচয়ের ভিত্তি', তাহলে একটা মারাত্মক ভু ল হয় । খুবই বড়ো ধরনের ভু ল সেটি । আর, আমাদের রবীন্দ্রনাথ এই মস্ত বড়ো ভু লটাই করেছেন । ইতিহাসের রূপান্তর ও আমাদের বিবর্তনের ব্যাখ্যার জন্যে যে নিত্য লক্ষণের ধারণা আমাদের দরকার, যে ধারণা অনিবার্য, তাকেই তিনি আসল পরিচয় বলছেন । অথচ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে রূপ ইতিহাসের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করেছে, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যা আমাদের সামনে চাক্ষু ষ হাজির হয়েছে, তিনি তাকে সত্য পরিচয় বলে অস্বীকার করেছেন । এই পর্যন্ত পড়ে ফেলার পর সন্দেহ বেশ ঘোরালো হয়ে ওঠে, মজহার কি সত্যিই রবীন্দ্রনাথের 'ভাঙা-পাঠ' করছেন? রবীন্দ্রনাথ অনিত্যকে অসত্য একবারও বলেন নি । সেটা এখানে তাঁর বলবার কথাই নয় । তিনি শুধু বলেছেন, যা অনিত্য তা পরিচয়ের পাকা ভিত্তি নয় । মজহার যে-কারণে নিত্য লক্ষণের প্রয়োজনীয়তা মানেন রবীন্দ্রনাথ সেই একই দরকারেই কথাটা টেনেছেন । অনিত্য লক্ষণ দিয়ে তো ইতিহাস, বিবর্তন এগুলো বোঝা যায় না---মজহারেরই কথা । রবীন্দ্রনাথের কথাও এই পর্যন্তই । কী বলে নিজের পরিচয় দেব---তার উত্তর রবীন্দ্রনাথ ঐতিহাসিকভাবে পেতে চান, সে কারণেই একালের দুটো-একটা অনিত্য লক্ষণ দেখে অভিভূ ত না হয়ে তিনি আমাদের ঐতিহাসিকভাবে নিত্য লক্ষণগুলোর তালাশ নিতে বলছেন । এভাবে না বুঝে যদি মজহারের মর্জি মতো বুঝি তবে একটা বিপদ হয়, আমাদের কবুল করে নিতে হয় যে, মোম একটি বহুরূপী পদার্থ, যার এখনের পরিচয় 'গরম মোম' তখনকার পরিচয় 'ঠান্ডা মোম' ইত্যাদি । কিন্তু এতে করে শুধুমাত্র একটি চেনা পদার্থকে অচেনা করে তোলা হয়, ভাষা ও ভাবনার জগতে অনর্থক গোলমাল ডেকে আনা হয় । মজহার এই দিকটা একদমই না ভেবে জ্বালাময়ী গদ্যে রবীন্দ্রনাথকে দুষছেন : আমি নিজেকে কি ভাবি? হিন্দু? ব্রাহ্ম? মানুষ, গণতন্ত্রী? কমিউনিস্ট? মুসলমান? --এরকম বিস্তর যোগ করা যেতে পারে । নানান পরিচয়ের নামাবলি থেকে যে পরিচয়ে আমি নিজেকে প্রকাশ করতে চাই সেই পরিচয়ই আমরা গ্রহণ করি, সেই পরিচয়কেই

আমরা মুখ্য করে তু লি । ...কেউ ব্রাহ্ম কি হিন্দু কি মুসলমান সেটাও কেউ চু ক্তি করে আসে না । কিন্তু কেউ নিজেকে হিন্দু বা মুসলমান ভাবে কি ভাবে না, নিজেকে হিন্দু বা মুসলমান গড়ে তোলে কি তোলে না, নিজের ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের বাইরে নিজের পরিচয় খাড়া করতে চায় কি চায় না---এই সবই হচ্ছে নিজের ব্যাপার, নিজের ইচ্ছাই এখানে কর্তা, বিধাতা নয় । কিন্তু নিজের ইচ্ছাকে রবীন্দ্রনাথ এখানে বিধাতার ইচ্ছা বলে চালিয়ে দিলেন বেমালুম । তিনি ঘোষণা করছেন 'আমি হিন্দু' । এখানে মজহার যেটু কু বলেছেন তার সঙ্গে আমাদের মতভেদ নেই । খুব সম্ভব রবীন্দ্রনাথও এতে আপত্তি করার মতো কিছু দেখতে পেতেন না । শুধু শেষ কথাটায় গড়বড় থেকে যাচ্ছে, যেখানে মজহার এই বলে অভিযোগ রুজু করছেন যে, নিজের ইচ্ছাকে রবীন্দ্রনাথ 'বিধাতার ইচ্ছা বলে চালিয়ে দিলেন বেমালুম' । এত বড়ো দোষটা রবীন্দ্রনাথ হয়তো করেননি, দোষটা বরং মজহারের 'ভাঙা-পাঠে'র মধ্যেই একটু খুঁজে দেখা যাক । 'হিন্দু' বলতে রবীন্দ্রনাথ কী মানে করছেন---এই গোড়ার কথাটাই বোধ হয় মজহার আমল করতে পারছেন না । তিনি রবীন্দ্রনাথের 'আমি হিন্দু' ঘোষণার মধ্যে 'ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের বাইরে' আর কিছু খুঁজে পান নি । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ 'ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক' কোনো অর্থেই হিন্দুসমাজ কথাটা কবুল করেন নি, কথাটা তিনি জাতিগত অর্থে গ্রহণ করেছেন । তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, যে নিত্য লক্ষণের তিনি তালাশ করছেন সেটা জাতিগত নিত্য লক্ষণ, বিশেষ ধর্মমত ও কোনো বিশেষ আচারের নিত্য লক্ষণ নয় । এই সহজ কথাটা যে-কারণে মজহার বুঝতে পারছেন না সম্ভবত সেই একই কারণে রবীন্দ্রনাথের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা নিজের লেখায় তিনি বেমালুম চেপে গেছেন । এসব এতই গুরুতর ব্যাপার যে মজহারের চোখ এড়িয়ে গেছে বলার কোনো উপায় থাকছে না । রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে 'হিন্দু' এবং 'ব্রাহ্ম'---এই দুটি বিষয়কে আলাদা আলাদা ক্যাটেগরিতে স্থান দিয়েছেন । একটু মন দিয়ে প্রবন্ধটি পড়লেই সেটা মালুম হতে বাধ্য । এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন, 'হিন্দু বলিলে আমি আমার যে পরিচয় দিই, ব্রাহ্ম বলিলে সম্পূর্ণ তাহার অনুরূপ পরিচয় দেওয়া হয় না, সুতরাং একটি আর-একটির স্থান গ্রহণ করিতে পারে না ।' তিনি 'হিন্দু' বলতে যে ক্যাটেগরি বোঝাচ্ছেন সেখানে ব্রাহ্মসমাজ অপ্রাসঙ্গিক, সেখানে অন্য কোনো জাতি তু লনা হিসেবে আসতে পারে । হিন্দুসমাজেরই একটি নির্দিষ্ট ধর্মমত হল ব্রাহ্মসমাজ । রবীন্দ্রনাথের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হল, হিন্দু কোনো ধর্মমত নয়, হিন্দু একটি জাতি । ফরসা করে বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজের প্রতি-তু লনা টানছেন, 'যদিচ সাধারণত সমস্ত ইংরেজের ধর্ম খ্রীস্টানধর্ম, এবং ষ্ঠি

সেই ধর্মমতের উপরেই তাহার সমাজবিধি প্রধানত প্রতিষ্ঠিত তথাপি একজন ইংরেজ বৌদ্ধ হইয়া গেলে তাহার যত অসুবিধাই হউক তবু সে ইংরেজই থাকে ।' 'তেমনি ব্রাহ্মধর্ম আপাতত আমার ধর্ম হইতে পারে, কিন্তু কাল আমি প্রটেস্টান্ট পরশু রোমান ক্যাথলিক এবং তাহার পর দিনে আমি বৈষ্ণব হইতে পারি, তাহাতে কোনো বাধা নাই, অতএব সে পরিচয় আমার সাময়িক পরিচয়---কিন্তু জাতির দিক দিয়া আমি অতীতের ইতিহাসে এক জায়গায় বাঁধা পড়িয়াছি, সেই সুবৃহৎকালব্যাপী সত্যকে নড়াইতে পারি এমন সাধ্য আমার নাই ।' কাজেই জাতির দিক দিয়ে যারা 'অতীতের ইতিহাসে এক জায়গায় বাঁধা' পড়ে আছে তারা সকলেই হিন্দু । রবীন্দ্রনাথ এখানে একটা সাংঘাতিক দাবি করেছেন যা মজহার তাঁর লেখায় পুরোপুরি চেপে গেছেন । রবীন্দ্রনাথের কথাটা ভালো করে শোনা যাক : তবে কি মুসলমান অথবা খ্রীস্টান সম্প্রদায়ে যোগ দিলেও তু মি হিন্দু থাকিতে পার? নিশ্চয়ই পারি । ইহার মধ্যে পারাপারির তর্কমাত্রই নাই । ...বাংলাদেশে হাজার হাজার মুসলমান আছে, হিন্দুরা অহর্নিশি তাহাদিগকে হিন্দু নও হিন্দু নও বলিয়াছে এবং তাহারাও নিজদিগকে হিন্দু নই হিন্দু নই শুনাইয়া আসিয়াছে কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাহারা প্রকৃ তই হিন্দুমুসলমান । কোনো হিন্দু পরিবারে এক ভাই খ্রীস্টান এক ভাই মুসলমান ও এক ভাই বৈষ্ণব এক পিতামাতার স্নেহে একত্র বাস করিতেছে এই কথা কল্পনা করা কখনোই দুঃসাধ্য নহে বরঞ্চ ইহাই কল্পনা করা সহজ---কারণ ইহাই যথার্থ সত্য, সুতরাং মঙ্গল এবং সুন্দর । জাতি এবং ধর্ম যেমন দুটো আলাদা ক্যাটেগরি, হিন্দু আর মুসলমানও তেমনি আলাদা ক্যাটেগরি । রবীন্দ্রনাথ প্রাঞ্জল করে বোঝাতে বলে দিচ্ছেন, 'হিন্দু শব্দে এবং মুসলমান শব্দে একই পর্যায়ের পরিচয়কে বুঝায় না । মুসলমান একটি বিশেষ ধর্ম কিন্তু হিন্দু কোনো বিশেষ ধর্ম নহে । হিন্দু ভারতবর্ষের একটি জাতিগত পরিণাম ।' কারও মধ্যে কোনো ধোঁয়াশা ভাব যেন না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে রবীন্দ্রনাথ এরপর চিন বা পারস্যের উদাহরণ টানছেন । চিনের মুসলমানের সঙ্গে পারস্যের মুসলমানের ধর্মমত অনেক জায়গায় মেলে, কিন্তু অন্য অসংখ্য বিষয়েই মেলে না । কিন্তু স্বদেশীয় কনফু সীয় বা বুদ্ধ-মতের সঙ্গে তাদের অনেক মিল খুঁজলে পাওয়া যাবে । পারস্যে চিনের মতো কোনো প্রাচীন ধর্মমত নেই । এক মুসলমান ধর্মই সেখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে । তবুও পারস্যের মুসলমানদের ধর্মমতে পারস্যের অনেক জাতিগত উপাদান মিলেমিশে গেছে । অর্থাৎ এটা বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ কোনো ফাঁক রাখছেন না যে, হিন্দু, পারস্য, চিন---এগুলো হচ্ছে জাতি; আর বৌদ্ধ, ব্রাহ্ম, খ্রিস্টান, মুসলমান---এগুলো হল ধর্মমত । ঠ

ঠে

মজহারের এমন পাঠ আমাদের আরও বিস্ময়ের ঠেকবে যদি তাঁর একটি সাক্ষাৎকারের কথা আমরা বিবেচনা করি । ১৯৯৪ সালে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার জন্য তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন সাজ্জাদ শরিফ । পরে মজহারের সাক্ষাৎকারের বই সামনা-সামনিতে এটি সংকলিত হয়েছে ।৬ আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক অংশটি পড়া যাক/: সাজ্জাদ শরিফ : আপনি একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন যে আমরা যারা এখানে বাঙালি তারা প্রত্যেকে একই সঙ্গে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ।... ফরহাদ মজহার : হ্যাঁ, দুর্গাপূজা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে নিজের সম্পর্কে বলেছি, আমি একই সঙ্গে হিন্দু এবং মুসলমান । যে-ইতিহাসের মধ্যে আমি বড়ো হয়েছি তার সুবাদে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলামি এবং খ্রিস্টীয় উপাদানের মিশেল ঘটেছে আমার মধ্যে । আমি যুগপৎ হিন্দু এবং মুসলমান । কথাটা কেউ আক্ষরিক অর্থে নিলেও অসুবিধা নেই । হিন্দু কোনো ধর্মের নাম নয় । হিন্দু বলে কোনো ধর্ম নেই । এটা অনেকেই জানেন না । ...বিদেশিরা... সিন্ধু কে বলত হিন্দু । সিন্ধু নদের এদিকে যারাই বাস করত তারা অতএব 'হিন্দু', ...হিন্দু কথাটা একটি সম্প্রদায়ের নাম এবং একই সঙ্গে ধর্ম হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে অতি সম্প্রতিকালে । ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধে হিন্দু শব্দের যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন মজহার এখানে তার প্রায় অবিকল প্রতিধ্বনি করছেন । মজহারের এই বাক্য 'আমি যুগপৎ হিন্দু এবং মুসলমান' শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যাবে---রবীন্দ্রনাথ বলছেন, বাংলাদেশের মুসলমানরা 'প্রকৃ তই হিন্দুমুসলমান' । অথচ মজহার যখন এই প্রবন্ধের আলোচনা করছেন তখন এমন তরতাজা প্রসঙ্গগুলোই তিনি চেপে গেলেন । কেন? এটা ভাবার লোভ সংবরণ করতে পারা মুশকিল---মজহার 'মনে দোষ রেখে' রবীন্দ্রনাথের তফসির করছেন । কিন্তু ওই একই সাক্ষাৎকারে কিছুদূর এগিয়ে পড়লে আমাদের খটকা লাগবে : ফরহাদ : রবীন্দ্রনাথ সে [হিন্দু] কথাটা ভৌগোলিক অর্থে ব্যবহার করেন নি । তার একটা সম্প্রদায়গত অর্থ তিনি মেনে নিয়েছেন । ...তিনি বলেন নি যে সিন্ধু নদের তীরবর্তী প্রত্যেকেই হিন্দু । এই অর্থে সকল ধর্মের ও সকল মতের প্রত্যেকেই এই ভূ খণ্ডে হিন্দু এবং সেই সুবাদে এই ভূ খণ্ডের সকল ধর্ম, মত ও পথের ওপর আমার এখতিয়ার আছে, আমার অধিকার আছে । এই কথা তিনি বলেন নি । নিজেকে সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দু ভাবতেন বলে এই কথা বলা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল । সেই সম্প্রদায়গত হিন্দু কথাটা কিছুতেই মজহারের পিছু ছাড়ছে না । ফলে তাঁর পঠন এক-কদমও নড়ছে না এখানে । তবু এটা আমাদের ধন্দ লাগায়, কারণ এই কথার উপর

মজহারের পোক্ত ইমান আমাদের চেতনায় বাড়ি মারছে । রবীন্দ্রনাথ মজহারের মতো স্পষ্ট করে বলেন নি, সিন্ধু নদের তীরে যাদের বাড়ি তারা সকলেই হিন্দু । কিন্তু এটু কু পাঠোদ্ধার কঠিন হয় না যে, রবীন্দ্রনাথ হিন্দুসমাজ ভারতীয় সমাজের অর্থেই বুঝেছেন । তারপরেও যে মজহার 'সম্প্রদায়' ধারণাটি থেকে নড়ছেন না তার কি কোনো নিগূঢ় কারণ আছে? তাঁর এমন কোনো বোঝাপড়া যা শব্দগুলোর মধ্যকার ফাঁক থেকে সংগ্রহ করে নিয়েছে তাঁর মন? সন্দেহটা আরও ঘোরালো হবে যখন আমরা মজহারের লেখার শেষ দিকের একটি অংশে মনোযোগ দেই । এখানে তিনি শুধুমাত্র 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধের উপর নিজের মতামত প্রকাশ করছেন না, সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথকে বুঝে নেবার একটি বিশিষ্ট পথ বাতলে দিচ্ছেন : নিজের ইচ্ছার জায়গায় ফাঁক বুঝে বিধাতার ইচ্ছা ঢু কিয়ে দেওয়া এবং বিধাতার ইচ্ছাকেই 'আত্মপরিচয়'-এর লেবেল এঁটে দেওয়ার এই ওলটপালট স্রেফ একটা খামখেয়ালি ছিল না । কাব্যিকতার বা রাবীন্দ্রিক ভাবুকতার বেসামাল মুহূর্ত নয় এইসব । ঔপনিবেশিকতার ঔরসে হিন্দুত্বের যে 'নিত্য লক্ষণ' সদ্য বেড়ে ওঠা হিন্দু মধ্যবিত্ত নিজের অতীত ইতিহাসে আবিষ্কার করে চলেছিল, নিজের মনে ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে গড়ে ওঠা এক বিশেষ ধরনের হিন্দুত্বকে সে যেমন কখনো সচেতনে কখনো বেখেয়ালে অতীতে প্রক্ষেপ করছিল রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তারই মার্জিত এবং সৎ রূপটা আমরা খুঁজে পাই । মজহারের এই কথাগুলো মোটা-দাগে ভু ল বা শুদ্ধ বলে বুঝে নেয়া কঠিন । তিনি শুধু রবীন্দ্রনাথই নয়, উপনিবেশি যুগের গোটা হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজকেই তাঁদের শ্রেণিগত নিক্তিতে যাচাই করে নেবার একটি প্রস্তাব তু লেছেন । এটা নতু ন কথা মোটেই নয় । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধের প্রেক্ষিত থেকে দেখলে মজহারের একগুঁয়ে 'ভাঙা-পাঠে'র সঙ্গে এই কথাগুলোর কি কোনো সম্পর্ক আছে? এই সম্পর্কের হদিশ পেতে, বা মজহারের একগুঁয়েমির মানে বুঝতে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে আরেকবার কড়া আলো ফেলা দরকার । তাঁর লেখার দিকে তাকালে বোঝা যায়, তিনি বিভিন্ন ধারণাগুলো খুব 'ক্লারিফাইড' আকারে কল্পনা করেন নি । একই পদের জড়াজড়ি করা ভিন্ন ভিন্ন অর্থ তাঁর মনে ক্রিয়াশীল ছিল । একই পদ একবার যে অর্থে যে আঙ্গিকে তিনি ব্যবহার করছেন অন্যত্র তার অর্থ বদলে যাচ্ছে । সে কারণেই, মূল কথাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে কোনো-কোনো চিকন গলিতে রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই ভারসাম্য হারিয়ে টাল খেয়ে পড়ে গেছেন । রবীন্দ্রনাথের এই 'টলে পড়া'র ঘটনাগুলো মনে রাখলে মজহারের শ্রেণিগত যুক্তিটাই থেমে থেমে কামড়াতে শুরু করে । তার কতখানি সারবস্তু, আর কতটু কু মায়া---সেই তর্কে যাবার আগে রবীন্দ্রনাথের 'টলে পড়া'র মুহূর্তগুলো দাগিয়ে রাখা দরকার ।

'হিন্দু' কথাটার নতু ন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ---আগেই সেকথা বলেছি । কিন্তু এই ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং সর্বত্র রক্ষা করেন নি, প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত কখনো কখনো তাঁর শাসনের বাইরে চলে গেছে । এখানে যেমন হচ্ছে : ব্রাহ্মসমাজের কেহ কেহ এ সম্বন্ধে এইরূপ তর্ক করেন যে, হিন্দু বলিয়া নিজের পরিচয় দিলে মুসলমানের সঙ্গে আমার যোগ অস্বীকার করা হয়, তাহাতে ঔদার্যের ব্যাঘাত ঘটিয়া থাকে । বস্তুত পরিচয়মাত্রেরই এই অসুবিধা আছে । ...আমি যাহা এবং আমি যাহা নই এই দুইয়ের মধ্যে একটা বিচ্ছেদ আছে---পরিচয়মাত্রই সেই বিচ্ছেদেরই পরিচয় । পরিচয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের যোগ বোঝাতে গিয়ে এমন একটি ইঙ্গিত প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে যেখানে রবীন্দ্রনাথের 'মুসলমান মাত্রই হিন্দু' তত্ত্বের কোনো লক্ষণই নেই ।৭ এরপর ইংরেজ এবং আইরিশের জাতিগত বিবাদ নিয়ে কথা সেরে তিনি বলছেন, 'তেমনি হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের যদি বিরোধ থাকে, তবে আমি হিন্দু নই বলিয়া সে বিরোধ মিটাইবার ইচ্ছা করাটা অত্যন্ত সহজ পরামর্শ বলিয়া শোনায় কিন্তু তাহা সত্য পরামর্শ নহে ।' একটু পরেই রবীন্দ্রনাথ হিন্দু আর মুসলমানের যে ক্যাটেগরি গড়ে নেবেন তার সঙ্গে এই বক্তব্যের কোনো মিলই নেই । তিনি নিজের বানানো ক্যাটেগরি এখানে নিজেই এস্তেমাল করছেন না । রবীন্দ্রনাথের 'টলে পড়া'র প্রধান সাবুদ কিন্তু এখানে নেই । সেটা খুঁজতে হবে প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের কিছু মনোভঙ্গির মধ্যে । ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাসে এই তর্কটা প্রায় সারা জীবন জ্যান্ত ছিল---হিন্দুর সঙ্গে ব্রাহ্মের সম্পর্ক কী? আদি ব্রাহ্মসমাজের উত্তর ছিল, ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুত্বের অন্তঃপুরের জিনিস । সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ এই মত কবুল করে নি । রবীন্দ্রনাথের এই প্রবন্ধেও তেমন স্বীকারোক্তি প্রচু র পরিমাণে আছে । তিনি বলছেন, 'বস্তুত ব্রাহ্মসমাজের আবির্ভাব সমস্ত হিন্দুসমাজেরই ইতিহাসের একটি অঙ্গ । ...হিন্দুসমাজের বহুস্তরবদ্ধ কঠিন আবরণ একদা ভেদ করিয়া সতেজে ব্রাহ্মসমাজ মাথা তু লিয়াছিল বলিয়া তাহা হিন্দুসমাজের বিরুদ্ধ নহে, ভিতর হইতে যে অন্তর্যামী কাজ করিতেছেন তিনি জানেন তাহা হিন্দুসমাজেরই পরিণাম ।' যাঁরা ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাস জানেন তাঁদের কাছে এই কথার মানে একটু বেশি করে ফু টবে । কিন্তু এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যে নতু ন কথাটি বলছেন, সেটা এই মনোভঙ্গি ছাড়িয়ে উঠেছে । আদি ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ মত ছিল হিন্দুত্বের উঠানেই ব্রাহ্মসমাজের ফরাশ পাততে হবে । রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য দাঁড়াচ্ছে, হিন্দু আর ব্রাহ্ম আলাদা ক্যাটেগরি । কিন্তু এই নতু ন মতের ফাঁক গলে আদি সমাজের পুরোনো মতটাও মধ্যে মধ্যে উঁকি দিচ্ছে । 'হিন্দুসমাজ' কথাটা

ব্যাপক অর্থে ভারতীয় হলেও এর সংকীর্ণ সম্প্রদায়গত অর্থ তাঁর অচেতনে বোধহয় পুরোপুরি ঘোচে নি । একেই আমরা নাম দিচ্ছি---রবীন্দ্রনাথের 'টলে যাওয়া ।' রবীন্দ্রনাথের এই টলে পড়ার ঘটনাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে মজহারের শেষ বক্তব্যটি পাঠ করলে আমরা একটা সমস্যার মধ্যে পড়ে যাই । মজহার রবীন্দ্রনাথের যে শ্রেণিগত সংকীর্ণতার দিকে ইঙ্গিত করছেন তার সঙ্গে কি রবীন্দ্রনাথের 'টলে পড়া'র মুহূর্তগুলোর কোনো সম্পর্ক আছে? এই সওয়ালের মীমাংসা খুঁজতে যাওয়া খুব কঠিন খাড়ি বেয়ে ওঠার মতো ব্যাপার । এখানে কতগুলো চেনা প্রলোভন আছে । সেই রবীন্দ্রনাথের আমল থেকে আজ অবধি তাঁকে কাট-ছাঁট করে জমিদার বানিয়ে তোলার রেওয়াজ আছে । মূলের বেলায় তিনি যে 'হিন্দু ভদ্রলোক' এরকম বাক্যের উপর দাঁড়িয়ে তাঁকে শিল্পের আসন থেকে পেড়ে আনবার চেষ্টাও কম হয় নি । এসব কথার ষোলো আনাই যে মন-গড়া তাও নয়, রবীন্দ্রনাথের আশি বৎসরকালব্যাপী জীবনের মধ্যে কোথাও কোথাও এর সাক্ষ্য মেলে । কিন্তু এভাবে তাঁর চিন্তা বুঝতে গেলে তাঁর অনেক মুহূর্ত আমলনামা থেকে শুরুতেই বাদ দিতে হয় । বস্তুত কোনো একটি সরল স্টিরিওটাইপের মধ্যে জোর করে ঠেলে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে তাঁর ব্যক্তিত্ব বুঝে ফেলতে চাওয়ার কিছু বাস্তব অসুবিধা আছে । প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কথাটার মধ্যে সমস্যার সার-ভাবটা পাওয়া যাবে : রবীন্দ্রনাথকে লইয়া সমস্যা হইতেছে যে, তিনি কহিয়াছেন বিস্তর । ...একদিকে তাঁহার ভিতরে ছিল এক ইউরোপীয় পর্যটকের ঝপাঝপ সব বুঝিয়া ফেলার ঔদ্ধত্য, এক ধরনের Tourist Gaze, আর একদিকে বাঙালি শিশুর অপার মুগ্ধতাবোধ । ...অনেকে বলেন যে কোন সময়ে তিনি কী বলিয়াছেন সেইটি চু লচেরা বিচার করিয়া দেখিতে হইবে । ইহাতে খুব কিছু লাভ হইবে বলিয়া আমার মনে হয় না, কেননা তাহার অব্যবহিত পরেই নির্ঘাৎ দেখা যাইবে যে তিনি সম্পূর্ণ বিপরীতার্থক কথা বলিয়া বসিয়া আছেন ।৮ এই সমস্যার কারণেই রবীন্দ্রনাথের টলে পড়ার মুহূর্তগুলো তাড়াহুড়ো করে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না । আমাদের উপায় তাই কিছুটা ঘোরালো হবে । 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধটি যখন রবীন্দ্রনাথ পড়ছেন সেখানে তিনি যেসব পথ ঘুরে ঘুরে পৌঁছাচ্ছেন তার একটি মানচিত্র আঁকা কাজের হতে পারে । আপাতত একটি অনুমান দিয়ে আমরা শুরু করতে পারি । দেখাই যাক না, রবীন্দ্রনাথের জীবন এই অনুমানে সায় দেয় কি-না । ১৯১১ সালেই রবীন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেছেন । তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা আবার চালু করেছেন । এই প্রবন্ধ পাঠের সময়টা রবীন্দ্রনাথের 'অসীমের টানে ধাবিত' হবার কাল । তিনি যাবতীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে যাচ্ছেন,

কিন্তু তাঁর রাশ টেনে ধরছে ঐতিহাসিক কিছু বন্ধন । আমরা এই অবস্থার নাম করছি--চোরাটান । চোরাটান কথাটা ইংরেজি Ambivalence ধারণাটির পরিভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে । হোমি কে ভবা তাঁর দি লোকেশন অব কালচার বইতে উত্তর-উপনিবেশি তত্ত্বের পাটাতন থেকে এর একটি বিশিষ্ট রূপ খাড়া করেছেন । সেটাই এখন চোরাটান কথাটার প্রচলিত অর্থ বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে । কিন্তু আমরা ভবার অর্থে শব্দটিকে গ্রহণ করি নি । ক্রিটিক্যাল থিওরি গ্রন্থে চোরাটান কথাটির এই ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে : চোরাটান : মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বে এই পদটি নেয়া হয়েছে বিরতিহীন অস্থিরতার সঙ্গে যুগপৎ কোনো কিছুর আকাঙ্ক্ষা ও তার বিপরীত কিছুর আকাঙ্ক্ষা বোঝাতে । কোনো বস্তু ব্যক্তি বা কাজের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণের টান ও বিকর্ষণ বোঝাতেও পদটি ব্যবহৃত হয় । (ইয়ং ১৯৯৫ : ১৬১) রবীন্দ্রনাথের এই চোরাটানের ইতিহাস খোঁজার চেষ্টাই এই প্রবন্ধের মোদ্দা নিয়ত । তবে ভেতরে-ভেতরে এরকম একটি উচ্চচাশাও লালন করা যাক যে, এর মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের রচনার সামগ্রিক পাঠের ক্ষেত্রে একটি ভাঙাচোরা ধরতাই হয়তো তৈরি হতে পারে ।

দ্বিতীয় পর্ব : রবীন্দ্রনাথের নাড়ির টান ভঙ্গুর ব্রাহ্মসমাজ 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন কিছুটা পারস্পরিক তর্কের ধাঁচে । এখানে তিনি কোনো কাল্পনিক ব্যক্তির সওয়ালের জবাব দিচ্ছেন, বা যুক্তি খণ্ডন করছেন । বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই কাল্পনিক সওয়ালকার সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিনিধি । ১৩১৯ সালের বৈশাখে প্রকাশ হবার পরপরই এর কড়া জবাব আসে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের তরফ থেকে । হিন্দু আর ব্রাহ্মের সম্বন্ধ কী---সেই তর্কটাই তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকায় প্রকাশিত জবাবে বড়ো হয়ে ওঠে । রবীন্দ্রনাথ এর জবাব দিয়েছিলেন । আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের এই ঝগড়ার ইতিহাস খুব প্রাচীন । দেবেন্দ্রনাথের আমল থেকেই দুইরকম মতাদর্শের মধ্যে ঠোকরা-ঠু করি চালু ছিল । এই ঠোকরের ইতিহাসের প্রধান আঁচড়গুলো বুঝে নিতে দেবেন্দ্রনাথের মনোভাব সম্পর্কে কিছু আগাম ধারণা হাতের কাছে রাখা দরকার । দেবেন্দ্রনাথ যুগপৎ প্রগতিবাদী ও হিন্দু-ঘেঁষা ছিলেন । হিন্দুসমাজের বুকের উপর চেপে বসা আচারাদির সংস্কারের প্রতিজ্ঞা তিনি পেয়েছিলেন রামমোহন রায়ের কাছ থেকে ঠি

। তিনি কখনোই ঠিক ব্রাহ্মসমাজকে হিন্দুত্ব থেকে পৃথক করে দেখেন নি, 'ব্রাহ্মধর্মকে হিন্দুভাবে হিন্দুসমাজের মধ্যে প্রচার করা তাঁহার চিরদিনের আদর্শ । তিনি মনে করিতেন রামমোহন রায় তাঁহাকে সেই ভার দিয়া গিয়াছিলেন ।'৯ পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ পিতা সম্বন্ধে লিখছেন, 'আমার বাবা যদিও মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী ছিলেন, কিন্তু মজ্জাগতভাবে তিনি ছিলেন একজন রক্ষণশীল ।'১০ ধর্মের তাত্ত্বিক প্রশ্নে দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন 'চরমপন্থী' : পৌত্তলিকতা বা মূর্তিপূজার ব্যাপারে তাঁর বিরোধিতা ছিল অখণ্ড এবং সংশয়হীন । কিন্তু হিন্দুসমাজের প্রচলিত বর্ণভেদপ্রথার সঙ্গে আপস করতে তাঁর অমত ছিল না; বরং এ বিষয়ে কেশবচন্দ্র সেনের গোঁয়ার মনোভাবটাই তাঁর কাছে আপত্তিজনক মনে হয়েছিল । দেবেন্দ্রনাথ জানতেন যে, জাতিভেদ-প্রথার উপর আঘাত হিন্দুসমাজ সহ্য করবে না । এ ব্যাপারে হিন্দুসমাজের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করাই তিনি উচিত মনে করতেন । শিবনাথ শাস্ত্রীও এরকম মতামতই প্রকাশ করেছেন, 'দেবেন্দ্রনাথ যে দেশবাসীর থেকে মহর্ষি খেতাব পেয়েছিলেন সেটা যথার্থ । তিনি সত্যিই দ্রষ্টা ছিলেন । আর সারগতভাবে নিজের আত্মিক লক্ষ্য এবং আকাঙ্ক্ষায় তিনি ছিলেন একজন হিন্দু ।'১১ কিন্তু যাঁদের ছাহাবি করে তিনি ব্রাহ্মসমাজের কাজ করছিলেন তাঁদের মেজাজটা ঠিক এমনধারা ছিল না । মতাদর্শের প্রথম ফাঁকটা ধরা পড়বে দেবেন্দ্রনাথ আর অক্ষয়কু মার দত্তের দিকে তাকালে । দেবেন্দ্রনাথের একটা ঝোঁক ছিল সনাতন সমাজের দিকে । অক্ষয়কু মার দত্ত ছিলেন ঠিক উলটো । একগুঁয়ে যুক্তিবাদী বলে তাঁর বিরুদ্ধে বাংলার ইতিহাসে রটনা আছে । বেদান্তে তাঁর ভক্তি ছিল না, ইউরোপীয় রেনেসাঁসের ভাবাদর্শকেই তিনি চরম বলে গ্রহণ করেছিলেন । গোড়ার দিকে, দুই বিপরীতের এই বন্ধু ত্ব, ব্রাহ্মসমাজকে একটা বিশেষ ভারসাম্য দিচ্ছিল । তবে এই ভারসাম্য যে শেষতক রক্ষা পেয়েছিল সেটা বলা যায় না । দেবেন্দ্রনাথ আর কেশবচন্দ্রের যুগে এসে মতাদর্শের এই ফাঁকটা কোনো সেতু পেল না । কেশবচন্দ্র সেনের আদর্শকে বলতে হবে দেবেন্দ্রনাথের প্রায় উলটো পিঠ । তিনি গোড়া থেকেই খ্রীস্টিয় ভাবাদর্শের জেবের ভেতরে ছিলেন । তিনি চেষ্টা করছিলেন ব্রাহ্মধর্মের সঙ্গে যিশুকে যুক্ত করতে । ব্রাহ্মসমাজকে কেশবচন্দ্র নিছক হিন্দুধর্মের সংস্কার মনে করতেন না । বরং একটি ক্যাথলিক ধর্ম হিসেবে কল্পনা করতেন, যেখানে সবার স্থান হতে পারে । মানুষের ভেদনীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন না । সব মানুষের অধিকার সমান---কথাটা তিনি যিশুখ্রীস্টের জীবন থেকে শিখেছিলেন । ফলে জাতিভেদ বা নারীপুরুষের সমতার মতো প্রসঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রায় ঠোকাঠু কি হচ্ছিল । কেশবচন্দ্রের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের মতভেদ একটি জান্তব রূপ পেল জাতিভেদ প্রশ্নেই । ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরে উপাচার্যের কাজ যাঁরা করতেন তাঁরা ছিলেন উপবীতধারী ব্রাহ্মণ ।

কেশবচন্দ্র দেবেন্দ্রনাথকে বোঝাতে সক্ষম হলেন, শুধু ব্রাহ্মণদের মধ্যে আটকে রাখলে ব্রাহ্মমতের পরম ইষ্ট সিদ্ধি হয় না । ওই পদে এমন দুজনকে নিয়োগ দিতে হবে, যাদের উপবীত ত্যাগ করার হিম্মত আছে । ভেবেচিন্তে দেবেন্দ্রনাথ এতে সায় দিয়েছিলেন । কিন্তু তাতে ভারি বিপত্তি ঘটে গেল । ব্রাহ্মসমাজে প্রাচীন সভ্য যাঁরা ছিলেন এই অদল-বদল তাঁদের বুকে ভারি বাজল । তাঁরা দুঃখিত হয়ে দেবেন্দ্রনাথের কাছে অনুযোগ করলেন । আরও একটা কাণ্ড ঘটল এসময় । কেশবের অনুরাগী যুবক-পক্ষ ভারি উৎসাহে অসবর্ণ দুজনের মধ্যে বিয়ে দিয়ে দিলেন । বিয়ের খবরটা যাতে দশজনে জানতে পারে সেজন্য তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ঘটা করে এই বিয়ের খবর ছাপা হল । শুরুতে যখন বিধবা বিবাহ, বহুবিবাহের বিরুদ্ধে কেশবচন্দ্র কথা বলেছেন দেবেন্দ্র তাতে প্রসন্ন ছিলেন । কিন্তু অসবর্ণ বিয়েতে দেবেন্দ্রনাথ ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে গেলেন । ১৮৬৪ সালের সুপ্রসিদ্ধ ঝড়ে কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের বাড়ি ভেঙে গেলে সংস্কার লাগত । তখন কিছুকালের জন্য উপাসনা দেবেনের বাড়িতে উঠে গেল । সেখানে উপাসনার প্রথম দিন উপবীতত্যাগী উপাচার্য দুজন গিয়ে দেখেন আগের উপবীতধারী উপাচার্যরাই উপাসনা আরম্ভ করেছে । যুবক ব্রাহ্মদল সেই মুহূর্তে স্থান ত্যাগ করলেন, অন্যত্র উপাসনা করতে শুরু করলেন তাঁরা । কেশবচন্দ্র-দেবেন্দ্রনাথ দ্বন্দ্বে এটাই ব্রাহ্মমুহূর্ত । এরপর থেকে দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকে । অবশেষে ১৮৬৬ সালের ১১ নভেম্বর উন্নতিশীল ব্রাহ্মদলের এক সভাতে কেশবপন্থীরা নতু ন সমাজ গঠন করলেন । এই নতু ন ভাগের নাম দাঁড়াল--- 'ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ' । অ্যাদ্দিন পর্যন্ত ব্রাহ্মসমাজের অখণ্ড ধারা কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজ বলে পরিচিত ছিল । এই ভাঙনের পর দেবেন্দ্রনাথের সাবেকি ধারার পরিচয় দাঁড়াল 'আদি ব্রাহ্মসমাজ' । দেবেন্দ্র-কেশব গোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম যে বিচ্ছেদ হয় তার মূল কারণ শিবনাথ শাস্ত্রীর মতে দুটি : আদি ব্রাহ্মসমাজের আকূ তি ছিল 'ব্রাহ্মসমাজ মানে হিন্দুত্ব' । এর জবাবে তরুণ সংস্কারপন্থীদের চিৎকার ছিল 'ব্রাহ্মসমাজ ক্যাথলিক ও সার্বজনীন' । জাতিভেদ প্রথা বিষয়ে সংস্কারপন্থীদের মত ছিল : মূর্তিপূজা ত্যাগ করা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি বিষয় হচ্ছে বর্ণ-প্রথার অবসান । এসব কারণেই মূলত এই দুই পক্ষ আলাদা হয়ে যায় । ১২

কেশবচন্দ্র আর দেবেন্দ্রনাথ পৃথক হয়ে গেলে এর ফল দুই সমাজের উপরই দাঁড়াল গভীর । নবীন ব্রাহ্মদের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর আদি সমাজপন্থীরা ক্রমে হিন্দুত্বের দিকে ঝুঁকতে থাকেন । এই ঝোঁক দেবেন্দ্রনাথের মধ্যে গোড়া থেকেই ছিল । উদার মধ্যপন্থাই ষ্ঠ

তিনি শ্রেষ্ঠ পন্থা বলে মনে করতেন । বিচ্ছেদের পরে আদিসমাজ সামাজিক- পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠান---যেমন ব্রাহ্মণের উপনয়ন, বিবাহে সপ্তপদী ইত্যাদি---হিন্দুঘেঁষা করে সংস্কার করেন । নবগোপাল মিত্র এবং রাজনারায়ণ বসুর নেতৃ ত্বে মহা তোড়জোড় শুরু হল---হিন্দু মেলা করতে হবে । এই হিন্দুমেলার মধ্যেই কিশোর রবীন্দ্রনাথের হিন্দুত্ব এবং স্বাদেশিকতা---এই দুই ব্যাপারেই হাতেখড়ি হল । সে-প্রসঙ্গে যথাসময়ে আমরা আলোচনা করব । ১৮৬৭-৬৮ সালের দিকে ব্রাহ্মবিবাহ নিয়ে একটি বিতর্ক আরম্ভ হল । দেবেন্দ্রনাথ প্রণীত 'নূতন পদ্ধতি'তে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিয়ে-থা হচ্ছিল । কেশবচন্দ্র পরীক্ষা করে দেখলেন, আইন মতে বিয়ে বৈধ হয় না । আদিসমাজ তখন নবদ্বীপ, কাশী থেকে ব্রাহ্মণদের মত এনে দেখালেন, হিন্দুশাস্ত্র মতে এই বিয়ে বৈধ । কেশবচন্দ্র তখন সংস্কৃ তশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতের মত এনে দেখালেন উভয় সমাজের বিয়েই অবৈধ । এই নতু ন আইন প্রণয়ন নিয়ে ব্রাহ্মসমাজের বিবাদ চরমে উঠল । বিরোধের দরকারেই আদি ব্রাহ্মরা এই আন্দোলনকালে দীর্ঘ ও অতি দ্রুত পদক্ষেপে হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের দিকে এগিয়ে যান । ১৩

ব্রিটিশ-রাজ শেষতক ব্রাহ্ম ম্যারিজ বিলের সংকল্প ত্যাগ করে নেটিভ ম্যারিজ বিল করার সিদ্ধান্ত নিলেন । ১৮৭২ সালে তিন-আইনে রেজিস্টারি বিবাহের আইন পাস হয় । এই নতু ন আইনের মাধ্যমে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি এবং ধর্মে অবিশ্বাসীদের মধ্যকার আন্তর্বিবাহ ঘটাতে লাগল । বাইরের লোকের কাছে কথাটার মানে দাঁড়াল, 'ব্রাহ্মরা বলিতেছে---আমরা হিন্দু নই' । একদিকে দেবেনপন্থীরা পাল্লা দিয়ে হিন্দুসমাজে সেঁধানোর চেষ্টা করছে, কেশবচন্দ্র অন্যদিকে স্বাধীনতার ডঙ্কা বাজাচ্ছেন : বর্ণ প্রথা বিলোপ করতে হুঙ্কার করছেন, নারীমুক্তির জন্য কাজ করছেন । এই সময়ে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য ইন্ডিয়ান রিফর্ম অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয় । কেশবচন্দ্র সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূ মিকা পালন করেন । এরপর কেশবচন্দ্রের জীবনে বেশ কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটে যায় । ১৮৭৮ সালে তিনি কু চবিহারের তরুণ রাজার সঙ্গে নিজের নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দেন । প্রধানত তিনটি যুক্তিতে তখন এর কঠোর সমালোচনা হয় : (১) বয়সের বিচারে এটি ব্রাহ্মবিবাহ আইনের লঙ্ঘন (২) প্রতিমা পূজার আচারাদি মেনে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে (৩) কেশবচন্দ্র যেভাবে নিজের পক্ষে যুক্তি দিলেন সেটা আরও গুরুতর ব্যাপার । তিনি জানালেন, এই বিয়েতে ঈশ্বরের সমর্থন আছে---তিনি জেনেছেন । এই ঘটনার ফলে আবার ভাঙন হল । ১৮৭৮ সালে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ভেঙে দু'খানা হয়ে গেল । কেশব-অনুরাগীরা গঠন করলেন 'নববিধান ব্রাহ্মসমাজ' । আর ঠ

আনন্দমোহন বসু, শিবচন্দ্র দেব, উমেশচন্দ্র দত্তরা মিলে গঠন করলেন 'সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ' । এই সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকেই ১৮৭৮ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকা প্রকাশিত হল । তিরিশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ যখন 'আত্মপরিচয়' লিখবেন তখন এই তত্ত্বকৌমুদী-র পাতাতেই তাঁর কড়া সমালোচনা লেখা হবে । আদি ব্রাহ্মসমাজের মনোভঙ্গি কেমন ছিল---সেটা আমরা ইতিমধ্যেই বলেছি । সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মনোভঙ্গিটিও জেনে নেওয়া জরুরি । এই সমাজের পুরোধা ব্যক্তি ছিলেন আনন্দমোহন বসু এবং শিবনাথ শাস্ত্রী । এঁরা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের মতভেদের স্থানটিতে কেশবচন্দ্রের দিকে ঝুঁকে থাকলেও নববিধান সভায় যুক্ত হন নি । সাধারণ সমাজ প্রচলিত ব্রাহ্মবাদের একেশ্বর নীতিতে অটল থাকেন, ধর্মমন্দিরে নিয়মিত প্রার্থনার অনুষ্ঠান চলতে থাকে । তাঁরা মরমিবাদ এবং আবেগবাদের ঘোর বিরোধিতা পালন করেন । ভ্রাতৃ ত্বের প্রতি তাঁরা ঝোঁক দেন, বর্ণভেদের উচ্চচাঙ্গ প্রতিবাদ করেন, ধর্মবুদ্ধির স্বাধীনতার আওয়াজ দেন ।১৪ এই পাটাতনে দাঁড়িয়ে 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধের দিকে চোখ রাখলে অনেক জলছাপের মতো ইঙ্গিত ফরসা হয়ে উঠবে । রবীন্দ্রনাথ যখন এই প্রবন্ধে নিজের পরিচয় স্থির করছেন তখন তিনি এই গোলযোগের প্রধান কিছু ছেঁড়া সুতো ধরেই রিপু করার চেষ্টা করছিলেন । আত্মপরিচয়ের নিরিখে রবীন্দ্রনাথকে আমরা দুটো কাল-পর্বে ভেঙে নিতে পারি । তাঁর শৈশব থেকে ১৯০৫ সাল অবধি একটি পর্যায় মোটা-দাগে ঠিক করে নেয়া যায় । দ্বিতীয় পর্যায়টি এরপর থেকে আরম্ভ হয়ে ১৯১২ সালে গিয়ে ঠেকবে । আমাদের আলোচনা যথাসম্ভব ১৯১২ সালেই আটকে থাকবে । তবে বিশেষ দরকার পড়লে এই সীমানা ডিঙানো হতে পারে । এখন ১৯০৫ সাল অবধি রবীন্দ্রনাথের চিন্তার কয়েকটি প্রধান উপাদানকে শনাক্ত করার চেষ্টা করা যাক ।

ঠাকু রবাড়ির ছোহবত রবীন্দ্রনাথের উপর দেবেন্দ্রনাথের আছর ছিল সাংঘাতিক । পিতার প্রতি তাঁর নিশ্চল ভক্তি ছিল---সেটা তাঁর জীবনস্মৃতি বা দেবেন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধে স্পষ্ট । দেবেন্দ্রনাথের লেখা ব্রাহ্ম ধর্ম বইটি তাঁর চিরকালের সান্ত্বনা ছিল, এই বই তিনি কখনো কাছ-ছাড়া করেন নি । প্রথম দূরের ভ্রমণে তিনি গিয়েছিলেন বাবার সঙ্গে হিমালয়ে, সেই সময়কার একটা সুস্থায়ী ছাপ তাঁর উপর পড়েছিল । ব্রাহ্মসমাজ প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষক

ডেভিড কফ লিখেছেন : 'আমাদের অবশ্যই সব-সময় মনে রাখতে হবে---রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকু রের পুত্র, এবং তাঁর জীবনে আমি কখনো এমন কোনো সাক্ষ্য পাই নি যেখানে তাঁকে আদি সমাজের হিন্দু-ব্রাহ্ম রীতির বিরোধী বলে শনাক্ত করা যায় ।'১৫ আহমদ ছফাও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনার সময় বিশেষ করে তাঁর উপর দেবেন্দ্রনাথের প্রভাব আলোচনা করেছেন : বস্তুত রবীন্দ্রনাথের ওপর তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথের প্রভাব এতো ব্যাপক, এতো সুগভীর যে, দেবেন্দ্রনাথের আত্মজীবনী পাঠকের মনে হবে গীতাঞ্জলি, নৈবেদ্য, গীতিমাল্য, গীতালি ইত্যাদি আত্মনিবেদনমূলক কাব্যগুচ্ছে তাঁর পিতার মুখের কথা শুধুই ছন্দোবদ্ধ আকারে প্রকাশ করেছেন ।১৬ দেবেন্দ্রনাথের হিন্দুসমাজ-প্রীতি আমরা আগেই আলোচনা করেছি । দেবেন্দ্রনাথের এসব দৃষ্টিভঙ্গি রবীন্দ্রনাথের অন্তঃপুরে বাসা বেঁধেছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই । কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, রবীন্দ্রনাথ কখনো পিতার চৌহদ্দির বাইরে হাঁটেন নি । বিশেষত ১৯০৫ সালে দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ অনেক ক্ষেত্রে ছোটো-বড়ো রদবদল করেছেন । ১৯১০ সালের ২৯ জানুয়ারি রথীন্দ্রনাথ ঠাকু রের সঙ্গে গগনেন্দ্রনাথের বোন বিনয়নী দেবীর বালবিধবা কন্যা প্রতিমার বিয়ে দেন । ঠাকু র পরিবারে বা আদি ব্রাহ্মসমাজে এটা একটা বিপ্লব বা বিদ্রোহ ।১৭ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কেশবচন্দ্র সেনের খ্রিস্ট ভক্তি ও খ্রিস্টান-ঘেঁষা উৎসবের কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে একটি ভাষণে খ্রিস্ট ভীতির কথা বলেছিলেন । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে যিশু-খ্রীস্টের জন্মোৎসব পালন করেন । ১৩১৭ সনের পৌষ-উৎসবের বড়ো দিনে তিনি খ্রিস্টের প্রশস্তি করে ভাষণ দেন । কিন্তু মোটের উপর এটা সত্যি---দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন । তাঁর শৈশব এবং কৈশোর কাটছে ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্কোন্দলের মধ্যে এমন একটি প্রতিবেশে যখন আদি সমাজ আরও বেশি হিন্দু-ঘেঁষা হয়ে গেছে । ১৮৭৫ সালে চৌদ্দ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথম জনসমক্ষে আসেন হিন্দু মেলার মধ্যে । তু মুল উৎসাহ নিয়ে হিন্দুমেলার জন্য খাটছেন । হিন্দুমেলায় হিন্দুত্ব ও স্বাদেশিকতা---এই দুই বিষয়েই তার হাতেখড়ি হচ্ছে । রবীন্দ্রনাথের স্বাদেশিকতার আরেকটি উৎস ছিল সঞ্জীবনী সভা । কৈশোরে রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে আপন ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকু র । তাঁরই আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ এই গুপ্ত সংগঠনে যুক্ত হন । ক্যালকাটা লেনে এই সভা বসত । এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতির (১৩১৮-১৯) মধ্যে লিখছেন :

জ্যোতিদাদার উদ্যোগে আমাদের একটি সভা হইয়াছিল । বৃদ্ধ রাজনারায়ণ বাবু ছিলেন তাহার সভাপতি । ইহা স্বাদেশিকতার সভা । কলিকাতার এক গলির মধ্যে এক পোড়ো বাড়িতে সেই সভা বসিত । সেই সভার সমস্ত অনুষ্ঠান রহস্যে আবৃত ছিল । বস্তুত তাহার মধ্যে ঐ গোপনীয়তাটাই একমাত্র ভয়ংকর ছিল ।১৮ এই গুপ্ত সভা কিন্তু কোনোভাবেই নিজেকে হিন্দুসমাজের সঙ্গে একীভূ ত করতে চায় নি । বরং হিন্দুমেলার স্বদেশি প্রকল্পের মতোই বস্ত্র ও পাট শিল্পের শিল্পায়ন চেয়েছে । দেবেন্দ্রনাথের প্রভাবে রবীন্দ্রনাথ পেলেন হিন্দু সমাজ এবং আদি ব্রাহ্ম দৃষ্টিভঙ্গি । স্বাদেশিকতা তিনি পাচ্ছেন সঞ্জীবনী সভা আর হিন্দু মেলা থেকে । এরসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবনের আরেকটি অধ্যায় যুক্ত করে নিলে আমরা ১৯০৫ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে বোঝার ক্ষেত্রে ভালো ধরতাই পেয়ে যাব । এই অধ্যায়ে রয়েছে, ব্রহ্মবিদ্যালয়ের স্বপ্ন এবং সেই সূত্রে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় । রবীন্দ্রনাথ অনেকদিন থেকেই শান্তিনিকেতনে একটি আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপনার কথা ভাবছিলেন । এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটছে উপাধ্যায়ের । রবীন্দ্রনাথ 'আশ্রমের রূপ ও বিকাশ' প্রবন্ধে উপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের কথা জানাচ্ছেন : এমন সময় ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল । ...এই পরিচয় উপলক্ষ্যেই তিনি জানতে পেরেছিলেন আমার সংকল্প, এবং খবর পেয়েছিলেন যে, শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয়-স্থাপনের প্রস্তাবে আমি পিতার সম্মতি পেয়েছি । তিনি আমাকে বললেন, এই সংকল্পকে কার্যে প্রতিষ্ঠিত করতে বিলম্ব করবার কোনো প্রয়োজন নেই । তিনি তাঁর কয়েকটি অনুগত শিষ্য ও ছাত্র নিয়ে আশ্রমের কাজে প্রবেশ করলেন ।১৯ ১৩০৮ সালের ৭ পৌষের উৎসবের দিন 'ব্রহ্মচর্যাশ্রম' আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হল । ব্রহ্মবান্ধব অবশ্য এই আশ্রমে মাস চারেকের বেশি থাকতে পারেন নি । পরে রবীন্দ্রনাথ যখন আশ্রম নিয়ে লিখছেন তখন সযত্নে উপাধ্যায়ের এই ঋণ তিনি স্বীকার করছেন/: 'শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের সূচনার মূল কথাটা বিস্তারিত করে জানালুম । এইসঙ্গে উপাধ্যায়ের কাছে আমার অপরিশোধনীয় কৃ তজ্ঞতা স্বীকার করি ।' রবীন্দ্রনাথ ঠাকু রের চিন্তা-চেতনায় অন্তত কয়েক বছর ধরে বিরাট প্রভাব রেখেছিলেন উপাধ্যায় । যথাসময়ে আমরা সে-প্রসঙ্গে আলোচনা করব ।

রবীন্দ্রনাথের শ্রেণিচেতনা

উনিশ শতকের গোড়াতেই ইংরেজি জানা একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাংলায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল । শুরুর দিকে ইংরেজদের শাসন চালানোর সহায় হিসাবে ভাষার মধ্যস্থতা যাঁরা করেছিলেন তাঁদের ইংরেজি জ্ঞান সুবিধার ছিল না । একগোছা মুখস্ত ইংরেজি শব্দ বা বুলির ঠেকনাতেই তখনকার যোগাযোগ চলছিল । এই সূত্রে বাংলায় একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয় । এঁদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন সেসময়কার জমিদার এবং দপ্তরের কেরানিরা । নকলনবিশিতে এঁদের বেশ গুণপনা ছিল । উনিশ শতকেই এই শ্রেণিটিকে নিয়ে বিস্তর ঠাট্টা-মস্করা চালু ছিল । এই শ্রেণিটিকে আমরা বাবু বলে জানি । বাবু বলতে মোটা-দাগে বোঝায় হিন্দু, উচ্চচবর্ণ, জমিদার, প্রভু , শিক্ষিত, সংস্কৃ ত---অর্থাৎ অ্যাংলিসাইজড একটি শ্রেণি যাঁরা ইংরেজ হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন । এরপর যখন জমিদারির দাপট কিছুটা পড়ে আসে তখনকার ভদ্রলোকরা শিক্ষার দাপট গ্রহণ করেন । উনিশ শতকের শেষ দিকে ভদ্রলোক শ্রেণির লেখকরা নিজেদের 'শিক্ষিত সম্প্রদায়' বা 'শিক্ষিত মধ্যবিত্ত' বলতে শুরু করেন । ধনের আভিজাত্য ক্রমে সাংস্কৃ তিক আধিপত্যে বদলে যায় । বিশ শতকে ভদ্রলোক শ্রেণিটি নিজেদের 'কৃ ষ্টি-মনা', 'দীপায়িত' ভাবতে শুরু করে দেয়, যারা বাংলার রেনেসাঁসের প্রকৃ ত উত্তরাধিকার এবং প্রগতি-আধুনিকতার ধারক । এসব ভদ্রলোকদের এক পা শহরে থাকলেও অন্য পা থাকত গ্রামে । এদের জাতীয়তাবাদও তেমন, কলকাতা থেকে উচ্চচারিত ও শহুরে ইস্যুতে পরিপূর্ণ, আবার জমিদারি প্রথার প্রতিও ওয়াদাবদ্ধ, খাজনার লোভে উদগ্রীব । একটু উদাহরণ দিলেই এদের শ্রেণিচরিত্র সহজে বোঝা যাবে । ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরে ১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন---যার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকু র---ইংল্যাণ্ডের পার্লামেন্টে একটি আবেদনপত্র পাঠান এবং সেই পত্রে বাংলাদেশের মতো ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তনের অনুরোধ করেন এই যুক্তিতে যে : 'আপৎকালের শেষদিকে অনুগত ও অবাধ্যদের মধ্যে তু লনা করলেই অন্তত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এই প্রবণতাটু কু বেরিয়ে আসবে যে, এর মাধ্যমে একটি শক্তিশালী শ্রেণির জন্ম হয়েছে যারা তাদের স্বার্থকে গদিনশিন শক্তির সঙ্গে অভিন্ন করে ভাবে, এবং যারা তাদের অবস্থান নিয়ে তু ষ্ট ।'২০ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'বঙ্গদেশের কৃ ষক' প্রবন্ধে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে ইংরেজের চিরস্থায়ী ভু ল হিসেবেই শনাক্ত করেছিলেন । এই প্রবন্ধে তিনি বাংলার রায়তদের উপর জমিদারি অত্যাচার এবং সেই অত্যাচারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূ মিকা বিস্তারিত আলোচনা

করেছিলেন ।২১ কিন্তু তখনকার ভদ্রলোক শ্রেণিটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সাফল্যে শুধু মুগ্ধ ছিলেন তাই নয়, ভারতবর্ষের সব-খানে এই বন্দোবস্তের দাবি করেছিলেন । এই ভদ্রলোক শ্রেণি বলতে ডেভিড কফ বুঝেছেন উচ্চচবর্ণের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, যাদের উদ্ভব হয়েছিল উনিশ শতকের শেষ ভাগে । আমাদের আলোচনায় এই শ্রেণিটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, কারণ ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে এই শ্রেণিটির নাড়ির যোগ আছে । উনিশ শতকের ব্রাহ্ম আন্দোলন মূলত এই শ্রেণির ভেতর থেকে উঠে আসা আন্দোলন । বিশেষ করে ইউরোপিয় রেনেসাঁস, ধর্মসংস্কার, দীপায়নের যে নতু ন সংস্কৃ তি তৈরি হয়েছিল বাংলায় এই শ্রেণিটি নিজেদেরকে তার সাংস্কৃ তিক উত্তরাধিকার বলে মনে করত । ১৮৭০-৮০ সালের দিকে পাবনায় একটি আন্দোলন উপস্থিত হয় । এ-জাতীয় আন্দোলনগুলো বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে খুবই বিচিত্র প্রতিক্রিয়া জাগায় । জমিদারপ্রধান ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এই আন্দোলনের ব্যাপারে ছিল ঘোর শত্রুভাবাপন্ন । তার মুখপাত্র হিন্দু প্যাট্রিয়ট-এ পাবনা আন্দোলনকে হিন্দু ভূ স্বামীদের বিরুদ্ধে মুসলমান চাষিদের সাম্প্রদায়িক বিক্ষোভ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করা হয় । আসলে, ঘটনাচক্রে পাবনার চাষিদের বড়ো অংশই যদিও সত্যিই ছিলেন মুসলমান, আর তাঁদের জমিদাররা হিন্দু, তাহলেও সাম্প্রদায়িক উপাদান তখনও পর্যন্ত প্রায় ছিলই না । কৃ ষক সমিতির তিন প্রধান নেতা ছিলেন খুদে জমি-মালিক ঈশানচন্দ্র রায়, গ্রামের মোড়ল শম্ভু পাল (দুজনেই বর্ণহিন্দু) আর মুসলমান জোতদার খুদি মোল্লা । প্রসঙ্গত যেসব জমিদার মুখ্যত ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকু র । 'শান্তিশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য' কঠোর ব্যবস্থা নিতে ইনি জুলাই ১৮৭৩-এ সরকারের কাছে আর্জি জানান ।২২ রবীন্দ্রনাথ এই হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির মধ্যেই জন্মেছেন । তাঁর বেড়ে ওঠার ইতিহাস স্বভাবতই এই ভদ্রলোক শ্রেণির ভাবাদর্শের চৌহদ্দির বাইরে হয় নি । কৈশোরে স্বাদেশিকতার তাপে 'সঞ্জীবনী সভা'য় যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই তাঁর ব্রিটিশ-খেদ উবে যায় । ১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মন্ত্রি-অভিষেক প্রবন্ধে বলছেন, 'ভরসা করিয়া বলিতে পারি এমন অবিশ্বাসী এ সভায় কেহই নাই যিনি বলিবেন ভারতের উন্নতিই ভারত শাসনের মূল লক্ষ্য নহে ।' এবিষয়ে গবেষকদের সাক্ষ্য রয়েছে যে, ১৮৮৬ সাল থেকে ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরিভাবে ইংরেজের গুণমুগ্ধ ছিলেন ।২৩ এ-সময়টায় হিন্দু পুনরুত্থানবাদের প্রতি তাঁর স্পষ্ট অনীহা ছিল । রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, প্রচার ও নবজীবনে বঙ্কিমের 'ডিফেন্স অব হিন্দুইজম' প্রকাশ হলে রবীন্দ্রনাথ খুবই আহত

হয়েছিলেন ।২৪ এই কাল-পর্বেই অনুশীলনতত্ত্ব তথা হিন্দু ঐতিহ্য-প্রীতির প্রশ্নে তর্ক করতে গিয়ে তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তু মুল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন । কিন্তু উনিশ শতকের শেষ প্রহর থেকেই রবীন্দ্রনাথ ক্রমে হিন্দু জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন । ১৯০৪ সালে পিতার জন্মোৎসবে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদে আদি ব্রাহ্মসমাজের অবদান গৌরবের সঙ্গে স্মরণ করেন । এই সময়কালেই তিনি নিজের দুই কন্যার বিয়ে দেন প্রথাগত হিন্দু আচারাদি মেনে । বড়ো মেয়ে বেলার বয়স চৌদ্দ, মেজো মেয়ে রেণুকার বয়স দশ । যৌবনে রবীন্দ্রনাথ ভারতী, হিতবাদী পত্রিকায় বিয়ের বয়স নিয়ে যেসব মতামত দিয়েছিলেন নিজের মেয়েদের ক্ষেত্রে সেই মতের কোনো প্রতিফলন দেখা গেল না ।২৫ ডেভিড কফ কিন্তু আদি ব্রাহ্মসমাজের অবস্থানকে রক্ষণশীল বা ঐতিহ্য অনুরাগী বুঝতে নারাজ, তিনি ব্রাহ্মসমাজকে সাংস্কৃ তিক জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকেই বুঝতে চান । এই মতের সঙ্গে আমাদের তেমন দ্বিমত নাই । ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ সৃষ্টির পেছনে একটি বিরাট কৃ তিত্ব ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়কে দিতে হবে । উপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের বন্ধু -স্থানীয় হলেও একটা কালপর্বে তিনি গুরুতু ল্য ভূ মিকাই পালন করেছেন । এসময় রবীন্দ্রনাথের অনেক চিন্তা-চেতনার মধ্যে উপাধ্যায়ের মতের প্রতিধ্বনি শোনা যায় । আশিস নন্দী এ-সময়কার রবীন্দ্রনাথের মনোভাব বোঝাতে লিখছেন

২৬

:

আমরা ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছি রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম যৌবনের হিন্দু মেলার দিনগুলোতে উপাধ্যায়ের খারিজি সাংস্কৃ তিক ভাবাদর্শের অনেক অনুষঙ্গ গ্রহণ করেছিলেন । এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষের কল্পনায়, অন্তত একজন ভাষ্যকার এটি লক্ষ্য করেছেন, শুধুমাত্র মুসলমান আর খ্রিস্টানরাই বাদ পড়ে নি, অনেক নিচু -জাতের হিন্দুরাও বাদ পড়েছিল । ...১৯০২ সালে রবীন্দ্রনাথ খুব কর্তৃত্বের স্বরে লিখছেন, ব্রহ্মবিদ্যালয়ে হিন্দুসমাজের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো কিছুকেই গ্রহণ করা হবে না ।২৭ বিশ শতকের প্রথম কয়েক বছর রবীন্দ্রনাথের অভিব্যক্তি সরাসরি উপাধ্যায়ের চিন্তার সঙ্গে মিলে যায় । ১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন এই কথা বলেন যে, রাজত্ব নয়, আমাদের দেশের সম্পদ হল ব্রাহ্মণ্যবাদ, তখন তিনি উপাধ্যায়ের ব্যাখ্যাকেই নিজের ব্যাখ্যা বলে স্বীকৃ তি দিয়ে দেন । কয়েক বছর পর আমরা দেখব, রবীন্দ্রনাথ গোরা উপন্যাস লেখার মাধ্যমে উপাধ্যায়ের এই তীব্র আকর্ষণের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া করার চেষ্টা করছেন ।

সনাতন সমাজের কল্পনা

এসব আলোচনার পর রবীন্দ্রনাথকে তাঁর শ্রেণিচেতনা এবং ব্রাহ্মসমাজের এই গোলযোগ দিয়ে বুঝে ফেলতে লোভ জাগতে পারে । তিনি দেবেন্দ্রনাথের ছানা ছিলেন এবং গোলযোগের মধ্যে আদি ব্রাহ্মসমাজের হিন্দুয়ানির শিক্ষাই লাভ করেছেন । হিন্দুমেলা থেকে যেমন সেরকম অনুপ্রেরণাই তিনি উপাধ্যায়ের ছোহবতে পেয়েছেন । ফলে তাঁর একটি শ্রেণিগত হিন্দু পরিচয় দাঁড় করিয়ে ফেলা কঠিন নয় । রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এসব আলোচনা বিস্তর হয়েছে । এসব আলোচনাকে দুই ভাগে সহজেই নামিয়ে নেয়া চলে । একপক্ষ রবীন্দ্রনাথকে 'হিন্দু ভদ্রলোক' বলে জাহির করেন । অন্যপক্ষ তাঁকে 'সর্বভারতীয়' বলে প্রতিষ্ঠা দেন । এই দুই পথেই রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন হতে পারে । রাবণের মতো তাঁর সাহিত্যের দশখানা মুখ আছে । যেদিকে মুখ করে দাঁড়ানো যায়, সেদিকের মুখটা পরিষ্কার দেখা যায় । আমরা একটু ঘুরে ঘুরে দেখার চেষ্টা করব । আমাদের বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কথাসাহিত্যের দিকে মনোযোগ দিলে একটি অনড় কল্পনাকে সারাক্ষণই ডু বো-পাহাড়ের চূ ড়োর মতো চোখে পড়বে, সেটা হচ্ছে/: সনাতন সমাজের কল্পনা । 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধের মধ্যেও এই কল্পনাটি নাক জাগিয়ে আছে । কিন্তু ইঙ্গিত ধরে এগোলে আড়ালের গোটা পাহাড়টাই আমাদের নজরে মিলবে । সেই খোঁজের দিকেই আমাদের আলোচনা এখন এগোবে । 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ পাকা পরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে তালাশ নিয়েছেন । মজহার জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের খুঁটি হল মজহারের এই মত প্রবন্ধটি বোঝার ক্ষেত্রে দরকারি হাতল । নিত্য আক্ষরিক অর্থে আগে স্পষ্ট করে বোঝা যাক । অক্সফোর্ড ডিকশনারি নিত্যলক্ষণের সংজ্ঞা দিচ্ছে :

নিত্য লক্ষণের নিত্য লক্ষণ । লক্ষণ কথাটা অব ফিলসফি

'কোনো কিছুর নিত্যলক্ষণ ( substance ) বলতে বোঝায়/: ১. এর সারবস্তু, বা জিনিসটিকে যা সম্ভব করে তোলে । এটা নিশ্চিত করবে যেকোনো কিছুর গুণ বা উপাদানে বদল আসলেও সারবস্তু অপরিবর্তিত থাকবে । ২. যা নিজেই অস্তিত্বশীল থাকতে পারে, বা অস্তিত্বের জন্য যাকে কোনো শর্তাধীন থাকতে হয় না, যেভাবে কোনো বস্তুর গুণ শর্তাধীন থাকে । অতএব, যা গুণগুলোকে ধারণ করে । নিত্য লক্ষণ হল সারবস্তু, খোল-নলচেতে অনেক বদল আসবে, কিন্তু সারবস্তু অপরিবর্তনীয় থাকবে । এই কথাটা ভালো করে বুঝে রাখা দরকার যে, রবীন্দ্রনাথ

পরিচয়ের এই সারভাবটি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন সমাজের নাড়ি ধরতে । রবীন্দ্রনাথ নিত্য লক্ষণ বলতে যা বুঝেছেন সেটা আসলে সমাজেরই নিত্য লক্ষণ । রবীন্দ্রনাথের এই প্রবন্ধে, আমাদের অনুমান, তিনটি ধারণা প্রধান । এগুলো হল/: ক. নিত্য লক্ষণ, খ. সনাতন সমাজ, এবং গ. ধর্মের ওপর জাতির অগ্রাধিকার । এই তিনটি ধারণা মূলে একটিই ভাব-বিগ্রহ, সেটি হল ভারতীয় সমাজ । রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনের ভাবনার মধ্যে যে একটি ভাব-বিগ্রহ সব-সময় নাক জাগিয়ে ছিল সেটা হল তাঁর কল্পিত ভারতীয় সমাজ । এই সমাজকে তিনি ধর্মমতের উপরে রাখতে আগ্রহী---একথা স্পষ্ট করেই তিনি 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধে বলেছেন : জাতি জিনিসটা মতের চেয়ে অনেক বড়ো এবং অনেক অন্তরতর; মত পরিবর্তন হইলে জাতির পরিবর্তন হয় না । ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তিসম্বন্ধে কোনো একটা পৌরাণিক মতকে যখন আমি বিশ্বাস করিতাম তখনও আমি যে জাতি ছিলাম তৎসম্বন্ধে আধুনিক বৈজ্ঞানিক মত যখন বিশ্বাস করি তখনও আমি সেই জাতি । রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধটি ভালো করে বুঝতে হলে তাঁর সমাজ কল্পনার সঙ্গে জানাশোনা ঘটা জরুরি । তাঁর সারা জীবনের লেখালেখিতে এবিষয়ে অসংখ্য কথাবার্তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে । আমরা এখানে সুবিধা মতো কিছু কথা বেছে নেব । 'নববর্ষ' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এই প্রাচীন ভারতবর্ষের একটি আলুলায়িত কাব্যিক চিত্র আঁকছেন : আমরা আজ যাহাকে অবজ্ঞা করিয়া চাহিয়া দেখিতেছি না, জানিতে পারিতেছি না, ইংরেজি স্কু লের বাতায়নে বসিয়া যাহার সজ্জাহীন আভাসমাত্র চোখে পড়িতেই আমরা লাল হইয়া মুখ ফিরাইতেছি, তাহাই সনাতন বৃহৎ ভারতবর্ষ; তাহা আমাদের বাগ্মীদের বিলাতি পটহতালে সভায় সভায় নৃত্য করিয়া বেড়ায় না, তাহা আমাদের নদীতীরে রুদ্ররৌদ্রবিকীর্ণ বিস্তীর্ণ ধূসর প্রান্তরের মধ্যে কৌপীনবস্ত্র পরিয়া তৃ ণাসনে একাকী মৌন বসিয়া আছে । তাহা বলিষ্ঠ-ভীষণ, তাহা দারুণ-সহিষ্ণু , উপবাসব্রতধারী---তাহার কৃ শপঞ্জরের অভ্যন্তরে প্রাচীন তপোবনের অমৃত অশোক অভয় হোমাগ্নি এখনো জ্বলিতেছে । কারা এই সমাজ গড়ে তু লেছে? রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, এই সমাজের মধ্যে স্থান পায় নি এমন জাতি ভূ ভারতে নেই : প্রাচীন শকজাতীয় জাঠ ও রাজপুত; মিশ্রজাতীয় নেপালি, আসামি, রাজবংশি; দ্রাবিড়ী, তৈলঙ্গী, নায়ার---সকলে আপন ভাষা, বর্ণ, ধর্ম ও আচারের নানা প্রভেদ সত্ত্বেও সুবিশাল হিন্দুসমাজের মধ্যে একটি বৃহৎ সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া একত্রে বাস করিতেছে । হিন্দুসভ্যতা এত বিচিত্র লোককে আশ্রয় দিতে গিয়া নিজেকে নানাপ্রকারে বঞ্চিত

করিয়াছে, কিন্তু তবু কাহাকেও পরিত্যাগ করে নাই---উচ্চচ-নীচ, সবর্ণ-অসবর্ণ, সকলকেই ঘনিষ্ঠ করিয়া বাঁধিয়াছে, সকলকে ধর্মের আশ্রয় দিয়াছে, সকলকে কর্তব্যপথে সংযত করিয়া শৈথিল্য ও অধঃপতন হইতে টানিয়া রাখিয়াছে । নানা রূপে নানা ভূ ষণে রবীন্দ্রনাথ এই সনাতন সমাজের বন্দনা করেছেন, কল্পনার শক্তিতে প্রায় জীবন্ত ছবি করে তু লেছেন । শুধু রূপ-গরিমাই নয়, সমাজের বিশিষ্ট স্বভাবগুলোও তিনি তাঁর লেখার মধ্যে বেশ জাঁক করে বলেছেন । একটু লক্ষ্য করলেই চোখে পড়বে, এই বিশিষ্ট স্বভাবগুলোকেই তিনি আমাদের নিত্য লক্ষণ বলে জাহির করতে চান । রবীন্দ্রনাথের 'হিন্দু সমাজ'-এর এই বিশিষ্ট স্বভাবগুলো কেমন? রবীন্দ্রনাথ লিখছেন : ভারতবর্ষের চিরদিনই একমাত্র চেষ্টা দেখিতেছি, প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা, নানা পথকে একই লক্ষ্যের অভিমুখীন করিয়া দেওয়া এবং বহুর মধ্যে এককে নিঃসংশয়রূপে অন্তররূপে উপলব্ধি করা---বাহিরে যে-সকল পার্থক্য প্রতীয়মান তাহাকে নষ্ট না করিয়া তাহার ভিতরকার নিগূঢ় যোগকে অধিকার করা । এই এককে প্রত্যক্ষ করা এবং ঐক্যবিস্তারের চেষ্টা করা ভারতবর্ষের পক্ষে একান্ত স্বাভাবিক । তাহার এই স্বভাবই তাহাকে চিরদিন রাষ্ট্রগৌরবের প্রতি উদাসীন করিয়াছে; কারণ রাষ্ট্রগৌরবের মূলে বিরোধের ভাব । (রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র : ভারতবর্ষের ইতিহাস) এই বিচিত্রকে এক করতে পারার ক্ষমতাকেই ভারতীয় সমাজের সবচেয়ে খাঁটি জোর হিসেবে জেনেছেন । রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্তরের বিশ্বাস পাঠকের সামনে এইভাবে মেলে ধরছেন, নিশ্চয় জানিবেন, ভারতবর্ষের মধ্যে একটি বাঁধিয়া তু লিবার ধর্ম চিরদিন বিরাজ করিয়াছে । নানা প্রতিকূ ল ব্যাপারের মধ্যে পড়িয়াও ভারতবর্ষ বরাবর একটা ব্যবস্থা করিয়া তু লিয়াছে, তাই আজও রক্ষা পাইয়াছে । এই ভারতবর্ষের উপরে আমি বিশ্বাস স্থাপন করি । এই ভারতবর্ষ এখনই এই মুহূর্তেই ধীরে ধীরে নূতন কালের সহিত আপনার পুরাতনের আশ্চর্য একটি সামঞ্জস্য গড়িয়া তু লিতেছে । আমরা প্রত্যেকে যেন সজ্ঞানভাবে ইহাতে যোগ দিতে পারি---জড়ত্বের বশে বা বিদ্রোহের তাড়নায় প্রতিক্ষণে ইহার প্রতিকূ লতা না করি । সমাজ কী করে প্রতিকূ ল অবস্থার মধ্যে নিজেকে রক্ষা করেছে তাঁর কয়েকটি দৃষ্টান্তও তিনি পেশ করছেন এখানে । আর্যরা যখন ভারতবর্ষে ঢু কল তখন 'এখানকার আদিম অধিবাসীদের' সঙ্গে তাদের তু মুল বিরোধ হয়েছে । এই বিরোধে আর্যরা জয়ী হলেও অনার্যদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হল না । আচারবিচারের সমস্ত পার্থক্য নিয়েই তারা

'একটি সমাজতন্ত্রের মধ্যে স্থান' পেল । শুধু কি আর্যদের বেলা? না, বৌদ্ধ-প্রভাবের যুগেও এরকম একটি দুর্যোগ ঘটেছিল । বৌদ্ধধর্মের আকর্ষণে ভারতীয়দের সঙ্গে বিদেশী অনেকের সঙ্গ হয় । এসময় বিরোধের কড়া পাহারা ছিল না, ফলে 'আপনা ভু লিয়া' একাকার হয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল না । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছেন/: কিন্তু এই অতিবৃহৎ উচ্ছৃ ঙ্খলতার মধ্যেও ব্যবস্থাস্থাপনের প্রতিভা ভারতবর্ষকে ত্যাগ করিল না । যাহা-কিছু ঘরের এবং যাহা-কিছু অভ্যাগত, সমস্তকে একত্র করিয়া লইয়া পূনর্বার ভারতবর্ষ আপনার সমাজ সুবিহিত করিয়া গড়িয়া তু লিল; পূর্বাপেক্ষা আরও বিচিত্র হইয়া উঠিল । কিন্তু এই বিপুল বৈচিত্র্যের মধ্যে আপনার একটি ঐক্য সর্বত্রই সে গ্রথিত করিয়া দিয়াছে । (রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র/: স্বদেশী সমাজ) এরপর এসে পড়ল মুসলমানের সংঘাত । এই সংঘাতে হিন্দু সমাজ কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও ঠিকই সামলে নেয়, যার নমুনা তিনি দেখতে পাচ্ছেন এভাবে : 'হিন্দু ও মুসলমান-সমাজের মাঝখানে এমন একটি সংযোগস্থল সৃষ্ট হইতেছিল, যেখানে উভয় সমাজের সীমারেখা মিলিয়া আসিতেছিল; নানকপন্থী, কবীরপন্থী ও নিম্নশ্রেণির বৈষ্ণবসমাজ ইহার দৃষ্টান্তস্থল ।' এসব তো ইতিহাসের কথা । এই ঘোর কলিকালে ভারতীয় সমাজের সেই 'বাঁধিয়া তু লিবার' শক্তি কি কিছু অবশিষ্ট আছে? নিশ্চয়ই আছে । আছে বলেই তো রবীন্দ্রনাথের সমাজ নিয়ে এত বিপুল কল্পনা, সমাজের মধ্যেই জীবনের সমস্ত অবলম্বন খুঁজতে চাওয়া । এই ভারতীয় সমাজের উপর ভরসা রেখেই তিনি আমাদের অভয় দিচ্ছেন : ভারতবর্ষের এই গুণ থাকাতে কোনো সমাজকে আমাদের বিরোধী কল্পনা করিয়া আমরা ভীত হইব না । প্রত্যেক নব নব সংঘাতে আমরা আমাদের বিস্তারেরই প্রত্যাশা করিব । হিন্দু বৌদ্ধ মুসলমান খ্রিস্টান ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে পরস্পর লড়াই করিয়া মরিবে না, এইখানে তাহারা সামঞ্জস্য খুঁজিয়া পাইবে । এই সামঞ্জস্যের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যতই দেশবিদেশের হউক, তাহার প্রাণ, তাহার আত্মা ভারতবর্ষের । রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস, আমরা যে 'অধঃপতনের শেষ সীমায়' তলিয়ে যাই নি, এখনও যে লোকের মধ্যে সাধুতা আছে, আমরা সকলে যে ত্যাগ স্বীকার করছি, নিজে না খেয়ে অন্যের কথা চিন্তা করছি---এসব কিছুর পেছনের জোর আমাদের প্রাচীন সমাজ । শুধু পরিবার-পরিজনের কথাই নয়, সামাজিক প্রায় সমস্ত কর্তব্য আমাদের সমাজ নিজে নিজেই সম্পন্ন করে । শুধু 'যুদ্ধবিগ্রহ, রাজ্যরক্ষা এবং বিচারকার্য' ছাড়া আমাদের সমাজে রাজার হস্তে আর কিছুই নাই । 'বিদ্যাদান হইতে জলদান পর্যন্ত' সর্ববিধ সামাজিক দাবি-

দাওয়া এই সমাজ নিজেই এমন সুচারুভাবে পালন করে আসছে যে 'নব নব রাজার রাজত্ব' বন্যার মতো আমাদের উপর দিয়ে বয়ে গেলেও আমাদের ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু হয় না । এসব কারণে রবীন্দ্রনাথ মনে করছেন, 'এ কথা আমাদিগকে বুঝিতে হইবে, আমাদের দেশে সমাজ সকলের বড়ো । অন্য দেশে নেশন নানা বিপ্লবের মধ্যে আত্মরক্ষা করিয়া জয়ী হইয়াছে---আমাদের দেশে তদপেক্ষা দীর্ঘকাল সমাজ নিজেকে সকলপ্রকার সংকটের মধ্যে রক্ষা করিয়াছে ।' ইউরোপের সঙ্গে ভারতের তফাত দেখাতে তিনি বলছেন, 'বিলাতে রাজশক্তি যদি বিপর্যস্ত হয়, তবে সমস্ত দেশের বিনাশ উপস্থিত হয় । এইজন্যই য়ুরোপে পলিটিক্স এত অধিক গুরুতর ব্যাপার । আমাদের দেশে সমাজ যদি পঙ্গু হয়, তবে যথার্থভাবে দেশের সংকটাবস্থা উপস্থিত হয় ।' এসব আলোচনা থেকে হঠাৎ সন্দেহ জন্মাতে পারে, রবীন্দ্রনাথ হয়তো ভারতীয় সমাজের অজুহাতে সমাজটাকে সংকীর্ণ অর্থে হিন্দুর সমাজ বানিয়ে তু লতে চান, হিন্দুর প্রথাই যেখানে আইন । পাছে এরকম কোনো ভু ল বোঝাবুঝি হয় তিনি তাই স্পষ্ট করে বলছেন, ভারতবর্ষেও যে ইতিহাস গঠিত হইয়া উঠিতেছে এ ইতিহাসের শেষ তাৎপর্য এ নয় যে, এ দেশে হিন্দুই বড়ো হইবে বা আর-কেহ বড়ো হইবে । ভারতবর্ষে মানবের ইতিহাস একটি বিশেষ সার্থকতার মূর্তি পরিগ্রহ করিবে, পরিপূর্ণতাকে একটি অপূর্ব আকার দান করিয়া তাহাকে সমস্ত মানবের সামগ্রী করিয়া তু লিবে---ইহা অপেক্ষা কোনো ক্ষু দ্র অভিপ্রায় ভারতবর্ষের ইতিহাসে নাই । এই পরিপূর্ণতার প্রতিমাগঠনে হিন্দু মুসলমান বা ইংরেজ যদি নিজের বর্তমান বিশেষ আকারটিকে একেবারে বিলুপ্ত করিয়া দেয়, তাহাতে স্বজাতিক অভিমানের অপমৃত্যু ঘটিতে পারে কিন্তু সত্যের বা মঙ্গলের অপচয় হয় না । (রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র : পূর্ব ও পশ্চিম) না হয় সমাজের ঐতিহাসিক গতিবিধি জানা গেল । এখন কর্তব্য কী? রবীন্দ্রনাথের মতে, আমাদের সবাইকে এই কথা উপলব্ধি করতে হবে যে আমরা সবাই বৃহৎ ভারতবর্ষের উপকরণ মাত্র । এখন উপকরণ যদি বিদ্রোহ করে, তাকে সবার উপরে স্থান দিতে হবে, নইলে সে গোস্বা হবে, তবে যে সনাতন সমাজের কল্পনা তিনি করছেন সেটা ব্যর্থ হবে । 'যে খণ্ড সামগ্রী কোনোমতেই মিশ খাইবে না, যে বলিবে আমিই টিকিতে চাই, সে একদিন বাদ পড়িয়া যাইবে ।' এখানে খুব ভালোভাবে খেয়াল করা দরকার । রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সনাতন সমাজকেই সবার উপরে রাখছেন । সমাজ বাঁচাতে যেমন দরকার সেভাবে হিন্দু-মুসলমান

বাঁকিয়ে-চু রিয়ে নিজেদের জুড়ে নেবে---এই তার মনোবাসনা । কে তলে পড়ল, কে উপরে এসব নিয়ে তাঁর মাথা-ব্যথা তেমন নাই ।

তৃ তীয় পর্ব : রবীন্দ্রনাথের টানাপোড়েন ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রবীন্দ্রনাথের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর । বঙ্গভঙ্গের সময় গড়ে ওঠা স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে তিনি খুবই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং এই আন্দোলনের মধ্যেই নিজের কিছু প্রধান ফয়সালা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নতু ন করে ভাবতে শুরু করেন । 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধটিকে বিশেষ করে এই স্বদেশি আমলের উপলব্ধির প্রেক্ষাপট থেকে বোঝার চেষ্টা অর্থপূর্ণ হবে । রবীন্দ্রনাথ বহুকাল ধরে একটি স্বদেশি সমাজের কল্পনা তৈয়ার করেছিলেন । কিন্তু কালক্রমে তিনি বুঝতে পারলেন, সেই ভারতীয় সমাজ গড়ে তু লবার কিছু বাস্তবিক অসুবিধা আছে । এই অসুবিধাগুলো কী করে দূর করা যাবে সেটা নিয়ে তিনি বিস্তর ভেবেছেন । 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধটি এক দিক থেকে দেখলে এরকম কিছু অসুবিধা পেরিয়ে যাবার দাওয়াই । এসব উপলব্ধি তাঁর ঘটছে মূলত স্বদেশি আন্দোলনে এসে---যখন তিনি ভারতবর্ষের আম-মানুষের একেবারে মাঝখানে এসে পড়েছেন । রবীন্দ্রনাথ প্রথম যে বড়ো ধরনের অসুবিধা খেয়াল করলেন সেটা ভারতীয় নানা সম্প্রদায়ের মধ্যকার অনৈক্য । অনৈক্যের কারণ কী সে প্রসঙ্গে তাঁর নানারকম ব্যাখ্যা আছে । কিন্তু এই বিভেদের গোড়ার কারণ হিসাবে তিনি যাকে অভিযুক্ত করছেন সেটা বেশ চমকে যাবার মতো ব্যাপার । রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ধর্ম আমাদের মেলাতে পারে নি, বরঞ্চ হাজারখানা বেড়া গড়ে তু লে সেই বাধাগুলোকে ইতিহাসের অতীত শাশ্বত বলে পাকা করে দিয়েছে । ইংরেজ নিজের জাতকে ইংরেজ বলেই পরিচয় দেয় । যদি বলত খ্রিস্টান তা হলে যে ইংরেজ বৌদ্ধ বা মুসলমান বা নাস্তিক তাকে নিয়ে রাষ্ট্রগঠনে মাথা ঠোকাঠু কি বেধে যেত । আমাদের প্রধান পরিচয় হিন্দু বা মুসলমান । (রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র : লোকহিত, সংযোজন) রবীন্দ্রনাথের এই পাঠ আশ্চর্যজনক । তিনি বিশেষ করে নেশনের ধারণার বিরোধী ছিলেন । কিন্তু এখানে তিনি যাকে সমস্যা বলছেন সেটা প্রায় নেশন-স্টেট নিজেকে চিনতে না শেখারই সমস্যা । এখানে রবীন্দ্রনাথের মনের ভাবটা তাঁর 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধেরই সহগামী । হিন্দু মুসলমান এরকম ভিন্ন ভিন্ন নামে না ডেকে সকলেরই যদি নাম হত ভারতীয়, ইংরেজের বেলায় যেমন হয়েছে, তবে অনেক দ্বন্দ্বের মীমাংসা হতে পারত ।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথই তো বলেছেন, বৈচিত্র্যের মধ্যে একত্ব খুঁজে নেবার এক 'সহজাত শক্তি' হিন্দু সমাজের আছে । তাহলে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীস্টান---এরকম আলাদা আলাদা নাম থাকলে অসুবিধা কি? এই অসুবিধাটা তিনি কিন্তু অনেকদিন থেকেই বোধ করেছিলেন : আমি যখন আমার জমিদারি সেরেস্তায় প্রথম প্রবেশ করলেম তখন একদিন দেখি, আমার নায়েব তাঁর বৈঠকখানায় এক জায়গায় জাজিম খানিকটা তু লে রেখে দিয়েছেন । যখন জিজ্ঞেস করলেম, 'এ কেন' তখন জবাব পেলেম, যে-সব সম্মানী মুসলমান প্রজা বৈঠকখানায় প্রবেশের অধিকার পায় তাদের জন্য ঐ ব্যবস্থা । এক তক্তপোষে বসাতেও হবে অথচ বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা পৃথক । এ প্রথা তো অনেক দিন ধরে চলে এসেছে, অনেকদিন মুসলমান এ মেনে এসেছে, হিন্দুও মেনে এসেছে । জাজিম-তোলা আসনে মুসলমান বসেছে, জাজিম-পাতা আসনে অন্যে বসেছে । (রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র : স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, সংযোজন) তাহলে হিন্দু সমাজের মধ্যে একটি পাপ ভেতরে-ভেতরে অনেক বড়ো হয়ে উঠেছে । হিন্দু সম্প্রদায়ের জাত্যভিমানী বাবুরা মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকদের মানুষ বলে খাতির করে না । এই ঘটনাটা রবীন্দ্রনাথের মনে এত পোক্ত আসন পেয়েছে যে লোকহিত প্রবন্ধের সংযোজন অংশে এই কাহিনিটি তিনি আরেকবার বলেছেন । এই অনৈক্যকে ঘিরে তাঁর মধ্যে যেসব দুশ্চিন্তা ঘোরালো হয়ে উঠছিল সেটাই একটি স্পষ্ট রূপ পরিগ্রহ করল স্বদেশি আন্দোলনের মাধ্যমে ।

স্বদেশি-যুগ কয়েক বছর ধরেই বাংলা প্রদেশ দুই ভাগে যুদা করে দেবার কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল । গোড়া থেকেই বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় তীব্রভাবে এর বিরোধিতা করছিল । বিশেষ করে বঙ্গমাতার একটি আইডিয়া বাংলার সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই আসন পেয়ে গিয়েছিল । ফলে বঙ্গভঙ্গ একটি বিশেষ আবেগের তন্ত্রীতে গোড়া থেকেই টান দিচ্ছিল । বঙ্গভঙ্গের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতায় একটি সভা আহ্বান হয় । এই সভায় ব্রিটিশ পণ্য বয়কট করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । অনেকে এই দিনটিকেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সূচনা বলে মনে করে থাকেন । প্রবল বেগে আন্দোলন শুরু হয়ে যায় । এই আন্দোলনের সঙ্গে শুরু থেকেই যুক্ত হয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র । প্রবল বাধা অগ্রাহ্য করে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয় । ফলে বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজ ফুঁসে ওঠে । জোয়ারের মতো আন্দোলনের চৌহদ্দি ছড়িয়ে

পড়তে থাকে । রবীন্দ্রনাথও তাঁর নেশারু স্বভাব মতো এই আন্দোলনে সেঁধিয়ে যান । তিনি স্বদেশি আন্দোলন উপলক্ষ্যে দেশপ্রেমের অনেক গান রচনা করেন, যা আন্দোলনকে প্রেরণা জোগায় । বঙ্গভঙ্গ দিবস পালন করতে রবীন্দ্রনাথ ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী কল্পনাসমৃদ্ধ অবদান রাখেন । তাঁদের কল্পনা অনুসারেই রাখীবন্ধন ও অরন্ধন পালন করা হয় । বঙ্গভঙ্গ দিবসে ভাতৃ ত্বের প্রতীক হিসেবে বিনিময় করা হল নানা রঙের রাখী, আর বিষাদের চিহ্ন হিসেবে উনুনে আগুন দেয়া হল না ।২৮ এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ব্রাহ্মসমাজ গোছানোর কাজ থেকে সরে এসে পুরোপুরি স্বদেশি আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন । ১৯০৫ থেকে ১৯০৮-এর মধ্যে বাংলার রাজনৈতিক জীবনে, সুপ্রতিষ্ঠিত নরমপন্থী ঐতিহ্য ছাড়াও তিনটি প্রধান ধারাকে তত্ত্বগত স্তরে আলাদা করা যায় । এর মধ্যে প্রথমটিকে বলা যায় 'গঠনমূলক স্বদেশী'---নিষ্ফল ও আত্ম-অবমাননাকর 'ভিক্ষাবৃত্তি'র রাজনীতি বর্জন করে, স্বদেশি শিল্প, জাতীয় শিক্ষা আর গ্রামোন্নয়ন ও সংগঠনের মাধ্যমে আত্মসহায়তা । এটি প্রকাশ পেয়েছিল প্রফু ল্লচন্দ্র রায় ও নীলরতন সরকারের ব্যবসায়িক উদ্যোগে, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের পত্রিকা ডন ও ডন সোসাইটিতে (জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে যা অঙ্কু রের ভূ মিকা নেয়), আর সবার ওপরে, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ।২৯ 'স্বদেশী সমাজ' ভাষণে (১৯০৪) চিরায়ত হিন্দু 'সমাজ' বা জনসম্প্রদায়ের পুনরভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে গ্রামে গঠনমূলক কাজকর্মের একটা নকশা তিনি ইতিমধ্যে ছক করে ফেলেছিলেন । রবীন্দ্রনাথ যাকে আত্মশক্তি বলেছিলেন তার ওই ধীর ও অনাড়ম্বর বিকাশের প্রেক্ষিত বাঙলার উত্তেজিত শিক্ষিত যুবকদের মনে তেমন কোনো সাড়া জাগায় নি । তাঁরা অনেক বেশি আকৃ ষ্ট হচ্ছিলেন অধিকতর রাজনৈতিক চরমপন্থী প্রত্যয়ের দিকে । বিপিনচন্দ্র পালের নিউ ইন্ডিয়া, অরবিন্দ ঘোষের বন্দে মাতরম, ব্রহ্মবন্ধব উপাধ্যায়ের সন্ধ্যা ও যুগান্তর-এর মতো পত্র-পত্রিকা স্বরাজের জন্য সংগ্রামের ডাক দিচ্ছিল ।৩০ রবীন্দ্রনাথ এসময়ে লক্ষণীয়ভাবে একেবারে ভিন্নপথ ঠিক করেছেন । স্বদেশি আন্দোলনের সেই উত্তু ঙ্গ মুহূর্তগুলোতে তিনি আত্মশক্তি জাগানোর কথা বলছেন । হঠাৎ কোনো আলাউদ্দিনের চেরাগ তো পাওয়া যায় নাই যে দুদিনেই ভারতের সকল সমস্যার মীমাংসা হয়ে যাবে । রবীন্দ্রনাথ তাই ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করছেন । আত্মশক্তি জাগ্রত করার দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন পথ বাৎলাচ্ছেন । ইংরেজের কাছে ধরনা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি । ভিক্ষার ঝু লি হাতে জেহাদি জজবায় হাঁক দিয়ে বেড়ালে সমাজের চার-আনা পয়সার লাভ নেই

তিনি সেটা বিলক্ষণ জানতেন । স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ইরেজের দরবারে হত্যা দিয়ে থাকার বিকল্প রাস্তা বলে দিচ্ছেন তিনি : অথচ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আমাদের ঘরের কাছে পড়িয়া আছে---কেহ তাহা কাড়ে নাই, এবং কোনোদিন কাড়িতে পারেও না । আমাদের গ্রামের, আমাদের পল্লীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য আমরা নিজে করিতে পারি---যদি ইচ্ছা করি, যদি এক হই, এজন্য গবর্মেন্টের চাপরাস বুকে বাধিবার কোনো দরকার নাই । (রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র : আত্মশক্তি) পাবনা প্রাদেশিক সম্মিলনীর 'সভাপতির অভিভাষণ'-এ তিনি তাঁর মনের ভেতরের ছবিটি বেশ ফরসা করে বলছেন, দেশের শিল্পবাণিজ্যকে স্বাধীন করিয়া নিজের শক্তি অনুভব করিব, দেশের বিদ্যাশক্তিকে স্বায়ত্ত করিব, সমাজকে দেশের কর্তব্যসাধনের উপযোগী বলিষ্ঠ করিয়া তু লিব---ইহা করিতে গেলে ঘরে পরে দুঃখ ও বাধার অবধি থাকিবে না---সেজন্য অপরাজিত চিত্তে প্রস্তুত হইব; কিন্তু বিরোধকে বিলাসের সামগ্রী করিয়া তু লিব না । দেশের কাজ নেশার কাজ নহে; তাহা সংযমীর দ্বারা যোগীর দ্বারাই সাধ্য । স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান যদি খেয়াল করি তাহলে তাঁকে একটেরে-ভাবে বুঝতে চাওয়া কঠিন । স্বদেশি আন্দোলন যখন তু ঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তখন বলছেন, এখনও স্বরাজের সময় আসে নি । একটু ভাবলেই বোঝা যায়, তাঁর এসব কথা সেই টগবগে স্বদেশি আন্দোলনের মুহূর্তে কেমন বিসদৃশ লাগছিল : এ কথা বলাই বাহুল্য, যে দেশে একটি মহাজাতি বাঁধিয়া ওঠে নাই সে দেশে স্বাধীনতা হইতেই পারে না কারণ স্বাধীনতার 'স্ব' জিনিসটা কোথায়? স্বাধীনতা, কাহার স্বাধীনতা? ...পরের সঙ্গে যুদ্ধঘোষণা যেমনি করিয়াছি অমনি ঘরের মধ্যে এমন একটা গোল বাধিল যে, এমনতরো আর কখনো দেখা যায় নাই । হিন্দুতে মুসলমানে বিরোধ হঠাৎ অত্যন্ত মর্মান্তিকরূপে বীভৎস হইয়া উঠিল । ...ইংরেজ চলিয়া গেলেই আমাদের এই ছিদ্র পূরণ হইবে, আমরা এ কল্পনা কেন করিতেছি । (রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র : সমস্যা) তাই দেশের তরুণ সমাজকে ডেকে ডেকে তিনি বলছেন, হে স্বদেশনায়কগণ, এই পবিত্র সিংহাসনকে [ স্বদেশের মঙ্গল সাধনার কর্তৃত্বসিংহাসন] ব্যর্থ করিয়ো না, ইহাকে পূর্ণ করো । রাজার শাসন অস্বীকার করিবার কোনো প্রয়োজন নাই---তাহা কখনো শুভ কখনো অশুভ, কখনো সুখের কখনো অসুখের আকারে আমাদের উপর দিয়া প্রবাহিত হইয়া যাইবে কিন্তু আমাদের নিজের প্রতি নিজের যে শাসন তাহাই গভীর । তাহাই সত্য, তাহাই চিরস্থায়ী, সেই শাসনেই জাতি যথার্থ

ভাঙে-গড়ে, বাহিরের শাসনে নহে, সেই শাসন অদ্য আমরা শান্তসমাহিত পবিত্র চিত্তে গ্রহণ করিব । (রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র : সমূহ) ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল ভারতবর্ষে রক্ত হিম করে দেবার মতো একটি ঘটল । ক্ষু দিরাম এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের গুপ্ত হামলায় কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা খুন হলেন । হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হল । চাপা আনন্দের পাশাপাশি সহিংসতার বিরুদ্ধেও প্রচু র মত আসছিল । রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনায় খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন । ২৫ মে তিনি চৈতন্য লাইব্রেরিতে প্রবন্ধ পড়লেন 'পথ ও পাথেয়' । সাফ জানিয়ে দিলেন, গুপ্তহত্যার নীতি তিনি সমর্থন করেন না । রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে বলছেন/: কিন্তু যখন দেখা যায়, কোনো-একটা বিশেষ ঘটনামূলক উত্তেজনার তাড়নায়, একটা সাময়িক বিরোধের ক্ষু ব্ধতায় দেশের অনেক লোক সহসা দেশের হিত করিতে হইবে বলিয়া এক মুহূর্তে উর্ধ্বশ্বাসে ধাবিত হয়---নিশ্চয় বুঝিতে হইবে, হৃদয়াবেগকে একমাত্র সম্বল করিয়া তাহারা দুর্গম পথে বাহির হইয়া পড়িয়াছে । তাহারা দেশের সুদূর ও সুবিস্তীর্ণ মঙ্গলকে শান্তভাবে সত্যভাবে বিচার করিতে অবস্থাগতিকেই অক্ষম । তাহারা তাহাদের উপস্থিত বেদনাকেই এত তীব্রভাবে অনুভব করে এবং তাহারই প্রতিকার চেষ্টাকে এত উগ্রভাবে মনে রাখে যে আত্মসংবরণে অক্ষম হইয়া দেশের সমগ্র হিতকে আঘাত করা তাহাদের পক্ষে অসম্ভব হয় না ।৩১ কথাটিকে যুগপৎ রবীন্দ্রনাথের শ্রেণিচেতনা এবং সমাজ-কল্পনা নিয়ে বুঝতে হবে । রবীন্দ্রনাথ এতকাল ধরে যে সমাজের ছবি আঁকছেন সেই সমাজ সামান্য গোলাগুলিতেই মুক্ত হবে না । রবীন্দ্রনাথের মত হল 'উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে' কায়দায় স্বরাজ চেয়ে বসলে ফায়দা হবে না । রবীন্দ্রনাথের এই চেঁচামেচি সত্যিই তখন কারও কানে ঢোকে নি । সবাই একে কবির কল্পনা-বিলাস বলেই দেখেছেন । কিন্তু এই ডামাডোলের মধ্যে নিজের 'ভারতীয় সমাজে'র কল্পনার প্রতিমা বিসর্জনে তিনি মনে সায় পান নাই । যাকে সত্য বলে জেনেছেন, তাকেই সকলের বাধার মুখে দাঁড়িয়ে বারবার করে বলে গেছেন । রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে হলে তাঁর এসব খ্যাপাটে মনোভঙ্গিগুলোও মনে রাখা দরকার । এই বিরোধিতার মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল---রবীন্দ্রনাথের শ্রেণিচেতনা । সমাজের উচ্চচবর্গের সদস্য হিসেবে তিনি কখনো সহিংসতাকে সমর্থন করতে পারেন নাই । আরও পরে আমরা দেখব যে, দাঙ্গার সহিংসতা তাঁর মধ্যে গভীর আঁচড় দিয়ে যাচ্ছে ।

হিন্দু না, ওরা মুসলিম ঠ

স্বদেশি আন্দোলনের সময় তিনি সমাজ গঠনের আরও কিছু সমস্যা খুব ফরসা করে দেখতে পেয়েছিলেন । প্রাথমিকভাবে কিছুটা বিস্মিত হলেও ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারলেন কেন এই আন্দোলন মুসলমানদের তেমন করে কাছে টানতে পারে নি । এজন্য তিনি মুসলমানদের ততো দোষ দেখতে পেলেন যতোটা তিনি পেলেন সমাজের বিদ্যমান বৈষম্য ও অপমানমূলক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে । রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, বঙ্গবিচ্ছেদ-ব্যাপারটা আমাদের অন্নবস্ত্রে হাত দেয় নাই, আমাদের হৃদয়ে আঘাত করিয়াছিল । সেই হৃদয়টা যতদূর পর্যন্ত অখণ্ড ততদূর পর্যন্ত তাহার বেদনা অপরিচ্ছন্ন ছিল । বাংলার মুসলমান যে এই বেদনায় আমাদের সঙ্গে এক হয় নাই তাহার কারণ তাহাদের সঙ্গে আমাদের কোনোদিন হৃদয়কে এক হইতে দেই নাই । (রবীন্দ্রনাথ : লোকহিত) এই সময়ের কিছু ঘটনা তাঁর মনে গভীর দাগ টেনে যায়, বিশেষত হিন্দু-মুসলমান সমস্যাটিকে তিনি উপলব্ধি করতে পারেন । রবীন্দ্রনাথ একটি ঘটনার বর্ণনা করছেন এভাবে : হিন্দুমুসলমানের পার্থক্যটাকে আমাদের সমাজে আমরা এতই কু শ্রীভাবে বেআব্রু করিয়া রাখিয়াছি যে, কিছুকাল পূর্বে স্বদেশী অভিযানের দিনে একজন হিন্দু স্বদেশীপ্রচারক এক গ্লাস জল খাইবেন বলিয়া তাঁহার মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া হইতে নামিয়া যাইতে বলিতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করেন নাই । কাজের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার বশে মানুষ মানুষকে ঠেলিয়া রাখে, অপমানও করে---তাহাতে বিশেষ ক্ষতি হয় না । কু স্তির সময় কু স্তিগিরদের গায়ে পরস্পরের পা ঠেকে তাহার হিসাব কেহ জমাইয়া রাখে না, কিন্তু সামাজিকতার স্থলে কথায় কথায় কাহারও গায়ে পা ঠেকাইতে থাকিলে তাহা ভোলা শক্ত হয় । (রবীন্দ্রনাথ : লোকহিত) এখানে রবীন্দ্রনাথের কিছু সীমাবদ্ধতার দিক আমাদের বুঝে নেবার সুযোগ হয়েছে । ইউরোপিয় রেনেসাঁস থেকে মানুষের মুক্তি, সমতা, স্বাধীনতা---এরকম অনেক ধারণা তিনি আমল করেছিলেন । এগুলোর জন্য ইউরোপিয় সভ্যতার প্রতি তাঁর ভক্তির সীমা ছিল না । সমাজে হিন্দু এবং মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বৈষম্যের ব্যবধান থাকা উচিত না সেটা তিনি খুব করে বলতেন । কিন্তু তাঁর মেজাজটা সবসময় এর সঙ্গে তাল রেখে চলত না । রবীন্দ্রনাথের এই উদ্ধৃ তিটি একবার পড়া যাক : আমার অধিকাংশ প্রজাই মুসলমান । কোরবানি নিয়ে দেশে যখন একটা উত্তেজনা প্রবল তখন হিন্দু প্রজারা আমাদের এলাকায় সেটা সম্পূর্ণ রহিত করবার জন্য আমার কাছে নালিশ করেছিল । সে নালিশ আমি সংগত বলে মনে করি নি, কিন্তু মুসলমান

প্রজাদের ডেকে যখন বলে দিলুম কাজটা যেন এমনভাবে সম্পন্ন করা হয় যাতে হিন্দুদের মনে অকারণে আঘাত না লাগে তারা তখনই তা মেনে নিল । আমাদের সেখানে এ পর্যন্ত কোনো উপদ্রব ঘটে নি । আমার বিশ্বাস তার প্রধান কারণ, আমার সঙ্গে আমার মুসলমান প্রজার সম্বন্ধ সহজ ও বাধাহীন । (রবীন্দ্রনাথ : লোকহিত, সংযোজন) এখানে মানুষের সমতার বড়ো বড়ো কথাগুলো তাঁর মাথাতেই নেই । সামন্তীয় ভাবাদর্শের একেবারে কোলের ভেতর থেকে তিনি উঁকি মেরে প্রজাদের 'আঁখি মঞ্জিয়া' দেখছেন । এতেই তাঁর তৃ প্তি অশেষ যে, মনিব হিসেবে তিনি বেশ দিলখোলা, আর তাতে করে প্রজারাও হুজ্জত থেকে রক্ষা পাচ্ছে । এই মেজাজের ফেরেই মুসলমান প্রজার কোরবানির অধিকার তিনি নির্বিকারভাবে প্রজার সঙ্গে তাঁর 'সহজ ও বাধাহীন' সম্বন্ধের শর্তের অধীনস্থ করে ফেলেন । রবীন্দ্রনাথ সমাজ কল্পনার ব্যাপারে যেমন খুব সংবেদনশীল ছিলেন তেমনি এই সমাজের অসুবিধার দিকগুলোও সঠিকভাবে দাগিয়ে নিতে পেরেছেন । কিন্তু তবুও নিজেকে পুরোপুরি মুক্তির বশে আনতে পারেন নি । একটি প্রবন্ধে তিনি হিন্দুসমাজের ভালো-মন্দ অনেক দামি দামি কথা বলার পর শেষ করছেন এইভাবে/: আমি নিশ্চয় জানি, ভারতবর্ষের সুগম্ভীর আহ্বান প্রতি মুহূর্তে আমাদের বক্ষঃকু হরে ধ্বনিত হইয়া উঠিতেছে; এবং আমরা নিজের অলক্ষ্যে শনৈঃ শনৈঃ সেই ভারতবর্ষের দিকেই চলিয়াছি । আজ যেখানে পথটি আমাদের মঙ্গল-দীপোজ্জ্বল গৃহের দিকে চলিয়া গিয়াছে, সেইখানে আমাদের গৃহযাত্রারম্ভের অভিমুখে দাঁড়াইয়া 'একবার তোরা মা বলিয়া ডাক!' (রবীন্দ্রনাথ : স্বদেশী সমাজ) কিংবা পড়া যাক তাঁর 'অবস্থা ও ব্যবস্থা' প্রবন্ধের এই অংশটি : যিনি জাতি নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টানকে এক মহাযজ্ঞে আহ্বান করিয়া পাশে পাশে বসাইয়া সকলেরই অন্নের থালায় স্বহস্তে পরিবেশন করিয়া আসিতেছেন, দেশের অন্তর্যামী সেই দেবতাকে, আমাদের সেই চিরন্তন অধিপতিকে এখনো আমরা সহজে প্রত্যক্ষ করিতে পারি নাই । রবীন্দ্রনাথ স্বপ্ন দেখছেন সম্প্রদায়ের ছোঁয়াচ বাঁচানো এক সর্বভারতীয় সমাজের, কিন্তু সেখানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর হিন্দুয়ানির খোল-নলচে ছাপাতে পারছেন না । তাই যিনি হিন্দু মুসলিম সবার থালায় স্বহস্তে অন্ন তু লে দেবেন তিনি হন 'অন্তর্যামী সেই দেবতা', আর যেখানে আমাদের সবার মিলিত পথ 'মঙ্গল-দীপোজ্জ্বল গৃহের দিকে চলিয়া গিয়াছে' সেখানে রবীন্দ্রনাথের অনুরোধ হচ্ছে 'একবার তোরা মা বলিয়া ডাক'!

'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের 'টলে-পড়া'র মুহূর্তগুলো বুঝতে এই দিকটা বেশ কাজে আসবে । তিনি হিন্দু সমাজের একটা যুতসই ন্যারেশন তৈরির চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু খোল-নলচেতে এসে তাঁর ধুতির খুঁট আটকে যাচ্ছিল প্রায়ই---এখানে যেমন হচ্ছে । আসলে এই সমস্যাটাই 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধটিকে দুর্বোধ্য করে তু লেছে । কেন সেটা বলছি । রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ পড়ার পর এই সন্দেহ কোনো মতেই থাকে না যে, তিনি হিন্দু বলতে ব্যাপক অর্থে ভারতীয় বুঝিয়েছেন, হিন্দু সম্প্রদায় বোঝেন নি । সেভাবেই হিন্দুসমাজ কথার অর্থ হবে ভারতীয় সমাজ । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে একবারও স্পষ্ট করে সেটা বলেন নি । রবীন্দ্রনাথ পাগলের মতো এমন একটি নতু ন সংজ্ঞা খুঁজে মরছিলেন যা হিন্দুমুসলমানের অলঙ্ঘনীয় দূরত্ব ঘুচিয়ে দেবে । স্বদেশি আন্দোলন থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা না মিটলে কিছুতেই ভারতীয় সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না । এই সচেতনতা থেকেই তিনি হিন্দু কথাটার এমন একটি বিস্মৃত রূপ খুঁজছিলেন যা সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে বুজিয়ে ফেলতে পারবে । কাজেই তিনি হিন্দু কথাটা নিলেন ব্যাপক অর্থে ভারতীয় সমাজের যে কাউকে বোঝাতে । কিন্তু তিনি এই শব্দটাকে পরিত্যাগ করতে পারলেন না । কেন পারলেন না, তার উত্তর বোধ হয় কিছুটা রবীন্দ্রনাথের বেড়ে উঠবার ইতিহাসের মধ্যে আমরা ঠাওর করতে পারি । এটু কু এখানে বলা দরকার, 'ভারতীয়' কথাটি স্পষ্ট করে না বলে রবীন্দ্রনাথ একটি সমস্যা উজিয়ে রেখেছেন, যার সমাধান আজ অবধি হয় নি । তার প্রমাণ, রবীন্দ্রনাথের এরকম কিছু খোল-নলচের সূত্র ধরেই রবীন্দ্র গুপ্ত ছদ্মনামে ভবানী সেন তাঁকে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী বলে অভিযুক্ত করেছিলেন । তার অনেককাল পরে উঠে আসা মজহারের সমালোচনার মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের ওই ভু লের কিছুটা ফল ফলল । স্পষ্ট করে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে ভারতীয় মানলে মজহারের পক্ষে এ প্রবন্ধ লেখা সম্ভব হত না । আরেকটি গুরুতর ব্যাপার হল, হিন্দু-মুসলিম বৈষম্য রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে নড়িয়ে দিয়েছে তেমন করে শূদ্র ও বামুনের সম্পর্ক তাঁকে উদ্বেল করতে পারে নি । কেন পারে নি সেটাও খুব ভাবার মতো প্রশ্ন । রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে অনেকেই মতামত ব্যক্ত করেছেন । এরকম ভাবার অনেক কারণ যে নেই তা নয়, বরং উপলক্ষ্য ভালোই মিলবে । অন্তত ১৯০৫ সাল পর্যন্ত তাঁর হিন্দু ভদ্রলোকী মনোভাব কড়াকড়ি রকমের ছিল, হিন্দু-ভারতের বাইরের বিরাট ভারতবর্ষ তাঁর চোখে পড়ছিল না । কিন্তু সারা জীবন ধরেই

তাঁর ভদ্রলোকী মনোভাব ও নিম্নবর্গের মনোভঙ্গী ও প্রতিরোধ বুঝতে পারার অক্ষমতা স্পষ্ট করেই দেখা যাবে । শক্তিপূজার প্রতি অন্যায় দৃষ্টিভঙ্গি কালান্তরের প্রবন্ধে, ওলা-ওঠা দেবী নিয়ে রবীন্দ্রনাথের তামাশা; লোকসাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসা সত্ত্বেও এসব লৌকিক বিশ্বাসের সারকথাটা তিনি একেবারেই বুঝতে পারেন নি । 'রাজা ও প্রজা' প্রবন্ধে পাওয়া যাচ্ছে, ইতরশ্রেণির মুসলমানরা লাঠি হাতে ইংরেজদের আক্রমণ করে খুব মার খায় । কেন-ই বা তারা এরকম শিশুর মতো আক্রমণ করে, কেনই-বা তারা পড়ে পড়ে মার খায়---রবীন্দ্রনাথ তার বিন্দু-বিসর্গও বোঝেন না । সংবাদপত্র পড়েও এই নির্বোধগুলোর হাব-ভাব কিছু টের হয় না তাঁর! রবীন্দ্রনাথ তাই বিস্ময়ে অভিভূ ত । তাঁর এই বিস্ময় নিম্নবর্গের বিশ্বাসের জগৎ এবং প্রতিরোধের চেতনা সম্পর্কে পূর্ণ অবজ্ঞার ফল । এরকম উদাহরণ এন্তার মিলবে তাঁর লেখায় ।৩২ কিছু খুচরো হেলে পড়ার ঘটনা ছাড়া রবীন্দ্রনাথ চিরকাল জাতিভেদ প্রথার সপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন । হিন্দুসমাজের বিচিত্রের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার একটি অসামান্য আইডিয়া হিসেবেই তিনি জাতিভেদ প্রথাকে ব্যাখ্যা করেছেন । রবীন্দ্রনাথ কি হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের যোঝাযুঝির সম্ভাবনা ছিল বলেই সমস্যাটাকে অতো চারিয়ে দেখেছেন? আর শূদ্রের অত জোর নেই বলেই শূদ্রের অপমান অতটা মাথায় তোলেন নি? স্বদেশি আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে তোলপাড় চলছিল তার প্রধান তিনটি দিক আমরা শনাক্ত করতে পারি । (১) তিনি স্বদেশি সমাজ গঠনের প্রধান বিঘ্ন হিসেবে সাম্প্রদায়িকতাকে শনাক্ত করেছেন । (২) তিনি সহিংস ও সন্ত্রাসবাদী স্বদেশি আন্দোলনের কড়া সমালোচনা করেছেন । (৩) হিন্দু-মুসলমান সমস্যাটিকে তিনি যেমন জোরালো করে ভেবেছেন ব্রাহ্মণ-শূদ্রের যন্ত্রণাকে তিনি সেভাবে উপলব্ধি করতে পারেন নি । রবীন্দ্রনাথের চোরাটানের খুব গভীর এক সত্যের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এখানে । মানুষ হিসেবে সকল বাধা ডিঙিয়ে এক পারস্পরিক মমতার সম্পর্কের মধ্যে তিনি বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছেন, গোটা ভারতবাসীকেও সেই স্বপ্ন দেখাচ্ছেন । অন্যদিকে শ্রেণিচেতনার যে শিক্ষা তিনি পেয়েছেন, সেটার উর্ধ্বে সবসময় তিনি উঠতে পারেন নি, এ-ব্যাপারে তাঁর অক্ষমতা প্রায়ই চাগার দিয়ে উঠেছে । তাঁর লেখালেখির মধ্যে মুসলমান সমাজ প্রায়ই 'অপর' হিসেবে হাজির হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের সমন্বয়বাদী চেতনা সেটা রুখতে পারে নি । অন্যদিকে ভদ্রলোক সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসাবে সহিংসতার প্রতি তাঁর বিদ্বেষ ছিল । তাই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর অবস্থান নিচ্ছেন । একটু পরেই আমরা দেখব, রবীন্দ্রনাথের এই 'সহিংসতার ভয়'-ও অনেক চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁকে শাসন করেছে । সন্ত্রাসবাদের আগ পর্যন্ত চলমান তৎপরতার বিরুদ্ধে তাঁর প্রধান নালিশ ছিল এই যে,

বক্তৃ তা করে বা কাগজে লিখে দেশ উদ্ধার হবে না । ক্ষু দিরামের ঘটনার পর আরও একটি নালিশ যুক্ত হল, সেটা হল সন্ত্রাসের পথে ভারতের মুক্তি হবে না । এখন আমরা আরেকটু অগ্রসর হয়ে 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধে পৌঁছবার আগে ঘটে যাওয়া কিছু সাক্ষাৎ ঘটনা নিয়ে আলোচনা করব । এতে করে রবীন্দ্রনাথের নতু ন অর্থে 'হিন্দু' কথাটা আবিষ্কার করতে গিয়ে মধ্যে মধ্যে টলে যাওয়ার আরও কিছু নিশানা পেয়ে যাব ।

হিংসার সমাজতত্ত্ব বঙ্গভঙ্গের সময়ে গড়ে ওঠা স্বদেশি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা প্রকট আকার পেয়ে যায় । কিছুদিনের মধ্যেই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরম্ভ হয়ে যায় হিন্দুমুসলমানের মধ্যে । ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন ঘিরে ছোটো-বড়ো একাধিক দাঙ্গার বিবরণ মেলে । ১৯০৬-০৭ সালে ময়মনসিংহে সাম্প্রদায়িক বিবাদ দাঙ্গার রূপ পরিগ্রহ করে । ওই সময়েই জামালপুরে যেসব মুসলমান বিলাতি পণ্য বিক্রি করছিল তাদের দোকানে আক্রমণ করে স্বদেশি আন্দোলনের হিন্দু স্বেচ্ছাসেবকরা । ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জে (মে ১৯০৬), কু মিল্লায় (মার্চ ১৯০৭), জামালপুরে (মে ১৯০৬) হিন্দুমুসলিম সহিংসতা দাঙ্গার রূপ নেয় । দাঙ্গা ক্রমশ অন্যান্য এলাকার মহকু মাতেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে । রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৭ সালের কু মিল্লার দাঙ্গার কথা উল্লেখ করেছেন । কু মিল্লা শহরের দাঙ্গায় লক্ষণীয় ছিল 'বাজারের নিচু শ্রেণীর সাধারণ মুসলমানরা' । অন্যদিকে ময়মনসিংহের গোলযোগের একটা কৃ ষিঘটিত চরিত্র ছিল প্রকট । দাঙ্গাকারীদের লক্ষ্য ছিল হিন্দু জমিদার ও মহাজনরা---এদের মধ্যে কেউ কেউ তখন হিন্দু দেবদেবীর পূজা বহাল রাখার জন্য ঈশ্বরবৃত্তি চাপাতে শুরু করেছিলেন । নানান জায়গায় ঋণপত্র ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছিল, কখনো কখনো দাঙ্গা 'গরিবরা বড়লোকদের লুঠতরাজ করছে'---এমন রূপ নিয়েছিল ।৩৩ ১৯০৭-০৮-এ অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন একগুচ্ছ নিবন্ধে তথা পাবনা প্রাদেশিক সম্মিলনীর (ফেব্রুয়ারি ১৯০৮) সভাপতির অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ দেখান, দাঙ্গার জন্য শুধু ব্রিটিশদের দোষ দেওয়াটা যথেষ্ট নয় । এসব দাঙ্গার গভীর প্রভাব অন্তর্ভেদী হয়ে রবীন্দ্রনাথের ওপর পড়েছে । তিনি ধীরে ধীরে স্বদেশি আন্দোলনের প্রকট সমস্যাগুলোর বিষয়ে সাবধান হয়ে ওঠেন । এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের যে বিবর্তন ঘটে সেটা সুমিত সরকারের মুখ থেকেই শোনা যাক :

সম্ভবত এর মধ্যে সবচেয়ে কৌতু হলজনক ঘটনা হল রবীন্দ্রনাথের বিবর্তন---কয়েক বছর পুনরুত্থানবাদের যথেষ্ট প্রভাবে থাকার পরেও ১৯০৭-এর মাঝামাঝি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অভিঘাতে তিনি তার সঙ্গে পরিষ্কার সম্পর্কচ্ছেদ করলেন । তাঁর দুটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাসে---গোরা (১৯০৭-০৯) ও ঘরে বাইরে (১৯১৪)---সে যুগের চোরাটান ও দ্বিমুখিতা সুস্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে ।৩৪ আগেই আমরা আলোচনা করেছি, রবীন্দ্রনাথ কঠোরভাবে সহিংসতার বিরোধী ছিলেন । সহিংসতার বিরোধিতা করা উচ্চচবর্গের একটি স্বাভাবিক নীতি । সহিংসতার মধ্যে যে একটি 'অ্যানার্কি'র ভাব রয়েছে সেটা উচ্চচবর্গ নিজের অস্তিত্বের হুমকি হিসেবেই বিবেচনা করে । পূর্ববঙ্গে স্বদেশি আন্দোলনের সময়কার দাঙ্গাগুলো কোথাও কোথাও শ্রেণিগত রূপ পেয়েছিল । সাধারণ রায়তরা বেছে বেছে জমিদার এবং ভূ স্বামীদের হত্যা করছিল । এই ঘটনা রবীন্দ্রনাথের চেতনায় প্রবল অভিঘাত ফেলতে পারে । জমিদারির কাজে তাঁর সঙ্গে পূর্ববঙ্গের যোগ ছিল । স্বভাবতই তিনি আক্রান্ত জমিদারদের মধ্যে নিজের আতঙ্কের একটি জান্তব রূপ দেখে থাকতে পারেন । কিন্তু মনে রাখা দরকার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র একজন 'ছিঁচকে' জমিদার ছিলেন না । তিনি ভারতবর্ষের জন্য এক স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং স্বদেশি আন্দোলনের সময় লোকের গালমন্দ কু ড়াতে হবে জেনেও তিনি সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটছিলেন । দাঙ্গার অভিঘাতকে শুধুমাত্র ভয় হিসেবে ব্যাখ্যা করতে গেলেই আমরা ফাঁদে পড়ে যাব । রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনার অন্তঃকরণের বাণীই পাঠ করার চেষ্টা করেছিলেন । তিনি স্বদেশি আন্দোলনের হিন্দুয়ানি রূপের ব্যাপারে হুশিয়ার ছিলেন । এসময়ের আন্দোলনের সঙ্গে কালীর কল্পনা অঙ্গাঙ্গিভাবে জুড়ে যায় । আন্দোলনের অনেক রিচু য়ালের মধ্যে হিন্দুয়ানি অনুষঙ্গ সরাসরি ঢু কে পড়ে । মন্দিরে গিয়ে মায়ের নামে শপথ পাঠের অনেক রকম আচার এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে যায় । এই আন্দোলনের মূল শ্লোগান বন্দে মাতরম কথাটার মধ্যেই মুসলমানের সংবেদনশীলতার প্রতি আঘাত রয়েছে---যা রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করেন ।৩৫ ফলে ১৯০৮-এর পর রবীন্দ্রনাথ রাজনীতি থেকে সরে যান : যেজাতীয়তাবাদকে তিনি অতিসংকীর্ণ ও পুনরুত্থানবাদী বলে মনে করতেন তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে এক বিশ্বজনীন মানবতাবাদ প্রচার করেন । তবে সবসময় যে এই আদর্শ তিনি অটলভাবে ধরে রাখতে পেরেছিলেন তা নয় ।

গোরা ১৯০৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে বেড়াতে যান । সেখানে সিস্টার নিবেদিতাকে তিনি তাঁর গোরা উপন্যাসের গল্প শোনান । এই বইটির কথা তিনি

অনেকদিন ধরে ভেবেছেন । উপন্যাসটি তিনি উনিশ শতকের সাতের দশকের প্রেক্ষাপটে রচনা করেছিলেন । এটা বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয় যে, ব্রাহ্মসমাজের যে অন্তর্কোন্দলের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কৈশোর ও যৌবন কাটছিল তারই অভিঘাত এই উপন্যাসের মধ্যে পড়েছে । ব্রাহ্মধর্ম, হিন্দুধর্ম ও জাতীয়তাবাদের উপাদান-মিশ্রিত গোরা উপন্যাস রচনার প্রেরণা তিনি এই পরিবেশ থেকেই পেয়েছেন বলে মনে হয় । তিনি গোরা লিখতে আরম্ভ করেন আরও বছর তিনেক পরে, বঙ্গীয় ১৩১৪ সালের (ইংরেজি ১৯০৭) ভাদ্র মাসে । গোরার মতো নিবেদিতাও ছিলেন আইরিশ বংশোদ্ভূ ত কট্টর হিন্দুত্বে বিশ্বাসী । কারও কারও মতে, গোরার কল্পনার মধ্যে নিবেদিতার অংশভাক আছে । তবে এই মতটাই শক্তিশালী যে গোরার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধু ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ছায়া খুঁজছিলেন ।৩৬ উপাধ্যায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি মনস্তাত্ত্বিক বাহাস এই উপন্যাসে রয়েছে । আমরা আগেই জেনেছি, রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের জাতীয়বাদী ভাবাদর্শের গুরুস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন উপাধ্যায় । কিন্তু এই উপন্যাসে স্বদেশি আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি সেই শিক্ষাকে সওয়াল করছেন । উপাধ্যায়ের মোদ্দা কথা ছিল, জাতীয় লক্ষ্য পূরণ করতে আমাদেরকে আধুনিকতা কোরবানি করতে হবে । এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের নতু ন নিদান হল, আধুনিক বিশ্বে সাংস্কৃ তিক পরিচয় খোঁজার সাধনার সঙ্গে ইউনিভার্সেলিজমের কোনো বিরোধ নেই, তাই আধুনিকতার কোরবানি আবশ্যক নয় । রবীন্দ্রনাথের গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রবাসী পত্রিকায় । গোরা রচনা শেষ হয় বঙ্গীয় ১৩১৬, ফাল্গুন মাসে । গোরা উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধ পাঠের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ । এই উপন্যাসে প্রবন্ধের অনেক কথার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে । উদাহরণ নেয়া যাক । 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধের একেবারে সারকথাটা হচ্ছে---হিন্দু কোনো সম্প্রদায়ের নাম নয় । হিন্দু একটি জাতি । গোরা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গৌরমোহনের মুখে এই কথাটাই হুবহু শোনা যাচ্ছে : গোরা কহিল, 'আমি হিন্দু । হিন্দু তো কোনো দল নয় । হিন্দু একটা জাতি । এ জাতি এত বৃহৎ যে কিসে এই জাতির জাতিত্ব তা কোনো সংজ্ঞার দ্বারা সীমাবদ্ধ করে বলাই যায় না । সমুদ্র যেমন কেউ নয়, হিন্দুও তেমনি দল নয় ।' রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে অনেকবার হিন্দুত্বের অবিনশ্বরতা ঘোষণা করেছেন । রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে এরকম কথা বিরল নয় : 'কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি তাহাদের এই আচরণ আমার হিন্দু পরিচয়কে স্পর্শমাত্র করিতে পারে না ।' আরেক জায়গায় তিনি

বলছেন, 'অতএব হিন্দুসমাজের দশজন যদি আমাকে হিন্দু না বলে এবং সেই সঙ্গে আমিও যদি আমাকে হিন্দু না বলি তবে সে বলামাত্রের দ্বারা তাহা কখনোই সত্য হইবে না ।' গোরা উপন্যাসের এই অংশটি পড়ে দেখা যাক : বিনয় কহিল, মা, আমি যদি হিন্দুসমাজের মতে না চলি তা হলে--আনন্দময়ী কহিলেন, হিন্দুসমাজে যদি তিন শো তেত্রিশ কোটি মত চলতে পারে তবে তোমার মতই বা চলবে না কেন? বিনয় কহিল, কিন্তু মা, আমাদের সমাজের লোক যদি বলে তু মি হিন্দু নও তা হলে আমি কি জোর করে বললেই হল আমি হিন্দু? আনন্দময়ী কহিলেন, আমাকে তো আমাদের সমাজের লোকে বলে খ্রিস্টান---আমি তো কাজে-কর্মে তাদের সঙ্গে একত্রে বসে খাই নে । তবুও তারা আমাকে খ্রিস্টান বললেই সে কথা আমাকে মেনে নিতে হবে এমন তো আমি বুঝি নে ।৩৭ এরকম হুবহু কথা দুই টেক্সটে খুঁজে পাবার একটি তাৎপর্য আছে । রবীন্দ্রনাথের 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধে বিবৃত মত যে ভুঁইফোঁড় গজিয়ে ওঠা ঝোঁকের বশে বলে ওঠা কোনো ভাবনা নয়, তার প্রমাণ---এসব চিন্তা বহুকাল ধরে রবীন্দ্রনাথ নিজের মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করছিলেন । কয়েক বছরের ব্যবধান সত্ত্বেও একই চিন্তা অবিকৃ তভাবে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে । একটু মন দিয়ে পড়লে এই উপন্যাসের মধ্যে 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধের প্রায় সমস্ত প্রধান তর্ক খুঁজে পাওয়া যাবে । উপন্যাসের কাহিনি খুবই সরল । গোরা মৌলবাদী ধরনের হিন্দু এবং 'হিন্দু প্যাট্রিয়ট সোসাইটি'-র সভাপতি । হিন্দুসমাজের যে-কোনো আচারের প্রতিই তার ভক্তি একনিষ্ঠ এবং অচল । কোনো যুক্তিতেই সে তার এই মৌলবাদী অবস্থান ছাড়তে চায় না । কিন্তু উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে গোরা জানতে পারে যে হিন্দুসমাজের জন্য সে পুরো জীবন উৎসর্গ করছে সেই হিন্দুসমাজে তার কোনো বৈধ শেকড় নেই, সে আইরিশ বাবা-মার সন্তান । এই কথায় তার যে উপলব্ধি হয় সেটা গোরার নিজের মুখ থেকেই শোনা যাক/: ...আমি একেবারে ছাড়া পেয়ে হঠাৎ একটা বৃহৎ সত্যের মধ্যে এসে পড়েছি । সমস্ত ভারতবর্ষের ভালোমন্দ, সুখদুঃখ জ্ঞান-অজ্ঞান একেবারেই আমার বুকের কাছে এসে পৌঁচেছে---আজ আমি সত্যকার সেবার অধিকারী হয়েছি--- সত্যকার কর্মক্ষেত্র আমার সামনে এসে পড়েছে---সে আমার মনের ভিতরকার ক্ষেত্র নয়---সে এই বাইরের পঞ্চবিংশতি কোটি লোকের যথার্থ কল্যাণক্ষেত্র । ...আমি যা দিনরাত্রি হতে চাচ্ছিলুম অথচ হতে পারছিলুম না, আজ আমি তাই হয়েছি । আমি আজ ভারতবর্ষীয় । আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান কোনো সমাজের কোনো

বিরোধ নেই । আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন । মোটা দাগে মনে হবে, নিজের জন্মতত্ত্ব জানতে পেরে সংকীর্ণ হিন্দুত্বের কোল থেকে সহসা লাফিয়ে পড়ছে গোরা । কিন্তু উপন্যাসের মধ্যে গোরার গোটা বিবর্তনটারই একটি ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ । বিরাট এই উপন্যাসের শুরুর পঞ্চাশ-ষাট পাতার মধ্যেই আমরা গোরার প্রথম বিদ্রোহের সংবাদটি পেয়ে যাই । গোরার ঘনিষ্ঠ স্যাঙাত নন্দ হঠাৎ করেই কু সংস্কারের বলি হল । এই ঘটনায় ভীষণ ক্রু দ্ধ গোরা তার পরম বন্ধু বিনয়কে বলছে : সমস্ত হাত মিথ্যার কাছে মাথা বিকিয়ে দিয়ে রেখেছে । দেবতা, অপদেবতা, পেঁচো, হাঁচি, বৃহস্পতিবার, ত্র্যহস্পর্শ---ভয় যে কত তার ঠিকানা নেই--- জগতে সত্যের সঙ্গে কী রকম পৌরুষের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় তা এরা জানবে কী করে? ...না, বিনয়, এ আমি কিছুতেই সহজে সহ্য করতে পারব না । ওই-যে ভূ তের ওঝা এসে আমার নন্দকে মেরে গেছে তার মার আমাকে লাগছে, আমার সমস্ত দেশকে লাগছে, আমি এইসব ব্যাপারকে এক-একটা ছোটো এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে কোনোমতেই দেখতে পারি নে । গোরা উপন্যাসে লোকাচারের ঢঙ-ঢাঙ দেখে দেখে গোরা যেমন ভেতরে-ভেতরে ভাঙছে, রবীন্দ্রনাথও তেমনি বহুকাল ধরে সন্তর্পণে নিজেকে ভেঙেছেন । কিন্তু এখানে ধন্দ লাগার ব্যাপার হল, সহজিয়া পথে গোরার সত্য উপলব্ধি হল না, মানুষ হিসেবে গোরা সম্পূর্ণ হল এই সত্য জেনে যে, সে জন্মসূত্রে আইরিশ । সেটা ছিল একটা ট্রমা । এই ট্রমার ঘটনা ছাড়াও কি রবীন্দ্রনাথ গোরাকে ধীরে ধীরে সংকীর্ণতা মুক্ত একজন মানুষে রূপান্তর করতে পারতেন? সেই চেষ্টা যে রবীন্দ্রনাথের গোরায় আছে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি, গোরা অনেকদিন থেকেই ভাঙছে । গোরার জন্য এই ট্রমার তবে প্রয়োজন হল কেন? রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোনো একটি লেখায় বলেছিলেন, যখন টোকা দিলে খুলছে না, তখন ঘা মারলেই দরজা খোলে । রবীন্দ্রনাথ কি মনে করছেন, অমন একটি জবর ঘা না খেলে হিন্দুত্বের মোহ কাউকে পুরোপুরি ঘোচে না? রবীন্দ্রনাথের অচেতনে হলেও কি এমন একটি আত্মসমর্পণ ছিল যে, গোরার মতো তিনি কখনোই পুরোপুরি মুক্ত হয়ে উঠতে পারবেন না? তাঁর জীবনে এমন কোনো ট্রমা তো নেই যা তাঁকে ঘা দিয়ে জাগিয়ে দিতে পারে ।

সেনসাস

যে সমস্ত বিবেচনায় আর্য সমাজ শুদ্ধির আচারাদি প্রবর্তন করে তার একটি প্রধান প্রণোদনা এসেছিল লোকগণনা থেকে । উপনিবেশি যুগে ভারতবর্ষে লোকগণনার শুরু হয়েছে ১৮৭১ সাল থেকে । প্রতি দশ বছর অন্তর অন্তর এই লোকগণনা করা হত । প্রতিটি লোকগণনা থেকেই এই কথাটি উঠে আসছিল যে, ভারতে দিন-দিন খ্রিস্টান বাড়ছে সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে হিন্দু । ১৯১১ সালের লোকগণনার আগে আর্য সমাজের তৎপরতার মধ্যে কিছু মজার ব্যাপার আছে । ১৯১১ সালের আগ পর্যন্ত আর্য সমাজের দাবি ছিল, লোকগণনার সময়ে তাদের সমাজের কাউকে 'হিন্দু' শ্রেণিভু ক্ত করা চলবে না, কারণ ইতিমধ্যেই তারা 'হিন্দু' তকমাটি প্রত্যাখ্যান করেছিল । কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা যায়, আর্যসমাজ তাদের সভ্যদের সনাতনি বিশ্বাস জানান দিতেই তাগাদা দিচ্ছে ।৩৮ বিশ শতকের গোড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এসব সেনসাসের প্রভাব কেমন পড়ছিল সেটা এই ঘটনা থেকে আঁচ করা যেতে পারে । চেতন ভাটের মতে, হিন্দুবাদের জঙ্গী হিন্দু জাতীয়তাবাদী বাগধারা গড়ে উঠবার পেছনে ১৯০১ এবং ১৯১১ সালের সেনসাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূ মিকা পালন করেছে । বিশ শতকের গোড়ায় খ্রিস্টান এবং মুসলমানের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাতাত্ত্বিক হুমকি থেকেই হিন্দুরা এরকম চরম পথ বেছে নিচ্ছিল । ১৯১১ সালের লোকগণনার সময় সেনসাস কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন ই. এ. গাল্ট । ১৯১৩ সালে তিনি এই লোকগণনার প্রতিবেদন প্রকাশ করেন । এই প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯১১ সালে বাংলা প্রদেশের মোট জনসংখ্যা ৪৫,৪৮৩,০৭৭ । এর মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা ২০,৩৭৭,৭৯৩ । আর মুসলমানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩,৯৮৯,৭১৯ । আর্য সমাজ এবং ব্রাহ্মসমাজ-ভু ক্ত সদস্যদের 'হিন্দু' ক্যাটেগরির মধ্যে গণনা করা হলেও তাঁদের লোকসংখ্যা আলাদা আলাদা ভাবে দেখানো হয়েছে ।৩৯ ১৯১১ সালের সেনসাসের জন্য তৈরিকৃ ত ব্যবস্থাপত্র আগের যে-কোনো সময়ের তু লনায় অত্যন্ত জটিল ছিল । হিন্দু যথার্থই হিন্দু কিনা সেটা যাচাই করে দেখার জন্য অনেকগুলো প্রশ্ন স্থির করা হয়েছিল । এসব প্রশ্নের ভিত্তিতেই খাঁটি হিন্দু নির্ণয় করা হচ্ছিল । হিন্দুত্বের এই যাচাই-বাছাইয়ের কারণেই মূলত বাংলায় এই বিতর্ক খুব জোরেসোরে বইতে লাগল---ব্রাহ্মরা হিন্দু কিনা । নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মরা সরাসরি বলে দিলেন, 'ব্রাহ্মরা হিন্দু নয় ।' তাঁরা যুক্তি দেখালেন, বেদের অভ্রান্ততা, গোরুর পবিত্রতা ও ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার আর সেই সঙ্গে সাকার দেবতার পূজা করা যদি হিন্দুধর্মের আবশ্যক শর্ত হয়, তবে ব্রাহ্মরা নিজেদের হিন্দু বলতে পারেন না ।৪০ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আদি ব্রাহ্মসমাজ এই বক্তব্যে একমত হয় নাই । একমত হবার তেমন কোনো কারণও ছিল না । তিনি ভেদনীতির তু মুল বিরোধী ছিলেন । হিন্দু-

মুসলমানের ঐক্যে যেমন তাঁর গভীর তৃ ষ্ণা ছিল তেমনি কোনো একটা ছুতোয় হিন্দুর মধ্যে ভেদ ঘটু ক এটা তিনি কখনোই চান নি । দিনকে-দিন খরচ হয়ে যাওয়া হিন্দু সম্প্রদায় থেকে নিজেদের আলাদা করে নিলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভিত আরও নড়বড়ে হয়ে যাবে---এমন একটি ভয় তাঁর মধ্যে থাকাটা অযৌক্তিক নয় । হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমাগত দেউলিয়া হয়ে যাবার যে ভয়টা জাঁকিয়ে বসেছিল এই ভয়টা হয়ত রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করেছিল । কথাটা নিছক অনুমান, কিন্তু অমূলক বলে একে উড়িয়ে দেয়া মুশকিল । এরকম একটা আশংকা যে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে জাগতে পারে তার সায় রবীন্দ্রনাথের জীবনে খুঁজলে পাওয়া তো যাবেই । এখানে বলা দরকার যে, রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই এমন একটা কথা উঠেছিল । আদিনাথ চট্টোপাধ্যায় ১৯২১ সালে তত্ত্বকৌমুদীতে প্রকাশিত পত্রে 'শোনা কথা'র বরাত দিয়ে জানাচ্ছেন, 'সেনসাস গণনার জন্য রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মদিগকে একেশ্বরবাদী হিন্দুরূপে পরিগণিত করিতে চাহিয়াছেন' ।৪১ 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধটি লেখার সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট বলতে এই লোকগণনার মুহূর্তটিকেই বুঝতে হবে বলে আমাদের ধারণা । আদি ব্রাহ্মসমাজের রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে যদি লোকগণনার ঘটনাটিকেও আমরা মনে রাখি, তাহলে রবীন্দ্রনাথ কেন 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধে হিন্দু কথাটা প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, এবং কেন হিন্দু আর ব্রাহ্মের সম্পর্কের গণেশ মাঝেমধ্যে অদল-বদল হচ্ছিল সেটার অনুমান সহজ হয়ে আসবে ।

হিন্দু ও ব্রাহ্ম ব্রাহ্মসমাজের ভাঙচু রের গোড়া থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি---দুটো প্রধান পক্ষ থাকছে । একদিকে থাকছে সনাতনপন্থী আদি ব্রাহ্মসমাজ, তার উলটো পাশে কখনও এসে দাঁড়াচ্ছে ভারবতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ, কখনো বা সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ । এই দুটি অবস্থানের দ্বন্দ্ব উনিশ শতক ছাপিয়ে বিশ শতকেরও প্রথম সিকি শতাব্দী পর্যন্ত তরতাজা ছিল । 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে দুই ব্রাহ্ম অবস্থানের বহুকালের ঠেলাঠেলির ধারা সবেগে প্রবাহিত হয়েছে । এই ঢেউয়ের শব্দ রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে কান পাতলেই শোনা যাবে । 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেসব তত্ত্ব প্রচার করছিলেন সেখানে কিছু নতু ন ব্যাপার ছিল । কিন্তু মোটের উপর একে আদি ব্রাহ্মসমাজের অবস্থান বলে শনাক্ত করা যায় । রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধটি ছাপা হলে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ হয় । রবীন্দ্রনাথ তখন 'হিন্দু ব্রাহ্ম' শিরোনামে এই প্রতিবাদের একটি জবাব দিয়েছিলেন ।৪২ এসব বাতচিৎ বোঝার একমাত্র উপায় হল ব্রাহ্মসমাজের বহু বছরের সংঘাতের ইতিহাসের পাটাতনে দাঁড়িয়ে বোঝা ।

রবীন্দ্রনাথ যুগপৎ আদি ব্রাহ্মসমাজের চৌহদ্দির মধ্যেও ছিলেন, আবার একে অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টাও করছিলেন । নিজের প্রথম জীবনে ব্রাহ্মসমাজের ভাঙচু রবাদ তাঁকে ভারি বীতশ্রদ্ধ করে তু লেছিল । যখন তিনি নিজে ব্রাহ্মসমাজকে গোছানোর দায়িত্ব নিলেন তখন এসব ইতিহাস তিনি ভু লে যান নি । ডেভিড কফের মতে, আদি ব্রাহ্মসমাজের হিন্দু আধুনিকতার যে নতু ন তফসির রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছিলেন সেটা রবীন্দ্রনাথকে বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । কারণ বাংলার চিন্তাধারার মধ্যে এটিই তাঁর সবথেকে মূল্যবান অবদান ।৪৩ ১৮৮৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক হন । ১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতৃ ত্ব গ্রহণ করেন । এই সময় তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক হন এবং পরে সেটি ব্রাহ্মবিদ্যালয়ের মুখপত্র রূপে প্রকাশ করেন । তত্ত্ববোধিনী সভা বহুদিন মৃতকল্প থাকার পর তিনি আবার সচল করেন । রবীন্দ্রনাথ গোড়া থেকেই ব্রাহ্মসমাজের তিন বিচ্ছিন্ন ধারার মধ্যে যোগাযোগ তৈরির চেষ্টা করছিলেন । সেই সঙ্গে তিনি হিন্দু সহানুভূ তিশীলদের সহযোগিতা পেতে চেষ্টা করেন । এসময় কেশবচন্দ্রপন্থী ত্রৈলোক্যনাথ সান্যালের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে । রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মবাদের নতু ন সংস্করণ তৈরি করলে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অনেক তরুণ তাঁর প্রতি আকৃ ষ্ট হন । এঁদের মধ্যে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে সবথেকে বড়ো শিষ্য বলে মানতে হবে ।৪৪ রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে হিন্দু এবং ব্রাহ্ম এই দুই ক্যাটেগরিকে যেভাবে সম্পর্কিত করার চেষ্টা করেছিলেন সেটা বোঝার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্মসমাজ কল্পনা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে, রবীন্দ্রনাথের টলে পড়ার ঘটনাগুলো দাগিয়ে রাখতে আমরা হিন্দু-ব্রাহ্ম সম্পর্কের দুটো ধরনের কথা বলেছিলাম । কারও কারও মত ছিল, ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুত্বের ভেতরের জিনিস, বাইরে তাকে টেনে-হিঁচড়ে বার করে আনা উচিত নয় । আর রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধে বলার চেষ্টা করেছিলেন, হিন্দু আর ব্রাহ্ম দুটো স্বতন্ত্র ক্যাটেগরি । এই প্রবন্ধেই আমরা লক্ষ্য করেছি, রবীন্দ্রনাথ অসতর্কভাবে কখনো কখনো এই পুরোনো অর্থের পাদানিতে পা রাখছিলেন । হিন্দু আর ব্রাহ্মসমাজের সম্বন্ধ কীরকম হবে এই বিতর্ক অনেকদিন ধরেই ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে ছিল । তিন-আইনে যখন বিয়ের প্রচলন হল, তখন ব্রাহ্মসমাজ নিজেদের হিন্দু সম্প্রদায় থেকে পৃথক করে ফেলছে---এমন একটি রব শোনা গিয়েছিল । সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ অকপটে নিজেদের অহিন্দু বলে জাহির করায় সনাতন ধর্মরক্ষিণী সভা ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিল । এর ফলটা দাঁড়িয়েছিল এমন : 'ছি! ছি! ব্রাহ্মগণ আপনাকে হিন্দু বলিতে চায় না এই রব যেমন দেশে উঠিয়া গেল, তেমনি এই সভার উদ্যোগে হিন্দুধর্মের

পুনরুত্থানের প্রয়াস বাড়িতে লাগিল' ।৪৫ এই বিবাহ উপলক্ষ্যে তত্ত্ববোধিনী এবং তত্ত্বকৌমুদীর মধ্যে দীর্ঘ বিতর্ক চলে । এই বিতর্কের হাওয়ার পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে আদি ব্রাহ্মসমাজ ক্রমশ বৃহত্তর হিন্দুসমাজের অঙ্গ হিসেবেই নিজেদের সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে তোলে । সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র তত্ত্বকৌমুদীর আদর্শ কেমন ছিল এসময়? এদের চেষ্টা ছিল পাশ্চাত্য ভাবধারার সঙ্গে ভারতীয় চিন্তার সমন্বয় করা । তত্ত্বকৌমুদী থেকে পড়া যাক :৪৬

জ্ঞান হৃদয় বিবেক ভক্তি প্রভৃ তি মানব প্রকৃ তির সমুদয় বিভাগের সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া ধর্ম সাধন যাহা এক্ষণে ব্রাহ্মসমাজে পরম সমাদরে গৃহীত হইয়াছে, যাহা প্রধান প্রধান ব্রাহ্ম প্রচারকারী প্রচার করিয়াছেন তাহা ব্রাহ্মগণ বেদ বেদান্তের কাছে নয় আমেরিকার থিওডোর পার্কারের কাছে শিক্ষা করিয়াছেন ।৪৭ কিংবা এই উদ্ধৃ তিটি পড়া যাক যেখানে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের ঋণ সাষ্টাঙ্গে স্বীকার করা হচ্ছে : ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের নিকট ব্রাহ্মগণ অনেক শিখিয়াছেন । বৈদান্তিক ধর্মের পরিবর্তে ব্রাহ্মসমাজে যে প্রকৃ ত ব্রাহ্মধর্ম প্রচারিত হইয়াছে, ইহার মূল পাশ্চাত্য জ্ঞান । ব্রাহ্মসমাজের নেতৃ গণ ইংরেজি ভাষায় সুশিক্ষিত না হইলে আজও ব্রাহ্মসমাজকে বৈদান্তিক ধর্মের অনুসরণ করিতে হইত । যোনিভ্রমণ প্রভৃ তি কু সংস্কারে আস্থা রাখিতে হইত ।'৪৮ তত্ত্বকৌমুদীর এই আদর্শ কেশবচন্দ্র প্রবর্তিত । যদিও কেশবচন্দ্রের সঙ্গে তত্ত্বকৌমুদীর তখন তত্ত্বগত বিরোধ চলছে তবু সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ কেশবচন্দ্রের এই প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সমন্বয়বাদকেই নির্ভর করেছিল । সোমপ্রকাশ আদি বা সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের পত্রিকা ছিল না । হিন্দুর সঙ্গে ব্রাহ্মর সম্বন্ধ কেমন হওয়া উচিত সে প্রসঙ্গে সোমপ্রকাশের মতামত শোনা যাক । 'হিন্দুসমাজের সহিত ব্রাহ্মদিগের সংস্রব রাখা উচিত কিনা?' শিরোনামে সোমপ্রকাশ লিখছে (২৭ মাঘ ১২৭০) : হিন্দু মুসলমান ও খ্রিস্টান প্রভৃ তি যেরূপ স্বতন্ত্র ধর্মাবলম্বী ও স্বতন্ত্র জাতি বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে, ব্রাহ্ম ও হিন্দু সেরূপ নহে । ব্রাহ্মরা এক ঈশ্বরের উপাসনা করিয়া থাকেন, ইহাই তাঁহাদিগের ধর্ম । হিন্দুদিগেরও সেই আদিধর্ম । ...ফলত ব্রাহ্ম ও হিন্দুতে বৈলক্ষণ্য নাই, উভয়ে একজাতীয় ও একধর্মাবলম্বী, কেবল কিঞ্চিৎ প্রস্থান ভেদ এই মাত্র ।৪৯

রাজনারায়ণ বসুর কথাও একবার মনে করা যাক । দেবেন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে ১৮৭২ সালে তিনি 'হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা' বিষয়ে বক্তৃ তা করেন । সভায় উপস্থিত হিন্দুরা ব্রাহ্মদের বলেন---শুনলেন তো, এবার গোবর খেয়ে আবার হিন্দু হয়ে যান ।৫০ 'সোমপ্রকাশ'-এ লেখা হয়---'হিন্দুধর্ম ডু বিতেছিল । রাজনারায়ণবাবু তাহা রক্ষা করিলেন ।' ত্রিবেণীর কাছে আকনা গ্রামের 'গাঢ়'সাকারবাদী হিন্দু দুর্গাপ্রসাদ ঘোষ স্থানীয় লোকদের কাছে রাজনারায়ণ বসুর পরিচয় দিয়ে বলেন, 'ইনি অন্যরূপ ব্রাহ্ম নহেন । ইনি হিন্দু ব্রাহ্ম' ।৫১ এখানে মনে রাখা অত্যন্ত দরকার যে রবীন্দ্রনাথ যে অর্থে হিন্দু কথাটা ব্যবহার করেছিলেন সেটা রাজনারায়ণ বসুর হিন্দুত্ব থেকে বহুদূরের পথ ছিল । রবীন্দ্রনাথ যদি প্রচলিত অর্থেই হিন্দু-ব্রাহ্ম মতটিকে বুঝে থাকতেন তবে তাঁর অবস্থান নিয়ে কোনো অসুবিধা ছিল না । কিন্তু এই প্রবন্ধটিকে যদি আমরা সাক্ষী মানি, তবে একথা না মেনে উপায় থাকে না, রবীন্দ্রনাথ এখানে ব্রাহ্ম ভাবকল্পে কিছু নতু ন পালক গুঁজে দিচ্ছেন । হিন্দু-ব্রাহ্ম পরিচয় ব্রাহ্মসমাজে কোনো নতু ন পরিচয় ছিল না । ১৮৮০ সাল থেকেই এই বিতর্ক ব্রাহ্মসমাজে প্রচলিত ছিল । ১৮৯০ সালে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে হিন্দু-ব্রাহ্ম বলে ঘোষণা করেন, কারণ ব্রাহ্মবাদ আসলে হিন্দুত্বেরই সত্য ব্যাখ্যা ।৫২ ১৯১১ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনীর পাতায় ব্রাহ্মসমাজ নিয়ে প্রচু র লেখালেখি করেন । ডেভিড কফ এসব লেখাজোকাকে মোট চার শ্রেণিতে ভাগ করেছেন । (১) ব্রাহ্মবাদের প্রকৃ ত অর্থ (২) ব্রাহ্মসমাজের ভেদনীতির লোকসান (৩) ব্রাহ্মবাদ ও হিন্দুবাদের সম্পর্ক (৪) জাতীয়তার চরম দেমাগের এই বিশ্বে ব্রাহ্মবাদের বৈশ্বিক হিন্দুমতের উপযোগিতা । ১৯১৩ সালে অজিত চক্রবর্তীকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-ব্রাহ্ম বিষয়ে লিখছেন যে, তিনি ব্রাহ্মমতকে আন্তর-হিন্দুত্ব থেকে আলাদা করে দেখতে পান না ।৫৩ হিন্দু-ব্রাহ্ম পরিচয়টি যখনই রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন তখন হিন্দু অর্থে তিনি আন্তর-হিন্দুত্ব বলতে নিজে যা বুঝেছেন সেটাই মনে মনে আমল করেছেন । রবীন্দ্রনাথ তাঁর সনাতন সমাজের কল্পনায় ভারতবর্ষের যে রূপ প্রকাশ করেছেন সেটা আন্তর-হিন্দুত্ব নিয়েই তাঁর মনের ছবি এরকম একটা সমন্বয়ী ব্যাখ্যা মোটামুটি সঙ্গত বলেই মনে হচ্ছে । ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কথার প্রতিধ্বনি করছিলেন না । তিনি তাঁর প্রবন্ধে যেটা বলেছেন, সেটা ব্রাহ্মসমাজেই নতু ন । তিনি বলছেন, কেউ ইচ্ছে করলে যুগপৎ হিন্দু এবং মুসলমান থাকতে পারে । অত্যন্ত বিস্ময়ের

ব্যাপার হল, এই যুক্তিটিই কয়েক বছর আগে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় প্রয়োগ করেছিলেন । ১৮৯৮ সালের জুলাই মাসে উপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত সোফিয়া পত্রিকায় লিখছেন : জন্মসূত্রে আমরা হিন্দু, মৃত্যু পর্যন্ত আমরা হিন্দুই থাকব । কিন্তু ধর্মীয় আচার ও সংস্কারের গুণে আমরা হলাম ক্যাথলিক : যেখানে আমাদের দেহ এবং মনের রাজত্ব সেখানে আমরা হিন্দু, কিন্তু আমাদের অমর আত্মার যে রাজত্ব সেখানে আমরা ক্যাথলিক । আমরা হচ্ছি হিন্দু ক্যাথলিক ।৫৪ এখানে ক্যাথলিক শব্দটিকে ব্রাহ্ম কথাটা দিয়ে বদলে নিলেই রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য পরিষ্কার পাওয়া যায় । এমনকি উপাধ্যায় দেহ-মন আর আত্মার যে দুই ভাগ করেছেন সেটাও রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে মোটামুটি খাটে । সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ রবীন্দ্রনাথের এরকম মতামত একেবারেই সহ্য করতে চায় নি । তাই আত্মপরিচয় প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ১৯১২ সালের বক্তৃ তা নিয়ে সুদীর্ঘ বিতর্ক চলতে থাকে । ১৯১৪ সালের জানুয়ারি মাসে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ রবীন্দ্রনাথকে তাঁর অবস্থান পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য আমন্ত্রণ জানায় । রবীন্দ্রনাথ বক্তৃ তা করতে এসে এত প্রবল বাধার মুখোমুখি হন যে তিনি বক্তৃ তা দেবার বদলে শুধুমাত্র প্রার্থনা শেষ করেই চলে যান । সাধারণ সমাজে কিছুতেই তাঁর বক্তৃ তা হয় নি । তিনি এই বক্তৃ তা দিয়েছিলেন কলকাতা টাউন হলে, শিবনাথ শাস্ত্রী এই সভার সভাপতি হয়েছিলেন । আমরা আদি ও সাধারণ সমাজের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি । সেটা এখানে আরেকবার ঝালাই করে নেয়া দরকার, কারণ এই অবস্থানের নিরিখে তাঁদের বোঝার চেষ্টাটা বর্তমান প্রসঙ্গে কাজের হবে । সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ রামমোহন বা তরুণ কেশবচন্দ্রের মতো করে বিশ শতকে রাজনৈতিক ইস্যুতে তেমন কথাবার্তা কয় নি ।৫৫ এই কারণেই হিন্দুবাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ রেখেও তাদের বেশ চলে যেত । তারা রাজনীতি করতে চায় নি । ফলত তাদের চর্চা অনেকটা খ্রিস্টীয়বাদী একদল এলিটের ক্ষমতার দ্বন্দ্বমুক্ত নিরাপদ বুদ্ধির চর্চাতেই সীমিত হয়ে পড়েছিল । কোনো তোপ সামলাতে হয় নি, সাধারণ মানুষের অবস্থা বদলের কথা ভাবতে হয় নি যাদের, তাদের পক্ষে অহিন্দু ব্রাহ্মত্বের ফ্যাশনেবল পথ বেছে নেয়াটা অস্বাভাবিক নয় । অন্যদিকে আদি ব্রাহ্মসমাজ চেষ্টা করছিল হিন্দুসমাজের মধ্যে অন্তর্ভ^ূক্ত থেকেই সমাজ পরিবর্তনের পথ কেটে নিতে । ফলে বর্ণপ্রথা লোপ, অসবর্ণ বিবাহের মতো সংবেদনশীল ব্যাপারে তারা খুব বেশি মাতবরি ফলাতে পারে নি । একই সঙ্গে শ্রেণিগত স্বার্থ ও নতু ন বিকশিত হওয়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃ ত্বে থাকতে গিয়ে তাদের অনেক কিছু সমঝে চলতে হচ্ছিল । রবীন্দ্রনাথ এই ধারার সবচেয়ে উচ্চচাভিলাষী পথ গ্রহণ করেছিলেন । আদি ঠি

ব্রাহ্মসমাজ ছিল রবীন্দ্রনাথের বুড়ির ঘর, যেখানে নানা-স্থানে ওড়াউড়ির পর তিনি ঠিকই সময়মতো ফিরতেন । যে সমাজ এবং শ্রেণির মধ্যে তিনি জন্মেছিলেন তাঁদের স্বার্থ থেকে পৃথক করে নিজের মতো ঠিক করা সব সময় তাঁর পক্ষে হয়ে ওঠে নি । এসব সামলে রেখেই রবীন্দ্রনাথ উড়াল দেবার এমন একজোড়া পাখা খুঁজছিলেন যা তাঁকে সহ গোটা ভারতীয় সমাজকেই ভেদাভেদের উর্ধ্বে উড়িয়ে নিয়ে যাবে । সেই প্রণোদনা থেকেই রবীন্দ্রনাথের এই প্রবন্ধ রচনা । আর সাধারণ সমাজের রাজনৈতিক উদাসীনতা তাদের আরেকরকম মুক্তির আনন্দ দিল । সমাজের দশজনের সঙ্গে মিল-তাল রাখবার দায় না থাকায় তাঁরা সহজেই সব কিছু অস্বীকার করতে পারতেন ।

তলানি একটা বিষয় লক্ষণীয়---উনিশ শতকে ইউরোপের প্রভাবে কেউ আর ভারতবর্ষের ইতিহাস সমাজ বা সংস্কৃ তি বুঝে নেবার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না । যেন ভারতকে বদলে দিতে হবে---এই ছিল রেনেসাঁস । ব্রাহ্মসমাজ এই দৃষ্টিভঙ্গির আদর্শ উদাহরণ । নরপূজার প্রবল বিরোধিতা কিন্তু আমাদের ইতিহাস ও বৈষ্ণব আন্দোলনের ব্যাপারে অসংবেদনশীলতারই নজির । ঐতিহাসিকভাবে বোঝার যেসব চেষ্টা ছিল সেগুলো কট্টর হিন্দুত্বের দিকে চলে গেছে । সেই হিন্দুত্ব আবার বঙ্কিম এবং শশধরে দুইরকম । আর যেদিকে যেতে পারত--অর্থাৎ রেনেসাঁস এবং ভারতীয় ঐতিহ্যকে যুক্ত করে---সেটাই রবীন্দ্রনাথের পথ । এই পথ কিছুটা হিন্দুঘেঁষা হলেও ঐতিহাসিকভাবে সাবালক ও পোস্ট-কলোনিয়াল । উনিশ শতকে যে ভারতকে বোঝার চেষ্টা ছিল না, তার প্রমাণ---রামমোহন বা ঈশ্বরচন্দ্রের মতো কয়েকজন বাদ দিলে---অবশিষ্ট সবার মধ্যেই কমবেশি খুঁজে পাওয়া যাবে । প্রথার অন্ধ অনুসরণ করলেই যে উনিশ শতকের বিদ্বৎসমাজ খুব বাহবা পেতেন এমন নয় । রামমোহন রায় সেসময়ে যেসব প্রথার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই করছিলেন সেই লড়াই একটি স্বতন্ত্র মূল্যের দাবি রাখে । ভারতীয় সংস্কৃ তির প্রতি শ্রদ্ধা উত্তর-উপনিবেশি চর্চার একটি গুরুতর দিক সন্দেহ নেই, কিন্তু সেটা দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানের প্রশ্নে উপযুক্ত জবাব । বর্তমানের কড়াইতে যে সমস্ত ক্ষতিকর প্রথা টগবগ করে ফু টছিল সেগুলোর তাপ কমানোই তখনকার জরুরি কাজ ছিল, যেমন নারীর উপর নিপীড়নের চলমান বুলডোজারকে থামানো, বা বর্ণপ্রথা ভেঙে দেয়া । দুটো বিষয়কে এক করে বলা যেতে পারে, সেই সময়ের সব থেকে জরুরি কাজ ছিল ভারতীয় সমাজের কি রাখতে হবে, কি বাদ দিতে হবে সেটা ইতিহাসের যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে স্থির করা, এই বাছাইকৃ ত উপাদানের সঙ্গে কী করে রেনেসাঁসের অমূল্য দানগুলো অঙ্গীভূ ত করা যাবে সেটার উপায় বাতলানো; আর রেনেসাঁস থেকে আমাদের প্রধান অর্জন

হতে পারত সমাজের প্রথা-ঐতিহ্যের বিচার করার ক্ষমতা । এই ক্ষমতা আমরা মুঘল যুগে সম্রাট আকবরের মধ্যে দেখেছি, কিন্দু দেবেন্দ্রনাথ এই তরিকায় হাঁটেন নাই । প্রবল বর্ণপ্রথা সভয়ে বাঁচিয়ে চলেছেন । এই দোষ রবীন্দ্রনাথে এসে অনেকখানি উবে গেছে । রবীন্দ্রনাথ শুধু যে উপনিবেশি যুগের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সবচেয়ে সঠিক পথগুলোর একটি বেছে নিয়েছিলেন তাই নয়, তিনি নিজের সৃষ্টি ও কল্পনার গুণকে কাজে লাগিয়ে এমন অনেক দাওয়াই হাজির করার চেষ্টা করেছেন, যা ভারতীয় সমাজের জন্য অমূল্য পাথেয় । এসব দাওয়াই ভারতবর্ষ কতদূর গ্রহণ করেছে, কতদূর করে নাই তার বিচার করা খুবই মুশকিল হবে । কিন্ত এটু কু নিশ্চিন্তে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের চিন্তা নানাভাবে আধুনিক ভারতবর্ষের নির্মাণে অবদান রেখেছে । 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ ভাবনার এমন অমূল্য নিদর্শন রেখে গেছেন । কিন্তু শ্রেণিচেতনা বা আদি ব্রাহ্মসমাজের ভাবাদর্শ তিনি সব সময় ছাপিয়ে উঠতে পারেন নি । রবীন্দ্রনাথের এই দুই মহলার চোরাটান তাঁকে এই প্রবন্ধে যেমন ভু গিয়েছে, তেমনি তাঁকে ভু গিয়েছে সারা জীবন ।

তথ্যসূত্র ও টীকা : ১ । রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র, রবীন্দ্র রচনাবলী (নবম খণ্ড), বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত । ২ । ফরহাদ মজহার, রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ, আগামী প্রকাশনী ঢাকা, ১৪১৪ । ৩ । মজহারের লেখার ভাষার নিবিড় পাঠ একটি বেশ কৌতু হলকর কাজ হতে পারে । তাঁর লেখার মধ্যে ধারালো যুক্তি আর রেটোরিকস এমনভাবে মিশে থাকে, যে এই দুটোকে আলাদা করে চিনতে পারা কঠিন হয়ে পড়ে । আমরা এখানে মজহারের যে রচনাটি নিয়ে আলোচনা করেছি তার মধ্যেও এমন মাল-মশলা এন্তার পাওয়া যাবে । ৪ । অমর্ত্য সেন, পরিচিতি ও হিংসা, আনন্দ, কলকাতা, ২০০৬ । ৫ । আশ্চর্য এই যে, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশও এই প্রসঙ্গে প্রায় অভিন্ন যুক্তি দিয়েছিলেন । তিনি 'কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের 'আত্মপরিচয়' রচনা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে লিখছেন, 'আমি ব্রাহ্ম হইলেও যেমন আমি বাঙ্গালি একথা সত্য, তেমনি আমি ব্রাহ্ম হইয়াও আমি হিন্দু এ কথা সমান সত্য ।' (প্রশান্ত মহলানবিশ, রবীন্দ্রনাথ, আনন্দ, কলকাতা, ২০০৮) ৬ । ফরহাদ মজহার, সামনা-সামনি, ঢাকা, ১৯৯৪ ।

৭ । সমাজ বলতে হিন্দু, আর সম্প্রদায় বলতে মুসলমান বা খ্রিস্টান বুঝতে যাওয়ার মধ্যেও একটা ফাঁকি আছে । এই ফাঁকিটা রবীন্দ্রনাথের অন্য লেখা পাশে রেখে পড়লে সহজেই ধরা পড়বে । ইসলাম বা খ্রিস্টানবাদ নিছক একটা সম্প্রদায়, সমাজ নয়---এমন ভু ল তাঁর হবার কথা না । এখানে যেমন, রবীন্দ্রনাথ বলছেন, 'এইরূপে পৃথিবীতে যে চারি প্রধান ধর্ম্মকে আশ্রয় করিয়া চার বৃহৎ সমাজ আছে---হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান---তাহারা সকলেই ভারতবর্ষে আসিয়া মিলিয়াছে ।' (রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র : স্বদেশী সমাজ) ৮ । পার্থ চট্টোপাধ্যায়, প্রজা ও তন্ত্র, অনুষ্টু প, কলকাতা, ২০০৬ । ৯ । শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, নিউ এজ পাললিশার্স প্রা. লি., কলকাতা, ২০০৭ । ১০ । [অনুবাদ] সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকু র ও ইন্দিরা দেবী, দি অটোবায়োগ্রাফি অব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ টেগোর, কর্নেল ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি, নিউইয়র্ক, ২০০৯ । ১১ । শিবনাথ শাস্ত্রী, হিস্ট্রি অব ব্রাহ্ম সমাজ, কলকাতা ১৯৭৪ । ১২ । শিবনাথ শাস্ত্রী (প্রাগুক্ত) ১৩ । বিনয় ঘোষ, বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা, বুক ক্লাব, ঢাকা, ২০০০ । ১৪ । স্পেনসার লেভন, 'দি ব্রাহ্ম সমাজ : ইন্ডিয়া'স ফার্স্ট মডার্ন মুভমেন্ট ফর রিলিজিয়াস রিফর্ম' । সংকলিত হয়েছে, রবার্ট ডি বেয়ার্ড [ সম্পাদিত/ণ্ণ, রিলিজিওন ইন মডার্ন ইন্ডিয়া, ১৯৯৪ । ১৫ । ডেভিড কফ, দি ব্রাহ্ম সমাজ অ্যান্ড দ্য শেপিং অব দ্য মডার্ন ইন্ডিয়ান মাইন্ড, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউ জার্সি, ১৯৭৯ । ১৬ । আহমদ ছফা, বাঙালি মুসলমানের মন, শ্রী প্রকাশ, ঢাকা, ২০০১ । ১৭ । প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবন কথা, আনন্দ, কলকাতা । ১৮ । জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকু র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সঞ্জীবনী সভা সম্পর্কে জানতে দেখুন, বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলীর নবম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭০৩ । ১৯ । প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায় (প্রাগুক্ত) ২০ । বিনয় ঘোষ, বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা, বুক ক্লাব, ঢাকা, ২০০০ । ২১ । অবশ্য পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এসব মত বজায় রাখতে পারেন নি । 'বঙ্গদেশের কৃ ষক' প্রবন্ধের নতু ন সংস্করণে তাঁর বক্তব্য প্রায় ঘুরে গিয়েছিল । তিনি

এতদূর পর্যন্ত লিখেছিলেন যে, এখন অনেক ক্ষেত্রে প্রজাই পীড়ক, জমিদার পীড়িত । 'সাম্য' প্রবন্ধটি তিনি তু লে নিয়েছিলেন, তাঁর জীবদ্দশায় আর ছাপা হয় নি । ২২ । সুমিত সরকার, আধুনিক ভারত ১৮৮৫-১৯৪৭, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, কোলকাতা, ১৯৯৩ । ২৩ । সুশোভন সরকার, বেঙ্গল রেনেসাঁস অ্যান্ড আদার এসেজ, পিপল'স পাব. হাউস, ১৯৭০ । ২৪ । ডেভিড কফ (প্রাগুক্ত) । ২৫ । প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায় (প্রাগুক্ত) । ২৬ । আশিস নন্দী, দি ইললেজিটিমেসি অব ন্যাশনালিজম : রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড দ্য পলিটিকস অব সেলফ, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লি, ১৯৯৪ । ২৭ । সুরজিৎ দাশগুপ্ত, দেশ ও ধর্ম প্রসঙ্গে রবীন্দ্রচেতনার বিবর্তন (গ্রন্থ : প্রেমেন্দ্র মিত্র ও অমিয়কু মার মজুমদার সম্পাদিত রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ, কোলকাতা : বৈতানিক, ১৯৭৬ পৃ. ৩৬-৪০ । উদ্ধৃ ত হয়েছে, আশিস নন্দী (প্রাগুক্ত) । ২৮ । সুমিত সরকার, আধুনিক ভারত ১৮৮৫-১৯৪৭, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, কোলকাতা, ১৯৯৩ । ২৯ । সুমিত সরকার (প্রাগুক্ত) । ৩০ । সুমিত সরকার (প্রাগুক্ত) । ৩১ । অবশ্য আগে রবীন্দ্রনাথের বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি গভীর উৎসাহ দেখা গেছে । তিনি একজন বিপ্লবীর প্রশংসা করে কবিতা রচনাও করেছেন । ৩২ । নিম্নবর্গের জগতের প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকু রের দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করতে দেখুন, 'সমস্যা', 'সমাধান', 'শক্তিপূজা'---এই প্রবন্ধগুলো । ৩৩ । এ সংক্রান্ত আলোচনার জন্য দেখুন, সুমিত সরকার, দি স্বদেশি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল ১৯০৩-১৯০৮, নতু ন দিল্লি, ১৯৭৩ । সেই সঙ্গে দেখুন, শৈলেশকু মার বন্দ্যোপাধ্যায়, দাঙ্গার ইতিহাস, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা: লি:, কলিকাতা ১৪০৫ । ৩৪ । সুমিত সরকার, আধুনিক ভারত ১৮৮৫-১৯৪৭, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কোলকাতা, ১৯৯৩ ।

৩৫ । রবীন্দ্রনাথ যে এবিষয়ে পরে হুঁশিয়ার হয়েছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তিরিশের দশকে বুদ্ধদেব বসুকে লেখা তাঁর একটি চিঠিতে । এই চিঠিতে তিনি হিন্দুয়ানি খোল-নলচের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন বসুর । চিঠিটি দময়ন্তী বসুর সম্পাদিত গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে । ৩৬ । আশিস নন্দী (প্রাগুক্ত) । ৩৭ । এখানে জ্যাঁ পল সার্ত্রের একটি উদ্ধৃ তি স্মরণ করা যেতে পারে । পরিচয় কীভাবে নির্মিত হয় সেটা বোঝাতে সার্ত্রে দেখাচ্ছেন, 'এক ইহুদি একজন মানুষ যাকে অন্যেরা ইহুদি বলে দেখে, ...যে ইহুদি-বিদ্বেষী সে-ই ইহুদি-পরিচয় গঠন করে ।' (সার্ত্রে, পোর্ট্রেট অব দ্য অ্যান্টি সোসাইটি) ৩৮ । চেতন ভাট, হিন্দু ন্যাশনালিজম : অরিজিনস ইডিওলজিস অ্যান্ড মডার্ন মিথস, বিইআরজি, অক্সফোর্ড নিউইয়র্ক, ২০০১ । ৩৯ । ই এ গাল্ট, সেনসাস অব ইন্ডিয়া, ১৯১১, ক্যালকাটা : সুপারিনটেনডেন্ট গর্ভানমেন্ট প্রিন্টিং, ১৯১২ । ৪০ । প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায় (প্রাগুক্ত) । ৪১ । প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, রবীন্দ্রনাথ, আনন্দ, কলকাতা, ২০০৮ । ৪২ । আশ্চর্য এই যে, এই জবাবের মধ্যেও ঠিক হিন্দু ও ব্রাহ্মের মধ্যকার যে সম্পর্কে তিনি 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধে স্থির করেছিলেন, সেটা যথাযথভাবে রক্ষিত হয় নি । ৪৩ । ডেভিড কফ (প্রাগুক্ত) । ৪৪ । রবীন্দ্রনাথকে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের 'অনারারি' সদস্যপদ দেওয়া হবে কিনা সেটা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক চলেছে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে । রবীন্দ্রনাথ 'আমি হিন্দু' বলে ব্রাহ্মসমাজের সার্বভৌমিকতার ক্ষতি করেছেন---এটাই ছিল বিরোধের মূল যুক্তি । এসময় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ও সুকু মার রায় প্রত্যক্ষভাবে রবীন্দ্রনাথের পক্ষ নেন । রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন 'কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই' এই শিরোনামে । ৪৫ । শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রা. লি., কলকাতা, ২০০৭ । ৪৬ । তত্ত্বকৌমুদী, ৬ অক্টোবর, ১৮০৯ শকাব্দ । ৪৭ । এখানে স্মর্তব্য পরেশবাবুর বাড়িতে গিয়ে প্রথমেই গোরার চোখে পড়ল পার্কারের রচনা । পার্কার কি বিশেষ করে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে বরেণ্য? এখানে কথা ওঠে

পরেশবাবু কি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিনিধি? রবীন্দ্রনাথ কিন্তু পরেশবাবু এবং আনন্দময়ীকেই সবচেয়ে যত্নে ভারসাম্যে এঁকেছেন । ৪৮ । তত্ত্বকৌমুদী, ১৬ আষাঢ় । ১৮০৯ শকাব্দ । ৪৯ । বিনয় ঘোষ, (প্রাগুক্ত) । ৫০ । বিনয় ঘোষ, (প্রাগুক্ত) । ৫১ । ডেভিড কফ (প্রাগুক্ত) । ৫২ । দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকু র আরও এক কাঠি সরেস ছিলেন । এখানে তাঁকে একটু উদ্ধৃ ত করা দরকার । তাঁর কথাটা শোনা গেলে বাদ-বাকিদের কথার অর্থ আরও সহজে বোধগম্য হবে । রবীন্দ্রনাথের চিন্তার স্বাতন্ত্র্য ও সীমা বুঝতেও কাজে আসতে পারে । দ্বিজেন্দ্রনাথ বঙ্গীয় ১৩১৮ সনের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়---অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের 'আত্মপরিচয়' প্রকাশিত হবার প্রায় বছর খানেক আগে---প্রবাসী পত্রিকাতে 'ব্রাহ্ম হিন্দু কি অহিন্দু' নামে একটি প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, 'আমাকেও যদি তু মি জিজ্ঞাসা কর তু মি কোন ধর্ম্মাবলম্বী তবে আমিও বলিব না আমি হিন্দু-ব্রাহ্ম; বলিব শুধু আমি ব্রাহ্ম । কোনো বৈষ্ণবকে যদি জিজ্ঞাসা কর তু মি কোন ধর্ম্মাবলম্বী, তিনিও বলিবেন না আমি হিন্দু বৈষ্ণব; বলিবেন শুধু আমি বৈষ্ণব । ...অশ্ব বলিলেই যেমন চতু ষ্পদ অশ্ব বুঝায়, তেমনি বৈষ্ণব বলিলেই হিন্দু-বৈষ্ণব বোঝায় ।' ৫৩ । ডেভিড কফ (প্রাগুক্ত) । ৫৪ । উদ্ধৃ ত হয়েছে, চতু র্বেদী বদ্রিনাথ, ধর্ম, ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অর্ডার : টু য়েনটি এসেজ, সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ, নিউ দিল্লি, ১৯৯১ । ৫৫ । স্পেনসার লেভন (প্রাগুক্ত) ।

'নিশীথে' চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ মনুজেন্দ্র শ্যাম গল্পগুচ্ছ-র বেশ কিছু গল্পে এবং নানা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ নানা অসুস্থ, রুগণ এবং মনোরোগীর চরিত্র দেখিয়েছেন। বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের আগে কোনো লেখকই এধরনের চরিত্রের সঙ্গে পাঠকের সাক্ষাৎ ঘটাননি। এই রোগী ও রুগণ মানুষদের বর্ণনা, সংলাপ ও ব্যবহারের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাদের রোগের লক্ষণগুলিও আমাদের জানিয়েছেন, বৈজ্ঞানিক নাম উল্লেখ না করেও। উনিশ শতকের শেষের ও বিশ শতকের প্রথম দিকের নানা নিদানের মধ্যেও তিনি সময়ের সুস্পষ্ট প্রেক্ষিত রচনা করেছেন। নিপুণ বর্ণনার মাধ্যমেই এই চরিত্রগুলিকে রক্তমাংসের মানুষ হিসেবেই তিনি দর্শিয়েছেন। এমনই একটি ঘটনাশ্রয়ী কাহিনি হল তাঁর লেখা 'নিশীথে' গল্পটি। এই গল্পের মূল চরিত্র মনোরোগী হলেও শতাধিকবর্ষ পূর্বের নিদান, চিকিৎসাব্যবস্থা ও রোগের বিবরণ আমরা এই কাহিনিতে যখন পড়ি তখন তার সাহিত্যমূল্যকে ওই সব বিবরণ ছাপিয়ে যায় না। এই কাহিনি বলার কৌশলে তাঁর এই ধরনের রচনাগুলি নিছক তথ্যসঞ্চয় হয়ে ওঠেনি। রবীন্দ্রনাথের দুই অগ্রজ বীরেন্দ্রনাথ ও সোমেন্দ্রনাথ উন্মাদ রোগে ভু গতেন। বীরেন্দ্রনাথকে পাগলাগারদেও পাঠানো হয়েছিল। তাঁর মাতু ল-পরম্পরায়ও এই রোগ ছিল বলে জানা যায়। শতজনের বেশি সংখ্যক লোকবিশিষ্ট তাঁদের পরিবারে মনোরোগী যে আরও ছিলেন না, তা-ও বলা যায় না। 'নিশীথে' কাহিনির ঘটনা-পরম্পরায় মানুষের মনের এক জটিল মানচিত্রে রবীন্দ্রনাথ আলোকপাত করেছেন। 'নিশীথে' কাহিনির শুরুতেই আমরা পড়ি, এক মনোরোগী চিকিৎসকের দ্বারস্থ। নিশীথকালে তাঁর মনোবিকার হয়। মনোবিকারের তাড়নায় তিনি চিকিৎসকের কাছে তাঁর মনোবিকারের আদ্যোপান্ত কারণ বর্ণনা করছেন। অ্যারিস্টটলের অভিধা ধরে অ্যাবনরম্যাল সাইকোলজিতেও একে ক্যাথারসিস বা ভাবমোক্ষণ বলা হয়, যার অর্থ, অবদমিত ক্ষোভ বা আবেগের মোক্ষণ বা উদগার, যাতে মন হালকা হয়।, আঠারোশো বিরাশিতে যোসেফ ব্রিউয়েরের বর্ণনানুসারী Cathartic Psychotherapy -র নিদানও রবীন্দ্রনাথের এই কাহিনিতে লক্ষণীয়। রোগের উৎপাত ও প্রকোপ রাত্রির অনুষঙ্গে, একারণে এই কাহিনির নামকরণও বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।

কাহিনির শুরু এই রকম, 'ডাক্তার! ডাক্তার!' জ্বালাতন করিল! এই অর্ধেক রাত্রে-চোখ মেলিয়া দেখি আমাদের জমিদার দক্ষিণাচরণবাবু। ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া পিঠভাঙ্গা চৌকিটা টানিয়া আনিয়া তাঁহাকে বসিতে দিলাম এবং উদবিগ্নভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিলাম। ঘড়িতে দেখি, তখন রাত্রি আড়াইটা। দক্ষিণাচরণবাবু বিবর্ণমুখে বিস্ফারিত নেত্রে বলিলেন, 'আজ রাত্রে আবার সেইরূপ উপদ্রব আরম্ভ হইয়াছে-তোমার ঔষধ কোন কাজে লাগিল না।' আমি কিঞ্চিত সসংকোচে বলিলাম, 'আপনি বোধ করি মদের মাত্রা আবার বাড়াইয়াছেন।' দক্ষিণাচরণবাবু অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া কহিলেন, 'ওটা তোমার ভারি ভ্রম। মদ নহে; আদ্যোপান্ত বিবরণ না শুনিলে তু মি আসল কারণটা অনুমান করিতে পারিবে না। এইভাবে 'নিশীথে' গল্পের প্রারম্ভেই দেখা যায় একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ অর্থাৎ একজন মনোরোগী অর্ধেক রাত্রে ডাক্তারের কাছে এসেছেন। ডাক্তারের কাছে যে-কোনো সময় রোগী এলে তাঁকে পরীক্ষা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা একজন চিকিৎসকের নৈতিক, সামাজিক ও মানসিক দায়িত্ব। এইজন্য চিকিৎসকের পেশাকে noble profession বলা হয়ে থাকে। এখানে ডাক্তার বিরক্তিবোধ করলেও, তা প্রকাশ না করে পেশাগত দায়বদ্ধতার জন্য রাত আড়াইটায় ঘুম থেকে উঠেছেন। রোগী হচ্ছেন জমিদার দক্ষিণাচরণবাবু, সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত মানুষ, ডাক্তারবাবুর কথাবার্তায় সেই সৌজন্যবোধ ও সম্মান প্রকাশ পেয়েছে। দক্ষিণাচরণবাবুর অভিযোগ ডাক্তারের ঔষধে কোনো কাজ হয়নি। বোঝা যাচ্ছে যে দক্ষিণাবাবু ডাক্তারের পুরোনো রোগী। রোগের লক্ষণ ও বিবরণ ডাক্তার জানতেন। শারীরিক বা মানসিক যে-কোনো রোগের একটি aetiology বা কারণ থাকে; সেই ইতিহাস তিনি রোগীর কাছ থেকে জেনে নেননি। অথবা জমিদারবাবু যে মানসিক রোগগ্রস্ত তা ডাক্তারের চিন্তায় স্থান পায়নি। অতিমাত্রায় মদ্যপান করলে এই ধরনের বিভ্রম হতে পারে, এটাই ডাক্তার ধরে নিয়েছিলেন। এই জন্য ডাক্তার বলেছিলেন, 'আপনি বোধহয় মদের মাত্রা বাড়াইয়াছেন।' কিন্তু দক্ষিণাবাবু তাঁর ভয় ও বিভ্রমের কারণ ভালোভাবে জানতেন, ডাক্তারবাবুর কাছে তা ব্যক্ত করেননি। অনেক রোগী ডাক্তারের কাছে তাঁর ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবন, স্বভাব ও আসক্তি ইত্যাদি প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করেন বা লুকিয়ে রাখেন। চিকিৎসকদের এই ধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

রোগীর ইতিহাস রোগনির্ণয়ে প্রধান সহায়ক ও দিশারি। রোগের সূচনাকালের বিবরণ, রোগীর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ইতিহাস আনুপূর্বিক জেনে নিতে পারলে, অনেক রোগ laboratory ও radiology ইত্যাদির সাহায্য না নিয়েও নির্ণয় করা সম্ভব। আজকাল বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ রয়েছে তাই আমরা laboratory, radiology ও নানা ধরনের electronics পদ্ধতির মাধ্যমে রোগনির্ণয় সুনিশ্চিত করে নিই। দক্ষিণাবাবু ডাক্তারের কাছে তাঁর পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনের ইতিহাস লুকিয়ে রেখেছিলেন, হয়তো তাঁর সামাজিক মর্যাদা ক্ষু ণ্ণ হতে পারে এমন আশঙ্কায়। নিদ্রাহীন রাত ও মানসিক কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ডাক্তারের কাছে মধ্যরাত্রে এসে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। গল্পে আছে, 'দক্ষিণাবাবু অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া কহিলেন, ওটা তোমার ভারি ভ্রম। মদ নহে। আদ্যোপান্ত বিবরণ না শুনিলে তু মি আসল কারণ অনুমান করিতে পারিবে না।' দক্ষিণাবাবু লজ্জায় এবং মর্যাদাহানির ভয়ে যা এতদিন বলেননি, তা রবীন্দ্রনাথ গল্পের শেষে উল্লেখ করেছেন। দক্ষিণাবাবু তাঁর বিবাহিত জীবনের কাহিনি বলতে আরম্ভ করলেন। প্রথমেই তাঁর উক্তি 'আমার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর মতো এমন গৃহিণী দুর্লভ ছিল।' কিন্তু 'সখীভাবে প্রণয় সম্ভাষণ' প্রথমা স্ত্রী অনুভব করতেন না। অথবা পছন্দ করতেন না; হেসে পরিহার করতেন। কিন্তু স্বামীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা-প্রেম-স্নেহ এবং দায়িত্ব সবই পূর্ণমাত্রায় ছিল। এবং দক্ষিণাচরণবাবুও তাঁর স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য-প্রেম-ভালোবাসা-দায়িত্ব থেকে কখনো বিচ্যুত হননি মনোরমার সঙ্গে পরিচয়ের পূর্ব পর্যন্ত। মনোরমার সঙ্গে পরিচয়ের পর স্ত্রীর প্রতি দক্ষিণাচরণবাবুর অনুরাগ ও আকর্ষণ নিষ্প্রভ হয়ে আসছিল এবং কর্তব্যে ও দায়িত্বে কিছুটা উদাসীনতাও দেখা যাচ্ছিল। তাঁর স্ত্রী তা বুঝেছিলেন এবং জানতেন তাঁর মৃত্যুর পর মনোরমাই এই ঘরের গৃহিণী হয়ে আসবে; তা সত্বেও প্রথমা স্ত্রীর প্রেম-ভালোবাসা-স্নেহ পূর্বের মতোই প্রবহমান ছিল। অন্যদিকে তাঁর স্বামীকে মনোরমার সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ দিতেন এমন কি তাড়নাও দিতেন। দক্ষিণাচরণবাবু স্ত্রীর মনোভাব বুঝতে পারেননি। তিনি প্রায়ই ছলনা ও মিথ্যার আশ্রয় নিতেন। কিন্তু পরবর্তী জীবনে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ডাক্তারের কাছে তাঁর মন্তব্য 'আমি নির্বোধ, মনে করিতাম তিনি নির্বোধ।' স্ত্রীর প্রতি সেবাকার্যে ও কর্তব্যে ক্লান্তি, এই নিয়ে দক্ষিণাচরণবাবুর মনে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। দক্ষিণাবাবুর নিজের উক্তি-'এই আরোগ্য-আশাহীন সেবাকার্যে আমি মনে মনে

পরিশ্রান্ত হইয়া গিয়াছিলাম। এই কার্যে ভঙ্গ দিব, এমন কল্পনাও আমার মনে ছিল না; অথচ চিরজীবন এই চিররুগণকে লইয়া যাপন করিতে হইবে, এ কল্পনাও আমার কাছে পীড়াজনক হইয়াছিল।' স্ত্রীর প্রতি তাঁর স্বাভাবিক অনুরাগ ও আকর্ষণ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছিল; তাঁর অবচেতন মনে তা সুপ্ত ছিল এবং যখনই চেতনায় সাড়া দিত তখনই এই ভাবনা থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য বলতেন 'যতদিন এই দেহে প্রাণ আছে-এই জীবনে আর কাহাকেও ভালবাসিতে পারিব না।' এই ধরনের মানসিক অবস্থা compulsive obsession -এ আক্রান্ত মনোরোগীদের মধ্যে দেখা দেয়। তাঁর স্ত্রী সবসময়ই স্বামীর এই ধরনের উক্তি হেসে উড়িয়ে দিতেন। গল্পে আছে ''প্রতিবাদ স্বরূপে একটি কথামাত্র না বলিয়া কেবল তাঁহার হাসির দ্বারা জানাইলেন,-'কোন কালে ভু লিবে না, ইহা কখনো সম্ভব নহে এবং প্রত্যাশাও করি না।'' দক্ষিণাবাবুর উত্তর জীবনে যা ঘটতে যাচ্ছে, তা যেন তাঁর স্বামীর মনে কোনো অনুশোচনা বা খেদ না রাখে, তারই জন্য হয়তো এই কথা বলতেন। দক্ষিণাবাবুর চারিত্রিক গঠন ও মানসিক অবস্থা তাঁর প্রথমা স্ত্রী ভালো করেই বুঝেছিলেন। দক্ষিণাবাবুর কথাতেই আছে, আমার সেবার মধ্যে সেই আন্তরিক শ্রান্তি নিশ্চয়ই তিনি দেখিতে পাইয়াছিলেন। তখন জানিতাম না কিন্তু এখন সন্দেহমাত্র নাই যে, তিনি আমাকে যুক্তাক্ষরহীন প্রথম ভাগ শিশুশিক্ষার মতো অতি সহজে বুঝিতেন। সেইজন্য যখন উপন্যাসের নায়ক সাজিয়া গম্ভীরভাবে তাঁহার নিকট কবিত্ব ফলাইতে যাইতাম তিনি এমন সুগভীর স্নেহ অথচ অনিবার্য কৌতু কের সহিত হাসিয়া উঠিতেন। আমার নিজের অগোচর অন্তরের কথাও অন্তর্যামীর ন্যায় তিনি সমস্তই জানিতেন; এ কথা মনে করিলে আজও লজ্জায় মরিয়া যাইতে ইচ্ছা করে। দক্ষিণাচরণবাবু দ্বিতীয়বার দারগ্রহণের পর তাঁর মধ্যে মানসিক রোগ দেখা দিল। রুগণ স্ত্রীকে ছলনা, সেবাকাজে অবহেলা এবং অন্য নারীর প্রতি আকর্ষণ জন্মেছিল, এই অনুশোচনা বিবেক-দংশন নৈতিক-অবনতি ও অপরাধবোধ তাঁকে তাড়না করছিল, যার জন্য তিনি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গল্পের প্রথমদিকে শারীরিক রোগের বর্ণনা আছে। তাহার পর, আজ বছর চারেক হইল আমাকে সাংঘাতিক রোগে ধরিল। ওষ্ঠব্রণ হইয়া জ্বরবিকার হইয়া, মরিবার দাখিল হইলাম। বাঁচিবার আশা ছিল না। একদিন এমন হইল যে, ডাক্তারে জবাব দিয়া গেল। এমন সময় আমার এক আত্মীয় কোথা হইতে ব্রহ্মচারী আনিয়া উপস্থিত করিল; সে গব্যঘৃতের সহিত একটা শিকড় বাটিয়া

আমাকে খাওয়াইয়া দিল। ঔষধের গুণেই হউক বা অদৃষ্টক্রমেই হউক সে-যাত্রা বাঁচিয়া গেলাম। এখানে ওষ্ঠব্রণের উল্লেখ আছে, ওষ্ঠব্রণ অর্থাৎ Erysipela haemolyter streptococcal infection ধরে নেওয়া যেতে পারে অসুখের বর্ণনানুয়ায়ী। তখনকার দিনে সুনিশ্চিত ভাবে আরোগ্যলাভ করার মতো ঔষধ ডাক্তারদের হাতে ছিল না। Antibiotic তো দূরের কথা Sulphonamides তখনও আবিষ্কৃ ত হয়নি। বিজ্ঞানী Gelmo Sulphonamides উনিশশো আটে প্রথম বিশ্লেষণ করেছেন। ১৯৩৫-এ বিজ্ঞানী Domagk তার কার্যকারিতা প্রদর্শন করেন। 'নিশীথে' গল্প মাঘ ১৩০১ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ ১৮৯৫-তে রচিত। আজকালকার আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি তখন আতু রঘরে। 'ডাক্তারে জবাব দিয়া গেল' এই ধরনের উক্তি তখন প্রায়ই শোনা যেত। গল্প উপন্যাসেও উল্লেখিত হতো। অর্থাৎ ডাক্তারের আর করার কিছু নেই। দক্ষিণাচরণবাবু এক ব্রহ্মচারীর টোটকা ওষুধ খেয়ে অথবা ভাগ্যক্রমেই সেরে উঠলেন। কিছু ভেষজ ওষুধ আছে যে কীভাবে অসুখ প্রতিরোধ করে বা নিরাময় করে তা অজানা রয়ে গেছে এবং এমন গাছ-গাছড়া শিকড় ফল বীজ ইত্যাদি আছে যা রোগ সারাবার জন্য বিশেষভাবে পল্লীগ্রামের মানুষ ও আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত আছে। আজকাল Anthropo botany বলে একটা কথা শোনা যাচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানেও empirical use বলে একটি কথা আছে। অর্থাৎ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান আহরণ করে কোনো জিনিস রোগ সারাবার জন্য প্রয়োগ। 'ওষুধের গুণেই হউক বা অদৃষ্টক্রমেই হউক সে-যাত্রা বাঁচিয়া গেলাম।' বিজ্ঞান-মনস্ক ও যুক্তিবাদী রবীন্দ্রনাথ এই উক্তি দক্ষিণাচরণবাবুকে দিয়ে করিয়েছেন। ব্রহ্মচারী প্রদত্ত শিকড়ের ওপর খুব আস্থা প্রকাশিত হয়নি। কী করে তিনি রোগমুক্ত হলেন তা নিয়ে তাঁর মনে অজ্ঞতা থেকে গেছে। হয়তো বা শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য সেরে উঠেছেন, যা তিনি অদৃষ্ট বলে বর্ণনা করেছেন। অসুস্থ অবস্থায় সন্তান-সম্ভাবনাকালে তাঁর স্ত্রী আহার নিদ্রা ত্যাগ করে স্বামীকে শুশ্রুষা করেছেন, নিজের শরীরের প্রতি কোনো যত্ন বা খেয়াল ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়রোগের সময় আমার স্ত্রী অহর্নিশি এক মুহূর্তের জন্য বিশ্রাম করেন নাই। সেই কটাদিন একটি অবলা স্ত্রীলোক, মানুষের সামান্য শক্তি লইয়া প্রাণপণ ব্যাকু লতার সহিত, দ্বারে সমাগত যমদূতগুলোর সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ করিয়াছিলেন। তাঁহার সমস্ত প্রেম, সমস্ত হৃদয়, সমস্ত যত্ন দিয়া আমার এই অযোগ্য প্রাণটাকে যেন বক্ষের শিশুর

মত দুই হস্তে ঝাঁপিয়া ঢাকিয়া রাখিয়াছিলেন। আহার ছিল না, নিদ্রা ছিল না, জগতের তার কোন কিছুর প্রতি দৃষ্টি ছিল না। দক্ষিণাবাবু 'অযোগ্য প্রাণ' বলে নিজেকে আখ্যাত করেছেন। এটা তাঁর আত্মধিক্কার। স্ত্রীকে তাঁর প্রতিশ্রুতি, ছলনা, মিথ্যা আশ্বাস এবং দ্বিচারিতার জন্য তাঁর মনে অনুশোচনা ও পাপবোধ জন্মে ছিল এবং নিজেকে অপয়া মনে করতেন। গর্ভবতী থাকাকালীন উদ্বেগ, অনিয়ম, রাত্রিজাগরণ ও অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য তাঁর স্বাস্থ্যহানি হয় ও এক মৃত-সন্তান প্রসব করেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় দক্ষিণাচরণবাবুর উক্তি যম তখন পরাহত ব্যাঘ্রের ন্যায় আমাকে তাঁহার কবল হইতে ফেলিয়া দিয়া চলিয়া গেলেন। কিন্তু, যাইবার সময় আমার স্ত্রীকে একটা প্রবল থাবা মারিয়া চলিয়া গেলেন। আমার স্ত্রী তখন গর্ভবতী ছিলেন, অনতিকাল পরে এক মৃত সন্তান প্রসব করিলেন। তাহার পর হইতেই তাঁহার নানা প্রকার জটিল ব্যামোর সূত্রপাত হইল। তখন আমি তাঁহার সেবা আরম্ভ করিয়া দিলাম। উদ্বেগ, অত্যধিক পরিশ্রম অনিয়ম ইত্যাদির জন্য মৃত-সন্তান জন্মাতে পারে। জটিল রোগ, জ্বর, অত্যধিক দুর্বলতা এবং মধ্যে মধ্যে আকস্মিক প্রচণ্ড ব্যথার উদ্ভব, গল্পে এই লক্ষণগুলোর উল্লেখ রয়েছে। প্রসবোত্তর কালে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যাকে আমরা Postnatal Complication বলে থাকি। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে এই অবস্থাকে সূতিকা বলা হয়ে থাকে। পিউপেরিয়েল সেপসিসে (Peuparial sepsis) জ্বর রক্তাল্পতা ও শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার স্বল্পতায় নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, জটিল রোগের ব্যাখ্যা এভাবে কারা যেতে পারে। অনেক চিকিৎসা করার পর তাঁর স্ত্রীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেল না। দক্ষিণাবাবুর উক্তি, ''বহু চিকিৎসায় আমার স্ত্রীর রোগ-উপশমের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। ডাক্তার বলিল, 'একবার বায়ু পরিবর্তন করিয়া দেখিলে ভালো হয়।' আমি স্ত্রীকে লইয়া এলাহাবাদে গেলাম।'' একশো বছর আগে অব্যর্থ ও শক্তিশালী ওষুধ আবিষ্কৃ ত হয়নি ও রোগনির্ণয়ের জন্য আজকালকার মতো বীক্ষণাগার রঞ্জনরশ্মি ও বিবিধ electronics পদ্ধতির আবির্ভাব ঘটেনি। রঞ্জনরশ্মি আবিষ্কার হয়েছে ১৮৯৬-তে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রয়োগ হয়েছে তার কয়েকবছর পর। আবিষ্কারক উইলহেলম রনরাড রন্টজেনকে উনিশশো একে পদার্থবিদ্যায় প্রথম নোবেল পুরস্কারে ভূ ষিত করা হয়। এই বছর থেকেই নোবেল পুরস্কার দেওয়া আরম্ভ হয়।

এলাহাবাদ যাওয়ার পর থেকে দক্ষিণাবাবুর জীবন নতু ন খাতে বইতে শুরু করে। এলাহাবাদে স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে দক্ষিণাবাবুর মানসিক দ্বন্দ্ব, স্ত্রীর প্রতি ছলনা, লুকোচু রি, ঘটনা চেপে যাওয়া, দ্বিচারিতা, রুগণ স্ত্রীকে নিয়ে ক্লান্তি ও হতাশা দেখতে পাই। গল্পের বর্ণনায়, ''এইখানে দক্ষিণাবাবু হঠাৎ চমকিয়া চু প করিলেন। সন্দিগ্ধভাবে আমার মুখের দিকে চাহিলেন, তাহার পর দুই হাতের মধ্যে মাথা রাখিয়া ভাবিতে লাগিলেন। আমিও চু প করিয়া রহিলাম। কু লুঙ্গিতে কেরোসিন মিটমিট করিয়া জ্বলিতে লাগিল এবং নিস্তব্ধ ঘরে মশার ভনভন শব্দ সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল। হঠাৎ মৌনভঙ্গ করিয়া দক্ষিণাবাবু বলিতে আরম্ভ করিলেন- 'সেখানে হারান আমার স্ত্রীকে চিকিৎসা করিতে লাগিলেন।'' দীর্ঘকাল চিকিৎসা করার পর সুস্থ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। এখানে আরেকটি প্রসঙ্গের উপস্থাপন করছি, যা আমার আলোচনার সীমাবদ্ধতার বাইরে। রবীন্দ্রনাথ হাস্যকৌতু ক রচনা ছাড়াও গল্পে-উপন্যাসে-নাটকে-কবিতায় ও ছড়ার মধ্যে মধ্যে সুনিপুণভাবে অন্তঃসলিলার মতো কৌতু ক, পরিহাস ও শান্ত হাস্যরসের প্রয়োগ করেছেন মূল রচনার রসধারা ক্ষু ণ্ণ না করেও। এই গল্পে এই ধরনের প্রয়োগ আছে ''তখন একদিন আমার স্ত্রী আমাকে বলিলেন, 'যখন ব্যামোও সারিবে না এবং শীঘ্র আমার মরিবার আশাও নাই তখন আর কতদিন এই জীবন্মৃতকে লইয়া কাটাইবে। তু মি আর-একটা-বিবাহ করো।'... আমি উপন্যাসের প্রধান নায়কের ন্যায় গম্ভীর সমুচ্চভাবে বলিতে লাগিলাম, 'যতদিন এই দেহে জীবন আছে- ... এ জীবনে আর-কাহাকেও ভালোবাসিতে পারিব না।' শুনিয়া আমার স্ত্রী ভারি হাসিয়া উঠিলেন। তখন আমাকে ক্ষান্ত হইতে হইল।'' হারাণ ডাক্তার যদিও একজন ডাক্তার কিন্তু গল্পে একজন চিকিৎসকের পেশাগত গুণাবলি ও দায়িত্ব থেকে তাঁর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক স্বার্থই প্রাধান্য লাভ করেছে। এই ডাক্তারকে আমরা অতি সাধারণ একজন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ভূ মিকায় দেখি। হারাণ ডাক্তার আমাদের স্বজাতীয়। তাঁহার বাড়ীতে আমার প্রায়ই নিমন্ত্রণ থাকিত। কিছুদিন যাতায়াতের পর ডাক্তার তাঁহার মেয়েটির সঙ্গে আমার পরিচয় করাইয়া দিলেন। মেয়েটি অবিবাহিত; তাঁহার বয়স পনেরো হইবে। ডাক্তার বলেন, তিনি মনের মত পাত্র পান নাই বলিয়া বিবাহ দেন নাই।' যার ঘরে রুগণ স্ত্রী বর্তমান এবং তিনি চিকিৎসা করিয়ে যাচ্ছেন অথচ সেই ডাক্তারই রোগিণীর স্বামীর কাজে রোগিণীর মৃত্যুর পর তাঁর কন্যার বিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। এখানে ডাক্তারের স্বার্থের কাছে তাঁর মানবিক মূল্যবোধ ও চিকিৎসকের নৈতিক দায়বদ্ধতা নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। দক্ষিণাবাবুর উক্তি 'হারাণ ডাক্তার প্রায়ই মাঝে মাঝে বলিতেন, যাহাদের রোগ আরোগ্য হইবার কোনো সম্ভাবনা নাই, তাহাদের পক্ষে মৃত্যুই ভালো; কারণ, বাঁচিয়া তাহাদের নিজেরও সুখ নাই, অন্যেরও অসুখ। কথাটা সাধারণভাবে বলিতে দোষ নাই, তথাপি আমার স্ত্রীকে লক্ষ করিয়া এমন

প্রসঙ্গ উত্থাপন করা তাঁহার উচিত হয় নাই। কিন্তু, মানুষের জীবনমৃত্যু সম্বন্ধে ডাক্তারদের মন এমন অসাড় যে, তাঁহারা ঠিক আমাদের মনের অবস্থা বুঝিতে পারে না।'' এই উক্তি হারাণ ডাক্তারের চরিত্রের যে দিকটি উন্মোচিত করেছে, তা স্ববিশ্লেষিত; বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। দক্ষিণাবাবুর মনে ডাক্তারের জীবন ও মৃত্যুর অনুভূ তি ও উপলব্ধির প্রতি বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করেছিল। সে যুগের সামাজিক প্রথা, বিধিনিষেধ সংস্কার, রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা ইত্যদি অমান্য করে চলা বা লঙ্ঘন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে দুরূহ ও কঠিন ছিল। ডাক্তারবাবুর কন্যা মনোরমা দক্ষিণাবাবুর স্ত্রীকে দেখবার জন্য আসতে চাইলে, দক্ষিণাবাবু সেই প্রস্তাব আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি; কারণ তাঁর মনে এক অপরাধবোধ ছিল। একদিন সন্ধ্যায় মনোরমা বাড়িতে আসেন, সেদিন দক্ষিণাবাবুর স্ত্রী অত্যন্ত কাতর ছিলেন। সেদিন আমার স্ত্রীর বেদনা অন্যদিন অপেক্ষা কিছু বাড়িয়া উঠিয়াছিল। যেদিন তাঁহার ব্যথা বাড়ে সেদিন তিনি অত্যন্ত স্থির নিস্তব্ধ হইয়া থাকেন; কেবল মাঝে মাঝে মুষ্টি বদ্ধ হইতে থাকে...। ঘরে কোন সাড়া ছিল না, আমি শয্যাপ্রান্তে চু প করিয়া বসিয়া ছিলাম; সেদিন আমাকে বেড়াইতে যাইতে অনুরোধ করেন এমন সামর্থ্য তাঁহার ছিল না কিম্বা হয়তো বড়ো কষ্টের সময় আমি কাছে থাকি, এমন ইচ্ছা তাঁহার মনে মনে ছিল। চোখে লাগিবে বলিয়া কেরোসিনের আলোটা দ্বারের পার্শ্বে ছিল। ঘর অন্ধকার এবং নিস্তব্ধ। কেবল এক একবার যন্ত্রণার কিঞ্চিৎ উপশমে আমার স্ত্রীর গভীর দীর্ঘনিশ্বাস শুনা যাইতেছিল। ব্যামোর বর্ণনা থেকে ধরে নেওয়া যেতে পারে ব্যথাটি কোন ধরনের Colic pain, intestinal, billialy বা renal colic/ billiary colic - এর সম্ভাবনাই বেশি। Collicystitis অথবা Gall bladder - এর অসুস্থতায় নারীরাই পুরুষদের চেয়ে বেশি আক্রান্ত হন। সন্তান প্রসবের পর নানা রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে বিশেষভাবে শতবর্ষ আগে। সন্তানধারণের সময় রক্তের Cholesterol -এর স্বাভাবিক মাত্রা বেড়ে যেতে পারে এবং তা থেকেও Gall bladder -এ পাথরের উৎপত্তি হতে পারে। জ্বর ভাবাপন্ন অবস্থায় বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার স্বল্পতায় রোগ বীজাণুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ কারণগুলো থেকেও Cholicystitis হওয়া সম্ভব। তীব্র বেদনায় তিনি যখন কষ্ট পাচ্ছিলেন-

এমন সময় মনোরমা ঘরের প্রবেশদ্বারে দাঁড়াইলেন। বিপরীত দিক হইতে কেরোসিনের আলো তাঁহার মুখের উপর পড়িল। আলোআঁধারে লাগিয়া তিনি কিছুক্ষণ ঘরের কিছুই দেখিতে না পাইয়া দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া ইতস্তত করিতে লাগিলেন। আমার স্ত্রী চমকিয়া আমার হাত ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, 'ওকে!'-তাঁহার সেই দুর্বল অবস্থায় হঠাৎ অচেনা লোক দেখিয়া ভয় পাইয়া আমাকে দুই-তিনবার অস্ফু ট স্বরে প্রশ্ন করিলেন, 'ও কে! ও কে গো!' আমার কেমন দুর্বুদ্ধি হইল আমি প্রথমেই বলিয়া ফেলিলাম, 'আমি চিনি না।' বলিবামাত্রই কে যেন আমাকে কশাঘাত করিল। পরের মুহূর্তেই বলিলাম, 'ওঃ, আমাদের ডাক্তারবাবুর কন্যা।' স্ত্রী একবার আমার মুখের দিকে চাহিলেন; আমি তাহার মুখের দিকে চাহিতে পারিলাম না। পরক্ষণেই তিনি ক্ষীণ স্বরে অভ্যাগতকে বলিলেন, 'আপনি আসুন।' আমাকে বলিলেন, 'আলোটা ধরো।' এখানে দক্ষিণাচরণবাবু ছলনার আশ্রয় নিয়ে বিবেকের দংশনে সত্য কথা বলতে হয়েছিল। দক্ষিণাবাবুর ভেতরে এক দ্বন্দ্ব চলছিল এবং স্ত্রীর কাছে তা প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল। তখন তিনি বুঝতে পারেননি কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পর তা হৃদয়ঙ্গম হয়েছিল। সেই অন্যায় আচরণ ও অপরাধবোধ তাঁকে তাড়না করছিল। এই সময় হারাণ ডাক্তার এসে দুই শিশি ওষুধ দেন, একটি নীল শিশি মালিশের জন্য; অন্যটি খাবার। ডাক্তারবাবু মনোরমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার সময় বারবার সাবধান করে দিয়ে যান যে নীল শিশির ওষুধ ভয়ানক বিষ, ভু ল যেন না হয়। দক্ষিণাবাবুকেও সতর্ক করেছিলেন। স্ত্রীর অনুরোধে ডাক্তারবাবু দক্ষিণাবাবুকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। ডাক্তারের বাড়ি থেকে আহার পর্ব সেরে ফিরতে রাত হল। এসে দেখেন ''আমার স্ত্রী ছটফট করিতেছেন। অনুতাপে বিদ্ধ হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম 'তোমার কি ব্যথা বাড়িয়াছে।' তিনি উত্তর করিতে পারিলেন না, নীরবে আমার মুখের দিকে চাহিলেন। তখন তাঁহার কণ্ঠরোধ হইয়াছে। আমি তৎক্ষণাৎ সেই রাত্রেই ডাক্তারকে ডাকিয়ে আনিলাম। ডাক্তার প্রথমটা আসিয়া অনেকক্ষণ কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। অবশেষে জিজ্ঞাসা করিলেন, 'সেই ব্যথাটা কি বাড়িয়া উঠিয়াছে। ঔষধটা একবার মালিশ করিলে হয় না?'' বলিয়া শিশিটা টেবিল হইতে লইয়া দেখিলেন, সেটা খালি। আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, 'আপনি কি ভু ল করিয়া এই ওষুধটা খাইয়াছেন?' আমার স্ত্রী ঘাড় নাড়িয়া নীরবে জানাইলেন, 'হাঁ।'

ডাক্তার তৎক্ষণাৎ গাড়ি করিয়া তাঁহার বাড়ি হইতে পাম্প আনিতে ছুটিলেন। আমি অর্ধমূর্ছিতের ন্যায় আমার স্ত্রীর বিছানার উপর গিয়া পড়িলাম। 'তখন, মাতা তাঁহার পীড়িত শিশুকে যেমন করিয়া সান্ত্বনা করে তেমনি করিয়া তিনি আমার মাথা তাঁহার বক্ষের কাছে টানিয়া লইয়া দুই হস্তের...স্পর্শের দ্বারাই আমাকে বারংবার করিয়া বলিতে লাগিলেন, 'শোক করিও না, ভালই হইয়াছে, তু মি সুখী হইবে, এবং সেই মনে করিয়া আমি সুখে মরিলাম।' ''ডাক্তার যখন ফিরিলেন, তখন জীবনের সঙ্গে সঙ্গে আমার স্ত্রীর সকল যন্ত্রণার অবসান হইয়াছে।'' এখানে মালিশের ওষুধ ও খাবার ওষুধের কথা উল্লেখিত হয়েছে। তখনকার দিনে যেকোনো ধরনের শারীরিক ব্যথা প্রশমিত করার জন্য মালিশের অত্যধিক প্রচলন ছিল। Irritants বা Counter irritant drug ব্যবহৃত হতো। Turpentine oil, Methyl Salicylate দিয়ে তৈরি মলম, Belladona lininent,আজকাল সেগুলোকে Old fashioned drug বলা হয়ে থাকে-ইত্যাদি ব্যবহার করা হত। Turpentine, Methyl Salicylates Belladona অতিমাত্রায় খেলে বিষক্রিয়া হয়। ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তরে দক্ষিণাবাবুর স্ত্রী ইচ্ছাকৃ ত বিষপান ভু ল-ক্রমে হয়েছে বলে ইঙ্গিত করেন; কারণ আত্মহনন প্রকাশ পেলে দক্ষিণাবাবুর উত্তর জীবনে নানারকম সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং পরবর্তী জীবনে সুখী না হতে পারেন। দক্ষিণাবাবু মনোরমাকে বিয়ে করে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু বিবাহ পূর্ববর্তী মনোরমা ও বিবাহোত্তর মনোরমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে,- 'কিন্তু আমি যখন তাহাকে আদরের কথা বলিতাম, প্রেমালাপ করিয়া তাঁহার হৃদয় অধিকার করিবার চেষ্টা করিতাম, সে হাসিত না, গম্ভীর হইয়া থাকিত। তাঁহার মনের কোথায় কোনখানে কী খটকা লাগিয়াছিল, আমি কেমন করিয়া বুঝিব?' মনোরমা প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনা সহজভাবে নিতে পারেনি; পরোক্ষভাবে সেও যে এই মৃত্যুর জন্য কিছুটা দায়ী, এই সংশয় তার মধ্যে ছিল। মনোরমাকে বিয়ে করার পর থেকেই দক্ষিণাবাবু মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। নিম্নবর্ণিত ঘটনা থেকেই রোগের লক্ষণ ও মানসিক বিকার প্রথম প্রকাশ পায়। সেদিনও বৈকালে আমি কিছু মদ খাইয়াছিলাম, মনটা বেশ একটু তরলাবস্থায় ছিল। অন্ধকার যখন চোখে সহিয়া আসিল তখন বনচ্ছায়াতলে পাণ্ডুর বর্ণে অঙ্কিত সেই শিথিল-অঞ্চল শ্রান্তকায় রমণীর আবছায়া মূর্তিটি আমার মনে এক অনিবার্য আবেগের সৃষ্টি করিল। মনে হইল, ও যেন একটা ছায়া, ওকে যেন কিছুতেই দুই

বাহু দিয়া ধরিতে পারিব না।... সাদা পাথরের উপর সাদা শাড়ি পরা সে শ্রান্তশয়ান রমণীর মুখের উপর জ্যোৎস্না আসিয়া পড়িল। আমি আর থাকিতে পারিলাম না। কাছে আসিয়া দুই হাতে তাহার হাতটি তু লিয়া ধরিয়া কহিলাম, 'মনোরমা, তু মি আমাকে বিশ্বাস কর না, কিন্তু তোমাকে আমি ভালবাসি। তোমাকে আমি কোনোকালে ভু লিতে পারিব না। কথাটি বলিবামাত্র চমকিয়া উঠিলাম; মনে পড়িল, ঠিক এই কথাটা আর একদিন আর কাহাকেও বলিয়াছি! এবং সেই মুহূর্তেই বকু লগাছের শাখার উপর দিয়া ঝাউগাছের মাথার উপর দিয়া ,কৃ ষ্ণপক্ষের পীতবর্ণ ভাঙ্গা চাঁদের নিচে দিয়া গঙ্গার পূর্বপার হইতে গঙ্গার সুদূর পশ্চিম পার পর্যন্ত হাহা-হাহা-হাহা করিয়া অতি দ্রুতবেগে একটা হাসি বহিয়া গেল। সেটা মর্মভেদী হাসি কি অভ্রভেদী হাহাকার, বলিতে পারি না। আমি তদ্দণ্ডেই পাথরের বেদীর উপর হইতে মূর্ছিত হইয়া নীচে পড়িয়া গেলাম। মূর্ছাভঙ্গে দেখিলাম, আমার ঘরে বিছানায় শুইয়া আছি। স্ত্রী জিজ্ঞাসা করিলেন, 'তোমার হঠাৎ এমন হইল কেন?' 'আমি কাঁপিয়া উঠিয়া বলিলাম, 'শুনিতে পাও নাই, সমস্ত আকাশ ভরিয়া হাহা করিয়া একটা হাসি বহিয়া গেল?' স্ত্রী হাসিয়া কহিলেন, 'সে বুঝি হাসি? সার বাঁধিয়া দীর্ঘ একঝাঁক পাখি উড়িয়া গেল, তাহাদেরই পাখার শব্দ শুনিয়াছিলাম। তু মি এত অল্পেই ভয় পাও?' দিনের বেলায় স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম, পাখির ঝাঁক উড়িবার শব্দই বটে, এই সময় উত্তরদেশ হইতে হংসশ্রেণী নদীর চরে চরিবার জন্য আসিতেছে। কিন্তু সন্ধ্যা হইলে সে বিশ্বাস রাখিতে পারিতাম না। তখন মনে হইত, চারিদিকে সমস্ত অন্ধকার ভরিয়া ঘন হাসি জমা হইয়া রহিয়াছে, সামান্য একটি উপলক্ষে হঠাৎ আকাশ ভরিয়া অন্ধকার বিদীর্ণ করিয়া ধ্বনিত হইয়া উঠিবে। অবশেষে এমন হইল, সন্ধ্যার পর মনোরমার সহিত একটা কথা বলিতে আমার সাহস হইত না। এই প্রাকৃ তিক ঘটনা Auditory Hallucination -এর জন্য অতিপ্রাকৃ ত বা অলৌকিক ঘটনা রূপে প্রতিভাত হয়েছে। তাঁর পরলোকগতা স্ত্রীর হাসির কথা অবচেতন মনে বিরাজ করছিল। দক্ষিণাবাবু বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর সব উক্তি তাঁর প্রথমা স্ত্রী সাময়িক মোহ বা ভাবাবেগ বলে উড়িয়ে দিতেন। এই গল্পে আরো কিছু hallucination -এর ঘটনা আছে,

সেই মরুবালুকা বেষ্টিত নিস্তরঙ্গ নিষুপ্ত নিশ্চল জলটু কু র উপরে একটি সুদীর্ঘ জ্যোৎস্নার রেখা মূর্ছিতভাবে পড়িয়া আছে। সেই জায়গাটাতে আসিয়া আমরা দুই জনে দাঁড়াইলাম-মনোরমা কি ভাবিয়া আমার মুখের দিকে চাহিল, তাঁহার মাথার উপর হইতে শালটা হঠাৎ খসিয়া পড়িল। আমি তাঁহার সেই জ্যোৎস্না বিকশিত মুখখানি তু লিয়া ধরিয়া চু ম্বন করিলাম। সেই সময় সেই জনমানব শূন্য নিঃসঙ্গ মরুভূ মির মধ্যে গম্ভীরস্বরে কে তিনবার বলিয়া উঠিল, 'ও কে? ও কে? ও কে? আমি চমকিয়া উঠিলাম, আমার স্ত্রীও কাঁপিয়া উঠিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই আমরা দুজনেই বুঝিলাম, এই শব্দ মানুষিক নহে, অমানুষিকও নহে-চরবিহারী জলচর পাখির ডাক। হঠাৎ এত রাতে তাহাদের নিরাপদ নিভৃ ত নিবাসের কাছে লোক সমাগম দেখিয়া চকিত হইয়া উঠিয়াছে। গল্পের এই অংশ Auditory Hallucination এক বাস্তব রূপায়ণ। এর পরেই যে বর্ণনা আছে, তাতে Auditory ও Visual Halluicination দুটোই আছে। সেই ভয়ের চমক খাইয়া আমরা দুজনেই তাড়াতাড়ি বোটে ফিরিলাম। রাত্রে বিছানায় আসিয়া শুইলাম; শ্রান্ত শরীরে মনোরমা অবিলম্বে ঘুমাইয়া পড়িল। তখন অন্ধকারে কে একজন আমার মশারির কাছে দাঁড়াইয়া সুষুপ্ত মনোরমার দিকে একটিমাত্র দীর্ঘ শীর্ণ অস্থিসার অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া যেন আমার কানে কানে অত্যন্ত চু পি চু পি অস্ফু টকণ্ঠে কেবলই জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, 'ও কে? ও কে? ও কে গো?' তাড়াতাড়ি উঠিয়া দেশলাই জ্বালাইয়া বাতি ধরাইলাম। সেই মূহূর্তেই ছায়ামূর্তি মিলাইয়া গিয়া, আমার মশারি কাঁপাইয়া, বোট দুলাইয়া, আমার সমস্ত ঘর্মাক্ত শরীরের রক্ত হিম করিয়া দিয়া হাহা-হাহা-হাহা করিয়া একটা হাসি অন্ধকার রাত্রির ভিতর দিয়া বহিয়া চলিয়া গেল। পদ্মা পার হইল, পদ্মার চর পার হইল, তাহার পরবর্তী সমস্ত সুপ্ত দেশ গ্রাম নগর পার হইয়া গেল-যেন তাহা চিরকাল ধরিয়া দেশদেশান্তর লোকলোকান্তর পার হইয়া ক্রমশ ক্ষীণ ক্ষীণতর ক্ষীণতম হইয়া অসীম সুদূরে চলিয়া যাইতেছে; ক্রমে যেন তাহা জন্মমৃত্যুর দেশ ছাড়াইয়া গেল; ক্রমে তাহা যেন সূচির অগ্রভাগের ন্যায় ক্ষীণতম হইয়া আসিল; এত ক্ষীণ শব্দ কখনো শুনি নাই, কল্পনা করি নাই; আমার মাথার মধ্যে যেন অনন্ত আকাশ রহিয়াছে এবং সেই শব্দ যতই দূরে যাহিতেছে কিছুতেই আমার মস্তিষ্কের সীমা ছাড়াইতে পারিতেছে না; অবশেষে যখন একান্ত অসহ্য হইয়া আসিল তখন ভাবিলাম, আলো নিবাইয়া না দিলে ঘুমাইতে পারিব না। যেমনি আলো নিবাইয়া শুইলাম অমনি আমার মশারির ঠি

পাশে, আমার কানের কাছে, অন্ধকারে আবার সেই অবরুদ্ধ স্বর বলিয়া উঠিল, 'ও কে, ও কে, ও কে গো।' আমার বুকের রক্তের ঠিক সমান তালে ক্রমাগতই ধ্বনিত হইতে লাগিল, 'ও কে, ও কে, ও কে গো।' 'ও কে, ও কে, ও কে গো।' সেই গভীর রাত্রে নিস্তব্ধ বোটের মধ্যে আমার গোলাকার ঘড়িটাও সজীব হইয়া উঠিয়া তাহার ঘণ্টার কাঁটা মনোরমার দিকে প্রসারিত করিয়া শেলফের ভিতর হইতে তালে তালে বলিতে লাগিল, ' ও কে, ও কে, ও কে গো! ও কে, ও কে গো।' এই উদ্ধৃ তাংশে Visual ও Auditory Hallucination -এরও ইঙ্গিত আছে। দক্ষিণাবাবুর আরেকটি কথায় Compulsive Obsession -এর আভাস আছেদক্ষিণাচরণ বাবু আর-একবার জল খাইয়া বলিলেন, 'উঃ, বড়ো গরম!' বলিয়া দ্রুত বাহির হইয়া বারকয়েক বারান্দায় পায়চারি করিয়া আসিয়া বসিলেন। বেশ বোঝা গেল, তিনি বলিতে চাহেন না কিন্তু আমি যেন জাদু করিয়া তাঁহার নিকট হইতে কথা কাড়িয়া লইতেছি। আবার আরম্ভ করিলেনদিনের আলো নিবে আসার পরই দক্ষিণাবাবুর মানসিক বিকার দেখা দিত। আলো-আঁধারে মনোরমার সঙ্গে তাঁর প্রথম স্ত্রীর দেখা হয়েছিল। সেই রাত্রেই তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। দিনাবসানের পরই দক্ষিণাবাবু মানসিক রোগে আক্রান্ত হতেন এবং রাত্রি অবসানের পরই তিনি স্বাভাবিক আচরণ করতেন। এই স্বাভাবিক মনস্কতা মানসিক রোগগ্রস্তদের Lucid Interval। কাহিনির সমাপ্তিতে ডাক্তারবাবুর বক্তব্যে আছে, বলিতে বলিতে দক্ষিণাবাবু পাংশুবর্ণ হইয়া আসিলেন, তাঁহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইয়া আসিল। আমি তাঁহাকে স্পর্শ করিয়া বলিলাম, 'একটু জল খান।' এমনি সময় হঠাৎ আমার কেরোসিনের শিখাটা দপদপ করিতে করিতে নিবিয়া গেল। হঠাৎ দেখিতে পাইলাম, বাহিরে আলো হইয়াছে। কাক ডাকিয়া উঠিল। দোয়েল শিশ দিতে লাগিল। আমার বাড়ীর সম্মুখবর্তী পথে একটা মহিষের গাড়ির ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ জাগিয়া উঠিল। তখন দক্ষিণাবাবুর মুখের ভাব একেবারে বদল হইয়া গেল। ভয়ের কিছুমাত্র চিহ্ন রহিল না। রাত্রির কু হকে, কাল্পনিক শঙ্কার মত্ততায় আমার কাছে যে এত কথা বলিয়া ফেলিয়াছেন সেজন্য যেন অত্যন্ত লজ্জিত এবং আমার উপর আন্তরিক ত্রু�দ্ধ হইয়া উঠিলেন। শিষ্টসম্ভাষণমাত্র না করিয়া অকস্মাৎ উঠিয়া দ্রুতবেগে চলিয়া গেলেন। সেইদিনই অর্ধরাত্রে আবার আমার দ্বারে আসিয়া ঘা পড়িল, 'ডাক্তার! ডাক্তার!

দক্ষিণাচরণ বাবু শুধু Acute Hallucinosis, Compulsive Obsession -এই ভোগেন নি - Depression, Anxiety, Neurosis, Delusion -এর লক্ষণ রয়েছে। এই লক্ষণাবলি Alcohlism Schizophrenia, Affective Disorder, Prereactive Psychosis রোগীর মধ্যে বিশেষভাবে দেখা যায়। একই ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মনোরোগ একই সঙ্গে সহ-অবস্থান করতে পারে। 'নিশীথে' গল্পে তিনজন ডাক্তারের উল্লেখ আছে। প্রথম ডাক্তার যার কাছে দক্ষিণাচরণবাবু মধ্যরাত্রে নিদ্রাহীনতা ও মানসিক বিভ্রান্তির জন্য যেতেন এবং বিগত জীবনের কথা তিনি অকপটে বলে যেতেন। দ্বিতীয়জন বরানগরের ডাক্তার যিনি তাঁর স্ত্রীকে হাওয়া বদলের পরামর্শ দিয়েছিলেন; তৃ তীয়জন হারাণ ডাক্তার। হারাণ ডাক্তারের মধ্যে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ভূ মিকা, চিকিৎসকের দায়িত্ব ও মানসিক মূল্যবোধকে ছাপিয়ে গেছে; বরানগরের ডাক্তারের পরামর্শের কথা আছে যা তখনকার কালে দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসার একটি বিশেষ নিদান বলে ধরে নেওয়া হতো। প্রথম ডাক্তারের মধ্যে একজন সুচিকিৎসক ও সমাজের একজন দায়িত্বশীল মানুষের গুণাবলির প্রকাশ দেখতে পাই। ডাক্তারদের সম্বন্ধে একটি প্রচলিত কথা মনে করিয়ে দেব - ‘The Doctor has a temper which never tires’. 'নিশীথে' গল্পে রবীন্দ্রনাথ ডাক্তার, রোগ ও মানসিক বিকারকে ভিত্তি করে এবং তৎকালীন সামাজিক ব্যবস্থা ও সংস্কারকে অবলম্বন করে প্রাকৃ তিক ও অতিপ্রাকৃ তিক ঘটনা ও ভাবনার মিলন ঘটিয়েছেন। প্রদোষের আলোছায়ায় ও রাত্রির অন্ধকারের স্তব্ধতায় স্বাভাবিক ঘটনাকে সংশয় ও অস্থির মনস্কতায় Uncanny পরিবেশের সৃষ্টি করেছেন। একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ এই কাহিনির মূল চরিত্র যিনি পরিস্থিতিতে ঘটনাচক্রে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে মনোরোগে আক্রান্ত হন। রবীন্দ্রনাথ মানসিক রোগের উৎপত্তির উৎস, পরিবেশ-প্ররোচিত লক্ষণাবলি, অস্বাভাবিক আচরণ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব যেমন বর্ণনা করেছেন, সেই সঙ্গে সাময়িকভাবে স্বাভাবিক ব্যক্তিতে ফিরে আসা একজন মনোরোগীর সজীব আলেখ্য তাঁর অতু লনীয় ভাষা ও অনুপম কাব্যিক মাধুর্যে এই কাহিনিতে পরিবেশন করেছেন। তাঁর বর্ণনা বাস্তবোচিত। রবীন্দ্রনাথের আগে বাংলা গল্পে এভাবে কোনো মনোরোগীর সাক্ষাৎ আমরা পাই না। এই কল্পকাহিনির মূলে যে কোনো একটি বাস্তব ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল, সেটা বুঝে নিতে আমাদের অসুবিধে হয় না। ৩৪ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, ২০০০

আত্মার আত্মীয় : রবীন্দ্রনাথ ও নীলরতন শ্যামল চক্রবর্তী ‘তাঁর শিল্পের পরম সৌন্দর্য, কাব্যের অনন্য হূদয়গ্রাহিতা, সারা বিশ্বের জন্য তাঁর ভালবাসার গভীর উদ্ভাস, তাঁর দৃষ্টির অসীম ব্যাপ্তি, ধর্মবোধের গভীরতা ও উদার সমর্পণ, এই সব কিছুকে আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি৷ সবিনয়ে বলি, এর জন্য আমি বিশেষভাবে গর্বিত৷ নিজের কাছে ধন্যবাদার্হ৷’১ বন্ধু রবীন্দ্রনাথের সত্তরতম জন্মদিনে কবিকে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন ‘ধন্বন্তরী’ চিকিৎসক ডা. নীলরতন সরকার৷ সেটা ১৯৩১ সাল৷ এর ছ’বছর পরে ১৯৩৭-এ শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে এক সন্ধ্যারাতে বিসর্পরোগে আক্রান্ত হয়ে চেতনা হারালেন রবীন্দ্রনাথ৷ রাতেই খবর গেল কলকাতায়, ডা. সরকারের কাছে৷ পরদিন সকালে সব কাজ ফেলে রেখে আরো কয়েকজন ডাক্তারকে সঙ্গী করে ট্রেন ধরে বোলপুর ছুটে এলেন নীলরতন৷ দিনরাত ক্লান্ত চেষ্টায় বন্ধু র শরীরে বাসা বাঁধা রোগটার বিরুদ্ধে শুরু করলেন লড়াই৷ রাত জেগে বসে আছেন সংজ্ঞাহীন বন্ধু র শয্যার পাশে, নাড়িতে হাত রেখে৷ ‘ধন্বন্তরী’র বিক্রমে পিছু হটল ব্যাধি৷ আড়াইদিন অচেতন অবস্থায় থেকে বন্ধু র চেষ্টায় যমের দুয়ার থেকে জীবনে ফিরে এলেন কবি৷ অচেতনার অন্ধগহ্বর থেকে আশ্চর্য জীবনালোকে ফিরলেন সাতাত্তর বছরের রবি ঠাকু র৷ জিয়নকাঠির জাদুস্পর্শে খুলে গেল সৃজনপ্রতিভার উৎসমুখ৷ নিজেকে ‘রূপনারানের কূ লে জেগে’ উঠতে দেখছেন কবি৷ ছায়াছায়া স্বপ্নের অস্পষ্ট অন্ধকার জগৎ থেকে জীবনের আলোকিত অঙ্গনে ফিরে কবি অনুভব করছেন, ‘এ জগৎ স্বপ্ন নয়৷’ একের পর এক কবিতা আসছে পুনর্জন্ম পাওয়া রবীন্দ্রনাথের চেতনার গভীর থেকে৷ এসব কবিতা নিয়ে ১৯৩৮ এর জুলাই মাসে ‘বিশ্বভারতী’ থেকে প্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথের ‘সেঁজুতি’ কাব্যগ্রন্থ৷ বইটি কবি উৎসর্গ করলেন ‘ডাক্তার সার নীলরতন সরকার বন্ধু বরেষু’ কে৷ ‘সেঁজুতি’-রই একটি কবিতা দিয়ে ১৩৪৫ এর ১লা শ্রাবণ সাজালেন জীবন-ফিরিয়ে দেওয়া বন্ধু কে উৎসর্গের অর্ঘ্য : অন্ধতামসগহ্বর হতে ফিরিনু সূর্যালোকে৷ বিস্মিত হয়ে আপনার পানে হেরিনু নূতন চোখে৷ মর্ত্যের প্রাণরঙ্গভূ মিতে

যে চেতনা সারারাতি সুখদুঃখের নাট্যলীলায় জ্বেলে রেখেছিল বাতি, সে আজি কোথায় নিয়ে যেতে চায় অচিহ্নিতের পারে, নবপ্রভাতের উদয়সীমায় অরূপলোকের দ্বারে৷ আলো আঁধারের ফাঁকে দেখা যায় অজানা তীরের বাসা, ঝিমিঝিমি করে শিরায় শিরায় দূর নীলিমার ভাষা৷ সে ভাষার আমি চরম অর্থ জানি কিবা নাহি জানি ছন্দের ডালি সাজানু তা দিয়ে তোমারে দিলাম আমি৷ রবীন্দ্রনাথ ও নীলরতন, দুজনেই জন্মেছেন একই বছরে৷ ১৮৬১ সালে৷ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের চর্তুদশ সন্তান রবি জন্মেছেন মে মাসের ৭ তারিখে৷ আর নন্দলাল সরকারের দ্বিতীয় সন্তান নীলরতনের জন্ম ১ অক্টোবর৷ বয়সে নীলরতনের চাইতে রবীন্দ্রনাথ তাই মাস পাঁচেক বড়৷ একই বছরে জন্মেছেন বাংলার আর এক মহান সন্তান প্রফু ল্লচন্দ্র৷ পরে যিনি বদলে যাবেন আচার্য প্রফু ল্লচন্দ্র রায়ে৷ বয়সে ইনি মধ্যম৷ রবি ঠাকু রের চাইতে কয়েকমাসের ছোট, নীলরতনের চাইতে সামান্য বড়৷

আশ্চর্য মিল জীবনবোধে কী আশ্চর্য মিল রবীন্দ্রনাথ আর নীলরতনে৷ ছেলেবেলা থেকেই দুজনের আকণ্ঠ জ্ঞানপিপাসা৷ আলো, আরো আলোর অন্বেষণ৷ উদার ব্রাহ্ম পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা৷ অফু রান প্রাণশক্তি৷ তীব্র জীবনবোধ৷ সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাবার অদম্য সাহস৷ প্রখর ইচ্ছাশক্তি৷ সব মানুষের জন্য অপার ভালোবাসা৷ বড় হয়ে প্রজ্ঞায়, চারিত্রিক গুণে, প্রভাবে, প্রতিপত্তিতে দুজনেরই খ্যাতি দেশের সীমান্ত পেরিয়ে ছড়িয়েছে দেশান্তরে৷ দুজনেই কাজ করে গেছেন পরাধীন দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য৷ শিক্ষার আলোক সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য৷ স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশবাসীকে শক্তিতে সামর্থ্যে

জ্ঞানে বিজ্ঞানে পাশ্চাত্যের মানুষের সমকক্ষ করে তু লতে আজীবন ঘাম ঝরিয়েছেন দুজনেই৷ অথচ প্রথম জীবনে দু’জনের জীবনপথ ছিল একেবারে অন্যরকম৷ শিক্ষায় ধনে সংস্কৃ তিতে অগ্রণী জোড়াসাঁকোর ঠাকু র পরিবারে জন্মেছেন রবীন্দ্রনাথ৷ বড় হবার পথে পেয়েছেন উদার পরিবেশ, প্রকৃ তির শুশ্রূষা, শৈল্পিক সাংস্কৃ তিক পরিমণ্ডল৷ নীলরতন জন্মেছেন এখনকার উত্তর চবিবশ পরগনা জেলার ডায়মন্ডহারবার থেকে খানিকটা দূরে অজ পাড়াগাঁ নেত্রায়৷ নীলরতনের তিন বছর বয়সে ভয়ঙ্কর এক আশ্বিনের ঝড়ে নন্দলাল সরকারের ঘরবাড়ি ভেঙে পড়লে গৃহহারা নন্দলালকে পাঁচ ছেলে, তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে জয়নগরের শ্বশুরালয়ে৷ মামাবাড়িতে অভাবে অনটনে, দুঃখ যন্ত্রণায় শিশু নীলরতনের বড় হয়ে ওঠা৷ জয়নগর ও তার আশেপাশে তখন বহু উদারচেতা, জ্ঞানীগুণীর বাস৷ শিবনাথ শাস্ত্রী, দীননাথ দত্ত, হরনাথ বসু বা উমেশচন্দ্র দত্ত যেমন৷ এঁদের সংস্পর্শে বড় হতে হতে উদারতা, দৃঢ়তা, মানবপ্রেমের মতো মানবিক গুণের ছাপ পড়তে থাকল নীলরতন ও তার অন্য ভাইবোনেদের মধ্যে৷ জয়নগরের স্কু লে ভর্তি হলেন মেধাবী নীলরতন, এগোলেন শিক্ষালাভের প্রচলিত রাস্তায়৷২ অন্যদিকে, শিক্ষার প্রচলিত পথটি সহ্য হল না কল্পনাপ্রবণ শিশু রবির৷ একের পর এক মাস্টারের তত্ত্বাবধানে চলল পড়াশোনা৷ নানা বিষয়ে শিক্ষালাভ৷ দরিদ্র পিতার মেধাবী ছেলে নীলরতনের স্কু লই ছিল এগিয়ে যাবার একমাত্র অবলম্বন৷ স্কু লছুট হয়ে শিক্ষালাভের সুযোগ তার ছিল না৷ অন্যদিকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মেধাবী পুত্রটি স্কু ল পালিয়েও বাড়িতেই সুযোগ পেল নানাজনের তত্ত্বাবধানে নানা বিষয়ে শিক্ষিত হয়ে ওঠার৷ কাব্য, ব্যাকরণ, সাহিত্য, ভাষা থেকে শুরু করে জ্যোতির্বিজ্ঞান, এমনকি শারীরবিদ্যা পর্যন্ত৷ পড়ার ঘরে টাঙানো নরকঙ্কাল দেখিয়ে হাড়ের নাম, অবস্থান শুধু নয়, হাতে কলমে বিজ্ঞানের পাঠও৷৩

দুর্গম পথ শিক্ষালাভের অধ্যবসায় আর ইচ্ছাশক্তির জোরে নীলরতন এগিয়েছেন প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠার পথে৷ তীব্র অভাব, চরম দারিদ্র, ভরপেট খেতে না পাওয়া--কিছুই পারে নি মেধাবী বালক নীলরতনের আলোর সন্ধানে এগিয়ে চলার পথটিকে রুদ্ধ করতে৷ এগারো বছর বয়সে উপনয়ন হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের৷ এরপর মহর্ষির সঙ্গে প্রথমে শান্তিনিকেতন ও পরে

ডালহৌসি ভ্রমণে যাচ্ছে বালক রবি৷ ঐ বছর, ১৮৭২ সালে বালক নীলরতন পড়ছে জয়নগরের ইন্টারমিডিয়েট স্কু লের ষষ্ঠ শ্রেণিতে৷ লড়াই করছে দাঁতে দাঁত চেপে৷ কাব্যপাঠ, গ্রন্থপাঠ, নাটকে অভিনয়, গান, প্রিয় বৌঠান কাদম্বরী দেবীর সাহচর্য, কবিতা লেখা, কিশোর রবির কৈশোর কাটছে এক নেশাধরানো সাংস্কৃ তিক পরিমণ্ডলের ভেতর৷ অন্যদিকে চোদ্দ বছর বয়সে অর্ধাহার ও অতি-পরিশ্রমে জীর্ণশীর্ণ মাকে চোখের সামনে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে দেখছে নীলরতন৷ অন্য ভাইবোনেরা চিৎকার করে কাঁদছে, অশ্রুজল শুকিয়ে ইস্পাত হয়ে জমছে নীলরতনের বুকে৷ ইষ্পাতকঠিন প্রতিজ্ঞা জন্ম নিচ্ছে বুকের গভীরে৷ যে ভাবেই হোক, বড় ডাক্তার তাকে হতেই হবে৷ মুছে দিতে হবে আর্তের কান্না, পীড়িতের যন্ত্রণা৷৪ ১৮৭৬-এ কৃ তিত্বের সঙ্গে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে অর্থাভাবের কারণে মেডিক্যাল কলেজের বদলে ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কু লে ভর্তি হচ্ছে নীলরতন ৷ ১৮৭৯-তে ক্যাম্বেল স্কু ল থেকে ডিপ্লোমা ডাক্তার হয়ে বার হচ্ছে যখন, পড়াশোনা ও ক্ষু ন্নিবৃত্তির জন্য তখনই নামতে হয়েছে অর্থ উপার্জনে৷ তবু থামে নি পড়াশোনা৷ প্রথমে জেনারেল অ্যাসেমলি ও পরে মে*্রোপলিটান (এখনকার বিদ্যাসাগর) কলেজ থেকে আই.এ. ও বি. এ. পাশ করলেন৷ পড়তে পড়তেই আরো বিদ্যার্জনের জন্য অর্থের সংস্থান করতে প্রথমে চাতরার স্কু লে ও পরে বাগবাজারের স্কু লে স্কু লমাস্টারি৷ ১৮৮৩ সালে আই. এ. পাশ করছেন নীলরতন৷ ঐ বছরই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে মৃণালিনীর৷ ১৮৮৮ তে নীলরতন মেডিকেল কলেজ থেকে এম. বি. পাশ করছেন যখন রবীন্দ্রনাথ তখন বড় কন্যা মাধুরীলতার পিতা হলেন৷ মহর্ষির নির্দেশে পদ্মাবোটে নদীর মনোরম পরিবেশে সংসার পেতেছেন রবি ঠাকু র৷ শিলাইদহে জমিদারির দেখাশোনা আর সংসারের ফাঁকে ফাঁকে চলছে কাব্যরচনা, পড়াশোনা, লেখালেখি৷ কখনও বা শিলাইদহ থেকে কিছুদিনের জন্য কলকাতা যাওয়া, পারিবারিক নাটকে অংশ নেওয়া৷ এম. বি. পাশ করে নীলরতন কলকাতার মেয়ো হাসপাতালে হাউস সার্জেনের চাকরিতে ঢু কছেন৷ কাজ করতে করতে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া৷ ১৮৮৯ সালে একই সঙ্গে এম. এ. ও এম. ডি. ডিগ্রী লাভ৷ ১৮৯০ সালে মেয়ো হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে নীলরতন নামছেন কলকাতার বুকে ডাক্তারি প্র্যাকটিস করতে৷ ঐ বছর জন্ম নিচ্ছে রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় সন্তান রথীন্দ্রনাথ৷ এম. ডি. পাশ করবার পর নীলরতনের বিয়ে হচ্ছে ব্রাহ্মপ্রচারক গিরীশচন্দ্র মজুমদারের প্রথম কন্যা নির্মলার সঙ্গে৷ সেই বছর, ১৮৮৯-তে রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনীর দাম্পত্যের বয়স ছয়৷ ফু টফু টে বেলা এক বছরের শিশু৷

নীলরতন, জগদীশচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ কবে প্রথম পরিচয় ঘটেছিল রবিঠাকু রের সঙ্গে নীলরতনের? ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে৷ দুজনের প্রথম পরিচয়ে অনুঘটকের কাজটি সুন্দরভাবে করেছিলেন কবির আর এক বন্ধু বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু৷ ১৮৯১ সালে জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে কবির প্রথম পরিচয়৷ দুজনের যোগাযোগ গভীর হতে হতে বন্ধু ত্বে বদলে গেছে দ্রুত৷ কবির সৃষ্টিশীলতা আকৃ ষ্ট করেছে জগদীশচন্দ্রকে, বিজ্ঞানীর ব্যতিক্রমী প্রতিভা মুগ্ধ করেছে কবিকে৷ এই বিজ্ঞানীর মাধ্যমে বিজ্ঞানীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডা. নীলরতন সরকারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয়৷৫ এই প্রাথমিক পরিচয়পর্ব পরবর্তীকালে বদলে যাবে গভীর বন্ধু ত্বে, অন্তরঙ্গতায়৷ সব মানুষের জন্য অফু রান ভালোবাসা, গভীর দেশপ্রেম, ঈশ্বরচেতনা, শিক্ষার আলোকে আরো আরো ছড়িয়ে দেওয়া--রবীন্দ্রনাথ আর নীলরতনের বোধে-মননে-চেতনায় এরকম মিল এই দুই মহান বঙ্গসন্তানকে খুব কাছাকাছি নিয়ে আসে৷ নীলরতনের কাব্য ও সাহিত্যে গভীর অনুরাগ কবির সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতায় অনুঘটকের কাজ করে৷ একই ঘটনা ঘটেছিল কবির সঙ্গে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের গভীর বন্ধু ত্ব গড়ে ওঠার বেলায়৷ ১৮৯৭ সালে ইংল্যান্ডে সফর শেষ করে বিদেশের বিজ্ঞানীমহলে খ্যাতি ছড়িয়ে জানুয়ারির ২৯ তারিখ দেশে ফিরলে জগদীশচন্দ্রকে অভিনন্দন জানাতে হাওড়া স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন প্রফু ল্লচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার, শিবনাথ শাস্ত্রী ও আরো অনেকে৷ রবীন্দ্রনাথ স্টেশনে না-গেলেও একগুচ্ছ ফু ল নিয়ে হাজির হলেন জগদীশচন্দ্রের বাড়িতে৷ বিজ্ঞানী বাড়িতে ছিলেন না৷ ফিরে এসে কবির উপহার পেয়ে অভিভূ ত হলেন৷৬ এভাবে সখ্যতার সেতু বন্ধন দ্রুত পরিণত হল বন্ধু ত্বে৷ রবীন্দ্রসাহিত্যে গভীর অনুরাগী জগদীশচন্দ্র, বিজ্ঞানীর কাজের দেশে-বিদেশে সমাদরে সচেষ্ট রবীন্দ্রনাথ৷ যৌবনের উপান্তে কবি ও বিজ্ঞানীর সখ্যতা তাই দ্রুত বদলে গেল গভীর বন্ধু ত্বে৷ এই জগদীশচন্দ্রের মাধ্যমেই নীলরতনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয় নতু ন সহস্রাব্দ শুরু হবার কিছুদিন আগে, ১৮৯৯ এর শেষভাগে৷ ১৮৯৫ সালে উইলহেম রন্টজেন আবিষ্কার করলেন অদৃশ্য আলোকরশ্মি এক্স-রে৷ কাগজে ঐ আবিষ্কারের বিশদ বিবরণ পড়ে জগদীশচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজের একটি ঘরে নিজেই বানালেন ‘রঞ্জনকল’৷ ডা. নীলরতন সরকার তখন প্র্যাকটিস করছেন কলকাতায়৷ প্রায়ই হাড়-ভাঙা রোগী নিয়ে হাজির হচ্ছেন প্রেসিডেন্সির ওই ঘরে৷ ১৮৯৯-র ফেব্রুয়ারি মাসে বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে জগদীশচন্দ্রের লেখা এক চিঠিতে রয়েছে এ প্রসঙ্গের উল্লেখ৷ ‘আঁধারে আলোক দেখিতে গিয়া আমার আলোকে আঁধার দেখিবার উপক্রম হইয়াছে...আপনারা (লোকেন, সুরেন ও কবি) আশা করি রবিবার দিন ৮/৯ টার সময়

আমার বাড়িতে আসিবেন...যদি পারেন তাহা হইলে সকাল ৮টার সময় প্রেসিডেন্সী কলেজ হইয়া আসিবেন...রঞ্জেন কলে একজন রোগী দেখিতে হইবে--তাহার পৃষ্ঠভঙ্গ হইয়াছে...ডাক্তার নীলরতন সরকারের কথা এড়াইতে পারিলাম না...’৷৭ সেদিন বন্ধু লোকেন পালিত ও ভ্রাতু ষ্পুত্র সুরেনকে নিয়ে কবি প্রেসিডেন্সী কলেজে যান নি, নীলরতনের সঙ্গে কবির দেখাও হয় নি৷ নীলরতন ও রবীন্দ্রনাথ, দুজনেই শুনেছেন পরস্পরের প্রতিভার কথা৷ তাঁদের প্রথম পরিচয় সার্কুলার রোডে জগদীশচন্দ্রের বাড়িতে৷ ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা হল৷ ৭ই পৌষ ১৩০৮, ২২ ডিসেম্বর ১৯০১ মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন ও সংকল্পের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের কাজ শুরু হয়৷ সবে বিদ্যালয়ের কাজ শুরু করছেন রবীন্দ্রনাথ৷ পরের বছর ১৯০১ সালে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন কবিপত্নী মৃণালিনী৷ আগস্টে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ায় মৃণালিনীকে সেপ্টেম্বরে নিয়ে আসা হচ্ছে কলকাতায়৷ হোমিওপ্যাথিতে আসক্ত রবীন্দ্রনাথ বারবার স্ত্রীর অসুখের ব্যাপারে পরামর্শ নিচ্ছেন তখনকার প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথ প্রতাপ মজুমদার বা ডি. এন. রায়ের৷ তাঁরা বারবার ঠাকু রবাড়িতে আসছেন মৃণালিনীকে দেখতে৷৮ ডা. নীলরতন সরকার তখন পুরোদস্তুর চিকিৎসা করছেন কলকাতার বুকে, তবু রবীন্দ্রনাথ একবারও যাচ্ছেন না নীলরতনের কাছে৷ মৃণালিনীর চিকিৎসার বিষয়ে একবারও নেওয়া হচ্ছে না তাঁর পরামর্শ৷ ২৩ নভেম্বর ১৯০২ কবি ও পাঁচটি ছোট সন্তানকে রেখে মৃত্যুর দেশে পাড়ি দিচ্ছেন মৃণালিনী৷৯ নীলরতনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটেছে৷ ওই সময় রবীন্দ্রনাথ বন্ধু হয়েছেন নীলরতনের অনুজ ভ্রাতা প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকারেরও৷ ১৮৯৬ সালে যোগীন্দ্রনাথ খুলছেন তাঁর প্রকাশন সংস্থা ‘সিটি বুক সোসাইটি’৷ এর আগেই ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে যোগীন্দ্রনাথ সরকার সংকলিত শিশুপাঠ্য বই ‘হাসি ও খেলা’৷ ‘সাধনা’ পত্রিকার মাঘ ১৪০১ সংখ্যায় ঐ বইয়ের ‘সপ্রশংস সমালোচনা করে যোগীন্দ্রনাথের বন্ধু ত্ব অর্জন’ করছেন রবীন্দ্রনাথ৷১০ শুধু তাই নয় স্বভাবগম্ভীর ব্যতিক্রমী ভাবপ্রবণ তৃ তীয়া কন্যা রেণুকার হাতে ঐ বছরই (১৮৯৪) মাত্র তিন বছর বয়সে রামায়ণ, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘কঙ্কাবতী’, ‘ভূ ত ও মানুষ’ এর পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ তু লে দিচ্ছেন যোগীন্দ্রনাথের ‘হাসি ও খেলা’৷১১ মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হবার পরই অসুখে পড়ছে রেণুকা৷ এই সময়ও নীলরতনের পরামর্শ নিচ্ছেন না কবি, চালাচ্ছেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা৷ অবশ্য অ্যালোপ্যাথিতেও তখন নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই কবিকন্যার অসুখ যঙ্মার৷ পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া আর বিশ্রামই চিকিৎসা৷ রেণুকাকে নিয়ে কবি প্রথমে হাজারিবাগ, পরে গেলেন আলমোড়ায়৷ রোগটা তবু

সারল না৷ শেষ অবস্থায় রেণুকার ইচ্ছা অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ তাকে নিয়ে এলেন কলকাতায়৷ ১৯০৩-এর চোদ্দই সেপ্টেম্বর মৃত্যুর দেশে পাড়ি দিল কবিকন্যা রেণুকা৷ স্ত্রী-কন্যার মৃত্যুশোকে কাতর কবি শুশ্রূষা খুঁজলেন শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়লেন শিক্ষাদানের কাজে৷ এই সময় বন্ধু কে সাহচর্য দিতে এগিয়ে আসছেন নীলরতন৷ কলকাতায় কবি এলেই মাঝেমধ্যে দেখা হচ্ছে তাঁদের৷ ব্যস্ত চিকিৎসক নীলরতন প্রবল শিক্ষানুরাগী৷ দেখা হলেই দুজনে আলোচনা করছেন বিদ্যালয়ের আদর্শ শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে, আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে৷ আশ্রম বিদ্যালয় নিয়ে নীলরতনের মূল্যবান নানা পরামর্শ কাজে লাগাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ৷

বিজ্ঞান, বিজ্ঞানচেতনা ও কবি আশৈশব বিজ্ঞাননিষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ চাইতেন, ‘শিক্ষা যারা আরম্ভ করছে বিজ্ঞানের আঙিনায় প্রবেশ না হোক, বিজ্ঞানের ভিতটি তাদের পোক্ত হওয়া চাই’৷১২ আর বিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিজ্ঞানের ভিতটি পোক্ত করে তু লতে শুধু প্রকৃ তিবিজ্ঞান বা অঙ্ক নয়, মানবদেহ সম্পর্কেও ছাত্রদের মোটামুটি একটা ধারণা থাকা দরকার বলে মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ৷ এ নিয়ে আলোচনা করছেন নীলরতন সরকারের সঙ্গে, ছাত্রদের মানবদেহের হাড়গুলো চেনাতে ‘হিউম্যান স্কেলিটন’ বা নরকঙ্কাল জোগাড় করে দিতে অনুরোধ করছেন নীলরতনকে৷ নীলরতন মেনে নিচ্ছেন বন্ধু র আবদার৷ রেণুকার বিয়ে হয়েছিল খুব কম বয়সে৷ জামাতা সত্যেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্যকে ‘অ্যালোপাথি ডিগ্রির উপর হোমিয়োপ্যাথির চূ ড়া চড়াইবার জন্য’ বিলেত পাঠিয়েছিলেন কবি৷ কবির মনস্কামনা পূর্ণ হয় নি৷ শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরে আসেন সত্যেন্দ্রচন্দ্র, রেণুকার মৃত্যুর পর তিনি থেকে যান শান্তিনিকেতনে৷ কবি এই জামাতাটিকে কাজে লাগাতে চান আশ্রম বিদ্যালয়ের ছাত্রদের শিক্ষাদানে৷ এপ্রিল ১৯০৫-এ মোহিতচন্দ্র সেনকে লেখা এক চিঠিতে কবি লিখছেন তাঁর এরকম ইচ্ছার কথা৷ সঙ্গে এসেছে ‘নীলরতনবাবু’র নরকঙ্কাল জোগাড় করে দেবার প্রতিশ্রুতির প্রসঙ্গ৷১৩

জাতীয় শিক্ষা ও দুই বন্ধু ডাক্তারির পাশাপাশি ১৮৯৩ সাল থেকেই ডাক্তার নীলরতন সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ‘ফেলো’৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কাজে সক্রিয় অংশ নেন নীলরতন৷ নানা বিষয়ে পরামর্শ নেন রবীন্দ্রনাথের৷ এর পাশাপাশি, নীলরতন ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেই গভীর যন্ত্রণা পান দেশের পরাধীনতায়৷ গভীর দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ আরো কাছাকাছি

নিয়ে আসে এই দুই মহান বঙ্গসন্তানকে৷ দুজনেই ভাবেন জাতীয় শিক্ষার কথা, স্বপ্ন দেখেন স্বাদেশিকতার বোধে উদ্বুদ্ধ জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায়৷ ১৯০৫ সালে ইংরেজ ‘বঙ্গভঙ্গ আইন’ চালু করে৷ এর প্রতিবাদে স্কু ল কলেজের ছাত্ররা তু মুল বিক্ষোভে সামিল হয়ে জাতীয় নেতাদের কাছে স্বদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জোরদার দাবী পেশ করে৷ রাসবিহারী ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারকনাথ পালিত, প্রমথনাথ বসু, মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, ডা. নীলরতন সরকার, আশুতোষ চৌধুরী ও আরো মান্যগণ্যের উপস্থিতিতে ১৯০৬ সালের জুন মাসে এই উদ্দেশ্যে তৈরি হয় ‘জাতীয় শিক্ষা পর্ষদ’৷ পরে ঐ পর্ষদ ছাড়াও কারিগরি শিক্ষার স্বদেশি প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে তৈরি হয় ‘কারিগরি শিক্ষা পর্ষদ’৷ নীলরতনের আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ দুটি শিক্ষা পর্ষদের সঙ্গেই গভীরভাবে জড়িয়ে যান৷ নীলরতন সরকার ও অন্যান্যদের উদ্যোগে আপার সার্কুলার রোডে তৈরি হল ‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনসটিটিউট’৷ এখানে মাতৃ ভাষার মাধ্যমে নানা কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করেন নীলরতন সরকার ও অন্যান্যরা৷ অন্যদিকে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’-এর উদ্যোগে ১৯০৬ এর জুলাইতে এক হাজার ছাত্রের জন্য নানা বিষয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়৷ বাংলার প্রশ্নকর্তা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র, রসায়নের রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এবং ডা. নীলরতন সরকার৷১৪ বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনসটিটিউটের যুগ্ম-সম্পাদক পদে ডা. নীলরতন সরকার ও বি. এল. চৌধুরী ছাড়া ছিলেন রবীন্দ্রঘনিষ্ঠ রমণীমোহন চ্যাটার্জী৷ এই মানুষটিকে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্যর মন্ত্রীপদে বসিয়েছিলেন ত্রিপুরারাজকে রাজদরবারের চক্রান্তের হাত থেকে বাঁচাতে৷ কিন্তু রাজার দুর্বলতায় ও পারিষদদের চক্রান্তে রমণীমোহন ত্রিপুরা ছাড়তে বাধ্য হলে নীলরতন কবির অনুরোধে তাঁকে তাঁদের ইনসটিটিউটে একজন কর্মকর্তা হিসেবে যুক্ত করে নেন৷ জাতীয় শিক্ষা পরিষদের গঠনপ্রণালী, পাঠ্যসূচি ও প্রশ্নপত্র প্রণয়নে প্রচু র পরিশ্রম করেছেন রবীন্দ্রনাথ, সক্রিয় থেকেছেন একটানা বেশ কিছুদিন৷ আবার বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনসটিটিউটের মূল হোতা ছিলেন ঠাকু র পরিবারের ঘনিষ্ঠ, রবীন্দ্রবান্ধব লোকেন পালিতের পিতা তারকনাথ পালিত৷ তাঁরই আপার সার্কুলার রোডের বাড়িতে নীলরতন সরকারের সক্রিয়তায় শুরু হয়েছিল ঐ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ৷ ওই প্রতিষ্ঠানের নানা কাজকর্মেও যুক্ত ছিলেন কবি, অনেক ছাত্রকে সুপারিশ করেছেন ওই কলেজে ভর্তি হতে৷ শুধু তাই নয়, নীলরতন সরকারের অনুরোধে কবি ঐ সময় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ থেকে প্রকাশিত ‘শিক্ষার আন্দোলন’ পুস্তিকার দীর্ঘ অনুপম ভূ মিকাটি লিখে দেন৷ তারও

আগে স্বদেশি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন কবি তাঁর লেখা ‘স্বদেশী সমাজ’ ও ‘দেশনায়ক’ প্রবন্ধে৷ জাতীয় শিক্ষাসমাজের খসড়া সংবিধান রচনার জন্য যে সমিতি গঠিত হয় ১৯০৬-এর ডিসেম্বর মাসে তার সচিব ছিলেন ডা. নীলরতন সরকার, অন্যতম সদস্য রবীন্দ্রনাথ৷ বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনসটিটিউটের ছাত্রদের শরীরর্চ্চায় রপ্ত করে তু লতে তারকনাথ পালিত ও নীলরতন সরকার কবিকে অনুরোধ করেন তাঁর আশ্রম বিদ্যালয়ের জুজুৎসু শিক্ষককে ঐ কলেজে কিছুদিনের জন্য পাঠাতে৷১৫ বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনসটিটিউট জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কাজকর্মের ধারা থেকে একটু অন্যভাবে চলত৷ কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্ররা দেশে স্বদেশি শিল্পোন্নতি ঘটাবে, এই সংকল্প সামনে রেখে কলেজটিকে চালাতেন প্রযুক্তি পর্ষদের দুই মূল হোতা নীলরতন সরকার ও তারকনাথ পালিত৷ রবীন্দ্রনাথ ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’-এর কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি এই কলেজ ও পর্ষদের অন্য প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ অ্যান্ড স্কু ল’-এর কাজকর্মে সক্রিয় সাহায্য করে গেছেন একটানা৷ পরে ১৯১০ সালে ‘জাতীয় কারিগরি শিক্ষা পর্ষদ’ ও ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’-এর আলাদা অস্তিত্ব তু লে দিয়ে শেষোক্ত নামে একটিই সংস্থা তৈরি হয়৷ ১৯২৯ এর মে মাসে শেষ পর্যন্ত বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনসটিটিউট বদলে যায় যাদবপুরের কলেজ অফ এঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে৷ এই উঁচু মানের কারিগরি প্রতিষ্ঠান তৈরিতেও নীলরতন সরকার ও অন্য উদ্যোক্তারা পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের সক্রিয় সমর্থন৷ এটিই আজকের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ৷ জাতীয় শিক্ষার প্রসারে নিঃস্বার্থ আন্দোলনের নীরব অথচ সক্রিয় যোদ্ধা নীলরতন৷ চিকিৎসকজীবন শুরু হবার সময় থেকেই (১৮৯০) তিনি কংগ্রেসের সদস্য৷ স্বদেশের কাজে নীলরতনের সক্রিয় যোগাযোগ অবশ্য ইংরেজের বাংলাকে ভাগ করার চক্রান্তের সময় (১৯০৫) থেকে৷ ঐ সময় দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন রবীন্দ্রনাথও৷ স্বদেশবাসীকে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করে তু লতে ‘রাখি উৎসব’ এর সূচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ, মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন দেশজ শিক্ষা ও শিল্পের অগ্রগতিতে আত্মনিয়োগ করতে৷ স্বদেশি শিক্ষা ও শিল্পের বুনিয়াদ গড়ে তু লতে কঠিন পরিশ্রম করেছেন নীলরতন, ঢেলেছেন কষ্টার্জিত বিপুল অর্থ৷ এ ক্ষেত্রে বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে নীলরতনের পাশে দেখা যাচ্ছে বারবার৷

জনগণমন ও কু ৎসা

১৯১১ সালে কংগ্রেসের অধিবেশন হচ্ছে কলকাতায়৷ জানকীনাথ ঘোষালের সভাপতিত্বে ‘অভ্যর্থনা সমিতি’ তৈরি হল ঐ অধিবেশনের প্রস্তুতিপর্বে৷ সমিতির অন্যতম সম্পাদক ব্যস্ত চিকিৎসক ডাক্তার নীলরতন সরকার, অন্যতম সদস্য রবীন্দ্রনাথ৷ নীলরতন বন্ধু কবিকে অনুরোধ করছেন অধিবেশনের জন্য একটা উপযুক্ত গান লিখে দিতে৷ অনুরোধ করছেন কমিটির অন্য সদস্যরাও৷ অধিবেশন শুরুর দিন সকালে ডা. নীলরতন সরকার তাঁর সহকারি জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগীকে পাঠালেন কবির কাছে৷ জোড়াসাঁকোর ঠাকু রবাড়িতে কবির কাছ থেকে গান লেখা কাগজ নিয়ে জ্ঞানাঞ্জন ছুটলেন ডা. সরকারের হ্যারিসন রোডের বাড়িতে৷ নীলরতন সেখানে আগে থাকতেই আনিয়ে রেখেছেন রবি ঠাকু রের সুরের কাণ্ডারী দিনেন্দ্রনাথ ঠাকু রকে৷ আনিয়ে রেখেছেন অমল হোম ও অন্য গায়ক গায়িকাদের৷ গানে দ্রুত সুর বসালেন দিনেন্দ্রনাথ, গানের মহড়া হল বেশ কয়েকবার৷ শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস অধিবেশনের উদ্বোধন হল রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন’ গানটি দিয়ে৷ ব্যাপক প্রশংসা পেল গানটি৷ ওদিকে ‘জ্যোতির্ময় রবি’-র এই কীর্তিতে গাত্রদাহ শুরু হল ‘কালো মেঘের দল’-এর৷ নানা পত্রপত্রিকায় কবির লেখা ঐ গানে ব্রিটিশরাজের বন্দনার গন্ধ খুঁজে পেলেন একশ্রেণীর সমালোচক৷ সমালোচনার খবর পৌঁছে গেল তখন লন্ডনে স্থিত মার্কিন কবি এজরা পাউন্ডের কাছেও৷ এজরা পাউন্ড এ নিয়ে চিঠি লিখলেন আমেরিকায়, বাবাকে৷ স্বাধীনতার পর অবশ্য এরকম সমালোচকরা স্তব্ধ হয়ে যান গানটি জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পাওয়ায়৷১৬

নীলরতন, কবি ও প্রফু ল্লচন্দ্র নীলরতন ও রবীন্দ্রনাথের সখ্যতা অন্তরঙ্গতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সমবয়সী প্রফু ল্লচন্দ্র রায়ও৷ আমৃত্যু অটু ট এই তিন বন্ধু র বন্ধু ত্বের ত্রিভূ জটিকে আয়তক্ষেত্রে বদলে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র৷ ১৮৯৩-তে ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ প্রতিষ্ঠা করছেন প্রফু ল্লচন্দ্র, হাড়ভাঙা পরিশ্রমে তিলে তিলে গড়ে তু লছেন এই স্বদেশি শিল্প-প্রতিষ্ঠানটিকে৷ ১৯০১-এ শ্রীবৃদ্ধি ঘটে আপার সার্কুলার রোডের ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ বদলে যাচ্ছে ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’-এ৷ প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে যাবার পথে প্রফু )ল্লচন্দ্র সক্রিয় সহযোগিতা পাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ও ডা. নীলরতন সরকারের দিক থেকে৷ ঐ প্রতিষ্ঠান থেকে নানা ধরনের ওষুধ তৈরিতে মদত জোগাচ্ছেন ডা. নীলরতন সরকার, ডা. রাধাগোবিন্দ কর৷১৭ ঐ সব ওষুধ, বিশেষ করে আয়ুর্বেদিক ওষুধগুলোর ব্যবহারের সুফল নিয়ে দরাজ প্রশংসা করে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ৷ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ষ্ঠা

নীলরতন সরকার চেষ্টা করছেন শিল্প প্রতিষ্ঠার৷ ১৯০৩ সালে তৈরি হল ডা. নীলরতন সরকারের ‘বিজয়া সাবান’ তৈরির কারখানা৷ ঐ সাবান যে বহুদিনের গবেষণায় তৈরি ও মানুষের ত্বকের কোনো ক্ষতি করে না তা জানিয়ে ১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথকে এক বাক্স বিজয়া সাবান পাঠালেন বন্ধু জগদীশচন্দ্র৷ কনিষ্ঠা কন্যা মীরার হাতে ঐ সাবান জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতার জন্য মজফফরপুরে পাঠাচ্ছেন কবি৷ কন্যাদের জানাতে ভু লছেন না, ওই সাবান নীলরতন সরকারের কারখানায় তৈরি৷ সঙ্গে উল্লেখ করছেন ঐ স্বদেশি সাবানের অক্ষতিকর দিকটির কথা৷১৮

দুই বন্ধু র চলমান সখ্যতা রবীন্দ্রনাথ ও নীলরতনের বন্ধু ত্ব গভীর হতে হতে প্রসারিত হয়েছে ঠাকু র পরিবার ও সরকার পরিবারে৷ নীলরতন সরকার যাচ্ছেন ঠাকু রবাড়িতে৷ ‘ধন্বন্তরী’ পরিচিত হচ্ছেন গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে৷ তাঁর মুখের স্মিত হাসি, চেহারার নির্ভয় আশ্বাস আশ্বস্ত করছে সবাইকে, বিশেষ করে রবীন্দ্র-অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথকে৷ যতদিন জীবিত ছিলেন, ‘নীলরতনবাবু’ ছাড়া আর কোনো ডাক্তারকে দেখাতে চাইতেন না দ্বিজেন্দ্রনাথ৷ নীলরতনের কন্যারাও পরিচিত হচ্ছেন কবির সঙ্গে, মাঝে মাঝে জোড়াসাঁকোয়৷ প্রথমদিকে নলিনী অরুন্ধতী, পরের দিকে তৃ তীয়া কন্যা রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে কলকাতায় এলে যান ডা. সরকারের হ্যারিসন রোডের শোনেন নলিনী ও অরুন্ধতীর গান ও পিয়ানোবাদন৷ এই বিশেষ গুণের জন্য কন্যা দ্রুত রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন৷

যাচ্ছেন কমলাও৷ বাড়িতে৷ এই দুই

১৯১১ সালের শান্তিনিকেতনে প্রথমবার ‘রাজা’ নাটকের অভিনয় দেখতে হাজির হন নলিনী দেবী৷ কবিবান্ধব ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা শান্তা ও রামানন্দবাবুর সঙ্গে আশ্রমে যান নলিনী৷ নলিনী মুগ্ধ হলেন কবির আতিথ্য-বাৎসল্য সৌজন্য-সৌন্দর্য-প্রসন্নতা আর বাকমাধুর্যে৷ পরবর্তীকালে নলিনী দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় অপুত্রক জগদীশচন্দ্রের একমাত্র ভাগ্নে বিজ্ঞানী দেবেন্দ্রমোহন বসুর৷ কম বয়স থেকেই দেবেন্দ্রমোহন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহাস্পদ৷ তাঁর পত্নী হিসেবে কবির সঙ্গে নীলরতনের এই কন্যাটির সম্পর্ক আরো দৃঢ়তর হল৷ দীর্ঘকাল ‘বিশ্বভারতী’র অর্থসচিবের দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে দেবেন্দ্রমোহনকে সামলাতে হয়েছে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের গুরুদায়িত্ব সামলেও৷১৯

ঐ বছরই মে মাসে রামানন্দবাবু অন্য কন্যা সীতা ও নীলরতনের দ্বিতীয় কন্যা অরুন্ধতীকে নিয়ে কবির জন্মোৎসব উপলক্ষে শান্তিনিকেতন যান৷ রম্য পরিবেশে জন্মদিনের সুন্দর অনুষ্ঠান শেষ হবার পর রাতে কবি অতিথিদের নিয়ে চাঁদের আলোয় পারুলবনে বেড়াতে যান৷ অজিতকু মার চক্রবর্তী, দিনেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও অরুন্ধতীর গানে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত প্রান্তর লাবণ্যে আর আনন্দে টইটু ম্বর ভরে ওঠে৷২০ নীলরতন সরকার ব্যস্ত চিকিৎসক৷ তবু কবির কবিতা ও গল্প উপন্যাসে গভীর অনুরাগ তাঁর৷ অনুরাগ তাঁর সঙ্গীতপ্রেমী কন্যাদেরও৷ ১৯১৩-১৪ সালে বিদেশসফর সেরে দেশে ফিরে রবি ঠাকু রের কলম থেকে বেরিয়ে আসছে একের পর এক নতু ন ধারার গল্প, কবিতা, উপন্যাস৷ জোড়াসাঁকোর ঠাকু রবাড়ির গ্রন্থাগারটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ‘বিচিত্রা ক্লাব’-এ কবি প্রায়দিনই পড়ে শোনান তাঁর নতু ন লেখা৷ শুনতে হাজির হন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর মেয়েরা, শরৎচন্দ্র, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নীলরতন সরকারের ভাগ্নে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, নীলরতনকন্যা নলিনী, সীতা ও শান্তা৷ সময় পেলেই হাজির হন কবিবান্ধব নীলরতন৷ আপ্লুত হন কবির মুখে কবির নতু ন ধারার লেখা শুনে৷২১

কবির নোবেল ও নীলরতন ১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথের কথা হল বন্ধু , মেয়ো হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের সঙ্গে, জাহাজে ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক ইত্যাদি দেশ দেখতে যাবার৷ টিকিট কাটা হল জাহাজের, যাত্রার দিন কবির মালপত্রও চাপল জাহাজে৷ হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন, বাতিল হল বিলেতযাত্রা৷ নীলরতন সরকার কবিকে পরীক্ষা করে বিশ্রাম নিতে পরামর্শ দিলেন শিলাইদহ গিয়ে৷ বন্ধু র পরামর্শ মেনে কবি চলে গেলেন শিলাইদহের পদ্মাবোটে৷ শান্ত প্রকৃ তির বুকে বসে শুরু হল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদ৷ ঐ অনুবাদের খাতা নিয়ে পরের বছর ইংল্যান্ড গেলেন রবীন্দ্রনাথ৷ ব্রিটিশ কবি ইয়েটস ও চিত্রকর রোটেনস্টাইন মুগ্ধ হলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার অপূর্ব ভাবে, আবেদনে৷ ইয়েটসের ভূ মিকা সহ প্রকাশিত হল ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ Song Offerings৷ এই গ্রন্থটির জন্যই ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান রবীন্দ্রনাথ৷ সেদিন যাত্রার আগে অসুস্থ হয়ে সফর বাতিল না হলে, নীলরতনের পরামর্শ মেনে বিশ্রামে না গেলে এত তাড়াতাড়ি ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ ও ভারতের কবির সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারলাভ যে ঘটত না, এ নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই৷২২

রাজনীতি, রবীন্দ্রনাথ ও নীলরতন ১৯১৭ সালে ইংরেজ ভারতে স্বায়ত্তশাসনের আভাস দিলে কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী বা বামপন্থী সদস্যদের মতবিরোধ চরমে ওঠে৷ বামপন্থীরা আসন্ন কংগ্রেস অধিবেশনে তথাকথিত বামপন্থী অ্যানি বেসান্টকে কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে চাইলেন৷ এইজন্য অভ্যর্থনা সমিতির চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁরা রায়বাহাদুর বৈকু ন্ঠনাথ সেনকে সরিয়ে চাইলেন রবীন্দ্রনাথকে৷ কংগ্রেসের বামপন্থী নেতারা সেপ্টেম্বরে এই আর্জি নিয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে৷ কবি পরামর্শ নিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডা. নীলরতন সরকার ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের৷ অ্যানি বেসান্টকে ক্ষণে ক্ষণে রংবদলে দক্ষ বলে মত দিলেন মধ্যপন্থী নীলরতন৷ বেসান্টের প্রতি অনাস্থার কথা জানালেন মডারেটর রামানন্দও৷ তবু এই একবার মাত্র দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু র মতামত অগ্রাহ্য করে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হলেন রবীন্দ্রনাথ৷ এতদিন বেসান্টে অবিশ্বাসী নরমপন্থী নেতারাও এরপর বেসান্টকে কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে মেনে নিলে রবীন্দ্রনাথ স্বেচ্ছায় ঐ পদ ছেড়ে বৈকু ণ্ঠনাথকে আবার ঐ পদে বসান৷২৩ এ বিষয়ে নীলরতন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সহমত হতে না পারলেও দুই বন্ধু ই ছিলেন সংকীর্ণ দলাদলির ঊর্ধ্বে৷ দুজনের কেউই রাজনীতিতে কোনো ধরনের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে প্রশ্রয় দেন নি কোনোদিন৷ ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে চরমপন্থী ও নরমপন্থীদের মধ্যে বিরোধ কদর্য দলাদলির আকার নিলে ডা. নীলরতন সরকার কংগ্রেসের কাজকর্ম থেকে সরে আসেন৷ প্রায় একই সময়ে কংগ্রেসের বেশিরভাগ সদস্যের স্বার্থান্ধতা রবীন্দ্রনাথকেও সরিয়ে আনে কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ সংস্রব থেকে৷ দুজনেই দেশপ্রেমকে, স্বরাজলাভকে চরম লক্ষ্য বলে ভেবেছেন৷ ঘৃণা করেছেন স্বার্থপর রাজনৈতিক দলাদলিকে৷

প্রজ্ঞা আর কর্ম, আশ্চর্য সমন্বয় কী আশ্চর্য জীবনীশক্তি, কী তীব্র জীবনবোধ, বিপুল কর্মবৈচিত্র্যে বয়ে গেছে নীলরতন ও রবীন্দ্রনাথ, এই দুই বন্ধু র জীবন৷ আশ্রমের হাজারটা কাজ, বিশ্বভারতীর জন্য অর্থসংগ্রহ, দেশবিদেশ ভ্রমণ, সভা-সমিতির কাজ, আশ্রমের অতিথিদের নিয়মিত দেখাশোনার মতো হাজারটা কাজের মাঝে অবিরত রবীন্দ্রনাথের কলম থেকে বেরিয়ে আসছে একের পর এক কবিতা-গান-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ৷ প্রায় সারা সকাল বিপুল রোগীর চাপ সামলে দুপুরে নীলরতন ছুটছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে৷ সন্ধ্যায় রোগীদের বাড়িতে একের পর এক কল৷ এর মাঝে মাঝে মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের কাজ, সভা-সমিতিতে যোগ

দেওয়া, কার্মাইকেল মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলার কাজ৷ সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের কাজ, অন্য নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের কাজকর্ম৷ দুই বন্ধু ই প্রায় সারাদিন ব্যস্ত, তবু অক্লান্ত৷ বিপুল কর্মব্যস্ততায় আশ্চর্য নিয়মানুবর্তিতায় বাঁধা দুই বন্ধু র কর্মজীবন৷ কবি প্রায় মাঝরাতে উঠে উপাসনা শেষ করে বাগানের চা-পর্ব সেরে লিখতে বসে যান ভোরবেলা৷ আর ডাক্তারবাবু সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর বাড়ি ফিরে নৈশাহার সেরে ডু ব দেন নানা ধরনের বইতে৷ একজন ভোরবেলা চায়ের টেবিলের পাশে বসে থাকা কু কু রটিকে নিয়মিত খেতে দেন মাখনরুটি৷ অন্যজন কর্মমুখর দিনের শেষে বাড়ি ফিরে সঙ্গে নিয়ে আসা ফল কেটে খেতে দেন পোষা পাখিটিকে৷২৪ দুজনের কেউই ফেরান না কোনো দর্শনপ্রার্থীকে, কেউ ভু লেও বিরক্ত হন না এত কাজের চাপ অবলীলায় সামলেও৷ দুজনেরই আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব, মুখেচোখে প্রজ্ঞার দীপ্তি৷ দেশবিদেশে প্রায় সবাই চেনেন রবীন্দ্রনাথকে৷ ডা. নীলরতন সরকারের ডাক্তারি প্রতিভার খ্যাতি ভারত পেরিয়ে ছড়িয়েছে ইউরোপে, আমেরিকায়৷ তবু এতটু কু দম্ভ নেই দুই বন্ধু র চলনে বলনে৷ বেশিরভাগ সময় দুজনেরই মুখে স্মিত হাসি৷ আশ্রমবাসীদের পরম আশ্রয় তাঁদের ‘গুরুদেব’,যে কারো যে কোনো সংকটে ভরসা তিনি৷ অসংখ্য দীন দরিদ্র আর্ত পীড়িত মানুষের ভরসা ‘ধন্বন্তরী’ ডাক্তার নীলরতন৷ তাঁকে দেখলেই যেন সেরে যায় অর্ধেক রোগ৷

প্রাণের বান্ধব, আত্মার আত্মীয় নীলরতনের কন্যাদের বিবাহসভায় উপস্থিত হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, উপহার দিচ্ছেন নিজের লেখার পাণ্ডুলিপি৷ ওদিকে কবির মানসপুত্র প্রশান্তচন্দ্রের সঙ্গে হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের কন্যা রানীর বিয়ের পদ্ধতিতে বাদ সাধছেন গোঁড়া ব্রাহ্ম হেরম্বচন্দ্র৷ সংকটমোচনে এগিয়ে আসছেন প্রশান্তচন্দ্রের মেজোমামা নীলরতন৷ তাঁর বাড়িতে আয়োজন হচ্ছে দু’জনের বিয়ের, কন্যা সম্প্রদান করছেন পাত্রের মাতু ল ডাক্তার নীলরতন সরকার৷ মানসপুত্রের বিবাহসভায়, বন্ধু নীলরতনের বাড়িতে সদলবলে হাজির হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, মনের আনন্দে একের পর এক গান গেয়ে মাতিয়ে তু লছেন বিবাহবাসর৷ নবদম্পতি মিলনবসন্তে উপহার পাচ্ছে কবির ‘বসন্ত’ নাটকের পাণ্ডুলিপি৷২৫ ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডি. লিট. দিল রবীন্দ্রনাথকে৷ এর সিদ্ধান্ত ও আয়োজনে মূল ভূ মিকায় ডাক্তার নীলরতন সরকার৷ ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বপ্নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘বিশ্বভারতী’ কে তু লে দিলেন ‘বিশ্বভারতী পরিষদ’-এর হাতে৷ প্রতিষ্ঠার দিন থেকে ঐ পরিষদের আজীবন ট্রাস্টি ও ‘প্রধান’ ডাক্তার নীলরতন সরকার৷

বেশ কয়েকবার বিশ্রাম নিতে বা বেড়াতে শৈলশহর দার্জিলিং-এ গেছেন রবীন্দ্রনাথ, প্রত্যেকবার উঠেছেন অতিথিবৎসল বন্ধু ডা. নীলরতন সরকারের ওখানকার বাড়ি ‘গ্লেন ইডেন’-এ৷ বন্ধু র চিকিৎসার দায় মোটামুটি ১৯২০ সাল থেকে নিজের হাতে তু লে নিচ্ছেন ডাক্তার নীলরতন৷ নিয়মিত পরীক্ষা করছেন কবিকে, প্রয়োজনে করাচ্ছেন পরীক্ষানিরীক্ষা, নির্দেশ দিচ্ছেন বিশ্রামের৷ প্রায় প্রত্যেকবার বিদেশ সফরের আগে কবিকে পরীক্ষা করে যাত্রার ছাড়পত্র দেবেন কে? শরীর যথেষ্ট সুস্থ না-থাকলে কে বাতিল করে দেবেন কবির বিদেশযাত্রা? শরীর অসুস্থ হলে কে তাঁকে পরীক্ষা করে বলবেন, তাঁর শরীরের কলকব্জা সবই মজবুত, অভাব শুধু বিশ্রামের? সব প্রশ্নের উত্তর একটাই৷ কবির পরম বান্ধব ডা. নীলরতন সরকার৷ নীলরতনের দুই কন্যা নলিনী ও অরুন্ধতী প্রায়ই যাচ্ছেন জোড়াসাঁকোয়৷ গান গাইছেন, পিয়ানো বাজাচ্ছেন ‘বিচিত্রা’র অনুষ্ঠানে৷ কবির আদরের বোনঝি সত্যেন্দ্রনাথকন্যা ইন্দিরার সঙ্গে হূদ্যতা তৈরি হচ্ছে দু’বোনের৷ বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা টাউন হল, বসু বিজ্ঞান মন্দির ও আরো নানা জায়গায় রবীন্দ্রনাথের সভায় উপস্থিত থাকছেন ডা. নীলরতন সরকার৷ কোথাও বক্তা হিসেবে, কোথাও বা অসুস্থ কবিকে প্রয়োজনে সাহায্য করতে হতে পারে বলে৷ ১৯৩১ সাল৷ কবির সত্তরতম জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে ‘গোল্ডেন বুক অব টেগোর’৷ অভিজাত ঐ বইটির সম্পাদনার গুরুদায়িত্বে রয়েছেন ডা. নীলরতন সরকার, বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়৷ শুধু এ দেশে নয়, সারা বিশ্বের বিদগ্ধদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে ঐ স্বর্ণগ্রন্থ৷ ঐ বইতে রবীন্দ্রমূল্যায়ন করতে বসে ডা. নীলরতন সরকার লিখছেন, ‘প্রত্যেকটা ঘটনায় সাড়া দেয়, এই বিশ্বে এমন হূদয় হাতেগোনা৷ এমন চোখ আছে ক’জনের যে দৃষ্টিতে সময় ও দূরত্বের সীমাকে অতিক্রম করে ধরা দেয় সব কিছু৷ এমন কথা বলার মানুষ বিরল যে সংশয়ী ও অনিচ্ছু ক মানুষের কানেও পৌঁছে দেয় বক্তার মরমী মন ও দরদী সত্তাকে৷ ...রবীন্দ্রনাথ এই বিরল মানুষদের একজন৷’২৬ রবীন্দ্রনাথের আশ্চর্য প্রতিভার এত সুন্দর, এত গভীর মূল্যায়ন আর কে করতে পারেন! চিকিৎসাবিজ্ঞানের মানুষ হয়েও ডা. নীলরতন সরকার রবীন্দ্রনাথকে জেনেছেন, বুঝেছেন হূদয় দিয়ে৷ উপলব্ধি করেছেন অন্তর দিয়ে৷ দুজনেই মানবতার পূজারি৷ দুজনেরই হূদয় মানবপ্রেমের আলোয় উদ্ভাসিত৷ দুজনেরই জীবনাদর্শে শেষ কথা সব

মানুষের জন্য নিখাদ ভালবাসা৷ এমন দুই মহানহূদয় বঙ্গসন্তান তাই একে অন্যের এত কাছের মানুষ, এত গভীর বন্ধু ত্ব দু’জনের৷ ১৯৩২ সাল৷ বিশ্ববরেণ্য মহামানব রবীন্দ্রনাথ ঠাকু রকে সংবর্ধনা জানাচ্ছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হাউসে আয়োজিত ঐ বর্ণাঢ্য সম্বর্ধনা সভায় উপস্থিত রয়েছেন বাংলার জ্ঞানীগুণী, বিদগ্ধ বহু মানুষ৷ এমন এক উজ্জ্বল সভায় সভাপতির আসনে আর কে বসবেন, কবিবান্ধব নীলরতন সরকার ছাড়া! আশ্চর্য মিল নীলরতন আর রবীন্দ্রনাথ দুই বন্ধু র ধর্মবোধে, ঈশ্বরচেতনায়৷ দুজনেই ব্রাহ্ম৷ উদার, মানবকল্যাণের আদর্শে ঋদ্ধ ধর্মবোধে দুজনেই প্রাণিত৷ রবীন্দ্রচেতনায় ঈশ্বর পরব্রহ্মের রূপ নিয়ে একাকার হয়ে যান বিশ্বমানবতার ধারণায়, বিশ্বপ্রকৃ তির উদারতায়৷ আর নীলরতন ঈশ্বরকে খুঁজে পান আর্ত, পীড়িত, দীন-দরিদ্রের মধ্যে, রোগক্লিষ্ট মানুষের মধ্যে৷ নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করেন দুজনেই৷ দুজনেরই ধর্মবোধে এতটু কু জায়গা পায় না শুষ্ক, মানবতারহিত ধর্মাচার৷ ‘ধর্ম যদি অন্তরের জিনিস না হইয়া শাস্ত্রমত ও বাহ্য আচারকেই বড় করিয়া তোলে তবে সেই ধর্ম যত বড়ো অশান্তির কারণ হয় এমন আর কিছুই না’, মনে করেন রবীন্দ্রনাথ৷২৭ আর নীলরতনের মনে হয়, ‘সমাজের দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের, পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য সেবার ব্রত নেই যে ধর্মে, সেই ধর্ম আত্মবিলাসমাত্র৷’২৮ দুজনেই পরম অতিথিবৎসল৷ নানা অনুষ্ঠানে আশ্রমে আসা অতিথিদের দেখাশোনায়, তাঁদের আনন্দ দেওয়ায় হাজারটা ব্যস্ততার মধ্যেও পরম মনোযোগী রবীন্দ্রনাথ৷ আর নিজের বাড়িটাকে সব শ্রেণির মানুষের জন্য প্রায় এক অতিথিশালা বানিয়ে তোলেন নীলরতন৷ পীড়িত রোগী থেকে কলকাতায় পড়তে আসা দরিদ্র ছাত্র, আশ্রয়হীন থেকে কোথাও ঠাঁই না-পাওয়া মানুষ--সবার জন্য দুয়ার খোলা ধন্বন্তরী চিকিৎসক ডা. নীলরতন সরকারের বাসগৃহের৷ দার্জিলিংয়ে ডা. সরকারের বাড়ি ‘গ্লেন ইডেন’-ও তাই৷ শৈলশহরে বেড়াতে আসা পরিচিত-অপরিচিত সব মানুষই যেন নীলরতন সরকারের অতিথি৷ অতিথিদের শোয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা করে একেক গ্রীষ্মের রাতে গৃহকর্তার জন্য পড়ে থাকে কোনো ঘরের একটা কোণ৷ সেখানেই কোনোমতে ক্যাম্প খাট বিছিয়ে শুয়ে পড়েন ধন্বন্তরী ডা. নীলরতন সরকার! কবির স্বাস্থ্য শুধু নয়, প্রয়োজনের, সুবিধার দিকে তীক্ষ্ণ নজর কবিবান্ধব নীলরতনের৷ ১৯৩৩ সালে বন্ধু র আমন্ত্রণে দার্জিলিং গিয়ে বন্ধু র বাড়িতে উঠেছেন সপরিবার রবীন্দ্রনাথ৷ কবির জন্য এমন একটা ঘর বাছলেন নীলরতন যে ঘর থেকে দূরের পাহাড়গুলো ধরা দেয় চোখ খুললেই৷ বাড়ির চারপাশের বারান্দার দুটো দিক কাচ দিয়ে ঢেকে একদিকে

তৈরি হল কবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর আঁকার স্টু ডিও৷ অন্যদিকে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের কাঠের কাজের ওয়ার্কশপ৷২৯

কার্মাইকেল, নীলরতন, রবীন্দ্রনাথ দুজনেই কর্তব্যবোধে অবিচল, অটল৷ ১৯১৫ সালে কলকাতার বুকে একটি স্বদেশি মেডিক্যাল কলেজ তৈরির স্বপ্নকে সামনে রেখে বাংলার তখনকার বড়লাট লর্ড কার্মাইকেলের কাছে ছুটছেন নীলরতন৷ কলেজ করতে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বিপুল অর্থ তু লে দিতে হবে বড়লাটের হাতে৷ নিজের রোগীর দেখার ফিজ ছাড়াও সবটু কু সঞ্চয় উপুড় করে দিচ্ছেন ডাক্তার নীলরতন৷ ভিক্ষার ঝু লি হাতে ছুটছেন ধনী রোগীদের বাড়িতে বাড়িতে৷ তাতেও প্রতিশ্রুত অর্থ জোগাড় না হওয়ায় নীলরতন শরণাপন্ন হচ্ছেন বন্ধু রবীন্দ্রনাথের৷ সক্রিয় হচ্ছেন কবি৷ ঠাকু রবাড়ির প্রভাবে পূর্ণ হচ্ছে নীলরতনের ভিক্ষার ঝু লি৷ তৈরি হচ্ছে কলকাতার প্রথম স্বদেশি চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার প্রতিষ্ঠান কার্মাইকেল মেডিকেল কলেজ৷ পরে আর এক প্রতিষ্ঠাতা ডা. রাধাগোবিন্দ করের নামে ঐ কলেজ বদলে যাবে আর. জি. কর মেডিকেল কলেজে৷ প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে সক্রিয় থাকছেন রবীন্দ্রনাথ, আশীর্বাণী পাঠাচ্ছেন ঐ কলেজের পঁচিশ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান (১৯৪১) এ৷৩০

অর্থাভাব, ভিক্ষাব্রত, মানবপ্রেম বিশ্বভারতীকে বিশ্বমানবতার আদর্শে আদর্শ শিক্ষা ও সংস্কৃ তির মিলনকেন্দ্র হিসেবে তিলে তিলে গড়ে তু লেছেন রবীন্দ্রনাথ৷ এই বিশাল কর্মযজ্ঞে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রবল অর্থাভাব৷ নিঃসংকোচে ভিক্ষার ঝু লি হাতে দেশে বিদেশে ‘বিশ্বভারতী’র জন্য অর্থ সংগ্রহে বেরিয়েছেন নোবেল পুরস্কার পাওয়া কবি৷ কখনও বা আশ্রমের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে কলকাতার নানা মঞ্চে নাটকের অভিনয় করিয়েছেন নিজে নেতৃ ত্ব দিয়ে৷ অর্থাভাব মাত্রা ছাড়ালে কবির পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন রবীন্দ্রবান্ধব নীলরতন৷ বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত৷ প্রবল অর্থাভাবের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালে রাশিয়ার দুর্ভিক্ষের সংবাদ জেনে গড়ে তু লেছেন ‘রুশ মনীষী সাহায্যভাণ্ডার’৷ ভাণ্ডারে অর্থ সংগ্রহের জন্য নিজের নাটক মঞ্চস্থ করছেন কলকাতার মঞ্চে৷ সংগৃহীত অর্থ পাঠিয়ে দিচ্ছেন রাশিয়ার নিরন্ন, অভু ক্ত মানুষের কাছে৷৩১ কবির ভাণ্ডারে হাত উপুড় করে সাহায্য করছেন নীলরতন৷ আবার শেষ

জীবনে শিল্পে বিশাল লোকসানের ধাক্কার ভেতরও তীব্র অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে চলা নীলরতন বাড়িতে আসা সাহায্যপ্রার্থীর হাতে তু লে দিচ্ছেন পকেটের টাকা৷ মেয়েরা এ নিয়ে অনুযোগ করলে তাঁদের বোঝাচ্ছেন, কখন মানুষ সাহায্য চায়, সাহায্যপ্রার্থীর প্রয়োজনটা কত জরুরি!৩২ দুই বন্ধু র গভীর মিল শান্তভাবে প্রতিকূ ল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে অবলীলায় বাধাবিপত্তিকে তু চ্ছ করার৷ ‘বিশ্বভারতী’র প্রবল অর্থাভাবকে সামাল দিতে নিজের যাবতীয় বই বিক্রির অর্থ রবীন্দ্রনাথ আজীবনের জন্য দান করছেন ঐ প্রতিষ্ঠানকে৷ পতিসরের আশেপাশের গ্রামের উন্নতিতে নোবেল পুরস্কারের টাকা রাখছেন সেখানকার গ্রামীণ ব্যাঙ্কে, সুদের টাকায় চলেছে পল্লীর উন্নতির কাজ৷ আর নিজের সারা জীবনের বিপুল সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ দেশের শিল্পোন্নতিতে অবলীলায় ঢালছেন নীলরতন৷ লোকসানের বোঝায় শেষ বয়সে বাসগৃহ বিক্রি হতে বসলে থাকছেন অচঞ্চল৷ বলছেন, ‘এই কলকাতা শহরে এখনও পনেরো কু ড়ি টাকায় বাসা ভাড়া পাওয়া যায়৷ আমার ওতেই চলে যাবে৷’৩৩

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ও নীলরতন কবি ও চিকিৎসকের গভীর বন্ধু ত্ব প্রাণিত হয়েছে মানুষের প্রতি নিখাদ ভালবাসায়৷ সব মানুষের জন্য অপার ভালবাসায় উজ্জ্বল হয়েছে দুই বন্ধু র গভীর সম্পর্ক৷ ১৯৩৮ সালে বিসর্পরোগে আক্রান্ত হয়ে কবি চেতনা হারালে খবর পেয়েই পরদিন সকালের ট্রেন ধরে সব কাজ ফেলে হাজির হয়েছেন শান্তিনিকেতনে৷ একা নন, সঙ্গে নিয়ে এসেছেন আরো বেশ কয়েকজন ডাক্তারকে৷ রাতের পর রাত জেগে অচেতন বন্ধু র নাড়িতে হাত রেখে বসে থেকেছেন কবির শয্যার পাশে৷ টানা কয়েকদিনের অক্লান্ত চেষ্টায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছেন রবি ঠাকু রকে৷ কালিম্পংয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় কবিকে কলকাতায় নিয়ে আসার পর একটানা চিকিৎসা করে গেছেন শুধুমাত্র ওষুধ দিয়ে৷ যুক্তি দিয়ে আটকেছেন অন্য ডাক্তারদের কবির শরীরে অস্ত্রোপচারের ইচ্ছাকে৷ শেষ পর্যন্ত নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ধন্বন্তরী নীলরতন৷ শয্যা নিয়েছেন গিরিডির আবাসে৷ কবি চেয়েছিলেন স্বাভাবিক মৃত্যু৷ চেয়েছিলেন ফু ল-ফল-পাতার মতো স্বাভাবিকভাবে, জীবনের বৃন্ত থেকে স্বতঃস্ফূ র্তভাবে খসে যেতে৷ যতদিন সুস্থ ছিলেন, বন্ধু র এই ইচ্ছাকে যথোচিত মর্যাদা দিয়েছেন ডাক্তার নীলরতন৷ চিকিৎসা চলেছে শুধু ওষুধ দিয়ে, বারবার বাদ সেধেছেন অন্য ডাক্তারদের কবির শরীরে অস্ত্রোপচারের প্রস্তাবে৷ ধন্বন্তরী নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লে বিধান রায়ের পরামর্শে কবির দেহে অস্ত্রোপচার হয়েছে ১৯৪১-এর জুলাই মাসে৷ আগে বহুবার নীলরতন সবাইকে সতর্ক করেছেন বন্ধু র

সুকু মার দেহে কাটাছেঁড়ার পরিণতি নিয়ে৷ বারবার জানিয়েছেন অস্ত্রোপচারে রবীন্দ্রনাথের গোটা দেহযন্ত্রটাই বিকল হয়ে যাবার আশঙ্কার কথা৷ তবু তাঁর অবর্তমানে অস্ত্রোপচার হয়েছে কবির শরীরে৷৩৪ সত্যি হয়েছে কবির বহুকালের বন্ধু র আশঙ্কা৷ অস্ত্রোপচারের পর ক্রমাগত অবনতি ঘটেছে কবির অবস্থায়৷ শেষ সময়ে তাঁকে দেখতে নিয়ে আসা হয়েছে এতকালের বন্ধু ডা. নীলরতন সরকারকে৷ দেখেই বুঝেছেন ধন্বন্তরী, সব আশা শেষ৷ ‘কতবার এই বন্ধু কে তিনি ফিরিয়ে এনেছেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে৷ কিন্তু এখন আর উপায় নেই৷ সব্যসাচীর হাত থেকে গাণ্ডীব পড়েছে খসে৷’৩৫ অনেকক্ষণ বন্ধু র হাতে হাত বোলালেন নীলরতন, তারপর ফিরে চললেন সজল নয়নে৷

অমৃতলোকে মহামিলন ২১ শে শ্রাবণ ১৩৪৮৷ কবি শুয়ে আছেন জোড়াসাঁকোর ঘরে৷ শিয়রে পূর্ণিমার চাঁদ৷ অচেতন কবির অপরূপ মুখশ্রীকে উজ্জ্বলতর করে তু লেছে ভরাচাঁদের অপার্থিব আলো৷ পরদিন দুপুরে অমৃতের পথে যাত্রা করছেন মহামানব রবীন্দ্রনাথ৷ এরপর আর কতদিনই বা এই ধরাধামে বন্ধু কে ছেড়ে জীবন কাটাবেন তাঁর আত্মার আত্মীয়৷ বছর ঘুরতেই নীলরতন আক্রান্ত হলেন সন্ন্যাস রোগে৷ স্মিত মুখে নির্ভয়ে এগিয়ে চললেন জীবনের বৃত্তটি পূর্ণ করার পথে৷ ১৮ মে, ১৯৪৩৷ ধন্বন্তরী শুয়ে আছেন গিরিডির ‘মাজলা কু ঠী’র ঘরে৷ পায়ের দিকের জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ভরা চাঁদ৷ চাঁদের ফু টফু টে আলোয় জানালায় কবির মুখ দেখছেন নীলরতন৷ হাতছানি দিয়ে ডাকছেন রবীন্দ্রনাথ৷ ‘আসুন নীলরতনবাবু!’ বন্ধু র ডাকে সাড়া দিয়ে ধরাধাম ছেড়ে চললেন নীলরতন৷ পুত্র কন্যা জামাতাদের সাক্ষী রেখে, সব কাজ শেষ করে জীবনের বৃত্তটি পূর্ণ করলেন রবি ঠাকু রের আত্মার আত্মীয় ডা. নীলরতন সরকার৷ রাতে উশ্রী নদীর বুকে ভেঙে খানখান হচ্ছিল পূর্ণিমার চাঁদ৷ চাঁদকে সাক্ষী রেখে, চিতার লেলিহান শিখাকে স্পর্শ করে ঊর্ধ্বপানে চললেন ধন্বন্তরী৷ অমৃতলোকে ঘটে গেল দুই বন্ধু র মহামিলন৷

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু, বিধান রায় ও নীলরতন ডা. নীলরতন সরকার বারবার বারণ করেছেন কবির দেহে অস্ত্রোপচার করতে৷ বারবার বলেছেন শুধু ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাবার কথা৷ বলেছেন, ‘ভু লে যেও না, রোগী অন্য কেউ নন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ৷ সুকোমল দেহ ওঁর, খুব সুন্দর করে বাঁধা একটা

তানপুরার মতো, সামান্য আঘাতে গোটা দেহযন্ত্রটা ভেঙে পড়তে পারে৷’ যতদিন সুস্থ ছিলেন নীলরতন আটকেছেন অন্য একদল ডাক্তারের কবির দেহে অস্ত্রোপচারের ইচ্ছা৷ রবীন্দ্রনাথও চান নি, তাঁর দেহে কাটাছেঁড়া হোক৷ নীলরতন চেয়েছিলেন কবির অসুখের ব্যক্তিনির্দিষ্ট বা সাবজেকটিভ চিকিৎসা৷ এই সিদ্ধান্ত ডা. বিধান রায় অগ্রাহ্য করলেন নীলরতন অসুস্থ ও স্ত্রীর মৃত্যুতে কাতর হয়ে গিরিডি চলে যাবার পর৷ প্রস্টেটগ্রন্থি বড় হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের৷ মূত্রপথ রুদ্ধ হয়ে বাড়ছিল রক্তে ইউরিয়ার মাত্রা৷ সমস্যার নাম ইউরিমিয়া৷ ১৯৪১ সালে সামান্য কিছু মানুষের প্রস্টেটগ্রন্থি বাদ দেবার অস্ত্রোপচার পরীক্ষামূলকভাবে সবে চালু হয়েছে পশ্চিমের কিছু দেশে৷ এ দেশে বসে ঐ অস্ত্রোপচারের কথা ভাবাও সম্ভব ছিল না সেদিন৷ তবু যে মানুষটা বারবার গিয়েছেন বিশ্বের নানা দেশে, নানা দেশে অসংখ্য অনুরাগী যে কবির, তাঁর এমন অসুখে কেন মার্কিন, ব্রিটিশ বা জার্মান ডাক্তারদের পরামর্শ অন্তত নেওয়া হয় নি, আক্ষেপ হয় বারবার৷ মানুষটা যে অন্য কেউ নন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ৷ বিদেশে বহুবার চিকিৎসা হয়েছে তাঁর, অর্শের অস্ত্রোপচার হয়েছে লন্ডনে৷ অথচ এমন এক জটিল সমস্যায় কেন নেওয়া হল না বিদেশি চিকিৎসকদের পরামর্শ? বহু পরিশ্রম করেও এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর আজও যায় নি খুঁজে পাওয়া৷ কবির চিকিৎসার বিষয়ে, কবির শেষ অবস্থায় চরম বিচলিত অবস্থায় ছিলেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ৷ ছিলেন খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়৷ বিদেশ যাবার মত শারীরিক অবস্থায় ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ৷ তবু বিদেশের ডাক্তারদের মতামত নেওয়া ছিল না অসম্ভব৷ এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারতেন রথীন্দ্রনাথ, নিতে পারতেন কবির মানসসন্তান প্রশান্তচন্দ্র৷ কেন নেওয়া হয় নি এরকম উদ্যোগ, এখনও জানা নেই৷ অনুসন্ধান তবু থেমে নেই৷ ধন্বন্তরী নীলরতন বৃদ্ধ হয়েছেন, তিনি স্ত্রীর মৃত্যুতে গিরিডি চলে যেতেই চিকিৎসার দায় হাতে তু লে নিয়েছেন নীলরতনের ছাত্র ডা. বিধান রায়৷ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মূত্রাশয়ে ছিদ্র করে মূত্রপথে অবরোধ সরিয়ে দেবার৷ আজকের দিনে এরকম অস্ত্রোপচার সামান্য ফোঁড়া কাটার মত ব্যাপার৷ সালটা ১৯৪১, পেনিসিলিন তখনও আসে নি, জীবাণুর আগ্রাসন আটকানোর একমাত্র ব্যবস্থা সালফোনামাইড৷ যে ওষুধ নীলরতনের ব্যবস্থা অনুযায়ী কবি খেয়ে চলেছেন বেশ কয়েকমাস৷ ধন্বন্তরী কলকাতা থেকে অদৃশ্য হতেই সক্রিয় হচ্ছেন বিধানবাবু৷ ব্যক্তিনির্দিষ্ট সাবজেকটিভ চিকিৎসা থেকে ব্যক্তিনিরপেক্ষ অবজেকটিভ চিকিৎসা চাইছেন তিনি৷ যতদিন

কলকাতায় আছেন নীলরতন, তাঁর মতকে অগ্রাহ্য করার সাহস বা ক্ষমতা বিধান রায়ের নেই৷ তিনি শহর থেকে অদৃশ্য হতেই তাই বিধানবাবুর কবির দেহে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত৷ রবীন্দ্রনাথ চাইছেন ফু ল পাতা বৃক্ষের মত স্বাভাবিক পথে ঝরে যেতে৷ রথীন্দ্রনাথও চাইছেন, চিকিৎসা চলুক ওষুধ দিয়ে৷ কবি ও কবিপুত্রের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিলেন না ডা. বিধান রায়৷ বললেন, ‘অপারেশন ছাড়া উপায় নেই৷ নইলে সারা দেশ আমাদের অপরাধী বানাবে৷’ স্থির করলেন অস্ত্রোপচার করবেন বিখ্যাত সার্জেন ডা. ললিত ব্যানার্জী৷ ১৯৪১এর ১৬ জুলাই ললিতবাবুকে সঙ্গে করে বিধানবাবু এলেন বোলপুরে, কবিকে দেখতে৷ দেখতে দেখতে পাশে দাঁড়ানো ললিতবাবুর কাছে জানতে চাইলেন, ‘কি? কবে করছ অপারেশন?’৩৬ ললিতবাবু জানতেন, বিধানবাবুর কথাই শেষ কথা৷ লাভ হবে না তাঁর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে৷ মানুষটা যে বিধান রায়৷ কিছুক্ষণ চু প থেকে গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন, ‘তোমরা যেদিন বলবে৷’ ১৯৪০-এর ১৫ সেপ্টেম্বরে কালিম্পংয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার রাতে দার্জিলিংয়ের সিভিল সার্জেনও চেয়েছিলেন সেই রাতেই অস্ত্রোপচার করতে৷ মত দেন নি কবির পুত্রবধু) প্রতিমা দেবী৷৩৭ এবার কিন্তু আটকানো গেল না অস্ত্রোপচার৷ সামান্য অস্ত্রোপচারে সেরে উঠবেন কবি, তাঁর মাথার ঝাপসা ভাব যাবে কেটে, আরও অন্তত দশ বছর লিখতে পারবেন তিনি, বিধানবাবু বললেন কবিকে৷ এই আশ্বাস পেয়েই অস্ত্রোপচারে মত দিলেন রথীন্দ্রনাথ৷ কবিও চু পচাপ রইলেন, বিরোধিতা করলেন না অস্ত্রোপচারের৷ আর কিই বা করার ছিল বৃদ্ধ কবির! বিধান রায়ের মত ডাক্তারের সিদ্ধান্তকে মুখ বুজে মেনে নেওয়া ছাড়া৷ কবির আসন্ন মৃত্যুকে আটকাতে চাইছেন বিধানবাবু, তাই সম্ভবত তাঁর এই সিদ্ধান্ত৷ তবু প্রশ্ন উঠে আসে ডাক্তারি মনে৷ কবি সেরে উঠবেন, অনেকদিন লিখতে পারবেনএরকম আশ্বাস ১৯৪১-এ, প্রাক-পেনিসিলিন যুগে দেওয়া কতটা বাস্তবসম্মত? যে কোনও অস্ত্রোপচারে থাকে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা, আজকের দিনে যা সহজে আটকাতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিবায়োটিকহীন ১৯৪১ তা পারত না৷ কবিপুত্রকে এরকম আশঙ্কার কথা খুলে বললেন না কেন বিধানবাবু? বললে তিনি মত দিতেন অস্ত্রোপচারে? দিতেন না৷ ঘটনাক্রম তাই বলে৷ ইনফেকশনের আশঙ্কার কথা বলা হল না, বলা হল না ঐ বয়সে ইনফেকশন হলে অ্যান্টিবায়োটিকহীন যুগে জীবনসঙ্কট দেখা দেবার কথা৷ কবির স্বাভাবিক মৃত্যু-ইচ্ছাটিকে করা হল উপেক্ষা৷ কেন? কেন সেদিন কবির দেহে অস্ত্রোপচার না করবার নীলরতনের

সিদ্ধান্তকে উড়িয়ে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিলেন বিধান রায়? কবির বহুকালের বন্ধু কবির দেহযন্ত্রটিকে চিনতেন বহুকাল, যা চেনা সম্ভব ছিল না বিধান রায়ের পক্ষে৷ অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে ইনফেকশন হয়ে কয়েকদিন বাদে মৃত্যু হল কবির৷ এমন একটা সময়, যখন তাঁর মস্তিষ্কে আশ্চর্য সৃজনদক্ষতা৷ অস্ত্রোপচারের আগে মুখে মুখে কবি একের পর এক কবিতা বলছেন, লিখে নিচ্ছেন রানী চন্দ৷ এভাবে অস্ত্রোপচারের দিন সকালে লেখা হল ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি’ কবিতাটি৷ কবি রানী চন্দকে বললেন, সেরে উঠে সংশোধন করবেন ঐ কবিতা,৩৮ অর্থাৎ বিধানবাবুর আশ্বাসে ছিল কবির বিশ্বাস৷ সেরে উঠবেন জেনেই না করেন নি অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্তে৷ আশঙ্কা আছে সেরে না ওঠারও, জানতেন না রবীন্দ্রনাথ৷ জানলে, অবশ্যই মেনে নিতেন না অস্ত্রোপচার৷ এসব তথ্য আর যুক্তিবুদ্ধির আলোয়, একজন চিকিৎসকের দৃষ্টিতে, সেই সময়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অবস্থান মাথায় রেখে, ডা. বিধান রায়ের সেদিন নেওয়া এরকম সিদ্ধান্তকে ‘ঐতিহাসিক ভু ল’ বলি যদি, যদি বলি এক বড় মাপের চিকিৎসকের চরম হঠকারিতা, এতটু কু ভু ল হবে না সে বলায়৷ ভু ল হবে না ডা. নীলরতন সরকারের মত মেনে তখন ওষুধ দিয়ে চিকিৎসাই সঠিক হত, এ কথা বললেও৷ রোগীকে আশ্বাস দেওয়া যেমন চিকিৎসকের দায়িত্ব, তাঁর নিকটজনকে চিকিৎসাপদ্ধতির ভালোমন্দ বুঝিয়ে বলাও তাই৷ ডা. বিধান রায় সেদিন চিকিৎসক হিসেবে নিজের সঠিক দায়িত্ব পালন করলে রথীন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্রনাথ, কেউই রাজি হতেন না অস্ত্রোপচারে, ঘটনাক্রম তাই বলে৷ নীলরতনের দেখানো পথে চিকিৎসা চললেও হয়তো বেশিদিন বাঁচতেন না রবীন্দ্রনাথ৷ তবু সেক্ষেত্রে তাঁর ফু ল-ফল-পাতার মত ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’র ইচ্ছাটি মর্যাদা পেত৷ এত বড় মাপের এক বঙ্গসন্তানকে পৃথিবী ছাড়তে হত না এত কষ্ট পেতে পেতে৷ যে ক’দিন বাঁচতেন কবি, আরও অনেক আশ্চর্য সৃষ্টি হয়তো পাওয়া যেত ব্যতিক্রমী এই স্রষ্টার কলম থেকে৷ দুর্ভাগ্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের৷ ডা. আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন খুঁজে পেয়েও ঐ জীবনদায়ী ওষুধ তৈরির কাজ মাঝপথে ছেড়ে না-দিলে ১৯৪১-এর অনেক আগেই হয়তো চলে আসত জীবন ফিরিয়ে দেওয়া ওষুধ পেনিসিলিন৷ বাঁচত অনেক অসহায় রোগী, কমত অনেক যন্ত্রণা৷ দুর্ভাগ্য বাঙালির৷ বাঙালির ইতিহাসে সবচাইতে উজ্জ্বল, সমৃদ্ধ ‘পূর্ণ মানব’কে কাটাছেঁড়া-করা শরীরে একটানা ন’ দিন তীব্র যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে হার মানতে হল জীবাণুদলের আগ্রাসনের হাতে৷

রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের মিলনমেলা শান্তিনিকেতনে শেষ নিঃশ্বাসটি ফেলতে৷ হয় নি৷ কবি চেয়েছিলেন স্বাভাবিক মৃত্যু৷ হয় নি৷ নীলরতন সরকার কলকাতায় থাকলে হয়তো অস্ত্রোপচার হত না কবির৷ শান্তিনিকেতন ছেড়ে তাঁকে যেতে হত না কলকাতায়৷ তিনি মৃত্যুর দেশে পাড়ি দিতে পারতেন শান্তিনিকেতনের মাটি থেকে৷ তাহলে তো আর হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানবপিণ্ড অথবা উন্মত্ত জনস্রোতের অগুনতি মাথার ওপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে দাড়িগোঁফ উপড়াতে উপড়াতে রবি ঠাকু রের মরদেহটিকে সেদিন বিলীন হতে হত না কলকাতার নিমতলার মহাশ্মশানে৷ বন্ধু নীলরতন কলকাতা ছেড়ে গিরিডি চলে না গেলে কবি হয়তো ঝরে যেতে পারতেন তাঁর স্বপ্নের আশ্রমের নিভৃ ত এক কোণে৷ কি বিচিত্র এ জীবন! মা সারদা দেবীর মৃত্যুর সময় মাকে দেখতে পায় নি বালক রবি৷ মা চলে গেছেন বুঝতে পেরেছে শিশু এক দাসীর আর্ত চিৎকারে, ‘ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রে!’৩৯ কবিপত্নী মৃণালিনী যখন মারা যান, সেই রাতের শেষ প্রান্তে ভোরবেলা ‘লালবাড়ি’তে মায়ের ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রথীন্দ্রনাথসহ ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারে, ‘মা আর নেই, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷’৪০ মায়ের মুখাগ্নির সুযোগও পেলেন না পুত্র রথীন্দ্রনাথ৷ কবির মৃত্যুর পর উন্মত্ত জনস্রোতের তাণ্ডবে নিমতলা শ্মশানে পৌঁছোতে পর্যন্ত পারলেন না রথীন্দ্রনাথ৷ জীবিত একমাত্র পুত্র সুযোগ পেলেন না পিতার মুখাগ্নির৷ ‘ছায়া ছায়া কত ব্যথা’ই যে অনন্তকাল ধরে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে ঘুরে বেড়ায় এই ধরাধামে! তথ্যসূত্র ১. Golden Book of Tagore, ed. by Ramananda Chatterjee, J.C. Bose et al, Golden Book Committee, 1931, ভাষান্তর : লেখক৷ ২. চিকিৎসাবিজ্ঞানে বাঙালি, অরুণকু মার চক্রবর্তী, সাহিত্যবিহার, কলকাতা৷ ৩. জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র, বিশ্বভারতী৷ ৪. নীলরতন সরকার কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী পত্রিকা, বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৬৯৷ ৫. পত্রাবলী ণ্ডরবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্রণ্ণ, দিবাকর সেন সম্পাদিত, বসু বিজ্ঞান মন্দির, কলকাতা৷ ৬. রবিজীবনী, প্রশান্তকু মার পাল, আনন্দ৷ ৭. পত্রাবলী ণ্ডরবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্রণ্ণ, দিবাকর সেন সম্পাদিত, বসু বিজ্ঞান মন্দির, কলকাতা৷ ঠা

৮. পিতৃ স্মৃতি, রথীন্দ্রনাথ ঠাকু র, জিজ্ঞাসা পাবলিকেশন, কলকাতা৷ ৯. রবিজীবনী, প্রশান্তকু মার পাল, আনন্দ, দ্বিতীয় খণ্ড৷ ১০. রবিজীবনী, প্রশান্তকু মার পাল, আনন্দ চতু র্থ খণ্ড৷ ১১. ঐ ১২. বিশ্বপরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র, বিশ্বভারতী৷ ১৩. বিশ্বভারতী পত্রিকা, চৈত্র ১৩৪৯, ৫৬৬৷ ১৪. বিজ্ঞান ও জাতীয়তাবাদ (১৩), দৈনিক স্টেটসম্যান, ১৫. ৬. ২০০৮৷ ১৫. রবিজীবনী, প্রশান্তকু মার পাল, আনন্দ, চতু র্থ খণ্ড৷ ১৬. ঐ ১৭. আাচার্য প্রফু ল্লচন্দ্র, দেবেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা৷ ১৮. রবিজীবনী, প্রশান্তকু মার পাল, আনন্দ৷ ১৯. Rabindranath and D.M. Bose, Dibakar Sen, DM Bose Commemorative Volume, Bose Institute, Calcutta. ২০. রবিজীবনী, প্রশান্তকু মার পাল, আনন্দ৷ ২১. রবীন্দ্রনাথের চেনাশোনা মানুষ, প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায়, ইষ্টলাইট বুক হাউস, কলকাতা ১৷ ২২. চিঠিপত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র, ১৭ খণ্ড, বিশ্বভারতী৷ ২৩. শারদীয় যুগান্তর, ১৩৬৫ (১৯৫৮)৷ ২৪. পিতৃ দেব স্মরণে, নলিনী দেবী, বোস ইনসটিটিউট প্রকাশিত পুস্তিকা, ১৯৮৩৷ ২৫. আম্রপালী মিউসিয়ম, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনসটিটিউট, বরানগর-এ প্রদর্শিত তথ্য ও পাণ্ডুলিপির চিত্র৷ ২৬. ১ অনুরূপ, ভাষান্তর : লেখক৷ ২৭. কালান্তর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র৷ ২৮. ৪ অনুরূপ৷ ২৯. সদ্যপ্রয়াত নীলরতনের দৌহিত্রী, অরুন্ধতী-কেদারনাথ কন্যা ইষিতা দত্তের নন্দন রোড, কলকাতার বাড়িতে লেখককে দেওয়া সাক্ষাৎকার৷

৩০. Souvenir of R. G. Kar Medical College Ex-Sterdents Assn 1966. ৩১. চিঠিপত্র, ১৭ খণ্ড, বিশ্বভারতী৷ ৩২. ২৪ অনুরূপ৷ ৩৩. ৪ অনুরূপ৷ ৩৪. ২ অনুরূপ৷ ৩৫. নীলরতন সরকার, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, প্রবাসী, শ্রাবণ ১৩৫০৷ ৩৬. ২ অনুরূপ৷ ৩৭. নিবাণ, প্রতিমা দেবী, বিশ্বভারতী৷ ৩৮. গুরুদেব, রানী চন্দ, বিশ্বভরতী৷ ৩৯. রবিজীবনী, প্রশান্তকু মার পাল, আনন্দ, ১ম খণ্ড৷ ৪০. পিতৃ স্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র, জিজ্ঞাসা৷

ঋণ : ঈশিতা দত্ত, ড. রঞ্জনকু মার দে৷

সংকট সভ্যতার, সংস্কৃ তির : কবির দৃষ্টিতে উদয়নারায়ণ সিংহ ‘সভ্যতার সংকট’ একাধিক অর্থে ভাষা ও সংস্কৃ তির সংকটও৷ যদিও দূরদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ এই বক্তৃ তা ও লিখিত নিবন্ধে সমাজ ও রাজনীতির কোণে ঘনিয়ে আসা দুর্দিন ও কালোমেঘের ছবিই করেছেন চিত্রিত এবং যদিও ‘পরদেশিকতা’ অথবা কলোনিয়ালিজমের দম্ভ ও শাসক-শাসিতের মধ্যে ধরা বিশ্বাসের ফাটলই এই বক্তৃ তায় অধিকতর স্পষ্টভাবে ফু টে উঠেছে-এক অর্থে সভ্যতার সংকট একটি সাংস্কৃ তিক বিপন্নতার প্রতিও ইঙ্গিত করে৷ তারই সঙ্গে পথ-হারানো, স্রোত-হারানো ছোটো ছোটো ভাষা সম্প্রদায়গুলির হতাশা ও ক্রন্দনও কোথাও লুকিয়ে রয়েছে৷ যে মানুষ প্রকৃ তিকে মনে করছে নিজস্ব সম্পদ, যার উপর মানবেতর পশুপাখির কোনো অধিকার নেই-অতএব প্রকৃ তিতে যেমন ইচ্ছা পরিবর্তন ও প্রদোষ ডেকে আনা যায় নিজের খেয়াল-খুশি মতন-সেই মানুষ যে শেষমেশ দৈত্যবৎ ভাষা-সংস্কৃ তিরই জয়ধ্বনি গাইবে ও সংহারক সংস্কৃ তিরই ধুয়ো তু লতে থাকবে, সে বিষয়ে আর সন্দেহ কী? আজ যে বিশ্ব জুড়ে বিপন্ন ভাষা নিয়ে বিরাট সর্বেক্ষণের পরিণতিতে দেখা যাচ্ছে আমরা ক্রমশ মুছে দিচ্ছি পৃথিবীর শরীর থেকে বিভিন্ন রকমের চিত্র-বৈচিত্র্য, কবি রবীন্দ্রনাথ যেন তারই ইঙ্গিত বহুবার করেছেন সংকটের বাণী শোনাতে গিয়ে৷ ‘সভ্যতার সংকট’ নিবন্ধের আলোচনা করতে গিয়ে অন্য একটি সংকটও ফু টে ওঠেযার মূলে রয়েছে এই একই নিবন্ধের বাংলা মূল এবং ইংরেজি প্রতিরূপের মাঝের শূক্ষ্ম ফারাক, যে বিষয়ে ইঙ্গিত কিন্তু কবি নিজেই করে গেছেন৷ কিছু কিছু শব্দের সাংস্কৃ তিক শিকড় এমনই গভীর যে সেগুলি অনবদ্যও বটে, অননুবাদ্যও বটে৷ ‘সিভিলাইজেশান’ কিংবা ‘নেশান’ কথাগুলি এই পর্যায়েরই অবধারণা, যেমন ‘ধর্ম’ আর ‘সদাচার’ এদেশীয় অবধারণা৷ হালে সাহিত্য আকাদেমির দিল্লির একটি আলোচনাসভায় অধ্যাপক হরীশ ত্রিবেদীর ‘Crisis in Civilisation’-এর ইংরেজি তর্জমা-নির্ভর ব্যাখ্যার বোধের ক্ষেত্রে যে ফাঁক থেকে যাচ্ছে-এই দৃষ্টিতে তার একটি সুন্দর ব্যাখ্যা প্রস্তুত করেছিলেন অগ্রণী শিল্পবিদ শ্রী শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এ প্রসঙ্গে ভাষা-সংস্কৃ তির পিছনের সারির ছাত্র হিসেবে আমারও কিছু বক্তব্য ছিল৷ ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে ‘ক্রাইসিস’ এই ইংরেজি শব্দটির ব্যবহারের ইতিহাসের সূত্র-সন্ধান আমাকে নিয়ে যায় চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিধির মধ্যে, যার বাইরে এর ব্যবহারের সূচনা ১৬২০ খ্রিস্টাব্দের পর৷ গোড়াতে শব্দটির উৎপত্তি প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান ক্রিয়ামূল ‘ক্রি’ (ছাঁকা, প্রভেদ করা, পার্থক্য করা অর্থ) থেকে-যার সাক্ষ্য দেয় গ্রিকভাষায়

ব্যাখ্যা করা অর্থে ব্যবহূত krinesthai শব্দ, আবার প্রাচীন ইংরেজি hriddel বা লাতিন cribrum এই ক্রিয়ারূপকে নিয়ে যায় ছাঁকা, বিচার করা বা সীমা নির্দেশ করা ইত্যাদি অর্থের অভিমুখে (cf Harper Douglas, 2001-10, Online Etymology Dictionary, http://www.etymonline.com/index.php)৷ সাক্ষ্যপ্রমাণ অনুযায়ী গ্রিক শব্দ ‘ক্রাইসিস’ প্রথম যুগে হিপোক্রেটাস বা গ্যালেন-এর মতো চিকিৎসাবিদরা ব্যবহার করেছেন কোনো রোগের সন্ধিক্ষণ বা সংকট-মুহূর্ত বোঝাতে৷ অতএব তত্ত্বগতভাবে আমরা ‘ক্রাইসিস’ শব্দটিকে আসন্ন সর্বনাশের পরিণতির উপলব্ধির সূচনার পরিবর্তে বরং কোনো সন্ধিক্ষণ বা সংকট-মুহূর্ত বোঝাতে ব্যবহার করতে পারি৷ এই সূত্রে স্যান্ডি ক্রলিক তাঁর প্রবন্ধ ‘Crisis in Civilization and Cultural Criticism’ (March, ২০১০) -এর সূচনায় যে যথার্থ মন্তব্য করেছেন তা আমরা দেখে নিতে পারি-‘সমালোচকেরা বলেন, ইতিহাস অধ্যয়নে যারা ব্যর্থ সেই দুর্ভাগারাই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করে৷ তাই, আমরা সর্বদাই পিছনপানে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিই বিগত যুগের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে, চেষ্টা করি অতীতকালের জাতিগুলি যে সব বিপজ্জনক ফাঁদে ঘটনাক্রমে পা দিয়েছে, সেগুলিকে পরিহার করার উপায় নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে৷ নিশ্চিতভাবেই ইতিহাসের উদ্ভব হয়, কিভাবে এই জগৎ গড়ে উঠেছে, কিভাবে এখানে বিভিন্ন ক্রিয়াকর্ম ঘটে, ঐতিহাসিক বর্ণনার যুক্তিপ্রণালী এবং ভাষার প্রকৃ তি বিষয়ে একগুচ্ছ ধারণা থেকে৷’ আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে আমাদের সভ্যতা, যা এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, তার ধ্রুবসূচকগুলির পুনর্নির্মাণের জন্য যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে কিনা৷ এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে কান্টের যথাযথ মন্তব্য (প্রলেগোমেনা/মেটাফিজিক্স), যেখানে তিনি বলেন, ‘নির্মাণপ্রকল্পে মানবজাতির যুক্তিবোধ এমনি এক স্ফূ র্তিলাভ করে যে বহুবার তা উচচ এক অট্টালিকা নির্মাণ করেছে, যা পরে সে নিজেই ধ্বংস করেছে তার ভিত্তিভূ মির প্রকৃ তি পরীক্ষার্থে৷ প্রাজ্ঞতা অর্জনের জন্য কখনোই খুব বেশি সময় লাগে না৷ কিন্তু পরিবর্তন যদি বেশি বিলম্বিত হয়, তবে সংস্কার আরম্ভ করা সর্বদাই আরও আরও কঠিন হয়ে পড়ে৷’ (কান্ট, ১৭৮৩ ইং অনু, ১৯০২) অমীমাংসিত প্রশ্নটি হল এই যে ইতিমধ্যেই কি যথেষ্ট দেরি হয়ে যায় নি, এবং আমাদের অনুভূ তিগুলি কি এতদূর গতানুগতিক কিংবা ভোঁতা হয়ে গেছে, এবং উপলব্ধির জগৎটাই কি এতদূর বহুধাবিভক্ত যে এই বিশ্বজগৎ আমাদের কাছে এক খণ্ডবিচ্ছিন্ন অস্তিত্বমাত্র? ১৯৪১ সালে, ৮০ বছর বয়সে কবি রবীন্দ্রনাথ ‘সভ্যতার সংকট’ শীর্ষক অভিভাষণে স্বীকার করলেন যে, আমাদের সম্পূর্ণ জাতিসত্তাই নয়, সমগ্র জগৎসংসারেরই উপলব্ধি এতই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে যে আমরা বিচ্ছিন্নবাদী এক মনোভঙ্গি নিয়েই দেখব বলে স্থির করেছি, কোনো কিছুকেই এক

সমগ্রতার চোখে দেখতে আমরা অক্ষম৷ আমরা যেন এক ঘোরের মধ্য দিয়ে গিয়ে জগৎকে শুধুই ‘আমরা’-‘ওরা’, ‘অন্দরের’ বা ‘বাইরের’ নিরিখে বিবেচনা করি৷ কবি দুঃখ করে বলেন, ‘পূর্বতম দিগন্তে যে জীবন আরম্ভ হয়েছিল তার দৃশ্য অপর প্রান্ত থেকে নিঃসক্ত দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি এবং অনুভব করতে পারছি যে, আমার জীবনের এবং সমস্ত দেশের মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে সেই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে গভীর দুঃখের কারণ আছে’৷১ অথচ এও সত্য যে যে-ভাষা এবং সংস্কৃ তি বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটিয়েছে তা প্রধানত ইংরেজি৷ এমনকি একথাও সত্য যে এখনও ইংরেজি ভাষা বিশ্বের প্রাঙ্গণের দিকে তাকানোর বেলায় যেন আমাদের একটা খোলা জানালার মতো, যদিও গত ২৫০ বছরে সংস্কৃ তির সহায়িকা পদ্ধতি রূপেও ইংরেজি এক বিশাল অবস্থান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে৷ কবির দৃষ্টিতে দেখলে বলতে হয়, ব্রিটিশ আমাদের শাসকস্বরূপ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আগেই ইংরেজি সাহিত্য যে উচচতায় পৌঁছেছিল, তা ছিল এই ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আমাদের সদর্থক প্রতিক্রিয়ার অন্যতম কারণ৷ অতএব এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, ইংরেজি কবিতা ও নাটকের পাশাপাশি, সাধারণ নব্যশিক্ষিত ভারতীয় তাদের ব্রিটিশ প্রভু র জীবনযাপনের ধরন ও সংস্কৃ তিকে তার সংগীত, রুচিবোধ, বেশভূ ষা এমনকি খেলাধুলো সমেত সমাদর করেছে৷ এর মূল কারণ হল আমরা না ছিলাম বিবিধ বিষয়ের প্রকাশ ও প্রচার করার জন্য যথেষ্ট সৃজনশীল, না ছিলাম বিশ্বব্যাপী আমাদের সংস্কৃ তিকে তু লে ধরার জন্য যথেষ্ট উদ্যোগী৷ মনে করুন কবির মন্তব্য, ‘তখন আমাদের বিদ্যালাভের পথ্য পরিবেশনে প্রাচু র্য ও বৈচিত্র্য ছিল না৷’ আমরা বরং চিরকাল বিশ্বাস করে এসেছি এমন এক প্রকাশমাধ্যমের নির্মাণ ও র্চ্চায় যা শুধু উচচকোটির মানুষজনেরই অধিগম্য৷ যন্ত্রপাতি, প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যার বিরাট ভাণ্ডারের জ্ঞান ও ব্যবহার সমাজের সংখ্যাগুরু অংশের জন্য নিষিদ্ধ ছিল, যতদিন না একলব্য এবং তার দেখানো পথ পরে রঘুনাথ শিরোমণিরা কেবলমাত্র নিখাদ অধ্যবসায়ের জোরে এই দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে ঢু কে পড়তে থাকেন৷ আমরা যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজস্ব দক্ষতা ও স্বভাবপটু ত্ব বিকশিত করে তু লেছি, উপন্যাস বা ছোটোগল্পের মতো নতু ন মাধ্যম নিয়ে শৌখিনর্চ্চা থেকে শুরু করে, স্কু লপাঠ্য বই লেখার মতো নতু ন বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করা শুরু করেছি অথবা ধরা যাক পণ্যদ্রব্যের বিপণনপ্রচার সংগঠিত করা বা বাণিজ্য উদ্যোগ গড়তে মুদ্রণশিল্পের মতো নতু ন প্রকৌশল ব্যবহার করতে পর্যন্ত চেষ্টা করেছি, সেখানেও আমরা কিন্তু মনের গোপনে ব্রিটিশ মডেলের গুণমুগ্ধ সমর্থকই রয়ে গেছি৷ আমাদের জাতি এবং সমাজ সংগঠনের নির্মাতাদের অন্তরে এই গভীর বিশ্বাস প্রোথিত ছিল যে স্বাধীনতা আসবে ব্রিটিশ

উদারনীতির কারণে, এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য ‘তখন আমরা স্বজাতির স্বাধীনতার সাধনা আরম্ভ করেছিলুম, কিন্তু অন্তরে অন্তরে ছিল ইংরেজ জাতির ঔদার্যের প্রতি বিশ্বাস৷ সে বিশ্বাস এত গভীর ছিল যে একসময় আমাদের সাধকেরা স্থির করেছিলেন যে, এই বিজিত জাতির স্বাধীনতার পথ বিজয়ী জাতির দাক্ষিণ্যের দ্বারাই প্রশস্ত হবে’৷ রবীন্দ্রনাথের এই শেষ অভিভাষণ বিষয়ে নবনীতা দেবসেন তাঁর ‘সভ্যতার সংকট ও এক কবির বিকল্পগুলি : শিক্ষা একটি বিকল্প হাতিয়ার’ শীর্ষক প্রবন্ধে (www.parabaas.com) বলেছেন কবি কিভাবে বিশ্বায়ন এক সর্বগ্রাসী ভয়ংকরে পরিণত হওয়ার বহুদিন আগেই অনুভব করেছিলেন এর বিপদ৷ কবির ‘দূরদৃষ্টিতে অনেক আগেই ধরা পড়ে সভ্যতা, যার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শিক্ষা, আসন্ন কোনো বিপদের সম্মুখীন কিনা৷ বিশ্বজগৎ সম্পর্কে কবির রয়েছে এক অস্তিসূচক স্বপ্ন, একই সঙ্গে তিনি বাস্তবমুখী প্রয়োগবাদেও বিশ্বাসী, কারণ এ বিশ্ব নিয়ে তাঁর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা রয়েছে৷ বাস্তবে প্রোথিত তাঁর প্রজ্ঞা এবং দূর ভবিষ্যতে বিচরণে সক্ষম তাঁর কল্পনার ফলে মানব-ইতিহাস কোন ধারায় বইতে চলেছে, তা তাঁর বিচক্ষণ অন্তর্দৃষ্টিতে ধরা পড়ে মানবজাতির ভবিষ্যৎচিন্তা তাঁকে উদ্বিগ্ন করে, পীড়া দেয়৷ আমাদের সত্যদ্রষ্টা কবি, পাশ্চাত্য সভ্যতা কেমন করে তার নিজের জন্য এবং বাকি দুনিয়ার জন্য সংকট সৃষ্টি করছে সে সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, তার সমাধানের কথা বলেছিলেন৷ কারণ দেখা যায় প্রাচ্য, কিছুটা স্বেচ্ছায় আর কিছুটা ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির চাপে তৈরি মূল্যবোধের কারণে পাশ্চাত্যের সাগ্রহ অনুকরণে মশগুল৷’ আমাদের নব্যশিক্ষিত এ পথে না হাঁটলে ও বিভিন্ন চিন্তাধারার সমন্বয় ঘটাতে রাজি না থাকলে নিশ্চিতভাবেই পথ-চিন্তা, উপায়-নির্বাচন, শাসন, সর্বক্ষেত্রে মুক্তি আনতে পারত না৷ স্বাধীনতা যে পরের দয়ার দান হতে পারে না, তাকে যে রীতিমতো অর্জন করতে হয়, এ শিক্ষা প্রথমদিকেই আমাদের অনেক কষ্ট করে পেতে হয়েছে৷ কবি বুঝেছিলেন এ বিষয়ে পরনির্ভর হলে চলবে না (‘এই পরনির্ভরতা নিশ্চয়ই আমাদের শ্লাঘার বিষয় ছিল না’)৷ একটা সময় ছিল যখন বিশ্বের অবহেলিত, নিপীড়িত মানুষের আশ্রয়, সমর্থনের উৎস ছিলেন ইংল্যান্ডের সামাজিক আন্দোলনের নেতারা, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ ও লেখকেরা৷ তাঁদের স্বার্থ ও চিন্তা জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল না৷ সভ্যতার ভিত্তিই এই গণ্ডিমুক্ত চিন্তা৷ এর ভিত্তিপ্রস্তর হল এই প্রত্যয় যে মানবজাতির যা শ্রেষ্ঠ সম্পদ তা কখনো কোনো জাতি বা দেশের একচ্ছত্র দখলভু ক্ত হতে পারে না৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান অবস্থানের বিপ্রতীপে এই বিশ্বাসই রবীন্দ্রনাথকে মৃত্যুর কিছুমাস আগে নিজের অভিমত, নিজের বীক্ষণ ব্যক্ত করতে প্রণোদিত করেছিল৷ তিনি জোরের সঙ্গে বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যা কিছু শ্রেষ্ঠ তা সংকীর্ণভাবে কোনো জাতির মধ্যে বদ্ধ হতে

পারে না, তা কৃ পণের অবরুদ্ধ ভাণ্ডারের সম্পদ নয়’৷ এই কারণেই কবি গোঁড়া জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলির বিরোধী ছিলেন৷ তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছাত্ররা যেন আয়ত্ত করতে পারে এই মূল্যবোধ, এই অন্তর্দৃষ্টি, যেন গড়ে তু লতে পারে এক শুভতর জগৎ যা বিচ্ছিন্নতা এবং আত্মম্ভরিতা নয়, পারস্পরিক বিশ্বাস ও আপাতদৃষ্টিতে বিরল কিন্তু অত্যন্ত কাম্য যৌথতার ভিত্তিতে তৈরি৷ শুরু করেছিলাম শব্দতত্ত্ব দিয়ে দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ এই প্রশ্নের অন্য যে অংশটি, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘সিভিলাইজেশন’, তার অনূদিত কোনো প্রতিশব্দ খোঁজার চেষ্টা২ করছেন এবং ভারতীয় ভাষায় খুঁজতে গিয়ে মনুসংহিতা থেকে তিনি উদ্ধার করেন খুব সন্তাোষজনক সমাধান না হলেও সদাচার শব্দটিকে৷ এটি ব্যক্তিগত, নৈতিক ও সামাজিক আচারের, ব্যবহারের সমাজস্বীকৃ ত কিছু চু ক্তি বা নিয়ম-যে নিয়ম এক নির্দিষ্ট ভূ গোলখণ্ডে (ব্রহ্মাবর্ত) প্রচলিত প্রথার ওপর প্রতিষ্ঠিত৷ তিনি ব্যাখ্যা করেন প্রতিশব্দটি নিয়ে অপছন্দের কারণও যেহেতু এই সামাজিক আচার ঐতিহ্য ও প্রথানির্দিষ্ট, একে পবিত্র বলে, অলঙ্ঘ্য বলে অভিহিত করে সকল প্রশ্ন ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে তু লে রাখা হয়েছে, যদিও তা কখনো কখনো নিষ্ঠু রতা ও অবিচারের পর্যায়ে পৌঁছায়৷৩ সদাচার শব্দটি আক্ষরিক অর্থে যা সৎ বা আদর্শ তারই আচার বোঝায়, যা সামাজিক ব্যবহার বা লোকাচারে পর্যবসিত হয়েছে৷ লোকাচারের এই অভদ্র অসৌজন্যের বিরুদ্ধেই প্রশ্ন তু লেছিলেন রাজা রামমোহন, ডিরোজিও, রাজনারায়ণ বসু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো রবীন্দ্রনাথের পূর্বসূরীরা, তাঁর সমসাময়িকেরাও৷ এরই ফলে উদারনৈতিক চিন্তার ঢেউ আধুনিকদের যুক্তিকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল, সনাতন প্রথার নিগড় ভেঙে বেরিয়ে আসার আগ্রহ প্রবল হয়েছিল৷ ঠাকু র পরিবারের মতো আরও বহু পরিবারে মনুদর্শনের তত্ত্ব ও র্চ্চা থেকে সর্বক্ষেত্রে, ধর্মমতে (যার প্রভাবে পরে শান্তিনিকেতনে ভেদাভেদহীন শ্রেণিবৈষম্যহীন জীবনর্চ্চা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল), লোকব্যবহারে, নৈতিক বা ন্যায়ের অনুশাসন মানার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটেছিল৷ এই নবজাগরণে এবং প্রথাগত লোকাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে (যা কখনো সামাজিক কখনো বা আইনি পথ নিয়েছিল) ব্রিটিশ রাজশক্তির সমর্থন ছিল৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ইংরেজ সমাজের উদারনৈতিকতা ও ইংরেজি ভাষার উচচমানের সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ৷ সব মিলিয়ে সিভিলাইজেশনের ইংরেজি মডেলকে আমরা উচচ পূজাবেদীতে বসিয়েছিলাম৷ সন্ধিক্ষণ বা সংকট ঘনিয়ে এল তখনই যখন আমরা দেখলাম এই তথাকথিত ‘সভ্য’ দেশীয়রাই সবচেয়ে ঘৃণ্য লোকব্যবহারে লিপ্ত হতে পারে৷ এমন কর্মেও লিপ্ত হতে পারে, যা আদিম প্রাক-সভ্য মানুষের মতো শুধুমাত্র মৌলিক আবেগের প্ররোচনায় সংঘটিত হয়৷ এই সংকটকে ঘনিয়ে আনে দুর্বৃত্তায়ন, বলপ্রয়োগ (যা সব ভিন্ন মতামত এবং সব অন্য

ব্যবস্থাকে নতিস্বীকারে বাধ্য করে) এবং কেন্দ্রীকরণ (দুষ্প্রাপ্য সম্পদকে মুষ্টিমেয় লোকের কু ক্ষিগত করা)৷ ইংরেজের দ্বিচারিতা আরও প্রকট হল যখন বোঝা গেল তার স্বার্থ হল ভারতকে শুধুমাত্র এক বাজার হিসেবে যেমন খুশি ব্যবহার করা৷ যারা নিজেদেরকে সভ্যতার মন্ত্রে দীক্ষিত বলে গর্ব করে, শাসক হিসেবে দেশে খাদ্য, বস্ত্র, পানীয় জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অভাব নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই৷ পাশ্চাত্য সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি যে প্রযুক্তি, এদেশে তার গবেষণা বা বিকাশের প্রচেষ্টা রুদ্ধ, কারণ ভারতে এর কতটু কু ব্যবহার অনুমোদিত হবে তা স্থির করবে সেই ইংরেজরাই যারা এদেশের শিল্পে বা ব্যবসায় প্রযুক্তি ব্যবহারের আশু আর্থিক সুফল ভোগ করবে৷ এই মুনাফা লুটের জন্য সমস্ত প্রতিযোগিতার সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করতে প্রয়োজনে এই উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশীয় সব দক্ষতার ধ্বংস সাধনই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক৷ ভারতীয় ভদ্রলোক সমাজের কাছে এই উপলব্ধি এনেছিল শপথভঙ্গ ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, যে স্বপ্ন তাদের আদর্শ সামাজিক প্রশাসনকে নিয়ে তারা ইংরেজকে কেন্দ্র করে রচনা করেছিল৷ ‘আদর্শ প্রশাসন’-এর এহেন অধঃপতিত সংস্করণ ছিল কল্পনারও অতীত৷৪ যা কিছু ভারতীয় তার সম্পর্কে ইংরেজের উপেক্ষা ও অশ্রদ্ধা যত দিন যাচ্ছিল ততই প্রকট হচ্ছিল৷ ভারতবাসী বিস্ময়ের সঙ্গে এও লক্ষ করছিল কিভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাপানের সমাজ তার আপাত অচেতনতাকে কাটিয়ে বিশ্ব-অর্থনীতির সামনের সারিতে স্থান করে নিয়েছে৷ অথবা কিভাবে রাশিয়া শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমে উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে তার দীর্ঘদিনের সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও অস্থিরতাকে কাটিয়ে জগৎসভায় সম্মানের স্থান অধিকার করে নিয়েছে৷ এগুলো ছিল উন্নতির এমন সব উদাহরণ যেখানে বিদ্যা এবং প্রজ্ঞা, ঐতিহ্য এবং আধুনিকতা পরস্পরের পরিপূরক, এবং যা বস্তুগত ও মানসিক দুই ধরনের দারিদ্র্য, অবিনয় ও আত্মপ্রত্যয়ের অভাব দূর করে৷ এই নতু নতর আদর্শ ব্যবস্থায় ধর্ম বা শ্রেণির ভিত্তিতে ভেদাভেদের স্থান নেই, এই ব্যবস্থা ‘আলাদা’ করে কারওকে বাইরে রাখে না৷ এগুলি ছিল এমন উদাহরণ যেখানে সমাজের অংশগুলি পরস্পরের সঙ্গে ক্ষমতা ও দায়িত্ব ভাগ করে নিতে শিখেছে৷ সাংস্কৃ তিক ভিন্নতা ও ভাষাভিত্তিক ভিন্নতা বিষয়ে রাশিয়ান সংযুক্তরাষ্ট্র এবং ইংরেজের আচরণের বিরাট পার্থক্য কবিকে পীড়া দিয়েছিল৷ সহিষক্ততা এবং সহানুভূ তির উচচ আদর্শ যা ইংরেজের সভ্যতার ভিত, সেখানে তাদের ব্যর্থতা তাঁর কাছে বেদনাদায়ক ছিল৷ বস্তুত, সেই রাজনৈতিক ভূ খণ্ডকেই সভ্য বলা চলে যেখানে ‘ওরা’র দল অবজ্ঞার পাত্র নয়, তাদের মৌলিক অধিকার ও প্রাপ্য সুবিধা অবদমিত হয় না৷ পারস্য, দুই বিদেশি শক্তির কবল থেকে বেরিয়ে এসে, নতু ন এক সমাজ-রাষ্ট্র হিসেবে যে পদক্ষেপ নিচ্ছিল তাও কবি আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ করছিলেন৷ তাঁর মনে হয়েছিল আধুনিক পারস্যের পক্ষে এ এক সৌভাগ্যের ঠি

বিষয় যে তার বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্তর্জাতিক চক্রান্তকে সে বানচাল করে দিতে পেরেছে৷ কবি জানতেন না যে কয়েক দশক পরেই পারস্য এবং আফগানিস্তান, তাঁর বক্তৃ তায় যাদের নিয়ে তিনি আশার কথা বলেছেন, হয়ে উঠবে নতু ন একদল শোষকের, আন্তর্জাতিক শিল্পগোষ্ঠীর শক্তি-পরীক্ষার নব্যতর রঙ্গভূ মি৷ তিনি দেখলেন, যে ইংরেজ একদা স্পেনের জন্য লড়াই করেছে, অথচ তারাই সেখানকার প্রজাতন্ত্রী সরকারের বিরুদ্ধে টর্পেডোর আঘাত হেনেছে৷ তিনি লক্ষ করেছিলেন ব্রিটিশ লুটেরারা কিভাবে আফিমের নেশায় চিনের যুবসমাজকে বুঁদ করে রেখে, প্রবঞ্চনা করে তাদের ভূ খণ্ড দখল করে রেখেছে৷ সভ্য সমাজের পররাষ্ট্র সম্পর্কিত যে-কোনো রীতিনিয়মের পক্ষে নিতান্ত লজ্জাকর এই গর্হিত পদক্ষেপেও নীতির বড়াই করছে, অথচ তাদের সমাজনেতৃ ত্ব নিতান্তই অন্ধ৷ একথা আজ কারও মনে হতেই পারে যে সাধারণ ভারতীয় শিক্ষিত ভদ্রলোকের ব্রিটিশ শাসকের সৌজন্যে এই বিশ্বাস হল তার দাসসুলভ মানসিকতার এক বলিষ্ঠ উদাহরণমাত্র৷ রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন, এই বিশ্বাস হল নিশ্চিতভাবে নতু নকে, পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর, সাগ্রহে গ্রহণ করতে পারার ক্ষমতার পরিচয়৷ ‘বহিরাগত’কে আপন করে নেওয়ার, অপরকে আত্মীয় করে নেওয়ার ভারতীয় মনোভঙ্গির পরিচয় মেলে এতে৷ ভারতের যে দারিদ্র্য কবিকে সবচেয়ে বেশি আহত করেছিল, তা হল তার একতাকে প্রত্যাখ্যান, যা এক অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, তিনি একে বলেছেন ‘ভারতবাসীর মধ্যে অতি নৃশংস আত্মবিচ্ছেদ’৷ তিনি মনে করতেন এই বিভেদবোধ বিদেশি শাসকের প্ররোচনায় ও প্রভাবে আমাদেরই এক অংশের পরিকল্পিত অভিসন্ধির ফল, যদিও এর জন্য ইতিহাস একদিন আমাদেরই দায়ী করবে৷৫ দীর্ঘ বিদেশি শাসন আমাদের আত্মবিশ্বাস, নিজেদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে আমাদের আস্থা নষ্ট করে দিয়েছে তার বদলে উপহার দিয়েছে এক সীমিত রাজনৈতিক জ্ঞান, জারি করেছে যাকে ওরা বলে ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’, এক আইনি প্রশাসনিক ব্যবস্থা৷ যে ব্যবস্থা বড়োজোর আমাদের সমাজের দোরগোড়ায় চৌকিদারি করতে পারে, কোনোমতেই সমাজের চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে না৷ ইংরেজ শাসক এটা নিশ্চিত করতে চায় যে, এ ব্যবস্থার প্রচলন করে তারাই যে আমাদের জন্য সভ্যতা এনেছে, বর্বর ঐতিহ্যের কবল থেকে আমাদের মুক্ত করেছে, এ বিশ্বাসে যেন কখনো আমাদের অণুমাত্র চিড়ও না ধরে৷ এ যুগ্মব্যবস্থা প্রায়ই পেশি আস্ফালন করে আমাদের তার শক্তিরূপ দেখিয়েছে, সাবধানে বিরত থেকেছে তার মুক্তিরূপের প্রদর্শন থেকে৷ সভ্যতার প্রকৃ ত রূপ যেখানে ব্যক্তিমানুষের আন্তঃসম্পর্কের বিকাশ ঘটায়, যেখানে ভাবধারা ও মতামতের বিভিন্নতা সমানভাবে মান্যতা পায়, সেই রূপটির প্রকাশ ইংরেজ

শাসককু ল ভারতে সভ্যতার নামে যে ব্যবস্থা প্রচলন করেছে সেখানে দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত৷ ভারতের ভৌগোলিক ভূ খণ্ড তার দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতা লাভ করার সাত বছর আগেই কবি নির্দেশ করেন কেমনভাবে তথাকথিত পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজেকে প্রস্তুত করেছে সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য, বর্বর এক সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য যা আঘাত করবে সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে, যা কতশত শতাব্দী ধরে পরম যত্নে গড়ে তু লেছেন, লালন করেছেন এই সভ্যতারই স্থপতি, কবি, দার্শনিকেরা৷ তিনি এখানে ‘ক্রাইসিস’ শব্দের চিকিৎসাশাস্ত্রীয় অর্থটি ব্যবহার করে বলেন, এ ‘এক মানবপীড়নের মহামারী’, যা পাশ্চাত্য সভ্যতার মেরুদণ্ড থেকে জন্ম নিয়ে এক অপ্রতিরোধ্য দূষণের মতো, ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ে মানবাত্মার অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করে৷ ভারত থেকে বিদেশি শাসকের অবশ্যম্ভাবী বিদায় সেই ১৯৪১-এই লেখা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কবির প্রশ্ন : কেমন ভারত তারা আমাদের জন্য রেখে যাবে? তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘কিন্তু কোন ভারতবর্ষকে সে পিছনে ত্যাগ করে যাবে?’ আরও ব্যাখ্যা করেন, ‘কী লঙ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনাকে? একাধিক শতাব্দীর শাসনধারা যখন লুপ্ত হয়ে যাবে, তখন এ কী বিস্তীর্ণ পঙ্কশয্যা দুর্বিষহ নিষ্ফলতাকে বহন করতে থাকবে?’ সে কি পিছনে ছেড়ে যাবে গুরুভার দারিদ্র্যের উত্তরাধিকার, যা দুর্ভাগ্যপীড়িত মানুষের অবনমনের চিহ্ন? রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন সভ্যতার ইতিহাসের একটা সর্ববৃহৎ সংকট হল এই উপলব্ধি যে তথাকথিত সভ্য, উন্নত দুনিয়ার আসলে রয়েছে একটা ফাঁপা, নিষ্ফলা রূপ, যা অনুন্নত জাতি-রাষ্ট্রগুলির জন্য কোনোরকম বিকল্পের সন্ধান দিতে অপারগ৷ অন্যদিকে তিনি এই আশাও পোষণ করতেন যে প্রাচ্যের অন্ধকার কেটে গিয়ে এখানকার নতু ন আদর্শ ও ভাবধারার আলোয় মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়তো আবার রঙেরসে ভরে উঠবে৷ তাঁর মনে হয়েছিল আগামী সময় পিছনে ফেলে যাবে ‘ইতিহাসের...অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূ প!’ জোসেফ এ. ক্যামিলারি যেমন বলেন, ‘পরস্পরবিরোধী মনে হলেও একথা সত্য যে, আদিম অবস্থা থেকে মহাপ্রযুক্তির যুগে মানুষের বৈপ্লবিক যাত্রা তাকে আরওই বিপন্ন করেছে, কারণ মূল্যবান জ্ঞান ও উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে যে বিপুল লাভ হয়েছে তাকে ছাপিয়ে উঠেছে আবর্জনা, হিংসা ও ধ্বংস’ (সিভিলাইজেশন ইন ক্রাইসিস : হিউম্যান ক্রাইসিস ইন এ চেঞ্জিং ওয়ার্ল্ড, ১৯৭৬) এতৎসত্ত্বেও কবি শেষপর্যন্ত আস্থা রেখেছেন মানুষের সূঙ্মতর ও মহত্তর বোধের উপর, আত্মস্থ থেকেছেন নিজের অস্তিবাদী মনোভঙ্গিতে যা স্পষ্ট হয় তাঁর কথায় : তিনি বলেন, আমাদের সভ্যতা যত পরীক্ষার মধ্য দিয়েই যাক, তার ভাগ্যে যাই ঘটু ক, মানুষের ক্ষমতায় বিশ্বাস হারানো পাপ৷ তিনি বিশ্বাস করতেন যে মেঘের অন্ধকার ঘনঘটা কেটে

যাবে, প্রাচ্য গোলার্ধে নবীন সূর্যোদয় সূচনা করবে এক নতু ন যুগের৷ তাই তিনি এই প্রবন্ধের শেষে মানুষের মহান প্রচেষ্টার স্বাগত সংগীতের উদগাতা-‘ঐ মহামানব আসে/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/মর্ত্যভূ মির ঘাসে ঘাসে’ (আনুষ্ঠানিক সংগীত, ১৬৷) তিনি বিশ্বাস করতেন, কোনো জাতি, তা সে যত প্রভাবশালী, যত শক্তিশালীই হোক, যদি সে ফাঁপানো আত্মগর্ব আর শক্তির প্রদর্শনে মত্ত হয় তবে সে ইতিহাসের আঁস্তাকু ড়ে নিক্ষিপ্ত হবে৷ তাই তার গান শেষ হয় মানব অভ্যুদয়ের বিজয় ঘোষণায়, ‘জয় জয় জয় রে মানব অভ্যুদয়/ মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে’-এই কথা দিয়ে৷ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন ভারতের অক্লান্ত প্রাণশক্তি সমস্ত বাধা অতিক্রম করে ‘আত্ম’ এবং ‘অপর’ কে জয় করে তার আন্তঃসম্পর্ককে প্রতিষ্ঠিত করবে৷ পাদটীকা ১.

রবীন্দ্র রচনাবলী rachanabali.nltr.org/node/1

অন-লাইন

http://rabindra-

২. ‘সিভিলিজেশন, যাকে আমরা সভ্যতা নাম দিয়ে তর্জমা করেছি, তার যথার্থ প্রতিশব্দ আমাদের ভাষায় পাওয়া সহজ নয়৷ এই সভ্যতার যে রূপ আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল মনু তাকে বলেছেন সদাচার৷ অর্থাৎ, তা কতকগুলি সামাজিক নিয়মের বন্ধন৷’ (সভ্যতার সংকট) ৩. ‘এই আচারের ভিত্তি প্রথার উপরেই প্রতিষ্ঠিত-তার মধ্যে যত নিষ্ঠু রতা, যত অবিচারই থাক৷ এই কারণে প্রচলিত সংস্কার আমাদের আচার-ব্যবহারকেই প্রাধান্য দিয়ে চিত্তের স্বাধীনতা নির্বিচারে হরণ করেছিল৷’ (সভ্যতার সংকট) ৪. ‘মানব-আদর্শের এতবড়ো নিষ্ঠু র বিকৃ ত রূপ কল্পনা করতেই পারি নি৷’ (সভ্যতার সংকট) ৫. ‘আমাদের বিপদ এই যে, এই দুর্গতির জন্য আমাদেরই সমাজকে একমাত্র দায়ী করা হবে৷ কিন্তু এই দুর্গতির রূপ যে প্রত্যহই ক্রমশ উৎকট হয়ে উঠেছে সে যদি ভারতশাসনযন্ত্রের ঊর্ধ্বস্তরে কোনো-এক গোপন কেন্দ্রে প্রশ্রয়ের দ্বারা পোষিত না হত তা হলে কখনোই ভারত-ইতিহাসের এতবড়ো অপমানকর অসভ্য পরিণাম ঘটতে পারত না৷’ (সভ্যতার সংকট)

সন্দর্ভ সূচি

বার্ণহার্ট, রবার্ট কে সম্পা. ১৯৮৮. বার্ণহার্ট ডিকশনারি অব ইটিমলজি. এইচ. ডবলিউ ইউলসন কো. বাক, কার্ল ডার্লিং ১৯৪৯/১৯৮৮. এ ডিকশনারি অব সিলেক্টেড সিননিমস ইন দ্য প্রিন্সিপল ইন্দো-ইউরোপিয়ান ল্যাংগুএজেস. শিকাগো : ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো৷ ক্যামিলেরি, জোসেফ এ. ১৯৭৬, সিভিলাইজেশন ইন ক্রাইসিস : হিউম্যান ক্রাইসিস ইন এ চেঞ্জিং ওয়ালর্ড৷ কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস৷ ক্রলিক, স্যাক্লি. ২০১০. ‘ক্রাইসিস ইন সিভিলাইজেশান এ্যাণ্ড কালচারাল ক্রিটিসিজম’৷ ইজাইনআর্টিকলস. কম, মার্চ সংখ্যা৷ দেব সেন, নবনীতা, ২০০৬, ‘ক্রাইসিস ইন সিভিলাইজেশান এ্যাণ্ড এ পোয়েটস অল্টার্নেটিভস৷ এডু কেশান এ্যাজ ওয়ান অল্টার্নেটিং ওয়েপন’৷ (পরবাস.কম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র বিষয়ক বিশেষ সংকলন) শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় ও রামকৃ ষ্ণ মিশনের দ্বারা আয়োজিত রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-বিষয়ক দর্শন নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে পঠিত নিবন্ধ, ২৯ মার্চ ২০০৬৷ কান্ট, ইমানুয়েল ১৭৮৩. প্রলেগোমেনা টু এনি ফিউচার মেটাফিজিক্স৷ আকাদেমি এডিশান, ৪র্থ খণ্ড, বার্লিন, ১৯১১, জর্মন থেকে ইংরেজি অনুবাদ, পল ক্যারুস কৃ ত (১৯০২) জেমস ডাবলিউ এলিংটন দ্বারা পরিমার্জিত (১৯৭৭) ও জেরস ফ্রেজার দ্বারা পুনঃসংশোধিত (১৯৯৭)৷ ক্লাইন, ড. আর্নেস্ট. ১৯৭১. এ কম্প্রিহেনসিভ ইটিমলজিকাল ডিকশনারি অব দ্য ইংলিশ ল্যাংগুএজ৷ আমস্টার্ডাম : এলজেভিয়ার সাইন্টিফিক পাবলিশিং কোম্পানি৷ লিবারম্যান, অ্যানাটলি. ২০০৮. এ্যানালিটিক ডিকশনারি অব ইংলিশ ইটিমলজি৷ মিনিয়াপোলিস : ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা প্রেস৷

ঠাকু র, রবীন্দ্রনাথ. ১৯৪১. ‘সভ্যতার সংকট’ রবীন্দ্র রচনাবলী, ২৪ তম খণ্ড কালান্তর, পৃ. ৬৩৫-৪৩ দ্য অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৯. ক্ল্যারেণ্ডন প্রেস৷ ওয়াটকিন্স, ক্যালভার্ট, সম্পাদিত. ২০০০. দ্য আমেরিকান হেরিটেজ ডিকশনারি অব ইন্দোইউরোপিয়ান রুটস, ২য় সংস্করণ, হাউটন মিফলিন কোম্পানি৷ উইকলি, আর্নেস্ট, ১৯২১. এ্যান ইটিমলজিকাল ডিকশনারি অব মডার্ন ইংলিশ৷ মারে পুনর্মুদ্রিত ১৯৬৭, ডোভার পাবলিকেশনস.

গোরা : জর্জ এলিয়ট ও রবীন্দ্রনাথ প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস ‘বিদেশের উপাদান নিয়ে আমি কখনও কিছু লিখি নি৷’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র, চিঠিপত্র ৯৷ ‘ইংরেজের সহিত আমাদের মিলন সার্থক করিতে হইবে৷ মহা-ভারতবর্ষ গঠন ব্যাপারে এই ভার আজ আমাদের উপর পড়িয়াছে৷’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র, ‘পূর্ব ও পশ্চিম’, ১৩১৫ ১ মূলত গীতিকার বা কবি হয়েও রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র প্রায় সারা জীবন ধরেই উপন্যাস লিখে গেছেন৷ ষোলো বছর বয়সে লেখা ‘করুণা’ (১২৮৪) থেকে শুরু করে ‘চার অধ্যায়’ (১৩৪১) পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের লেখা উপন্যাসের সংখ্যা তেরো৷ সংখ্যাটির মধ্যে অবশ্যই কোনো অশুভ ইঙ্গিত নেই, তবে একথাও সত্যি যে তাঁর উপন্যাসগুলি সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথকে নানা ধরনের প্রতিবাদ ও বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে৷ উপন্যাস লেখা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অদম্য উৎসাহ আমাদের কিছুটা বিস্মিত করে এইজন্যেই যে ভালো উপন্যাস লেখার জন্যে পরিবেশসৃষ্টি, কাহিনিবিন্যাস, চরিত্রচিত্রণ বা সংলাপরচনা সম্পর্কে যে বিশেষ ধরনের উদ্ভাবনীশক্তি বা কু শলতার দরকার হয় সেটি খুব কম কবিরই আয়ত্তে থাকে, এবং রবীন্দ্রনাথেরও ছিল না বলেই মনে হয়৷ এ-প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে : ‘রবীন্দ্রনাথ কবি আর কথাশিল্পীর সম্পূর্ণ সংগতি ঘটাতে পারেন নি...৷ দুয়ের বিরোধে ক্ষতি হয়েছে উপন্যাসের কবিত্ব যখন দমিত হয়েছে তখন এসেছে ‘নৌকাডু বি’র কৃ ত্রিমতা, আর যখন প্রশ্রয় পেল তখন দেখি ‘ঘরে বাইরে’র আতিশয্য, ‘শেষের কবিতা’য় বিষয়বস্তুতে যাথার্থ্যের অভাব৷’ রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব উপন্যাস সম্পর্কেই সমালোচকেরা এই ধরনের আপত্তি তু লেছেন৷ ‘যোগাযোগ’ সম্পর্কে সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেছেন : ‘কবির প্রতিপাদ্য ...যাহা উপন্যাসের প্রতিপাদ্য বিষয় বলিয়া মনে হয় তাহা উপন্যাসে স্থানই পায় নাই৷’ ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের মূল চরিত্র বিনোদিনীর অস্বাভাবিক পরিণতির জন্যে নীহাররঞ্জন রায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন : ‘ঘটনাচক্রে যে জীবন বিড়ম্বিত, সে জীবনকে পাইবার জন্য মূল্য তো কম দেয় নাই, তবু তাহার কলঙ্ক-স্পর্শবিহীন প্রেম প্রেমের তীর্থে পৌঁছিয়া জীবনের সার্থকতা পাইবে না কেন? যে যুক্তি দিয়া সে বিহারীকে নিরস্ত করিল, সে-যুক্তি তো সামাজিক যুক্তি, তাহা না আর্টের যুক্তি, না অখণ্ড জীবনদর্শনের৷ আর্টের যুক্তি হইতে হইলে

কার্যকারণ-সম্বন্ধের ইঙ্গিতের প্রয়োজন ছিল, তাহা এক্ষেত্রে নাই৷’ ‘চতু রঙ্গ’ অনেকেরই ভালো লাগে, কিন্তু শ্রীকু মার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘রবীন্দ্রনাথের শেষযুগের উপন্যাসসমূহের মধ্যে ‘চতু রঙ্গ’ সর্বাপেক্ষা কাঁচা ও আংশিকত্বের লক্ষণাক্রান্ত ( fragmentary ) ৷ ...সমস্ত বিষয়ের আলোচনা অপূর্ণ ...যেন একটা পাগলা হাওয়া যদৃচ্ছাক্রমে চরিত্রগুলিকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ও তাহাদের সম্পর্কটিকে অস্থির পরিবর্তনের ঘূর্ণাবর্তে সর্বদা বিবর্তিত করিতেছে৷ উদ্দেশ্যগভীরতার অভাব সর্বত্রই পরিস্ফু ট৷’ ‘মালঞ্চ’-র বীভৎসতা ও ‘দুই বোন’-এর অলৌকিক পরিণাম সম্পর্কেও সমালোচকেরা অসন্তুষ্ট৷ ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসের সমস্ত কপি প্রকাশের এক মাসের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়৷ প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায় লিখছেন : ‘লোকে বলিতে আরম্ভ করিল গভর্ণমেন্ট এই বই কিনিয়া অন্তরীণাবদ্ধদের দিতেছেন, বিপ্লবদমনের জন্য এই বই সরকারের উপযুক্ত অস্ত্র হইয়াছে৷’ রবীন্দ্রনাথ নিজেও ‘চার অধ্যায়’ সম্পর্কে খুব একটা স্বস্তিতে ছিলেন না৷ ‘রাজর্ষি’, ‘বউঠাকু রাণীর হাট’ ও ‘চিরকু মার সভা’ অপরিণত রচনা, এগুলির মূল্য নিতান্তই ঐতিহাসিক৷ কিন্তু ‘গোরা’ উপন্যাস সম্পর্কে সাধারণ পাঠক ও সমালোচক সকলেই প্রায় উচ্ছ´সিত৷ অতু লনীয়, অসামান্য, অভিনব, মহাকাব্যিক-এইসব বিমুগ্ধ বিশেষণ সাধারণত প্রয়োগ করা হয় ‘গোরা’ সম্পর্কে৷ ‘গোরা’-ই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথের একমাত্র সাহিত্যকর্ম যা সম্পর্কে তথাকথিত রবীন্দ্রবিরোধী ও রবীন্দ্র-উপাসকদের মধ্যে এক আশ্চর্য সহমত লক্ষ করা যায়৷ ‘গোরা’ উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যাঁরা উপন্যাসটিকে অভিনন্দিত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, যিনি তখন এবং এখনও রবীন্দ্রবিরোধী হিসেবেই চিহ্নিত৷ ‘বাণী’ পত্রিকায় (আশ্বিন-কার্তিক, ১৩১৭) দ্বিজেন্দ্রলাল ‘গোরা’ সম্পর্কে লিখেছিলেন : ‘এত সুন্দর সামাজিক উপন্যাস কদাচিৎ নয়নগোচর হয়৷ ...উপন্যাসখানি Vicar of Wakefield -এর ধরনে লিখিত৷ ইহা শুধু উপন্যাস নহে ইহা ধর্মগ্রন্থ৷ একদিকে যেমন ৬০০ পৃষ্ঠা পড়িতে পড়িতে কেমন কৌতূ হল বাড়িতে থাকে এবং পাঠ অসমাপ্ত করিয়া উঠিতে অনিচ্ছা হয়, অন্যদিকে ইহা হইতে অনেক শিক্ষালাভ করা যায়৷ ওই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের গৌরব৷’ প্রায় একই রকমের মুগ্ধতা লক্ষ করা যায় নীহাররঞ্জনের মন্তব্যে : ‘ ‘গোরা’ মহাকাব্যের প্রসার ও গভীরতা লইয়া বাংলা সাহিত্যের প্রথম এবং আজ পর্যন্ত একমাত্র আধুনিক উপন্যাস৷’ বুদ্ধদেব বসুর মতেও ‘রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলির মধ্যে ...সবচেয়ে তৃ প্তিকর মনে হয় ‘গোরা’৷’ গোরা-চরিত্র সম্পর্কেও বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য মনে রাখা দরকার : ‘এই কাহিনীটিকে আদ্যন্ত অধিকার করে আছে গোরা, কোনো কলোসাসের মতো দুই প্রান্তে দুই পা রেখে-ভারত ও ইউরোপের প্রান্ত, সংস্কার ও মুক্তির-তার গম্ভীর স্বর গড়িয়ে চলছে পাতার পর পাতায়৷ এইরকম প্রবল পুরুষ চরিত্র রবীন্দ্র-সাহিত্যে আর

নেই৷’ ‘গোরা’ উপন্যাস সম্পর্কে সমালোচকদের এই ধরনের উচ্ছ´সিত প্রতিক্রিয়া কতটা যুক্তিযুক্ত বর্তমান প্রবন্ধে আমরা সেটা একটু বোঝার চেষ্টা করব৷ ২ উপন্যাস হিসেবে ‘নৌকাডু বি’র ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে নীহাররঞ্জন লিখেছেন : ‘নৌকাডু বি উপন্যাস লেখকের স্বতঃস্ফূ র্ত আনন্দের রচনা নয়, মাসিক পত্রের তাগাদায় মাসের পর মাস বিচ্ছিন্ন, অসংলগ্ন ভাবে লেখা৷ ...অন্তরের প্রেরণায় আর প্রয়োজনের তাড়নায় রচনার মধ্যে পার্থক্য কিছু আশ্চর্যের কথা নয়৷’ রবীন্দ্রনাথও বিশ্বাস করতেন-‘সাহিত্য জীবনের স্বাভাবিক প্রকাশ, তাহাতো প্রয়োজনের প্রকাশ নহে৷’ তাঁদের কথা মানতে গেলে ‘গোরা’কে বোধহয় সাহিত্য হিসেবে স্বীকার করা যাবে না, কারণ এ-উপন্যাস লেখা হয়েছিল প্রয়োজনের প্রকাশ হিসেবেই, জীবনের স্বতঃস্ফূ র্ত আনন্দের স্বাভাবিক প্রকাশ হিসেবে নয়৷ প্রভাতকু মার ‘গোরা’ সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছেন : ‘গল্পরচনার প্রেরণা ছিল বাহিরের৷ রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যার বিবাহ হইবে জ্যৈষ্ঠ মাসে (১৩১৪) অর্থের টানাটানি খুব৷ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রবাসীর জন্য একটি গল্প লিখিয়া দিবার জন্য অনুরোধ করেন ও কিছু টাকা পাঠাইয়া দেন৷ কবি লিখিয়া পাঠান ‘মাস্টারমশায়’ গল্প, দুই কিস্তিতে (আষাঢ় ও শ্রাবণ) প্রবাসীতে বাহির হইল৷ কিন্তু কবির মনে হইল তিনি টাকা পাইয়াছেন তাহার উপযুক্ত প্রতিদান হয় নাই৷ তাই লিখিতে বসিলেন ‘গোরা’৷ কতো বড়ো কাহিনী হইবেকোথায় তার শেষ কিছুই না ভাবিয়া লিখিতে শুরু করিলেন-মনের মধ্যে হয়তো একটা অতি সাধারণ রেখাঙ্কন করিয়া লইয়াছিলেন-ইহার অধিক নহে৷ প্রতিমাসে যথাসময়ে ৩২ মাস নিয়মিতভাবে লেখা পাঠাইয়াছেন৷ কোনোদিন দেরি হয় নাই৷ এমনকি তাঁহার পুত্রের মৃত্যুর পরেও ঠিক সময়েই গোরার কিস্তি প্রবাসী অফিসে হাজির হইয়াছিল৷’ প্রভাতকু মারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ‘গোরা’ একটি Pot-boiler, অর্থাৎ পয়সার জন্যে লেখা, বা ভাড়াটে লেখা৷ দ্বিতীয় তথ্যটি আরও গুরুত্বপূর্ণ- ‘গোরা’ লেখার সময় রবীন্দ্রনাথের মনে গল্পের প্লট, চরিত্র বা বক্তব্য সম্পর্কে একটি রেখাঙ্কন ছিল যা এতই স্পষ্ট যে উপন্যাস লেখার সময় রবীন্দ্রনাথকে খুব একটা দুর্ভাবনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে না, এমনকি পুত্রের মৃত্যুও মাসিক কিস্তি লেখা বা পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো ব্যাঘাতই সৃষ্টি করতে পারছে না৷ এই আশ্চর্য ছকটি রবীন্দ্রনাথ কীভাবে তৈরি করেছিলেন আমাদের জানা নেই, তবে অনুমান করা যেতে পারে৷ ‘গোরা’ উপন্যাসের বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে আছে গোরার বক্তৃ তা, যেটাকে ঠিক তর্ক বলা চলে না এইজন্যেই যে গোরার কোনো উপযুক্ত প্রতিপক্ষ নেই৷ উপন্যাসের প্রায় প্রত্যেক চরিত্রকেই গোরা এক-একটি জনসভা মনে করে৷

তার ফলে গোরা যখন কথা বলে তখন তার কথাগুলিকে একটি কাহিনির একটি চরিত্রের সংলাপ বলে মনে হয় না, মনে হয় বক্তৃ তা শুনছি বা প্রবন্ধ পড়ছি : গোরা কহিল-এইজন্যই, যাহার প্রতি সমগ্রের হিতের ভার তাহার নির্লিপ্ত থাকিবার বিধি আমাদের দেশে চলিয়া আসিয়াছে৷ প্রজার সঙ্গে একেবারে ঘনিষ্ঠভাবে মিশিলে তবেই যে প্রজা-পালন করা রাজার পক্ষে সম্ভব হয় একথা সম্পূর্ণ অমূলক৷ প্রজাদের সম্বন্ধে রাজার যেরূপ জ্ঞানের প্রয়োজন সংস্রবের দ্বারা তাহা কলুষিত হয়৷ এই কারণে, প্রজারা নিজেই ইচ্ছা করিয়া তাহাদের রাজাকে দূরত্বের দ্বারা বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছে৷ রাজা তাহাদের সহচর হইলেই রাজার প্রয়োজন চলিয়া যাইবে৷ উদ্ধৃ তির প্রথমেই ‘গোরা কহিল’ আছে৷ স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে যে গোরা অন্য কোনো চরিত্রকে কথাগুলি বলছে৷ উদ্ধৃ তিটি নেওয়া হয়েছে একাত্তর নম্বর অধ্যায় থেকে৷ গোরার বক্তৃ তা অংশগুলো সাধারণত পাঠকেরা বাদ দিয়ে উপন্যাসটি পড়েন তাই, ভালো করে পড়লে দেখা যাবে ওই অধ্যায়ে অন্য কোনো চরিত্র উপস্থিতই নেই৷ অর্থাৎ গোরা যে শুধু অন্যান্য চরিত্রের সামনে বক্তৃ তা করে তাই নয়, কেউ না থাকলেও করে, বা নিজের সঙ্গেও করে৷ রবীন্দ্রনাথের নিজেরও সম্ভবত খেয়াল হয় নি যে ওই অধ্যায়ে অন্য কেউ উপস্থিত নেই, তাই ‘গোরা ভাবিল’ না লিখে ‘গোরা কহিল’ লিখেছেন৷ কাহিনির প্রয়োজনে গোরা চরিত্রের সংলাপ তৈরি হয় নি বলেই এইসব অদ্ভু ত ঘটনা ‘গোরা’ উপন্যাসে ঘটেছে৷ গোরা শুধু প্রবন্ধের ভাষায় বা সুরে কথা বলে তাই নয়, ভাবে ও প্রবন্ধের বাক্যবিন্যাসের মাধ্যমে, কারণ গোরা ঠিক উপন্যাসের চরিত্র নয়, সে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের ‘ডামি’৷ সুরেশ সমাজপতি দুটি চমৎকার মন্তব্য করেছিলেন ‘গোরা’ সম্পর্কে : ‘গোরা তর্কের খনি, গল্প খুব অল্প’ (সাহিত্য পত্রিকা, চৈত্র, ১৩১৪) ‘ইতিপূর্বে রবীন্দ্রনাথের ইদানীন্তন বিবিধ প্রবন্ধে যাহা পড়িয়াছি, গোরা নামক ফনোগ্রাফে সেইসকল পুরাতন ‘গৎ’ বাজিতেছে’ (সাহিত্য পত্রিকা, বৈশাখ, ১৩১৫)৷ শেষের মন্তব্যটির মধ্যে মস্করার মেজাজ থাকলেও, একথা সত্যি যে গোরার অনেক কথাই গোরা উপন্যাস লেখার আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে লিখেছেন৷ তাই ‘গোরা’ লেখার সময় উপন্যাসের একটা বড়ো অংশ সম্পর্কে তাঁকে নতু ন করে আর ভাবতেই হচ্ছে না৷ এরপর আসছে উপন্যাসের নায়ক প্রবল পুরুষ গোরার চরিত্র সৃষ্টির প্রশ্ন৷ রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞদের ধারণা যদি সঠিক হয়, তাহলে এ ব্যাপারেও রবীন্দ্রনাথকে খুব বেশি কল্পনার সাহায্য নিতে হয় নি-তাঁর চারপাশে যেসব মানুষ ছিলেন তাঁদের সামনে রেখেই গোরা চরিত্র গড়ে তু লেছিলেন৷ রবীন্দ্রপণ্ডিতদের মতে গোরা চরিত্র কল্পনার মধ্যে যাঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে তাঁরা হলেন-শশধর তর্কচূ ড়ামণি, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, বিবেকানন্দ, নিবেদিতা, তিলক, অরবিন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং৷ নেপাল মজুমদার বলেছেন

: ‘গোরা চরিত্র যেন রবীন্দ্রনাথের নিজেরই আত্মকাহিনী৷’ নিবেদিতার সঙ্গে ‘গোরা’ উপন্যাসের অন্য একটি সম্পর্কও ছিল৷ রবীন্দ্রনাথ এই সম্পর্কের কথা পিয়ার্সনকে লেখা একটি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন : You ask me what connection had the writing of Gora with Sister Nivedita. She was our guest at Shilaida and in trying to improvise a story according to her request I gave her something which came very near to the plot of Gora. She was quite angry at the idea of Gora being rejected even by his disciple Sucharita owing to his foreign origin. You won't find it in the Gora as it stands now-but I introduced it in my story which I told her in order to drive the point deep into her mind . ' (Visvabharati Quarterly, Aug-Oct, 1943) ঘটনাটি সত্যি হওয়াই সম্ভব, যদিও বনফু লকে ঘটনাটি একটু অন্যরকম করে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ (বনফু ল, ‘রবীন্দ্র-স্মৃতি’)৷ সুচরিতা-নিবেদিতা নামদুটির সাদৃশ্যও লক্ষণীয় গোরা চরিত্রের মধ্যেও বিবেকানন্দকে ক্যারিকেচার করার ঝোঁক যে একেবারে নেই তাও বলা যায় না, যেটা ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের সন্দীপের চরিত্রেও কিছুটা রয়েছে বলেই সত্যজিৎ রায়ের ছায়াছবিতে সন্দীপের প্রথম দৃশ্যের মেক-আপে এবং আনুষঙ্গিক ডিটেলেও স্পষ্ট ধরা পড়েছে৷ শিষ্যা সুচরিতা গুরু গোরাকে বিদেশি বলে প্রত্যাখ্যান করায় নিবেদিতা কেন এত রেগে গেলেন সেটা অবশ্য ঠিক বোঝা গেল না ওই চিঠি থেকে৷ তাহলে গোরা চরিত্র সৃষ্টির জন্যে প্রয়োজনীয় প্রায় সব উপাদান বা আদর্শই রবীন্দ্রনাথের সামনেই ছিল৷ পরেশবাবুর জন্যে অবশ্যই ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকু র বা ‘নৌকাডু বি’-র অন্নদাবাবু৷ শ্রীকু মার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারণা : ‘বঙ্কিমের যুগ হইতেই আমাদের উপন্যাসে একজন করিয়া অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন, দিব্যদৃষ্টি মহাপুরুষের স্থান নির্দিষ্ট আছে-রবীন্দ্রনাথও বোধহয় অজ্ঞাতসারেই সেই পুরাতন ধারার অনুবর্তন করিয়াছেন৷ বাস্তবযুগের আবহাওয়ায় পরেশবাবু তাঁহার অলৌকিকত্ব বর্জন করিয়াছেন, কিন্তু মহাপুরুষের অসাধারণত্ব ও দুর্জ্ঞেয়তা তাঁহাকে ত্যাগ করে নাই৷’ সুকু মার সেন আরও পিছিয়ে গিয়ে বলছেন : ‘প্রাচীনকালের ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহপতির আদর্শ আধুনিককালের উপযোগী পরিবর্তন লাভ করিলে যেমন হয়, পরেশবাবু তেমনিই৷’ সুচরিতা-ললিতার আদর্শ ঠাকু রবাড়ির সরলা দেবী থেকে শুরু করে সে যুগের বেশ কিছু শিক্ষিতা মার্জিতরুচি অবিবাহিতা ব্রাহ্ম মেয়েদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সহজেই পেতে পারতেন, যা ‘নৌকাডু বি’ উপন্যাসে হেমনলিনীর চরিত্রে তিনি আগেই ব্যবহার করেছেন৷ সুতরাং চরিত্র সৃষ্টির

ব্যাপারেও ‘গোরা’ উপন্যাস লেখার সময় রবীন্দ্রনাথকে নতু ন করে কিছু ভাবতে হচ্ছে না৷ পানুবাবু বা আনন্দময়ীর মডেলও রয়েছে ‘নৌকাডু বি’র অক্ষর ও ক্ষেমঙ্করীর মধ্যে৷ বাকি রইল শুধু গোরা-সুচরিতার প্রেমের গল্পটু কু র প্লট, আর কিছু আনুষঙ্গিক ঘটনা, যেমন পাহারাওয়ালাদের সঙ্গে মারামারি করে গোরার জেলে যাওয়া বা হরিমোহিনী-কৈলাশ উপদ্রব৷ প্লটের ব্যাপারে, খানিকটা শেকসপিয়ারের মতোই, রবীন্দ্রনাথকে দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়তে হত না কখনও৷ চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একবার (১৩২১) বলেছিলেন : ‘বছর কু ড়ি আগে যদি তোমরা জন্মাতে তাহলে তোমাদের আমি দেদার প্লট দিতে পারতাম৷ তখন আমার মনে হত আমি দুহাতে প্লট বিলিয়ে হরির লুট দিতে পারি৷’ কিভাবে রবীন্দ্রনাথ এত প্লট পেতেন তা কথাগুলি থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবে কু ড়ি বছর আগে, অর্থাৎ ১৩০০ সালের কাছাকাছি সময়ে রবীন্দ্রনাথ যে অজস্রধারায় গল্প লিখেছেন, তার থেকে কিছুটা বোঝা যায় কিভাবে তিনি এত প্লট পেতেন৷ শুধু এডগার অ্যালান পো থেকেই তিনি ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ (১২৯৮) , ‘মহামায়া’ (১২৯৯) , ‘নিশীথে’ (১৩০১) , ‘গুপ্তধন’ (১৩১১) - এই চারটি গল্পের প্লট পেয়ে গিয়েছিলেন৷ বিদেশি গল্প থেকে প্লট আহরণ করা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি সুচিন্তিত মত পাওয়া যাচ্ছে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়কে দেওয়া তাঁর একটি উপদেশ থেকে : ‘গল্প উপন্যাস লেখার সম্বন্ধে তিনি দিতেন আমাদের নানা উপদেশ৷ ...তখন রবীন্দ্রনাথ বলেন, সেরা বিদেশি উপন্যাস বাংলায় অনুবাদ করতে৷ লাইন ধরে অনুবাদ নয়...বিদেশি উপন্যাস পড়ে মূল কাহিনিকে নিজের ভাষায় বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে লিখতে হবে৷ বিদেশি উপন্যাসের মধ্যে যে-সব ঘটনা বা চরিত্রাদি আমাদের দেশের পাঠকসমাজ ঠিক উপলব্ধি করতে পারবে না, তা বাদ দিলেও দোষ হবে না৷ (‘রবীন্দ্র-স্মৃতি’)’ রবীন্দ্রনাথের ‘দর্পহরণ’ গল্পের নায়ক ঠিক এইভাবেই গল্প লেখার চেষ্টা করেছিল : ‘ইংরাজি গল্পের বই দেদার পড়িতে লাগিলাম৷ অনেকগুলি গল্প ভাঙিয়া চু রিয়া একটি প্লট দাঁড় করাইলাম৷ প্লটটা খুবই চমৎকার হইয়াছিল৷’ কথাগুলি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ব্যঙ্গ করে বলেছেন, কিন্তু এর মধ্যে প্লট সংগ্রহ করার ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বা অভিজ্ঞতার কথা একেবারেই নেই তা মনে করা বোধ হয় ঠিক হবে না৷ ৩ রবীন্দ্রনাথ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন নি বলে আমাদের একটা স্বস্তিকর ধারণা আছে যে তাঁকে বা তাঁর সাহিত্যকর্ম বোঝার জন্যে বাংলা সাহিত্য, উপনিষদ বা পদ্মাবক্ষে নৌকাভ্রমণের প্রেক্ষিতই যথেষ্ট৷ এই গুজবে বিশ্বাস করার ফলেই আমরা রবীন্দ্রনাথের গল্পের প্লট, চরিত্র, বক্তব্য সবকিছুই তাঁর চারপাশেই খুঁজতে থাকি, বা সেগুলি সম্পর্কে

রবীন্দ্রনাথের নিজের কথার ওপরেই বেশি বিশ্বাস রেখে ফেলি৷ রবীন্দ্রনাথের মতো পড়াশোনা করা বাঙালি আজ পর্যন্ত বেশি জন্মায় নি এমনকি তাঁর চারপাশে যেসব বিদেশি ছিলেন তাঁরাও বিদেশি সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের মতো পড়াশোনা করেছিলেন কিনা সে সম্বন্ধে সন্দেহ করার কারণ আছে৷ ‘ক্ষু ধিত পাষাণ’ গল্পের প্লট, চরিত্র, খুঁটিনাটি বর্ণনা নেওয়া হয়েছিল দুটি অতি-বিখ্যাত বিদেশি লেখকের দুটি বিখ্যাত গল্প থেকে-এডগার অ্যালান পোর Under the Ragged Mountains ও ফরাসি লেখক Theophile Gautier -এর Le pied de la momie থেকে, যেটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন Lafcadio Hearn ১৮৮২ সালে৷ তা সত্ত্বেও নিবেদিতা এবং অ্যান্ডরুজ নিশ্চিন্তে ‘ক্ষু ধিত পাষাণ’ গল্পের ইংরেজি অনুবাদে সাহায্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে৷ এর থেকে বোঝা যায় যে নিবেদিতা, অ্যান্ডরুজ, বা যেসব বাঙালি পণ্ডিত রবীন্দ্রনাথের এই অনুবাদে সাহায্য করেছিলেন, তাঁরা কেউই রবীন্দ্রনাথের মতো ঘনিষ্ঠভাবে পো বা গোতিয়ের লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না যেমন ছিলেন না যদুনাথ সরকার যিনি ‘মহামায়া’ গল্পটিকে সযত্নে অনুবাদ করে Adamant নাম দিয়ে মডার্ন রিভিয়ু পত্রিকায় ( Dce, 1912 ) ছাপাতে দিয়েছেন, গল্পটি এডগার অ্যালান পো-র Premature Burial রচনাটির একটি কাহিনির প্রায় হুবহু অনুকরণ কিনা (শেষে মহামায়ার রাজীবকে ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া) সে খবর না নিয়েই৷ আবার এটাও সত্যি যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিদেশি, বিশেষত ব্রিটিশ লেখকদের রচনার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সম্পর্কে সে যুগের অনেকেই কিছুটা অবহিত ছিলেন৷ গোরা উপন্যাস যখন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় মাসিক কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে, তখন ইন্দুপ্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ঔপন্যাসিক সাহিত্যে নবরীতি’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন প্রবাসীতে (পৌষ ১৩১৫)৷ এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ও ইংরেজ লেখিকা জর্জ এলিয়ট সম্পর্কে কিছু মূল্যবান মন্তব্য ছিল : বিগত শতাব্দীতে এবং বর্তমান সময়ে ইংলণ্ডের শিক্ষিত সমাজে জর্জ এলিয়টের উপন্যাসসকল যেরূপ সমাদৃত হইয়াছে এরূপ আর অতি অল্প লোকেরই হইয়াছে৷ ভারতবর্ষে যাঁহারা ইংরেজি শিক্ষালাভ করিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যেও জর্জ এলিয়টের খুব আদর৷ এমনকি যাঁহারা উপন্যাস-পাঠের বিরোধী এমন লোককেও জর্জ এলিয়টের উপন্যাসসকল মনোবিজ্ঞানের হিসাবে পড়িতে দেখা গিয়াছে৷ যেমন বঙ্কিমচন্দ্রকে লোকে স্কট আখ্যা দিয়া থাকে, রবীন্দ্রনাথকেও কেহ কেহ জর্জ এলিয়ট বলিয়া থাকেন৷ এক বিষয়ে যে রবিবাবুর সহিত জর্জ এলিয়টের সুগভীর মিল আছে তাহাতে সন্দেহ নাই৷ সে মিল মনের ব্যবসা লইয়া৷ ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের সূচনায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন : ‘সাহিত্যের নবপর্যায়ের পদ্ধতি হচ্ছে ঘটনাপরম্পরার বিবরণ দেওয়া নয়, বিশ্লেষণ করে তাদের আঁতের কথা বের করে

দেখানো৷ সেই পদ্ধতিই দেখা দিল চোখের বালিতে৷’ ইংরেজি সাহিত্যে এই নবপর্যায় শুরু হয়েছে জর্জ এলিয়টের হাতে, যাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে : ‘এক একটা ইংরেজি নভেলে এত বেশি কথা, বেশি ঘটনা, বেশি লোক যে, আমার মনে হয় ওটা একটা সাহিত্যের বর্বরতা৷ ...এমনকি, জর্জ এলিয়টের নভেল যদিও আমার খুব ভালো লাগে, তবু এটা আমার বরাবর মনে হয়, জিনিসগুলো বড়ো বেশি বড়ো-এত লোক, এত ঘটনা, এত কথার হিজিবিজি না থাকলে বইগুলো আরও ভালো হতো৷ কাঁঠাল ফল দেখে যেমন মনে হয়, প্রকৃ তি একটা ফলের মধ্যে ঠেসাঠেসি করে বিস্তর সারবান কোষ পুরতে চেষ্টা করে ফলটাকে আয়তনে খুব ভারি করেছেন বটে এবং একজন লোকের সংকীর্ণ পাকযন্ত্রের পক্ষে কম দুঃসহ করেন খনি, কিন্তু হাতের কাজটা মাটি করেছেন৷ এরই একটাকে ভেঙে ত্রিশ পঁয়ত্রিশটা ফল গড়লে সেগুলো দেখতে ভালো হতো৷ জর্জ এলিয়টের এক একটি নভেল এক একটি সাহিত্য-কাঁঠাল বিশেষ (‘সাহিত্যের পথে’)৷ লক্ষ করার বিষয়, রবীন্দ্রনাথ একবার বলছেন জর্জ এলিয়ট পড়তে তাঁর ‘খুব ভালো লাগে’, আবার অন্যদিকে আমাদের ভয় খাওয়াচ্ছেন আমাদের সংকীর্ণ পাকস্থলীর পক্ষে জর্জ এলিয়টের সাহিত্য-কাঁঠাল গুরুপাক হবে বলে৷ নিজের হজমশক্তি সম্পর্কে এতখানি আস্থা এবং সেযুগের শিক্ষিত বাঙালি পাঠকদের পাকযন্ত্রের সংকীর্ণতা সম্পর্কে এতখানি দৃঢ় বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ কীভাবে অর্জন করেছিলেন জানতে ইচ্ছা করে৷ জর্জ এলিয়টের নামকরা উপন্যাসগুলির- Adam Bede, Middlemarch, The Mill on the Floss বা Silas Marner- কোনোটাকেই ঠিক সাহিত্য-কাঁঠাল বলা যায় না৷ তাঁর একটি উপন্যাস সম্পর্কেই এ অভিযোগ সত্যি বলে মনে হয়, সেটি Felix Holt, the Radical (1866) যার প্লট সম্পর্কে Walter Allen বলেছেন : ‘ ...no reader's attention has ever been engaged by the plot of Felix Holt’ ৷ ‘এত লোক, এত ঘটনা, এত কথার হিজিবিজি’ - রবীন্দ্রনাথের বিরক্তির এই কারণগুলি Felix Holt সম্পর্কে খুব সংগতভাবেই প্রযোজ্য হতে পারে, এবং সবথেকে আশ্চর্যের কথা, এই সাহিত্য-কাঁঠাল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যতগুলি অভিযোগ এনেছেন, উপন্যাসে যে দোষগুলিকে তিনি ‘বর্বরতা’ মনে করেন, তার সবগুলিই রয়েছে তাঁর নিজের লেখা ‘গোরা’ উপন্যাসে৷ Felix Holt -এর সঙ্গে ‘গোরা’র এই দোষগত সান্নিধ্য সত্যিই আমাদের অবাক করে৷ ৪ আমি যতদূর জানি, প্রিয়রঞ্জন সেন তাঁর Western Influence in Bengali Literature বইয়ে প্রথম ‘গোরা’ এবং Felix Holt -এর সাদৃশ্যের প্রসঙ্গ তোলেন৷

আমি বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৪৭) সম্পর্কে একথা বলছি৷ বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল সম্ভবত ১৯৩২ সালে, তাতে Felix Holt -এর কথা ছিল কিনা আমার জানা নেই৷ প্রিয়রঞ্জন লিখছেন : When we come to Gora (the Prabasi, 1907) we find some trace of his reading of George Eliot's Felix Holt in the outward appearances as well as the characters of the hero and Mr. Lyon, and the attitude that the hero observes towards Esther in their first meeting at the tea-table. প্রায় কাছাকাছি একটি মন্তব্য শচীন সেন উদ্ধৃ ত করেছেন প্রিয়রঞ্জন সেনের Western Influence in Bengali Novel থেকে, তাঁর ‘রবীন্দ্র সাহিত্যের পরিচয়’ (১৩৬২) বইয়ে : In his Gora, a few traces of his impressions of Felix Holt may be found, but no more. Felix Holt is a radical, and so is Gora, but in a sense of the word other than conventional. In his burly proportions, his negligence to dress, in his attitude to Sucharita when he first meets her, Gora reminds the reader again and again of Felix Holt...there is the faintest resemblance possible between Esther and Sucharita. প্রিয়রঞ্জনের ভাষার মধ্যে যথেষ্ট দ্বিধা বা লাজুকভাব থাকলেও একটা কথা তিনি স্পষ্ট করে বলছেন : ‘Gora reminds the reader again and again of Felix Holt’ ৷ এই ‘again and again’ শব্দগুচ্ছটি অত্যন্ত জরুরি, যা ‘some trace’ বা ‘a few traces’ - এর সংকোচকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দেয়৷ ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্তের ‘রবীন্দ্রনাথ’ বইটিতে বা তার দ্বিতীয় সংস্করণে (১৯৪৫) ‘গোরা’ প্রসঙ্গে Felix Holt -এর কোনো উল্লেখ নেই, যদিও ‘চোখের বালি’ প্রসঙ্গে জর্জ এলিয়টের উল্লেখ আছে৷ ‘বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা’ (১৩৪৫) বইয়ে শ্রীকু মার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘গোরা’ প্রসঙ্গে জর্জ এলিয়ট বা Felix Holt -এর কথা বলছেন না৷ বুদ্ধদেব বসুর ‘রবীন্দ্রনাথ : কথাসাহিত্য’ (১৯৪৫) বইটির ‘গোরা’ সম্পর্কে লেখা একচল্লিশ পৃষ্ঠার আলোচনায় কারমাজফ, লেভিন, অ্যানা কারেনিনা, জুড, টু র্গেনিয়েফ, ডেভিড কপারফিল্ড, ওয়র এ্যাণ্ড পীস, শেক্সপীয়র, মেজার ফর মেজার, ম্যাক্সিম গর্কী, হাক্সলি, আংকল টোবি, সমারসেট মম-সবাই আছেন বা আছে, কিন্তু জর্জ এলিয়ট বা Felix Holt নেই৷ বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের এইসব সমঝদার পাঠক ও

সমালোচকেরা প্রিয়রঞ্জন সেনের স্পষ্ট ইঙ্গিতকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলেন না, এটা বেশ লক্ষ করার মতো ব্যাপার৷ জর্জ এলিয়ট সম্পর্কে আধুনিক বাঙালি সমালোচকদের উৎসাহ না থাকার একটা কারণ হতে পারে যে ১৯২০ সালের পর থেকে ইংল্যান্ডেই জর্জ এলিয়ট সম্পর্কে পাঠকদের উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে৷ A Literary History of England (Ed. Albert C. Baugh, 1950) বইয়ে Samuel Chew লিখছেন : ‘No other Victorian of major rank is so little read today’৷ প্রায় একই কথা বলেছেন Quentin Andersen তাঁর George Eliot in Middlemarch প্রবন্ধে : ‘although admired, she is not much read’ (The Pelican Guide to English Literature, Vol. 6, 1955) ৷ ইংল্যান্ড বা আমেরিকাতেই যখন প্রায় কেউ জর্জ এলিয়ট পড়ে না, তখন আমাদের দেশে তাঁর সম্পর্কে উৎসাহ কম থাকবে এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজে যেখানে বলছেন যে জর্জ এলিয়ট পড়তে তাঁর খুব ভালো লাগে, এবং একজন গবেষক লিখছেন যে ‘গোরা’ বারবার Felix Holt -এর কথা মনে করিয়ে দেয়, তখন অন্তত রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নিয়ে যাঁরা আলোচনা করছেন, বা ‘গোরা’কে একটি মহৎ সাহিত্যকীর্তি বলে মনে করছেন তাঁদের বোধ হয় একটু কষ্ট করে খুঁজে দেখা দরকার ছিল ‘গোরা’ উপন্যাসের কাহিনি বা চরিত্র কতটা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি আর কতটা জর্জ এলিয়টের৷ প্রিয়রঞ্জনের মন্তব্যের প্রায় তিরিশ-চল্লিশ বছর পরে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা অর্চনা মজুমদার তাঁর ‘রবীন্দ্র-উপন্যাস-পরিক্রমা’ (১৯৭০) বইয়ে Felix Holt ও ‘গোরা’ -র সাদৃশ্য নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছিলেন৷ আলোচনাটি তাঁর পি. এচ. ডি থিসিসের অংশ ছিল বলেই বোধহয় তিনি কিছুটা সঙ্কু চিত হয়ে জর্জ এলিয়টের কাছে রবীন্দ্রনাথের ঋণের পরিমাণ অনেক হালকা করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও আলোচনাটি অত্যন্ত মূল্যবান৷ ‘গোরা’ ও Felix Holt থেকে কয়েকটি সমান্তরাল অংশ তু লে ধরে তিনি দেখিয়েছেন যে ‘গোরা’ উপন্যাসে Felix Holt-এর প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে৷ কিন্তু তাঁর একটি মন্তব্য* : ‘‘*‘ফেলিক্স হোল্ট’, উপন্যাসখানির প্রভাব কবির জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তাঁর উপর পড়ে থাকতেও পারে’’ পড়ে তাঁর প্রবন্ধের পাঠকদের এমন একটা ভু ল ধারণা হতে পারে যে Felix Holt -এর প্রভাবে সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য বোধহয় খানিকটা অনুমান নির্ভর৷ উজ্জ্বলকু মার মজুমদারের ‘উপন্যাসে জাতীয় চেতনা : দুটি উপন্যাস ও রবীন্দ্রনাথ’ (রবীন্দ্রসঙ্গ, ১৩৮৪) প্রবন্ধেও এই ধরনের একটি অনিশ্চিত মন্তব্য রয়েছে ‘হয়তো... জর্জ

এলিয়টের ‘ফেলিক্স হোল্ট’ তাঁর কোনো কোনো চরিত্রের রেখায়ণে প্রেরণা দিয়ে থাকবে...’৷ আসলে অর্চনা মজুমদার Felix Holt -এর সঙ্গে ‘গোরা’ উপন্যাসের যতটা সাদৃশ্য আছে বলে মনে করেছেন বা দেখিয়েছেন, প্রকৃ ত সাদৃশ্য তার চাইতে অনেক বেশি ব্যাপক, গভীর, ঘনিষ্ঠ ও বেদনাদায়ক৷ ৫ জর্জ এলিয়ট (১৮১৯-৮০) একটু বেশি বয়সেই উপন্যাস লেখা শুরু করেন, যার ফলে তাঁর কোনো উপন্যাসেই অপরিণতমনস্কতার ছাপ নেই৷ তাঁর প্রথম উপন্যাস Adam Bede প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৯ সালে, শেষ উপন্যাস Daniel Deronda ১৮৭৬ সালে৷ এই সতেরো বছরে তিনি আরও পাঁচটি উপন্যাস লেখেন- The Mill on the Floss (1860) , Silas Marner (1860) , Romola (1862 - 1863) , Felix Holt , the Radical (1866) , Middlemarch (1872) ৷ জর্জ এলিয়টকে ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম আধুনিক ঔপন্যাসিক বলা হয়, যে আধুনিকতা তাঁর সময়কার ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য উন্নত দেশের সমাজচিন্তা ও সাহিত্যকর্মেরও বৈশিষ্ট্য৷ এই সময়ে প্রকাশিত কয়েকটি উপন্যাস বা অন্যান্য বইয়ের উল্লেখ করলেই এই আধুনিকতার চরিত্র সম্পর্কে আমাদের ধারণা কিছুটা স্পষ্ট হবে : হার্বার্ট স্পেন্সারের Social Statics (1850) , Principles of Psychology , Vol 1 (1851) , ফ্লোবেয়রের Madame Bovary (1857) , ডারউইনের Origin of Species (1859) , মিলের Liberty (1859) , ডস্টয়েফস্কির The House of the Dead (1861) , রাস্কিনের Unto this Last (1862) , টু র্গেনিয়েফের Fathers and Sons (1863) , হাক্সলির Man's Place in Nature (1863) , টলস্টয়ের War and Peace (1866) , ডস্টয়েফস্কির Crime and Punishment (1866) , কার্ল মার্কসের Das Kapital (1867) , ম্যাথু আর্নল্ডের Culture and Anarchy (1869) , ডারউইনের Descent of Man (1871) , হার্বার্ট স্পেন্সারের Data of Ethics (1879) , ইবসেনের The Doll's House (1879) , এমিল জোলার L' Assomoir (1878) , মেরিডিথের The Egoist (1879) , ইবসেনের Ghosts (1881) , আনাতোল ফ্রাঁসের The Crime of Sylvestre Bonnard (1881) ৷ তালিকাটি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কী ধরনের ইনটেলেকচু য়াল বা চিন্তাভাবনাগত ঐতিহাসিক পরিবেশে জর্জ এলিয়ট তাঁর উপন্যাসগুলি লিখেছেন৷ এটা বোঝা দরকার আরও একটি জরুরি কারণে৷ রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর সময়কার বাঙালি ইংরেজি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের ধর্মীয়, সামাজিক,

রাজনৈতিক, দার্শনিক বা সাহিত্যগত চিন্তাধারার মধ্যেই তাঁদের শিক্ষাদীক্ষা মতামত ও ধ্যানধারণা গড়ে তু লেছিলেন৷ এই জগতেই রবীন্দ্রনাথ নিশ্বাস ফেলেছেন, বড়ো হয়েছেন৷ সে-জগৎ আমাদের বর্তমান চিন্তাধারার জগৎ থেকে বেশ কিছু দূরে বলে তাকে ঠিকমতো চিনতে পারা বা বুঝতে পারা আমাদের পক্ষে বেশ কঠিন৷ কিন্তু সে-কাজ আমাদের করতেই হবে রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর সময়কার বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মানসিকতাকে ঠিকমতো চিনতে বা বুঝতে হলে৷ রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব, সমাজচিন্তা ও সাহিত্যর্চ্চার ওপর ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ ও ধ্যানধারণার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অপরিমেয়৷ ‘উনিশ শতকের শেষভাগে যেসব মহামনীষী ইংলণ্ডে বসিয়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা করিয়াছেন, তাঁহাদের সাধনসম্পদে জগতের যে জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হইয়া উঠিয়াছিল-তাহার সিংহদরজা রবীন্দ্রনাথের নিকট উন্মুক্ত হইল না’-নেপাল মজুমদারের এই অদ্ভু ত উক্তিটি যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর৷ ৬ Felix Holt উপন্যাসের এক জায়গায় এলিয়ট একটি কথা বলেছেন যেটি মনে রাখলে এলিয়টের সব উপন্যাসের একটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট হবে : ‘There is no private life which has not been determined by a wider public life’ ৷ এলিয়টের সব উপন্যাসের কাহিনিতেই দুটি বৃত্ত থাকে-একটি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বৃত্ত, যার মধ্যে কয়েকটি মুখ্য চরিত্র তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও সমস্যার মধ্যে ঘোরাফেরা করে আর সেই ছোটো বৃত্তের সম্পর্ক বা দ্বন্দ্বগুলোকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত করে একটি বৃহত্তর সামাজিক, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বৃত্ত যেখানে ছোটো বৃত্তের চরিত্রগুলো তাদের চারপাশের অন্যান্য স্তরের মানুষ বা সমস্যার সংস্পর্শে এসে তাদের ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে (Joan Bennet) ৷ রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডু বি’ বা ‘চোখের বালি’ পারিবারিক বা ব্যক্তিগত ছোটো বৃত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ ‘গোরা’-তেই প্রথম রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোকে একটা বড়ো সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক মাত্রা দেবার চেষ্টা করেন৷ জর্জ এলিয়টের আর একটি বৈশিষ্ট্যও ‘গোরা’-য় লক্ষ করা যায়-সেটি হল ইনটেলেক্ট বা বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে প্যাশন, অনুভব বা আবেগকে মেশানো৷ Quentin Andersen বলছেন *: ‘The briefest possible answer to the question, what is the greatness of George Eliot ? is to say that she knew and could show that every idea is attended by a passion, that thought is passional act’ ৷ বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ ও অজ্ঞাবাদের সঙ্গে Methodist আবেগের এই আশ্চর্য মিশ্রণ আমরা পাই জর্জ এলিয়টের মধ্যে, যা গোরার চরিত্রে বা রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়৷

১৯০৭-১৯০৯ সালে লেখা ‘গোরা’ উপন্যাসের পটভূ মিতে রয়েছে প্রায় তিরিশ বছর আগেকার অর্থাৎ ১৮৮০ সালের কাছাকাছি সময়ের রক্ষণশীল ও হিন্দু ব্রাহ্মসমাজের বিরোধের ধর্মীয় পরিবেশ ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত Felix Holt -এর কাহিনিও তেমনি প্রায় চৌত্রিশ বছর আগেকার ১৮৩২ সালের Reform Bill -কে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ডের শহর ও গ্রামাঞ্চলে যে সামাজিক-রাজনৈতিক আলোড়ন জেগেছিল তার পটভূ মিতে৷ Felix Holt -এর বাইরের বৃত্তটি মূলত সামাজিক- রাজনৈতিক, কিন্তু ভেতরের পারিবারিক বা প্রেমকাহিনির বৃত্তে একটি ধর্মীয় পরিবেশ রয়েছে ননকনফর্মিস্ট পাদ্রি Rufus Lyon -কে কেন্দ্র করে৷ যদিও লায়ন ( Lyon ) ধর্মযাজক বলে এই বৃত্তের একটা সামাজিক মাত্রা আছে৷ ননকনফর্মিস্ট বা Dissenter বলতে সেই সমস্ত প্রোটেস্ট্যান্টদের বোঝায় যাঁরা সরকারি Church of England-এর এক্তিয়ারে না থেকে আলাদা ধর্মমত, উপাসনাপদ্ধতি ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আলাদা আলাদা ধর্মসম্প্রদায় গড়ে তু লেছিলেন, যেমন Quakers, Methodists, Baptists, Unitarians ইত্যাদি৷ ব্রাহ্মরাও এক অর্থে dissenter , যেহেতু তাঁরা সনাতন হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা, আচারঅনুষ্ঠান বা অনুশাসনের মধ্যে না থেকে পৃথক একটি ধর্মসম্প্রদায় গড়ে তু লেছিলেন৷ পাদ্রি লায়ন ও পরেশবাবু দুজনেই dissenter ; লায়ন উপাসনা করেন চ্যাপেলে, আর পরেশবাবু বাগানের চাঁপাতলায় বা ব্রাহ্ম উপাসনালয়ে৷ ‘গোরা’-র প্রেমকাহিনির বৃত্তে আছেন ব্রাহ্ম পরেশবাবু ও তাঁর পরিবার আর গোঁড়া হিন্দু কৃ ষ্ণদয়াল, আনন্দময়ী, গোরা, মহিম ও গোরার বন্ধু বিনয়৷ এই পরিবারিক বৃত্তের সমস্যা ‘গোরা’য় একটা সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় জটিলতা পেয়েছে গোরার ইংরেজবিদ্বেষ, গ্রামপরিক্রমা ও পাহারাওয়ালাদের সঙ্গে মারামারি করে জেলে যাওয়া এবং ব্রাহ্মসমাজের গোঁড়া সমর্থকদের সঙ্গে পরেশবাবুর বিরোধের মধ্যে ঠিক তেমনি FelixEsther -এর প্রেমকাহিনি জটিলতা পেয়েছে ফেলিক্সের র্যাডিক্যাল রাজনীতি, অভিজাত ফ্যাশন-দুরস্ত ধনীদের সম্পর্কে ফেলিক্সের ঘৃণা, শ্রমজীবী সাধারণ মানুষদের সঙ্গে ফেলিক্সের অন্তরঙ্গতা, পাহারাওয়ালাদের সঙ্গে মারামারি করে ফেলিক্সের জেলে যাওয়া এবং পাদ্রি লায়নের সঙ্গে স্থানীয় গির্জার রেক্টরের মতবিরোধ ও বিতর্কের মধ্যে৷ Felix Holt উপন্যাসের মূল কাহিনির কেন্দ্রে ফেলিক্স ও এসটার (Esther) থাকলেও Transome পরিবারকে নিয়ে একটি দীর্ঘ ও যথেষ্ট জটিল উপকাহিনি গড়ে তোলা হয়েছে যা মূল কাহিনির সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত নয়৷ এই উপকাহিনি অনেক সংক্ষিপ্ত আকারে রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন হরিমোহিনী-কৈলাশ উপাখ্যানে৷ সে-প্রসঙ্গে আমরা পরে আসছি৷

Felix Holt উপন্যাসের শুরুতেও ঘোড়ার গাড়ি আছে, কিন্তু কোনো অ্যাকসিডেন্ট নেই৷ ‘গোরা’ শুরু হচ্ছে একটি জুড়িগাড়ির সঙ্গে একটি ভাড়াগাড়ির ধাক্কা এবং তার ফলে ভাড়াগাড়ির চাকা ভেঙে যাওয়া দিয়ে৷ এ ধরনের দুর্বিপাকের সাহায্য নিয়ে উপন্যাস শুরু করা বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক উপন্যাসের পক্ষে খুব একটা গৌরবজনক হয় নি৷ ভাবতে খারাপ লাগে যে সুচরিতা-পরেশের সঙ্গে বিনয়ের প্রথম সাক্ষাতের জন্যে ঠিক বিনয়ের বাড়ির সামনেই গাড়ির ধাক্কা লাগানো ছাড়া রবীন্দ্রনাথ আর কোনো সুযোগ উদ্ভাবন করতে পারলেন না৷ Felix Holt উপন্যাসে হ্যারল্ড যাঁকে বাবা বলে, তিনি তার বাবা নন আবার নায়িকা এসটার পাদ্রি লায়নকে বাবা বলে, কিন্তু লায়ন এসটারের বাবা নন৷ ‘গোরা’-তেও গোরা কৃ ষ্ণদয়ালকে বাবা বলে জানে, কিন্তু কৃ ষ্ণদয়াল তার বাবা নন, সুচরিতা পরেশবাবুকে বাবা বলে, কিন্তু পরেশবাবু সুচরিতার বাবা নন৷ এসটার ছোটোবেলায় তার বাবা-মাকে হারিয়েছে, সুচরিতাও জ্ঞান হবার আগেই তার বাবা-মাকে হারিয়েছে৷ এসটার এবং সুচরিতা দুজনেই তাদের পৈতৃ ক সম্পত্তির খবর অনেক পরে জেনেছে, জানার পর দুজনেই তাদের নিজের বাড়িতে উঠে এসেছে এবং সেখানে অনেক জটিলতা দেখা দিয়েছে৷ মানসিক যন্ত্রণা বা দুশ্চিন্তায় পড়লে এসটার পাদ্রি লায়নের স্নেহশীলতার আশ্রয় চায়, সুচরিতাও ধীরস্থির সত্যনিষ্ঠ পরেশবাবুর কাছে আসে শান্তির জন্যে৷ ফেলিক্সের সঙ্গে পাঠকদের প্রথম দেখা হবে লায়নের বসার ঘরে, যার মধ্যে শৌখিন আসবারপত্র কিছু নেই, শুধু ‘a bookcase, a map, ...a portrait of Dr. Doddridge, and a black bust ... covered with green gauze’ ৷ পরেশবাবুর বসার ঘরটিও অতিসাধারণ, যার মধ্যে রয়েছে একটি ছোটো বইয়ের আলমারি, একটি গ্লোব, কেশব সেনের ফোটোগ্রাফ, গ্লোবটি কাপড় দিয়ে ঢাকা৷ Dr. Doddridge, কেশব সেনের মতোই, একজন বিখ্যাত ননকনফর্মিস্ট ধর্মপ্রচারক৷ ফেলিক্সের চেহারা ও গলার আওয়াজ সম্পর্কে জর্জ এলিয়ট এই কথাগুলি ব্যবহার করেছেন *: ‘massively built’ , ‘considerably taller’ , ‘his head and neck...massive’ , ‘strong-limbed’ , ‘a peculiar-looking person, but not insignificant’ , ‘the loud abrupt tones made the old man vibrate a little’ , ইত্যাদি৷ গোরার চেহারা ও গলার আওয়াজ নিশ্চয় আমাদের মনে আছে : মাথায় সে প্রায় ছ’ফু ট লম্বা, হাড় চওড়া, হাতের মুঠো বাঘের থাবার মতো বড়ো, মুখের গড়নও অনাবশ্যক রকমের বড়ো এবং অতিরিক্ত রকমের মজবুত, চোয়াল এবং চিবুকের হাড় ‘দূর্গদ্বারের দৃঢ় অর্গলের মতো’, ‘ঠিক সুশ্রী বলা যায় না, কিন্তু তাহাকে না দেখিয়া থাকিবার যো নাই ( not insignificant ) , সে সকলের মধ্যে চোখে পড়িবেই’, ঠা

ঠি

‘গলার আওয়াজ এমনি মোটা ও গম্ভীর যে হঠাৎ শুনিলে ‘কেরে’ বলিয়া চমকিয়া উঠিতে হয়’, ‘প্রবল কণ্ঠের কথাগুলি ঘরের দেয়ালে টেবিলে সমস্ত আসবাবপত্রে যেন কাঁপিতে লাগিল৷’ ফেলিক্সের সঙ্গে যেদিন পাদ্রি লায়নের প্রথম দেখা হয় সেদিন ফেলিক্সের অভব্য অদ্ভু ত বেশভূ ষা ( without waistcoat or cravat ) এবং অবিনয়ে লায়ন ‘felt a slight shock’৷ পরেশবাবুর সঙ্গে গোরা যেদিন প্রথম দেখা করতে এল তার ‘অদ্ভু ত সাজ দেখিয়া সকলেই বিস্মিত হইয়া উঠিল৷’ ফেলিক্স লেখাপড়া শিখেছে, বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে, কিন্তু লায়নের সুপারিশ নিয়ে কোনো চাকরি করতে চায় না : ‘I'll take no employment that obliges me to prop up my chin with a high cravat ... I do choose to withdraw myself from the push and scramble for money and position’ ৷ গোরাও কলেজে লেখাপড়া শিখেছে, কিন্তু ‘চাকরির উমেদারি’, ‘খেতাবের মায়া’-এইসব ‘উঞ্ছবৃত্তির প্রলোভনে’ ভু লতে চায় না৷ ফেলিক্স তার বাবার লোক-ঠকানো ওষুধের ব্যবসা বন্ধ করে খেটে রোজগার করে বাঁচতে চায়৷ গোরাও তার বাবার বিষয়সম্পত্তির ‘এক পয়সাও নেবে না’, ‘নিজে খেটে উপার্জন করে খাবে’৷ ওঝাদের হাতু ড়ে ওষুধের ওপর গোরার দারুণ রাগ, ফেলিক্সও হাতু ড়ে ওষুধের ওপর তার মার বিশ্বাস দেখে একইভাবে উত্তেজিত৷ ফেলিক্স ছোটো ছোটো গরিব ছেলেদের লেখাপড়া শেখায়, অশিক্ষিত শ্রমজীবী মানুষদের কাছে যায়, তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করে৷ ফেলিক্স মদ খাওয়া পছন্দ করে না, তবু ওদের সঙ্গে সহজ হবার জন্যে এক গ্লাস বিয়ার নিয়ে বসে৷ গোরা ইস্কু লের ছেলেদের সর্দারি করত, পরে ‘ক্ষু দ্র বিদ্রোহীদের দলপতি হইয়া উঠিল৷’ গোরা পাড়ার ‘নিম্নশ্রেণীর লোকদের ঘরে যাতায়াত করিত৷ ...নিতান্তই তাহাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করিবার জন্য যাইত৷ ...গোরাকে ইহারা কড়িবাঁধা হুঁকা দিয়া অভ্যর্থনা করিত৷ কেবলমাত্র উহাদের আতিথ্য গ্রহণ করিবার জন্যই গোরা জোর করিয়া তামাক খাওয়া ধরিয়াছিল৷’ ফেলিক্সের বিয়ারের বদলে গোরার তামাক খাওয়াটি রবীন্দ্রনাথ বেশ চমৎকার ব্যবহার করেছেন৷ ফেলিক্স একটু বদরাগী, মাথায় রক্ত চড়ে গেলে তার আর কোনো কাণ্ডজ্ঞান থাকে না৷ এই রোগটিও রবীন্দ্রনাথ গোরাকে দিতে ভু লে যান নি৷ ৭ বুদ্ধদেব বসুর মতো অনেক পাঠকই মনে করেন ‘গোরা’ উপন্যাসের প্রাণকেন্দ্র গোরাসুচরিতার প্রেমকাহিনির মধ্যেই সঞ্চিত আছে৷ Felix Holt উপন্যাসেও ফেলিক্সএসটারের প্রেমের গল্পটিই মূল কাহিনি৷ ‘গোরা’ উপন্যাসের মূল প্রেমকাহিনি ও তার সমস্ত

অনুপুঙ্খ ফেলিক্স-এসটারের প্রেমের গল্পটিকে অনুসরণ করেছে৷ বাপ-মা-হারানো এসটার বাপ-মা-হারানো সুচরিতার মতোই সুন্দরী, শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী দুজনেরই আত্মমর্যাদাবোধ প্রখর৷ এসটার দু-একটি মেয়েকে পড়াতে যায়, সুচরিতাও তাই৷ লায়ন ফেলিক্সকে বলেছেন : ‘You will stay and have a dish of tea with us; my daughter is detained by giving a lesson in the French tongue ... But she is doubtless returned now, and will presently come and pour out tea for us’ ৷ পরেশবাবুও বলছেন : ‘সুচরিতা আমার একটি বন্ধু র মেয়েকে পড়াতে যায়৷ ...আর একটু বসলেই তাদের সঙ্গে দেখা হত, তাদের ফেরার আর বড়ো দেরি নেই৷’ প্রথম দেখা হওয়ার দিন ফেলিক্স এসটারকে ভালো করে লক্ষ করতেই চায় নি প্রথমটায় : ‘determined to notice her as little as possible , ... rose and bowed also with an air of indifference’ ৷ গোরাও ‘মেয়েরা যে এখানে কোনো-এক জায়গায় আছে তাহা লক্ষ্য করা অশিষ্টতা বলিয়া গণ্য করিল৷’ প্রথম সাক্ষাতেই ফেলিক্স সম্পর্কে এসটারের একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হল : ‘I think he is very coarse and rude’ ৷ সুচরিতারও ‘প্রথম দৃষ্টিতে গোরার প্রতি একটা আক্রোশ জন্মিল... ইচ্ছা করিল কেহ এই উদ্ধত যুবককে তর্কে একেবারে পরাস্ত করিয়া দেয়৷’ ফেলিক্সের উদ্ধত ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে এসটার তার হাতে চা তু লে না দিয়ে শুধু বলল : ‘The tea is poured out, father’ ৷ সুচরিতাও ঠিক এইভাবে ‘কয়েক পেয়ালা চা তৈরি করিয়া পরেশের মুখের দিকে চাহিল৷ কাহাকে চা খাইতে অনুরোধ করিবে না করিবে তাহা লইয়া তাহার মনে দ্বিধা হইতেছিল৷’ প্রথমে ফেলিক্স পাদ্রি লায়নের সামনে যথেষ্ট উদ্ধত অবিনয় দেখালেও বিদায় নেবার সময় সে হাসিমুখে লায়নকে বিদায়-সম্ভাষণ জানিয়েছে : ‘I understand you, sir, said Felix, good-humoredly, putting out his hand to the little man’ ৷ গোরাও প্রথমে এসে ‘পরেশকে বড়ো একটা খাতির করে নাই৷ যাইবার সময় যথার্থ ভক্তির সঙ্গে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া গেল৷’ এসটারকে দেখে ফেলিক্স কিছুটা অবাক হয়েছে : ‘he was inwardly surprised... The minister's daughter was not the sort of person he expected’ ৷ সুচরিতাও গোরাকে কিছুটা অবাক করেছে, শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে যে প্রগলভতা গোরা কল্পনা করেছিল সুচরিতার মধ্যে তা নেই৷ ভালো করে না দেখলেও ফেলিক্স এসটারের শরীরের কোনো কোনো অংশ সম্পর্কে সচেতন হয়েছে৷ সুচরিতা যখন মুখ নিচু করে বসেছিল তখন গোরাও ভালো করে তার দিকে তাকিয়েছে এবং তার মুখ, ঠোঁ

ভ্রূ, শাড়ি পরার ভঙ্গি, ঠোঁট, হাত, কপালের ভ্রষ্ট কেশ, পায়ের কাছে শাড়ির পাড়-এ সবই লক্ষ করে তার ভালো লেগেছে৷ এসটারের দীর্ঘ গ্রীবা আর চকচকে বাদামি কু ঞ্চিত কেশের গুচ্ছ দেখে ফেলিক্সও কিছুটা আকৃ ষ্ট হয়েছে, স্বীকার না করলেও৷ ফেলিক্স চলে যাবার পর এসটারের মনের মধ্যে একটা আলোড়ন জেগেছে৷ ফেলিক্সের ঔদাসীন্য তাকে আহত করেছে, কিন্তু ফেলিক্সের প্রবল ব্যক্তিত্বের প্রতি একটা আকর্ষণ থেকে সে কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না৷ সুচরিতার মানসিক অবস্থা ঠিক একই রকম৷ আমরা এসটারের ভাবনাগুলো পরপর তু লে ধরছি গোরা-সম্পর্কে সুচরিতার চিন্তাগুলোকে পাশাপাশি রেখে : ‘He looked at her as if he never saw a single detail about her person...She had begun to find him rather irritating to her woman's love of conquest . ’ ‘But she had only a mortified sense that he was quite indifferent to what others praised her for . ’ ‘সে তাহাকে একেবারে যেন লক্ষ্য মাত্রই করে নাই-যাইবার সময়েও তাহাকে সে যেন চোখে দেখিতেই পাইল না৷ এই পরিপূর্ণ উপেক্ষাই যে সুচরিতাকে গভীরভাবে বিঁধিয়াছে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই৷’ ‘He held himself to be immeasurably her superior; and what was worse, Esther had a secret consciousness that he was her superior . ’ ‘গোরাকে সে কু সংস্কারাচ্ছন্ন উদ্ধত যুবক বলিয়া সমস্ত মনের সঙ্গে অবজ্ঞা করিতে চাহিল, কিন্তু তবু...সুচরিতা মনে মনে অত্যন্ত ছোটো হইয়া গেল৷’ ‘She... wished in her vexation that she could have found more fault with him . ’ ‘কোনো মতে গোরার পরাভব ঘটে তাই সে মনে মনে ইচ্ছা করিল৷’ ‘Esther wished that a finished gentleman were among her acquain-tances; he would certainly admire her, and make her aware of Felix's inferiority . ’ ‘সুচরিতার ইচ্ছা করিতে লাগিল কেহ এই উদ্ধত যুবককে তর্কে একেবারে পরাস্ত লাঞ্ছিত করিয়া দেয়৷’

‘She ran upto her bedroom and burst into tears . ’ ‘তাহার বুকের অনির্দেশ্য বোঝাটার জন্য তাহার কাঁদিতে ইচ্ছা করিল৷’ ফেলিক্স-এসটারের প্রেমকাহিনিকে এইভাবে রবীন্দ্রনাথ ঘনিষ্ঠভাবে গোরা উপন্যাসে অনুসরণ করেছেন, কিন্তু তাদের সব কথাবার্তা বা অনুভূ তিগুলোর আক্ষরিক অনুবাদ করেন খনি, বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে নিজের মতো করে ভাবানুবাদ করেছেন৷ সেইজন্যে উদ্ধৃ তিগুলির মধ্যে ভাবনার মিল থাকলেও, বাক্য বা শব্দের হুবহু অনুবাদ থাকবে না৷ তাছাড়া ফেলিক্স-এসটারের মনের দ্বন্দ্বগুলো বা কথাবার্তা Felix Holt উপন্যাসে যে ক্রমে এসেছে, ‘গোরা’ উপন্যাসে সেই ক্রম সবসময় অনুসরণ করা হয় নি৷ তাই আমরা যে তু লনীয় অংশগুলো তু লে ধরছি সেগুলোর ক্রমে দুটি উপন্যাসের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে৷ সব অংশগুলি উদ্ধৃ ত করলে Felix Holt আর ‘গোরা’ দুটি উপন্যাস আবার আমাদের লিখতে হবে, তাই কয়েকটি অংশ আমরা এখানে উল্লেখ করছি : ফেলিক্স তাদের বাড়ি আসছে না বলে এসটার খুব অস্থির হয়ে আছে- ‘Esther was waiting for the sake of - not a probability, but a mere possilility ... she ... started from her seat, sat down again, and listened eagerly. If Liddy (পরিচারিকা) should send him away, could she herself rush out and call him back ? ’ ‘অনেকদিন এমন হইয়াছে বিনয় আগে আসিয়াছে, গোরা তাহার পরে আসিয়াছে- আজও সেইরূপ ঘটিতে পারে ইহাই মনে করিয়া সুচরিতা যেন একপ্রকার সচকিত অবস্থায় রহিল৷ গোরা পাছে আসিয়া পড়ে এই তাহার একটা ভয় ছিল এবং পাছে না আসে এই আশঙ্কাও তাহাকে বেদনা দিতেছিল৷’ ‘wished that she had not been obliged to admire more and more the varying expressions of his open face and his deliciously goodhumoured smile . ’ ‘গোরা যে ছেলেমানুষের মতো এমন প্রচু রভাবে হাসিয়া উঠিতে পারে ইহাতে সুচরিতা আশ্চর্য বোধ করিল এবং তাহার মনের মধ্যে ভারি একটা আনন্দ হইল৷’ ‘She could not contradict what Felix said . ’ ‘গোরার কথাকে একেবারে অগ্রাহ্য করিবার চেষ্টা করিল৷ কিন্তু... তাহাকে ঠেলিয়া ফেলিতে যে হাত উঠে না৷’ ‘এই প্রথম একজনকে একটি বিশেষ মানুষ একটি বিশেষ পুরুষ বলিয়া যেন দেখিতে পাইল৷ তাহাকে আর দশজনের সহিত মিলাইয়া দেখিতে পারিল না৷ ...মানুষ কি, মানুষের

আত্মা কি, সুচরিতা এই তাহা প্রথম দেখিতে পাইল এবং অপূর্ব অনুভূ তিতে সে নিজের অস্তিত্ব একেবারে বিস্মৃত হইয়া গেল৷’ ফেলিক্স এসটারকে পরিবর্তন করতে চায়, তাই বলছে : Not enough Miss Lyon not all that I came to say. I want you to change . ’ গোরাও বলছে : ‘যেখানে তোমার প্রতিষ্ঠা সেখানেই তোমাকে দৃঢ় করে প্রতিষ্ঠিত করব তবে আমি ছাড়ব৷’ ‘Did he love her one little bit, and was that reason why he wanted her to change ? Esther felt less angry at that form of freedom . ’ ‘এ সকল কথা আর কাহারও মুখে সে সহ্য করিতেই পারিত না, রাগ হইত, সে লোকটাকে মূঢ় মনে করিত, তাহাকে শিক্ষা দিয়া সংশোধন করিবার চেষ্টার জন্য মনে উত্তেজনা হইত৷ কিন্তু সেদিন গোরার সম্বন্ধে তাহার কিছুই হইল না৷’ ‘She felt as if she should forever more be haunted by selfcriticism, and never do anything to satisfy those fancies on which she had simply piqued herself before without being dogged by inward questions . ’ ‘এতদিন যাহা নিশ্চয় বলিয়া জানিয়াছি তাহা সংশয়াকীর্ণ এবং প্রত্যহ যাহা করিয়া আসিতেছি তাহা অর্থহীন৷’ এস্টারের এক একবার মনে হয় ফিলিক্সের কাছে তার কোনো মূল্য নেই : ‘She was utterly trivial to him . ’ গোরা অকারণে বেড়াতে বেরিয়েছে শুনে সুচরিতারও মনে হল-‘গোরার কাছে মানুষের কোন মূল্য নাই৷’ ফেলিক্স এস্টারকে বলছে : ‘No, you are not an insect. That is what exasperates me at your making a boast of littleness. You have enough understanding to make it wicked that you should add one more to the women who hinder men's lives from any nobleness in them.’ গোরা সুচরিতাকে ঠিক ওই কথাই বলছে : ‘আপনি নিজেও যাতে নিজেকে ঠিকমতো বুঝতে পারেন এইটে আমার ইচ্ছে৷ ...আপনি নিজেকে ছোটো বলে জানবেন না৷ ...আপনার মনের মধ্যে যে একটি স্বাভাবিক উদার শক্তি আছে সেটা দলের মধ্যে সঙ্কু চিত হচ্ছে দেখে আমি কষ্ট পাচ্ছি৷’ ‘His life was like his words . ’

‘গোরার কথা শুধু কথা নহে, সে যেন গোরা স্বয়ং৷’ ‘The tumult of feeling in Esther's mind - mortification, anger, the sense of a terrible power over her that Felix seemed to have as his angry words vibrated through her - was getting almost too much for her self-control . ’ ‘লজ্জা ভু লিয়া, আপনাকে ভু লিয়া, ভাবের উৎসাহে উদ্দীপ্ত গোরার মুখের দিকে সুচরিতা চোখ তু লিয়া চাহিয়া রহিল৷’ ‘You are very pale; you look ill, compared with your old self . ’ ‘পূর্বের চেয়ে সে অনেকটা রোগা হইয়া গেছে৷ ...তাহার উজ্জ্বল শুভ্র বর্ণও পূর্বের চেয়ে কিছু ম্লান হইয়াছে৷’ ‘The rest she needed was the rest of a final choice. On each side there was renunciation . ’ ‘সুচরিতা বুঝিয়াছে এবার তাহার জীবনে একটা সন্ধিক্ষণ আসিয়াছে৷’ ফেলিক্স বিয়ে করবে না বলে পণ করেছিল, তাই এস্টারের কাছে তার দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলে নিজেকে তিরস্কার করেছে৷ সে বুঝেছে তাদের দুজনের মিলিত হবার কোনো আশা নেই, দুজনের পথ আলাদা, জীবনবোধ আলাদা : ‘Felix reproached himself... He felt that they would never marry - that they would ruin each other's life . ’ গোরাও বিয়ে করবে না বলেছিল, সুচরিতা সম্পর্কে মন দুর্বল হওয়ার পর সে-ও নিজেকে একইভাবে ভর্ৎসনা করেছে : ‘ইহার কি প্রয়োজন! যে সংকল্প লইয়া আগাগোড়া বিধিবদ্ধ করিয়া মনে মনে সাজাইয়া লইয়াছিল তাহার মধ্যে ইহার স্থান কোথায়? ...না এসব কিছু নয় এ কোনোমতেই চলিবে না৷’ এইভাবে গোরা-সুচরিতার প্রেম, আকর্ষণ-বিকর্ষণ, মানসিক দ্বন্দ্ব ফেলিক্স- এস্টারের প্রেমকাহিনির সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলেছে৷ তফাত শুধু এই যে, ফেলিক্স ও এস্টার অনেক সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলার ফলে, বিশেষত narrator বা কথকের ভঙ্গি ও ভাষা সহজ বলে, তাদের অন্তরঙ্গতার মধ্যে একটা বিশ্বাসযোগ্যতা এসেছে, গোরার এবং কথকের কৃ ত্রিম, বক্তৃ তাধর্মী ও প্রবন্ধগন্ধী কথাবার্তার জন্যে যেটা গড়ে উঠতে পারে নি গোরা-সুচরিতার প্রেমের মধ্যে৷ তাছাড়া ফেলিক্স ও এসটার দুজনেরই বেশ উইট ও হিউমারবোধ থাকার জন্যে তাদের মান-অভিমান- খুনসুটির মধ্যে দিয়ে একটা ভাববিনিময় বা অনুভবের আদানপ্রদান ঘটেছে সুচরিতা বা গোরা কারওরই সেটি না থাকায় গোরার কথাবার্তা বরাবরই একতরফা থেকে গেছে, মন দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটি ঘটতে পারে ঠা

নি৷ গোরার বয়স তেইশ-চবিবশ, সুচরিতার এখনও আঠারো হয় খনি, অথচ তাদের কথাবার্তায় তারুণ্যের কোনো উত্তাপ নেই, তার কারণ গোরা কথা বলে প্রৌঢ় রবীন্দ্রনাথের মতো৷ স্বাভাবিকভাবেই তার কণ্ঠস্বরে একটা জ্যাঠামশায়ির ছাপ বা সুর এসে যায় যেটা সুচরিতার সঙ্গে তার অনুরাগের সম্পর্ককে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হতে দেয় না৷ একটা উদাহরণ দিলে বোধ হয় ভালো হয় : ‘গোরা কহিল, ব্রহ্ম যিনি নির্বিশেষ তিনি বিশেষের মধ্যেই ব্যক্ত৷ কিন্তু তাঁর বিশেষের শেষ নেই৷ জল তাঁর বিশেষ, স্থল তাঁর বিশেষ, অগ্নি তাঁর বিশেষ, প্রাণ তাঁর বিশেষ...৷ যিনি নিরাকার তাঁর আকারের অন্ত নেই-হ্রস্বদীর্ঘ স্থূলসূক্ষ্মের অনন্ত প্রবাহই তাঁর৷ যিনি অনন্তবিশেষ তিনিই নির্বিশেষ, যিনি অনন্তরূপ তিনিই অরূপ৷’ কোনো সুস্থ যুবক একটি ষোলো-সতেরো বছরের মেয়ের সঙ্গে এমন catechism -এর ভাষায় কথা বলে না৷ এই একটি সংলাপের জন্যেই সুচরিতার উচিত ছিল গোরাকে প্রত্যাখ্যান করা, ব্রাহ্ম মেয়েদের পক্ষে উপযুক্ত পাত্র যতোই দুষ্প্রাপ্য হোক৷ অবশ্য এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ কিছু করার ছিল না, কেননা গোরা আসলে দুটি চরিত্র-একটি প্রেমিক গোরা যে সরাসরি এসেছে Felix Holt থেকে আর একটি বক্তা গোরা যার জন্ম রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ধারণায় বা প্রবন্ধে৷ এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন গোরা স্বাভাবিকভাবেই ঠিকমতো জোড়া লাগে নি উপন্যাসে, তাদের মধ্যে একটা স্পষ্ট চিড় রয়েই গেছে৷ ‘গোরা’ উপন্যাসের সবথেকে গুরুতর কাঠামোগত বা শিল্পগত দুর্বলতা এখানেই৷ ৮ এবার আমরা ‘গোরা’ উপন্যাসের বাইরের বৃত্তটির দিকে একবার তাকাব৷ বাইরের বৃত্তে একটি উল্লেখ করার মতো ঘটনা গোরার জেলে যাওয়া৷ যে-পরিস্থিতিতে গোরা জেলে গেছে সেটি রবীন্দ্রনাথ নিজের অভিজ্ঞতা বা কল্পনা দিয়ে সহজেই তৈরি করতে পারতেন, যেমন করেছিলেন ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন কোনো বিদেশি গল্প থেকে প্লট নিতেন তখন নিজের উদ্ভাবনশক্তির ওপর খুব একটা চাপ দিতে চাইতেন না বোধ হয়৷ তাই এই ঘটনাটিও Felix Holt থেকেই তাঁকে নিতে হল৷ ফেলিক্সকেও জেলে যেতে হয়েছে, এবং আশ্চর্যের বিষয়, একই কারণে-পাহারাওয়ালাদের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ার ফলে৷ রবীন্দ্রনাথ এই মারামারি ব্যাপারটি খুব আকস্মিকভাবে এনেছেনগ্রামের পুকু রে ছেলেরা নামলে পাহারাওয়ালা তেড়ে আসে এমন ঘটনাকে খুব একটা স্বাভাবিক বলে মনে হয় না৷ রবীন্দ্রনাথেরও মনে হয় খনি, তাই লিখছেন : ‘হঠাৎ কোথা হইতে একটা পাহারাওয়ালা আসিয়াই একেবারে ছাত্রের ঘাড়ে হাত দিয়া ধাক্কা মারিয়া তাহাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিল৷’ এই ব্যাপারটি Felix Holt -এ অনেক

বিশ্বাসযোগ্যভাবে ও ঘটনাপরম্পরার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঘটেছে৷ ফেলিক্স র্যাডিক্যালপ্রার্থী হ্যারল্ডের সমর্থক, কিন্তু হ্যারল্ডের লোকজন টোরি ভোটারদের ভয় দেখিয়ে নির্বাচনকেন্দ্র থেকে হটিয়ে দেওয়ার জন্যে কিছু মাতাল গুন্ডাগোছের লোকজনদের দিয়ে ঝামেলা পাকাবার চেষ্টা করছে৷ ফেলিক্স উন্মত্ত জনতাকে একটা নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় গোলমাল বাধে৷ একজন পাহারাওয়ালা তাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করলে ফেলিক্স তাকে ধাক্কা মেরে তার হাত থেকে তরোয়াল কেড়ে নেয়, পাহারাওয়ালা পড়ে গিয়ে মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে মারা যায়৷ বুলেটের আঘাতে ফেলিক্সও পড়ে যায়৷ ‘গোরা’ উপন্যাসের দারোগার মতো Felix Holt -এর Mr. Crow -ও যথেষ্ট কটু ভাষী ও দুষ্কর্মী৷ মাধব চাটু জ্জে যেমন সদরে খবর পাঠাতে বলেছে গোরার বিরুদ্ধে, Felix Holt -এ তেমনি জন জনসন ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেছে *: ‘I know this man very well... he is a dangerous character - quite revolutionary’৷ পরের দিনই ফেলিক্স ও অন্য চারজন আসামিকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেমন ‘গোরাকে এবং কয়েকজন ছাত্রকে পুলিশে গ্রেফতার করিয়া লইয়া হাজতে’ রেখেছিল৷ ফেলিক্স কোনো উকিলের সাহায্য নেবে না : ‘Felix had declared that he would receive no aid...he would in any case have spoken in his own defence’ ৷ তাই গোরাও বলছে : ‘না, আমি উকিলও রাখব না, জামিনে খালাসেরও চেষ্টা করতে হবে না৷’ ‘...সে নিজের মামলা নিজে চালাইবার উপলক্ষে...কিছু বলিবার চেষ্টা করিতেই ম্যাজিস্ট্রেট...পুলিশের কর্মে বাধা দেওয়ার অপরাধে তাহাকে একমাস সশ্রম কারাদণ্ড দিলেন৷’ ফেলিক্সের জন্যে স্থানীয় একজন উকিল ফি না নিয়ে মামলায় সাহায্য করেছে, গোরার সহপাঠী সাতকড়ি উকিলও তাই করেছে৷ পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া, একজন পাহারাওয়ালার মৃত্যু ঘটানো ও দাঙ্গাহাঙ্গামা করার অপরাধে ফেলিক্সের চার বছর জেল হয়েছে৷ এই বিচারের ব্যাপারটি ‘গোরা’ উপন্যাসে নমোনমো করে সারা হয়েছে, কিন্তু Felix Holt -এ এটি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে, বিশেষত বিচারদৃশ্যে ফেলিক্স, লায়ন, হ্যারল্ড ও এসটারের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও মনোভাব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ ৯ ‘গোরা’ উপন্যাসের হরিমোহিনী-কৈলাশ উপাখ্যান, রবীন্দ্রনাথ গড়ে তু লেছেন Felix Holt উপন্যাসের Transome পরিবারের উপকাহিনির ওপর ভিত্তি করে৷ ট্র্যানসাম পরিবারের সম্পত্তি-পাওয়া, মামলা-মোকদ্দমা, Mrs. Transome -এর সঙ্গে পারিবারিক বন্ধু ও উকিল Jermyn -এর অবৈধ সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের ফলে হ্যারল্ডের জন্ম, এই জন্মরহস্য ঠা

দীর্ঘকাল গোপন থাকার পর হঠাৎ প্রকাশ পাওয়া, একটি পুরোনো মামলার রায় অনুযায়ী ট্র্যানসাম-সম্পত্তি এসটারের অধিকারে চলে আসা, নানাধরনের ব্ল্যাকমেল, ইত্যাদির মাধ্যমে উপন্যাসের এই অংশটিতে জর্জ এলিয়ট যথেষ্ট জটিলতার সৃষ্টি করেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ শুধু কয়েকটি চরিত্র ও ঘটনা তু লে এনেছেন ‘গোরা’তে৷ ট্র্যানসাম-সম্পত্তির বর্তমান মালিক ট্র্যানসাম পরিবার জেনেছে যে সম্পত্তির উত্তরাধিকার চলে গেছে এসটারের কাছে, এসটার সে-কথা এখনও জানে না৷ Mrs. Transome ও তাঁর ছেলে হ্যারল্ডের ইচ্ছার খবরটা এসটারকে জানিয়ে যদি তাকে এ বাড়িতে আনা যায় এবং ভবিষ্যতে যদি হ্যারল্ডের সঙ্গে এসটারের বিয়ে হয়, তাহলে এ সম্পত্তি তাদেরই থেকে যাবে৷ হরিমোহিনী ঠিক এই উদ্দেশ্যেই তাঁর দেওর কৈলাশের সঙ্গে সুচরিতার বিয়ে দিতে চান৷ হ্যারল্ড বিপত্নীক, এসটারের কাছে সম্পত্তি চলে গেছে একথা জানার আগে সে বলেছে আর সে বিয়ে করবে না৷ কিন্তু পরে এসটারের সম্পত্তির লোভে এসটারকে বিয়ে করতে চেয়েছে৷ কৈলাশও বিপত্নীক, হরিমোহিনী বলেছেন : ‘ওর স্ত্রীর মরার পর ও তো কিছুতেই বিবাহ করিতে চায় নাই৷’ কিন্তু সম্পত্তির লোভে কৈলাশও বিয়েতে রাজি হয়েছে৷ সুচরিতা যেমন হঠাৎ জানতে পেরেছে কলকাতায় তার বাড়ি আছে এবং সে সেই বাড়িতে উঠে এসেছে, এসটারও তেমনি তার বাড়ি ও সম্পত্তির কথা আকস্মিকভাবে জানতে পেরে উঠে এসেছে তার নিজের বাড়িতে, যার ওক-কাঠের জানালা দরজা সুচরিতার বাড়ির ‘সেগুন কাঠের জানালা দরজার’ মতোই দামি৷ মিসেস ট্র্যানসাম খুবই নিঃসঙ্গ, তিনি এসটারকে দেখে বলেছেন : ‘I should like you to be really my daughter ... that is something still for an old woman to look for’ ৷ ছোটোবেলায় মা-হারানো এসটারেরও Mrs. Transome -কে দেখে মনে হয়েছে : ‘I shall seem to have a mother again’ ৷ সুচরিতার মধ্যে হরিমোহিনী তাঁর মৃতা কন্যা মনোরমাকে ফিরে পেয়েছেন, সুচরিতাও মাসির মধ্যে তার হারানো মাকে খুঁজে পেয়েছে৷ এসটার অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব পেরিয়ে তার সমস্ত সম্পত্তি ছেড়ে চলে এসেছে পাদ্রি লায়নের স্নেহের আশ্রয়ে, সুচরিতাও কৈলাশকে বিয়ে করবে না বলে দিয়ে চলে এসেছে পরেশবাবুর স্নিগ্ধ সান্নিধ্যে৷ হাজতে থাকার সময় ফিলিক্স খবর পেয়েছে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে এসটার হ্যারল্ডের সঙ্গে তার নিজের বাড়িতে উঠে গেছে ও বসবাস করছে৷ তাই সে পাদ্রি লায়নকে বলেছে : ‘Then she will marry Transome’৷ বলেছে বটে, কিন্তু তার মন তাতে সায় দেয় নি৷ হরিমোহিনীও গোরাকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে নিয়েছে যাতে সুচরিতা মনে করে কৈলাশকেই তার বিয়ে করা উচিত এবং গোরা যেন সুচরিতার ওপর তার সব দাবি ছেড়ে দিচ্ছে৷ একথা চিঠিতে লিখলেও গোরার হূদয় সে চিঠিতে স্বাক্ষর দেয় নি৷

১০ আনন্দময়ীর মতো ফেলিক্সের মা Mrs. Holt -ও চিরকালের সবদেশের স্নেহময়ী মা৷ গোরার মায়ের মতোই Mrs. Holt ছেলের জন্যে গর্বিত, আবার তাঁর কথা শোনে না বলে ক্ষু ব্ধ৷ আনন্দময়ীর মতো ফেলিক্সের মা-ও ব্যক্তিগত ঈশ্বরে বিশ্বাসী, শাস্ত্রসম্মত আচার-অনুষ্ঠানে নয়৷ ফেলিক্সের কারাদণ্ড হবে শুনে তার মা বলেছেন : ‘If they are to transport him I should like to go to the prison’৷ আনন্দময়ী বলছেন : ‘যদি তার জেল হয়, আমি কি তার আগে তাকে একবার দেখে আসতে পারব না?’ ফেলিক্স বিয়ে করবে না বলেছে বলে মার মনে খুব দুঃখ, তাই এসটারের সঙ্গে তার সহজ মেলামেশা দেখে তাঁর ভালো লেগেছে৷ আনন্দময়ীর মধ্যেও ঠিক এইরকম একটি আনন্দ আমরা দেখতে পাই- "*‘ গোরা বলে ‘আমি বিবাহ করিব না৷’ ...এবারে গোরার দু-একটা লক্ষণ দেখিয়া তিনি মনে মনে উৎফু ল্ল হইয়াছিলেন৷’’ মায়ের মতামতের সঙ্গে ফিলিক্সের যত বিরোধই থাক, মাকে ফিলিক্স গভীরভাবে ভালোবাসে-হাজতে তার কোনো দুঃখ নেই, শুধু তার দুঃখ মৃত পাহারাওয়ালার জন্যে আর তার মায়ের জন্যে৷ গোরাও জেল থেকে মাকে লিখেছে* : ‘তোমার দুঃখই আমার দণ্ড, আমাকে আর কোন দণ্ড ম্যাজিষ্ট্রেটের দিবার সাধ্য নাই৷’ ফেলিক্স হাজতে থাকার সময় ফেলিক্সের মার কাছে এসটার এসেছে, সহানুভূ তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর কথা শুনেছে৷ সুচরিতাও তেমনি গোরা জেলে থাকার সময় এসেছে আনন্দময়ীর কাছে৷ আনন্দময়ীকে দেখে সুচরিতা যেমন গোরাকে আরও বেশি শ্রদ্ধা করতে পেরেছে, ঠিক তেমনি ফেলিক্সের মাকে দেখে ও তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়ে ফেলিক্সকে এসটার আরও ভালো করে চিনতে পেরেছে৷ আনন্দময়ীর চেহারা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ একটি বর্ণনা দিয়েছেন : ‘গোরার মা আনন্দময়ীকে দেখিলে গোরার মা বলিয়া মনে হয় না৷ তিনি ছিপছিপে পাতলা, আঁটসাট...হঠাৎ দেখিলে বোধহয় তাঁহার বয়স চল্লিশের কম৷ ...শরীরের সমস্তই বাহুল্যবর্জিত৷’ বর্ণনাটি আমাদের একটু অবাক করে৷ ছেলেপুলে না হলে মেয়েরা একটু ছিপছিপে থাকে ঠিকই, কিন্তু আনন্দময়ীর মতো সাদাসিধে, প্রায় একটি আর্কি-টাইপাল মায়ের আঁটসাট শরীরের দিকে রবীন্দ্রনাথ পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ কেন করলেন ঠিক বোঝা যায় না, কেননা আনন্দময়ীর চরিত্রের সঙ্গে এই আঁটসাট শরীর আদৌ মানানসই নয়, গল্পের জন্যেও আনন্দময়ীর ‘শরীরের সমস্তই’ কেমন তা পাঠকদের জানানোর কোনো দরকার ছিল না৷ আসলে এই চেহারা Mrs. Transome-এর যাঁর চরিত্র সম্পূর্ণভাবে আনন্দময়ীর বিপরীত : ‘Her figure was slim and finely formed, though she was between fifty and sixty ৷ ’ হ্যারল্ড তাঁকে বলেছে* : ‘You have

not got clumsy and shapeless’ ৷ Felix Holt -এর মতো এতবড়ো উপন্যাসের এতগুলো ঘটনা ও চরিত্র ‘গোরা’-র মধ্যে আনতে গিয়ে কার চেহারা যে কার মতো হয়ে যাচ্ছে এটা সবসময় খেয়াল রাখা সম্ভব হয় নি রবীন্দ্রনাথের পক্ষে৷ এসটার সম্পর্কে এলিয়টের একটি মন্তব্য অবশ্য লাবণ্যের ক্ষেত্রে বেশ মানিয়ে গেছে : ‘She was fond of netting, because it showed to advantage both her hands and her feet’ ৷ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন : ‘তাহাকে কবে একজন বলিয়াছিল বুনানির সময় তাহার কোমল আঙ্গুলগুলির খেলা ভারি সুন্দর দেখায়, সেই অবধি লোকের সাক্ষাতে বিনাপ্রয়োজনে বুনানি করা তাহার অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল৷’ ফিলিক্স যে অনাথ ছেলেটিকে তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে সেই Job -কেও রবীন্দ্রনাথ অগ্রাহ্য না করে নাপিতের ঘরে আশ্রিত মুসলমান ছেলেটির মধ্যে স্থান করে দিয়েছেন৷ ১১ আমরা এতক্ষণ জর্জ এলিয়টের Felix Holt, the Radical উপন্যাসের যে ঘটনাবলী, চরিত্র বা আনুষঙ্গিক খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করেছি সেগুলি দিয়েই ‘গোরা’ একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস হতে পারত৷ কিন্তু গোরা-বিনয় বন্ধু ত্ব ও বিনয়-ললিতার প্রেমের প্রসঙ্গ এনে রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ উপন্যাসটিকে দীর্ঘায়িত করেছেন৷ বিনয়-ললিতার উপকাহিনি উপন্যাসের মধ্যে কিছুটা বৈচিত্র্য এনেছে সন্দেহ নেই৷ বিনয় ও ললিতা দুজনেই গোরা ও সুচরিতার চাইতে অনেক স্বাভাবিক ও জীবন্ত৷ তাই তাদের প্রেম-কাহিনি উপন্যাসের মধ্যে একটা গতি পেয়েছে এবং বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে একটা বিশ্বাসযোগ্য পরিণতিতে পৌঁছেছে৷ রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত বিনয়-ললিতার উপকাহিনির অবতারণা করেছিলেন গোরাসুচরিতার প্রতিতু লনা হিসেবে৷ কিন্তু তার ফল হয়েছে উলটো৷ বিনয়-ললিতার স্বাভাবিক তারুণ্য ও তাদের প্রেমকাহিনির বিশ্বাসযোগ্য গতিময়তার পাশে গোরা-সুচরিতার প্রেম অনেকখানি আড়ষ্ট ও নিষ্প্রভ হয়ে গেছে৷ গোরা চরিত্র-সৃষ্টির মূল দুর্বলতার ফলেই এটা আরও বেশি করে চোখে পড়ে৷ মনে হয়, বিনয় যদি আর একটু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হত, তাহলে বিনয়-সুচরিতাকে নিয়েই উপন্যাসটি সম্পূর্ণতা পেতে পারত, গোরার মতো একটি বক্তৃ তাবাজ ডামি ছাড়াই৷ সেক্ষেত্রে Felix Holt থেকে এত বেশি মালমশলা তু লে আনারও দরকার হত না৷ ‘গোরা’ উপন্যাসের গোরা-বিনয় বন্ধু ত্বের সঙ্গে তু লনীয় কোনো সম্পর্ক Felix Holt -এ নেই৷ রবীন্দ্রনাথ এটি নিজের কল্পনাশক্তি দিয়ে তৈরি করেছিলেন, ‘চোখের বালি’-র মহেন্দ্র-বিহারী বা ‘নৌকাডু বি’-র যোগেন্দ্র-অক্ষরের মতো, একথা সত্যি হলেই আমাদের ভালো লাগত৷ কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের একটি ক্লাসিক বন্ধু ত্বের সঙ্গে

গোরা-বিনয়ের বন্ধু ত্বের এত আশ্চর্য মিল যে সেটি রবীন্দ্রনাথের মতোই আমাদের পক্ষেও ভু লে থাকা বেশ কঠিন৷ একাধিক বিদেশি গল্প থেকে প্লট সংগ্রহ করার সম্ভাবনার কথা রবীন্দ্রনাথ ভাবতেন তার প্রমাণ আমরা পাই শুধু ‘দর্পহরণ’ গল্পের নায়কের কথায় নয়, রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘ক্ষু ধিত পাষাণ ’ -এ, বা ‘সম্পত্তি সমর্পণ’-এ, এমনকি ‘নিশীথে’ -ও৷ আমরা যে বিদেশি উপন্যাসটির কথা বলছি সেটি ‘Fathers and Sons’ , লেখক টু র্গেনিয়েফ৷ রবীন্দ্রনাথের ‘পয়লা নম্বর’ গল্পের নায়ক যাঁর লেখা পড়েছে, এবং যাঁর লেখা গল্প রবীন্দ্রনাথ দিনেন্দ্রনাথ ঠাকু রকে দিয়ে অনুবাদ করিয়েছেন৷ ‘Fathers and Sons’ উপন্যাসের অনুবাদ পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই প্রকাশিত হয়েছে৷ এই উপন্যাসের Bazarov - Arkady -র বন্ধু ত্বের কথা আমরা অনেকেই জানি, যাঁরা পড়েন নি তাঁদের সুবিধের জন্যে কয়েকটি কথা বলছি৷ বাজারফ বিদ্রোহী, নিহিলিস্ট আর্কেডি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ৷ কলেজের পড়া শেষ করে দুজনে এসেছে প্রথমে আর্কেডির বাড়িতে, পরে বাজারফের বাড়িতে৷ দুই বন্ধু এক আত্মা, একসঙ্গে খায়, একসঙ্গে শোয়, আর অনবরত তর্ক করে, যদিও সে-তর্কে বাজারফ প্রায়ই জেতে৷ বাজারফ প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সব কিছু পুরোনো সংস্কারকে সে ভেঙে ফেলতে চায়, রোম্যাণ্টিক প্রেমের ধার ধারে না : ‘Love in the ideal, or romantic sense he called lunacy, unpardonable imbecilty’ ৷ আর্কেডি শান্তশিষ্ট, ভালোমানুষ, একটু ছেলেমানুষও৷ বাজারফকে সে গুরুর মতো দেখে, নেতা বলে মানে, তার ওপর বাজারফ কর্তৃত্ব করে৷ বাজারফের মা ছেলেকে খুব ভালোবাসেন, একটু ভয়ও পান৷ ছেলের বন্ধু আর্কেডিকে ভালো ভালো খাবার রেঁধে খাইয়ে তাঁর দারুণ তৃ প্তি, আনন্দময়ীর মতোই৷ আর্কেডিরও খুব ভালো লাগে তার বন্ধু র মাকে৷ একই বাড়িতে দুটি বোনকে দুই বন্ধু ভালোবাসে, বাজারফ অ্যানাকে (Anna) , আর্কেডি কাটিয়াকে (Katya) ৷ কাটিয়া, ললিতার মতোই, বাজারফের কাছে তার ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেওয়ার জন্যে আর্কেডিকে বিদ্রূপ করে৷ কাটিয়াকে ভালোবাসার পর থেকে আর্কেডি আস্তে আস্তে বাজারফের কর্তৃত্বের আওতা থেকে বেরিয়ে আসে এবং শেষ পর্যন্ত সে বাজারফের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে ও কাটিয়াকে বিয়ে করে৷ আমরা খুবই সংক্ষিপ্ত করে ব্যাপারটি বললাম, তবু বোঝা যায় যে বাজারফ-আর্কেডির বন্ধু ত্বের মূল সম্পর্ক ও ঘটনার অনুপুঙ্খ গোরা-বিনয়ের সম্পর্কের মধ্যে অনুসরণ করা হয়েছে, যদিও টু র্গেনিয়েফের উপন্যাসে বাজারফের সঙ্গে অ্যানার বিয়ে হবে না, বাজারফ মারা যাবে৷ তাতে কিছু অসুবিধে হয় নি গোরার ক্ষেত্রে, কেননা তার বিয়ের ব্যাপারটি এসেছে Felix Holt থেকে৷ প্রিয়রঞ্জন সেন Felix Holt প্রসঙ্গে মন্তব্য করার সঙ্গে আরও একটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছিলেন : ‘Turgenev's Fathers and Children [ sic ] , however,

shows interesting parallels both to the two friends Gora and Binoy, as well as to Sandip who runs very close to Bazarov, the nihilist’৷ প্রিয়রঞ্জন সেনের পর আর কোনো বাঙালি ‘Fathers and Sons’ পড়েন নি একথা নিশ্চয় সত্যি নয়৷ আসলে পড়েছেন হয়তো অনেকেই কিন্তু ‘গোরা’ পড়ার সময় আমাদের সে-কথা মনে থাকে না, যেমন মনে থাকে না ‘নিশীথে’ গল্পটি পড়ার সময় এডগার অ্যালান পো-র শ্রেষ্ঠ গল্প ‘Ligeia’-র কথা৷ মনে না পড়াই স্বাভাবিক৷ পাঠকের সঙ্গে লেখকের একটা অলিখিত চু ক্তি থাকে যার ওপর বিশ্বাস রেখেই আমরা ধরে নিই যে লেখক পাঠকের সঙ্গে ছলনা করছেন না, নিজের কল্পনা, অভিজ্ঞতা বা সৃজনশক্তি দিয়েই তিনি গল্প বা উপন্যাস লিখছেন৷ এ বিশ্বাস যেমন পাঠকের থাকে, তেমনি সব বড়ো লেখকই সে-বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেন৷ রবীন্দ্রনাথ যে সবসময় সে-বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেন না একথা মনে রাখতে আমরা অভ্যস্ত নই বা মনে রাখা আমাদের পক্ষে খুব স্বস্তিকরও নয়৷ ধরা যাক, আরেকটি গল্পের কথা৷ শান্তশিষ্ট, নিরীহ, ধর্মভীরু এক ভদ্রলোকের স্ত্রী গ্রাম্য, অশিক্ষিত, কিন্তু তাঁর আধুনিক, ফ্যাশনদুরস্ত হওয়ার খুব শখ৷ তাঁর সিল্কের পোশাক একটু বেশি খসখসে৷ তাঁর মেয়েদের মধ্যে একটি একটু চঞ্চল, খোলামেলা, কিন্তু তেজি আর একজন শান্ত, নরম স্বভাবের, লাজুক, দেখতে ভালো৷ ভদ্রলোকের আরও কয়েকটি সন্তান আছে, তার মধ্যে একজন একটু বড়ো, একটু লেখাপড়াও শিখেছে বলে বাড়িতে কেউ এলে, বিশেষত তার বোনেদের কারও প্রেমিকের সঙ্গে, সে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলে আর অদ্ভু ত অদ্ভু ত সব প্রশ্ন করে তাদের জব্দ করার চেষ্টা করে৷ ভদ্রলোকের স্ত্রী তাঁর মেয়েদের রূপগুণ, শিক্ষাদীক্ষা, গানবাজনার প্রশংসা করার সুযোগ পেলে কখনই ছাড়েন না৷ নিজেও খুব সাজগোজ করেন, চু লে পমেটম, গালে রংটংও মাখেন মেয়েদের সঙ্গে৷ বাড়িতে কোনো যুবক এলে মেয়েদের গান শোনাতে বলেন-ড্রাইডেনের একটি বিখ্যাত গান৷ ভদ্রলোকের পছন্দের নাম যথেষ্ট রোম্যান্টিক নয় বলে তিনি মেয়েদের অন্য নাম দেন৷ পাঠকদের মনে হতে পারে আমরা পরেশবাবুর স্ত্রী বরদাসুন্দরীর কথা বলছি যিনি সারাজীবন গ্রাম্য থেকে হঠাৎ আধুনিকা হবার জন্যে ব্যস্ত হয়েছেন, যাঁর সিল্কের শাড়ি বেশি খসখস শব্দ করে এবং ললিতা-সুচরিতা, সতীশের অদ্ভু ত অদ্ভু ত প্রশ্ন করে বিনয়কে জব্দ করা, মেয়েদের গুণপনাপ্রচারে বরদাসুন্দরীর অক্লান্ত উৎসাহ, মেলার নাটকে ড্রাইডেনের কবিতা আবৃত্তি, রাধারানী নাম পালটে সুচরিতা নাম রাখা-এই সবের কথা বলছি বোধ হয়৷ আসলে তা নয়৷ ভদ্রলোকের নাম Dr. Primrose, ভদ্রমহিলার নাম Mrs. Primrose, মেয়েদুটি Olivia ও Sophia, ছেলেটির নাম Moses ৷ উপন্যাসটি দীর্ঘদিন কলকাতা ঠ্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবশ্যিক পাঠ্যসূচিতে ছিল বলে অজস্র বাঙালিকে উপন্যাসটি পড়তে হয়েছে৷ কিন্তু ‘গোরা’ পড়ার সময় আর আমাদের মনে থাকে না যে উপন্যাসটির নাম ‘The Vicar of Wakefield’ , লেখক অলিভার গোল্ডস্মিথ, যে বই থেকে ছোটোবেলায় অনুবাদ করার কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘জীবনস্মৃতি’-তে৷ ‘স্বাভাবিক হবার শক্তি পরিণত বয়সের, সে বয়সে ভু লচু ক থাকতে পারে নানা রকমের, কিন্তু অক্ষম অনুকরণের দ্বারা নিজেকে পরের মুখোসে হাস্যকর করে তোলা তার ধর্ম নয়-অন্তত আমি তাই অনুভব করি’, এই কথাগুলি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ১৯৪০ সালে ‘অচলিত সংগ্রহ’ বইয়ের ভূ মিকায়৷ পরিণত বয়সের ধর্ম-সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অনুভবের আন্তরিকতা বিচার করার সময় আমাদের মনে রাখা দরকার যে ‘গোরা’ লেখার সময় তাঁর বয়স ছিল সাতচল্লিশ৷ ১২ বাংলাসাহিত্যের অসামান্য মহাকাব্যিক উপন্যাস ও রবীন্দ্রনাথের ঔপন্যাসিক প্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ‘গোরা’ রচনার নেপথ্য ইতিহাস এতক্ষণ আমরা আলোচনা করেছি৷ ‘গোরা’ উপন্যাসের শুধু মূল প্রেমকাহিনি নয়, প্রায় সব উপকাহিনি, প্রায় সবকটি চরিত্র, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, ছোটোখাটো ঘটনা, বর্ণনা, এমনকি কোনো কোনো চরিত্রের শারীরিক বৈশিষ্ট্য বা সংলাপ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ আহরণ করেছেন জর্জ এলিয়টের প্রায়-অপঠিত Felix Holt, the Radical উপন্যাস থেকে আর পৃথিবীর দুটি অতি-পঠিত উপন্যাস Fathers and Sons এবং The Vicar of Wakefield থেকে৷ সারা দেশ জুড়ে রাজনৈতিক আলোড়ন ও পুলিশি তাণ্ডব, গীতাঞ্জলির গান ও অজস্র প্রবন্ধ লেখা, ‘শান্তিনিকেতন’ উপদেশমালা রচনা, অর্শের জন্যে শারীরিক কষ্ট, কন্যা মীরার অসুস্থতা, বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদার, জামাতা সত্যেন্দ্রনাথ, পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু-এই সবের মধ্যেও যে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিন্তে বত্রিশ মাস ধরে নিয়মিতভাবে ‘গোরা’ উপন্যাসের মাসিক কিস্তি ‘প্রবাসী’ অফিসে পাঠাতে পেরেছিলেন, তার একটা বড়ো কারণ এই যে উপন্যাসের কোনো কিছুর জন্যেই তাঁকে তাঁর নিজস্ব কল্পনা বা চিন্তার ওপর বিশেষ নির্ভর করতে হয় নি৷ এক পা ইউরোপে ও আরেক পা ভারতে রেখে গোরা কলোসাসের মতো দাঁড়িয়ে আছে-বুদ্ধদেব বসুর এই ধারণা যে কতোটা সত্যি বুদ্ধদেব নিজেও সম্ভবত তা জানতেন না৷ প্রভাতকু মার বলেছেন, ‘বারবার পাঠ করিলেও ‘গোরা’ যেন পুরাতন হয় না৷’ একটু খেয়াল করলে প্রভাতকু মার নিশ্চয় বুঝতে পারতেন ব্যাপারটি ঠিক উলটো, অর্থাৎ ‘গোরা’ মাত্র একবার পড়লেই যথেষ্ট পুরোনো মনে হয়৷ কারণ এর মধ্যে এমন জিনিস খুব কমই আছে, যা ‘গোরা’ রচনার অনেক আগেই লেখা হয়ে যায় খনি, এবং আর একটু ভালো ঠে

ষ্ঠ

করে লেখা হয়ে ওঠে নি৷ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার পাবার মাত্র চার পাঁচ বছর আগে ‘গোরা’ লেখার সময় উপন্যাস রচনার যে-পদ্ধতি রবীন্দ্রনাথ অনুসরণ করলেন, সমস্ত নোবেল পুরস্কারবিজয়ী সাহিত্যিকদের রচনার ক্ষেত্রে সেটি একটি সর্বকালের আন্তর্জাতিক রেকর্ড হয়ে রইল৷ আর একটি রেকর্ডের কথাও এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা দরকার : ‘বিদেশের উপাদান নিয়ে আমি কখনও কিছু লিখি নি৷ বাইরের থেকে মালমশলা ধার করে নিয়ে লেখা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব৷’ হেমন্তবালা দেবীকে লেখা একটি চিঠিতে (২৪ ডিসেম্বর, ১৯৩১) এই আশ্চর্য কথাগুলি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র৷ ১৩ সৎ-সাহিত্যের মূল শর্তই ‘গোরা’ পালন করে না বলে এ উপন্যাসের সাহিত্যমূল্য সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা যথেষ্ট অস্বস্তিজনক৷ তবু এ উপন্যাসের পরিণতি সম্পর্কে দু-একটি কথা বলা দরকার যেহেতু গোরার বক্তৃ তাগুলির মতো এ অংশটু কু রবীন্দ্রনাথের নিজের৷ মানুষের পরিচয় তার ধর্মে বা সম্প্রদায়ে নেই, আছে তার মনুষ্যত্বে-এই হিউম্যানিজম অনেকে খুঁজে পেয়েছেন ‘গোরা’-র পরিণতিতে৷ প্রভাতকু মার লিখছেন : ‘রবীন্দ্রনাথ গোরা, সুচরিতা ও পরেশবাবুকে যেখানে বাহির করিয়া আনিলেন তাহা মানুষের ধর্মের উদার ক্ষেত্র-যেখানে তাহারা হিন্দুও নহে, ব্রাহ্মও নহে, খ্রিস্টানও নহে, তাহারা মানুষ৷’ অরবিন্দ পোদ্দার বলছেন : ‘অনুভব-উপলব্ধি-কল্পনার যে মনোহারিত্ব গোরার স্বপ্নে বিধৃত তার আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য, কেননা, তা মানবিক মূল্যবোধ এবং মানবগোষ্ঠীর অবিভাজ্যতার চেতনা দিয়ে নির্মিত’৷ প্রভাতকু মার ও অরবিন্দ পোদ্দার আমার চাইতে অনেক ভালো করে রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়েছেন৷ তাই তাঁদের মন্তব্যের বিরোধিতা না করেই বলছি, আমি ‘গোরা’ উপন্যাসের পরিণতিতে এই মনুষ্যত্বের জয়ের কথা খুঁজে পাই নি৷ Felix Holt উপন্যাসে ফিলিক্সের সংস্পর্শে এসে এসটারের যে মানসিক পরিবর্তন, শৌখিন বিলাসী জীবনের আকর্ষণ থেকে আস্তে আস্তে মুক্ত হয়ে সহজসাধারণ জীবনযাপনের মাধুর্য উপলব্ধি করা, আকস্মিকভাবে ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েও শুধু ফেলিক্সকে ভালোবাসার জন্যে সবকিছু ছেড়ে চলে আসা-হঠাৎ উত্তেজনার মুহূর্তে নয়, স্থির বিশ্বাস নিয়ে-এই সুস্থ জীবনমুখী প্রেমের জয় গোরা-সুচরিতার মিলনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি৷ গোরা সুচরিতার কাছে আসতে পেরেছে সে ব্রাত্য, পরিত্যক্ত, পরাজিত বলে৷ বিজয়ীর মতো তার হূদয়ের দাবির জোর নিয়ে সে সুচরিতাকে গ্রহণ করতে আসে নি৷ গোরা-সুচরিতার মিলন তাই মনুষ্যত্বের জয় নয়, আকস্মিকতার জয়, শুধুমাত্র গোরার জন্মের দুর্ঘটনার জন্যেই যেন তারা মিলিত হতে পেরেছে৷ নীহাররঞ্জন রায়ও এই আকস্মিকতার দিকটি লক্ষ করেছেন৷ কিন্তু গোরার সাহেব-জন্মসূত্রের মধ্যে যে সূক্ষ্ম একটি catch বা দুষ্টু মি আছে, সেটি

অনেকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে৷ গোরার মা যদি মেম না হয়ে কোনো মুসলমান মহিলা হতেন তাহলে কি ধর্মসমন্বয়ী, বিশ্বমানবতার পূজারি পরেশবাবু বা সুচরিতা গোরাকে তত সহজে গ্রহণযোগ্য মনে করতেন যেভাবে তাঁরা তা করেছেন শুধু গোরা শাসকজাতির বংশধর বা সাহেব বলেই? মুসলমান ছেলেকে বাড়িতে রেখেছে জেনেও নাপিতের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করা, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে গ্রাম-পরিক্রমা, জেলখাটার অভিজ্ঞতা, সুচরিতাকে ভালোবাসা-এসব কোনো কিছুই গোরার উন্মাদ শুচিবায়ুগ্রস্ত সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আনতে পারে খনি, বিশ্বমানবতার বোধও জাগাতে পারে নি৷ যে মুহূর্তে গোরা জানল সে সাহেব-সেই মুহূর্তে অনায়াসে সে সর্বধর্মসমন্বয়ী বিশ্বমানবতায় দীক্ষিত হয়ে পুরো ভারতবর্ষকে দেখতে পেয়ে গেল আনন্দময়ীর মধ্যে, যেহেতু তিনি গোরাকে সাহেব জেনেও ঘৃণা করেন নি৷ সাহেব না হয়ে গোরা যদি কৃ ষ্ণদয়াল-আনন্দময়ীর নিজস্ব হিন্দু সন্তান হত, তাহলে কু সংস্কারাচ্ছন্ন গোরা শাস্ত্রমতে প্রায়শ্চিত্ত করে ব্রাহ্ম সুচরিতাকে প্রত্যাখ্যান করে তার হিন্দুসত্তা বজায় রাখত-এই অস্বস্তিকর সম্ভাবনা ও সংকীর্ণ ধর্মীয় গোঁড়ামির ইঙ্গিতের মধ্যেই ‘গোরা’ উপন্যাস শেষ হয়েছে৷ ‘গোরা’ উপন্যাসের তত্ত্ব তাই ধর্মসমন্বয় নয়, জাতিসমন্বয়, তা-ও সব জাতি নয়, দুটি জাতি-ভারতবাসী ও সাহেবজাতি৷ গোরাকে ইংরেজ করলে এই গূঢ় তত্ত্বটি অস্বস্তিকরভাবে স্পষ্ট হয়ে যেত বলেই গোরাকে আইরিশ বানাতে হয়েছে, আইরিশরা খুব দেশপ্রেমিক বলে নয়, নিবেদিতার কথা ভেবেও নয়, গল্পের প্রয়োজনে তো নয়ই৷ ‘গোরা’ উপন্যাসের বিশ্বমানবতা তত্ত্বের আসল ফাঁক বা ফাঁকি এখানেই৷ এই ফাঁকি বা ছলনার তাৎপর্য উপন্যাসটির কাহিনিগত পরাশ্রয়িতার চাইতে অনেক বেশি গভীর ও অর্থবহ৷ ১৪ নেপাল মজুমদার ‘গোরা’ উপন্যাসকে রবীন্দ্রনাথের আত্মকাহিনি বলেছেন৷ ‘গোরা’ রবীন্দ্রনাথের শুধু আত্মকাহিনি নয়, আত্মসমর্থন ও আত্মসমর্পণের কাহিনি যার শুরু হয়েছে ‘গোরা’ লেখার অনেক আগেই ‘নৈবেদ্য’ লেখার সময়ে এবং তারপরে স্বদেশি আন্দোলন থেকে সরে আসার পর থেকে লেখা বিভিন্ন কবিতায়, প্রবন্ধে এবং ‘গোরা’ লেখার সময় রচিত ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকের হরিবোলের মধ্যে৷ ‘গোরা’ উপন্যাসের জাতিসমন্বয় তত্ত্বের চরিত্র ঠিকমতো বুঝতে হলে তাই আমাদের একটু পিছিয়ে যাওয়া দরকার৷ শাসক সাহেবদের সঙ্গে শাসিত ও শোষিত ভারতবাসীর সমঝোতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে একটি মহাজাতি গড়ে তোলার ভাবনা ‘গোরা’ উপন্যাসের চাইতে বেশ কিছু প্রাচীন, এমনকি রবীন্দ্রনাথের চাইতেও৷ রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় এই ধারণাটি কখন কীভাবে আসছে সেটা একটু ভালো করে সন তারিখ ধরে লক্ষ করলে বোঝা যাবে সাহেব-

ভারতবাসী মিলনের তত্ত্ব সমকালীন ঘটনাবলী ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার ধারাবাহিকতার সঙ্গে যুক্ত, কোনো বিচ্ছিন্ন, তাৎক্ষণিক মানসিকতার প্রতিফলন নয়৷ এই তত্ত্বটির প্রথম প্রবক্তা একজন রাজা ও তাঁর সমর্থক এক রাজকু মার-রাজা রামমোহন রায় ও প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকু র, যে দুজনের ব্যক্তিগত জমিদারি ও ব্যবসায়িক স্বার্থ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে৷ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকু র জমিদার ও রামমোহনের ভক্ত হয়েও ইংরেজিয়ানা সহ্য করতে পারতেন না একেবারেই৷ শুধু তাঁর মেজোছেলে সত্যেন্দ্রনাথকে বিলেতে পাঠিয়ে আই সি এস করে এনেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথকেও ওই একই পরীক্ষা দেবার জন্যে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে হিন্দুমেলার স্বদেশি পরিবেশে, জাতীয় চেতনার উন্মেষপর্বে৷ চোদ্দো বছর বয়সে লেখা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ ও দুবছর পরে লেখা ‘দিল্লীর দরবার’ (১৮৭৭) সম্পর্কিত কবিতায় কিশোর কবির দেশাত্মবোধের পরিচয় রয়েছে৷ ১৮৮১ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত-‘দয়ালু মাংসাশী’, ‘জুতাব্যবস্থা’, ‘চীনে মরণের ব্যবসায়’ ইত্যাদি প্রবন্ধে ব্রিটিশ শাসকদের ঔদ্ধত্য, নির্মমতা ও সাম্রাজ্যবাদী লোলুপতা সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ৷ তারই সঙ্গে তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের জনসংযোগহীন বক্তৃ তাবাজিকেও বিদ্রূপ করেছেন ‘জিহ্বা-আস্ফালন’ বা ‘ন্যাশনাল ফণ্ড’ প্রবন্ধে৷ এই প্রবন্ধ দুটিতে অবশ্য নতু ন একটা সুর লক্ষ করা যাচ্ছে-রবীন্দ্রনাথ ‘political agitation’ পছন্দ করছেন না, তাঁর মতে ওটা ভিক্ষাবৃত্তি৷ যা করণীয় তা হল আত্মনির্ভর হওয়া৷ রাজনীতির মধ্যে না গিয়ে, শাসকদের বিব্রত না করে নীরবে গ্রামে কাজ করার যে তত্ত্ব রবীন্দ্রনাথ কয়েকবছর পরে অক্লান্ত অধ্যবসায় নিয়ে প্রচার করা শুরু করবেন তার আগমনী সুর বেজেছে এইসব প্রবন্ধে৷ ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারী’ (১৮৯১) , ‘রাজনীতির দ্বিধা’ (১৮৯৩) , ‘অপমানের প্রতিকার’ (১৮৯৪) বা বেশ কয়েকবছর পরে লেখা ‘ধর্মবোধের দৃষ্টান্ত’ (১৯০৩) প্রবন্ধেও ইংরেজ শাসকদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধ মানসিকতার কোনো নিদর্শন নেই৷ সিডিশন বিল পাস হবার আগের দিন টাউন হলে ‘কণ্ঠরোধ’ (১৮৯৮) বক্তৃ তাতেও ব্রিটিশ শাসকদের অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ক্ষোভ স্পষ্টভাষায় প্রকাশিত হয়েছে, যখন সুরেন্দ্রনাথের মতো ‘বিক্রমশীল’ ইংরেজ-ভজা কংগ্রেসি বাগ্মীরা ‘বিবর আশ্রয় করিয়া বাগরোধ অভ্যাস’ করছেন৷ রবীন্দ্রনাথের জমিদারি স্বার্থ এবং ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকা সত্ত্বেও, তাঁর এবং অন্যান্য জমিদারদের জীবিকা, অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি তাঁদের পূর্ণ আনুগত্যের ওপর নির্ভর করে একথা মনে রেখেও রবীন্দ্রনাথ যেভাবে এইসব প্রবন্ধে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, নির্মমতা ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ ধ্বনিত করেছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর৷ আরও যেটা লক্ষ

করার মতো তা হল, ইংরেজদের আপন করে ভারতীয় জীবনের সঙ্গে একাত্ম করে নেবার যে ব্যাকু ল আগ্রহ আমরা কিছুদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দেখতে পাব তার বিশেষ কোনো চিহ্ন আমরা দেখতে পাই না ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত লেখা তাঁর প্রবন্ধ বা কবিতার মধ্যে, যদিও শাসকদের সঙ্গে সংঘাতে না যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশিত হয়েছে কখনও কখনও৷ সিডিশন বিল পাস হবার পর স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর অনেক নরম হয়ে গেল৷ এই সময়ে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের চাইতে হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের প্রশ্নে অনেক বেশি আলোড়িত হয়ে পড়লেন৷ ইতিমধ্যে ১৮৯৬ সালে আমেরিকা জয় করে বিবেকানন্দ দেশে ফিরেছেন৷ কিছুটা তারই প্রতিক্রিয়ায় এবং কিছুটা দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে রবীন্দ্রনাথ শুরু করলেন ঔপনিষদিক ব্রহ্মবাদ ও প্রাচীন বর্ণাশ্রমের বাণী প্রচার বঙ্গদর্শনের বিভিন্ন প্রবন্ধে আর ‘নৈবেদ্য’-র কবিতায়, যার মধ্যে রইল আধ্যাত্মিক আত্মসমর্পণ, আর স্বদেশচেতনার সঙ্গে প্রাচীন ভারতের তপোবনভিত্তিক অধ্যাত্মচেতনার একটি অবাস্তব মিশ্রণ৷ এই সময়কার হিন্দু-সাম্প্রদায়িক, পশ্চাৎমুখী, প্রাচ্যামির পরিবেশেই রবীন্দ্রনাথের মনে ইংরেজদের আপন করে ভারতবর্ষে একটি মহাজাতি গড়ে তোলার চিন্তার জন্ম হয়৷ এই অস্বস্তিকর তত্ত্বটিকে সুখশ্রাব্য করার জন্যে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’ (১৯০১), ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ (১৯০২) ইত্যাদি প্রবন্ধের মাধ্যমে একটি ভূ মিকা রচনা করলেন যার মধ্যে বলতে চাইলেন ইউরোপের জাতীয়তাবাদ জাতি-বৈরিতামূলক, আর ভারতের জাতি-চেতনা সমন্বয়বাদী৷ তারপরেই ‘স্বদেশি সমাজ’ (১৩১১) প্রবন্ধে শুরু করলেন ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধাচরণ : ‘ইংরেজের উপর রাগারাগি করিয়া ক্ষণিক উত্তেজনা-মূলক উদ্যোগে প্রবৃত্ত হওয়া সহজ, কিন্তু সেই সহজ পথ শ্রেয়ের পথ নহে৷’ এই প্রবন্ধের মূল বক্তব্য : ইংরেজদের জব্দ করার কোনো চেষ্টা করো না, গ্রামে গিয়ে নীরবে দেশের কাজ করো, রাজনীতি করো না৷ কয়েকমাস পরেই লিখলেন ‘সফলতার সদুপায়’ (১৩১১, চৈত্র) যাতে সোজাসুজি ভারতে ইংরেজশাসনকে বিধাতার অভিপ্রেত বলে দাবি করে ব্রিটিশ শাসনের মহিমা-কীর্তন করলেন : ‘ভারতবর্ষে একচ্ছত্র ইংরেজ রাজত্বের প্রধান কল্যাণই এই যে, তাহা ভারতবর্ষের নানা জাতিকে এক করিয়া তু লিতেছে৷ ...ঐক্যহীন দেশে এক বিদেশি রাজার শাসনও সেইরূপ যোগের বন্ধন৷ বিধাতার এই মঙ্গল অভিপ্রায়ই ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনকে মহিমা অর্পণ করিয়াছে৷’ এইসব ঘটনা ঘটছে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আগেই৷ ১৩১২ সালে শ্রাবণ মাসে (৭ আগস্ট, ১৯০৫) থেকে শুরু হল বয়কট ও স্বদেশি আন্দোলন বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে৷ ভাদ্রমাসে কলকাতা এসেই রবীন্দ্রনাথ টাউনহলে ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ বক্তৃ তা দিলেন : ইংরেজদের ওপর রাগ করে স্বদেশি করা ঠিক নয়,

গ্রামে গিয়ে চাষিদের লেখাপড়া শেখাও, কৃ ষির উন্নতি করো, বিবাদবিসম্বাদ নিজেরাই মিটমাট করো-রাজার সঙ্গে কোনো গোলমাল করার দরকার নেই৷ এতেই ভারতবর্ষের অন্তর্যামী দেবতাকে প্রত্যক্ষ করা যাবে যিনি মিলন চান, বিচ্ছেদ নয়৷ তার সঙ্গে লিখতে লাগলেন স্বদেশি গান, যার মধ্যে যতটা আধা-আধ্যাত্মিক হিন্দু মাতৃ পূজার উপচার আর বিবাগী বাউলের উদাস সুর রইল, রাজদ্রোহী প্রত্যয়ের দৃঢ়তা ততটা রইল না৷ থাকা বোধহয় সম্ভব ছিল না, কারণ মাত্র দুমাস আগে লেখা ‘শেষ খেয়া’ কবিতা ইতিমধ্যেই রবীন্দ্রনাথকে ওপারের সোনার কূ লের আঁধার মায়ায় আচ্ছন্ন করেছে ও কাজ-ভাঙানো গান শুনিয়েছে৷ আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ এই তিনমাস মাত্র স্বদেশি আন্দোলনের গান বক্তৃ তা মিছিলে থেকে অগ্রহায়ণের শেষে রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন শান্তিনিকেতন৷ গিয়েই রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে চিঠি (২৬শে অগ্রহায়ণ) দিচ্ছেন : যারা গভর্নমেণ্টের বিরুদ্ধে স্পর্ধা করে আত্মশক্তি দেখাচ্ছে তিনি তাদের মধ্যে নেই৷ তিনি ঠিক করেছেন ‘অগ্নিকাণ্ডের আয়োজনে উন্মত্ত না হইয়া যতদিন আয়ু আছে, আমার এই প্রদীপটিকে জ্বালিয়া পথের ধারে বসিয়া থাকিব৷’ রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টই বুঝতে পারলেন এ অগ্নিকাণ্ড শুধু ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থকেই আঘাত করবে তা নয়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকেও ক্ষণস্থায়ী করে তু লতে পারে৷ ওই একই আশঙ্কায় অন্যান্য জমিদারেরাও বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে তাঁদের সমর্থন তু লে নিলেন ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তা করলেন না বলে ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁর জমিদারি বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দিল৷ এই ধরনের সরে দাঁড়ানো সংবেদনশীল মনে স্বাভাবিকভাবেই এক ধরনের হতাশা, অপরাধবোধ বা বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয় যা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে কেউ আশ্রয় নেয় নির্জন প্রকৃ তির কোলে, কেউ নেয় প্রাচীন ঐতিহ্যর্চ্চায় বা অধ্যাত্মবাদী দর্শনে, কেউ বা শান্তি পাবার চেষ্টা করে ভগবান বা ওই জাতীয় কোনো অবাস্তব বা অতিপ্রাকৃ ত শক্তির কাছে আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে৷ এই অবসাদ, অতীন্দ্রিয়তা, ঈশ্বরের কাছে আত্মনিবেদনসবই আমরা পাই এই সময়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে৷ কিন্তু এরই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আর একটি কাজ শুরু করেন যেটি খুব স্বাভাবিক বলা যায় না৷ সেটি হল বিভিন্ন বক্তৃ তায় ও প্রবন্ধে সুপরিকল্পিত ভাবে ব্রিটিশ-শাসক-বিরোধী আন্দোলনকে তীব্র, কর্কশ ভাষায় আক্রমণ করা, আর ঠিক তারই সঙ্গে ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য, সর্বধর্মসমন্বয়, বিশ্বমানবতা ইত্যাদি আপাতনির্দোষ আদর্শের প্রসঙ্গ তু লে ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে ভারতবাসীর জাতিসমন্বয়ের একটি তত্ত্ব খাড়া করা৷ শুধু তাই নয়, এই রাজনৈতিক আপোশের তত্ত্বকে একটা আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা দেবার জন্যে রবীন্দ্রনাথ এতদূর পর্যন্ত যাচ্ছেন যে বিশ্ববিধাতার ইচ্ছা অনুযায়ী ভারতের মঙ্গলের জন্যে, ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে প্রেমহার গাঁথার জন্যে, নিদ্রিত ভারতকে জাগাবার জন্যেই ইংরেজরা

ভারতশাসনের মহান ব্রতে নিযুক্ত৷ ভারতবাসীর উচিত ইংরেজদের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে তাদের আপন করে নেওয়া, কারণ বিশ্ববিধাতার অভিপ্রায়ই তাই৷ প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায়, নেপাল মজুমদার, অরবিন্দ পোদ্দার ও হিতেন্দ্র মিত্র রবীন্দ্রনাথের এই সময়কার মানসিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, তবু দু-চারটি উদ্ধৃ তি দেওয়া দরকার যাঁরা ওই আলোচনাগুলি ভালো করে পড়েন নি তাঁদের সুবিধের জন্যে৷ প্রভাতকু মার বলছেন : ‘বঙ্গচ্ছেদের আবর্ত মধ্য হইতে বাহির হইয়া আসিয়া রবীন্দ্রনাথের মনে সবচেয়ে বড়ো করিয়া যে কথাটি জাগিতেছিল সেটি হইতেছে সর্বমানবের মধ্যে মিলনসাধন৷’ শীতকালে এলেন প্রিন্স অব ওয়েলস, রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘রাজভক্তি’ (মাঘ, ১৩১২) প্রবন্ধ : ‘রাজপুত্র আসুন, ভারতের সিংহাসনে বসুন...তাহাতে ভারতবর্ষের মঙ্গল এবং ইংলণ্ডের স্থায়ী লাভ৷’ (১লা বৈশাখ ১৩১৩) বরিশালের প্রাদেশিক সভা পুলিশ ভেঙে দিল, রবীন্দ্রনাথ বোলপুরে ফিরে এসে ‘খেয়া’-র কবিতা লিখছেন ‘শ্রান্ত ওরে, রেখে দে জালবোনা, গুটিয়ে ফেলো সকল মন্দ ভালো’ (সমাপ্তি), ‘নামিয়ে দিয়ে এসেছি সব বোঝা, তরী আমার বেঁধে এলেম ঘাটে’ (প্রতীক্ষা), ‘পা ছড়িয়ে বোস রে হেথায় সারাদিনের শেষে, তারায়-ভরা আকাশ-তলে সব-পেয়েছির দেশে’৷ তারই মধ্যে ১৫ই বৈশাখ কলকাতায় ‘দেশনায়ক’ প্রবন্ধ পাঠ করলেন : ‘কলহ অক্ষমের উত্তেজনা প্রকাশ, তাহা অকর্মণ্যের একপ্রকার আত্মবিনোদন৷’ ‘দেশের সমস্ত উদ্যমকে বিক্ষেপের ব্যর্থতা হইতে একের দিকে ফিরাইয়া আনিবার একমাত্র উপায়’ একজনকে অধিনায়ক বলে স্বীকার করা-সে অধিনায়ক কট্টর ইংরেজ-প্রেমী সুরেন্দ্রনাথ : ‘সুরেন্দ্রনাথকে সকলে মিলিয়া প্রকাশ্যভাবে দেশনায়করূপে বরণ করিয়া লইবার জন্য আমি সমস্ত বঙ্গবাসীকে আহ্বান করিতেছি’ (‘রবীন্দ্রজীবনী’, ২য় খণ্ড)৷ আষাঢ় মাসে ‘শিক্ষা-সংস্কার’ প্রবন্ধে আবার সেই তপোবনের শিক্ষা, ব্রহ্মচর্যপালন৷ পৌষ উৎসবে শান্তিনিকেতনে ভাষণ দিচ্ছেন-শান্তম শিবমদ্বৈতম : ‘আমরা নিজেরা শান্ত হইলেই সেই শান্তস্বরূপের আবির্ভাব আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হইবে৷’ আষাঢ়ের শেষ থেকে কবিতার স্রোত প্রায় সম্পূর্ণ রুদ্ধ থাকবে দীর্ঘ তিনবছর৷ ১৩১৪ সালের আষাঢ় মাসে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের তিনশো টাকা শোধ করবার জন্যে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘মাস্টারমশায়’ গল্প৷ ভাদ্র মাসে শুরু হল ‘গোরা’, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক জীবনের সবথেকে অবসন্ন, ক্লান্ত ও রিক্ত পর্বে৷ ঠিক এক মাস আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধ : সব চঞ্চলতা ভু লে গ্রামে যাও৷ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বিরক্ত হয়ে লিখলেন : ‘স্বদেশির আগুন যখন জ্বলিয়া উঠিল, তখন রবীন্দ্রনাথের লেখনী তাহাতে বাতাস দিতে ত্রুটি করে নাই৷ ...ইংরেজরা যখন ...লগুড় তু লিয়া আমাদের গলা চাপিয়া ধরিয়াছেন তখন ...রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন-ও পথে চলিলে হইবে না-মাতামাতি-লাফালাফির কর্ম নহে, নীরবে ধীর ভাবে

কাজ করিতে হইবে’ ( ‘প্রবাসী’, ১৩১৪, আশ্বিন ) ৷ অরবিন্দের বিরুদ্ধে মামলা চলছে, ব্রহ্মবান্ধব জেলে মারা গেলেন, রবীন্দ্রনাথ ‘এইসবের সহিত এখন আর তেমনভাবে যুক্ত নহেন৷ ...বেশির ভাগ সময়ই শান্তিনিকেতনে কাটিতেছে, বিদ্যালয়ে কাজ দেখেন, ‘গোরা’ লেখেন৷ কাব্যলক্ষ্মীর সাক্ষাৎ ক্ষণে ক্ষণে পাইতেছেন বটে, তবে তাহা বিষাদে অন্ধকার৷ কতকগুলি গানের মধ্যে দুঃখকে মাথা পাতিয়া লইবার বা ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ করিবার আকু তি অত্যন্ত স্পষ্ট’ (প্রভাতকু মার, ‘রবীন্দ্রজীবনী’, ২য় খণ্ড)৷ কয়েকমাস আগেই লিখেছেন : ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’৷ চৈত্রমাসে ক্ষু দিরাম ও প্রফু ল্লর বোমায় কেনেডির স্ত্রী ও কন্যার মৃত্যু হল৷ মানিকতলা মামলায় বারীন্দ্র, অরবিন্দ, কানাই, সত্যেন্দ্র, নরেন গ্রেফতার হলেন৷ বৈশাখ (১৩১৫) মাসেই রবীন্দ্রনাথ চৈতন্য লাইব্রেরিতে পড়লেন ‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধ৷ যাতে লিখলেনঈশ্বর একটি মহৎ কর্মের ভার আমাদের ওপর দিয়েছেন ‘যার মাহাত্ম্য যেন এক মুহূর্তও বিস্মৃত না হইয়া আমরা কোনোপ্রকার চাপল্য প্রকাশ না করি৷’ তারপরেই আর্যদের বেদমন্ত্র উচচারণ, হোমাগ্নি জ্বালা, আর্য-অনার্য মিলনের উপক্রমণিকা, বুদ্ধ, যীশু এবং তারপরেই আসল কথা : ‘তাহার পরে য়ুরোপের মহাক্ষেত্রে মানবশক্তি প্রাণের প্রাবল্যে, বিজ্ঞানের কৌতূ হলে, পণ্যসংগ্রহের আকাঙ্ক্ষায় যখন বিশ্বাভিমুখী হইয়া বাহির হইল তখন তাহারও একটি বৃহৎ প্রবল ধারা ওই ভারতবর্ষে আসিয়াই বিধাতার আহ্বান বহন করিয়া আমাদিগকে আঘাতের দ্বারা জাগ্রত করিয়া তু লিতেছে৷ ...শ্বেত ও কৃ ষ্ণ, মুসলমান ও খ্রিস্টান, পূর্ব ও পশ্চিম, কেহ আমাদের বিরুদ্ধ নহে-ভারতের পুণ্যক্ষেত্রে সকল বিরোধ এক হইবার জন্য শত শত শতাব্দী ধরিয়া অতি কঠোর সাধনা করিবে বলিয়াই অতি সুদূর কালে তপোবনে’ ...ইত্যাদি৷ ‘এমন সময় আজ অকস্মাৎ ধৈর্যহীন উন্মত্ততা যজ্ঞক্ষেত্রে রক্তবৃষ্টি করিয়া তাহার বহুদিনসঞ্চিত তপস্যার ফলকে কলুষিত করিবার উপক্রম করিতেছে৷’ অতএব ‘ইংরেজশাসন নামক বাহিরের বন্ধনটাকে স্বীকার করিয়া...সেবার দ্বারা, প্রীতির দ্বারা, সমস্ত কৃ ত্রিম ব্যবধান নিরস্ত করার দ্বারা, বিচ্ছিন্ন ভারতবর্ষকে নাড়ির বন্ধনে এক করিয়া তু লিতে হইবে৷’ ‘চারিদিকের কোলাহল ও চিত্তবিক্ষেপের মধ্যে সাধনাকে মহৎ লক্ষ্যের দিকে অবিচলিত রাখিব৷ নিশ্চয় জানিব এই ভারতবর্ষে যুগযুগান্তরীয় মানবচিত্তের সমস্ত আকাঙ্ক্ষাবেগ মিলিত হইয়াছে-এইখানেই জ্ঞানের সহিত জ্ঞানের মন্থন হইবে, জাতির সহিত জাতির মিলন ঘটিবে৷ ...ভারতবর্ষে আমরা ...সেই দুঃসাধ্য সাধনা করিব যাহাতে শত্রুমিত্র ভেদ লুপ্ত হইয়া যায়৷’ এই শত্রুমিত্র ভেদ লুপ্ত করবার সাধনা তখন ‘গোরা’-তেও চলছে৷ ঠি

ঠিক দুমাস পরে লিখছেন ‘সদুপায়’ (আষাঢ়, ১৩১৫) প্রবন্ধ : ‘প্রশস্ত ধর্মের পথে চলাই নিজের শক্তির প্রতি সম্মান এবং উৎপাতের সংকীর্ণ পথ সন্ধান করাই কাপুরুষতা, তাহাই মানবের প্রকৃ ত শক্তির প্রতি অশ্রদ্ধা৷’ আগের বছর ভাদ্রমাসে যখন অরবিন্দকে ‘নমস্কার’ জানিয়েছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ বোধ হয় জানতেন না যে অরবিন্দ এই ‘কাপুরুষতা’ ও অধর্মের কাজই করছেন৷ আবার ঠিক দুমাস পরে ‘পূর্ব ও পশ্চিম’ (ভাদ্র, ১৩১৫) প্রবন্ধে লিখলেন : ‘আজ যে পশ্চিম হইতে ইংরেজ আসিয়া, ভারতেতিহাসের একটা প্রধান অংশ জুড়িয়া রাখিয়াছে, ইহা কি সম্পূর্ণ আকস্মিক, অপ্রয়োজনীয়? ...নিখিল মানবের সঙ্গে জ্ঞান প্রেম কর্মের নানা আদান-প্রদানে আমাদের অনেক প্রয়োজন আছে ইংরেজ বিধাতাপ্রণোদিত হইয়া তাহারই উদ্যাম আমাদের মধ্যে জাগাইতে আসিয়াছে৷ সফল না হওয়া পর্যন্ত সে নিশ্চিন্ত হইবে না৷ সে সফলতা পূর্ব ও পশ্চিমের মিলনে, বিরোধে নহে৷’ ‘ইংরেজের সহিত আমাদের মিলন সার্থক করিতে হইবে৷ মহা-ভারতবর্ষ গঠন ব্যাপারে এই ভার আজ আমাদের উপর পড়িয়াছে৷’ ‘ইংরেজ জগতের যজ্ঞেশ্বরের দূতের মতো জীর্ণ দ্বার ভাঙিয়া আমাদের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে৷ তাহাদের আগমন যে-পর্যন্ত না সফল হইবে, জগৎ-যজ্ঞের নিমন্ত্রণে তাহাদের সঙ্গে যে-পর্যন্ত না যাত্রা করিতে পারিব, সে পর্যন্ত তাহারা আমাদিগকে পীড়া দিবে, তাহারা আমাদিগকে আরামে নিদ্রা যাইতে দিবে না৷’ ‘যে ভারতবর্ষ অতীতে অঙ্কু রিত হইয়া ভবিষ্যতের অভিমুখে উদ্ভিন্ন হইয়া উঠিতেছে, ইংরেজ সেই ভারতের জন্য প্রেরিত হইয়া আসিয়াছে৷ সেই ভারতবর্ষ সমস্ত মানুষের ভারতবর্ষআমরা সেই ভারতবর্ষ হইতে অসময়ে ইংরেজকে দূর করিয়া দিব, আমাদের এমন কি অধিকার আছে?’ এই ভয়াবহ প্রবন্ধের ঠিক এক মাস পরে ‘দেশহিত’ (আশ্বিন, ‘বঙ্গদর্শন’, ১৩১৫) প্রবন্ধে অবিশ্বাস্য আক্রোশ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবীদের আক্রমণ করলেন : ‘কিন্তু যেখানে আমাদের স্বদেশের লোক আমাদের যজ্ঞের পবিত্র হুতাশনে পাপ-পদার্থ নিক্ষেপ করিয়া আমাদের হোমকে নষ্ট করিতেছে তাহাদিগকে আমরা কেন সমস্ত মনের সহিত ভর্ৎসনা করিবার, তিরস্কৃ ত করিবার শক্তি অনুভব করিতেছি না৷ তাহারাই কি আমাদের সকলের চেয়ে ভয়ঙ্কর শত্রু নহে৷’ পাঁচ মাস আগে ‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন শত্রুমিত্রভেদ লুপ্ত করার সাধনা করতে হবে অর্থাৎ ইংরেজরা আমাদের শত্রু একথা ভু লতে হবে৷ এখন বলছেন বিপ্লবীরা দেশের সব থেকে ভয়ঙ্কর শত্রু বলে তাদের ভর্ৎসনা করতে হবে সবাইকে৷ সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের অনেক ত্রুটি ছিল-হিন্দু-সাম্প্রদায়িক, শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, ভদ্রলোক চরিত্র, যোগ্য নেতৃ ত্ব ও পরিকল্পনার অভাব, জনসংযোগহীন বিচ্ছিন্নতা, ব্যক্তিসন্ত্রাসে বিশ্বাস ইত্যাদি৷ কিন্তু একথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা থেকে রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবীদের এইভাবে আক্রমণ করছেন, বা

বিপ্লবীদের ওই ত্রুটিগুলি না থাকলে তিনি বিপ্লবী সংগ্রামকে সমর্থন করতেন৷ আসলে তিনি দেশের সত্যিকারের শত্রু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসক ও তাদের লুঠেরাবাহিনী জমিদার- মহাজনদের আড়াল করে বিপ্লবীদের ‘ভয়ঙ্কর শত্রু’ বলে চিহ্নিত করে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন থেকেও বিপ্লবীদের বিচ্ছিন্ন করতে চাইছেন৷ প্রভাতকু মার আশ্চর্য হয়ে লিখছেন : ‘স্বদেশি যুগের দৃপ্ত রবীন্দ্রনাথের আজ কী পরিবর্তন!’ অরবিন্দ পোদ্দার বলছেন : ‘সত্য বলতে কি, এ যেন পূর্বতন স্বদেশি আদর্শের অবিশ্বাস্য কর্ণমর্দন৷ ...মনে হয় স্বদেশি আন্দোলন থেকে সরে-দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে যেন প্রতিহিংসার উন্মাদনা৷’ মনে রাখা দরকার, ঠিক এই সময় রবীন্দ্রনাথ ‘গীতাঞ্জলি’-র গান লিখছেন, মাসখানেক আগে লিখেছেন ‘আমার মিলন লাগি তু মি আসছ কবে থেকে’ গানটি৷ ‘গোরা’ লেখাও চলছে৷ অর্থাৎ শোষক ইংরেজদের সঙ্গে শোষিত ভারতবাসীর মিলন ঘটাবার আকাঙ্ক্ষা রবীন্দ্রনাথের যত তীব্র হচ্ছে, তত তীব্র হচ্ছে তাঁর ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনাকাঙ্ক্ষা, ঠিক ততখানিই তীব্র হচ্ছে বিপ্লবীদের সম্পর্কে তাঁর ক্রোধ, আবার ততখানি নিবিষ্ট মনেই রবীন্দ্রনাথ Felix Holt পড়ছেন ‘গোরা’ লেখার জন্যে, যার মূল বক্তব্য হবে জাতিসমন্বয়৷ এই আশ্চর্য ঘটনাগুলি আদৌ পরস্পরবিরোধী নয়, ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত৷ প্রবন্ধে ও বক্তৃ তায় ইংরেজ শাসকদের কাছে আত্মসমর্পণ, ‘খেয়া’-‘গীতাঞ্জলি’র গানে আধ্যাত্মিক প্রভু বা রাজার কাছে আত্ম-নিবেদন, এবং ‘গোরা’ উপন্যাসে জর্জ এলিয়টের কাছে আত্মবিসর্জন, রবীন্দ্রনাথের সেই সময়কার মানসিক দৈন্য, অবসাদ, হতাশা, অবক্ষয় ও আত্ম-অবমাননারই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ মাত্র, যে আত্ম-অবমাননা আত্ম-প্রবঞ্চনার রূপ নিয়েছিল তাঁর আপাতমহান, কিন্তু আসলে বিপ্লববিরোধী, নিরালম্ব, বিমূর্ত বিশ্বজাতীয়তা তত্ত্বের মধ্যে৷ এই প্রসঙ্গে অরবিন্দ পোদ্দারের একটি মূল্যবান মন্তব্য মনে রাখার মতো : ‘যে জাতি...বিদেশি শাসনের শোষণ-অত্যাচারে জর্জরিত, তার নিকট বিশ্বজাতীয়তার আদর্শ একটি আত্মপ্রবঞ্চনাময় সম্মোহমাত্র৷ জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের আত্যন্তিকতার প্রশ্ন কাটিয়ে উপস্থিত লক্ষ্য হিসেবে বিশ্বজাতীয়তার আদর্শ অনুসরণ করা ভারতবর্ষের ক্ষতবিক্ষত দেহের প্রতি দৃষ্টিপাত না করা ও অলীক এক ভূ মানন্দে আবিষ্ট হওয়ার নামান্তর৷’ ১৩১৫ সালের গোড়ার দিকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটক যেটি প্রভাতকু মার মনে করেন ‘‘সমসাময়িক রাজনীতি ও দেশের জনমতের বিরুদ্ধে যেন রচিত৷ দেশ তখন কবির আরেকদিনের কথাই মনে মনে আবৃত্তি করিতেছিল, ‘অত্যাচারের বক্ষে পড়ি, হানিতে তীক্ষ্ণ ছুরি৷’ কিন্তু কবির কাছে আজ তাহারা শুনিতেছে ‘বাঁচান বাঁচি মারেন মরি, বলো ভাই ধন্য হরি৷’’ রবীন্দ্রনাথের জীবনে আত্মসমর্পণ প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এসেছে, যার স্পষ্ট সুর শোনা যাবে কয়েকমাস পরে লেখা ‘শান্তিনিকেতন উপদেশ-মালা’র মধ্যে : ‘আমাদের জীবনের বুনিয়াদ শান্তমের মধ্যে, তাহার ব্যাপ্তি শিবম-এ, ও তাহার

পরিণতি অদ্বৈতম-এ৷’ এইসব মহামূল্য উপদেশ চলবে বৈশাখ (১৩১৬) পর্যন্ত৷ তার সঙ্গে চলবে Felix Holt পড়া ও ‘গোরা’ লেখা৷ আষাঢ়ে কয়েকটি ‘গীতাঞ্জলি’-র গান, শ্রাবণ কাটবে বোটে শিলাইদহে, ‘গোরা’ লেখা শেষ করবেনই৷ ‘গোরা’ লেখা শেষ হল শ্রাবণেই (১৩১৬)৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মিলনযজ্ঞের হুতাশন জ্বলতে লাগল৷ আসন্ন রাখিবন্ধন উপলক্ষে অজিতকু মার চক্রবর্তীকে চিঠিতে (২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯০৯) লিখলেন : ‘বর্তমান ভারতবর্ষে যাদের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থের প্রতিকূ লতা আছে এ রাখি তাদের কাছ থেকেও নিরস্ত হবে না৷ ...পূর্ব-পশ্চিম, রাজা-প্রজা সকলকেই ভারতবর্ষ সকল প্রকার বিরুদ্ধতার ভিতরেও একক্ষেত্রে আকর্ষণ করার জন্য চিরদিন চেষ্টা করছে-এই তার ধর্ম, এই তার কাজ...৷’ তারই সঙ্গে সাবধান করে দিচ্ছেন যাতে কোনো বিপ্লবী উত্তেজনা আশ্রমের শান্তি নষ্ট না করে : ‘আমি বার বার করে তোমাদের সতর্ক করতে চাই...আমাদের আশ্রমে বেসুর না বাজে৷’ পৌষমাসে YMCA হলে ‘তপোবন’ প্রবন্ধে আবার ভারতের প্রাচীন উদার তপস্যা, পৌষ-মাঘ মাসের আরও তিনটি প্রবন্ধ ‘ভক্ত’, ‘আশ্রম’, ‘বিশ্ববোধ’-এ সেই একই মহামিলনবাণী : বাইরে থেকে যেসব জাতি ভারতে এসেছে তাদের সঙ্গে মিলন যতদিন না হবে ‘বিধাতা একদিনের জন্যও আমাদের আরামে বিশ্রাম করতে দেবেন না৷’ পরের বছর আষাঢ় মাসে (১৩১৭) লিখলেন ‘ভারততীর্থ’ কবিতা৷ গত সাত-আট বছর ধরে যে ভারতীয় তপস্যা আর বিশ্বমানবযজ্ঞের কথা বলে আসছিলেন বিভিন্ন প্রবন্ধে বা বক্তৃ তায় সেই একই কথা আবার বললেন এই পদ্যটিতে-সেই আর্য-অনার্য, শক-হুন, পাঠান-মোগল, তারপরেই ‘পশ্চিম’, মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে, মহাওঙ্কার, যজ্ঞশালা, তপস্যা৷ আবার আর্য-অনার্য, হিন্দু-মুসলমান, এবং তারপরেই সেই মহা-আহ্বানমন্ত্র : ‘এসো এসো আজ তু মি ইংরাজ’, যারা না এলে ভারতমাতৃ কার অভিষেক সম্পূর্ণ হবে না৷ এই অবিরাম ও অক্লান্ত ইংরেজ-প্রশ্রস্তি ও তার সঙ্গে বিপ্লবীদের ‘ভয়ঙ্কর শত্রু’ বলে চিহ্নিত করা লক্ষ করে ইংরেজ শাসকেরা খুব সঙ্গতভাবেই ১৯১১ সালে, অর্থাৎ ‘ভারততীর্থ’ লেখার বছরখানেক পরেই, পঞ্চম জর্জের আগমন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথকে একটি রাজপ্রশস্তিমূলক গান রচনা করার অনুরোধ করে৷ রবীন্দ্রনাথ এতে কেন বিস্মিত হয়েছিলেন বোঝা যায় না৷ দশ বছর ধরে যদি প্রবন্ধে ও বক্তৃ তায় অবিশ্রান্তভাবে বলা যায় ইংরেজ শাসকেরা ভারতের অন্তর্যামী দেবতার দূত, বিধাতৃ -প্রেরিত হয়ে ভারতের মঙ্গল বিধানের জন্যে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য আনার জন্যে ইংরেজরা ভারত শাসন করছে, আমাদের তারা আর নিদ্রিত থাকতে দেবে না, সব বিচ্ছেদচিন্তা ভু লে তাদের সঙ্গে প্রীতির বন্ধনে মিলিত না হতে পারলে ভারতের যুগ-যুগান্তরের সব সাধনা একেবারে পণ্ড হয়ে যাবে, তখন ওই কথাগুলিই কেউ গানের মধ্যে লিখে দেবার জন্যে রবীন্দ্রনাথকে ঠি

অনুরোধ করলে, বা রবীন্দ্রনাথ সে অনুরোধ রাখলে আপত্তির কী আছে ঠিক বোঝা যায় না৷ গানের মধ্যে ‘প্রেমহার হয় গাঁথা’, ‘নিদ্রিত ভারত জাগে’ ইত্যাদি কথাগুলি পড়া বা শোনার সময় কার করুণারুণরাগে হঠাৎ এইসব আশ্চর্য ঘটনা আমাদের দেশে ঘটছে, বা ‘দারুণ বিপ্লব মাঝে’ ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথের দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে পীড়িত মুর্চ্ছিত দেশে কে সেই অভয়শঙ্খবাদনরত সংকট-দুঃখত্রাতা, জনগণপথপরিচায়ক, জনগণমঙ্গলদায়ক, জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক রাজেশ্বর, এটা বুঝতে আমাদের কেন অসুবিধে হবে, বা প্রবন্ধে ওই একই কথাগুলি পড়ে যদি আগে কষ্ট না পেয়ে থাকি, তাহলে গানে ওগুলি শুনলে কেন আমরা কষ্ট পাব, আমি ঠিক বুঝতে পারি না৷ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বা কাকে উদ্দেশ্য করে রবীন্দ্রনাথ বা অন্য যে-কোনো কবি একটি কবিতা লিখেছেন এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবার ক্ষেত্রে কবির নিজের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করার বিপদ সম্পর্কে আমাদের সাবধান করে গেছেন আর একজন নোবেলপুরস্কার-পাওয়া বিশ্বকবি : ‘The testimony of poets as to what they thought they were doing when they wrote a poem, cannot be taken altogether at its face value’ (T. S. Eliot, ‘Three Voices of Poetry , ’ 1957) ৷ শ্বেত ও কৃ ষ্ণ, পূর্ব ও পশ্চিম, শাসক ও শাসিতের মধ্যে মিলন ঘটাবার যে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে ‘পথ ও পাথেয়’ ও অন্যান্য অজস্র প্রবন্ধে, সেই আকাঙ্ক্ষাই উচচারিত হয়েছে ‘গোরা’ উপন্যাসে, সেই ব্যাকু ল আহ্বানই জানানো হয়েছে ‘ভারততীর্থ’ কবিতার ‘এসো এসো আজ তু মি ইংরাজ’এর মধ্যে, সেই মিলনবাণীই ধ্বনিত হয়েছে ‘জনগণমন-অধিনায়ক’-এর ‘পূরব পশ্চিম আসে, তব সিংহাসন- পাশে’-র মধ্যে৷ প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায় সঠিকভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন : ‘গোরা উপন্যাসে (১৯১০ জানুয়ারি) এবং ভারততীর্থ কবিতায় (১৯১০ জুলাই) যে বাণী প্রকাশ পেয়েছে, জনগণমনঅধিনায়ক রচনায় (১৯১১) সেই বাণীই উৎসারিত হয়েছে সঙ্গীতের রূপ ধরে৷’ ‘গোরা’ তাই শুধু একটি উপন্যাসমাত্র নয়, রবীন্দ্রনাথের জীবনের একটি সংকটময় পর্বের চিন্তাধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল৷ সাহেব গোরাকে সাধারণ অশিক্ষিত ভারতবাসীর প্রতিনিধি আনন্দময়ী অতি সহজেই আপন করে নিয়েছেন তাই নয়, তৎকালীন শিক্ষিত, নাগরিক, বুদ্ধিজীবী বাঙালির (ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের পেছনে যাদের সমর্থন ছিল সর্বাধিক) প্রতিনিধি পরেশবাবুও সাহেব গোরাকে সাদরে গ্রহণ করে পূর্ব ও পশ্চিম, শ্বেত ও কৃ ষ্ণ, শোষক ও শোষিতের মিলন ঘটিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সহযোগী একটি রাজানুরক্ত ইউরেশিয়ান প্রজাতি ও সংস্কৃ তি গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন৷ ‘গোরা’-র মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধগুলির চাইতে অনেক বেশি হূদয়গ্রাহী করে বোঝাতে চেয়েছেন তিনি আর তাঁর আগেকার শাসক-বিরোধী

অবস্থানে নেই, এখন তিনি শত্রুমিত্রসমন্বয়ের পক্ষে, সমঝোতার পক্ষে৷ কিন্তু যাদের তিনি একথা বোঝাতে চাইছেন তারা শুধু সমঝোতায় সন্তুষ্ট হবে না৷ তারা চাইবে আরও স্পষ্টভাবে বিপ্লববিরোধিতা করে তিনি মাথা আরও নত করুন৷ তাই তাঁকে লিখতে হবে ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস, যেখানে তিনি সন্দীপের মধ্য দিয়ে দেখাতে চাইবেন বিপ্লবীরা কত স্বার্থপর, স্থূল, কত ঘৃণ্য, আর স্বদেশি আন্দোলন-বিরোধী নিখিলেশ বা তাঁর নিজের মতো জমিদারেরা কত উদার, বিবেচক ও মানবদরদি৷ সঙ্গতভাবেই ব্রিটিশ শাসকেরা এই মনোভাবকে স্বাগত জানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ‘নাইট’ উপাধি দিয়ে অভিনন্দিত করবেন৷ কিন্তু ব্রিটিশ শাসক বা তাদের দেশি আমলারা না বুঝলেও রবীন্দ্রনাথ বুঝবেন যে সন্দীপ এমনই একটি অবাস্তব ক্যারিকেচার যে তাকে কোনো বুদ্ধিমান পাঠক বিপ্লবীদের প্রতিনিধি বলে ভু ল করবে না৷ তাই সেই ত্রুটি রবীন্দ্রনাথ শুধরে নেবেন ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে যাতে তিনি দেখাতে চেষ্টা করবেন দুটি কচি হূদয় কীভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে বিপ্লবের কঠোর ও নিষ্ঠু র অনুশাসনে৷ বিপ্লববাদের বিরুদ্ধে এই জোলো প্রেমের ভাবালু আবেদনকে তরুণসমাজ ও সরলমতি বয়স্ক পাঠকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসের ভাষায় কবিতার ‘যাদু’ লাগাবেন, এবং এলা-অতীনের অন্তরঙ্গতার মধ্যে একটু শারীরিক ন্যাচারালিজম আনারও চেষ্টা করবেন৷ ১৯৩২ সালে হিজলি জেলে রাজবন্দিরা রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করে কবিকে অভিনন্দন জানাবেন : ‘বন্ধন-বিমূঢ় অবমানিতের মর্মবেদনাকে ভাষা দান করিয়াছ তু মি, হে দরদী, আজ তোমার কল্যাণ কামনা করি৷’ দুবছর পর ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাস পড়ে স্তম্ভিত ও মর্মাহত হবেন বিভিন্ন বন্দিনিবাসে আটক সরোজ আচার্য ও জিতেন ঘোষের মতো বিপ্লবীরা৷ ওই উপন্যাসের বিপ্লব-বিরোধিতায় উল্লসিত হয়ে ব্রিটিশ শাসকেরা তাদের দেশি আমলাদের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে রাজি করাবে উপন্যাসটির নাট্যরূপ তৈরি করার জন্যে, যাতে রংমহল বা নাট্যনিকেতনের মতো অভিজাত থিয়েটারে ওই নাটক মঞ্চস্থ করে দর্শকদের মধ্যে বিপ্লবের বিরুদ্ধে কু ৎসা ছড়ানো যায়৷ ‘গোরা’ উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের একটি বিচ্ছিন্ন সাহিত্যপ্রচেষ্টা নয়, এটি ‘গোরা’-‘ঘরে বাইরে’-‘চার অধ্যায়’ ট্রিলজির প্রথম অংশ৷ প্রভাতকু মার বলেছেন ‘গোরা’ রচনার প্রেরণা ছিল আর্থিক৷ কথাটি পুরো সত্যি নয়, অন্তরের তাগিদও ছিল৷ এ উপন্যাসের গল্পাংশ জর্জ এলিয়টের, কিন্তু এর পরিণতির তত্ত্ব খেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্যের আধ্যাত্মিক মুমুক্ষা ও আত্মসমর্পণের ঐহিক ও রাজনৈতিক সম্পূরক, এবং সেই অর্থে এর তত্ত্ব একান্তভাবেই রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব৷ জীবনের একটি দীর্ঘ পর্বে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস রেখেছিলেন এই তত্ত্বে, যদিও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও ফাসিজমের বীভৎসতা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর পরিচয়ের ফলে সে-বিশ্বাস কিছুটা শিথিল হয়ে এসেছিল তাঁর জীবনের শেষ

কয়েক বছরে, যখন কোনো অতিপ্রাকৃ ত, পরমমঙ্গলময়, সর্বশক্তিমান বিশ্বস্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কেও একটি সুস্থ, মানবিক সংশয় ও অবিশ্বাস জেগেছিল রবীন্দ্রনাথের মনে৷ রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্যের পূর্ণতর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও চেতনার বিবর্তনের সঙ্গে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও সংশয়ের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের গুরুত্ব যোগ্যতর গবেষকের মনোযোগ ও বিশ্লেষণের অপেক্ষায় থাকবে৷

কৃ তজ্ঞতা স্বীকার ও উৎসনির্দেশ এই প্রবন্ধ লেখার ব্যাপারে আমি সবথেকে বেশি ঋণী আমার ছাত্রজীবনের অধ্যাপক প্রিয়রঞ্জন সেনের কাছে৷ তাঁর ‘Western Influence in Bengali Literature (1947) ’ বইটি না পড়লে এ প্রবন্ধ হয়তো আমি কোনোদিনই লিখতাম না৷ অর্চনা মজুমদারের ‘রবীন্দ্র-উপন্যাস-পরিক্রমা’ (১৯৭০) বইটি পড়েও আমি যথেষ্ট উপকৃ ত হয়েছি Felix Holt ও ‘গোরা’ উপন্যাসের সাদৃশ্য প্রসঙ্গে আমি যে অংশগুলি উদ্ধৃ ত করেছি, তার কয়েকটি অধ্যাপিকা মজুমদার তাঁর প্রবন্ধে আগেই উল্লেখ করেছেন৷ Felix Holt ও ‘গোরা’-র সাদৃশ্য সম্পর্কে প্রথম গবেষণার কৃ তিত্ব তাঁরই৷ প্রবন্ধ লেখার সময় অন্যান্য যেসব বই পড়ে আমি উপকৃ ত হয়েছি বা প্রবন্ধে যেসব বই থেকে উদ্ধৃ তি নেওয়া হয়েছে সেগুলি হল : বুদ্ধদেব বসু, ‘রবীন্দ্রনাথ : কথা-সাহিত্য’, ১৯৫৫ সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, ‘রবীন্দ্রনাথ,’ ১৩৫১ নীহাররঞ্জন রায়, ‘রবীন্দ্র-সাহিত্যের ভূ মিকা,’ ১৩৬৯ শ্রীকু মার বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা,’ ১৩৮০ সুকু মার সেন, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস,’ ৩য় খণ্ড, ১৩৭৬ নেপাল মজুমদার, ‘ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ,’ ১ম খণ্ড, ১৯৬১ অরবিন্দ পোদ্দার, ‘রবীন্দ্রনাথ : রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব,’ ১৯৮২ শচীন সেন, ‘রবীন্দ্র-সাহিত্যের পরিচয়, ’ ১৩৬২ Walter Allen, 'The English Novel ' , 1958 ; Quentin Andersen, ' George Eliot in Middlemarch , ' Pelican Guide to English Literature, Vol. 6, 1955 ; Joan Bennet, ' George Eliot : Her Mind and Art , ' 1948 ; Hitendra Mitra, ' Tagore Without Illusions , ' ১৯৮৩৷ সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ থেকে উদ্ধৃ তিটি নেওয়া হয়েছে নিত্যপ্রিয় ঘোষের ‘মুক্ত একক রবীন্দ্রনাথ’ (১৯৮৩) থেকে৷ প্লট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি পাওয়া যাবে ‘গল্পগুচ্ছ’ চতু র্থ খণ্ডের শেষে ‘উৎস ও ব্যাখ্যান’ অংশে৷ স্বদেশি অন্দোলন ও রবীন্দ্রজীবনী-সংক্রান্ত তথ্য ও উদ্ধৃ তি প্রায় সবই নেওয়া হয়েছে প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্রজীবনী’ (২য় খণ্ড, ১৩৫৫) থেকে৷ তাঁর কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য৷

‘চার অধ্যায়’ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক তথ্য পাওয়া যাবে ‘আনন্দবাজার’ (রবিবাসরীয়, ১২ এপ্রিল, ১৯৮১) পত্রিকায় প্রকাশিত শিশির কর-লিখিত ‘ব্রিটিশ সরকার ও চার অধ্যায়’ প্রবন্ধে৷ অরবিন্দ পোদ্দার তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ : রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব’ বইয়ে (পৃ. ৩২১) এ প্রসঙ্গে শিশির করের দেওয়া একটি তথ্যের উল্লেখ করেছেন, যে তথ্য তদানীন্তন বাংলা সরকারের হোম (প্রেস) ১৫৬/৩৬ নং ফাইল থেকে নেওয়া : ‘‘Arrangements have already been made for the staging of plays to oppose the evils of terrorism and civil disobedience ...Dr. Rabindranath Tagore also has recently been persuaded through the Assistant Director of Public Instruction, Bengal to dramatise one of his books Char Adhyaya which delivers a powerful attack on the cult of terrorism. When ready, copies will be distributed to District Officers in the same manner as ‘Pathabhrasta’ and it is also proposed to make it staged in the first class theatres in Calcutta like Rung Mahal or Natya Niketan . ’’ অরবিন্দ পোদ্দার মন্তব্য করেছেন : ‘বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে নাট্যায়িত চার অধ্যায়ের পাণ্ডুলিপি রক্ষিত থাকায় এ সিদ্ধান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ে যে, সরকারি দস্তাবেজের সাক্ষ্য যথার্থ৷’ চিন্মোহন সেহানবীশ তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবীসমাজ’ (১৩৯২, পৃ. ১৩৫ - ১৪০) বইয়ে অরবিন্দ পোদ্দারের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন নি৷ Home / Political File No. 55/1/1935 থেকে একটি তথ্য উদ্ধৃ ত করে সেহানবীশ দেখিয়েছেন যে ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসটিকে বাজেয়াপ্ত করার কথা বাংলা সরকার ভেবেছিল একসময়৷ সেহানবীশের দেওয়া তথ্যগুলি অরবিন্দ পোদ্দারের মন্তব্যকে অযৌক্তিক মনে করার পক্ষে যথেষ্ট নয় বলেই মনে হয়৷ উৎসাহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন৷ Felix Holt উপন্যাস থেকে উদ্ধৃ তিগুলি নেওয়া হয়েছে ‘Felix Holt, the Radical’ (Doubleday, Page & Co. , 1901) থেকে৷ এই বইয়ের Esther Wood লিখিত ভূ মিকাটি পড়েও আমি উপকৃ ত হয়েছি৷ রবীন্দ্রনাথের রহস্যগল্পগুলির বিদেশি উৎস-সম্পর্কে এই প্রবন্ধে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে সেগুলির বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস, ‘রবীন্দ্রনাথের রহস্যগল্প ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ (১৯৮৩) বইয়ের মধ্যে৷ টু র্গেনিয়েফের রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় সম্পর্কে দানিলচু ক তাঁর ‘Tagore, India & Soviet Union : A Dream Fulfilled’ (1986) বইয়ে লিখছেন : ‘One of Tagore's most

favourite Russian writers was Ivan Turgenev ... In 1911, a friend of Tagore [দিনেন্দ্রনাথ ঠাকু র] translated into Bengali, on his request, Turgenev's Triumphant Love . ’৷ দানিলচু কের এই মন্তব্য ও টু র্গেনিয়েফ সম্পর্কে অন্য কয়েকটি মূল্যবান তথ্য আমাকে জানানোর জন্যে আমি অধ্যাপক প্রশান্তকু মার পালের কাছে গভীরভাবে ঋণী৷

পাঠ ও প্রতিক্রিয়া ‘অনুষ্টু প’ শারদীয় (১৯৮৭) সংখ্যায় প্রকাশিত প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের প্রবন্ধ ‘গোরা : জর্জ এলিয়ট ও রবীন্দ্রনাথ’ পড়ার পর কিছু প্রশ্ন মনে জেগেছে৷ পরবর্তী সংখ্যা যেহেতু ‘সমর সেন বিশেষ সংখ্যা’ হিসেবে প্রকাশিত হবার ঘোষণা ছিল, তাই এই চিঠি এখন দিচ্ছি৷ গোড়াতেই স্বীকার করে নিই যে জর্জ এলিয়টের ‘Felix Holt’ আমার পড়া নেই৷ সুতরাং ‘গোরা’ ও ‘Felix Holt’ -এর সাদৃশ্য এবং/অথবা বৈসাদৃশ্য সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করছি না৷ তবে প্রবন্ধে অন্যান্য যে সব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এসেছে, তার জন্যেই কৌতূ হল৷ প্রবন্ধের ৫ম অধ্যায়ে প্রতাপনারায়ণ ওই কালপর্বে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত বেশ কিছু গ্রন্থের তালিকা দিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘তালিকাটি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কী ধরনের ইনটেলেকচু য়াল বা চিন্তাভাবনাগত ঐতিহাসিক পরিবেশে জর্জ এলিয়ট তাঁর উপন্যাসগুলি লিখেছেন৷’ কিন্তু ওই চিন্তা-ভাবনাগত ঐতিহাসিক পরিবেশে জর্জ এলিয়টকে কি পরিমাণে প্রভাবিত করে, অথবা এলিয়টের বিভিন্ন উপন্যাসেই বা ওই পরিবেশের প্রভাব কত-এ প্রসঙ্গে কিছুই উল্লেখ নেই৷ অথচ এরপরই তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘এটা বোঝা দরকার আরো একটি জরুরী কারণে৷’ নেপাল মজুমদারের প্রাসঙ্গিক উক্তিটি তাঁর বিবেচনায় ‘যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর’৷ কেন? -তার বিশ্লেষণ অনুপস্থিত৷ আমার প্রশ্নতালিকায় উল্লেখিত মনীষীদের চিন্তাজগতের ‘সিংহদরজা’ জর্জ এলিয়টের ‘নিকট কতটা উন্মুক্ত’ হয়েছিল? ডারউইনের ‘Origin of Species’ পড়ার পর ৫ ডিসেম্বর, ১৮৫৯ তারিখে Madam Bodichon -কে এক চিঠিতে এলিয়ট লেখেন - ‘to me the Development Theory, and all other explanations of processes by which things came to be , produce a feeble impression compared with the mystery that lies under the processes . ’ ৫ জুলাই ১৮৫৯ তারিখে Charles Bray -কে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘Freethinkers are scarcely wider than the orthodox in this matter , - they all want to see themselves and their own opinions held up as the true and lovely . ’ এরপর ‘Romola’ রচনাকালে Madam Bodichon -কে আর একটি চিঠিতে তিনি লেখেন, òPray donót ever ask me again not to rob a man of his religious belief as if you thought my mind tended to such robbery. I have too profound a conviction of the efficacy that lies in all sincere faith, and the spiritual blight that comes with no

faith, to have any negative propagandism in me . In fact, I have very little sympathy with Freethinkers as a class, and have lost all interest in mere antagonism to religious doctrines. I care only to know, if possible, the lasting meaning that lies in all religious doctrine from the beginning till now . ’ Walter Allen বলেছেন‘George Eliotós toryism is evident in her traditionalism, her delight in an ordered, hiararchical way of life in which everyone has his prescribed place and duties. In her youth she had been a great reader of Scott, and Scott is probably the greatest single influence on her fiction. ’ ওই যুগের ঔপন্যাসিকদের আলোচনায় জর্জ এলিয়ট প্রসঙ্গে Lord David Cecil বলেছেন, ‘Not that she was a revolutionary genius like Emily Bronte. Here was a cautious, scholarly, painstaking talent ; she took trouble to learn her art from the novelists who preceded her. And her books have a lot in common with theirs . ’ মনে হয়, আর উদ্ধৃ তির প্রয়োজন নেই৷ এখন প্রশ্ন-পাশ্চাত্যদেশের বাসিন্দা হিসেবে ওই চিন্তাজগতের নৈকট্য লাভ করেও জর্জ এলিয়ট যদি অমন কথা জানাতে পারেন, তবে এতদূর থেকে সেই চিন্তাজগৎ কি করে রবীন্দ্র-চিন্তার বাস্তুভূ মি হবে? প্রবন্ধের ২য় ও ৩য় অধ্যায়ে প্রতাপনারায়ণ উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গল্পের প্লট কোন কোন বিদেশি গল্পের প্লট থেকে আহরণ করা হয়েছে৷ ‘অনুষ্টু প’-এর প্রাক-শারদীয় (১৯৮৭) সংখ্যায় ইরাবান বসুরায় লিখিত ‘রবীন্দ্র- জিজ্ঞাসার আধুনিকতা’ পর্যালোচনাটিতে প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের ‘রবীন্দ্রনাথের রহস্যগল্প ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ নামক গ্রন্থটিও অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ এ প্রসঙ্গে তাই নতু ন করে কিছু বলার প্রয়োজন দেখছি না৷ এখানে স্মৃতি-সহায়ক হিসেবে কিছু অংশ উদ্ধৃ ত করছি-‘‘আসলে প্রতাপনারায়ণ বহিরঙ্গগত সাদৃশ্যর প্রতিই বেশি মনোযোগী, গল্পকে উপলব্ধি করার ইচ্ছে তাঁর নেই৷ তিনি গল্প পড়েন গোয়েন্দার মনোভাব নিয়ে, সাহিত্যবোদ্ধার মন নিয়ে নয়৷ তাই ‘কঙ্কাল’ ও ‘মণিহারা’ গল্পের উপর কোনো বিদেশি গল্পের প্রভাব না পেয়ে তাঁর মন খারাপ হয়ে যায়৷ তারপরই তিনি ‘ক্ষু ধিত পাষাণ’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে সরাসরি অসত্য ভাষণের দায়ে অভিযুক্ত করেন৷ এই অভিযোগ বিচারের আগে অবশ্য ভাবতে হয়-অর্ধসত্য আরো মারাত্মক কিনা৷ বেশ বিনয়ের ভঙ্গিতেই প্রতাপনারায়ণ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত সুখময় মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্রসাহিত্যের নবরাগ’ গ্রন্থের ‘রবীন্দ্রনাথ ও এডগার অ্যালেন পো’

প্রবন্ধের উল্লেখ করে বলেছেন, সেখানে শ্রীমুখোপাধ্যায় ‘Legia’ গল্পের সঙ্গে ‘নিশীথ’-এর সাদৃশ্য নিয়ে আলোচনা করেন৷’ সুখময় মুখোপাধ্যায় শুধু সাদৃশ্য নয়, দুটি গল্পের পার্থক্যও স্পষ্ট করে দেখিয়েছিলেন৷ প্রতাপনারায়ণ সে-কথাটি চেপে গেছেন৷ কারণটি সহজেই অনুমেয়৷ ...হতেই পারে, রবীন্দ্রনাথ নানা জায়গা থেকে উপাদান নিয়েছিলেন কিন্তু কোনো সৃষ্টির সার্থকতা তো উপাদানে নয়, তার নিজস্ব সম্পূর্ণতায়৷ ‘ক্ষু ধিত পাষাণ’ সেই স্বতন্ত্র সম্পূর্ণতায় পৌঁচেছে আর তার পিছনে শাহিবাগের প্রভাব উড়িয়ে দেবার মতো কোনো প্রমাণ প্রতাপনারায়ণ দেখাতে পারেননি৷ শাহিবাগে যখন ছিলেন, তার বহুদিন পরে কেন কোনো রচনায় তার প্রভাব পড়বে, এ প্রশ্নের কোনো অর্থ হয় না-শিল্পসৃষ্টি তো আর বীজগণিতের নিয়মে হয় না৷ প্রতাপনারায়ণ তা মনে রাখেন না৷ আসলে তাঁর উৎসাহ গোয়েন্দাগিরিতেই, সাহিত্য-অনুভবে নয়৷’’ ২য় অধ্যায়ে প্রতাপনারায়ণ প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র-জীবনী’ (২য় খণ্ড) থেকে একটি উদ্ধৃ তি দিয়ে সিদ্ধান্ত টেনেছেন, ‘গোরা একটি Pot-boiler, অর্থাৎ পয়সার জন্য লেখা বা ভাড়াটে লেখা৷’ এই চটজলদি সিদ্ধান্তের ভিত্তি কি? এরপর তিনি পিয়ার্সনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠির অংশবিশেষ উদ্ধার করে যে মন্তব্য করেছেন, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ-‘ঘটনাটি সত্যি হওয়াই সম্ভব, যদিও বনফু লকে ঘটনাটি একটু অন্যরকম করে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ সুচরিতা-নিবেদিতা নাম দুটির সাদৃশ্যও লক্ষণীয় গোরা চরিত্রের মধ্যেও বিবেকানন্দকে ক্যারিকেচার করার ঝোঁক যে একেবারে নেই তাও বলা যায় না...শিষ্যা সুচরিতা গুরু গোরাকে বিদেশি বলে প্রত্যাখ্যান করায় নিবেদিতা কেন এত রেগে গেলেন সেটা অবশ্য ঠিক বোঝা গেল না ঐ চিঠি থেকে৷’ এই মন্তব্যের দুটি অংশ-প্রথম অংশে ‘গোরা’ রচনায় বিবেকানন্দের এবং নিবেদিতার কর্ম-জীবনের ছাপ স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে৷ দ্বিতীয় অংশ, অর্থাৎ সুচরিতার গোরাকে বিদেশি বলে প্রত্যাখ্যান করায় নিবেদিতার রাগের কারণ বুঝতে না পারা৷ প্রতাপনারায়ণের এই বুঝতে না পারা কিন্তু রীতিমতো বিস্ময়কর৷ প্রভাতকু মারের গ্রন্থের যে পৃষ্ঠা থেকে একটু আগেই উদ্ধৃ তি দিয়েছেন, সেই ২৩৫ পৃষ্ঠাতেই আছে ‘‘তাঁহার (বিবেকানন্দের) আদর্শায়িত হিন্দু সমাজের সাধ্য ছিল না যে আইরিশ মহিলা মিস মারগারেট নোবলকে ‘ভগিনী নিবেদিতা’ আখ্যা দিয়া হিন্দু সমাজের কোনো পর্যায়ে কণামাত্র স্থান করিয়া দিতে পারে৷’’ এই অংশটি কেন প্রতাপনারায়ণের কৌতূ হল উদ্রেক করল না, সেটাই প্রশ্ন৷ ‘নিবেদিতা স্মৃতি’ গ্রন্থে স্বামী অভেদানন্দ লিখেছেন, ‘‘শুনেছি এই বিদেশিনী মহিলাকে তার শিষ্যারূপে গ্রহণ করা ও পরে তাকে বেলুড় মঠে এনে রাখার বিষয়টি আমাদের কোনো কোনো গুরুভ্রাতা, বিশেষ করে রাখাল (স্বামী প্রজ্ঞানন্দ) নাকি প্রীতির চক্ষে দেখেননি৷ শেষ পর্যন্ত নরেনকে বাধ্য হয়েই মিস নোবলকে বাগবাজারে স্থানান্তরিত করে তাঁর জন্য পৃথক বাসস্থানের

ব্যবস্থা করতে হয়েছিল৷’’ ১৯০২ সালে বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর মিশনের সভাপতি হন স্বামী ব্রহ্মানন্দ৷ ধর্মীয় সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি কোনো আপোসের পক্ষপাতী ছিলেন না৷ ফলে, নিবেদিতাকে মঠের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদ করতে হয় এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রে খোলা চিঠি দিয়ে তিনি জানাতে বাধ্য হন যে তিনি স্বেচ্ছায় মঠ ত্যাগ করেছেন, বিতাড়িত হননি৷ শুধু তাই নয়৷ বিদ্যালয়ের জন্যে যে অর্থ নিবেদিতা সংগ্রহ করেছিলেন তা থেকে নিজের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে কিছু রেখে বাকি সব (চারশো স্টার্লিং পাউন্ড) স্বামী ব্রহ্মানন্দকে পাঠাতে বাধ্য হন৷ দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে নিবেদিতার প্রবেশাধিকার ছিল না তাঁকে প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকতে হত৷ নিবেদিতার শেষ জীবন জগদীশ বসু ও অবলা বসুর আশ্রয়ে দার্জিলিং-এ কাটে৷ তাঁর মৃত্যুও ঘটে দার্জিলিং-এ ১৯১১ সালে৷ স্বামী অভেদানন্দ প্রাগুক্ত গ্রন্থে লিখেছেন- ‘১৯২৫ সনে আমার আরব্ধ কর্ম শেষ করে আমেরিকা থেকে আমি ভারতে প্রত্যাবর্তন করি ও প্রথমে দার্জিলিং-এ একটি মঠ স্থাপন করি৷ ঐ সময়ে আমার মনে হল এই দার্জিলিং-এই মিস নোবলের নশ্বর দেহ ভস্মীভূ ত হয়েছিল চৌদ্দ বছর আগে৷ কিন্তু তার চিতাভস্মের উপর একটি স্মরণচিহ্ন নির্মাণ করার কথা কেউ চিন্তা করেনি-না রামকৃ ষ্ণ মিশন, না জনসাধারণ৷ ভারতের বেদীমূলে যিনি নিজেকে অমনভাবে নিবেদন করে তাঁর গুরুর দেওয়া নামটি সার্থক করেছিলেন, তাঁর স্মৃতির প্রতি এই অবহেলা আমাকে ব্যথিত করে৷’ সুতরাং, রবীন্দ্রনাথের কাহিনি শুনে নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই নিবেদিতা রেগে গিয়ে অস্বাভাবিক কিছুই করেন নি৷ প্রভাতকু মার ‘গোরা’ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, ‘নিবেদিতার পক্ষে হিন্দু হওয়া অসম্ভব কল্পনা করিয়াই রবীন্দ্রনাথ যেন আইরিশম্যানের পুত্র গোরাকে উপন্যাসের নায়করূপে সৃষ্টি করিলেন৷’ এই সমস্ত তথ্য এড়িয়ে যাওয়া হল কেন, বুঝতে পারলাম না৷ Felix Holt -এর সঙ্গে ‘গোরা’র সাদৃশ্য বিশেষ কোনো সমালোচকের মনোযোগ আকর্ষণ না করার কারণ ব্যাখ্যায় প্রতাপনারায়ণ বলেছেন যে ‘জর্জ এলিয়ট সম্পর্কে পাঠকের উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে’ এবং তা ১৯২০ সালের পর থেকেই৷ অর্থাৎ, ভাঁটা পড়ার আগে পর্যন্ত Felix Holt সমেত জর্জ এলিয়টের সব উপন্যাস সম্পর্কে পাঠকদের আগ্রহ ছিল৷ কিন্তু তাই কি? Walter Allen লিখেছেন, ‘In fact, no reader’s interest has ever been engaged by the plot of Felix Holt . ’ তাছাড়া, খোদ ইংল্যান্ডেই কি সব ইংরেজ সাহিত্যিকদের সম্পর্কে পাঠকদের সমান উৎসাহ আছে? Everyman Library প্রকাশিত Charles Lamb -এর ‘Easays of Elia’ গ্রন্থের মুখবন্ধে Geoffrey Tillotson বলেছেন - ‘To judge by the pundits of the present day, Lamb - as he himself might have said - is as dead as mutton . ’ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে কি Lamb -এর Essays আজও পাঠ্যতালিকার

অন্তর্ভুক্ত নয়? এখনও কি জর্জ এলিয়টের একাধিক উপন্যাস ভারতের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য নয়? এখন যে বিশেষ কারণে এই চিঠি, সেই প্রসঙ্গে আসি৷ প্রতাপনারায়ণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন যে ‘গোরা’ উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের ইংরেজ-ভজনারই সাহিত্যিক প্রকাশ৷ কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পশ্চাতে কোনো catch বা দুষ্টু মি নেই, যা আছে তা হল তথ্যের বিকৃ তি বা কারচু পি৷ তাছাড়া আছে ‘মনে হয়’, ‘হয়তো’ ইত্যাদির ছয়লাপ৷ প্রতাপনারায়ণ লিখেছেন, ‘সিডিসন বিল পাশ হবার পর স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর নরম হয়ে গেল৷’ স্বাভাবিকভাবেই?! তা, এমন সিদ্ধান্ত চমকপ্রদ হলেও তার ভিত্তি কি? হিতেন্দ্র মিত্রর যে গ্রন্থটির প্রতি তিনি ঋণ স্বীকার করেছেন, তাতেও তো লেখা হয়েছে - ‘There is no evidence that he publicly renounced his political opinions as erroneous . ’ অরবিন্দ পোদ্দার বলেছেন, ‘‘সেই ১৮৮১ সনে ‘ভারতী’ পত্রে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ ‘চীনে মরণের ব্যবসায়’ থেকে শুরু করে মৃত্যুর মাত্র কয়েকমাস আগে রচিত ‘সভ্যতার সংকট’ পর্যন্ত জীবনের প্রত্যেকটি অধ্যায়েই আমরা তাঁকে দেখেছি আবেগতপ্ত ভাষায় সাম্রাজ্যবাদী ফ্যাসিবাদী বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করতে৷’’ (‘পশ্চিমবঙ্গ’, ২৫শে বৈশাখ, ১৩৮৫) এরপর প্রতাপনারায়ণ লিখেছেন - ‘১৮৯৬ সালে আমেরিকা জয় করে বিবেকানন্দ দেশে ফিরেছেন৷ কিছুটা তারই প্রতিক্রিয়ায় এবং কিছুটা দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে রবীন্দ্রনাথ শুরু করলেন ঔপনিষদিক ব্রহ্মবাদ ও প্রাচীন বর্ণাশ্রমের বাণীপ্রচার৷’ তু হিনশুভ্র ভট্টাচার্যের গবেষণা-গ্রন্থটি ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের সম্পর্ক নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচিত হয়েছে৷ আদিত্যপ্রসাদ মজুমদারের ‘চিন্তানায়ক রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ’ গ্রন্থের ভূ মিকায় অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন-‘বিশ্ববিজয়ের পর স্বদেশে ফিরে তিনি (বিবেকানন্দ) মহর্ষির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন৷ কিন্তু তাঁর আদর্শ ও কমৈষণার সঙ্গে ঠাকু রবাড়ির, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক সংযোগ ছিল না৷ সেই বিরোধ দূর করে স্বামীজীর ভাবাদর্শ ও ব্রাহ্মসমাজের ভাবাদর্শকে একটি মিলনসূত্রে মিলিয়ে দেওয়া যায় কিনা তা পরীক্ষা করবার জন্য নিবেদিতা চা-চক্রের আয়োজন করেছিলেন, তাতে বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত হলেও এ-ব্যাপারে নিবেদিতা বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে পারেননি৷ ঠাকু রবাড়ির সঙ্গে ভগিনীর ঘনিষ্ঠতাও স্বামীজী অনুমোদন করতেন না৷ অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ দু’একবার প্রসঙ্গক্রমে বিবেকানন্দের কর্মপদ্ধতির প্রশংসা করলেও কবির সঙ্গে যে বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর পার্থক্য আছে তা তিনি রোমাঁ রোলাঁকে স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন৷’ সুতরাং বিবেকানন্দের বিশ্ব-বিজয়ের ‘প্রতিক্রিয়া’য় রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর স্বাভাবিকভাবেই নরম হয়ে আসা, ব্রহ্মবাদের আশ্রয় নেওয়া প্রভৃ তি প্রতাপনারায়ণের একান্ত নিজস্ব উদ্ভাবন৷ ণ্ঠ

এবার রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর নরম হয়ে আসার ব্যাপারটা একটু যাচিয়ে দেখা যাক৷ ১৩০৯ কার্তিকে ‘বঙ্গদর্শন’-এ প্রকাশিত ‘মা ভৈঃ’ প্রবন্ধে তিনি লেখেন, ‘তু মি দেশকে যথার্থ ভালোবাস, তাহার চরম পরীক্ষা তু মি দেশের জন্য মরিতে পার কি না৷ ...দৈন্যই বল, অজ্ঞতাই বল, মূঢ়তাই বল, মনুষ্যচরিত্রে ভয়ের মতো এত ছোটো আর কিছুই নাই৷’ এরপরই ‘অত্যুক্তি’ প্রবন্ধে লিখলেন, ‘ঠিক যে সময়ে ইংরেজদের সঙ্গে ভারতবাসীর হূদয়ের সম্বন্ধ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নপ্রায়, যে সময়ে আমাদের প্রতি ইংরেজের বিতৃ ষ্ণা ও অবজ্ঞা তাহাদের সামাজিক আচরণে ও ব্যবসায়িক ব্যবহারে প্রতিদিন অনাবশ্যক সুস্পষ্টতার সহিত পরিস্ফু ট হইয়া উঠিতেছে...ঠিক সেই সময়টাতেই অধম ভারতবর্ষের রাজভক্তি ইংরেজ নানা প্রকারে বিশ্বজগতের কাছে উত্থাপিত করিবার আয়োজন করিতেছে, আশানুরূপ ফলও পাইয়াছে, শূন্য ঘট যথেষ্ট পরিমাণে শব্দ করিতেছে৷’ সোমেশ্বর দাস নামক এক ভদ্রলোক ইংরেজদের হাতে উৎপীড়িত হবার পর অত্যন্ত অন্যায়ভাবে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন৷ রবীন্দ্রনাথ এই সম্পর্কে ‘বঙ্গদর্শন’-এ ‘রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতি’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে লিখলেন, ‘বিচারের নিক্তিতে সক্ষম-অক্ষম এবং কালো-সাদায় ওজনে কমবেশি নাই৷ কিন্তু পোলিটিকাল প্রয়োজন বলিয়া একটা ভারী জিনিস আছে, সেটা যেদিকে ভর করে সে দিকে নিক্তি হেলে৷ ...আমরা প্রতিদিন নানা দৃষ্টান্তের দ্বারা শিখিতেছি যে পোলিটিকাল প্রয়োজনের যে বিধান তাহা ন্যায়ের বিধান সত্যের বিধানের সঙ্গে ঠিক মেলে না৷’ ‘রবীন্দ্র-জীবনী’ (২য়) গ্রন্থে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত উল্লেখ আছে৷ ১৩১০ সালে ‘বঙ্গদর্শন’-এ ‘ধর্মবোধের দৃষ্টান্ত’ নামক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘একটা অবস্থা আছে যখন ফলাফল বিচার করা অসংগত ও অন্যায়৷ ইংরাজ যখন অন্যায় করিয়া আমাকে অপমান করে, তখন যতটু কু আমার সামর্থ্য আছে, তৎক্ষণাৎ তাহার প্রতিকার করিয়া জেলে যাওয়া এবং মরাও উচিত৷ ইহা নিশ্চয় জানিতে হইবে যে, হয়তো ঘুষায় পারিব না এবং হয়তো বিচারশালাতেও দোষী সাব্যস্ত হইব তথাপি অন্যায় দমন করিবার জন্য প্রত্যেক মানুষের যে স্বর্গীয় অধিকার আছে যথাসময়ে তাহা যদি না খাটাইতে পারি, তবে মনুষ্যত্বের নিকট হেয় এবং ধর্মের নিকট পতিত হইব৷’ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হলে যে তু মুল আন্দোলন গড়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথ তার পুরোভাগে ছিলেন৷ ১৯০৫ সালে লিখিত ব্যঙ্গাত্মক প্রবন্ধ ‘রাজভক্তি’তে লিখলেন-‘দেবই হউন আর মানবই হউন, যেখানে কেবল প্রতাপের প্রকাশ, বলের বাহুল্য, সেখানে ভীত হওয়া নত হওয়ার মতো আত্মাবমাননা, অন্তর্যামী ঈশ্বরের অবমাননা আর নাই৷’ প্রবন্ধটি রচিত হয় প্রিন্স অফ ওয়েলস-এর ভারতে আগমন উপলক্ষে৷ কিন্তু এই উপলক্ষে বেশ কিছু ব্যক্তিকে নিগৃহীত হতে হয়৷ ওই নিগৃহীতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে গ্র্যান্ড থিয়েটারে ১৪৷২৷১৯০৬ তারিখে এক সভা হয়৷ ওই সভায় প্রেরিত বাণীতে রবীন্দ্রনাথ জানান-‘বাংলাদেশের বর্তমান স্বদেশী আন্দোলন কু পিত রাজদণ্ড যাঁহাদিগকে পীড়িত করিয়াছে, তাঁহাদের প্রতি

আমার নিবেদন এই যে, তাঁহাদের বেদনা যখন আজ সমস্ত বাংলাদেশ হূদয়ের মধ্যে বহন করিয়া লইল তখন এই বেদনা অমৃতে পরিণত হইয়া তাঁহাদিগকে অমর করিয়া তু লিয়াছে৷ রাজরোষের অগ্নিশিখা তাঁহাদের জীবনের ইতিহাসে লেশমাত্র কালিমাপাত না করিয়া বার বার সুবর্ণ অক্ষরে লিখিয়া দিয়াছে-বন্দে মাতরম৷’ ‘সফলতার সদুপায়’ প্রবন্ধের যে লাইনটি প্রতাপনারায়ণ পছন্দ করেছেন তা তো ঐতিহাসিক সত্য এবং স্বয়ং মার্কসও একই কথা বলেছেন৷ ১৩১২ সালে লেখা ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য ছিল যে দেশের মানুষের চিন্তার ভাবের ও ভাষার ঐক্যসাধন তা প্রভাতকু মার লিখেছেন৷ ‘দেশনায়ক’ প্রবন্ধটির পশ্চাৎপট অনুল্লেখিত থাকায় যা প্রকাশ পেয়েছে, তা অর্ধসত্যও নয়৷ বরিশাল প্রাদেশিক সম্মিলনী ও সাহিত্য সম্মিলনী পুলিশের তাণ্ডবে ভেঙে যায়৷ ম্যাজিস্ট্রেট এমার্সন সুরেন্দ্রনাথকে শুধু অপমানই করেন নি, জরিমানাও করেন৷ বরিশাল থেকে ফেরার পর রবীন্দ্রনাথ দেখেন যে রাজনৈতিক নেতারা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও সংবাদপত্র মারফত বিষোদগার করায় মত্ত৷ নেতার মধ্যে মিলনের প্রচেষ্টাতেই পশুপতি বসুর বাড়িতে যে সভা হয় তাতে রবীন্দ্রনাথ ওই প্রবন্ধ পাঠ করেন৷ ওই প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘কলহ অক্ষমের উত্তেজনা প্রকাশ, তাহা অকর্মণ্যের একপ্রকার আত্ম-নিবেদন৷’ দেশের নেতাদের মধ্যে খেয়োখেয়ি তখন তু ঙ্গে৷ বীতশ্রদ্ধ রবীন্দ্রনাথ ‘ডন সোসাইটি’তে দুটি বক্তৃ তা দেন৷ প্রথমটিতে বলেন, ‘আমার মনে হয় যে, এইরূপ মত্ত অবস্থায় বেশি কিছু পাইবার আশা করা যাইতে পারে না৷’ পরের বক্তৃ তায় বলেন, ‘‘এখন আমাদের ছোট ছোট জায়গায় organisation তৈরি করা উচিত৷ কিছুদিন হইতে আমি ‘পল্লীসমিতি’ স্থাপনের চেষ্টা করিতেছি, কিন্তু সেটা সফল হয় নাই৷ ...আমাদিগকে এখন পল্লীর patriotism জাগাইয়া তু লিতে হইবে৷’’ এই মনোভাব থেকেই তো তিনি লিখেছেন, ‘তোমরা তবে বিদায় দেহ মোরে/অকাজ আমি নিয়েছি সাধ করে’৷ ‘স্বাভাবিকভাবেই’ যদি রবীন্দ্রনাথের মনোভাব পরিবর্তিত হয়ে থাকে তবে স্বদেশি আন্দোলনের যুগে রাজদ্রোহমূলক বক্তৃ তা করার জন্য রবীন্দ্রনাথকে সতর্ক করে কেন চিঠি পাঠিয়েছিলেন তদানীন্তন চীফ সেক্রেটারি ম্যাকফার্সন? তথ্যটি তো হিতেন্দ্র মিত্রের গ্রন্থে লব্ধ৷ রবীন্দ্রনাথ ওই পত্রের উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করেন নি৷ হিতেন্দ্র মিত্র এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘মুখ্য সচিবের পত্রের উত্তর না দেওয়া স্পষ্টতই কবির উৎপীড়িত ব্যক্তিত্ব ও আহত মর্যাদার দ্যোতক’৷ (রবীন্দ্রনাথের রূপান্তর-অনীক, এপ্রিল-মে, ১৯৮৭) ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটির প্রসঙ্গে ‘রবীন্দ্রজীবনী’ গ্রন্থের ২য় খণ্ডে প্রভাতকু মার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন৷ প্রতাপনারায়ণ সে-সব তথ্য এড়িয়ে গেছেন৷ গানটি ১৯১১ সালে পঞ্চম জর্জের আগমন উপলক্ষে দিল্লীর দরবারে আদপেই গাওয়া হয় নি গাওয়া হয়

কলকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে৷ সেই অধিবেশনেই ‘রাজদম্পতিকে আনুগত্য ও স্বাগত’ জানাতে যে বিশেষভাবে রচিত হিন্দি গানটি গাওয়া হয়, তা হল ‘যুগ জীব মেরা বাদশা’, -রচয়িতা ছিলেন সরলাদেবীর স্বামী রামভজ দত্তচৌধুরী৷ প্রভাতকু মার বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের রাজভক্ত বন্ধু বুঝলেন এই গানটিকে রাজপ্রশস্তির কাজে লাগানো চলে না৷ অথচ রাজভক্তির গান চাই৷ তাই রবীন্দ্রনাথকে ছেড়ে অন্যত্র সে গানের সন্ধান করতে হয়েছিল৷’ ‘অনীক’-এ প্রকাশিত পূর্বেউল্লেখিত প্রবন্ধে হিতেন্দ্র মিত্র এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রভাবশালী বন্ধু র অসঙ্গত অনুরোধ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেননি বটে, কিন্তু এমন এক গান রচনা করে দিয়েছিলেন যা তাঁর রাজভক্ত বন্ধু র উদ্দেশ্যকে অবশ্যই ব্যর্থ করে দিয়েছিল৷ এ ক্ষেত্রে কবি যে আত্মসমর্পণ করেননি, সে ঘটনা আনন্দদায়ক৷ তবে স্পষ্টই বোঝা যায় কবির রাজভক্ত বন্ধু র অনুরোধের পেছনে শাসকদের নির্দেশ ছিল৷ নানা সময়ে নানা ভাবে বিদেশী শাসকরা এদেশের বুদ্ধিজীবী এবং কবি- সাহিত্যিকদের ওপর পীড়ন করেছেন, ভয় দেখিয়ে তাদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে৷ তারা এদেশের মানুষদের কখনও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেনি, এদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ওপর থেকে তাদের সতর্ক দৃষ্টি কখনও শিথিল হয়নি৷ রবীন্দ্রনাথ নাইট খেতাব পাওয়ার পরেও তাঁর চিঠিগুলি সরকারিভাবে নিয়মিত পরীক্ষা করা হত৷’ এই কারণেই ২৭ ডিসেম্বর, ১৯১১ তারিখে ‘জনগণমন’ গানটি গীত হবার কয়েকদিনের মধ্যেই শিক্ষা-বিভাগের ডিরেক্টর এক সার্কুলার জারি করে শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে সরকারি কর্মচারীদের সন্তানদের ভর্তি করা নিষিদ্ধ করেন৷ প্রতাপনারায়ণ এসব তথ্য বেমালুম চেপে গেছেন কেন,-সেটাই প্রশ্ন৷ সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে ‘চার অধ্যায়’ কি একমাত্র দলিল? তাছাড়া চিন্মোহন সেহানবীশ সরকারি ফাইল থেকে তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন যে তদানীন্তন সরকার ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসটিকে বাজেয়াপ্ত করতে চেয়েছিল৷ সেহানবীশের দেওয়া এই সরকারি তথ্য কেন প্রতাপনারায়ণের ‘যথেষ্ট নয় বলেই মনে হয়’, তা জানা যায় নি৷ সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রসাহিত্য যদি বিপ্লব-বিরোধী তবে বিপ্লবীরা রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে প্রেরণা পেতেন কি করে? ফাঁসির দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত কানাইলাল জেল থেকে বাড়িতে চিঠি লিখেছেন বিপুল আবেগে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃ ত করে সূর্য সেন ফাঁসির আদেশ পাবার পর রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই পেয়ে দাদাকে আনন্দ প্রকাশ করেছেন, এবং বৌদিকে চিঠি লিখছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা উদ্ধৃ ত করে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্বেচ্ছামৃত্যুর পর তাঁর পোশাকপরিচ্ছদ থেকে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের কিছু উদ্ধৃ তি৷ বার্মার আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সারির নেতা সুবোধ মুখার্জী রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’ সংগ্রহ করেছেন কলকাতা থেকে৷ এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে চিন্মোহন সেহানবীশের গ্রন্থে৷ ১৯৬৬-তে ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পলিটব্যুরোর সদস্য

নিয়োটো সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ শুনে যে বিবৃতি দেন তা শেষ হয় রবীন্দ্রনাথের গানের দুটি লাইনের আবৃত্তি দিয়ে-‘আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলা বারে বারে/ডাক দিয়ে যায় নতু ন পাতার দ্বারে দ্বারে৷’ সবচেয়ে বড়ো কথা, অন্যান্য বিষয়ের মতো বিপ্লবীদের সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথের বীক্ষা এক জায়গায় স্থির ছিল না৷ আর বিচ্ছিন্ন হত্যাকে সাফল্যের কার্যকর পন্থা বলে মানতে না-পারলেও সন্ত্রাসবাদীদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের প্রশংসা করেছেন রবীন্দ্রনাথ বার বার, যেমন-‘পরবর্তীকালের প্রজন্মে ইচ্ছার অগ্নিগর্ভ রূপ দেখেছি বাংলার তরুণদের চিত্তে৷ দেশে তারা দীপ জ্বালাবার জন্যে আলো নিয়েই জন্মেছিল ভু ল করে আগুন লাগালো, দগ্ধ করলো নিজেদের, পথকে করলো বিপথ৷ কিন্তু সেই দারুণ ভু লের সাংঘাতিক ব্যর্থতার মধ্যে বীর হূদয়ের যে মহিমা ব্যক্ত হয়েছিল, সেদিন ভারতবর্ষের আর কোথাও তা দেখিনি৷’ পারতপক্ষে তথ্যের জন্য প্রতাপনারায়ণ হিতেন্দ্র মিত্রের ওপর একান্ত নির্ভরশীল, -আর তাও নির্বিচারে৷ ‘গোরার মা যদি মেম না হয়ে কোনো মুসলমান মহিলা হতেন’ বলে প্রতাপনারায়াণ যে তর্কের প্রেসিস খাড়া করতে চেয়েছেন, তা কি খুব সুস্থ চিন্তার পরিচয়বহ? মুসলমানদের সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের কি মনোভাব ছিল, তার অজস্র প্রমাণ তো ছড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের নানা রচনায়৷ প্রতাপনারায়ণ মন্তব্য করেছেন, ‘‘সৎ সাহিত্যের মূল শর্তই ‘গোরা’ পালন করে না বলে এ উপন্যাসের সাহিত্যমূল্য সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা যথেষ্ট অস্বস্তিজনক৷’’ সৎ সাহিত্যের মূল শর্ত কি, তা আমার ঠিক জানা না থাকলেও প্রতাপনারায়ণের অবশ্যই জানা আছে৷ তাই বারান্তরে এ সম্পর্কে তাঁর একটি জ্ঞানগর্ভ আলোচনা পড়ার আশা রাখি৷ অভিনন্দনসহ প্রণবেশ রায় অনুষ্টু প ২২ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা

লেখকের উত্তর ‘অনুষ্টু প’ শারদ (১৯৮৭) সংখ্যায় প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ ‘গোরা : জর্জ এলিয়ট ও রবীন্দ্রনাথ’ সম্পর্কে শ্রীপ্রণবেশ রায়ের কিছু প্রশ্ন-সম্বলিত চিঠিটি আমাকে পাঠানোর জন্য ধন্যবাদ৷ এ সম্পর্কে আমার বক্তব্যও সম্পাদক জানতে চেয়েছেন৷ সংক্ষেপে শ্রীরায়ের প্রশ্নগুলির উত্তর দেবার চেষ্টা করছি আমার সাধ্যমতো৷ আমার বেশিরভাগ রবীন্দ্র-আলোচনার উদ্দেশ্য হল রবীন্দ্রনাথের বিস্তীর্ণ অথচ প্রায় অনাবিষ্কৃ ত পড়াশোনার এলাকা সম্পর্কে যাতে রবীন্দ্রনাথের পাঠকেরা উৎসাহিত বোধ

করেন, যাতে রবীন্দ্রনাথ যেসব বিদেশি বই পড়ে তাঁর গল্প-উপন্যাস লেখায় উৎসাহিত হতেন সেই বইগুলি তাঁর পাঠকেরাও পড়েন ও রবীন্দ্রনাথের সৃজন-পদ্ধতির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে তাঁদের পড়াশোনা ও মানসিকতার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একটা সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করেন৷ এটা করতে পারলে রবীন্দ্রনাথের মৌলিক শক্তিশালী রচনাগুলি থেকে তাঁর derivative রচনাগুলিকে আলাদা করা সম্ভব হবে৷ শ্রীরায় প্রথমেই লিখছেন Felix Holt তিনি পড়েন নি, তাই এ সম্পর্কে তাঁর কোনো প্রশ্ন নেই, অর্থাৎ আমার প্রবন্ধের মূল বিষয় সম্পর্কেই আমি তাঁকে উৎসাহিত করতে পারি নি৷ এইটেই আমার প্রবন্ধের সব থেকে বড়ো ব্যর্থতা৷ প্রবন্ধের শেষের দিকের মন্তব্যের সুর ও যুক্তিক্রম মূল বিষয় থেকেই আসে৷ মূল বিষয়ে উৎসাহিত না হলে উপসংহার সম্পর্কে উৎসাহ যথেষ্ট অর্থবহ হয় না বলেই আমার মনে হয়৷ কথাশিল্পী হিসেবে জর্জ এলিয়ট অবশ্যই তাঁর পূর্বসূরি Scott ও Dickens-এর কাছে ঋণী ছিলেন, কিন্তু তাঁর মানসিকতা ও বিশ্বাসের জগৎ তৈরি করেছিল সে যুগের যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানচেতনা, Reform Bill, শিল্পবিপ্লব ও Chartist Movement থেকে উদ্ভূ ত সমাজচেতনা ও একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ধর্মীয় সামাজিক আন্দোলন Evangelism, যার moral earnestness সে যুগের ধর্মবিশ্বাসীদেরই শুধু প্রভাবিত করে নি, Arthur Hugh Clough -এর মতো sceptic এবং জর্জ এলিয়টের মতো agnostic -দেরও যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল৷ যুক্তিবাদী বিজ্ঞানচেতনা ও ভাববাদী ধর্মমনস্কতার এই দ্বন্দ্বই ভিক্টোরিয়ান বুদ্ধিজীবীদের সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য৷ এ দ্বন্দ্ব Scott -এর জগৎ থেকে আসতেই পারে না৷ ব্যক্তি ও তার সম্পর্কে জর্জ এলিয়টের আগ্রহ ও বিশ্লেষণের লেশমাত্রও পাওয়া যাবে না Scott-এ : ‘Of any philosophic conception of life there is no trace in Scott... There is no Speculation in his eyes’ (Samuel Chew, ‘A Literary History of England’ , ed. A. C. Baugh) ৷ এলিয়টের বিশ্বাসের সঙ্গে সমকালীন বিজ্ঞানের সম্পর্কও খুবই ঘনিষ্ঠ, একথা Walter Allen -ও জানেন : ‘George Eliot’s moral beliefs chimed with what appeared to be the findings of Contemporary Science , particularly heredity [ এই heredity-র চিন্তা আমরা lbsen-এ পাই ], Which appeared as a Scientific and Scientifically proved determinism’৷ Scott-এর জগৎ আর এলিয়টের জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা৷ উপন্যাসের পাত্রপাত্রীর বিবেক ও তাদের নৈতিক সিদ্ধান্তের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমেই জর্জ এলিয়ট ইংরেজি সাহিত্যে আধুনিক উপন্যাসের সূচনা করেছিলেন, Scott-এর রোমান্স বা traditionalism-এর প্রভাবে নয়৷

রবীন্দ্রনাথের মানসিকতা কত গভীরভাবে ঊনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের পাশ্চাত্য সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, যুক্তিবাদ, পজিটিভিজম, ভাববাদী দর্শন, সাহিত্য ও শিল্পভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল তার চিহ্ন রবীন্দ্ররচনায় সর্বত্র ছড়ানো রয়েছে, কিন্তু সেগুলিকে ঠিকমতো চিনে নেওয়ার কাজ তখনও ভালো করে শুরু হয় নি৷ রবীন্দ্রনাথ অজস্র বিদেশি বই পড়তেন, নানাধরনের বিদেশি পত্রপত্রিকা থেকে সাম্প্রতিকতম পাশ্চাত্য দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতেন৷ রবীন্দ্রনাথের বা সামগ্রিকভাবে ব্রাহ্মসমাজের ধর্মভাবনা ও সমাজ-সংস্কার প্রচেষ্টার ওপর Positivism, nonconformism ও utilitarianism-এর গভীর প্রভাব সম্পর্কে আর একটু সচেতন হলে আমরা বুঝতে পারব কেন রবীন্দ্রউপন্যাসে বিপ্রদাস বা জগমোহনের মতো ভালো চরিত্রগুলি পজিটিভিস্ট, কেন ‘গোরা’ উপন্যাসে পরেশবাবুর বইয়ের আলমারিতে Theodore Parker -এর বই সাজানো থাকে, বা Felix Holt উপন্যাসের dissenting পাদ্রি Lyon -এর ধরে টাঙানো Dr. Doddridge -এর ছবির সঙ্গে ব্রাহ্ম পরেশবাবুর ঘরের দেওয়ালে টাঙানো কেশব সেনের ছবির সম্পর্ক কোথায়৷ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচিন্তার মধ্যেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের বিজ্ঞান ও বাস্তবতাবিরোধী, সমাজবিমুখ, আত্মকেন্দ্রিক, অবক্ষয়ী য়ুরোপীয় কলাকৈবল্যবাদ ও সিমবলিজম-এর প্রভাব কতখানি কাজ করেছিল সেটা জানতে পারলে বোঝা যাবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে লেখা রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বা নাটকেও এত অবসাদ, দুঃখবাদ, অতীন্দ্রিয়তা, মৃত্যুচেতনা বা প্রতীকধর্মিতা রয়েছে কেন, কেন রবীন্দ্রনাথের Poe পড়তে ভালো লাগত কিন্তু টলস্টয়ের লেখা ভালো লাগত না, কেন তিনি বের্গসঁ বা নীটসে সম্পর্কে উৎসাহিত বোধ করতেন কিন্তু মার্কস বা এঙ্গেলস সম্পর্কে আগ্রহ দেখাতেন না৷ এই অনুসন্ধান কাজ শুধু সাহিত্যবোদ্ধারা করতে পারবেন না, বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের গবেষকদের সমবেত চেষ্টাতেই একাজ করা সম্ভব হবে৷ আমার সাহিত্যবোধের অভাবের কথাটা পাছে আমি ভু লে যাই তাই স্মৃতিসহায়ক হিসেবে শ্রীরায় শ্রী ইরাবান বসুরায়ের একটি দীর্ঘ মন্তব্য উদ্ধৃ ত করেছেন৷ শ্রী ইরাবান বসুরায়ের মতো রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞের সাক্ষ্যের পর আর আমার কিছু বলার থাকবে না জেনেই বোধ হয় তিনি এ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তু লে আমাকে আর বিব্রত করেন নি৷ শ্রী বসুরায়ের একটি মন্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত : ‘তিনি [ প্রতাপনারায়ণ ] গল্প পড়েন গোয়েন্দার মনোভাব নিয়ে, সাহিত্যবোদ্ধার মন নিয়ে নয়৷’ অনুষ্টু পের আগামী সংখ্যায় প্রকাশিতব্য আমার প্রবন্ধে আমি এই সাহিত্যবোধহীন গোয়েন্দাগিরি সম্পর্কে একটু বিস্তারিতভাবেই লিখেছি৷

‘গোরা’ উপন্যাসের সঙ্গে নিবেদিতার সম্পর্ক নিয়ে যেসব গল্প আমরা জানি, ইতিমধ্যে সেই তথ্যগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে একটি মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছেন নিত্যপ্রিয় ঘোষ‘বলবান আক্রমণের বাধা’ (গাঙ্গেয় পত্রিকা, পূজা, ১৯৮৭ ও তার পরের সংখ্যা)৷ শ্রীরায় ও অন্যান্য উৎসাহী পাঠকেরা প্রবন্ধটি পড়ে নেবেন আশা করি৷ Felix Holt উপন্যাসের জনপ্রিয়তার প্রশ্নটি সঠিকভাবেই তু লেছেন শ্রীরায়৷ জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের সব উপন্যাস সম্পর্কে পাঠকেরা উৎসাহ দেখাবেন এমন কোনো কথা নেই৷ শুধু তাই নয়, বেশ জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের সব থেকে জনপ্রিয় উপন্যাসটি সম্পর্কেও যে সাহিত্যের অধ্যাপকেরাও উৎসাহিত বোধ করবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই, যেমন ঘটেছে The Forsyte Saga -র ক্ষেত্রে৷ এরপর আসছি শ্রীরায়ের বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ-সম্পর্কিত প্রশ্নে৷ আমি লিখেছিলাম ‘প্রতিক্রিয়ায়’, ‘প্রভাবে’ নয়৷ দুটির মধ্যে তফাত আছে৷ যাই হোক, প্রশ্নটি যখন উঠেছে, তখন ব্যাপারটি একটু পরিষ্কার করে নেওয়াই দরকার৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ কয়েক বছরে ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভারতের ধর্ম-আন্দোলন সম্পর্কে প্রভাতকু মার বলেছেন : ‘‘বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ভারতের তিনজন মনীষী ভারতের তিনটি সাধনাকে ভারতের তিনটি পীঠস্থানে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন৷ মহাপুরুষ দয়ানন্দ সরস্বতী অমূর্ত দেবতার জন্য অহিংস যাগযজ্ঞাদির ব্যবস্থা দিয়াছিলেন৷ আর্যসমাজের আদর্শ জীবনে সফল করিবার জন্য (লালা মুন্সীরাম) স্বামী শ্রদ্ধারাম হরিদ্বারে গুরুকূ ল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিলেন৷ ...রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতের ঔপনিষদিক ব্রহ্মবাদ ও বর্ণাশ্রমকে ভারতীয় চিত্তের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ বলিয়া বিশ্বাস করিতেন উপনিষদের সাধনার মধ্যে সর্বসাধনার মিলন হইতে পারে৷ তজ্জন্য তিনি শান্তিনিকেতনে যে বিদ্যালয় স্থাপন করিলেন, তাহা তপোবন ও ব্রহ্মচর্যাশ্রম৷ ...স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের ক্রিয়াকর্মসমন্বিত নিখিল সাধনপ্রণালীকে গ্রহণ করিয়া বেদান্তের ওপরই মতবাদের প্রতিষ্ঠা করিলেন৷ ‘যত মত তত পথ’ বাক্যটি যদি সত্য হয়, তবে হিন্দুধর্মের সকলকিছুকেই সত্য বলিয়া মানিতে হয়৷ এই সকল-কিছুকে মানার নাম সিনথিসিস বা সমন্বয়৷ এই ধর্মসমন্বয়ের কেন্দ্র হইল বেলুড়মঠ৷ ...বৈদিক, ঔপনিষদিক ও পৌরাণিক যুগের তিনটি ধারা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ যথাক্রমে প্রচার ও ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন৷ ইহারা সকলেই বর্ণাশ্রমের সমর্থক, কিন্তু জাতিভেদের বিরোধী৷ ...এই তিনটি আন্দোলনই হিন্দুধর্মকেন্দ্রিক৷’’ সুতরাং ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ ও হিন্দু বিবেকানন্দের ব্যক্তিত্বে যত পার্থক্যই থাক, তাঁরা দুজনেই বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের সহায়ক শক্তি হিসেবেই কাজ করেছিলেন সামাজিক প্রগতির সহায়ক যুক্তিবাদী, সামন্ততন্ত্রবিরোধী, সেকিউলার শক্তি হিসেবে নয়৷

ইংরেজদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব-সম্পর্কিত প্রবন্ধ বা বক্তৃ তা সম্পর্কে নতু ন করে বলার কিছু নেই৷ অরবিন্দ পোদ্দার ও প্রভাতকু মার এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন৷ আমিও আমার প্রবন্ধে আমার বক্তব্য বলেছি৷ ১৮৯৩ সালে লেখা ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’ প্রবন্ধ থেকে শুরু করে ১৯০৮ সালের ‘দেশহিত’ প্রবন্ধের মূল সুরই ইংরেজদের সম্পর্কে ভারতবাসীর বিদ্বেষ প্রশমিত করার৷ ইংরেজদের হূদয়ে ধর্মভাব জাগানোর, ভারতবাসীর সঙ্গে ইংরেজ রাজার হূদয়ের সম্পর্কে গড়ে তোলার, ইংরেজ শাসকদের বিরক্ত না করে পল্লীমঙ্গল করার, ইংরেজদের নিয়ে মাতৃ -অভিষেকের ঘট ভরে তোলার৷ এরই মধ্যে অবশ্যই ‘অত্যুক্তির’-র মতো কিছু প্রবন্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় ক্ষোভ ও অভিমান প্রকাশ করা হয়েছে৷ কিন্তু তাতে এতগুলি প্রবন্ধের সমন্বয়বাদী, বিপ্লববিরোধী সুরে বা বক্তব্যে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি৷ আমলাদের যে রিপোর্টের ভিত্তিতে ম্যাকফার্সন রবীন্দ্রনাথকে রাজদ্রোহমূলক বক্তৃ তা করা থেকে বিরত হতে বলেছিলেন, সে রিপোর্ট অবশ্যই অতিরঞ্জিত ছিল, রবীন্দ্রনাথ অতটা রাজদ্রোহী কখনোই ছিলেন না৷ রবীন্দ্রনাথ ম্যাকফার্সনের চিঠির জবাব দেন নি ঠিকই, কিন্তু স্বদেশি আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে অধ্যাত্মসাধনায় নিমগ্ন হয়েছিলেন এবং অবিশ্রান্তভাবে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছিলেন৷ ‘জনগণমন’ সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের নিজের বক্তব্যও আছে৷ কিন্তু সেগুলির কোনোটিই তথ্য নয়, তাই এড়িয়ে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না৷ এ ব্যাপারে তথ্য একটিই আছে-সেটি হল গানটির Tত্রঅন্ঠ৷ কবি কি ভেবে, কার কথা ভেবে গানটি লিখেছিলেন সেটার থেকেও দরকারি তথ্য হল কবি শেষ পর্যন্ত কি লিখেছিলেন৷ কবিকে অনুরোধ করা হয়েছিল পঞ্চম জর্জের আগমন উপলক্ষে একটি রাজপ্রশস্তিমূলক গান লেখার জন্যে, রবীন্দ্রনাথকে রাজদ্রোহী মনে করলে আমলারা সে অনুরোধ কখনোই করত না৷ রবীন্দ্রনাথ খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু এই বিস্ময়ের পরেও একটি গান লিখেছিলেন-সেই গানে বিশ্ববিধাতা সম্পর্কে যেসব কথা আছে, সেগুলি ইংরেজ শাসকদের নিয়ে গত দশ বছর ধরে লেখা রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের বিভিন্ন কথার প্রতিধ্বনি৷ সেইজন্যেই কোনো ‘Intentional fallacy’ -র মধ্যে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করি নি৷ রবীন্দ্রনাথ তাঁর কৈফিয়তে বলেছিলেন ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’ বলতে তিনি কোনো পার্থিব রাজাকে বোঝান নি, বিশ্ববিধাতাকে বুঝিয়েছেন৷ এতে গানের অর্থের কোনো হেরফের হয় নি, কেননা ইংরেজ শাসকদের তিনি ঠিক পার্থিব শক্তি বলে মনে করতেন না, বিশ্ববিধাতার দূত বলেই মনে করতেন৷ আসলে, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দুটি বিরোধী প্রবণতা কাজ করত-একটি তাঁর পড়াশোনার জগৎ থেকে পাওয়া bourgeois liberalism আর একটি তাঁর জীবিকার সঙ্গে যুক্ত

জমিদারি স্বার্থচিন্তা৷ যখন বিপ্লবী আন্দোলন ততটা তীব্র থাকত না, যখন প্রথমটার প্রভাবে ইংরেজদের সম্পর্কে প্রচু র রূপক ও তির্যকতা দিয়ে ইংরেজদের হূদয়হীনতা, অবিচার, লোভ সম্পর্কে ক্ষোভ ও অভিমান প্রকাশ করতেন, আবার বিপ্লবী আন্দোলন তীব্রতা পেলেই বিপ্লবীদের কু ৎসা করা শুরু করতেন৷ এই ব্যাপারটি নিত্যপ্রিয় ঘোষের একটি প্রবন্ধে (‘কোন সুরে আজ বাঁধিবে যন্ত্র’, মুক্ত একক রবীন্দ্রনাথ, ১৯৮৩) ইতিমধ্যেই আলোচিত হয়েছে৷ আশা করি শ্রীরায় প্রবন্ধটি পড়ে নেবেন৷ রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে বিপ্লবীরা যদি তাঁদের ক্রিয়াকর্মে প্রেরণা পেয়ে থাকেন, তার জন্যে রবীন্দ্রনাথকে দায়ী করা ঠিক হবে না, তিনি আজীবন চেষ্টা করে গেছেন তাঁদের নিরুৎসাহ করার৷ গোরা সাহেব না হয়ে ভারতীয় হিন্দু বা মুসলমান হলে গোরা-সুচরিতার মিলন এত সহজ হত কিনা, আমি এ প্রশ্ন তু লেছি এ কথাটির জোর দেবার জন্যে যে গোরা humanist by choice নয়, humanist by accident৷ এ প্রশ্ন উপন্যাসটির বক্তব্য ও কাঠামোর বলিষ্ঠতা বিচার করার ক্ষেত্রে একটি জরুরি প্রশ্ন বলেই আমার মনে হয়েছে৷ গোরা উপন্যাসের এই পরিণতি ঘটনা ও চরিত্রের স্বাভাবিক বিকাশের পথে আসে নি, এসেছে একটি যান্ত্রিক deus ex machina -র মাধ্যমে৷ এটি একটি বড়ো রকমের শিল্পগত ত্রুটি৷ তবে, আমি ‘সাহিত্যবোদ্ধা’ নই, সুতরাং এ ব্যাপারে আমার ভু ল হতেই পারে৷ চিঠির শেষে শ্রীরায় লিখেছেন সৎ সাহিত্যের মূল শর্ত কি তিনি জানেন না, বারান্তরে আমার একটি জ্ঞানগর্ভ আলোচনার মাধ্যমে জেনে নেবেন৷ তাঁর কথাগুলির সুরেই বোঝা যাচ্ছে তিনি সবই জানেন, শুধু আমাকে পরীক্ষা করার জন্যেই এই অজ্ঞানতার ভান করছেন৷ তিনিও জানেন, আমিও জানি, জ্ঞানের আধার সমালোচক নয়, পাঠক সমাজ৷ সমালোচকেরা শুধু অজ্ঞানতা প্রকাশ করার ধরনটাই পালটায়, এবং সমালোচক হিসেবে এই ভু ল করার ধরন পালটানোটাকে আমি খুবই জরুরি মনে করি, যেমন মনে করতেন আমার থেকে অনেক বড়ো একজন সমালোচক৷ যাই হোক, অনুষ্টু প শারদ (১৯৮৮) সংখ্যায় প্রকাশিতব্য আমার প্রবন্ধের উপসংহারে আমি এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করেছি বলে এখানে আলাদা করে আর কিছু লিখলাম না৷ শ্রীরায়ের কাছে আমি কৃ তজ্ঞ আমার প্রবন্ধের কিছু অস্পষ্ট দিক সম্পর্কে আমাকে নতু ন করে ভাবার সুযোগ দেবার জন্যে৷ এই ধরনের feedback বা মত বিনিময়ের মাধ্যমেই সাহিত্যসমালোচনা ব্যক্তিগত অভিমান বা চিন্তার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে একটি অর্থপূর্ণ সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে গড়ে উঠতে পারে৷ প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস

অনুষ্টু প ২২ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা

প্রসঙ্গ : রক্তকরবী

'রক্তকরবী' ও স্মৃতিলোক তপোব্রত ঘোষ 'মানুষের ধর্ম' গ্রন্থের উপসংহারে 'মানবসত্য' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ মানুষের তিনটি জন্মভূ মির কল্পনা করেছিলেন। একজীবনে তিনবার জন্মায়, তাই সে 'ত্রিজ'। তার প্রথম জন্মভূ মি, 'নিখিল পৃথিবী'। সমগ্র বসুন্ধরাকে সম্বোধন করে রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, 'ওগো মা মৃন্ময়ী, তোমার মৃত্তিকা-মাঝে ব্যাপ্ত হয়ে রই'-তখন কবিসত্তায় তিনি 'নিখিল পৃথিবী'র জাতক। মানুষের দ্বিতীয় জন্মভূ মি, 'নিখিল ইতিহাস'। একেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'স্মৃতিলোক' 'মানুষের দ্বিতীয় বাসস্থান স্মৃতিলোক। অতীতকাল থেকে পূর্বপুরুষদের কাহিনী নিয়ে কালের নীড় সে তৈরি করেছে; এই কালের নীড় স্মৃতির দ্বারা রচিত, গ্রথিত। এ শুধু একটা বিশেষ জাতির কথা নয়, সমস্ত মানুষ জাতির কথা। স্মৃতিলোকে সকল মানুষের মিলন।'-অর্থাৎ, এ কোনো জাতিক কিংবা দেশিক স্মৃতিলোক নয়; রবীন্দ্রনাথ একে বলেছেন, 'সমস্ত মানুষের স্মৃতিলোক'। মানুষের তৃ তীয় আর শেষ জন্মভূ মি, 'সর্বমানবচিত্তের মহাদেশ'। 'বসুন্ধরা'য় রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, 'সকলের ঘরে ঘরে/ জন্মলাভ করে লই হেন ইচ্ছা করে' কিংবা 'ইচ্ছা করে মনে মনে/স্বজাতি হইয়া থাকি সর্বলোকসনে/দেশে দেশান্তরে' -তখন তিনি ঐ 'সর্বমানবচিত্তের মহাদেশ'-এই ভূ মিষ্ঠ হন। এখন আমাদের বিশেষভাবে দেখতে হবে মানুষের ঐ দ্বিতীয় জন্মভূ মির দিকে-যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'স্মৃতিলোক', 'সমস্ত মানুষের স্মৃতিলোক', 'পূর্বপুরুষের কাহিনী নিয়ে' তৈরি-হয়ে ওঠা 'কালের নীড়'। রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন একু শও পূর্ণ হয়নি-সেই কতদিন আগে তাঁর কল্পনায় এই 'স্মৃতিলোক' প্রথম ধরা দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, 'এমন শব্দ আছে যাহা আমাদের কাছে নিস্তব্ধতা, তেমনি এমন স্মৃতি আছে যাহা আমাদের কাছে বিস্মৃতি। আমরা যাহা একবার দেখিয়াছি, যাহা একবার শুনিয়াছি, তাহা আমাদের হৃদয়ে চিরকালের মতো চিহ্ন দিয়া গিয়াছে। কোনোটা বা স্পষ্ট, কোনোটা বা অস্পষ্ট, কোনোটা বা এত অস্পষ্ট যে আমাদের দর্শন-শ্রবণের অতীত। কিন্তু আছে।'১ 'এমন স্মৃতি আছে যাহা আমাদের কাছে বিস্মৃতি'-এই কথাটা আরও একটু পরে, তাঁর তেইশ বছর বয়সে লেখা একটি রচনায় স্পষ্টতর হল। রবীন্দ্রনাথ বললেন, 'আমাদের স্মরণশক্তি অতি ক্ষু দ্র, বিস্মৃতি অতিশয় বৃহৎ। কিন্তু বিস্মৃতি অর্থে তো বিনাশ বোঝায় না। স্মৃতি-বিস্মৃতি একই জাতি। একই স্থানে বাস করে। বিস্মৃতির বিকাশকেই বলে স্মৃতি, কিন্তু স্মৃতির অভাবকেই যে বিস্মৃতি বলে তাহা নহে। এই অতি বিপুল বিস্মৃতি আমাদের

মনের মধ্যে বাস করিতেছে।...অবিশ্রাম কাজ করিতেছে এবং কোনো কোনোটা স্মৃতিরূপে পরিস্ফু ট হইয়া উঠিতেছে।'২ অর্থাৎ স্মৃতি হল বিস্মৃতির বিকাশ কিন্তু বিস্মৃতি মানে বিনাশ নয়। স্মৃতি যেখানে অপরিস্ফু ট সেখানেই আমাদের অন্তর্গত বিস্মৃতির মহাবিশ্ব। এই 'অতি বিপুল বিস্মৃতি'কে কেন্দ্র করেই ফ্রয়েড গড়ে তু লেছিলেন তাঁর পার্সোনাল আনকনশাস বা ব্যক্তিগত নির্জ্ঞানের সত্য আর তাকেও ব্যবচ্ছেদ করে ইয়ুং আবিষ্কার করলেন কালেকটিভ আনকনশাস বা জাতিগত, সমষ্টিগত নির্জ্ঞানের সত্য। ইয়ুং-এর মতে ঐ সমষ্টিগত নির্জ্ঞানেই ব্যক্তিমানুষ নিজের মধ্যে বহন করে 'সমস্ত মানুষের স্মৃতিলোক'। সেই 'মহা-অতীত', ইয়েটস-এর সেই 'গ্রেট মেমরি'-কে সম্বোধন করে রবীন্দ্রনাথ তাই বলেন, 'তব সঞ্চার শুনেছি আমার/ মর্মের মাঝখানে,/কত দিবসের কত সঞ্চয়/রেখে যাও মোর প্রাণে!/...তু মি জীবনের পাতায় পাতায়/অদৃশ্য লিপি দিয়া/পিতামহদের কাহিনী লিখিছ/মজ্জায় মিশাইয়া।' ইয়ুং-এর মতে, সুপ্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর নানা দেশের সাহিত্য-ভাণ্ডারে সঞ্চিত মিথগুলি ঐ সমষ্টিগত নির্জ্ঞানেরই সৃষ্টি। মিথের স্মৃতিলোকেই মানুষের আদিম বিশ্বাস আর বাসনার সূত্রগুলি অনুসূ্যত হয়ে রয়েছে। বস্তুবাদের অহংকারে আধুনিক মানুষ প্রথমে এই মিথকে অতীতের যত অর্থহীন অলীক জল্পনা বলে পরিত্যাগ করতে চেয়েছিল; কিন্তু ক্রমশ তার এই উপলব্ধি হয়েছে যে বাইরে থেকে যতই নিজেকে পুরাণহারা বলে মনে হোক-নাকেন, তারও জীবনের পাতায় পাতায় অতীতের অদৃশ্য লিপিতে লেখা হয়ে আছে পিতামহদের কাহিনি। বলা বাহুল্য, মিথ বা পুরাণ সম্পর্কে আধুনিক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনের মূলে উনিশ শতকের সমাজবিজ্ঞান আর নৃতত্বের নতু ন গবেষণার প্রভাব কম নয়। আধুনিক মানুষের মনোলোকে মিথের এই প্রাণময় প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে হার্বার্ট রিড ভারি সুন্দর করে একবার তাই বলেছিলেন যে, যেসব মিথ এতকাল মৃত ছিল তারা এখন আবার বেঁচে উঠেছে; এমনও হতে পারে, যেসব প্রাচীন দেবতা আর দেবকল্প পুরুষ ('heroes') কত সহস্র শতাব্দী আগে মানবচিত্তকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিলেন তাঁরা সবাই আবার শীঘ্র ফিরে আসছেন যিনি যাঁর নির্ধারিত ভূ মিকায়।৩ ১৯১২ সালে লেখা একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এই মিথের ভাষাকেই বলেছিলেন, 'মানব-সাহিত্যে সকলের চেয়ে পুরাতন ভাষা।' 'অথচ' তিনি বলেছেন, 'আজও যখন কোনো কবি বিশ্বকে আপনার বেদনা দিয়া অনুভব করেন তখন তাঁহার ভাষার সঙ্গে মানুষের পুরাতন ভাষার মিল পাওয়া যায়। এই কারণে বৈজ্ঞানিক যুগে মানুষের পৌরাণিক কাহিনী আর-কোনো কাজে লাগে না; কেবল কবির ব্যবহারের পক্ষে তাহা পুরাতন হইল না। মানুষের নবীন বিশ্বানুভূ তি ঐ কাহিনীর পথ দিয়া আনাগোনা করিয়া ঐখানে আপন

চিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে। অনুভূ তির সেই নবীনতা যাহার চিত্তকে উদবোধিত করে সে ঐ পুরাতন পথটাকে স্বভাবতই ব্যবহার করিতে প্রবৃত্ত হয়।'৪ মনে পড়ে যায়, পাশ্চাত্য আর্কেটাইপাল সাহিত্য-বিচারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গিলবার্ট মারে এই মিথের মধ্যেই দেখেছিলেন এক 'ইটারন্যাল ডিউরেবিলিটি'। ২ রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী' বিংশ শতকের একটি অত্যাধুনিক সমস্যার ভিত্তিতেই দাঁড়িয়ে আছে। অথচ নাটকের অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ বললেন, 'আধুনিক সমস্যা বলে কোনো পদার্থ নেই, মানুষের সব গুরুতর সমস্যাই চিরকালের'। সদ্যতনকে সনাতনের সঙ্গে, সাম্প্রতিককে শাশ্বতের সঙ্গে অবিচ্ছেদে এক করে দেখার জন্যই 'রক্তকরবী'র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঐ অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ বার বার মিথের ভাষায় কথা বলেন। রবীন্দ্রসাহিত্য যাঁরা গভীরভাবে অনুশীলন করেন তাঁরা এই কথাটা ভেবে দেখবেন যে শুধু নাট্যসাহিত্যের ক্ষেত্রেই নয়, তাঁর অন্যান্য সাহিত্যের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ যেখানেই নিজস্ব ভাষ্য রচনা করেছেন তার কোথাও রবীন্দ্রনাথ এত বেশি মিথের ভাষায় কথা বলেননি। শুধু তাই নয়, 'রক্তকরবী'তে ধনতন্ত্রের স্বৈরাচারী স্পর্ধার ফলে উদ্ভূ ত সমস্যার মীমাংসায় যেটা সবচেয়ে রাবীন্দ্রিক চিন্তা-ধনতন্ত্রের অন্তর্গত দ্বৈধ, নিজেরই মৃত্যুকে নিজেরই মধ্যে লালন-সেটিকেও রবীন্দ্রনাথ আগাগোড়া মিথের বুনোটেই শিল্পিত করে তু লেছেন। 'রক্তকরবী'র এই আলোচনায় তাই আমরা দুটি ব্যাপারে লক্ষ রাখব ক. আধুনিক ধনতন্ত্রের সমস্যা কী করে মিথের ভাষায় রূপকল্পিত হয়ে যাচ্ছে। খ. আধুনিক ধনতন্ত্রের ওই অন্তর্বিরোধ কী করে নাটকের আদ্যন্ত একই মিথের পরস্পর-বিরোধী তাৎপর্যে উপস্থাপিত হচ্ছে। ৩ 'রক্তকরবী'র ঘটনাস্থল 'যক্ষপুরী'। 'যক্ষপুরী' নামের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'পৌরাণিক যক্ষপুরীতে ধনদেবতা কু বেরের স্বর্ণসিংহাসন।...যে-জায়গাটার কথা হচ্ছে সেখানে মাটির নিচে যক্ষের ধন পোঁতা আছে। তাই সন্ধান পেয়ে পাতালে সুড়ঙ্গখোদাই চলছে, এইজন্যই লোকে আদর ক'রে একে যক্ষপুরী নাম দিয়েছে।' ভূ গর্ভস্থ এই যক্ষপুরীর কল্পনা প্রথম পাওয়া যাবে 'রক্তকরবী'র বহুকাল আগে লেখা 'সম্পত্তি সমর্পণ' গল্পে। যজ্ঞনাথ কু ণ্ড মাটির নীচে যখ দিয়েছিল। 'যজ্ঞনাথ' ধ্বনি-অনুষঙ্গে

'যক্ষনাথ'কে মনে পড়িয়ে দেয়। যক্ষনাথ কু বের। স্কন্দপুরাণে যক্ষনাথ কু বেরের পুত্র 'কু ণ্ড'। গল্পের উপসংহারে যজ্ঞনাথ ভূ গর্ভ থেকে উপরে উঠবার মই খুঁজে না পেয়ে 'বায়ুহীন আলোকহীন মহাগহ্বরে' চিরকালের জন্য অধঃপতিত হয়েছে। 'রক্তকরবী'র বিশুপাগল বলেছে, 'যক্ষপুরীর কবলের মধ্যে ঢু কলে তার হাঁ বন্ধ হয়ে যায়।...আজ তার সেই আশাহীন আলোহীন জঠরের মধ্যে তলিয়ে গেছি।' যজ্ঞনাথ কু ণ্ড তার পৌত্র গোকু লকে যখ দিয়েছিল। 'রক্তকরবী'র বর্তমান পাঠে যক্ষানুচর এক সুড়ঙ্গ-খোদাইকরের চরিত্র আছে-যার নাম গোকু ল। 'রক্তকরবী'র যে চারটি পাণ্ডুলিপি এখন মুদ্রিত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে তার কোনোটিতেই এই চরিত্রটি নেই। গোকু ল পরবর্তী সংযোজন। যক্ষপুরীর কেন্দ্রবিন্দু কু বেরগড়। পুরাণে কু বের উত্তরদিকের অধিপতি। এই কল্পনার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে 'কু বের উত্তরদিকের অধিপতি, এই হিসেবে তাঁকে উত্তরদিকের সূর্য-রূপে গ্রহণ করা চলে। শীতকালে সূর্যের যখন উত্তরায়ণ শুরু হয়, সেই সময়ই ফসল ওঠার সময়। সুতরাং ধনাধিষ্ঠাতৃ ত্বের সঙ্গে সম্পর্ক আছে।'৫ আমাদের মনে পড়ে যায় পৌষের নাটক 'রক্তকরবী'তে নিজের নিঃসঙ্গতা বোঝাতে গিয়ে যক্ষরাজ নন্দিনীকে বলেছিলেন, 'আমার সঙ্গী? মধ্যাহ্নসূর্যের কেউ সঙ্গী আছে?' 'মেঘদূত'-এ রামগিরিতে নির্বাসিত যক্ষ অলকার উদ্দেশে মেঘকে উত্তরাভিমুখে পাঠিয়েছিল। 'উত্তরমেঘ'-এ বলা হয়েছে, ধনপতি কু বেরের বাড়ির উত্তরেই যক্ষের বাড়ি। ধ্বজাপূজা উপলক্ষে যক্ষপুরীর বাগানবাড়িতে সর্দারদের ভোজের আয়োজন। সেই উৎসবে যোগ দিতে সর্দারের স্ত্রী আসছে যক্ষপুরীতে-মোড়লের পাড়ার কাছে ডাকবদল হবে। 'রক্তকরবী'র দ্বিতীয়, তৃ তীয় এবং চতু র্থ পাণ্ডুলিপিতে সর্দার মেজোসর্দারকে বলছে, 'আমার স্ত্রীকে ভাবছি মন্দরপুর থেকে এগিয়ে নিয়ে আসব।' 'রক্তকরবী'র বর্তমান পাঠে অবশ্য এই সংলাপটি নেই। 'মেঘদূত'-এ যক্ষরাজ কু বেরের একটি উদ্যানের নাম 'বৈভ্রাজ'। পুরাণে কু বেরের অন্যান্য উদ্যানের মধ্যে একটি হল 'মন্দর'। 'রক্তকরবী'র মুদ্রিত চারটি পাণ্ডুলিপিতেই চন্দ্রা বলেছে, 'অঘ্রান শেষ হয়েছে'। অগ্রহায়ণ থেকেই সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু বলে প্রাচীনকালে অগ্রহায়ণ থেকেই শুরু হত সৌর-বৎসর গণনা। অগ্রহায়ণ তাই মার্গশীর্ষ। 'রক্তকরবী'র বর্তমান পাঠে চন্দ্রা বলেছে, 'নবান্নের সময় এল ব'লে'। আসন্ন এই নবান্ন-উৎসবের সূত্রেই পৌষের আবাহন-সংগীতটি হয়েছে নাটকের প্রাণসংগীত। উত্তরাভিমুখে সূর্য-রূপী কু বেরের অয়ন-কাল ফসল-ওঠার সময়-তাই গাওয়া হয়েছে, 'ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে'। উত্তরদিকের এই যক্ষপুরীর একটি আভাস মিলবে ১৮৯৮ সালে 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি গ্রন্থ-সমালোচনায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন 'উত্তর-

আমেরিকার ক্লণ্ডাইক-নামক দুর্গম তু ষারমরুর মধ্যে স্বর্ণখনির সংবাদ পাইয়া লোভোন্মত্ত নরনারীগণ দীপশিখালুব্ধ পতঙ্গের মতো কেমন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়াছে-পথের বাধা, প্রাণের ভয়, অন্নকষ্ট কিছুই তাহাদিগকে রোধ করিতে পারে নাই, সে বৃত্তান্ত সংবাদপত্রে সকলেই পাঠ করিয়াছেন।...ইহার উদ্দীপক দুর্দান্ত লোভ।'৬ সংবাদপত্রের একটি সাম্প্রতিক খবরকে সঙ্গে সঙ্গে পৌরাণিক উপমায় উপমিত করে রবীন্দ্রনাথ বললেন, 'দুর্যোধনপ্রমুখ কৌরবগণ যেমন লোভের প্ররোচনায় উত্তরের গোগৃহে ছুটিয়াছিল, ইহারাও তেমনি ধরণীর স্বর্ণরস দোহন করিয়া লইবার জন্য মৃত্যুসংকু ল উত্তরমেরুর দিকে ধাবিত হইয়াছে।'৭ 'উত্তরের গোগৃহ' বলতে বিরাট রাজ্যের উত্তরদিকের গোষ্ঠভূ মিকে বোঝানো হচ্ছে। আর 'গোগৃহ'র সূত্রেই এসেছে 'ধরণীর স্বর্ণরস দোহনের কল্পনা'। বলা বাহুল্য, 'গো' শব্দের একটি অর্থই হল 'ধরণী'। রবীন্দ্রনাথ বসুন্ধরাকে তাই বলেছিলেন, 'শ্যাম কল্পধেনু'। 'রক্তকরবী'র যক্ষরাজও 'ধরণীর স্বর্ণরস' মৃত্যু-শোষণে আকর্ষণ করে নেন-তাই মোড়লপাড়ায় গোরুর মড়ক লাগে। গোরুর সঙ্গে কর্ষণজীবী সভ্যতার কল্পনা ঘনিষ্ঠ হয়ে রয়েছে; আর সেইসঙ্গে রয়েছে যারা কর্ষণ করে তারাও। যক্ষরাজ পালোয়ানের 'শুধু জোর নয়, একেবারে ভরসা পর্যন্ত শুষে নেয়।' 'রাজার এঁটো' যারা বেরিয়ে আসে রাজার মহলের খিড়কি-দরজা দিয়ে তাদের মধ্যে 'মাংসমজ্জা মনপ্রাণ আর কিছুই' অবশিষ্ট থাকে না। এই প্রসঙ্গে যক্ষের পৌরাণিক জন্মবর্ণনাটি মনে পড়ে। বিষ্ণু পুরাণ বলছেন, যক্ষ ক্ষু ধার্ত ব্রহ্মার সৃষ্টি। পিতার এই ক্ষু ধা পুত্রের মধ্যে দারুণতর হয়ে দেখা দেয় বলেই জন্মলাভের পর যক্ষ স্বয়ং ব্রহ্মাকেই ভক্ষণ করতে উদ্যত হয়। 'রক্তকরবী'র রাজা বলেন, 'পুরাণ ব'লে কিছু নেই। বর্তমান কালটাই কেবল বেড়ে বেড়ে চলেছে।' নাটকের প্রথম পাণ্ডুলিপিতে যক্ষরাজ নন্দিনীকে বলেন, 'শক্তি কেবল শক্তি খায়, আর বলে, আমি থাকব আমি থাকব।...ক্রমাগতই এই থাকার পেট ভরিয়ে চলা, এ কী বীভৎস থাকা।' যক্ষরাজের খাবারকে নাটকের দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিতে বলা হয়েছে, 'জ্যান্ত খাবার'। পুরাণে যক্ষরাজ কু বের দেখতে কু ৎসিত। কু ৎসিত 'বের' বা শরীর বলে তাঁর নাম কু বের। লক্ষ্মীর সম্পদে শ্রী আছে তাই লক্ষ্মী সুন্দরী; কিন্তু কু বের শুধু সঞ্চয় করে, সামঞ্জস্য করে না-তাই সে কু ৎসিত। 'রক্তকরবী'র যক্ষপুরী যেমন সুন্দর নয়, যক্ষরাজাও তেমনি সুন্দর নন। বিশু বলেছে, 'যক্ষপুরীর হাওয়ায় সুন্দরের 'পরে অবজ্ঞা ঘটিয়ে দেয়, এইটেই সর্বনেশে।' নাটকের প্রথম পাণ্ডুলিপিতে নন্দিনী দেখতে পেয়েছিল যক্ষরাজের এই জরামলিন মূর্তি 'মুখের চামড়া ঝু লে পড়েছে, চোখের পাতা তু লতে পারছে না।' দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিতে যক্ষরাজ 'প্রকাণ্ড রাশ-করা স্থবিরতা'র সূত্রেই মনে পড়ে যায় 'গুপ্তধন' গল্পে

যক্ষপুরীর সুড়ঙ্গে নিদ্রিত স্তূ পাকার ভেকগুলিকে। 'রক্তকরবী'তে বেঁচে থাকার বদলে ঐ স্থবিরের শুধু টিকে থাকার অস্বাভাবিকতাকে যখন পাথরের কোটরে তিন হাজার বছর ধরে টিঁকে থাকা ব্যাঙের সঙ্গে উপমিত করা হয় তখন ঐ টিকে থাকার একান্ত কু শ্রীতা যেন মূর্ত হয়ে ওঠে। আমাদের মনে পড়ে, 'আধুনিক কাব্য' প্রবন্ধে সৌন্দর্যতত্বের পক্ষে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ অ্যাপোলোর হাসি আর ব্যাঙের হাসিকে একাকার-করে-ফেলা 'বৈজ্ঞানিক সাম্যতত্ব'র প্রতিবাদ করেছিলেন। উত্তরদিকের যক্ষপুরীর সঙ্গেই রবীন্দ্র-কল্পনায় মিশে গিয়েছে পশ্চিমদিকের যক্ষপুরী। স্বভাবতই এস্ট্যাব্লিশড মিথ-এর সঙ্গে এখানে সংযুক্ত হয়েছে ক্রিয়েটিভ মিথ। আসলে তাঁর সমকালীন ধনতান্ত্রিক পাশ্চাত্যকেই রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমা যক্ষপুরীর নব্য-পৌরাণিক রূপকল্পে নতু ন করে সৃষ্টি করেছেন। ১৮৯০ সালে দ্বিতীয়বার য়ুরোপযাত্রার সময় রবীন্দ্রনাথের পশ্চিমাভিমুখী জাহাজ যখন স্বদেশের উপকূ ল ত্যাগ করল, তখন তাঁর কবিচিত্ত শুনেছিল ভারতবর্ষের এই করুণ পিছু-ডাক 'বৎস, কোথায় যাস! কোন দূর সমুদ্রের তীরে? কোন যক্ষগন্ধর্বদের স্বর্ণপুরীতে?'৮ 'রক্তকরবী'তে বিশুর স্ত্রী ঘরের যে-জানালাটি দিয়ে দেখেছিল যক্ষপুরীর স্বর্ণচূ ড়া, সেই জানালাটিকে নাটকের প্রথম পাণ্ডুলিপিতে বিশেষিত করা হয়নি; কিন্তু নাটকের দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি থেকেই সেটি 'পশ্চিমের জানালা'। ৪ 'রক্তকরবী'র যক্ষরাজের একটি গোপন পরীক্ষাগার আছে। সেইখানে তাঁর স্বর্ণভাণ্ডার। এই সোনাকে বলা হয়েছে, 'অনেক যুগের মরা ধন'। যক্ষরাজ তাঁর পরীক্ষাগারে 'সেই মরা ধনের শবসাধনা' করেন; তার প্রেতকে বশ করতে চান। কারণ 'সোনার তালের তালবেতালকে বাঁধতে পারলে' পৃথিবীকে তিনি পাবেন মুঠোর মধ্যে। এই তালবেতালের শবসাধনায় তাঁর সহায়ক অধ্যাপক আর বস্তুবাগীশ। আবার বলা হয়েছে যে ওই সোনার তালগুলো হল মদ, যক্ষরাজের নিরেট মদ-সেই মদের নেশার শেষ নেই। যক্ষরাজ জরাগ্রস্ত। তাই রঞ্জনের যৌবনে তাঁর ঈর্ষা। তিনি বলেন, 'সোনাকে জমিয়ে তু লে তো পরশমণি হয় না-শক্তি যতই বাড়াই যৌবনে পোঁছল না।' অনায়ত্ত এই যৌবনকে আয়ত্ত করে শারীরিক অমরত্বলাভের দুঃসাধ্য চেষ্টায় যক্ষরাজ যৌবনকে শোষণ করেন। তাঁর পরীক্ষাগার থেকে যৌবন-খোয়ানো প্রেতকল্প যুবারা বেরিয়ে আসে। তাদের যৌবনকে শুষে নিয়ে আগুনের শিখার মতো লকলক করে ওঠেন যক্ষরাজ 'ছোটোগুলো হতে থাকে ছাই আর ওই বড়োটা জ্বলতে থাকে শিখা।'

এই সমস্ত অনুপুঙ্খগুলির তলে তলে প্রাচীন অ্যালকেমি-বিদ্যার স্মৃতি কাজ করে যায়। আধুনিক কেমিস্ট্রির প্রত্ন-রূপ এই অ্যালকেমি। 'য়ুরোপযাত্রীর ডায়ারি'র ভূ মিকায় ১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'য়ুরোপের মধ্যযুগে...অ্যালকেমি-তত্বান্বেষীরা গোপন গৃহে নিহিত থেকে বিবিধ অদ্ভু ত যন্ত্রতন্ত্রযোগে চিরজীবনরস বা 'Elixir of life' আবিষ্কার করবার চেষ্টা করেছিলেন।' অবশ্য মধ্যযুগের য়ুরোপে এই অ্যালকেমি-চর্চার অনেক আগেই প্রাচীন ভারতবর্ষ, চিন, আরব আর মিশরে অ্যালকেমি বা কিমিয়া-বিদ্যার চর্চা প্রচলিত ছিল। তাঁদের রহস্যময় আভিচারিক সাধনার মূল লক্ষ্য ছিল দুটি। প্রথম, সোনা তৈরি করা; দ্বিতীয়, 'চিরজীবনরস' বা 'ইলিক্সির অব লাইফ' আবিষ্কার করে অমরত্ব পাওয়া। এই দুই পৃথক অভীষ্ট বস্তু আবার এক জায়গায় অভিন্ন। কারণ সোনাই অ্যালকেমিস্টদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান ধাতু এবং অমরত্বের চেয়ে মূল্যবান আর কীই বা আছে! ঋগ্বেদে সোনার সঙ্গে দীর্ঘ আয়ুর সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। প্রাচীন আর মধ্যযুগের ভারতে অ্যালকেমিচর্চা হত মূলত বৌদ্ধ আর হিন্দু তান্ত্রিক সম্প্রদায়ে। চিনা অ্যালকেমিস্টরা মনে করতেন যে সবচেয়ে ভালো ইলিক্সির বা অমৃতরস হচ্ছে গলানো সোনা দিয়ে তৈরি একরকম পানীয়। অ্যালকেমিস্টদের এই দুই অভীষ্ট সিদ্ধির জন্যই দরকারি ছিল পরশমণি, পরশপাথর। 'খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর' যেমন মনে পড়বে আমাদের, তেমনিই মনে পড়বে, 'একদিন নদীতটে কু ড়ায়ে পেয়েছি বটে পরশমাণিক।' এই পরশপাথরকে বলা হত সোনা তৈরির রাসায়নিক পরীক্ষায় অত্যাবশ্যক অনুঘটক। পরশপাথর গুঁড়িয়ে কয়েকটি বিশেষ ধাতু র অজ্ঞাত সমবায়ের সঙ্গে মিশিয়ে উত্তপ্ত করতে থাকলে মিশ্রিত পদার্থের রং বদলাতে শুরু করে; শেষ পর্যন্ত যখন রং ধরে তখন বুঝতে হবে সোনা তৈরি হয়েছে। আবার এই পরশপাথর-চূ র্ণ থেকেই তৈরি হত না কি 'প্যানাসিয়া' বা সর্বরোগহর যৌবনপ্রদায়ী ওষুধ। বলা বাহুল্য, অষ্টাদশ শতকে ল্যাভয়েশিয়র যখন আধুনিক কেমিস্ট্রির সূচনা করলেন তার অনেক আগেই ওই প্রাচীন অ্যালকেমি পরিত্যক্ত হয়েছে। বেন জনসনের 'অ্যালকেমিস্ট' উপহাসের পাত্র, ভণ্ড প্রতারক। আমাদের মনে পড়বে ১৮৯২ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথের গল্প 'স্বর্ণমৃগ'। দরিদ্র দম্পতির কাছে এক সন্ন্যাসী এসে বলেছে যে সে সোনা তৈরি করতে পারে। স্বভাবতই সেই সোনাতৈরির পরীক্ষায় অর্থ জোগাতে গিয়ে দরিদ্র দম্পতি দরিদ্রতর হয়েছে। 'নিস্তব্ধভাবে অগ্নিকু ণ্ডের সম্মুখে বসিয়া কটাহের দিকে চাহিয়া উভয়ের চোখে পল্লব নাই, মুখে কথা নাই। তৃ ষিত একাগ্র নেত্রে অবিশ্রাম অগ্নিশিখার প্রতিবিম্ব পড়িয়া চোখের মণি যেন স্পর্শমণির গুণ প্রাপ্ত হইল।...সন্ন্যাসী আশ্বাস দিল, কাল সোনার রঙ ধরিবে।' 'রক্তকরবী'র যক্ষরাজ শুধু সোনার তালের তাল-বেতালকেই বাঁধতে চাননি, তিনি অমরত্বও পেতে চেয়েছিলেন আর সেই চাওয়ার পরিণতিতে তাঁর সঙ্গে পরশপাথর-চাওয়া

খ্যাপার বিশেষ পার্থক্য নেই 'আমি যৌবনকে মেরেছি-এতদিন ধ'রে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে কেবল যৌবনকে মেরেছি। মরা যৌবনের অভিশাপ আমাকে লেগেছে।' ৫ যক্ষরাজের নাম দেওয়া হয়েছে 'মকর'। কেন এই নাম-তার ব্যাখ্যায় অধ্যাপক বলেছেন, 'মকরের মতো ওর চোখের উপর পর্দা নেই।' জৈনপুরাণমতে যক্ষের চোখে পলক পড়ে না। স্বভাবতই বাজপাখির শ্যেনচক্ষু আমাদের মনে পড়বে। নন্দিনীর ভাষায় যক্ষরাজের দৃষ্টি 'বর্শাফলার মতো'। বৌদ্ধতন্ত্রে কু বেরের হাতে থাকে নকু ল বা বেঁজি। 'রক্তকরবী'র যক্ষরাজের বাঁ-হাতে বসেছিল একটা বাজপাখি। বাজ কপোতারি। নন্দিনীকে যক্ষরাজ বলেন, 'পালাও তু মি, পায়রা যেমন পালায় বাজপাখির ছায়া দেখে।' এখানে যক্ষরাজ নিজেই যেন বাজপাখি হয়ে উঠেছেন। কু বের অষ্টদন্ত। বলা হয়েছে, এই আটটি দাঁত আটটি দিকের প্রতীক। দশদিকের বদলে আট দিক বলার কারণ যক্ষপুরী পৃথিবীর চূ ড়ান্ত অধোদেশে অবস্থিত; তাই তার অধঃ নেই, ঊর্ধ্বও নেই। কাজেই তার আট দিকই সবদিক। এই কারণেই 'রক্তকরবী'র মকররাজের নিষ্পলক তীক্ষ্ণগ্র দৃষ্টি সর্বগ্রাসীও বটে। চশমা তাতে এনেছে যান্ত্রিক ত্রুটিহীনতা। সেই নজর এড়িয়ে কারোর কিছু করবার জো নেই। তাই বলা হয়েছে, ঝকঝকে 'মকরের দাঁত খাঁজে খাঁজে বড়ো পরিপাটি ক'রে কামড়ে ধরে।' কী এই 'মকর'? নক্র বা হাঙরকেই কি বলা হবে মকর? না কি এ এমন এক পুরাণকল্পিত জীব যার অস্তিত্ব বাস্তবে নেই-আছে শুধু শিল্পীর প্রকাশে? 'রক্তকরবী'র দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিতে রাজা সম্পর্কে বিশু বলেছে, 'বিশ্বকর্মার তৈরি বৃহদাকার একটা কলের খেলনা', 'কষে ওকে দম দিয়ে দিয়েছে-ক্রমাগতই ওর হাত চলছে, মুখ চলছে, ওর মধ্যে কোনোখানে কোনো সময়ে একটু ও থামবার কোনো কারণ নেই।' এ কি মেরি শেলি-র সেই মানুষের গড়া যন্ত্র-মানুষের পূর্বাভাস? তাই মকর? অতীতের মিথের নামে ভবিষ্যতের মিথের নামকরণ? খিদিরপুরের ঘাট থেকে আরম্ভ করে হঙকঙের ঘাট পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ যে যন্ত্রবাহন বাণিজ্য-দানবকে দেখেছিলেন তার চালচলনও অনেকটা 'রক্তকরবী'র ওই কষে-দম-দেওয়া বৃহদাকার কলের খেলনার মতোই 'লোহার হাত দিয়ে মুখে তু লছে, লোহার দাঁত দিয়ে চিবোচ্ছে, লোহার পাক-যন্ত্রে চিরপ্রদীপ্ত জঠরানলে হজম করছে এবং লোহার শিরা-উপশিরার ভিতর দিয়ে তার জগৎ-জোড়া কলেবরের সর্বত্র সোনার রক্তস্রোত চালান ক'রে দিচ্ছে।' একবার একে চিনাদের পুরাণ-কল্পিত ড্রাগনের

ঠি

সঙ্গে তু লনা করেও রবীন্দ্রনাথ ঠিক ভেবে পাননি এ কেমনতরো জনোয়ার! 'খানিকটা সরীসৃপের মতো, খানিকটা বাদুরের মতো, খানিকটা গণ্ডারের মতো।'৯ আসলে এই মকর হল কু বেরের পুরাণ-কথিত 'নবনিধি'র একটি নিধি। 'নবনিধি' কী কী? মহাপদ্ম, পদ্ম, শঙ্খ, মকর, কচ্ছপ, মুকু ন্দ, কু ন্দ, নীল আর খর্ব। 'মেঘদূত'-এ যক্ষের বাড়ির দরজার দুই পাশে আঁকা ছিল পদ্ম আর শঙ্খ। যক্ষরাজের জন্য নন্দিনী এনেছে কু ন্দফু লের মালা পদ্মপাতায় ঢেকে। আধুনিক নৃতাত্বিক দৃষ্টিকোণে এই 'নবনিধি' কু বেরের ন'টি টোটেম ছাড়া আর কিছু নয়। জেমস ফ্রেজার তাঁর 'গোল্ডেন বাউ' (Golden Bough) গ্রন্থে বলেছেন, ' Totemism is an intimate relation which is supposed to exist between a group of people on the one side and a species of natural or artificial objects on the other side, which objects are called the totems of the human group . '১০ ১৯১২ সালে লেখা 'ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'নৃতত্ব আলোচনা করিলে দেখা যায় বর্বর জাতির অনেকেরই মধ্যে এক-একটি বিশেষ জন্তু পবিত্র বলিয়া পূজিত হয়। অনেক সময়ে তাহারা আপনাদিগকে সেই জন্তুর বংশধর বলিয়া গণ্য করে। সেই জন্তুর নামেই তাহারা আখ্যাত হইয়া থাকে।' এখানে রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে অ্যানিম্যালটোটেম-এর কথাই বললেন। কু বেরের 'নবনিধি'র মধ্যে অবশ্য অ্যানিম্যাল-টোটেম আর আর্টিফিসিয়াল-টোটেম মিলেমিশে আছে। মকর আর কচ্ছপ অ্যানিম্যাল-টোটেম, বাকিগুলি আর্টিফিসিয়াল টোটেম। যেমন মকর তেমনি কচ্ছপ বা কূ র্মের উল্লেখও 'রক্তকরবী'তে দেখা যাবে। সমুদ্রমন্থনের সময়ে মন্দার পর্বত যখন ক্রমশ অতলে তলিয়ে যেতে লাগল তখন কূ র্মাবতার নিজের পিঠের উপর মন্দারকে রক্ষা করেছিলেন। যক্ষপুরীর খোদাইকরদের কেনারাম গোঁসাই বলেছে, 'এরা তো স্বয়ং কূ র্ম-অবতার। বোঝার নিচে নিজেকে চাপা দিয়েছে বলেই সংসারটা টিঁকে আছে।' অন্যদিকে বিশু বলেছে, 'শাস্ত্রমতে অবতারের বদল হয়। কূ র্ম হঠাৎ বরাহ হয়ে ওঠে, বর্মের বদলে বেরিয়ে পড়ে দন্ত, ধৈর্যের বদলে গোঁ।' পৃথিবী যখন রসাতলে তলিয়ে যাচ্ছিল তখন বরাহ-অবতার দাঁতের উপর পৃথিবীকে রক্ষা করে তাকে তু লে আনেন উপরে। মকরের দাঁতের উলটো মিথ হল এই বরাহের দাঁত। যারা নীচে পড়ে আছে তাদের হাতেই যক্ষপুরীর উদ্ধার। ৬ 'মেঘদূত'-এ কু বেরের অলকা মহাদেবের কৈলাসের সংলগ্ন। তাই 'হরশিরশ্চন্দ্রিকা'য় ধুয়ে গিয়েছে অলকার যত প্রাসাদ। 'রক্তকরবী'তেও যক্ষপুরীর বাইরেই আছে ঈশানী পাড়া।

নন্দিনী সেই ঈশানী-পাড়ার মেয়ে। কৈলাসে প্রেমিক মহাদেবের মাথার চাঁদ স্বভাবতই আধোচাঁদ। কিন্তু 'গ্রহণ-লাগা' যক্ষপুরী নন্দিনীকে একটু ও ছুঁতে পারেনি বলেই সে পূর্ণচাঁদ। তার অদৃশ্য আকর্ষণে বিশুর দুঃখসমুদ্রে জোয়ার লাগে চোখের জলের। নন্দিনীকে সম্বোধন করে বিশু গায় 'ও চাঁদ, চোখের জলের লাগল জোয়ার দুখের পারাবারে।' কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই যক্ষপুরী ধ্বনির সূক্ষ্ম স্বরান্তরে রক্ষ-পুরীও বটে। তা না হলে 'রক্তকরবী'র অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ যক্ষপুরী-প্রসঙ্গে পদে পদে রক্ষ-পুরী স্বর্ণলঙ্কা আর রক্ষোরাজ রাবণের প্রসঙ্গ আনতেন না। মিথের এই শিল্পিত বিপর্যাস অবশ্য রবীন্দ্রনাথ আগেও করেছেন তাঁর 'স্বর্ণমৃগ' গল্পে। স্ত্রী মোক্ষদাসুন্দরীর প্ররোচনায় স্বামী বৈদ্যনাথ যক্ষবিত্তের মিথ্যা ফাঁদে পড়েছেন এবং এর পরিসমাপ্তি ঘটেছে স্বামী-স্ত্রীর চিরবিচ্ছেদে। যক্ষের এই মায়াকে 'স্বর্ণমৃগ' বলায় যক্ষরক্ষ একাকার হয়ে গিয়েছে। যক্ষপুরীর সোনার চূ ড়ার মোহময় আকর্ষণে বিপর্যস্ত বিশুর দাম্পত্য-জীবনের ইতিবৃত্তে রক্ষোমায়া স্বর্ণমৃগ যক্ষপুরীর অঙ্গীভূ ত হয়েছে। যক্ষরাজকে রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, 'রাবণের বর্তমান প্রতিনিধি', 'সে একদেহেই রাবণ ও বিভীষণ'-তখন যক্ষরাজের অন্তর্দ্বন্দ্বকে রবীন্দ্রনাথ রাক্ষস-ভ্রাতৃ যুগলের রূপকে প্রকাশ করেন। 'রক্তকরবী'র ভিতরেও এই ব্যাপারটি আগাগোড়া লক্ষ করা যায়। পৌরাণিক কু বের 'একচক্ষু '-তার অন্য চোখটি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যক্ষবিত্ত-অপহরণকারীদের উদ্দেশে কু বেরের ক্রোধকে নন্দিনী বলছে, 'কানা রাক্ষসের অভিসম্পাত'। অন্যের প্রাণ-উৎসাদন-করা যক্ষরাজের 'বড়ো হবার তত্ব'কে সে বলে, 'রাক্ষসের তত্ব'। আসলে 'রক্তকরবী'তে যক্ষপুরী-রক্ষ-পুরী একাকার করে দেওয়ার একটি নিগূঢ় হেতু আছে। রাবণের সঙ্গে যক্ষরাজের সাদৃশ্যসূত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'ত্রেতাযুগের বহুসংগ্রহী রাবণ বিদ্যুৎবজ্রধারী দেবতাদের আপন প্রাসাদদ্বারে শৃঙ্খলিত ক'রে তাদের দ্বারা কাজ আদায় করত।' এখানে গৌরবে বহুবচন হলেও 'বিদ্যুৎবজ্রধারী দেবতা' আসলে স্বর্গরাজ ইন্দ্র। 'রক্তকরবী'তে স্বর্গরাজ-রক্ষোরাজ সংগ্রামের এই ভাবসূত্রটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লক্ষ করা যায়। ১৯১৫ সালে লেখা 'কর্মযজ্ঞ' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'কলিযুগের কলদৈত্য স্বর্গের দেবতাদের নির্বাসিত করে দিয়েছে, কিন্তু আবার তো স্বর্গকে ফিরে পেতে হবে!' স্বর্গকে ফিরে-পাওয়ার ব্যাপারটি 'রক্তকরবী'তে কিভাবে শিল্পিত হয়েছে তা পরের কথা, কিন্তু 'কলিযুগের কলদৈত্য' এখানে স্বর্গের দেবতাদের নির্বাসিত করে দিতে পেরেছে বলেই স্বর্গরাজ ইন্দ্রের হস্তধৃত বজ্র হয়েছে, 'বজ্রকঠিন হাত'। কু বেরগড়ের পাশেই এখানে থাকে বজ্রগড়।

ইন্দ্রের জাল স্বয়ং ইন্দ্র স্বর্গদ্বেষী রাক্ষসদের বন্দি করবার জন্য ব্যবহার করতেন। কিন্তু রাক্ষস-অধিকৃ ত ইন্দ্রজালের তাৎপর্যই গেল উলটে-তা হয়ে দাঁড়াল মকরের মানুষ ছাঁকাজাল। জাল ছেঁকে বেরিয়ে এল কয়েকটি সংখ্যা আর মানুষ গেল তলিয়ে। অবশ্য সেই জালের জানালার আবরণে স্বয়ং মকররাজের সত্তাও অস্পষ্ট হয়ে আসে-নন্দিনী তাই তাঁকে বলে, 'জালের কু য়াশায় ঢাকা' রাজা। ইন্দ্রজালের শিল্পকৌশল মনুষ্যবুদ্ধির অগোচর; তাই রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'জানলাটি যে কিরকম তা সুস্পষ্ট ক'রে বর্ণনা করা অসম্ভব। যারা তার কারিকর তারাই তার কলাকৌশল বোঝে।' এই ইন্দ্রজাল অমানুষী বলেই নাটকের চতু র্থ পাণ্ডুলিপিতে মকররাজ বলেন, 'সে জাল আপনাকে আপনি বুনেই চলেছে, কোথাও তার শেষ দেখতে পাই নে।' প্রথম পাণ্ডুলিপিতে বলা হয়েছে, 'এখান থেকে আরম্ভ করে এদের বেড়াজাল কতদূর চলে গেছে, দেশবিদেশের কত ঘাটে যে তার খুঁটি বাঁধা তার ঠিকানা নেই।' সমস্ত বিশ্বকে বেঁধে-ফেলা কলিযুগের কলদৈত্যের এই ইন্দ্রজালকেই 'মুক্তধারা'র যন্ত্রবন্দনা-সংগীতে বলা হয়েছে, 'তব পঞ্চভূ ত-বন্ধনকর ইন্দ্রজালতন্ত্র।' এই ইন্দ্রজাল আবার রাক্ষসের কু হকও বটে। মকররাজের সঙ্গে লড়াইয়ে ভিতর পর্যন্ত ফাঁকা হয়ে যাওয়া পালোয়ান এই ইন্দ্রজালকে বলেছে 'জাদু', বলেছে, 'এরা কোথাকার দানব, জাদু জানে।' বৃহৎসংহিতায় দেখা যায়, অসুর-পীড়িত দেবতাদের জয় সুনিশ্চিত করবার জন্য ইন্দ্রধ্বজের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু 'রক্তকরবী'তে সেই ধ্বজও রাক্ষস-কবলিত। দেব ও মানব-বিদ্বেষী পাতালবাসী রাক্ষসের হাতে পড়েছে বলেই তা একই সঙ্গে স্বর্গ ও মর্ত্যবিদারণকারী 'যার অজেয় শল্যের একদিক পৃথিবীকে অন্যদিক স্বর্গকে বিদ্ধ করছে সেই আমাদের মহাপবিত্র ধ্বজদণ্ড।' পৌরাণিক এই ধ্বজদণ্ডের পুরাণ-আচ্ছাদনটি সরিয়ে দিলেই এর সাম্প্রতিক চেহারাটি বেরিয়ে পড়বে। 'রক্তকরবী' 'প্রবাসী'তে প্রকাশিত হওয়ার পরের মাসেই (কার্তিক, ১৩৩১) 'বঙ্গবাণী'তে প্রকাশিত 'সৃষ্টি' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ য়ুরোপের এই 'বে-আব্রু' সভ্যতার কথা বললেন যে 'কারখানাঘরের চোঙাগুলোকে ধূমকেতু র ধ্বজদণ্ড বানিয়ে আলোকের আঙিনায় কালি' লেপে দেয়। ৭ 'রক্তকরবী'র অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'মানবের মহিমা উজ্জ্বল ক'রে ধরবার জন্যেই চিত্রপটে দানবের পটভূ মিকা।' সমস্ত 'রক্তকরবী' জুড়ে রক্ষ-বিজয়ী ইন্দ্রের

পাশাপাশি দানব-বিজয়ী ইন্দ্রের ভাবকল্পনাটিও লক্ষ করা যায়। ইন্দ্রকে কেউ কেউ বলেছেন আকাশ-দেবতা। সহস্রাক্ষ ইন্দ্র তারায় ভরা আকাশ। ১৯১২ সালে লেখা 'গীতিমাল্য'র একটি গানে ইন্দ্রের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি/তারায় তারায় খচিত,/স্বর্ণে রত্নে শোভন লোভন জানি/বর্ণে বর্ণে রচিত।' ইন্দ ধাতু বর্ষণে তাই কেউ কেউ বলেছেন যে ইন্দ্র বর্ষণকারী দেবতা আর বর্ষণহীনতাই বৃত্রাসুর। তাই ইন্দ্র বৃত্রবিজয়ী। 'নৈবেদ্য'র একটি সনেটে বৃত্রবিজয়ী বৃষ্টিদাতা এই ইন্দ্রকে সম্বোধন করেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'দীর্ঘকাল অনাবৃষ্টি, অতি দীর্ঘকাল/হে ইন্দ্র হৃদয়ে মম'; বলেছেন, 'সংহরো সংহরো, প্রভো, নিস্তব্ধ প্রখর/এই রুদ্র, এই ব্যাপ্ত, এ নিঃশব্দ দাহ/নিঃসহ নৈরাশ্যতাপ'। 'রক্তকরবী'র মকররাজ 'প্রকাণ্ড মরুভূ মি'-তপ্ত, রিক্ত, ক্লান্ত। 'তৃ ষ্ণার দাহে এই মরুটা কত উর্বরা ভূ মিকে লেহন করে নিয়েছে, তাতে মরুর পরিসরই বাড়ছে।' নাটকের প্রকাশিত সবগুলি পাণ্ডুলিপিতেই মকররাজ 'মরা নদীর পাঁক'এর সঙ্গে নিজের তু লনা করেছেন। প্রথম পাণ্ডুলিপিতে চন্দ্রাকে বিশু বলেছে, 'এই যক্ষপুরীর মরু-হাওয়ায় তোমার ফু লের মালা শুকিয়ে গেছে।' এই মরুকে, এই মরা নদীকে বৃষ্টিধারায় স্নাত করেন বলে ইন্দ্রই রঞ্জক। 'রঞ্জন' এখানে 'প্রতিকারক'। 'সোনার তরী'র 'বর্ষাযাপন'-এ যখন 'দিগন্তের চারিপাশে/আষাঢ় নামিয়া আসে,/বর্ষা আসে হইয়া ঘোরালো' তখন 'সমস্ত আকাশজোড়া/গরজে ইন্দ্রের ঘোড়া/চিকমিকে বিদ্যুতের আলো'। 'বুনো ঘোড়ার কেশর ধরে' রঞ্জন নন্দিনীকে বনের ভিতর দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। প্রথম পাণ্ডুলিপিতে নন্দিনী বলেছে, 'আমাদের গ্রামের নাগাই নদীতে যখন প্রথম বর্ষা এসে পৌঁছয়, তখন রঞ্জন তার উপর ঝাঁপিয়ে প'ড়ে সাঁতার কেটে স্রোতটাকে যেমন তোলপাড় ক'রে তোলে, আমাকে কাছে পেলে সে আমার ভিতর বাহির ঠিক তেমনি ক'রেই তোলপাড় ক'রে ঢেউ খেলিয়ে দিতে থাকে।' এখানে রঞ্জন আর নন্দিনী যেন বর্ষার সদ্যসমাগমে প্রকৃ তির দুরন্ত উল্লাসের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছে। প্রথম পাণ্ডুলিপিতে 'ঈশানী পাড়া' ছিল 'নিশানী পাড়া'। 'নিশানী' বা নিশান যদি ইন্দ্রের ধ্বজ হয় তবে ইন্দ্রের ইন্দ্রাণী বলেই নন্দিনী 'নিশানী পাড়ার মেয়ে'। কিন্তু 'নাগাই' কেন? বৃত্রাসুরকে কোথাও কোথাও বলা হয়েছে 'অহি'। যুদ্ধের সময়ে নাগরূপী বৃত্র ইন্দ্রকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরেছিল। স্বভাবতই অবৃষ্টিসংরম্ভ সর্পাকৃ তি মেঘ নাগরূপী বৃত্র হতে পারে। কিন্তু 'রক্তকরবী'তে মেঘ নয়, নদীর নাম 'নাগাই'। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি বর্ষাসংগীত মনে পড়ে যায় 'পুবসাগরের পার হতে কোন এল পরবাসী/শূন্যে বাজায় সন সন হাওয়ায় হাওয়ায়/সাপ খেলাবার বাঁশি'। পুরাণে ইন্দ্র পূর্বদিকের অধিপতি, ঊনপঞ্চাশ মরুৎ তাঁর সখা। তিনি মায়াবী, বিচিত্র রূপ-ধারণে সমর্থ।

ঋগ্বেদে ইন্দ্র একবার নর্তকের রূপ ধরেছিলেন। আর এখানে তিনি সাপ খেলাবার বাঁশি বাজাতেই সেই আকাশ-সাপুড়ের জাদুতে 'কু লু কু লু কলস্রোতে' 'দিকে দিকে জলের ধারা ছুটেছে উল্লাসি'। বলা বাহুল্য, 'সাপ খেলাবার বাঁশির সূত্রে 'জলের ধারা' ব্যঞ্জনায় সাপের সঙ্গেই সাযুজ্য পেয়েছে। রঞ্জনও জাদু জানে, 'কথায় কথায় সাজ বদল ক'রে চেহারা বদল করে', 'ভাঙা সারেঙ্গি জোগাড় ক'রে গান গেয়ে যায় যক্ষপুরীর রাস্তায়'। বৈদিক ইন্দ্র শম্বরাসুরকে যুদ্ধে পরাভূ ত করে তার অনেক দুর্গ ধ্বংস করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, এই শম্বরাসুর আসলে বৃত্রেরই নামান্তর। একজন পুরাণ-গবেষক বলেছেন, ' Sambara is an eclipse demon of the type of Rahu and Indra's battle with him represents a slow clearance of the eclipse . ' 'রক্তকরবী'র যক্ষপুরী 'গ্রহণ-লাগা পুরী', 'সোনার গর্তের রাহুতে ওকে খাবলে খেয়েছে'। গ্রহণ-মুক্তির জন্যই রঞ্জনের সংগ্রাম। ইন্দ্রের একটি নাম 'গোত্রভিৎ'; 'গোত্র' অর্থে পর্বতও হয়, অসুরও হয়। পর্বতাকার মেঘই বৃত্রাসুর কিংবা বৃত্রাসুরকে ইন্দ্র পর্বে পর্বে ভেদ করেছিলেন বলে বৃত্রাসুরই পর্বত। ইন্দ্রের উদ্দেশে ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, 'হে বজ্রী! তু মি সেই মহাবিস্তীর্ণ পর্বত বজ্রের দ্বারা পর্বে পর্বে ছিন্ন করেছ।' 'রক্তকরবী'র যক্ষরাজ বলেন, 'একদিন দূরদেশে আমারই মতো একটা ক্লান্ত পাহাড় দেখেছিলাম। বাইরে থেকে বুঝতেই পারিনি তার সমস্ত পাথর ভিতরে ভিতরে ব্যথিয়ে উঠেছে। একদিন গভীর রাতে ভীষণ শব্দ শুনলাম, যেন কোন দৈত্যের দুঃস্বপ্ন গুমরে গুমরে হঠাৎ ভেঙে গেল। সকালে দেখি পাহাড়টা ভূ মিকম্পের টানে মাটির নিচে তলিয়ে গেছে।' ইন্দ্র বন্দি জলকে গোষ্ঠমুক্ত গাভীগণের মতো মুক্ত করে দেন। এই বন্দি জলই বৃত্রাসুর। 'রক্তকরবী'র দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি থেকেই যক্ষরাজ নিজেকে বলেছেন, 'প্রকাণ্ড সরোবর'। নন্দিনীর প্রভাবে তাঁর 'সঞ্চয়-সরোবরের পাথরটাতে চাড় লেগেছে'। এই ব্যাপারটিকে উপমার সাহায্যে বিশদ করে অধ্যাপক পুরাণবাগীশকে বলেছেন, 'আমাদের ঐ পাহাড়তলা জুড়ে একটা সরোবর ছিল, শঙ্খিনী নদীর জল এসে তাতে জমা হত। একদিন তার বাঁ দিকের পাথরের স্তূ পটা কাত হয়ে পড়ল, জমা জল পাগলের অট্টহাসির মতো খলখল করে বেরিয়ে চলে গেল।' আমরা আগেই বলেছি যে শঙ্খ কু বেরের টোটেম। যক্ষ এখানে অসুরের সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছে বলেই যে-নদীর জল সরোবরে বন্দী হয় তার নাম 'শঙ্খিনী'। ইন্দ্র-বৃত্র সংগ্রামের এই-সব ভাবকল্পনার সবগুলিই-লক্ষ করার বিষয়-'রক্তকরবী'তে সরাসরি আসেনি। নাগাই নদীতে প্রথম বর্ষার ধারাপতনের বর্ণনাটি বিশুর কাছে নন্দিনীর স্মৃতিচারণ। 'ক্লান্ত পাহাড়'টিকেও যক্ষরাজ 'একদিন দূরদেশে' দেখেছিলেন। 'পাহাড়তলা

জুড়ে' থাকা সরোবরের জল বেরিয়ে যাওয়ার গল্পটিও পুরাণবাগীশের কাছে বলা অধ্যাপকের অতীতকালের গল্প। এর সহজ ও স্পষ্ট কারণ হল, ইন্দ্র-বৃত্রের সংগ্রাম মূলত আষাঢ় মাসের ব্যাপার। সূর্যের দক্ষিণায়ন-সূচনাতেই বৃত্রঘাতী বৃষ্টিধারা ইন্দ্রের আবির্ভাব। অন্য দিকে 'রক্তকরবী'তে সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয়েছে, অঘ্রান পেরিয়ে পৌষের ডাক এসে পৌঁচেছে। অবশ্য একজন জর্মন পুরাণবিৎ হিলেব্রানডট (Hillebrandt) ইন্দ্র-বৃত্র সংগ্রামের মিথকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে বৈদিক দেবতাদের কল্পনা করার সময়ে ইন্দো-ইরানীয়দের একটি শাখা মুখ্যত পশ্চিম ভারতেই বসতি করেছিল। ইরান আর পশ্চিম ভারতে শীতকালেই নদীর জল তলানিতে গিয়ে ঠেকে। তাই বৃত্র প্রকৃ তপক্ষে শীতের দানব আর ইন্দ্র বসন্তের উষ্ণ সূর্যকিরণ।১১ বৃত্র নদীর জলধারাকে উৎসমুখে পর্বতচূ ড়ায় জমিয়ে বরফ করে দেয় আর ইন্দ্ররূপী বসন্ত সেই তু ষারকঠিন জলকে গলিয়ে ফেলে নদীকে পুনশ্চ প্রাণিত করে তোলেন। মনে পড়ে 'ফাল্গুনী'? যখন 'জাদুকরের বাজল ভেরি' তখন 'হিমের বাহুবাঁধন টু টি পাগলাঝোরা পাবে ছুটি'। 'রক্তকরবী'র দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিতে যক্ষরাজ নিজেকে বলেন, 'হিমালয়ের চূ ড়ার মতো, বরফে ঢাকা'। প্রত্যুত্তরে নন্দিনী বলে, 'সেই চূ ড়ার বুকেও ঝর্না ঝরে'; 'তু মি যদি এই পৌষের সকালে রঞ্জনের সঙ্গে ধান কাটতে যাও, ঢেউ-খেলানো খেতের মাঝে প্রকাণ্ড শরীরটা সবুজ সাগরের তলা থেকে শাদা পাহাড়ের মতো জেগে ওঠে, তা হলে সে কী অপূর্ব হয়!' আবার মনে পড়ে 'ফাল্গুনী' 'সাদা তোমার শ্যামল হবে ফিরব মোরা তাই যে হেরি।' রঞ্জন সেই শ্যামল বসন্তের প্রতীক। তাই তার খবর আসে 'যে-পথে বসন্ত আসবার খবর আসে সেই পথ দিয়ে।' ৮ 'রক্তকরবী'র প্রথম থেকে তৃ তীয় পাণ্ডুলিপিতে যক্ষরাজ বলেছেন, 'জ্ঞানের তপোবনে দয়ামায়া ভালোবাসা ঢু কলেই তপোভঙ্গ হয়।' 'রক্তকরবী'র সমকালীন 'সৃষ্টি' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'ধর্মশাস্ত্রে বলে, ইন্দ্রদেব কঠোর সাধনার ফল নষ্ট করবার জন্যেই মধুরকে পাঠিয়ে দেন। আমি দেবতার এই ঈর্ষা, এই প্রবঞ্চনা বিশ্বাস করি নে। সিদ্ধির পরিপূর্ণ অখণ্ড মূর্তিটি যে কিরকম তাই দেখিয়ে দেবার জন্যেই ইন্দ্র মধুরকে পাঠিয়ে দেন।'

তপোভঙ্গের মিথ রবীন্দ্রনাথ আগেই ভেঙেছিলেন 'বলাকা'য়। 'শব্দময়ী অপ্সরা-রমণী' সেখানে 'স্তব্ধতার তপোভঙ্গ' করেছিল বলেই গতিস্পন্দিত বিশ্বভু বনের 'পরিপূর্ণ অখণ্ড মূর্তিটি' সেখানে অনাবৃত হয়েছিল। 'পূরবী'র 'তপোভঙ্গ'য় তা দ্বিতীয়বার ভাঙা হল। সেখানে স্বর্গের মহেন্দ্র তপোভঙ্গের যে-চক্রান্ত করেছিলেন তারই ফলে 'শ্মশানের বৈরাগ্যবিলাসী' মহাদেব লাভ করলেন 'সিদ্ধির পরিপূর্ণ অখণ্ড মূর্তি' উমাকে। 'রক্তকরবী'তে 'ইন্দ্রদেবের আগুন' নন্দিনীই সেই 'স্বর্গের চক্রান্ত'। যক্ষপুরীর যে-রক্ষরাজ সোনার তালের তালবেতালকে নিয়ে তিন হাজার বছরের মৃত্যু-তপস্যা চূ র্ণ করে তাঁকে মুক্তি দিয়েছে প্রেমের অখণ্ড সিদ্ধিতে। খণ্ড নয়, নন্দিনী সিদ্ধির 'অখণ্ড' মূর্তি বলেই রাজার 'সবখানা বাদ দিয়ে' জালের জানালার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা শুধু একখানি হাতকে সে ধরতে চায়নি; ধরেছে সেই দিন যেদিন জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ রাজা তাকে বলতে পেরেছেন, 'আমারই হাতের মধ্যে তোমার হাত এসে আমাকে মারুক, মারুক, সম্পূর্ণ মারুক-তাতেই আমার মুক্তি।' 'রক্তকরবী'তে বৃত্রবিজয়ী ইন্দ্রের যোদ্ধৃ মূর্তি যেমন আছে, তেমনি পাশাপাশি আছে ইন্দ্রের সৌন্দর্যমূর্তি। 'ইন্দ্র' শব্দের ব্যুৎপত্তি-ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ইন্দ্র 'ইরাং দারয়তে'; অর্থাৎ ইন্দ্র 'ইরা' বা অন্নকে বিদীর্ণ করেন; অস্যার্থ, অন্নোৎপাদনের জন্য হলকর্ষণের সময়ে মৃত্তিকা বিদীর্ণ করেন। ইন্দ্র 'ইরাং দদাতি'-'ইরা' বা অন্ন দান করেন। ইন্দ্র 'ইরাং ধারয়তে'-'ইরা' বা অন্নকে ধারণ করেন। দেখা যাচ্ছে, ইন্দ্র যেমন বর্ষণের দেবতা তেমনি ফসল-ফলানোর দেবতাও বটে। ঋগ্বেদে ইন্দ্রের একটি নাম 'উর্বরাপতি'। প্রাচীন ইন্দ্রোৎসবের সঙ্গে তাই শস্যক্ষেত্রের উর্বরতা-বৃদ্ধি আর ফসলের শ্রীবৃদ্ধির একটি সম্পর্ক ছিল। আশ্চর্যের বিষয়, সীতাকে কোথাও কোথাও বলা হয়েছে বৈদিক ইন্দ্রের স্ত্রী। ঋগ্বেদে আছে 'ইন্দ্র সীতাং নিগৃহ্লাতু ' ইন্দ্র সীতাকে গ্রহণ করুন। সীতা লাঙলের মৃত্তিকা-বিদারণকারী ফাল বলেই শস্যদেবতা ইন্দ্রের শক্তি। ১৯২৯ সালের শ্রাবণে হলকর্ষণ উৎসব উপলক্ষে শ্রীনিকেতনে সীতাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই কৃ ষির সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গী হয়ে আছে ধেনু-র কল্পনা। নন্দিনী যেমন সীতার মতোই মাটির কন্যা তেমনি ধেনুও বটে। 'রঘুবংশ'র নন্দিনী কল্পধেনু; 'পল্লবরাগতাম্রা'-নবপল্লবের মতো শ্যামল তার গাত্রবর্ণ। আমরা বলেছি সীতা বা নন্দিনী শস্যদেবতা ইন্দ্রের শক্তি। এই শক্তির যেমন একটি প্রায়োজনিক দিক আছে তেমনি একটি নান্দনিক দিকও আছে। ১৯৩৪ সালে লেখা 'পল্লীপ্রকৃ তি'তে রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন, 'পৃথিবী আমাদের যে-অন্ন দিয়ে থাকে সেটা শুধু পেট ভরাবার নয়; সেটাতে আমাদের চোখ জুড়োয়, আমাদের মন ভোলে।...ধরণীর অন্নভাণ্ডারে কেবল যে আমাদের ক্ষু ধানিবৃত্তির আশা তা নয়, সেখানে আছে সৌন্দর্যের

অমৃত।' স্বর্গের দেবতা ইন্দ্রের সৌন্দর্য-চেতনা রূপ ধরেছে তাঁর নন্দনকাননে। কিন্তু যেইন্দ্র শস্যদেবতা, 'ভূ তলের স্বর্গখণ্ড' এই শ্যামলা শস্যক্ষেত্রই তাঁর নন্দন। নন্দিনী সেই মর্ত্য-নন্দনের আনন্দরূপিণী। তাই 'পৌষের রোদদুর' যখন 'পাকা ধানের লাবণ্য' মেলে দেয়, আকাশে তখন 'পৃথিবীর প্রাণভরা খুশিখানা নিজের সর্বাঙ্গে টেনে নিয়ে' দেখা দেয় ধানি রঙের কাপড় পরা নন্দিনী। ৯ যক্ষপুরীর অভিশপ্ত মানুষদের না আছে অবকাশ না আছে আকাশ। তাই বারো ঘণ্টায় সমস্ত হাসি গান সূর্যের আলো কড়া করে তারা চুঁইয়ে নেয় এক চু মুকের তরল আগুনে। এই মদকেই বিশু পাগল বলেছে 'মরণরস'। 'সে যে চিতার আগুন গালিয়ে ঢালা, সব জ্বলনের মেটায় জ্বালা, সব শূন্যকে সে অট্ট হেসে দেয় যে রঙিন ক'রে।'-শেষ পঙক্তিটিতে খনিশ্রমিকদের নেশাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে 'শূন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল' রচনার ইঙ্গিত। কিন্তু আমরা তো জানি যে বেদ-পুরাণের ইন্দ্রও সোমপায়ী। 'ইন্দু' হল সোমরস, তা পান করেন যিনি তিনিই ইন্দ্র। 'রক্তকরবী'তে ইন্দ্রের সোমরস-পানের মিথকে রবীন্দ্রনাথ অভিনব ব্যঞ্জনায় সম্প্রসারিত করলেন। তাঁর মতে এই আকাশ-পৃথিবীর অপূর্ব সৌন্দর্যই ইন্দ্রের সোমরস। বিশু একেই বলেছে, 'নীল চাঁদোয়ার নিচে খোলা মদের আড্ডা'। বলা বাহুল্য, সোমরসের এই অভিনব ব্যাখ্যা করার সময়ে 'সোম' বলতে বিশেষ কোনো রসক্ষরণকারী উদ্ভিদের কথা রবীন্দ্রনাথ ভাবেননি। 'সোম' প্রথমত তাঁর কাছে 'অমৃত'কোনো আধিদৈবিক ইলিক্সির নয়, বাস্তব এই পৃথিবীর সৌন্দর্যই অমৃত। দ্বিতীয়ত, 'সোম' তাঁর কাছে চন্দ্র। চাঁদের আলো অমৃতবর্ষণকারী-'ঢালে ইন্দু অমৃতধার'-তাই চাঁদ 'সুধাকর'। ফাগুলাল মদ খেতে চাইলে বার বার তাকে বাধা দিয়ে ফেলে-আসা জীবনের সৌন্দর্যস্মৃতি যে মনে করিয়ে দেয় তার নাম 'চন্দ্রা'। আমরা আগেই দেখেছি, নন্দিনীকে বিশু চাঁদের নামে সম্বোধন করেছে। কিন্তু চাঁদ এখানে শুক্ল আর কৃ ষ্ণ-দুই পক্ষকে মিলিয়ে আছে। রঞ্জনের পাওয়া আর বিশুর না-পাওয়া-দুইকে এক করেই নন্দিনীর মধ্যে সৌন্দর্যের অমৃত অখণ্ডতা পেয়েছে। ১০ 'রক্তকরবী'তে যেমন রাক্ষসের মানুষ-ছাঁকার যন্ত্র হিসেবে আর প্রমত্তের স্বপ্ন-মরীচিকা হিসেবে ঠিক তেমনি অপরূপ সৌন্দর্য-রূপে ইন্দ্রজালের উদভাসন। নাটকের প্রথম পাণ্ডুলিপিতে নন্দিনী শুনিয়েছিল পৌষের সকালের এই গান 'বাদল এসে রচেছিল ছায়ার মায়াঘর, রোদ এসেছে সোনার জাদুকর। শ্যামে সোনায় মিলন হল এই যে মাঠের মাঝে,

ভালোবাসার মাটি মোদের তাই তো এমন সাজে।' 'সোনার জাদুকর' সেই হিরণ্যবর্ণ বৈদিক ইন্দ্র। রৌদ্রছায়ার সংগমে, শ্যামে সোনায় মিলিয়ে মাঠের মধ্যে যে ইন্দ্রজাল তিনি রচনা করেন তা শস্যক্ষেত্রকেই পরম রমণীয় করে তোলে। পুরাণে ইন্দ্রজাল ধারণ করে থাকে দণ্ডরূপী দিকসমূহ। 'রক্তকরবী'তে 'হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে দিগবধূরা ধানের ক্ষেতে'। 'মহুয়া'র 'নাম্নী' কবিতামালায় রবীন্দ্রনাথ 'নন্দিনী'র নামে যে স্তব রচনা করেছিলেন সেখানেও 'দিগবধূর মায়াবী অঙ্গুলি চঞ্চল চিন্তায় তার বুলায়েছে বর্ণ-আঁকা তু লি'। অর্থাৎ শুধু দেহেই নয়, তার মনে আর চৈতন্যেও সঞ্চারিত হয়ে যায় ইন্দ্রজালের বর্ণিকাভঙ্গ। সমস্ত সত্তায় নন্দিনী হয়ে ওঠে এই সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী। আমরা বলেছি 'রক্তকরবী'তে ইন্দ্রের যোদ্ধৃ মূর্তির পাশেই আছে ইন্দ্রের সৌন্দর্যমূর্তি। তাই একদিকে যেমন রাক্ষস-কবলিত ইন্দ্রধ্বজকে ধ্বংস করেই দেবলোকের পুনরুদ্ধার তেমনি অন্যদিকে এই ইন্দ্রধ্বজ বা ইন্দ্রধনু নন্দিনীর সত্তায় হয়ে উঠেছে সৌন্দর্যধনু। এই ইমেজটির মধ্যে সূক্ষ্ম একটি কারুকার্য আছে। ইন্দ্রধনুতে যখন জ্যা পরানো হয় না-তখন তা সুদীর্ঘ ধ্বজদণ্ডের মতো। স্বভাবতই যক্ষরাজ যে-ইন্দ্রধনুর পূজা করে মারণচণ্ডীর কাছে উৎসর্গ করবেন তাতে জ্যা পরানোর প্রশ্ন ওঠে না। তা ইন্দ্রকেতু বা ইন্দ্রধ্বজই বটে! কিন্তু জ্যা পরানো হলেই ইন্দ্রধ্বজ ইন্দ্রধনুর পরিচিত মূর্তি ধারণ করে-তাতে সুদীর্ঘ ঋজুতার বদলে সৃষ্ট হয় আনত বক্রতা। 'জাপানযাত্রী'তে সেই ১৯১৬ সালেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'সোজা লাইনটা মানুষের হাতের কাজের। তার কারখানাঘরের চিমনিতে মানুষের জয়স্তম্ভ একেবারে সোজা খাড়া। বাঁকা রেখা জীবনের রেখা, মানুষ সহজে তাকে আয়ত্ত করতে পারে না।' 'নাম্নী'র 'নন্দিনী' যেন 'রক্তকরবী'র নন্দিনীরই ঘনীভূ ত ভাবপ্রতিমা। সেখানে সে 'বর্ষা-অন্তে ইন্দ্রধনু মর্ত্যে নিল তনু।' ইন্দ্রের সৌন্দর্যরূপিণী শক্তি বলেই আকাশ-দেবতা ইন্দ্রের মতোই নন্দিনী আকাশ জুড়ে থাকে। কিন্তু ইন্দ্রধনুর দুই প্রান্ত যেমন, নন্দিনীও তেমন আকাশে বিস্তার পাওয়া সত্বেও ছুঁয়ে থাকে মাটিকে। তাই সে দেবী নয়, মানবী। উপরন্তু বর্ষান্তের নয়, সে হেমন্তের ইন্দ্রধনু। তাই শস্যের স্বর্ণাভা আকাশের ইন্দ্রধনুর উপর প্রতিফলিত হয়ে তাকে শুধু সুন্দরতরই করে না, মাটির সঙ্গে আরও একটু নিবিড় করে তোলে। ১১ কেন এই নাটকটির আগেকার নাম ছিল 'যক্ষপুরী' আর 'নন্দিনী'-আমরা এখন বুঝতে পারছি। এই দুটি নামই মিথের সংকেত-দীপ্তিতে ভাস্বর। কিন্তু তা হলে শেষ পর্যন্ত 'রক্তকরবী'? এর সঙ্গে তো হঠাৎ কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

নাটকের প্রথম পাণ্ডুলিপিতে নন্দিনীর পুষ্পভূ ষণ রক্তকরবীর উল্লেখমাত্র ছিল। দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপির প্রথমে আর শেষে দু'বার মাত্র রক্তকরবীর মালার উল্লেখ রয়েছে। প্রথমে নন্দিনী রাজাকে বলেছে, 'আমি পরেছি রক্তকরবী' আর শেষে নিজের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আগে রাজা নন্দিনীকে বলেছে, 'তোমার ঐ রক্তকরবী মালা দাও আমাকে পরিয়ে।' তৃ তীয় আর চতু র্থ পাণ্ডুলিপিতেও রক্তকরবী এসেছে মাত্র এই দু'বার। অথচ নাটকটির প্রচলিত পাঠে রক্তকরবী নন্দিনীর সর্বাঙ্গের ভূ ষণ, বহুবার ঘুরে ফিরে এর উল্লেখ। আরও একটি ব্যাপার লক্ষ করার মতো। নাটকের মুদ্রিত চারটি পাণ্ডুলিপির কোনোটিতেই কিশোর নেই। এই কিশোরই যক্ষপুরীতে দুষ্প্রাপ্য একটিমাত্র রক্তকরবী গাছের আবিষ্কর্তা। মনে হয় নাটকটির ঘষামাজার প্রায় অন্তিম পর্যায়ে, যখন নাট্যনাম 'রক্তকরবী'তেই স্থির হয়ে দাঁড়াল-তখনই এই কিশোর চরিত্রটি সংযোজিত হল নতু ন করে। এই রক্তকরবীর গাছটি কিশোরের 'একটিমাত্র গোপন কথার মতো', ঐ রক্তকরবী ফু ল তারই 'নিজের ফু ল'। রোজ সকালে তার হাত থেকেই নন্দিনী রক্তকরবী ফু ল নেবেকিশোর নন্দিনীকে সত্যবদ্ধ করিয়েছে। শুধু তাই নয়, শেষ পর্যন্ত এই কিশোরই দূত-রূপে নন্দিনীর পাঠানো রক্তকরবীর গুচ্ছ নিয়ে গিয়েছে রঞ্জনের কাছে। এই কিশোর কি পৌরাণিক মদনের কিশোর-মূর্তি? এই প্রসঙ্গে 'নটরাজ-ঋতু রঙ্গশালা' পর্যায়ের একটি গান আমাদের মনে পড়বে। 'ওগো কিশোর আজি তোমার দ্বারে পরান মম জাগে।' ১৯২৭ সালে লেখা এই গানটিতে কিশোরের অভ্যর্থনার জন্য কবি বলেছেন, 'আনো গো আনো ভরিয়া ডালি করবীমালা লয়ে।' এই কিশোরের মধ্যে যেমন মাধুর্য রয়েছে, তেমনই রয়েছে অকু তোভয় বীর্য। তাই যক্ষপুরীর শাসনকর্তাদের সে ভয় করে না একটু ও। নন্দিনীকে সে বলে, 'ওদের মারের মুখের উপর দিয়েই রোজ তোমাকে ফু ল এনে দেব।' যক্ষরাজাও বলেন, 'সে যে অদ্ভু ত ছেলে। বালিকার মতো তার কচি মুখ, কিন্তু উদ্ধত তার বাক্য। সে স্পর্ধা ক'রে আমাকে আক্রমণ করতে এসেছিল।' মনে পড়ে যায়, 'চিরকু মারসভা'র কৌমার্যব্রতভঙ্গের উদ্দেশ্যে শৈলবালা যখন পুরুষের ছদ্মবেশ ধরল তখন তাকে দেখে রসিক বলেছে, 'যেন কিশোর কন্দর্প, যেন সাক্ষাৎ কু মার।' শৈলবালার এই দুটি উৎপ্রেক্ষায় কিশোর কন্দর্প আর কু মার কার্তিক একাকার হয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্র-কল্পনায় মদনের সঙ্গে দেবসেনাপতির এই সমীকরণের ফলেই তাঁর মদন শুধু ধীরললিত প্রেমিক নন, বীর্যবান যোদ্ধাও বটে। তাঁর ফু ল রক্তকরবীর লালিমার মধ্যেও শুধু প্রেম নয়, বিপ্লবের রক্তরশ্মি বিচ্ছু রিত। এই প্রসঙ্গে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত 'তপতী' নাটকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। 'তপতী'তে রবীন্দ্রনাথ মদনের নতু ন মিথ তৈরি করে বললেন, 'মানকেতু প্রলয়েরই দেবতা'; 'এ পর্যন্ত

রতি নিজেরই বেশের অংশ দিয়ে কন্দর্পকে সাজিয়েছে। উনি রমণীর লালনে লালিত্যে আচ্ছন্ন আবিষ্ট, তাই তো বজ্রপাণি ইন্দ্রের সভায় উনি লজ্জিতভাবে চরের বৃত্তি করেন।' 'লালনে লালিত্যে আচ্ছন্ন' মদনের এই মূর্তিকে অস্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ বললেন, 'মীনকেতু র পথ সহজ পথ নয়, সে নয় পুষ্পবিকীর্ণ ভোগের পথ, সে দেয় না আরামের তৃ প্তি।' নিশ্চয়ই এ কথা মানতে হবে যে 'তপতী' নাটকে মদন সম্পর্কে এই সব বৈপ্লবিক কথা রবীন্দ্রনাথের নয়, বিক্রমদেবের। কিন্তু এ যে রবীন্দ্রনাথেরও কথা তার প্রমাণবিক্রমদেবের রচিত 'মীনকেতু র স্তব'কে আত্মসাৎ করেই রবীন্দ্রনাথ 'মহুয়া' শুরু করলেন 'ভস্ম-অপমানশয্যা ছাড়ো পুষ্পধনু হে অতনু, বীরের তনুতে লহো তনু।' ১২ 'রক্তকরবী'র উপসংহারে রক্তকরবীর লাল রঙে ঘনিয়ে আসা প্রলয়সন্ধ্যা। 'ভস্মঅপমানশয্যা' ছেড়ে মৃত পুষ্পধনুর পুনর্জীবনপ্রাপ্তির মতোই যেন রঞ্জনের মৃত্যুর পর নতু ন জীবনে জেগে ওঠেন রাজা। 'রাঙা আলোর মশাল' নন্দিনী হয়ে ওঠে রাজার 'প্রলয়পথে দীপশিখা'। যুদ্ধ শুরু হয় সর্দারের সঙ্গে-তার বর্শার শিখরে কু ন্দফু লের মালা। আগেই বলা হয়েছে যে 'কু ন্দ' যক্ষরাজ কু বেরের অন্যতম টোটেম। কু ন্দশীর্ষ বর্শাটি যেন কু বেরকবলিত ইন্দ্রধ্বজের শেষ চিহ্ন। নন্দিনী বলে যায়, 'ওই মালাকে আমার বুকের রক্তে রক্তকরবীর রঙ ক'রে দিয়ে যাবে।' বর্শাদণ্ডের শীর্ষে এই রক্তপুষ্প-এই কি তবে মদনদেবতার মকরকেতন? ইন্দ্রধ্বজের কেতন ছিঁড়ে ফেলে নন্দিনী কি শেষপর্যন্ত মকরধ্বজকেই রক্তকরবী কেতনে সুন্দর করে দিয়ে গেল? একজন পুরাণ-বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, 'চৈত্র মাসের শুক্লা চতু র্দশী তিথিতে একটি দীর্ঘ বংশদণ্ডে লাল শালু জড়িয়ে মদনের প্রতীক হিসাবে পূজা করা হয়-মদনের এই প্রতীক পূজা ইন্দ্রধ্বজপূজার সাদৃশ্যে কল্পিত।'১২ মনে পড়ে যায় 'কল্পনা'র 'মদনভস্মের পূর্বে'। সেখানে যখন 'কু সুমরথে মকরকেতু উড়িত মধুপবনে' তখন 'ছড়াতো পথে আঁচল হতে অশোক চাঁপা করবী মিলিয়া যত তরুণ তরুণী'। কিন্তু মীন আর মকর-দুই-ই মদনের ধ্বজচিহ্ন বা টোটেম হলেও রবীন্দ্রনাথ সাধারণত মদনকে 'মীনকেতু 'ই বলেন। 'চিত্রাঙ্গদা' মনে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তা হলে এখানে মকরকেতু কেন? এর উত্তর মিলবে 'রক্তকরবী'র 'নাট্যপরিচয়'এ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'জেলেদের জালে দৈবাৎ মাঝে মাঝে অখাদ্য জাতের জলচর জীব আটকা

পড়ে। তাদের দ্বারা পেট-ভরা বা ট্যাঁক-ভরা কাজ তো হয়ই না, মাঝের থেকে তারা জাল ছিঁড়ে দিয়ে যায়। এই নাট্যের ঘটনাজালের মধ্যে নন্দিনী নামক একটি কন্যা তেমনিভাবে এসে পড়েছে।' যক্ষরাজ মকর নন্দিনীকে গ্রাস করতে পারেনি বলেই সে 'অখাদ্য' জাতের জলচর জীব। আর অ-খাদ্য বলেই মীন নয়, মকরই তার যোগ্যতর উপমান। কী আশ্চর্য কৌশলে রবীন্দ্রনাথ কু বের আর মদনের একই টোটেমকে এখানে দুই পরস্পরবিরোধী শক্তির সংগ্রামে মুখোমুখি করিয়ে দিলেন। আর ধনতন্ত্রের অন্তর্বিরোধের ইঙ্গিত নিয়ে সমস্ত নাটক জুড়েই তো চলতে থাকে একজাতীয় মিথের দু'মুখো দ্বৈরথ, একদিকে ইন্দ্রের জাদু অন্য দিকে যক্ষের জাদু; একদিকে ইন্দ্রের সোমরস অন্যদিকে যক্ষের 'মরণরস'; একদিকে যক্ষের টোটেম কূ র্ম অন্যদিকে বিষ্ণু র টোটেম কূ র্ম; একদিকে ইন্দ্রের সৌন্দর্যজাল অন্যদিকে যক্ষের জানালার জাল; একদিকে মকরের দাঁত অন্যদিকে বরাহের দাঁত। শেষ পর্যন্ত 'রক্তকরবী' ফু লটিও একটি নতু ন মিথ হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের নবসৃষ্ট বীর্যদীপ্ত প্রেমদেবতা মদনের মকরকেতু র পুষ্পভূ ষণ। এই মদন ইন্দ্রের সভায় লজ্জিতভাবে আর চরের বৃত্তি করেন না। প্রেমশক্তি রূপেই তিনি সৌন্দর্যময় জীবনীশক্তির প্রতিরূপ। তাই তাঁর শক্তিতেই নন্দিনী যক্ষপুরী ধ্বংস করে দেবতার অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে যায়। এখানে রবীন্দ্রনাথের মদন ইন্দ্রের অভিন্নসত্ব বন্ধু । 'রক্তকরবী' নাটক প্রকাশের বছর দুই পরে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি গান দিয়েই শেষ করা যাক 'তু মি উষার সোনার বিন্দু'। 'নন্দনেরই নন্দিনী'কে সম্বোধন ক'রে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'তু মি আকাশপারের ইন্দ্রধনু ধরার পারে নোওয়া, নন্দনেরি নন্দিনী গো চন্দ্রলেখায় ছোঁওয়া'। 'চন্দ্রলেখা' মদনের ষোড়শ শক্তির অন্যতমা। সেই চন্দ্রলেখার স্পর্শে নন্দিনীর মধ্যে ইন্দ্রধনু আর পুষ্পধনু একাকার হয়ে যায়। টীকা ১। 'বধিরতার সুখ', বিবিধপ্রসঙ্গ, ভারতী, ফাল্গুন ১২৮৮ ২। 'বিস্মৃতি', ধর্ম, ভারতী, চৈত্র ১২৯০ ৩। Herbert Read, Collected Essays in Literary Criticism, London, 1938, p. 101. ৪। 'কবি য়েটস', পথের সঞ্চয়, প্রবাসী, কার্তিক ১৩১৯ ৫। হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, তৃ তীয় পর্ব, কলকাতা, ১৯৮৬, পৃ. ৩৯৬ ৬। ভারতী, শ্রাবণ ১৩০৫

৭। তদেব ৮। য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি, ২২ আগস্ট ১৮৯০ ৯। জাপান-যাত্রী, ১১ সংখ্যক অধ্যায় ১০। Sir James George Frazer, The Golden Bough, abridged edition, London, 1983, p. 902. ১১। Alfred Hillebrandt, Vedic Mythology, tr. by S. Rajeswara Sarma, vol. II, Delhi, 1990, pp. 114-15. ১২।দ্র. টীকা সংখ্যা ৫, পৃ. ৩৬৭।

'রক্তকরবী' শিশিরকু মার এবং একটি জিজ্ঞাসা অনিল মুখোপাধ্যায় ১৯২৩ সালে গ্রীষ্মের সময় শিলং-য়ে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কবে 'রক্তকরবী' প্রথম পাঠটি লিখতে শুরু করেছিলেন, কতদিনে শেষ করেছিলেন, মুদ্রিত হওয়ার আগে কতবার তিনি নাটকটি পরিমার্জনা করেছিলেন, কতসংখ্যক খসড়ায় নাটকের শেষতম নামটি রেখেছিলেন 'রক্তকরবী', নাটকের অন্তর্নিহিত কর্মটি ঠিক কী এবং তার উৎসই বা কী, নাটকটিকে রচয়িতা কথিত 'সত্যমূলক' বলে মান্য করা হবে কিনা, নাটকটিকে সাংকেতিক, প্রতীকী বা রূপক বলা হবে কিনা, রূপক হলেও তার কত অংশই বা রূপক, নন্দিনীরই বা প্রকৃ ত অর্থ কী-এই নিয়ে পণ্ডিতদের অন্বেষণার অন্ত নেই এবং বলা বাহুল্য যে কোনো মহৎ নাট্যসৃষ্টি ক্ষেত্রের মতো-যেমন শেকসপিয়রের নাটকের ক্ষেত্রে, এ অন্বেষণা চলতেই থাকবে। এইসব এবং এইরকম নানা মত থাকলেও একটা বিষয়ে দ্বিমত নেই, শম্ভু মিত্রের 'রক্তকরবী' মঞ্চায়ন এখনও পর্যন্ত সার্থকতম বলে মান্যতা প্রাপ্ত। মঞ্চায়ন প্রসঙ্গেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছানুযায়ী শিশিরকু মারের নাম শোনা যায় নাটকের পাণ্ডুলিপি অবস্থাতেই। আবার শ্রীমিত্রের কিংবদন্তী মঞ্চায়নের আলোচনাকালেও শোনা যাবে শিশিরকু মারের নাম, শোনা যাবে 'রক্তকরবী' নাটক অভিনয় করা সম্পর্কে তাঁর যোগ্যতার অভাবের কথা এবং ব্যাপকভাবে প্রচারিত আরও একটি 'কথা', তিনি 'রক্তকরবী'কে নাটক বলেই মনে করেননি। শুধু তাই নয় অনৈতিকভাবে শ্রীমিত্রকে তিনি নাটকটি মঞ্চায়ন করা থেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। বর্তমান প্রবন্ধে এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা হল।

বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চের সূচনা পর্ব থেকেই রবীন্দ্রনাথের নাটকের অভিনয় শুরু হয়েছে বটে কিন্তু তখনকার অভিনয় ও প্রয়োগ-পদ্ধতি তাঁর পছন্দের তো ছিলই না বরং এককালে এই নিয়ে তিনি প্রচু র উপহাস করেছেন। বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চ সম্বন্ধে তাঁর যা কিছু উৎসাহ তার সূত্রপাত নট ও নাট্যপ্রয়োগ-শিল্পী শিশিরকু মারের মাধ্যমেই। বস্তুত, শিশিরকু মারের জীবনে রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য, স্নেহ, পৃষ্ঠপোষকতা একটি অনালোচিত মূল্যবান বিষয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শিশিরকু মারের সাক্ষাৎ পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত কখন এবং কীভাবে তার কোনো তথ্য নেই, থাকার কথাও নয়। তবে প্রাক-অভিনয় পর্বেও শিশিরকু মার যে রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ অচেনা ছিলেন না সে তথ্য আছে। রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশতম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ' আয়োজিত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানে 'ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট'-এর জুনিয়ার মেম্বাররা 'বৈকু ণ্ঠের খাতা' নাটকটি অভিনয় করেন। অভিনয় দেখে রবীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউটের অন্যতম সভ্য অমল হোমকে একটি পত্রে জানান, 'তোমার ইনস্টিটিউটের বন্ধু দের জানিও তাঁদের অভিনয় আমার খুব ভাল লেগেছে।... কেদার আমার ঈর্ষার পাত্র একদা ঐ পার্টে আমার যশ ছিল।' কেদারের পার্ট করেছিলেন শিশিরকু মার। আবৃত্তিকার হিসাবেও তখন শিশিরকু মারের খুব সুনাম, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের কবিতা। তাঁর কাছে শুনেছি, 'তখন রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আবৃত্তিযোগ্য কবিতা কোথায়। আমি প্রবাসী পত্রিকার প্রেসের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ছাপা হলেই সেই পাতাটি সংগ্রহ করে হাতেগরম কবিতা আবৃত্তি করতাম।' এছাড়া 'ভারতী' পত্রিকা গোষ্ঠীর তরুণ লেখকরা ছিলেন রবীন্দ্রস্নেহধন্য, রবীন্দ্রভক্ত। এই গোষ্ঠীর প্রায় সকলেই, বিশেষ করে অবনীন্দ্রনাথের জামাতা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন শিশিরকু মারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং শিশিরকু মারের নাট্যসাধনার অন্যতম প্রধান সহায়ক। অসম্ভব নয়, গুণগ্রাহী বন্ধু মণিলাল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শিশিরকু মারের পরিচয়ের নেপথ্য সহায়ক হয়ে থাকবেন। শিশিরকু মারের নাম রবীন্দ্রনাথের কানে পৌঁছানোর আরও একটি সম্ভাব্য কারণ ঘটেছিল-শিশিরকু মারের পেশাদার অভিনেতা হিসাবে সাধারণ রঙ্গমঞ্চে যোগ দেওয়া। কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে সাধারণ রঙ্গমঞ্চে যোগ দেওয়ার ঘটনাটি তখনকার দিনে শিক্ষিত সমাজে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা এবং বাংলা রঙ্গমঞ্চের পক্ষে শুভলক্ষণ বলে পরিগণিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের 'সীতা' নাটক দেখতে যাওয়ার প্রসঙ্গে মণিলাল লিখেছেন, '...শিশিরকু মার বাংলা রঙ্গালয়ের উন্নতির উদ্যোগে লিখেছেন এই ব্যাপারটিকে রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেশের নাট্যকলার পক্ষে বিশেষ আশাপ্রদ শুভলক্ষণ বলে মনে করেন। সেইজন্যে সীতা অভিনয়ে কতটু কু কি করে তু লতে পেরেছেন তাই দেখার আগ্রহে তিনি মনোমোহন নাট্যমন্দিরে গিয়েছিলেন, নইলে বাংলা থিয়েটার দেখবার তাঁর কোনরকম উৎসাহই নেই সে আমি ভালরকম জানি।'

আমরা দেখব 'সীতা' অভিনয় দেখার পরেই রবীন্দ্রনাথ শিশিরকু মারকে 'রক্তকরবী' অভিনয় করার ভার দিচ্ছেন। মনে হয় কেবলমাত্র একটি অতি সাধারণ নাটকের একটিমাত্র প্রয়োগকর্ম এবং অভিনয় দেখে নয়, উপরিউক্ত সব ঘটনাগুলি মিলিয়ে শিশিরকু মারের ক্ষমতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের একটা আস্থা জন্মেছিল। রবীন্দ্রনাথের 'সীতা' নাটকের অভিনয় দেখাকে কেন্দ্র করে সেই সময়ে স্টার রঙ্গমঞ্চে অভিনয়তে 'আর্ট থিয়েটার'-এর অপপ্রচার এবং তৎসম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না পেলে আমরা জানতে পারতাম না যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ 'রক্তকরবী' অভিনয়ের ভার শিশিরকু মারকে দিয়েছিলেন। সুতরাং ঘটনাটি সম্পর্কে কিছু আলোকপাত প্রয়োজন। 'ম্যাডান'দের থিয়েটারের সংস্রব ছেড়ে নিজের সম্প্রদায় গঠন করে শিশিরকু মারের প্রথম প্রযোজনা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাট্যকাব্য 'সীতা'। উপস্থাপনা ইডেন গার্ডেনের মেলায় (১৯২৩) এক ক্ষণস্থায়ী রঙ্গমঞ্চে। প্রত্যক্ষদর্শী শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (নাট্যকার) সেই অভিনয়ের বিবরণ দিতে গিয়ে তাঁর 'বাংলার নাটক ও নাট্যশালা' গ্রন্থে লিখেছেন, '...শিশিরকু মার একেবারে ঝড় বইয়ে দিলেন এই অভিনয় দিয়ে।' স্বাভাবিকভাবেই শিশিরকু মার চেয়েছিলেন এই তৈরি নাটক দিয়ে শহরের কোনো স্থায়ী রঙ্গমঞ্চে তাঁর নিজস্ব সম্প্রদায় নিয়ে অভিনয় শুরু করবেন কিন্তু আর্ট থিয়েটারের কিছু লোকের কারসাজিতে দ্বিজেন্দ্রলালের 'সীতা' তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেল, তখন নাম না জানা লেখক যোগেশচন্দ্র চৌধুরীকে দিয়ে নতু ন করে 'সীতা' লিখিয়ে নিয়ে 'মনোমোহন নাট্যমন্দির'-এ অভিনয় শুরু করলেন (২১ শ্রাবণ ১৩৩১ ইং ৫ আগস্ট ১৯২৪)। এই 'সীতা' নাটকের প্রযোজনা বাংলা থিয়েটারে আধুনিক যুগ প্রবর্তনকারী বলে কীর্তিত। 'সীতা' নাটকের প্রয়োগপদ্ধতি, অভিনয়, নাট্যমন্দিরের আবহাওয়া, অন্যান্য থিয়েটারের ওপর তার প্রভাবএসব নিয়ে তৎকালে অনেক আলোচনা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শী অচিন্ত্যকু মার সেনগুপ্তের অভিজ্ঞতার একটি বাক্যাংশ উদ্ধৃ ত করা হল-'সে সব দিনের 'সীতা' একটা জাতীয় মহাঘটনা।' সত্যিই আজ পর্যন্ত কোনো বাংলা নাটকের প্রযোজনা/অভিনয় সর্বস্তরে এত আলোড়ন সৃষ্টি করেনি, আপামর জনসাধারণের কাছে কোনো নাটক এত জনপ্রিয় হয়নি। রবীন্দ্রনাথের পরিবারে সকলে, ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ সাহিত্য ও সংস্কৃ তি জগতের গণ্যমান্যরা 'সীতা' দেখে মুগ্ধ। এঁদের মাধ্যমে অভিনয়ের অকু ণ্ঠ প্রশংসা রবীন্দ্রনাথের কানে গিয়েও পৌঁছাল; তিনি শরৎচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে সম্পূর্ণ নাটকটি নিবিষ্ট হয়ে দেখলেন (রবিবার ১ ভাদ্র ১৩৩১ ইং ৭ আগস্ট ১৯২৪)। এই তাঁর প্রথম অন্য কোনো নাট্যকারের লেখা নাটকের অভিনয় দেখা প্রথম। 'রক্তকরবী' তখনও পাণ্ডুলিপি অবস্থায়।

একসময়ে বাংলা থিয়েটারে পরস্পরের রেষারেষি একটি পরিচিত ব্যাপার। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক কারণেই নয়, নানা ব্যক্তিগত গূঢ় কারণেও তা ঘটত এবং সময়ে সময়ে সে রেষারেষির মাত্রা মানবতার সীমা অতিক্রম করে যেত। 'সীতা' নিয়ে আবির্ভাবের সূচনা থেকেই আর্ট থিয়েটার নানাভাবে শিশিরকু মারের প্রতিকূ লতা সৃষ্টি করেছে। রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষের কোনো একটি নাটক দেখে প্রশংসা করা একজন নট/প্রয়োগশিল্পীকে আশাতীত উচ্চআসনে প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষে যথেষ্ট। ঈর্ষাকাতর হয়ে আর্ট থিয়েটার ব্যঙ্গবিদ্রূপ সহকারে প্রবল বিক্রমে প্রচার করতে শুরু করল যে 'সীতা'র অভিনয় রবীন্দ্রনাথের মোটেই ভালো লাগেনি, ভদ্রতার খাতিরে প্রকাশ্যে তিনি কিছু বলেননিইত্যাদি। এই মিথ্যা নিন্দা-প্রবাহের সংবাদ রবীন্দ্রনাথও জানতে পারলেন; বিচলিত হয়ে নিজে কাগজে কিছু না লিখে প্রতিবাদের ভার দিলেন মণিলালকে। যে চিঠিতে মণিলালকে তিনি এই দায়িত্ব দিলেন তার উদ্ধৃ তি এইরকম 'কল্যাণীয়েষু, কাগজে নিজের জবানীতে অভিনয় সম্বন্ধে কিছু লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তু মি লিখে দিতে পার যে শিশির ভাদুড়ীর প্রয়োগনৈপুণ্যে আমার বিশেষ শ্রদ্ধা আছে, সেই কারণেই ইচ্ছাপূর্বক আমার দুইএকটা নাটক অভিনয়ের ভার তাঁর হাতে দিয়েছি। 'সীতা'বইটিকে আমি একটু ও পছন্দ করিনে-ওটা নাটকই নয়-এই জন্যই এ নাটক অবলম্বন করে অভিনয়ের উৎকর্ষ দেখান কঠিন-তৎসত্বেও শিশিরবাবু নিজের ক্ষমতার জোরে এই বইটিকেও চালিয়ে দিতে পেরেছেন। তু মি আমার কাছ থেকে এসব কথা শুনেছ লিখে দিতে পার। ইতি ১২ই ভাদ্র ১৩৩১। রবিদাদা।' রবীন্দ্রনাথ 'ইচ্ছাপূর্বক' কোন কোন নাটক অভিনয়ের ভার শিশিরকু মারের হাতে দিলেন চিঠিতে তার উল্লেখ নেই বটে কিন্তু 'দুই-একটা' নাটকের মধ্যে একটি যে 'রক্তকরবী'সে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তৎকালীন সম্ভ্রমশালী প্রখ্যাত নাট্যপত্রিকা 'নাচঘর'-এর ১৩ ভাদ্র ১৩৩১ (ইং ৩০ আগস্ট ১৯২৪) সংখ্যায় প্রকাশিত নিম্নরূপ সংবাদ-সূত্রে '...রসিক সমাজকে আজ আমরা একটি আনন্দ সংবাদ দিতে চাই। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুগ্রহে শিশিরকু মার তাঁর নূতন ও অপূর্ব্ব নাটক 'রক্তকরবী' অভিনয় করার অনুমতি পেয়েছেন। নাটকখানি শীঘ্রই 'প্রবাসী'র পত্রে আত্মপ্রকাশ করবে; তা পাঠ করলে সকলেই বুঝতে পারবেন যে এ শ্রেণীর নাটক বাংলা রঙ্গালয়ে আর কখনো অভিনীত হয়নি এবং শীঘ্রই হতও কিনা সন্দেহ, কারণ প্রকাশ্য রঙ্গালয়ে এখন এরকম নাটক অভিনয় করে সফল করার শক্তি, সাহস ও প্রতিভা আছে একমাত্র শিশিরকু মারেরই। পরন্তু 'রক্তকরবী'র অভিনয়ও শিশিরকু মার যদি তাঁর অসাধারণ যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেন তবে বাংলার নাট্যজগতে যথার্থই নবযুগের প্রবর্তন হবে। আমরা সাগ্রহে মাহেন্দ্রক্ষণের প্রতীক্ষায় রইলুম।'

তাঁর 'সীতা' অভিনয় দেখা নিয়ে আর্ট থিয়েটারের মিথ্যা প্রচারে উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ মণিলালকে আরও একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটির সংশ্লিষ্ট অংশ এইরকম 'কল্যাণীয়েষু মণিলাল, আমি শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলুম যে, 'সীতা' অভিনয়ের পর আমার নাম নিয়ে কোন কোন লোক নিন্দা রটনা করছে। যদি প্রয়োজন হয় তু মি জানাতে পার যে তাদের কারোর সঙ্গে আমার কোনো রকম আলাপমাত্রই হয়নি এবং শিশিরকে আমি ক্ষমতাশালী লোক বলেই জানি। আমি বিদেশে যাচ্ছি, আমার আশঙ্কা হচ্ছে আমার অনুপস্থিতি কালে এইরূপ মিথ্যা রটনা প্রশ্রয় পাবে। তোমার উপর ভার রইল তু মি এদের মিথ্যাচারণের প্রতিবাদ করবে। ইতি ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯২৪, শুভানুধ্যায়ী শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র।' নাটক 'রক্তকরবী' জটিল এবং সাধারণ রঙ্গমঞ্চে প্রচলিত নাটকের তু লনায় যে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী এ কথা রবীন্দ্রনাথ বিলক্ষণ জানতেন। (শিশিরকু মারের কাছে শুনেছি, রবীন্দ্রনাথ 'রক্তকরবী'কে মজা করে বলতেন 'শক্তকরবী') তা সত্বেও নিজে অভিনয় না করে ইচ্ছাপূর্বক শিশিরকু মারকে অভিনয় করার ভার দিলেন। নিশ্চয় তিনি শিশিরকু মারকে খুশি করার জন্য দেননি। এর একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে, তাঁর মতো মানুষের না জানার কথা নয় নাটকের শেষবিচার অভিনয়ে। সব নাট্যকারই অভিনয়ের মাধ্যমে জনসংস্রব কামনা করে। রবীন্দ্রনাথ দেখতে চেয়েছিলেন নিমন্ত্রিত বাছা বাছা দর্শক নয়, তাঁর এই অভিনব রূপের নাটকটি সাধারণ দর্শক কেমনভাবে গ্রহণ করে এবং শিশিরকু মারই সে বিষয়ে যোগ্যতম ব্যক্তি তাতে তাঁর অন্তত কোনো সংশয় ছিল না। তৎকালীন তথ্যও সাক্ষ্য দেবে শিশিরকু মারের ক্ষমতা সম্বন্ধে তাঁর এ বিশ্বাসের কোনো দিন পরিবর্তন হয়নি। 'রক্তকরবী' অভিনয়ের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ 'প্রবাসী' সম্পাদককে একটি চিঠি লেখেন। চিঠির বয়ান এইরকম, 'যক্ষপুরী নাটকটি প্রবাসীর পূজা সংখ্যায় প্রকাশ না করিয়া ফাল্গুন বা চৈত্র মাসে যদি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন তবে ভাল হয়। অভিনয়ের পূর্বে আমি উহা বাহির করিতে ইচ্ছা করিনা'। (উদ্ধৃ তি সূত্র 'রঙ্গমঞ্চ ও রবীন্দ্রনাথ' লেখক রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী) গবেষক জানাচ্ছেন চিঠির তারিখ ১৯ ভাদ্র ১৯৩০ অর্থাৎ 'আত্মীয়সভা'য় পড়ারও আগে এই চিঠি। গবেষকের তারিখ যদি ঠিক হয় তবে এই অভিনয় ভাবনার সঙ্গে শিশিরকু মারের কোনো যোগ নাই। তবে নাটকটি শিশিরকু মার কর্তৃক অভিনয় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ নিয়ে আরও একটু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে 'নাচঘর'-এর ২২ ফাল্গুন ১৩৩১ (মার্চ ১৯২৫) সংখ্যায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে। সংবাদের সংশ্লিষ্ট অংশ এইরকম '...এবার সমুদ্রযাত্রার কিছুপূর্বে রবীন্দ্রনাথ বর্তমান বঙ্গের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা শিশিরকু মার ভাদুড়ীকে ডেকে তাঁর 'রক্তকরবী' নাটক পড়ে শুনিয়েছিলেন। আমাদের যতদূর স্মরণ হচ্ছে শিশিরকু মার নাটকখানি অভিনয় করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন। 'রক্তকরবী' নাটক

অভিনয়ের কি হলো?' (১৯২৪ সেপ্টেম্বর ১৯ তারিখে রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণ আমেরিকা যাত্রা করেন। এই বিদেশ যাত্রার কথাই তিনি মণিলালকে ১৩ সেপ্টেম্বর তারিখে লেখা তাঁর দ্বিতীয় চিঠিতে উল্লেখ করেছেন।) অনুমান করা অসঙ্গত নয় কালবিলম্ব না করে শিশিরকু মার 'রক্তকরবী' মঞ্চায়নের কথা ভেবেছিলেন। তাই প্রযোজনা-প্রস্তুতির সহায়তার জন্য বিদেশযাত্রার আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডেকে নাটকটি পড়ে শুনিয়ে দিয়েছিলেন। তবে অনুমান যাই করা হোক, নাটকটি কিন্তু মঞ্চায়িত হল না উৎসাহী গুণগ্রাহীদের সাগ্রহ প্রতীক্ষা বিফলে গেল। 'রক্তকরবী' প্রযোজনার আলোচনা প্রসঙ্গে কেউ কেউ শিশিরকু মারের ব্যর্থ হওয়ার কারণ সম্বন্ধে মনে করেছেন শিশিরকু মার (১) নিজে বুঝতে পারেননি বলে নাটকটি তাঁর কাছে দুর্বোধ্য ঠেকেছিল, (২) দর্শক নাটকটি বুঝতে পারবে না, থিয়েটারে লোকসান হবে অতএব শিশিরকু মার অভিনয়ের ঝুঁকি নিতে চাননি। প্রথম মন্তব্যটি সম্বন্ধে বলা যায়, শিশিরকু মার যথেষ্ট শিক্ষিত লোক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সহ তৎকালীন বিদগ্ধ সমাজ সাহিত্য বা নাটক সম্পর্কে তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্বন্ধে কেউ সংশয় প্রকাশ তো করেনই-নি, বরং শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেছেন। নিজে পাঠ করে এবং রবীন্দ্রনাথের পাঠ শোনার পরেও নাটকটি তিনি বুঝতে পারলেন না এতখানি নিরেট লোক ছিলেন শিশিরকু মার! তবে 'রক্তকরবী' নাটকটি যে দুর্বোধ্য, প্রবাসীতে প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকদের অন্তত একটা বড়ো অংশের মনে এমন ধারণা হয়েছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় 'নাচঘর'এ নরেন্দ্র দেবের লেখা চিঠি থেকে। চিঠিটির সংশ্লিষ্ট অংশ এইরকম '...এদেশে ভাল নাট্যকার একাধিক এখনও জন্মায়নি।... আর যিনি জন্মেছেন তাঁর লেখা বোঝবার ক্ষমতা আমাদের নেই। এই দেখুন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকু রের 'রক্তকরবী' বইখানা শিশিরবাবু অভিনয় করবেন ঠিক করেছেন শুনেছি কিন্তু বইখানা সম্বন্ধে ইতিমধ্যে লোকে রায় দিয়েছে যে ওটা দুর্বোধ্য নাটক। নরেন্দ্র দেব ১৭ আশ্বিন ১৩৩১।' সাধারণভাবে অবশ্য একথা মানতে হয় সাধারণ রঙ্গমঞ্চের মতো একটি গুরুভার প্রতিষ্ঠানে আর্থিক দায়ের প্রশ্ন আসে, কারণ অন্যান্য খরচ বাদ দিয়েও কম করে ৬০/৭০ জন লোককে বেতন দিতে হয় এবং সে টাকাটা জোগায় টিকিট কেটে থিয়েটার দেখা দর্শকরা। (ব্যাপারটা এখন এত সুদূরের যে ওটা ধর্তব্য বলে আমাদের মনেই হয় না) কিন্তু বিক্রি বেশি হবে বিবেচনা করে দর্শকদের পছন্দমাফিক জমিয়ে দেওয়ার মতো নাটক কি শিশিরকু মার কোনোদিন করেছেন? তাঁর নাটক নির্ধারণ সম্পর্কে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায়, তাই যদি তিনি করতেন তবে দৈন্যদশায় তাঁর জীবন শেষ হত না। থিয়েটারে অর্থকরী

বিষয়ে শিশিরকু মারের মানসিকতা সম্পর্কে শম্ভু মিত্র তাঁর 'সন্মার্গ-সপর্যা' গ্রন্থের 'স্মরণে' অংশে বলেছেন '...চারদিকের এই নিষ্ঠাহীন পেশাদার লোলুপতার মধ্যে তিনিই ছিলেন একটি অনমনীয় লোক যার পা দিয়ে পয়সা ছুঁড়ে ফেলতে কোনো দ্বিধা হতো না-অদ্ভু ত লোক।' অদ্ভু তই তো, বাংলা থিয়েটারে শিশিরকু মার এক ব্যতিক্রমী প্রক্ষিপ্ত চরিত্র। থিয়েটারি ব্যবসার গজকাঠি দিয়ে তাঁকে মাপতে যাওয়া ভু ল ও অনুচিত। রবীন্দ্রনাথের নাটকের প্রতি শিশিরকু মারের শ্রদ্ধা ও অনুরাগ যে কত গভীর ছিল তা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর এই উক্তিতে '...রবীন্দ্রনাথের যেসব নাটক অভিনয় করেছি তার প্রত্যেকটি কথা উচ্চারণ করেও আনন্দ পেয়েছি। অভিনয় করার জন্য ঠিক তেমন কথার হয়তো দরকার ছিল না কিন্তু ওটা অতিরিক্ত আনন্দ। সে আনন্দ একেবারে আমার সকল স্নায়ুর আনন্দ।' (উদ্ধৃ তি সূত্র 'দ্বিতীয় স্মৃতি', পরিমল গোস্বামী)। কবি নিজে একটি নাটক অভিনয় করার জন্য তাঁর হাতে তু লে দিলেন তার মূল্য যে 'রবীন্দ্রভক্ত রবীন্দ্রস্নেহধন্য' (ঊর্ধ্ব কমা চিহ্নিত বিশেষণটি ব্যবহার করেছেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য) শিশিরকু মারের কাছে কত অপরিসীম, শিশিরকু মারের সঙ্গে সামান্য মেশারও সুযোগ যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা তা উপলব্ধি করেছেন। সেই শিশিরকু মার পয়সা রোজগার হবে না বলে 'রক্তকরবী' করবেন না-এমন চিন্তা সুবিচার নয়। শিশিরকু মার 'রক্তকরবী' করতে পারেননি ঠিকই কিন্তু তার কারণ নির্ণয়ে সমালোচকদের কাছ থেকে আরও একটু সতর্ক মন্তব্য তাঁর প্রাপ্য। শিশিরকু মার 'রক্তকরবী' অভিনয় করতে ব্যর্থ হওয়াতে নাটকটির অভিনয় সম্পর্কে আগ্রহী কিছু লোকের হয়তো আশাভঙ্গ হয়েছিল কিন্তু কোনো আলোড়ন হয়নি-হওয়ার কথাও নয়। সুতরাং তাঁর ব্যর্থ হওয়ার কারণ সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে তাঁর সম্প্রদায়ে নন্দিনী করার মতো উপযুক্ত শিল্পী ছিল না বলে যে তখন শিশিরকু মার 'রক্তকরবী' প্রযোজনায় হাত দিতে পারেননি, সরাসরি না হলেও এমন একটি তথ্যের আভাষ আমরা পাই শিশিরকু মারের খুব ঘনিষ্ঠ সহযোগী মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের 'নট ও দেহপট' শীর্ষক একটি প্রবন্ধে। মনোরঞ্জনবাবু তাঁর প্রবন্ধে এক জায়গায় লিখছেন, '...রক্তকরবী পড়ে শোনাবার সময় রবীন্দ্রনাথ শিশিরকু মারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন নন্দিনীর ভূ মিকা বিশ্বনাথকে (শিশিরকু মারের ভাই বিশ্বনাথ ভাদুড়ী) দিয়ে অভিনয় করবার জন্য'। 'রক্তকরবী' সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে শিশিরকু মারও এই কারণের কথা বলেছিলেন। (এ সম্পর্কে তাঁর বলা আরও কিছু কথার উল্লেখ প্রবন্ধের যথাস্থানে করব) রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ কিন্তু আমাদের মনে কৌতূ হল উদ্রেক করে। শান্তিনিকেতনে তাঁর নিজের প্রযোজনায় কিংবা কলকাতার শখের দলের হলেও না হয় কথা ছিল কিন্তু সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অদৃষ্টপূর্ব একটি ব্যতিক্রমী নাটকের জন্যে এমন একটি পরামর্শ তিনি দিলেন কেন। এর একমাত্র ব্যাখ্যা এই হতে পারে রবীন্দ্রনাথ একান্তভাবে

দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর এই অভিনয় নাটকের ফলিত রূপ কিরকম দাঁড়ায়। শিশিরকু মারও বলেছিলেন, 'রক্তকরবীর অভিনয় দেখার জন্য কবি খুব ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন।' কিন্তু ঘটনা হল, দাতা ও গ্রহীতার আগ্রহ সত্বেও শিশিরকু মারের দ্বারা 'রক্তকরবী'র অভিনয় করা সম্ভব হল না কোনো দিন নয়। 'রক্তকরবী'র সার্থক রূপারোপ ঘটল রচনার ত্রিশ বছর পরে শম্ভু মিত্রের প্রতিভার স্পর্শে। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় নাট্যোৎসবে 'রক্তকরবী' অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ প্রযোজনার সম্মান লাভ করার পর 'রক্তকরবী'র প্রথম অভিনয় হল রঙমহল থিয়েটারে (ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫)। অভিনয়ের বিজ্ঞাপনে অন্যান্য সংবাদের মধ্যে ' Produced by ' বলে কোন এক ' INDRANI ' -র নাম বিজ্ঞাপিত হয়েছিল। রঙমহলে এমন একটি অভিনয়ের সংবাদ হয়তো তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, তাই কোথাও এ অভিনয়ের সংবাদ দেখা যায় না-এমনকি 'বহুরূপীর ইতিহাস' গ্রন্থেও না। আমি এই অভিনয়টি আগাম টিকিট কেটে দেখেছিলাম। ১৯৪৫ থেকে আমি নানা মঞ্চে অভিনয় দেখেছি, শ্রীরঙ্গমে তখন আমার অভিনয় করা হয়ে গেছে তিন বছরের কিছু বেশি সময়। 'রক্তকরবী'র মতো ওরকম দৃশ্যপট বাংলা থিয়েটারে দেখিনি আর আকাশে রক্তমেঘ উড়ে যাচ্ছে দেখে আমার চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠেছিল। সে এক অভিজ্ঞতা। অন্য এক কারণেই এই অভিনয়টি দেখা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অভিনয় দেখার সূত্রেই শিশিরকু মারের 'রক্তকরবী' পাঠ এবং সঙ্গে কিছু আলোচনা শোনার দুর্লভ সৌভাগ্য হয়েছিল। ঘটনাটা বলি। নানা প্রসঙ্গে 'রক্তকরবী' নাটকের কথা শিশিরকু মারের কাছে আমরা শুনতাম, সেই 'রক্তকরবী' অভিনয় দেখলাম, ঘটনাটি জানাবার জন্যে অভিনয় শেষ হতেই সোজা চলে গেলাম শ্রীরঙ্গম। সোমবার, রিহার্সাল বন্ধ। শিশিরকু মার যথারীতি নিবিষ্ট মনে বই পড়ছিলেন তাঁর ঘরে। যেতেই প্রশ্ন করলেন, 'কি হে এত রাত্তিরে!' বললাম, 'রক্তকরবী' দেখে এলাম রঙমহলে। তৎক্ষণাৎ বই নামিয়ে বললেন, 'রঙমহলে? কীরকম দেখলে বল।' খুব মন দিয়ে শুনলেন, বললেন না বিশেষ কিছু। শুধু দৃশ্যপট সম্বন্ধে বললেন 'যখন প্রবাসীর 'রক্তকরবী' ছাপা হয় তখন গগনবাবুর আঁকা ঐ ধরনের একটা ছবি ছাপানো হয়েছিল।' আলোর কথা শুনে বললেন 'তাই নাকি!' আমাদের খুব ইচ্ছা, শিশিরকু মারের 'রক্তকরবী' পাঠ শোনার। জানতে পারলাম দুএক জায়গায় 'রক্তকরবী' পড়ে শুনিয়েছেনও। অনুরোধ করায় তেমন গা করলেন না; কয়েকমাস পরে একদিন হঠাৎই পড়লেন নিজের ইচ্ছেতেই। শ্রোতা মাত্র কয়েকজন, তাঁর দুই ভাই মুরারিমোহন ও ভবানীকিশোর, শ্রীরঙ্গমের অভিনেতাদের মধ্যে বিনয় মিত্র আর

আমি এবং সুরেশ চৌধুরী (শিশিরকু মারের কাছে যাঁরা নিত্য আসতেন তাঁর কথা শুনতে সুরেশবাবু তাঁদের মধ্যে একজন। পড়াশোনা করতেন, হিন্দি এবং উর্দু দুটো ভাষা ভালোরকম জানতেন। 'তু লসীদাস' বলে সুরেশবাবুর লেখা একটি নাটক শিশিরকু মার শ্রীরঙ্গমে মঞ্চস্থ করেছিলেন)। শিশিরকু মারের বইটি অনেক দিনের পুরোনো, সাধারণ সাইজের বই-এর চেয়ে আকারে বড়ো। বইয়ের শেষে বাড়তি কিছু কাগজের পাতা লাগানো, বাঁধাই করা। মার্জিনে কিছু কিছু লেখা দেখতে পেলাম। বই খোলার সময় ধীরে ধীরে বললেন, 'রবীন্দ্রনাথ বলতেন, এ তো রক্তকরবী নয় শক্তকরবী।' পড়লেন একটানা, নাটকের চরিত্রগুলির নাম বললেন একবার মাত্র। কিন্তু চরিত্র অনুযায়ী কণ্ঠস্বরে ব্যবহারে পড়ার ভঙ্গিতে বুঝতে কোনো অসুবিধে হচ্ছিল না কোনটা কে। নাটকের শুরুতেই কিশোরের 'নন্দিনী, নন্দিনী' ডাক শুনেই চমকে উঠলাম। অন্যান্য চরিত্র এবং নেপথ্য থেকে বেরিয়ে এসে রাজার অংশ পাঠের কথা কি বলব, তাঁর নন্দিনীর পাঠ শুনে মনে হল এমন নন্দিনী না হলে সত্যি 'রক্তকরবী' করা যায় না। অভিনয়ের বর্ণনা যেমন কালিকলমের আঁচড়ে প্রকাশ করা যায় না, শিশিরকু মারের 'রক্তকরবী' পাঠের সে বর্ণনা দেওয়াও আমার সাধ্য নয়। তাঁর পাঠে নাটকের সম্পূর্ণরূপ দাঁড়াল অমানুষিক নির্মমতার, বীজসত্তার। শিশিরকু মার বললেন এ নাটকের অভিনয় দেখে দর্শকের মনে horror -এর সৃষ্টি হবে। (উৎপল দত্তও বলেছেন, 'রক্তকরবী' হচ্ছে একটি হরর প্লে।' অনুসন্ধিৎসু পাঠক, শ্রীদত্তের বক্তব্যের সম্পূর্ণ অংশের জন্য ১৯৯৩-র 'গণশক্তি'র শারদ সংখ্যা দেখতে পারেন) আমি বহুরূপীর 'রক্তকরবী' একাধিকবার দেখেছি, দেখে মুগ্ধ হয়েছি। শম্ভু মিত্রের এই অনবদ্য রূপকর্ম সম্পর্কে এখনও আমি সম্ভ্রম বোধ করি কিন্তু শিশিরকু মারের পাঠ শুনে আমাদের যে horror -এর অনুভূ তি হয়েছিল বহুরূপীর সাজানো গোছানো প্রযোজনায় ঠিক তা পাইনি। নাটক পড়া ছাড়া প্রযোজনা নিয়ে বলেছিলেন সামান্য কিছু কথা। তিনি যা বলেছিলেন তা মোটামুটি এইরকম, 'খোলা মঞ্চে কোনো দৃশ্যপট ছাড়াই 'রক্তকরবী' করার কথা ভাবা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের নাটকগুলির জন্য কোনো আঁকা দৃশ্যপটের প্রয়োজন হয় না। স্থানের ইঙ্গিত নাটকেই আছে, ঠিকমতো অভিনয় করতে পারলে স্থানের ধারণা দর্শক নিজেই করে নিতে পারবে-যেমন আমাদের যাত্রাপালায় হয়। নাটকের সমস্ত ঘটনা ঘটছে যক্ষপুরীর রাজার প্রাসাদ ঘিরে একটা জালের আবরণের সামনে। এর অর্থটা হচ্ছে ঐ জালের বেড়া ভেদ করে কেউ যেন রাজার কাছে পৌঁছাতে না পারে। ঐ জালটা বাস্তবে না দেখালেও চলে। জালটা হচ্ছে রাজা বা রাজতন্ত্রের তৈরি একটা জটিল 'সিস্টেম', যার আড়ালে আছে এক অদৃশ্য মালিক, সাধারণের সুখ-দুঃখের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষকে সে নির্মমভাবে শোষণ করে প্রকৃ তির সম্পদকে নির্বিকারে লুণ্ঠন করে

নিজেদের স্ফীত হওয়ার লালসায়। সেই রাজা কথা বলবে একটা যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে। খোলা মঞ্চে করার সুযোগ ছিল না, করলে থিয়েটারের স্টেজেই করতে হত। তবে আমি সামনের কার্টেন তু লে রাখতাম, দর্শক অডিটোরিয়ামে ঢু কে প্রথমে ফাঁকা স্টেজ দেখত। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অভিনয় করা নিয়ে সামান্য যতটু কু আলোচনা হয়েছিল তাতে খোলা মঞ্চে অভিনয় করার কথাই হয়েছিল। আর at all যদি দৃশ্যপট সাজিয়েই করতে হত তবে যতটা সম্ভব বাস্তব ঘেঁষা দৃশ্যপট দিয়েই করতাম। যেমন কোনো কয়লাখনি অঞ্চলে একটা ভয় পাওয়ানো চিত্র দেখা যায়। নাটকেও হয়তো কিছু পরিবর্তনের দরকার হত। তবে 'রক্তকরবী' নিয়ে ভাবনাটা প্রাথমিক স্তরের বেশি এগোয়নি।' সুরেশবাবু প্রশ্ন করলেন, 'নাটকে একাধিক আইডিয়া আছে তারপর রবীন্দ্রনাথের ভাষার জন্য নাটকটা অভিনয়ে ঠিকমতো প্রকাশ করতে অসুবিধা হতে পারে না?' শিশিরকু মার হেসে বললেন, 'অভিনয় করতে অসুবিধা কেন হবে? বর্ণপরিচয় থেকে ভট্টিকাব্য সব অভিনয় করা যায়। একাধিক আইডিয়া থাকলে তো ক্ষতি কিছু নেই-সব আইডিয়া মিলে তো একটি সত্যকে প্রকাশ করছে। অন্য নাটকের সঙ্গে 'রক্তকরবী'র মতো নাটককে মেলানো যাবে না। একটা প্রশ্ন অবশ্য আসে আমাদের দর্শক নাটক কতটা বুঝতে পারবে। কিন্তু ধরো, কোনো এক খনিতে শোষিত শ্রমিক আর শোষক মালিকের লড়াই এই ভাবনা নিয়ে যদি 'রক্তকরবী'কে সোজা করে-একটা নাটক করা হল; সে নাটক করাও সহজ দর্শকও সহজে বুঝবে কিন্তু সে কি রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী'তে মানবসভ্যতার যে সর্বকালীন সংকটের কথা বলা হয়েছে তা কি হত? 'রক্তকরবী' করা কঠিন তো বটেই। 'রক্তকরবী' তো শক্তকরবীই। কবি সেইজন্যেই তো চেয়েছিলেন, নাটকটা আমি করি।' এই আলোচনা কালেই আমরা শিশিরকু মারের নিজের মুখে শুনলাম, কেন তিনি তখন এবং পরেও 'রক্তকরবী' করতে পারেননি। বললেন, আমাদের দল তখন অত্যন্ত শক্তিশালী হলেও নন্দিনী করার মতো উপযুক্ত মেয়ে ছিল না, প্রভা পরে খুব Powerful অভিনেত্রী হয়েছিল কিন্তু প্রথমদিকে ওর অভিনয়ের মধ্যে শেখানোর ছাপ থাকত। তাছাড়া সীতাতে যে সহজ সেন্টিমেন্ট তা কি নন্দিনীতে আছে? অন্য অল্প-বয়সি মেয়ে ছিল উষা, বিসর্জনে অপর্ণা করেছিল কোনোরকমে চলে যায় গোছের। তোমরা ধারণা করতে পারবে না কি পরিশ্রম করে আমাদের থিয়েটারে প্রায় অক্ষরজ্ঞানশূন্য মেয়েদের শিখিয়ে পড়িয়ে অভিনেত্রী তৈরি করতে হত। কিছুটা নিজস্ব বোধ না থাকলে তোতা পাখির মতো পড়িয়ে নন্দিনী করানো যায় না। নরেন (নরেন্দ্র দেব) আমার জন্য 'ঘরে বাইরে' নাটক করে দিলঠিকমতো বিমলা পেলাম না বলে নাটকটা করতেই পারলাম না। নির্মম প্রাণহীন যক্ষপুরীতে এল প্রেম, প্রাণশক্তির প্রতীক নন্দিনী নামের এক নারী; সব সে ওলট পালট করে দেবে এ কি সহজ কথা! তার সাথী করে কবি এনেছেন বিশু

পাগল বলে এক চরিত্র। লক্ষ্য করো কবিতাকে বলেছেন 'পাগল'। গান গাইতে পারলেই কি আগল ভাঙা প্রাণের এই চরিত্র করা যায়? সব চরিত্র কি সম্পূর্ণটা শিখিয়ে দেওয়া যায়?' সুরেশবাবু এই কথার মাঝখানেই বললেন, 'আপনার বিশু পাগলই বা কে করত?' শিশিরকু মার বললেন, 'বিশু পাগল! নন্দিনীর সমস্যাটাই ছিল প্রধান সমস্যা। এটার সমাধান হলে কি জানি হয়তো কাজিকে (কাজি নজরুল ইসলাম) দিয়ে চেষ্টা করতাম। কাজি তখন আমার খুব ন্যাওটা ছিল। বয়সটা আর একটু বেশি হলে ভালো হত, তবে শেখালে ও পারত, ওর মধ্যে অভিনেতা ছিল। তবে ঐ যে বললাম ভাবনাটা অতদূর পর্যন্ত এগোয়নি। কবি তখন খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন 'রক্তকরবী' অভিনয়ের জন্যে, নন্দিনী সমস্যার কথা শুনে পরামর্শ দিলেন বিশুকে দিয়ে নন্দিনী করাতে। আমি বললাম সে কি করে হবে, অ্যামেচার ক্লাবে চলতে পারে, আমিও করেছি কিন্তু পাবলিক থিয়েটারে দর্শক একেবারেই নেবে না-ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, 'একটি মেয়েকে দিয়েই মেয়ের পার্ট করাতে হবে এ কেমন কথা। তোমাদের তো দর্শক তৈরি করারও দায়িত্ব নিতে হবে।' আমরা নির্বাক শ্রোতা, সুরেশবাবুই আবার বললেন, 'কঙ্কাবতী পারতেন না নন্দিনী করতে?' শিশিরকু মার বললেন, 'হ্যাঁ কঙ্কা পারত। কিন্তু আমার থিয়েটারে ওর যোগ দেওয়া নিয়ে আর্ট থিয়েটারের করা মামলা-মোকদ্দমা মেটার পর ঊনত্রিশ সালের আগে ও কোর্ট থেকে থিয়েটার করার permission -ই পায়নি। আর ঊনত্রিশ থেকেই আমার অনটনের শুরু। তারপর 'তপতী' করার পর তো নাট্যমন্দির উঠেই গেল। পরের বিপর্যয়ের কথা আর না বলাই ভালো। আমি 'রক্তকরবী' করার আর সুযোগ করে উঠতে পারিনি। কবি প্রত্যশা নিয়ে নিজে থেকে দুটি নাটক আমাকে করতে বলেছিলেন 'রক্তকরবী' আর 'বাঁশরি'-তার একটিও আমি করতে পারিনি; এ কি আমার কম দুঃখের। তাঁর অনেক স্নেহ পেয়েছি বলেই এ দুঃখ আমার আরও বেশি করে বাজে।' এসব কথা কেউ জানে না, জানার উপায়ও নেই। আর জানার সার্থকতাই বা কি। শ্রীরঙ্গম উঠে যাওয়ার পরে ওঁর বরানগরে এক জীর্ণ ভাড়াবাড়িতে বাস করার সময় একদিন তাঁকে রবীন্দ্র সান্নিধ্যের আরও কথা শুনে বলেছিলাম, 'এসব কথা কেউ জানে না, আপনি কোথাও এগুলো লিখুন না', উত্তরে বলেছিলেন, 'থিয়েটারে এসেছিলাম একটা আদর্শের লক্ষ্য নিয়ে, টাকা রোজগার করতে না। আমার নাট্যজীবনের ছাব্বিশ বছর কেটেছে পরাধীন ভারতবর্ষে। থিয়েটার সম্বন্ধে শাসকদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল আমরা যেন ওদের বিরুদ্ধে কিছু না বলি। বছর আষ্টেক কাটল স্বাধীন ভারতবর্ষে শাসকরা স্বীকারই করল না জাতির জাগরণের জন্যেও থিয়েটারের প্রয়োজন। নানা প্রতিকূ লতার মধ্যে যতটু কু করতে পেরেছি তার তু লনায় যা পারিনি তার পরিমাণই বেশি। এই ব্যর্থতার

বোঝার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের স্নেহের স্মৃতিই আমার একটু সান্ত্বনার জায়গা; একে আমি হাটের সামগ্রী করতে চাই না, আর এতে লাভই বা কি?' তারপর অনেকদিন কেটে গেছে রবীন্দ্রনাথ-রক্তকরবী-শিশিরকু মারের কথা, কালের হস্তাবলেপনে বেমালুম মুছে গেছে। 'রক্তকরবী'র কিংবদন্তী মঞ্চায়নের ইতিহাস সৃষ্টিকালেও প্রযোজনার উচ্চতা নির্মাণের পরিপূরক হিসাবে শিশিরকু মারের অপারগতার কথা শোনা যায় না। 'রক্তকরবী'-শিশিরকু মার সংযুক্তি পর্বের চৌষট্টি বছর পর আবার শিশিরকু মারের নাম আমাদের গোচরীভূ ত হল নতু ন করে এক অদ্ভু তভাবে। কারণ যাই হোক, শিশিরকু মার যে 'রক্তকরবী' করতে পারেননি তা তো জানা ঘটনা কিন্তু 'বহুরূপী ১৯৪৮-১৯৮৮' নামক ইতিহাস গ্রন্থে রচয়িতা অধ্যাপক/গবেষক স্বপন মজুমদার দীর্ঘকাল ধরে অজানা একটি সংবাদ আমাদের জানালেন। তাঁর গবেষণালব্ধ ইতিহাস গ্রন্থের সংশ্লিষ্ট অংশের উদ্ধৃ তি এইরকম '...রক্তকরবী করার সিদ্ধান্ত তখন নেওয়া হয়ে গিয়েছে যদিও সকলের সংশয় তখনও কাটেনি এ নাটকের অভিনয় যোগ্যতা বিষয়ে। এমনকি ১০ ফেব্রুয়ারি থর্নডাইক দম্পতির সম্মানসভা থেকে বেরিয়ে আসার পথে বহুরূপী রক্তকরবী করছে শুনে শিশিরকু মার (শম্ভু মিত্রকে) বলেছিলেন, 'না না ওসব নয়। ও হাফ ফিলজফি, হাফ থিওলজি, হাফ পলিটিক্স। নাটক করো, নাটক।' (উদ্ধৃ তিসূত্র বহুরূপী ১৯৪৮-১৯৮৮, পরিচ্ছেদ 'প্রযত্ন', ১৯৫৪-৬৩ পৃষ্ঠা-৩২) 'রক্তকরবী'র মঞ্চায়ন প্রসঙ্গে সঙ্গত কারণেই শম্ভু মিত্রের প্রযোজনার কথা ওঠে। এই প্রযোজনার আলোচনা প্রসঙ্গে কোনো কোনো সমালোচকের দ্বারা শ্রীমজুমদার পরিবেশিত এই সংবাদটিই বারবার উল্লেখের ফলে, যা হয়-সংবাদটি তথ্যের আকার লাভ করেছে। এমনকি 'আনন্দবাজার পত্রিকা' 'রক্তকরবী' প্রযোজনার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১০ মে ২০০৪ সংখ্যায় 'কোলকাতার কড়চা'য় কড়চা লেখক শ্রীমজুমদারের কথাটিরই প্রায় পুনরুক্তি করে লিখলেন, 'রক্তকরবী করার আগে শম্ভু মিত্র কথা প্রসঙ্গে শিশির ভাদুড়িকে জানিয়েছিলেন তাঁর ভাবনার কথা। নিরাশ করেছিলেন নাট্যাচার্য। বলেছিলেন, ওর অর্ধেকটা থিওলজি, অর্ধেকটা ফিলজফি। এতে কিন্তু দমে যাননি শম্ভু মিত্র।' সর্বাপেক্ষা অধিক সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছায় যে সংবাদপত্র তার মাধ্যমে প্রচারিত একটি কথা যে 'তথ্য' হয়ে দাঁড়াবে তাতে আর সন্দেহ কি। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, যে নাটক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছাসত্বেও করতে পারেননি বলে তাঁর বেদনাবোধ ছিল, মর্যাদাহানির আশঙ্কায় শিশিরকু মার যদি সেই নাটকটি সম্বন্ধে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করে তাঁর চেয়ে অনেক কনিষ্ঠ নতু ন প্রজন্মের এক সাহসী নট ও নির্দেশককে নাটকটি করতে নিষেধ করে থাকেন তবে তাঁর আচরণকে 'অনৈতিক' বলতেই হবে। অতএব নাট্যাচার্যের উক্তি বলে প্রচারিত এই সংবাদটি আমাদের সম্যকভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

আমরা দেখেছি, 'রক্তকরবী' করার আগে শিশিরকু মার কবে এবং কোথায় শম্ভু মিত্রকে 'রক্তকরবী' নাটক সম্পর্কে কিছু মন্তব্যসহ তাঁকে নাটকটি করতে নিষেধ করেছিলেন, শ্রীমজুমদার তাঁর উল্লিখিত লেখায় সে বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট সংবাদ দিয়েছেন, যথা '১০ফেব্রুয়ারি থর্নডাইক দম্পতির সম্মানসভা থেকে বেরিয়ে আসার পথে।' শম্ভু মিত্রের 'রক্তকরবী'র প্রথম অভিনয় ১০মে, ১৯৫৪ সালে। শ্রীমজুমদারের কথামতো 'রক্তকরবী' করার আগে যদি শিশিরকু মার শম্ভু মিত্রকে নিষেধ করে থাকেন তবে তা যে ১৯৫৪-র ১০ফেব্রুয়ারির আগে হবে তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারেনা। অতএব সাল নিয়ে আলোচনা করার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে শিশিরকু মারের উক্তি বিষয়ে 'থর্নডাইকদম্পতি' সংক্রান্ত কিছু ঘটনা সম্পর্কে আমাদের আলোচনা করতে হবে, কারণ স্বয়ং শ্রীমজুমদার পরিবেশিত থর্নডাইকডাইক-দম্পতি সংক্রান্ত একটি ঘটনাই শিশিরকু মারের উক্তি বলে প্রচারিত 'তথ্যে'র সত্য উদঘাটনে চাবির কাজ করবে। স্যার লুইস ক্যাসন ও তাঁর পত্নী ডেম সিবিল থর্নডাইক (ইংল্যান্ডের থিয়েটারে মূল্যবান অবদানের জন্য এই দুই শিল্পীকে যথাক্রমে 'স্যার' ও 'ডেম' উপাধিতে ভূ ষিত করা হয়) ১৯৫৫-র জানুয়ারির শেষের দিকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে কয়েকদিন কলকাতায় অবস্থান করেন। ১৯৫৫ ফেব্রুয়ারি ৪ তারিখে 'অমৃতবাজার পত্রিকা'য় তাঁদের প্রথম অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন এইরকম ' 4th February, 1955. Friday. Tonight at 9-15, and tomorrow night at 9-15 The British Council Presents Dame Sybil Thorndike, Sir Lewis Cason in a programme of Two Recitals . ' সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন থেকে আরও যে সব অনুষ্ঠানে তাঁরা যোগ দেন বলে জানা যায় সেগুলি হল-৬ ফেব্রুয়ারি তাঁরা স্টার থিয়েটারে 'শ্যামলী' নাটক দেখেন। এই ব্রিটিশ দম্পতির কলকাতায় থাকাকালীন অনুষ্ঠানসূচির মধ্যেই বহুরূপী দিল্লীতে শ্রেষ্ঠ প্রযোজনার সম্মান লাভ করার পর ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় তাদের প্রথম অভিনয় করে রঙমহলে (এই অভিনয়ের কথা আগে লেখা হয়েছে)। শিল্পী দম্পতি বাংলা নাট্যের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে ব্রিটিশ কাউন্সিল ১০ ফেব্রুয়ারি এক চায়ের আসরে শিশিরকু মারের সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে। ঘটনাটির নেপথ্য সহায়ক ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় এবং শিশিরকু মারের বন্ধু কালিদাস নাগ। প্রাসঙ্গিক না হলেও উল্লেখ করি, শিশিরকু মার এই মিটিংয়ে উৎসাহী ছিলেন না কিন্তু তাঁরই আগ্রহে জাতীয় নাট্যশালা স্থাপন সম্পর্কে রায়ের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তার সূত্রপাত এই সময় থেকেতাই মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করেননি। এই আসরে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অভিনেত্রী সুপ্রভা মুখার্জি, অরুন্ধতী দেবী, শম্ভু মিত্র এবং তৎকালীন বহুরূপী সম্পাদক অশোক মজুমদার। শিশিরকু মারের উক্তি সম্পর্কে এই অশোক মজুমদার খুব

গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হবেন। ১০ ফেব্রুয়ারির এই সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের ছবিসহ শিশিরকু মার ও শিল্পী দম্পতির মধ্যে আলোচিত বিষয়ের সারাংশ প্রকাশ করে ' The Free Lance ' নামে একটি মাত্র সান্ধ্য দৈনিক তাদের শুক্রবার ১১ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ সংখ্যায়, ' Three GREATS MEET AT QUIET Tea' Dame Sybil & Sir Lewis Cason Discuss Drama with Bhaduri ' এই হেডিং দিয়ে। শিল্পীদম্পতি শিশিরকু মারের অভিনয় দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি রবিবার তাঁর স্টেজ শ্রীরঙ্গমে 'মাইকেল' অভিনয় করেন। অভিনয় শেষে মঞ্চে উঠে ব্রিটিশ নাট্যশিল্পী দম্পতির শিশিরকু মারের প্রতি উচ্ছ্বাসপূর্ণ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন তারপর 'যাত্রা' সম্পর্কে শিশিরকু মারের একটি ছোট্ট ভাষণ একটি স্মরণীয় ঘটনা। (সেদিনের সেই পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে বর্তমান লেখকের বিদ্যাসাগরের পার্ট করার সৌভাগ্য হয়েছিল।) সন্দেহমাত্র নেই, শ্রীমজুমদার তাঁর লেখায় ১০ফেব্রুয়ারি থর্নডাইক দম্পতির সম্মানসভা বলতে উল্লিখিত চায়ের আসরই বুঝিয়েছিলেন। কারণ, ১৯৫৫-র আগে থর্নডাইক দম্পতি কোনোদিন কলকাতায় এসে শিশিরকু মারের উপস্থিতিতে কোনো সম্মানসভায় যোগ দেননি। ১৯৫৪ সালের মে মাসে যে নাটকের অভিনয় শুরু হয়ে গেছে এবং ১৯৫৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কমপক্ষে আটটি অভিনয় হয়ে গেছে, ১৯৫৫ সালে সেই নাটক করার আগে শিশিরকু মার কেমন করে শম্ভু মিত্রকে নিষেধ করতে পারেন? অতএব, তারিখ সম্পর্কে শ্রীমজুমদারের সংবাদ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। 'রক্তকরবী' নাটক সম্পর্কে শিশিরকু মারের উক্তি বলে যে সংবাদ শ্রীমজুমদার আমাদের জানিয়েছেন তেমন উক্তি কি তিনি আদৌ কোনোদিন করেছিলেন? সত্যিই কি তিনি শম্ভু মিত্রকে 'রক্তকরবী' করতে নিষেধ করেছিলেন? তারিখ ভিত্তিহীন হোক, এ অভিযোগও কিন্তু গুরুতর। আমরা এখন এই সংবাদের সত্যাসত্যের অনুসন্ধান করব। 'বহুরূপী ১৯৪৮-১৯৮৮' ইতিহাস গ্রন্থে শিশিরকু মারের উক্তি বলে শ্রীমজুমদার যে সংবাদ জানিয়েছিলেন একজন সৎ গবেষকের ধর্ম এবং কর্তব্য অনুযায়ী তিনি সে সংবাদের উৎসও তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। (দ্রষ্টব্য 'বহুরূপী ১৯৪৮-১৯৮৮' উল্লেখপঞ্জি অংশ, ক্রমিক সংখ্যা ৩৩। পৃ ১২৩) এই উৎসটি হল, 'বহুরূপী' নাট্যপত্রিকার ১৯৭২ মে ৩৮তম সংখ্যায় প্রকাশিত 'প্রচ্ছদপট' শীর্ষক একটি স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধ। লেখক অশোক মজুমদার (ইনিই থর্নডাইক দম্পতির চা-পান সভায় উপস্থিত ছিলেন) শ্রীমজুমদার কর্তৃক উল্লিখিত অশোক মজুমদারের এই প্রবন্ধের সংশ্লিষ্ট অংশ হুবহু এইরকম '...এবার একটা ঘটনার কথা বলি। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি নাগাদ বিখ্যাত ব্রিটিশ অভিনেত্রী Dame Sybil Thorndike এবং তাঁর স্বামী Sir Lewis Cason কলকাতায় এসেছিলেন। ১০ই ফেব্রুয়ারি বিকেল চারটের সময় British Council

তাঁদের নিয়ে এক ঘরোয়া চায়ের আসর করেন, সেখানে নাট্যাচার্য শিশিরকু মার বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন। সেই আসরে শম্ভু দার সঙ্গে আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ছে ভাদুড়ী মহাশয় 'যাত্রা' নিয়ে কিছু আলোচনা করেন সেখানে। আসর শেষে শম্ভু দার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে বাগানে নেমে এলেন। জানতে চাইলেন শম্ভু দা তখন কী নতু ন নাটক করছেন। তার প্রায় মাস দেড়েক আগে ২১শে ডিসেম্বর ১৯৫৪ সালে 'রক্তকরবী' অভিনয় করে বহুরূপী জয়মাল্য নিয়ে এসেছে প্রথম জাতীয় নাট্যোৎসব থেকে। 'রক্তকরবী'র কথা সম্ভবত শম্ভু দা তাঁকে জানিয়েছিলেন। যাই হোক কথাবার্তার পর গাড়িতে ওঠার সময় শম্ভু দার পিঠে হাত রেখে বললেন, ' Go ahead ' -তারপর গাড়িতে উঠে বসলেন তাঁর সেই বিখ্যাত পুরোনো গাড়িটি। ধীরে ধীরে গাড়িটা বাগান পার হয়ে গেট দিয়ে থিয়েটার রোডে বেরিয়ে গেল। কেমন যেন অভিভূ ত হয়ে পড়লাম সে দৃশ্য দেখে। মনে হল আচার্য তাঁর উত্তরসাধকের পিঠে হাত রেখে যেন বহুরূপীকেই বললেন ' Go ahead '। কোন এক সভায় তরুণ রবীন্দ্রনাথের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের আশীর্বাদের সেই বিখ্যাত গল্প আমার মনে পড়ে গেল সেই মুহূর্তে।' শ্রীমজুমদারের 'সংবাদ' সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার জায়গা নেই; পাঠকগণই বিচার করুন শ্রীমজুমদারেরই নির্দেশিত উৎসের তথ্যের সঙ্গে তাঁর পরিবেশিত সংবাদের কি অক্ষরগত বা অর্থগতভাবে সামান্যতমও মিল আছে? শ্রীমজুমদারের 'সংবাদ' আর সংবাদমাত্র নয়, তথ্যে পর্যবসিত হয়েছে। আমাদের কৌতূ হল জাগে 'রক্তকরবী' সম্পর্কে এ হেন বাক্যসমষ্টি সবটাই কি তাঁর বানানো? হুবহু না হলেও কিছু সাদৃশ্য আছে এমন একটি উৎস আছে। স্বনামধন্য গবেষক/লেখক কৃ ষ্ণ কৃ পালনী 'রক্তকরবী' সম্বন্ধে বলেছেন, ' The treatment is characteristically Tagorean-half realistic, half allegorical... ' অনবধানবশত শ্রীমজুমদার তাঁর লেখায় এটি ব্যবহার করে ফেললেন না তো? যাই হোক, সে আলোচনায় আমাদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এমন জিজ্ঞাসা কি জাগবে না, শিশিরকু মার সম্পর্কে এমন সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা শ্রীমজুমদার লিখলেন কেন? 'রক্তকরবী' প্রযোজনা বাংলা থিয়েটারে এক নতু ন দিগন্ত-তার রূপকার শম্ভু মিত্র নিজ কৃ তিত্বেই গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত-এ যেমন সত্য, বাংলা থিয়েটারে অবদানের কথা থাক, শিশিরকু মার বাংলা থিয়েটারেরই লোক, তিনি আমাদের পর নন; তাঁর সম্বন্ধে প্রয়োজনহীন অসত্যকথন একটি গর্হিত কাজ, এও তেমনই সত্য।

রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী তথ্য ও তত্ব প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস রাষ্ট্রব্যাপারের মধ্যস্থলে আমরা দেবতার শক্তিকে, মঙ্গলের প্রত্যক্ষস্বরূপকে রাজরূপে দেখিতে পাইলে শাসনের বিপুল ভার সহজে বহন করিতে পারি; নহিলে হৃদয় প্রতিক্ষণেই ভাঙিয়া যাইতে থাকে। আমরা পূজা করিতে চাই-রাজতন্ত্রের মধ্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিয়া আমাদের প্রাণের যোগ অনুভব করিতে চাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র, 'রাজভক্তি', ভাণ্ডার পত্রিকা, মাঘ ১৩১২ এক রবীন্দ্রনাথ ঠাকু রের রক্তকরবী -কে এখন কত চমৎকার একটি প্রগতিশীল বক্তব্যের নাটক বলে মনে হয় আমাদের, কিন্তু এটি যে একটি বেশ উপভোগ্য বা অভিনয়যোগ্য নাটক একথা বেশিরভাগ বাঙালি পাঠকই বুঝতে পারেননি 'বহুরূপী'র প্রযোজনার আগে, এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও না। তাঁর জীবদ্দশায় নাটকটি মঞ্চস্থ করার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ খুব একটা আগ্রহ কখনো দেখাননি। বই হিসেবে এদেশে ছাপা হওয়ার আগেই রক্তকরবী ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে ইংল্যান্ডে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৫ সালে। এডওয়ার্ড টমসন তাঁর Rabindranath (১৯২৬, পৃ. ২৩৫) বইয়ে লিখেছেন : ‘Red Oleanders has been published in England as well as in India, but made no impression '। টমসন অনেক কম করে বলেছেন, আসলে ইংল্যান্ডে নাটকটি সম্পর্কে যথেষ্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল পাঠকদের মধ্যে। Sheffield Telegraph পত্রিকার (২৩ জুলাই ১৯২৫) পুস্তক -সমালোচক লিখেছিলেন : Mr Tagore is too serious a writer to be suspected of publishing absolute nonsense on purpose, so one must suppose that he did it by accident. Presumably he is able to follow the workings of his brain, and it would be very interesting to hear from him just what it is all about । এই ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যটিতে কোনো বিশেষ ব্রিটিশ সমালোচকের রবীন্দ্রবিরাগ বা কু রুচির প্রতিফলন হিসেবে দেখা বোধহয় ঠিক হবে না, কেননা অন্য পত্রপত্রিকাতেও প্রায় একই ধরনের মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের সব থেকে প্রভাবশালী সাহিত্যপত্রিকা

Times Literary Supplement -এর সমালোচনাতেও (৯ জুলাই ১৯২৫) নাটকটির দুর্বোধ্যতা সম্পর্কে অভিযোগ তোলা হয়েছিল Many of the lofty utternaces of Nandini and the Voice are so devoid of meaning that one is constantly aware of the emptiness of such symbols as the tassel of oleanders, the network in front of the palace, and the caves of the Yaksha town । এমনকী, আইরিশ পত্রিকাগুলি সাধারণভাবে রবীন্দ্র -অনুরাগী হওয়া সত্বেও Dublin Evening Mail (২২ জুলাই ১৯২৫) লিখেছিল : It is drama in which no action takes place : a drama in which vague shadowy figures, indecisively male or female, meander through the pages, uttering pseudo -Maeterlinekian platitudes । রক্তকরবী নাটক সম্পর্কে বিদেশি পাঠকদের এই ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার পেছনে যে কারণ থাকার কথা আমাদের ভাবতে ভালো লাগে সেটা হলো রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি ত্যাগের ব্যাপারে ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের ক্ষোভ ও বিরক্তি। কিন্তু এই কারণ দেখিয়ে আইরিশ পত্রিকার বিরূপ সমালোচনার ব্যাখ্যা করা কঠিন। Red Oleanders নাটকটিতে বিদেশি সমালোচকদের ‘absolute nonsense’ মনে হওয়ার একটা সংগত কারণ থাকতে পারে। বাঙালি পাঠকেরা রবীন্দ্রনাথের বাংলা নাটকটিই পড়েন সাধারণত, ইংরেজি অনুবাদ Red Oleanders পড়েন না। পড়লে কিছুটা বোঝা যায় কেন বিদেশি পাঠকেরা নাটকটিকে দুর্বোধ্য মনে করেছিলেন। এমনিতেই নাটকটির বেশিরভাগ চরিত্রই যথেষ্ট হেঁয়ালি করে কথা বলে-ওইসব রূপকাশ্রিত ঘোরানো প্যাঁচানো সংলাপ ইংরেজিতে অনুবাদ করা খুব সহজ কাজ নয়। তার ওপর ইংরেজি ভাষা, বিশেষত শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে এমন স্বাধীনতা নিয়েছেন যে সেইসব আশ্চর্য শব্দসম্বলিত বাক্যের অর্থভেদ করা বিদেশি পাঠকদের পক্ষে বেশ কঠিন। যেমন, Nandini যখন বলে ‘How to fulfil leisure you will learn from Ranjan. He is so beautiful’, তখন ‘fulfil leisure’ বলতে রবীন্দ্রনাথ কী বোঝাতে চাইছেন কোনো ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠকের পক্ষে সেটা বোঝা কোনোমতেই সম্ভব নয়। তাঁরা কী করে বুঝবেন যে মূল বাংলা নাটকে সংলাপটি ছিল-'ছুটি কী করে মধুতে ভরে, তার জবাব রঞ্জনকে চোখে দেখলেই পাবে। সে বড়ো সুন্দর'? 'ভরা' ক্রিয়াটির ইংরেজি ‘fill’ লিখলে ইংরেজরা সহজেই সংলাপটির মানে বুঝত, কিন্তু ‘fulfil’ লিখলে শুনতে খুব একটা ভারী ভারী

লাগলেও 'ভরা' মানেটা সম্পূর্ণই হারিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ বোধ হয় ভেবেছিলেন fill না লিখে fulfil লিখলে 'মধুতে ভরে' কথাটার জোর এসে যাবে, কিন্তু ইংরেজরা ‘fulfil’ কথাটির মানে 'বেশি করে fill করা' বোঝে না। নিজের মতো করে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করার ফলে রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে কী ধরনের অর্থ বিপর্যয় ঘটত তার একটি চরম উদাহরণ 'পরশপাথর' বা 'পরশমণির' ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে ‘touchstone’ কথাটি ব্যবহার করা। 'পরশ' ইংরেজিতে ‘touch’ আর 'পাথর' ‘stone’ বলে রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল যে 'পরশমণি'র ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘touchstone '। Touchstone যে পরশমণির মতো কোনো কাল্পনিক পাথর নয়, একটি সত্যিকারের পাথর বা কষ্টিপাথর, একথা রবীন্দ্রনাথ কখনো তাঁর মনে স্থান দেননি, বা তাঁর কোনো শুভানুধ্যায়ী তাঁকে একথা জানিয়েও দেননি। এর ফলে তাঁর রচনায় যেখানেই 'পরশমণি' কথাটি থাকত, ইংরেজি অনুবাদে সেটি হয়ে যেত 'কষ্টিপাথর', অর্থাৎ সেই বাক্যের পুরো অর্থ বা অনুষঙ্গ সম্পূর্ণ বদলে যেত, বা বাক্যটি অর্থহীন হয়ে পড়ত। Red Oleanders -এও এই ঘটনা ঘটেছে। Voice বলছে ‘All I possess is so much dead weight. No increase of gold can create a particle of a touchstone... '। ইংরেজ পাঠকেরা এই কথাগুলি পড়ে কী করে বুঝবে যে মূল নাটকের রাজার সংলাপটি ছিল এইরকম 'আমার যা আছে সব বোঝা হয়ে আছে। সোনাকে জমিয়ে তু লে তো পরশমণি হয় না?' ১৯২৫ সাল থেকে Macmillan এই ‘touchstone’ ছেপে আসছে, ১৯৭৯ সালের মুদ্রণেও তার কোনো ব্যতিক্রম নেই, যেমন ব্যতিক্রম নেই ‘fulfil’ -এর ক্ষেত্রেও। বিশ্বভারতী কী করে এতদিন এই ‘touchstone’ সহ্য করে যাচ্ছে এটা বোঝাও বেশ কষ্টকর। ১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ব্রিটিশ পাঠক -সমালোচকদের উৎসাহে ভাঁটা পড়ার জন্যে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের Malapropism -কে পুরোপুরি দায়ী করাটা ঠিক হবে না। Sturge Moore ১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথেকে লেখা একটি চিঠিতে এই প্রসঙ্গে কিছু মূল্যবান মন্তব্য করেছিলেন ‘Immediately after the war there had been a violent reaction towards hope and generosity but it was short -lived and people are no longer thirsty for spirituality and beauty, but relish cynicism, pessimism and mechanical cruelty. Just as your work fed the first reaction, it now seems tasteless to the second... '।২ ঠি

স্টার্জ মুরের বক্তব্য সঠিক, তবে তার সঙ্গে এটাও বোধ হয় বলা দরকার যে রক্তকরবী -র মতো সিম্বলিস্ট -একসপ্রেশনিস্ট ধরনের নাটক সম্পর্কে শুধু ইংল্যান্ডে নয়, জার্মানি বা ফ্রান্সের পাঠক দর্শকদেরও উৎসাহে অনেক ভাঁটা পড়েছে ১৯২০ সালের পর থেকেই। মেটারলিংককে ‘hopeless mental cripple’ বলা হয়েছে অনেক আগেই। ১৯২৫ সালের কাছাকাছি সময়ে সিম্বলিস্ট নাটক সম্পর্কে পাঠকদের এই বিরক্তিই প্রকাশ পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রতীকী নাটক সম্পর্কে এডওয়ার্ড টমসনের একটি মন্তব্যে I frankly admit that it is literature of a kind that makes small appeal to me... If it fails to find me, that may be because it belongs to a class of imaginative writing that has been run to death during the last thirty years by authors using my own tongue ।৩ রক্তকরবী সম্পর্কে ব্রিটিশ পাঠকদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া তাই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কোনো ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক বিরূপতা থেকে ততটা আসেনি, যতটা এসেছে সিম্বলিস্ট নাটকের অতিরিক্ত আত্মমগ্নতা, ভাবালুতা ও চর্চিত দুরূহতা বা হেঁয়ালিপনা সম্পর্কে পাঠক -দর্শকদের কিছুটা ন্যায্য বিরক্তি থেকে। রক্তকরবী নাটক সম্পর্কে বিদেশি পাঠকদের আনা দুর্বোধ্যতার অভিযোগকে আমরা রুচির পরিবর্তন বা ভারতীয় কবি সম্পর্কে তাদের সাম্রাজ্যবাদী উন্নাসিকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখতেও পারতাম যদি এ অভিযোগের যথেষ্ট জোরালো সমর্থন আমরা না পেতাম রক্তকরবী নাটক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নিজের দেওয়া কৈফিয়তের মধ্যে। কৈফিয়তটি ছাপা হয় প্রবাসী পত্রিকায় (বৈশাখ ১৩৩২) 'অভিভাষণ' নাম দিয়ে, যেটি 'প্রস্তাবনা' হিসেবে নাটকটির সঙ্গে ছাপা হয়ে আসছে ১৩৩৩ সাল থেকে। এই প্রস্তাবনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ নিজেও নাটকটি সম্পর্কে খুব একটা স্বস্তিতে ছিলেন না। এ নাটকের মধ্যে এমন কিছু আছে যার অর্থ খুঁজতে গেলে অনর্থ ঘটতে পারে, এরকম একটা দুশ্চিন্তাও ছিল রবীন্দ্রনাথের মনে। 'প্রস্তাবনা' শুরু হয়েছে একটি অদ্ভু ত মন্তব্য দিয়ে 'আজ আপনাদের বারোয়ারি সভায় আমার 'নন্দিনী'র পালা অভিনয়। প্রায় কখনো ডাক পড়ে না, এবারে কৌতূ হল হয়েছে। ভয় হচ্ছে, পালা সাঙ্গ হলে ভিখ মিলবে না, কু ত্তা লেলিয়ে দেবেন। তারা পালাটিকে কু টিকু টি করার চেষ্টা করবে। এক ভরসা কোথাও দন্তস্ফু ট করতে পারবে না।' রক্তকরবী -র আগে রবীন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটি রূপকনাটক লিখেছেন, সেগুলি যে খুব ভালো নাটক হয়েছে তা নয়। কিন্তু সেগুলি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথকে কখনো এই ধরনের চড়া রসিকতা করতে হয়নি। 'কু ত্তা' বলতে রবীন্দ্রনাথ কী ধরনের রূপক ব্যবহার করছেন বা কাদের

বোঝাতে চাইছেন সেটা খুব স্পষ্ট না হলেও এটা বোঝা যাচ্ছে যে নাটকটির মধ্যে এমন কিছু আছে যার মধ্যে দন্তস্ফু ট করা কঠিন বলে মনে করছেন রবীন্দ্রনাথ, এবং একথা ভেবে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট ভরসাও পাচ্ছেন। প্রস্তাবনাটি বেশ দীর্ঘ। প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথ পাঠকদের অনুরোধ করছেন যাতে তাঁরা নাটকের প্রকাশ্য রসেই সন্তুষ্ট থাকেন, গূঢ় অর্থ নিয়ে টানাটানি না করেন 'যেটা গূঢ় তাকে প্রকাশ্য করলেই তার সার্থকতা চলে যায়।' কিন্তু এই প্রস্তাবনার মধ্যেই রামায়ণের প্রসঙ্গ তু লে রক্তকরবী নাটকের গূঢ় অর্থের বেশ খানিকটা রবীন্দ্রনাথ নিজেই পাঠকদের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছেন কর্ষণজীবী ও আকর্ষণজীবী সভ্যতার দ্বন্দ্ব, দানবীয় লোভের টানে কৃ ষীর আত্মবিস্মৃতি, মাটি খুঁড়ে যে -পাতালে খনিজ ধন খোঁজা হয় নন্দিনী সেখানকার নয়, মাটির ওপরে যেখানে রূপের নৃত্য প্রাণের লীলা, নন্দিনী সেই সহজ সুখের, সহজ সৌন্দর্যের। রবীন্দ্রনাথ একথাও জানিয়ে দিচ্ছেন যে রামায়ণের মতো তাঁর নাটকও একই কালে ব্যক্তিগত মানুষের আর মানুষগত 'শ্রেণী'র। 'শ্রেণী' -র কথা নিজে পাঠকদের মনে করিয়ে দিয়েই আবার কিছুটা সতর্ক হয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন যাতে পাঠকেরা 'শ্রেণীর কথাটা ভু লে যান', নন্দিনীকে যেন একটি মানবীর ছবি হিসেবেই দেখেন 'নয়তো রক্তকরবীর পাপড়ির অর্থ খুঁজতে গিয়ে যদি অনর্থ ঘটে তাহলে তার দায় কবির নয়।' এইভাবে রক্তকরবী -র প্রায় সব পাপড়ি নিজেই এই প্রস্তাবনার মধ্যে খসিয়ে দেবার পরেও পাপড়ির আড়ালে আর কোন অর্থ খোঁজার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ অনর্থের আশঙ্কা করছেন, বা সে অনর্থ ঘটলে তার দায়িত্ব তিনি কেন অস্বীকার করতে চাইছেন, এটা যথেষ্ট স্পষ্ট হচ্ছে না এই দীর্ঘ প্রস্তাবনা থেকে। রক্তকরবী -র মধ্যে আর একটু গূঢ় অর্থ ছিল, যার কথা রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাবনায় বলছেন না, কিন্তু কয়েকবছর পর 'যাত্রী' -র মধ্যে বলে দিয়েছেন নারীর ভিতর দিয়ে বিচিত্র রসময় প্রাণের প্রবর্তনা যদি পুরুষের উদ্যমের মধ্যে সঞ্চারিত হবার বাধা পায় তাহলেই তার সৃষ্টিতে যন্ত্রের প্রাধান্য ঘটে। তখন মানুষ আপনার সৃষ্ট যন্ত্রের আঘাতে কেবলই পীড়া দেয়, পীড়িত হয়। এই ভাবটা আমার রক্তকরবী নাটকের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। ...নারী এল, নন্দিনী এল; প্রাণের বেগ এসে পড়ল যন্ত্রের উপর, প্রেমের আবেগ আঘাত করতে লাগল লুব্ধ প্রচেষ্টার বন্ধনজালকে। তখন সেই নারীশক্তির নিগূঢ় প্রবর্তনায় কী করে মানুষ নিজের রচিত কারাগারকে ভেঙে ফেলে প্রাণের প্রবাহকে বাধামুক্ত করবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হল, এই নাটকে তা বর্ণিত হয়েছে। এ ব্যাখ্যার মধ্যেও তো অনর্থের কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে আর কোন অর্থের কথা ভেবে রবীন্দ্রনাথ ভয় পাচ্ছিলেন যে নাটক শেষ হলে পাঠকেরা 'কু ত্তা লেলিয়ে

দেবেন'? 'প্রস্তাবনা' ও 'নাট্যপরিচয়' -এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন রক্তকরবী রূপকনাটক নয়, সুতরাং কেউ যেন এর মধ্যে কোনো গূঢ় অর্থ খোঁজার চেষ্টা না করেন, তাতে নাটকের সার্থকতা চলে যায়। অথচ তিনি নিজেই বেশ গুছিয়ে নাটকের বিভিন্ন vehicles -এর পেছনে কোন কোন tenor কাজ করছে সেগুলি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে নাটকটির Metaphor -কে স্পষ্ট করে দিয়ে নাটকের সার্থকতা নষ্ট করে দিচ্ছেন, পাঠক বা শ্রোতাদের নিজস্ব নাট্যবোধ, বুদ্ধি বা কল্পনাশক্তির ওপর এইসব ব্যাখ্যার দায়িত্ব ছেড়ে দিতে ভরসা পাচ্ছেন না। রক্তকরবী -র পাপড়ির আড়ালের গূঢ় অর্থ সন্ধান করার ব্যাপারে পাঠকদের নিরুৎসাহিত করছেন, আবার তারই সঙ্গে নাটকের মধ্যে তিনি কী বলতে চেয়েছেন বা বলেছেন তার বিশদ ব্যাখ্যা করে নাটক সম্পর্কে পাঠকদের প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত বা সীমায়িত করার চেষ্টা করছেন, মনিটার করছেন। এইসব পরস্পরবিরোধী কথাবার্তার কারণ কি এই যে রক্তকরবী -র পাপড়ির আড়ালে এমন কিছু অনর্থ ছিল যা তিনি পাঠকদের কাছে নাটকের বক্তব্যের বা অর্থের যে এলাকা চিহ্নিত করে দিচ্ছেন তার মধ্যে রাখছেন না? রবীন্দ্রনাথ এ -কথাই বা কেন বলছেন যে পাপড়ির আড়ালের অর্থ খুঁজতে গিয়ে যদি অনর্থ ঘটে তার দায়িত্ব তিনি নেবেন না? কোনো পাঠক তার নিজের অশিক্ষা, অজ্ঞানতা বা বুদ্ধির দোষে নাটকের কোনো কদর্থ করে অনর্থ ঘটায়, তার দায়িত্ব অবশ্যই পাঠকের নিজের। কিন্তু রক্তকরবী -র পাপড়ির আড়ালে অর্থ খুঁজতে গেলে অনর্থ ঘটার সম্ভাবনা সম্পর্কে নাট্যকার নিজেই যখন এতটা সচেতন, তখন সে অনর্থের দায়িত্ব অবশ্যই নাট্যকারের ওপর বর্তায়, পাঠক বা দর্শকের ওপর নয়। রক্তকরবী নাটকের পাঠক বা দর্শক হিসেবে তাই আমাদের দেখা দরকার পাপড়ির আড়ালে লুকিয়ে রাখা কোন অনর্থের কথা চিন্তা করে রবীন্দ্রনাথ বারবার আমাদের নিষেধ করছেন ওই অনর্থের সন্ধানে না যেতে। দুই রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাবনায় বলেছেন পালাটি সত্যমূলক, ঐতিহাসিক দিক থেকে সত্যমূলক নয়, কিন্তু কবির জ্ঞানবিশ্বাস মতে সত্য। আবার, 'নাট্য -পরিচয়' -এ বলেছেন 'এ নাটকটি একেবারেই পৌরাণিক কালের নয়,' অর্থাৎ নিতান্তই একালের বা আধুনিক কালের। তাই যদি হয় তাহলে ঐতিহাসিক দিক থেকে নাটকটি কেন সত্যমূলক হবে না তার কোনো ব্যাখ্যা নেই প্রস্তাবনায় বা 'নাট্যপরিচয়' -এর মধ্যে। 'কবির জ্ঞানবিশ্বাস মতে সত্য'-এই দাবির মধ্যে কি তাহলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কোনো ঘটনা বা অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাইছেন? রক্তকরবী লেখার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনের কোন কোন

অভিজ্ঞতা জড়িত ছিল এ সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিলে হয়তো আমরা বুঝতে পারব কেন তিনি বলছেন যে নাটকটির ঘটনা কবির জ্ঞানবিশ্বাস মতে সত্য। রবীন্দ্রনাথ ১৩৩০ সালের বৈশাখ মাসে শিলঙে যান বিশ্রামের জন্য। প্রভাতকু মার জানাচ্ছেন 'কবির দিন যায় গান রচনায়, পড়াশুনায়।' কী পড়াশোনা রবীন্দ্রনাথ করছেন, বিশেষত কোনো বিদেশি নাটক পড়ছেন কিনা, এ সম্পর্কে প্রভাতকু মার কিছু বলছেন না, তবে জানাচ্ছেন এই সময়েই রবীন্দ্রনাথ যক্ষপুরী নাটক লিখছেন, পরে যার নাম দেন রক্তকরবী। অধ্যাপক রাধাকমল মুখোপাধ্যায় প্রভাতকু মারকে গল্পচ্ছলে জানিয়েছিলেন যে ওই সময়ে তিনি বোম্বাইয়ের শিল্পকেন্দ্রের শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা রবীন্দ্রনাথকে জানিয়েছিলেন, এবং রবীন্দ্রনাথ মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনেছিলেন। রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের ধারণা হয়েছিল তাঁর ওইসব কথার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ যক্ষপুরী নাটকের প্রেরণা পেয়েছিলেন। রাধাকমল মুখোপাধ্যায় সম্ভবত খেয়াল করেননি যে রক্তকরবী লেখার মাত্র তিনবছর আগে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ একবছরেরও বেশি সময় ধরে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি, সুইটজারল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া ইত্যাদি শিল্পোন্নত দেশগুলি ঘুরে যন্ত্রসভ্যতা সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এসেছিলেন, তার পরে বোম্বাইয়ের কথা থেকে যক্ষপুরী লেখার খোরাক সংগ্রহ করার বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছিল না রবীন্দ্রনাথের। বিদেশ সফর থেকে ফিরে এসেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন অনবচ্ছিন্ন সাতমাস আমেরিকায় ঐশ্বর্যের দানবপুরীতে ছিলাম। দানব মন্দ অর্থে বলছিলেন, ইংরেজিতে বলতে হলে হয়তো বলতাম 'টাইট্যানিক' ওয়েলথ। অর্থাৎ যে ঐশ্বর্যের শক্তি প্রবল, আয়তন বিপুল। হোটেলের জানলার কাছে রোজ ত্রিশ পঁয়ত্রিশতলা বাড়ির ভ্রূকু টির সামনে ব'সে থাকতাম আর মনে মনে বলতেম, লক্ষ্মী হলেন এক, আর কু বের হল আর-অনেক তফাত। লক্ষ্মীর অন্তরের কথাটি হচ্ছে কল্যাণ, সেই কল্যাণের দ্বারা ধন শ্রীলাভ করে। কু বেরের অন্তরের কথাটি হচ্ছে সংগ্রহ, সেই সংগ্রহের দ্বারা ধন বহুলত্ব লাভ করে। বহুলত্বের কোন চরম অর্থ নেই। ৪

রবীন্দ্রনাথ চু প করে রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের কথাগুলি শুনেছিলেন, প্রভাতকু মারেরও উচিত ছিল অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের গল্প শুনে নীরব থাকা। রক্তকরবী রচনার উপলক্ষ বা প্রেরণা হিসেবে রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের গল্পের কোনো তথ্যগত মূল্য না থাকারই কথা, বিশেষত যখন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সাতবছর পরে লক্ষ্ণৌয়ে প্রভাতকু মারকে জানানো ওই তথ্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মতামত মিলিয়ে নেবার কোনো উপায় নেই।

রক্তকরবী নাটকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনের কোনো বিশেষ অভিজ্ঞতার একটা ক্ষীণ সম্পর্ক থাকার কথা চিন্তা করা যেতে পারে অন্য একটি ঘটনার জন্যে। নাটকটি লেখা শুরু হয়েছিল ১৯২৩ সালের গ্রীষ্মকালে, শেষ হয়েছিল হেমন্তকালে। কিন্তু ১৯২৩ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নাটকটি মঞ্চস্থ করার কোনো ব্যবস্থা করেননি রবীন্দ্রনাথ । এই আঠারো বছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ কেন নাটকটিকে অভিনয়যোগ্য মনে করলেন না এ সম্পর্কে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকু মার বা কৃ ষ্ণ কৃ পালানি কোনো মন্তব্য করেননি। ব্যাপারটি একটু আশ্চর্য লাগে এই জন্যে যে জীবনের শেষ কু ড়ি বছর তাঁর নাটক ও নৃত্যনাট্যগুলির প্রযোজনায় অক্লান্ত উৎসাহ দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, গান্ধির নিষেধ সত্বেও অসুস্থ শরীর নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত থেকেছেন ১৯৩৮ সালেও। রক্তকরবী নাটকের ঘটনা বা বক্তব্যের মধ্যে এমন কিছু কি ছিল যার জন্যে নাটকটি মঞ্চস্থ করার ব্যাপারে কোনো অস্বস্তি বা আশঙ্কা কাজ করেছিল রবীন্দ্রনাথের মনে? রক্তকরবী লেখা যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন এলমহার্স্ট রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিলেন, রক্তকরবী -র ইংরেজি অনুবাদ রবীন্দ্রনাথ এলমহার্স্টকেই উৎসর্গ করেন। রক্তকরবী নাটকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনের কোনো অভিজ্ঞতার কিছু সম্পর্ক আছে কিনা এ সম্পর্কে এলমহার্স্টের বক্তব্য শোনা যেতে পারে, যাতে আমরা বুঝতে পারি কেন রবীন্দ্রনাথ বলছেন নাটকের ঘটনা 'কবির জ্ঞানবিশ্বাস মতে সত্য'। কৃ ষ্ণ কৃ পালানি তাঁর Rabindranath Tagore : A Biography বইটিতে এ সম্পর্কে এলমহার্স্টের কিছু মন্তব্য তু লে ধরেছেন। নাটকটি প্রকাশিত হবার বছর খানেক পরে রবীন্দ্রনাথ এলমহার্স্টকে বলেছিলেন যে নাটকটি তাঁর, এলমহার্স্টের ও একটি তরুণীর পারস্পরিক সম্পর্কের প্রেরণায় লেখা। এলমহার্স্ট বলছেন : Tagore enlarged to me upon the ideas he had tried to incorporate in the play, but he also hinted that it was originally the human relationship between himself and myself and W. that had given him the embryonic idea on which his imagination had set to work. এই মেয়েটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে এলমহার্স্ট মন্তব্য করেছেন Some weeks after Tagore himself had married, his sister -in law died. After the early death of Tagore’s own wife, no comparable companionship with a woman friend seemed to have come into his life, until, as he explained to me, the day

that an old friend arrived to stay at Santiniketan bringing with him his teenage daughter. This girl so vividly brought back to Tagore the memory of his boyhood companion that he begged the father to leave her behind as a guest in the poet’s house. The relationship that developed was deep and lasting. ওই মেয়েটি অর্থাৎ ‘W’ সম্পর্কে এলমহার্স্ট আরো লিখছেন ‘That she found in me a useful foil with which to tease Tagore, on occasion, I have very little doubt’, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি পাবার আগে পর্যন্ত এলমহার্স্ট কল্পনাও করতে পারেননি যে তাঁদের তিনজনকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি ত্রিকোণ -প্রেমের গল্পের ভিত্তিতে তাঁর একটি নাটকের কাঠামো গড়ে তু লবেন। এলমহার্স্ট রবীন্দ্রনাথের যে চিঠির কথা বলেছেন সেটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন এলমহার্স্টেরই একটি চিঠির উত্তরে, যে চিঠিতে এলমহার্স্ট রবীন্দ্রনাথকে জানিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর প্রেমিকাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এলমহার্স্টের প্রেমিকা Dorothy Straight -কে নিউ ইয়র্কে দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ওই চিঠিতে লিখেছিলেন Your marriage proposal has my hearty approval and blessings. It will take a huge load off my mind when it happens, for I have discovered that lately you have been paying an alarming amount of attention to a certain Brahmin maiden diverting her heart from its previous course. এলমহার্স্ট মন্তব্য করছেন ‘Not until after Tagore’s death in 1941 did I quite realize what a deeply and mutually enriching experience this friendship of his with a young and gifted girl had been '। এলমহার্স্ট আরো বলেছেন যে তাঁর সামনে একদিন গগন ঠাকু র ও অবনী ঠাকু রকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে ওই মেয়েটির কাছ থেকেই তিনি রক্তকরবী লেখার প্রেরণা পেয়েছিলেন। মেয়েটি তাঁকে নাটকটি তার নামে উৎসর্গ করার দাবি জানিয়েছিল, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাকে বলেছিলেন, এ নাটকের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই, যদিও রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন ‘She knew, and I know, that she is the figure around whom the whole theme revolves '। এই কথা বলেই রবীন্দ্রনাথ গগন ঠাকু রকে অনুরোধ করেন For goodness sake, Gagan, don’t breathe a word of this to your wife, or this news will be round Calcutta like

wild fire. They are all abusing me at Santiniketan as it is '। রক্তকরবী নাটকের অন্তর্নিহিত অর্থ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি আলোচনার শেষে এলমহার্স্ট এ কথাগুলিও পড়েছিলেন Elmhirst, you must come back to India, and play Ranjan and Nandini will bend over you and put a feather in your hair '।৫ এলমহার্স্টের এই স্মৃতিচারণা থেকে রক্তকরবী নাটকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনের কিছু অভিজ্ঞতার যোগাযোগ থাকার সম্ভাবনা সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো মতামত দেওয়া সংগত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত এই ত্রিমুখী সম্পর্কের কেন্দ্রে যে মহিলা রয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ যাঁর কথা মনে রেখেই নন্দিনী চরিত্রটি গড়ে তু লেছেন বলছেন, তাঁর কাছ থেকে এলমহার্স্টের এই বিবরণের কোনো সমর্থন না পাওয়া যায়। আমাদের সৌভাগ্য যে রক্তকরবী -র নন্দিনীর প্রেরণা শ্রীমতী রানু মুখার্জি আমাদের মধ্যে রয়েছেন। এ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বক্তব্য শোনার জন্যে রবীন্দ্র -গবেষকেরা দীর্ঘকাল অপেক্ষা করে আছেন। আমরা আশা করব এ সম্পর্কে তিনি তাঁর মতামত প্রকাশ করবেন, যাতে রক্তকরবী -র সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ব্যাপারে এলমহার্স্ট যে কথাগুলি কৃ ষ্ণ কৃ পালানিকে জানিয়েছেন সেগুলি তথ্য হিসেবে কতটা নির্ভরযোগ্য তা আমরা আর একটু স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি। এলমহার্স্টের এই স্মৃতিচারণা তথ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য প্রমাণিত হলে রক্তকরবী নাটকের ঘটনা কবির জ্ঞানবিশ্বাসমতে সত্য-রবীন্দ্রনাথের এই দাবির যৌক্তিকতা সম্পর্কেও আমাদের ধারণা আর একটু স্পষ্ট হবে। এলমহার্স্টের দেওয়া এই তথ্য রবীন্দ্রজীবনীর দিক থেকে কিছুটা প্রাসঙ্গিক হতে পারে, কিন্তু রক্তকরবী নাটকের আলোচনার ক্ষেত্রে খুব একটা উল্লেখযোগ্য তথ্য নয় বলেই আমার মনে হয়। তবু আমি এই স্মৃতিচারণা থেকে কয়েকটি উদ্ধৃ তি দিয়েছি এই জন্যে যে কৃ পালানির রবীন্দ্রজীবনীতে এই তথ্য এমনভাবে পরিবেশিত হয়েছে যে রানু যেন সত্যিই রক্তকরবী -র নন্দিনীর প্রেরণা। রবীন্দ্রনাথ এলমহার্স্টকে এ সম্পর্কে যাই বলে থাকু ন, নন্দিনী চরিত্র কল্পনার সঙ্গে রানু বা রবীন্দ্রনাথ -রানু -এলমহার্স্টের কল্পিত বা প্রকৃ ত ত্রিকোণ সম্পর্কের কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকার কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ রানু সম্পর্কে বলেছেন : ‘She knew and I know that she is the figure around whom the whole theme revolves '। রবীন্দ্রনাথ যদি সত্যিই এই কথাগুলি এলমহার্স্টের সামনে বলে থাকেন তাহলে বলতে হবে তিনি যতটা জোর দিয়ে কথাগুলি বলছেন ততটা জোর দিয়ে বলা ঠিক হয়নি। তার প্রথম কারণ, রক্তকরবী -র থিম নন্দিনী -রাজা -রঞ্জনের ত্রিকোণ প্রেমকাহিনিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় কারণ, রানু না জানতে পারেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় জানতেন যে তাঁর ওই কথাগুলির দ্বিতীয় ‘she’

রানু নয়, অন্য একটি মানবী, একজন সুইডিশ নায়িকা, যারও নাম ছিল 'নন্দিনী'। এলমহার্স্ট কৃ ষিবিশেষজ্ঞ ছিলেন, তাই হয়তো এই সুইডিশ নন্দিনীর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু সাহিত্য অ্যাকাডেমির সম্পাদক কৃ ষ্ণ কৃ পালানির সঙ্গে এই 'নন্দিনী'র পরিচয় ছিল না এটা ভাবতে একটু অবাক লাগে, কারণ পৃথিবীর সাহিত্যরসিকদের কাছে এই 'নন্দিনী' একটি যথেষ্ট পরিচিত নাম। তাই, রক্তকরবী -র পাপড়ির আড়ালে সত্যিই যদি কোনো রহস্য লুকিয়ে থাকে সে রহস্যের সন্ধান করতে গেলে এলমহার্স্টের স্মৃতিচারণার চাইতে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক তথ্য পাওয়া যাবে রক্তকরবী নাটক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অন্য একটি উক্তি থেকে। প্রথমে নাটকটির নাম ছিল 'যক্ষপুরী', পরে রবীন্দ্রনাথ এর নাম দেন 'নন্দিনী', তাতেও তৃ প্তি না পেয়ে 'রক্তকরবী' নাম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই নাম পরিবর্তন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কোনো মন্তব্য রেখে যাননি। কিন্তু মৃত্যুর কিছুদিন আগে ক্ষিতিমোহন সেনকে এই নাম পরিবর্তনের কারণ জানিয়ে দেন। ক্ষিতিমোহন সেন পরে একটি চিঠিতে প্রমথনাথ বিশীকে এই তথ্যটি জানান। রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহনকে বলেছিলেন : আমার ঘরের কাছে একটি লোহালক্কড় -জাতীয় আবর্জনার স্তূ প ছিল। তার নীচে একটি ছোট্ট করবীগাছ চাপা পড়েছিল। ওটা চাপা দেবার সময় দেখতে পাই নি, পরে লোহাগুলি সরিয়ে আর চারাটু কু র খোঁজ পাওয়া গেল না। কিছুকাল পরে হঠাৎ একদিন দেখি ঐ লোহার জাল -জঞ্জাল ভেদ ক'রে একটি সুকু মার করবীশাখা উঠেছে একটি লালফু ল বুকে করে। নিষ্ঠু র আঘাতে যেন তার বুকের রক্ত দেখিয়ে সে মধুর হেসে প্রীতির সম্ভাষণ জানাতে এলো। সে বললে ভাই মরিনি তো, আমাকে মারতে পারলে কই? তখন আমার মনে মধ্যে এই বিষয়ের প্রকাশ বেদনা দিল। নাটকটাকে তাই 'যক্ষপুরী' 'নন্দিনী' প্রভৃ তি বলে আমার তৃ প্তি হয়নি, তাই নাম দিলাম 'রক্তকরবী'।৬ প্রমথনাথ বিশী বলছেন 'পত্রখানির মর্ম অবগত হইবার পরে রক্তকরবীর স্বরূপ সম্পর্কে আর সন্দেহ থাকা উচিত নয়।' কিন্তু আমার মনে হয় পত্রখানি পড়ার পর রক্তকরবী সম্পর্কে আমাদের সংশয় আরো বাড়ল। ক্ষিতিমোহনের দেওয়া এই তথ্যটি খুবই অদ্ভু ত। তাঁর ঘরের কাছে লোহার জাল -জঞ্জালের মধ্যে বেড়ে ওঠা রক্তকরবী গাছের ফু ল দেখে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটকের 'যক্ষপুরী' বা 'নন্দিনী' নামে আর তৃ প্তি পেলেন না, তাই নাম দিলেন 'রক্তকরবী'। অর্থাৎ 'যক্ষপুরী' বা 'নন্দিনী' নাটকটি তিনি রক্তকরবী ফু লটি দেখার আগেই লিখে ফেলেছিলেন। তাহলে নাটকটির প্রথম দৃশ্য থেকে শুরু করে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত রক্তকরবী ফু লের যে উল্লেখ রয়েছে সেগুলি এল কোথা থেকে? রবীন্দ্রনাথ কি পুরো নাটকটাই আবার লিখেছিলেন রক্তকরবী গাছের ফু লটি দেখার পর ওই ফু লটিকে নাটকের

কেন্দ্রীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে? তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে 'নন্দিনী' বা 'যক্ষপুরী' হিসেবে নাটকটির যে খসড়া রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন, সেখানে রক্তকরবী ফু লের উল্লেখ থাকার কথা নয়। পাণ্ডুলিপি কিন্তু সে কথা বলছে না। বহুরূপী পত্রিকায় ১৯ সংখ্যায় মুদ্রিত নাটকটির দ্বিতীয় খসড়াতেও রক্তকরবী -র উল্লেখ রয়েছে, যদিও নাটকটির নাম 'রক্তকরবী' রাখা হয়নি তখনও। ক্ষিতিমোহনকে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী বলেছিলেন আমরা জানি না, তবে ক্ষিতিমোহন যেভাবে করবী গাছটির বর্ণনা দেবার সময় 'লোহালক্কড় -জাতীয় আবর্জনা', 'লোহার জাল -জঞ্জাল' ইত্যাদি কথাগুলি ব্যবহার করে করবীগাছটিকে নাটকের ঘটনা ও বক্তব্যের খুব কাছাকাছি এনে ফেলেছেন তাতে মনে হয় ওই গাছ ও ফু লের প্রেরণায় রক্তকরবী প্রতীকটি নাটকে আসেনি, নাটকের প্রতীকটির প্রেরণাতেই যেন রবীন্দ্রনাথের ঘরের পাশে লোহার জাল -জঞ্জালের মধ্যে ফু লটিকে ফু টতে হয়েছিল নাটকের সঙ্গে বেশ মানানসই করে। এক্ষেত্রে ক্ষিতিমোহন বা রবীন্দ্রনাথ কে ঠিক বলছেন বোঝা যাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথের ঘরের কাছেই আবর্জনার মধ্যে ওই ফু লটি ফোটার প্রয়োজন হয়েছিল অন্য একটি কারণে যা রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহনকে বলেননি। রবীন্দ্রনাথ যখন 'নন্দিনী' নাম দিয়ে নাটকটি লিখেছিলেন তখনই তিনি আবর্জনা থেকে উঠে আসা ফু লের প্রতীকটি পেয়ে গিয়েছিলেন, কারণ 'নন্দিনী' -কে তিনি যেখানে দেখেছিলেন, সেখানেই ওই প্রতীকী ফু লটি ফু টেছিল। আবর্জনায় জন্ম কিন্তু আকাশের আলোর দিকে বেড়ে ওঠা এই ফু লের প্রতীকটি ভারতীয় অধ্যাত্মসাধনার একটি বহু -ব্যবহৃত প্রাচীন প্রতীক, যেটি সংসারের কামনা -বাসনা -দুঃখে আবদ্ধ অথচ পরমাত্মার সান্নিধ্যের জন্যে উন্মুখ মানবের প্রতীক শুধু তাই নয়, সৃষ্টির মূল পুরুষলিঙ্গেরও প্রতীক বা একটি phallic symbol, যেটি বোঝাতে সাধারণত পদ্মফু লের প্রতীকটি ব্যবহার করা হয়। পদ্মের জন্ম অন্ধকার নোংরা পাঁকের মধ্যে, কিন্তু সে তাকিয়ে থাকে আলোয় ভরা আকাশের দিকে। বৌদ্ধ তন্ত্রসাধনায় ও শিল্পকর্মে এই পদ্মফু লের প্রতীকটির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে, বিশেষত 'ওঁ মণিপদ্মে হুঁ' মন্ত্রটির মধ্যে, যেটি বুদ্ধ ও প্রজ্ঞাপারমিতা বা অবলোকিতেশ্বর ও তারার যৌনসংগম কল্পনারই মন্ত্ররূপ। তিব্বতে ধর্মভীরুরা এই মন্ত্রটির সারাদিন ধরে জপ করে। অজন্তার 'অবলোকিতেশ্বর-পদ্মপাণি' ছবিটির মধ্যেও এই প্রতীকটি রয়েছে।'৭ অন্ধকার আবর্জনায় জন্ম কিন্তু আলোর দিকে উঠে যাওয়া এই ফু লের প্রতীকটি নিয়ে এতকথা বলতে হচ্ছে এইজন্যেই যে বৌদ্ধধর্মের এই কেন্দ্রীয় যৌন -আধ্যাত্মিক ফু লের প্রতীকটি আধুনিক কালের একজন অতি -বিখ্যাত নাট্যকার সৃষ্টি ও বিশ্বসৃষ্টির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন তাঁর দুটি জনপ্রিয় নাটকে। একটি নাটকে Hyacinth ফু ল ব্যবহৃত হয়েছে, যার নীচের অংশটি মাটির পৃথিবী, ডাঁটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অক্ষ, আর ছ'কোনা

ফু লগুলি হচ্ছে নক্ষত্রমালার প্রতীক, এবং পুরো ফু লটি সৃষ্টির প্রতীক। নাটকটির নাম ইংরেজি অনুবাদে The Ghost Sonata । অন্য নাটকটিতে নোংরা আবর্জনা থেকে উঠে আসা একটি Castle বা দুর্গের ওপরে স্ফু টনোন্মুখ ফু লের একটি কুঁড়ি রয়েছে যেটি নাটকের শেষে পুরো ফু টে উঠবে। এই ফু লের প্রতীকটি যুক্ত হয়েছে নাটকের নায়িকা পরমাপ্রকৃ তি Eternal Feminine -এর সঙ্গে, যার নাম ‘Dottern’, যার ইংরেজি অনুবাদ ‘Daughter’, এবং রবীন্দ্রনাথ যার আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন-'নন্দিনী'। এই বিখ্যাত নাটকটির নাম ইংরেজি অনুবাদে A Dream Play, লেখক Johann August Strindberg (1849 -1912) । তবে, এ নাটকের ফু লটি অবশ্য রক্তকরবী নয়, চন্দ্রমল্লিকা।৮ তিন রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সাহিত্য ও সংস্কৃ তির সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন, সাম্প্রতিকতম সাহিত্য বা দর্শনেরও খোঁজখবর নিতেন বিভিন্ন বই বা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে বা লোকেন পালিত ও প্রিয়নাথ সেনের মতো বন্ধু দের কাছে। পাশ্চাত্য সাহিত্যের নানা উপাদান তিনি তাঁর রচনায় ব্যবহার করতেও খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু অন্য কেউ তাঁর রচনায় বিদেশি আদর্শের সন্ধান করতে গেলে বা পেলে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত বিরক্ত হতেন।৯ তাঁর এই অসন্তোষ বা বিরক্তি পরে তাঁর ভক্তদের মধ্যেও সংক্রামিত হয়। এর ফলে, রবীন্দ্রনাথের নিজের দেওয়া তথ্য বা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কোনো সত্য বা কাল্পনিক অভিজ্ঞতা, ভারতীয় দর্শন, উপনিষদ, সংস্কৃ ত সাহিত্য, উত্তরবঙ্গে নদীবক্ষ থেকে ছোটো ছোটো প্রাণ ও ব্যথা দেখতে পাওয়া, বাংলাদেশের যাত্রা বা মেলা-এই সবের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের সমস্ত সাহিত্যকর্মের প্রেরণা বা আদর্শ খোঁজার একটি স্বদেশি ঐতিহ্যের সৃষ্টি হয়েছে আমাদের রবীন্দ্রগবেষণার ক্ষেত্রে। নীহাররঞ্জন রায় রবীন্দ্রনাথের রূপকনাটকগুলির ওপর মেটারলিংক, ইয়েটস, হাউপ্টমান, স্ট্রিন্ডবার্গের সিম্বলিস্ট নাটকের সম্ভাব্য প্রভাবের কথা বলেই অনুতপ্ত হয়ে লিখছেন 'আমি সমস্ত জিনিসটাকে ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে দেখিতে গিয়া ভু ল করিলাম কিনা জানি না; ইহাও হইতে পারে, রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই নব নাট্য -রূপের সৃষ্টি করিয়াছেন, পাশ্চাত্য নাট্য -রূপ দ্বারা একেবারেই প্রভাবিত হন নাই।'১০ প্রমথনাথ বিশীর ধারণা, রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটক বা তত্বনাটকগুলিতে কোনো অ -ভারতীয় প্রভাব নেই, সবই ভারতীয় দর্শন, ইতিহাস ও জনজীবন থেকে এসেছে। যাঁরা রবীন্দ্রসাহিত্যে অ -ভারতীয় আদর্শ বা প্রেরণা খুঁজে পান, অধ্যাপক বিশীর মতে তাঁরা শুধু অরসিক নন, তাঁদের পাণ্ডিত্যও 'অপঠিত', অর্থাৎ তাঁরা রবীন্দ্রসাহিত্য ভালো করে পড়েনই নি।১১ স্বাভাবিক ভাবেই, রক্তকরবী সম্পর্কে অধ্যাপক বিশীর লেখা কু ড়ি পৃষ্ঠার আলোচনায় ষ্ঠা

বা তাঁর দুশো আটাশ পৃষ্ঠার রবীন্দ্রনাট্যপ্রবাহ (২য় খণ্ড) বইটিতে রবীন্দ্রনাথের প্রতীকী নাটক প্রসঙ্গে কোনো অ -ভারতীয় নাট্যকার বা নাট্যধারার উল্লেখ নেই, স্ট্রিন্ডবার্গেরও না। অশোক সেন তাঁর রবীন্দ্র নাট্যপরিক্রমা (১৩৬৪) বইয়ে পাশ্চাত্য সিম্বলিস্ট সাহিত্য সম্পর্কে লেখা একটি অধ্যায়ে ব্লেক, ইয়েটস, ইবসেন, হাউপ্টমান, স্ট্রিন্ডবার্গ, ফরাসি প্রতীকী কবিতা, মেটারলিংক, ইউজিন ও'নিল সম্পর্কে ছাত্রবোধ্য কিছু আলোচনা করেছেন। মুক্তধারা ও রক্তকরবী নাটকের আলোচনায় কাইজারের Gas, কাপেকের R.U.R ও বেকেটের Waiting for Godot, এলিয়টের The Waste Land, অডেনের কবিতা, এজরা পাউন্ডের প্রবন্ধ ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন অশোক সেন, কিন্তু স্ট্রিন্ডবার্গের কোনো উল্লেখ করেন নি রক্তকরবী প্রসঙ্গে। শান্তিকু মার দাশগুপ্ত তাঁর রবীন্দ্রনাথের রূপকনাট্য বইয়ের মধ্যে পাশ্চাত্য প্রতীকবাদী সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন অনেকটা অশোক সেনের মতোই। তাঁর ধারণা-'রবীন্দ্রনাথ ইয়োরোপীয় প্রতীকধর্মী লেখকদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া প্রতীকী নাটকগুলি লিখিয়াছেন ইহা মনে করিবার কোনই কারণ নাই।'১২ অথচ পরের বাক্যেই অধ্যাপক দাশগুপ্ত বলেছেন 'তবে তাঁহার প্রতীকী নাটকের কলা -কৌশলে পাশ্চাত্য নাটকের প্রভাব যে কিছু কিছু পড়িয়াছে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।' অধ্যাপক দাশগুপ্তের আলোচনায় স্ট্রিন্ডবার্গের নাম একবার উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কোনো নাটকের সঙ্গে স্ট্রিন্ডবার্গের কোনো নাটকের সম্পর্কের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি অধ্যাপক দাশগুপ্ত। শঙ্খ ঘোষ কিন্তু রক্তকরবী প্রসঙ্গে স্ট্রিন্ডবার্গের A Dream Play নাটকের কথা ভেবেছেন। তাঁর কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক (১৯৬৯) বইটিতে A Dream Play থেকে একটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃ তি ছাড়াও 'রক্তকরবী, ক্রিসেন্থিমাম' নামে আলাদা একটি প্রবন্ধও আছে। অধ্যাপক ঘোষের প্রসঙ্গে আমি পরে ফিরে আসব। চার স্ট্রিন্ডবার্গ সুইডিশ সাহিত্যের সব থেকে খ্যাতিমান লেখক এবং আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের একজন অত্যন্ত প্রতিভাশালী ও প্রভাবশালী নাট্যকার। তাঁর নাটকের সংখ্যা ষাট, এ ছাড়া আছে আটটি আত্মজীবনী (যার মধ্যে Son of a Servant ও Inferno সব থেকে বিখ্যাত), তেরো খণ্ড ছোটোগল্প, উপন্যাস, কবিতা, ইতিহাস ও বিজ্ঞানবিষয়ক রচনা। ইবসেন, নীটশে ও এমিল জোলার প্রভাবে লেখা স্ট্রিন্ডবার্গের প্রথম দিকের ন্যাচারালিস্ট নাটকগুলির মধ্যে সব থেকে বিখ্যাত-The Father (1887), Miss Julie (1888) ও Creditors(1888)। ব্যক্তিগত জীবনের গ্লানিবোধ (তাঁর মা ছিলেন স্ট্রিন্ডবার্গের বাবার পরিচারিকা), দারিদ্র্য, স্বভাবগত অস্থিরচিত্ততা-এইসব নানা কারণে ঠে

১৮৯৪ -৯৬ সালে স্ট্রিন্ডবার্গ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, প্রেতচর্চায় মেতে ওঠেন। তাঁর ধারণা হয় অশরীরী প্রেতাত্মারা তাঁকে পীড়ন করছে, ভয় দেখাচ্ছে। পরে Swedenborg পড়ে কিছুটা সুস্থির হন, এবং তার পরে তাঁর কিছুটা বাস্তব কিছুটা সিম্বলিস্ট -আধ্যাত্মিক নাটকগুলি লেখেন। এই নাটকগুলি হলো A Dream Play (1902), The Road to Damascus (৩ খণ্ড, 1898 -1904), এবং The Ghost Sonata (1907) । এই নাটকগুলিতে স্ট্রিন্ডবার্গ নাটকের বিন্যাস, আঙ্গিক ও মঞ্জসজ্জা সম্পর্কেও নানা ধরনের পরীক্ষা -নিরীক্ষা করেন যেগুলি পরে ইয়োরোপীয় বিশেষত জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট নাটক ও থিয়েটারকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। স্ট্রিন্ডবার্গের এই শেষদিকের নাটকগুলি, Maeterlinck -এর প্রতীকী নাটক ও Gerhart Haupptmann -এর স্বপ্ননাটক Hannele Himmelfahrt (1893), সময়ের দিক থেকে ও আঙ্গিক বা বিষয়বস্তুর দিক থেকে সমগোত্রীয়। এই সময়েই লেখা ইবসেনের The Master Builder (1896) বা When We Dead Awaken (1899) নাটকের মধ্যেও এই সাংকেতিক বা প্রতীকী প্রবণতা রয়েছে যা আমরা লক্ষ করি প্রায় কাছাকাছি সময়ে মেটারলিংকের প্রভাবে লেখা ইয়েটসের The Hour Glass, The Land of Heart’s Desire, The Shadowy Waters ইত্যাদি নাটকের মধ্যেও। The Great Highway (1909) স্ট্রিন্ডবার্গের শেষ নাটক, এটিও সিম্বলিস্ট আঙ্গিকে লেখা একটি আত্মজীবনীমূলক নাটক। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে শুধু সুইডেনে নয়, জার্মানি ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের নাট্যজগতেও স্ট্রিন্ডবার্গ ছিলেন একটি অত্যন্ত পরিচিত ও আলোচিত ব্যক্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথ যখন স্বদেশি আন্দোলন থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর খেয়া ও গীতাঞ্জলি -র মরমি কবিতা ও গানগুলি লিখছেন, বা ১৯০৮ সাল থেকে শারদোৎসব, রাজা, অচলায়তন, ডাকঘর ইত্যাদি কিছুটা আধ্যাত্মিক কিছুটা সামাজিক -রাজনৈতিক সিম্বলিস্ট নাটকগুলি লিখছেন, তখন ইয়োরোপের বুদ্ধিজীবী মহলেও বিশেষ আলোড়ন তু লেছে সিম্বলিস্ট বা প্রতীকী নাটক, বিশেষত যেসব নাটকের বিষয় মুক্তি বা Erlosiing-যে জার্মান শব্দটির মধ্যে সামাজিক মুক্তি ও আধ্যাত্মিক মুক্তি এই দুটি ব্যঞ্জনাই রয়েছে। ১৯১১ ও ১৯১২ সালে কারা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন এটা খেয়াল করলে ১৯০৮ -১৯১১ সালে রূপকনাটক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উৎসাহিত হওয়ার ঘটনাকে খুব আকস্মিক বলে মনে হবে না। ১৯১১ -তে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বেলজিয়ান নাট্যকার Maurice Maeterlinck; ১৯১২ সালে জার্মান নাট্যকার Gerhart Hauptmann । স্ট্রিন্ডবার্গ যেভাবে তাঁর আগেকার ন্যাচারালিস্ট পর্বের নাস্তিকতা ছেড়ে জীবনের শেষের দিকে প্রেতচর্চা, ‘the Invisible Hand’ বা অধ্যাত্মবাদের দিকে এগোচ্ছিলেন, তাতে মনে হয়

আর এক বছর বেঁচে থাকলে তিনিই হয়তো ১৯১৩ সালের নোবেল পুরস্কারটি পেতেন, কারণ টমাস হার্ডি বা আনাতোল ফ্রাঁসের মতো নাস্তিকদের ওই পুরস্কার দেওয়া সম্ভব ছিল না ১৯১৩ সালের ইয়োরোপীয় সাহিত্য -ভাবনার মরমি -আধ্যাত্মিক পরিবেশে। ১৯১২ সালে স্ট্রিন্ডবার্গ মারা যাবার পর রবীন্দ্রনাথই ছিলেন নোবেল পুরস্কারের সব থেকে যোগ্য ও সময়োচিত প্রার্থী, যাঁর ওই সময়কার মানসিকতা Maeterlinck, স্বপ্ননাটকের লেখক Hauptmann বা ১৯০৮ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়া অধ্যাত্মবাদী দার্শনিক Rudolf Eucken -এর মানসিকতা থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। ইয়েটসকেও অবশ্য ১৯১৩ সালেই এ পুরস্কার দেওয়া যেত কারণ তিনিও Maeterlinck -এর খুব কাছাকাছিই ছিলেন সাহিত্যচিন্তা ও অধ্যাত্মভাবনার দিক থেকে। তাছাড়া, ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের মতোই প্রেতচর্চা করতেন, এবং রবীন্দ্রনাথের মতোই তাঁর দেশের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখে self -culture ও অধ্যাত্মবাদের অভিজাত আদর্শে একনিষ্ঠ থেকে আপনমনে সিম্বলিস্ট নাটক লেখায় ব্যস্ত থেকেছেন বেশ কয়েক বছর। রবীন্দ্রনাথের প্রতীকী নাটক প্রসঙ্গে মাঝে মাঝে মেটারলিংকের নাম উচ্চারিত হয়, কিন্তু তার সঙ্গে ইয়েটস, হাউপ্টমান, বিশেষত স্ট্রিন্ডবার্গের কথাও চিন্তা করা দরকার, কারণ যে চিন্তাভাবনাগত পরিবেশে ইয়েটস -হাউপ্টমান বা স্ট্রিন্ডবার্গ তাঁদের প্রতীকী নাটক লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর পড়াশোনার মাধ্যমে সে পরিবেশের খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছিলেন তাঁর রূপকনাটকগুলি লেখার সময়। ১৮৯০ -১৯১৩ সালের ইয়োরোপীয় সিম্বলিস্ট নাটক সম্পর্কে রবীন্দ্র -পাঠকদের বিশেষভাবে উৎসাহিত হওয়া দরকার শুধু রক্তকরবী নাটকের বিষয় বা বিন্যাসগত বৈশিষ্ট্যকে ঠিকমতো বোঝার জন্যেই নয়, সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথের রূপকনাটকগুলির সাময়িক প্রেক্ষিতটিকে ঠিকমতো চিনে নেবার জন্যেও। রবীন্দ্রনাথের ওই নাটকগুলি তাদের ভাবগত ও আঙ্গিকগত দিক থেকে ইয়েটসের প্রথম যুগের প্রতীকী নাটক The Land of Heart’s Desire (1894), The King’s Threshold (1903), The Hour Glass (1904), On Bailey’s Strand (1904), Where There is Nothing (1904), মেটারলিংকের The Blind (1890), The Intruder (1890), The Seven Princesses (1891), The Interior (1894), The Death of Tintagiles (1894), The Blue Bird (1908), হাউপ্টমানের Hannele Himmelfahrt (1893) ও স্ট্রিন্ডবার্গের মানসিক বৈকল্য থেকে সেরে ওঠার পর লেখা The Road to Damascus (1898 -1904), A Dream Play (1902) ইত্যাদি সিম্বলিস্ট নাটকগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। টমসন এ ঠি

সম্পর্কে সঠিক ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন, তবে তাঁর উচিত ছিল এ -বিষয়ে একটু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা। গত শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের এই ইয়োরোপীয় সিম্বলিস্ট সাহিত্য বা শিল্পধারার সঙ্গে অনেক খ্যাতনামা লেখক -শিল্পীর নাম যুক্ত থাকলেও এটি মূলত একটি আত্মকেন্দ্রিক, বাস্তবজীবন ও সমাজবিমুখ, অবক্ষয়ী, ভঙ্গিসর্বস্ব শিল্পচেতনার অভিব্যক্তি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের আর্থনীতিক -রাজনৈতিক সংকটের ফলে ইয়োরোপের সাহিত্যিক -বুদ্ধিজীবী -দার্শনিক -শিল্পীদের একটা বড়ো অংশে যে যন্ত্রসভ্যতাবিরোধী, বিজ্ঞান ও বস্তুবাদবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী, অহংসর্বস্ব, অতীন্দ্রিয়, পরাবাস্তবমুখী চেতনা কাজ করেছিল, Symbolist ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের Expressionist, Dadaist, Absurd ইত্যাদি সাহিত্য ও শিল্প আন্দোলন তারই ফসল। এই চেতনার মূল অনেক গভীরে। এর পেছনে যেসব শিল্পী -দার্শনিকের প্রভাব কাজ করেছে তাঁদের মধ্যে যেমন আছেন ইয়োরোপীয় কলাকৈবল্যবাদের গুরু আমেরিকান কবি ও কথাসাহিত্যিক Edgar Allan Poe ও তাঁর ফরাসি গুরু -শিষ্য Baudelaire ও Mallarme, তেমনি আছেন অজ্ঞেয় ‘things -in -themselves’ -এর প্রবক্তা দার্শনিক Kant, চরম অহংবাদী (‘The world is my representation’), বৌদ্ধ -দুঃখবাদী, নির্বাণকামী Schopenhauer ও তাঁর দু'জন মন্ত্রশিষ্য-একজন হলেন পবিত্র আর্যরক্ত ও শ্রেষ্ঠ -জাতিতত্বে বিশ্বাসী, মৃত্যুবিলাসী (Redemption through self -immolation : Tristan and Isolde, The King of the Nibelungs, The Flying Dutchman, Parsifal) সংগীতপ্রতিভা Richard Wagner, আর একজন গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রবিরোধী, ক্রিস্ট্রিয়ান -মানবতা -বিরোধী, নারীবিদ্বেষী Nietzsche, যাঁর বীরজাতি -তত্ব ও অতিমানব (undermensch) তত্ব, বীরের নীতি (Herrenmoral) ও ‘will to power’ তত্ব নাৎসি জার্মানির সব থেকে বীভৎস বীর মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৯০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে যেসব দার্শনিক কবি বা লেখক ইয়োরোপে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, তাঁদের একটা বড়ো অংশের রচনা পড়লেই বোঝা যায় এইসব subjectivism, anti -intellectualism, Irrationalism, Herrenmoral, Will to power, Vitalism, Racism, Intutionism, Theosophy, ‘Back to Nature’ ইত্যাদি ধ্যানধারণা বা প্রবণতা ইয়োরোপের বুকে খুব শীগগিরই একটা ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে-যার নাম ফ্যাসিজম। আমাদের মনে রাখা ভালো যে ‘Der Führer’ ও ‘Heil’ এই দুটি কু খ্যাত শব্দই চালু করেছিলেন একজন বিখ্যাত সিম্বলিস্ট কবিStefan George,১৩ এবং ফ্যাসিস্ট ইতালির Black Shirt গুন্ডাবাহিনীর প্রথম সংগঠক

ছিলেন একজন চরম কলাবৈকল্যবাদী কবি -নাট্যকার -কথাসাহিত্যিক Gabriele D’ Annunzio, মুসোলিনির গুরু এবং বন্ধু । Ernest Renan সিম্বলিস্ট কবিদের বলেছিলেন 'আঙু লচোষা খোকারা’-‘children sucking their thumbs '। সিম্বলিজম ঠিক অতটা নিরীহ ব্যাপার না হলেও Renan এইসব শিল্পীদের সমাজবাস্তব -বিচ্ছিন্ন আত্মকণ্ডূয়নের প্রবণতাটিকে সঠিকভাবেই চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের এই ইয়োরোপীয় সিম্বলিস্ট আন্দোলনটি খুব একটা সুস্থ, জীবনমুখী, প্রাণবন্ত, সমাজচেতন, মানবিক শিল্পধারা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ কেন এবং কীভাবে এই অবক্ষয়ী fin de siecle আন্দোলনটির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন এটি একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক গবেষণার বিষয় হওয়া উচিত। পাঁচ রবীন্দ্রনাথ ঠিক কোন সময় স্ট্রিন্ডবার্গের নাটক সম্পর্কে উৎসাহিত হয়েছিলেন আমরা জানি না, নিজের পড়াশোনা সম্পর্কে কোনো হদিশ রেখে যাওয়া রবীন্দ্রনাথ খুব একটা পছন্দ করতেন না। ১৯০৮ সাল থেকে অর্থাৎ ক্ষু দিরামের ফাঁসি ও মানিকতলা বোমার মামলার সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের বালকদের নিয়ে ঋতু উৎসব করার জন্যে বা সাধারণভাবে তাদের নাচ -গান -উৎসবে মাতিয়ে রাখার জন্য তাঁর আধ্যাত্মিক -সামাজিক -রাজনৈতিক রূপকনাটকগুলি লিখতে শুরু করেছিলেন। শঙ্খ ঘোষ বলেছেন '' 'শারদোৎসব' থেকে যে নাটকগুলি লেখা হচ্ছিল তার একটা প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য ছিল শান্তিনিকেতনের প্রমোদভাবনা।''১৪ ১৯০৮ সালের বাংলাদেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিবেশটিকে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের প্রমোদের উপযুক্ত সময় হিসেবে কেন বেছে নিলেন, বা ওই পরিবেশের কি ধরনের প্রভাব রবীন্দ্রনাথের ওই সময়ে লেখা মিস্টিক নাটকগুলির বক্তব্য পাত্র -পাত্রী বা ঘটনার ওপর পড়েছিল এ সম্পর্কে রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞরা আমাদের বিশেষ কিছু জানাননি। ১৯০৮ সালের কাছাকাছি সময়ে রবীন্দ্রনাথ কী ধরনের বইপত্র পড়ছেন তারও কোনো সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না রবীন্দ্রজীবনীগুলিতে। সবই আমাদের সন্ধান করে নিতে হচ্ছে তাঁর ওই সময়ে লেখা প্রবন্ধ, উপন্যাস বা নাটকের text থেকে। ১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথ গোরা উপন্যাসটিও লিখছিলেন। উপন্যাসটি একটু মন দিয়ে পড়লে আমরা বেশ স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারি যে ওই সময়ে তিনি যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে George Eliot -এর Felix Holt the Radical উপন্যাসটি পড়ছেন এবং কাছাকাছি সময়ে Turgenev -এর Fathers and Sons ও Oliver Goldsmith -এর The Vicar of Wakefield ও পড়েছিলেন। ১৯০৮ -১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথ যে খুব একটা

স্বয়ম্ভর creative পর্বে ছিলেন তা মনে হয় না গোরা পড়ে।১৫ উপন্যাসের মতো একটা পরিচিত অভ্যস্ত সাহিত্যটাইপের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ যখন কোনোরকম ঝুঁকি না নিয়ে প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছেন বিদেশি জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকদের রচনার ওপর, তখন সিম্বলিস্ট নাটকের মতো একটি অতিসাম্প্রতিক ও যথেষ্ট ঝাপসা বিদেশি নাট্যরূপের ক্ষেত্রে তিনি ইয়েটস, মেটারলিংক, হাউপ্টমান বা স্ট্রিন্ডবার্গের মতো সেই সময়কার খ্যাতিমান প্রতীকী নাট্যকারদের রচনা আগে না পড়ে নিয়ে শুধু বাংলাদেশের মেলা আর যাত্রার ওপর ভরসা রেখেই সিম্বলিস্ট নাটক লিখতে বসবেন একথা ভাবতে পারা একটু কঠিন। রবীন্দ্রনাথ ঠিক ততখানি হঠকারী স্বভাবশিল্পী ছিলেন না। তাঁর রূপক নাটকগুলির বক্তব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত উক্তি থেকে মনে হয় ১৯০৮ সালে শারদোৎসব লেখার আগেই তিনি অন্তত স্ট্রিন্ডবার্গের A Dream Play নাটকটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিচিত হয়েছিলেন। স্ট্রিন্ডবার্গের The Road to Damascus, A Dream Play ও The Ghost Sonata এই তিনটি নাটকের মূল বিষয়ই হলো Erlosüng, অর্থাৎ মুক্তি। এই Erlosüng কথাটি দুটো মানেতেই ব্যবহার করা যায়-একটা হলো Redemption বা ঋণশোধ বা ঋণ থেকে মুক্তি; আর একটি মানে হলো আধ্যাত্মিক মুক্তি বা deliverance, liberation, salvation। স্ট্রিন্ডবার্গ তাঁর একটি আত্মজীবনী Inferno -তে লিখেছেন : ‘Let us rejoice in our torments which are so many debts reapid '। তাঁর শেষের দিকের নাটকগুলির মূল বিষয়ই এই ঋণশোধ দুঃখের মধ্যে দিয়ে জীবনের ঋণ শোধ করতে হবে, মৃত্যুই মুক্তি। A Dream Play নাটকের একটি প্রধান চরিত্র Poet বলছে : ‘Surely suffering is redemption and death deliverance '। নাটকের অন্য একটি চরিত্র Officer -ও ওই একই কথা বলছে :: ‘Every joy has to be paid for twice with sorrow '। স্ট্রিন্ডবার্গের এই নাটকগুলির ঋণশোধের ধুয়া শারদোৎসব থেকে ফাল্গুনী পর্যন্ত লেখা রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকগুলিরও ধুয়া হয়ে গেল দেখে বেশ আশ্চর্য লাগে। সবুজপত্র -এ প্রকাশিত (১৩২৪, আশ্বিন -কার্তিক) 'আমার ধর্ম' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলছেন শারদোৎসব থেকে আরম্ভ করে ফাল্গুনী পর্যন্ত যতগুলি নাটক লিখেছি, যখন বিশেষ করে মন দিয়ে দেখি তখন দেখতে পাই, প্রত্যেকের ভিতরকার ধুয়াটা ঐ একই। রাজা বেরিয়েছেন সকলের সঙ্গে মিলে শারদোৎসব করার জন্যে। তিনি খুঁজছেন তাঁর সাথী। পথে দেখলেন ছেলেরা শরৎপ্রকৃ তির আনন্দে যোগ দেবার জন্যে উৎসব করতে বেরিয়েছে।...উপনন্দ প্রভু র ঋণশোধ করার জন্যে নিভৃ তে বসে এক মনে

কাজ করছিল। রাজা বললেন তাঁর সত্যকার সাথী মিলেছে কেন না, ঐ ছেলেটি দুঃখের সাধনা দিয়ে আনন্দের ঋণ শোধ করছে- সেই দুঃখেরই রূপ মধুরতম। দু'বছর পরে শান্তিনিকেতন পত্রিকায় (১৩২৬) রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ওই একই কথা :: 'শারদোৎসবের মূল অর্থটি এই ঋণশোধের সৌন্দর্য।...উপনন্দ তাহার প্রভু র নিকট হইতে প্রেম পাইয়াছিল, ত্যাগ স্বীকারের দ্বারা প্রতিদানের পথ বাহিয়া সে যতই সেই প্রেমদানের সমান ক্ষেত্রে উঠিতেছে ততই সে মুক্তির আনন্দ উপলব্ধি করিতেছে।' ত্যাগ ও দুঃখের মধ্যে দিয়ে মুক্তিলাভ A Dream Play নাটকেরও মূল বিষয় ‘The desire for suffering as a spiritual yearning for deliverance’ (Maurice Valency, ‘The Flower and the Castle’, New York,(1963), । এই ত্যাগ -স্বীকারের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কও খুব ঘনিষ্ঠ স্ট্রিন্ডবার্গের নাটকে। নাটকের নায়িকা 'নন্দিনী' (Dottern) বলছে ‘in order to be free from the earthly element, the descendants of Brahma sought renunciation and suffering. And so you have suffering as the deliverer. But this yearning for suffering comes into conflict with the longing for joy, for love. Now you understand what love is; supreme joy in the greatest suffering, the sweetest is the most bitter। ফাল্গুনী -র পরে লেখা মুক্তধারা ও রক্তকরবী -ও এই ত্যাগ ও দুঃখের মধ্যে দিয়ে মুক্তি অর্জনের নাটক। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের উক্তির সূত্র ধরে একথা হয়তো বলা যায় যে শারদোৎসব (১৯০৮) থেকে রক্তকরবী (১৯২৩) পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ যতগুলি রূপক নাটক লিখেছেন তার সবগুলিই যা ধুয়া, স্ট্রিন্ডবার্গের A Dream Play নাটকেরও অবিকল তাই ধুয়া-ঋণশোধ। এই ধুয়াসামীপ্যের জন্যে দৈবকে সম্পূর্ণ দায়ী করা বোধহয় সংগত হবে না। ছয় A Dream Play নাটকটি ভারি অদ্ভু ত। এটি পড়তে পড়তে কেবলই মনে হয় এ নাটকের বেশ কিছু সংলাপ আমরা কোথায় যেন আগে পড়েছি। রক্তকরবী নাটকের সঙ্গে A Dream Play -র সম্পর্ক প্রসঙ্গে আসার আগে ওই ধরনের দু'একটি ঘটনা বা সংলাপের উল্লেখ করা যেতে পারে। A Dream Play নাটকের একটি চরিত্র ‘Poet’ বা কবি নাটকের নায়িকা নন্দিনীকে বলছে Yet the children of men believe that poets merely play-invent and fabricate '। উত্তরে নন্দিনী বলছে :

It is just as well, my friend, or else the world would be laid waste from lack of endeavour. All men would lie upon backs, gazing at the heavens, no hand would be lifted to plough or spade or plane or axe. কবিরা মোটেই অলস স্বপ্নবিলাসী নয়, তারাই মানুষকে কাজের প্রেরণা জোগায়-এই সংলাপটি A Dream Play নাটকে পড়ার সময় মনে হয় এ সংলাপ যেন স্ট্রিন্ডবার্গের লেখা নয়, রবীন্দ্রনাথের ফাল্গুনী নাটকের একটি সংলাপের অনুবাদ : ওরা আমাদের গাল দেয় বলে নিষ্কর্মা.... পৃথিবীতে যত কবি যত কবিত্ব সমস্ত যদি ধুয়ে মুছে ফেলতে পার তাহলেই প্রমাণ হবে এতদিন কেজো লোকেরা তাদের কাজের জোরটা কোথা থেকে পাচ্ছিল, তাদের ফসল ক্ষেতের মূলের রস জুগিয়ে আসছে কারা। A Dream Play নাটকের একটি দৃশ্যে বেশ ছুটির আমেজ রয়েছে। নায়িকা নন্দিনী বলছে : ‘Here is peace and happiness, Holiday time. Work over, everyday a festival, everyone in holiday attire. Music and dancing even in the morning. Why don’t you go in and dance my dears? ’ এই সংলাপটি পড়ার সময় মনে হয় শুধু 'ঋণশোধ' নয় শারদোৎসব নাটকের ছুটি ও নাচগানের মেজাজ বা আমেজও লেগেছে স্ট্রিন্ডবার্গের কলমে। এমনকী ‘Even in the morning’ -এর নাচগানফু র্তি দেখে বা শুনে মনে হয় লক্ষেশ্বর এই সকালবেলার নাচগান দেখেই বোধহয় বিরক্ত হয়ে বলেছিল 'সক্কাল বেলা কানের কাছে চেঁচাতে আরম্ভ করেছে।' A Dream Play নাটকের একটি চরিত্র Kristin -এর কাজ শুধু ঘরের সব জানালা দরজার ফাঁকফোকর আটকে বেড়ানো, বাইরের আলোহাওয়া যেন কোনোমতেই ঘরের ভেতর না ঢোকে। Kristin -কে দেখে প্রায়ই মনে হয় সে যেন অচলায়তন আর ডাকঘর নাটকের জানালাদরজা বন্ধ করে এসেছে এইমাত্র। A Dream Play নাটকে নন্দিনী সব থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছে ‘From my vision dimmed by having eyes, my hearing dulled by having ears '-অর্থাৎ জড়জগতের চোখে -দেখার কানে -শোনার অতৃ প্তি থেকে। রাজা নাটকে সুদর্শনা বোধ হয় ঠিক এই কথাই বলতে চেয়েছে 'ইচ্ছে করছে চোখে -দেখা কানে -শোনা ঘুচিয়ে দিই।' ফাল্গুনী নাটকের অন্ধ বাউল চোখ দিয়ে দেখে না, কিন্তু পায়ের শব্দ শুনতে পায়, যেমন A Dream Play নাটকের Blind Man চোখে দেখতে পায় না, কিন্তু কানে শুনতে পায় ‘I cannot see, but I hear '। ইয়েটস, স্ট্রিন্ডবার্গ ও রবীন্দ্রনাথের অন্ধ

চরিত্রগুলির একটা স্পষ্ট পারিবারিক সাদৃশ্য আছে, তার কারণ হয়তো এটাই যে এরা সবাই এসেছে মেটারলিংকের বেশি দেখতে -পাওয়া সেয়ানা -অন্ধদের কাছ থেকে। অচলায়তন নাটকে দাদাঠাকু র যে ভগবানের দূত একথা প্রথমেই বুঝতে পেরেছে কবি -প্রাণ পঞ্চক। কবিদের সঙ্গে ভগবানের একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সবদেশেই আছে, কারণ ভগবানই বিশ্বকবি। তবে ইয়েটসের মতো স্ট্রিন্ডবার্গও এই ব্যাপারটি রেখেছেন A Dream Play -তে। সব চরিত্রগুলির মধ্যে একমাত্র Poet -ই বুঝতে পেরেছে নন্দিনী মানবী নয় ‘I shall believe you for I know who you are '। আগুনের শিখার সামনে দাঁড়িয়ে স্ট্রিন্ডবার্গের নন্দিনী যখন বলে ‘This is what you call death and approach with so much fear, ’ তখন মনে হয় নন্দিনী যেন রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকের রাজার একটি সংলাপেরই প্রতিধ্বনি করছে 'আমাকে হঠাৎ দেখে সইতে পারে না-আমাকে বিপদ মনে করে আমার কাছ থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে চায়।' A Dream Play নাটকের শেষ দৃশ্যে নন্দিনী যখন আগুনের শিখায় আত্মাহুতি দিচ্ছে তখন মনে হয় রাজা ও রানী নাটকটিকে ১৯২৯ সালে তপতী নাটকে রূপান্তরিত করার সময় সুমিত্রার আগেকার 'পতন ও মৃত্যু' -র বদলে চিতার আগুনে আত্মাহুতি দেবার প্রেরণা রবীন্দ্রনাথ শুধু ঈশোপনিষদের 'বায়ুরনিলমমৃতমহেদং ভস্মান্তং শরীরম' থেকেই সম্ভবত পাননি। শুধু স্ট্রিন্ডবার্গের একটি নাটক A Dream Play থেকে নেওয়া এই তথ্যগুলি থেকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ তাঁর রূপক নাটকগুলি লেখার আগে বা সে -সময় বেশ যত্ন করেই স্ট্রিন্ডবার্গ পড়েছিলেন। ইয়েটস, হাউপ্টমান বা মেটারলিংক -এর কথা আপাতত তু লছি না, কেননা তাহলে আমাদের মূল প্রসঙ্গ রক্তকরবী -তে পৌঁছোতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তবে তু ললে বোঝা যেত রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকের পুঁথিসর্বস্ব বিদ্যাবাগীশ, অবিশ্বাসী অধ্যাপক, রসিকপাগল ঠাকু র্দা, সব দেখতে -পাওয়া অন্ধ, অসুস্থ শিশু চরিত্র, তার সঙ্গে মৃত্যুর হাতছানি, ডাকঘরের চিঠি, রূপকথার ইশারা, নীল পাহাড়ের সবুজ পাখি, ফাল্গুনীর জরা -যৌবন তত্ব-যে জনজীবন থেকে এসেছে তার সবটাই বাংলাদেশের নয়, কিছুটা বেলজিয়াম, আয়ার্ল্যান্ড, সুইডেন বা জার্মানিরও হতে পারে। তখন হয়তো এটাও বোঝা যেত যে রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকগুলিকে যেসব সমালোচক পশ্চিমি কোনো নাট্যধারার সঙ্গে মেলাতে চেয়েছেন তাঁদের যতটা বিভ্রান্ত মনে করে আমরা স্বস্তি পেয়েছি ততটা বিভ্রান্ত তাঁরা না -ও হতে পারেন। সাত

রক্তকরবী নাটকের বিষয়ের সঙ্গে একটি পশ্চিমি নাটকের বিষয়ের অনেকখানি মিল যাঁরা দেখতে পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন শঙ্খ ঘোষ। রবীন্দ্রনাটকের আঙ্গিক ও অভিনয়ের নানা দিক সম্পর্কে লেখা তাঁর কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক বইয়ের দুটি প্রবন্ধে অধ্যাপক ঘোষ রক্তকরবী প্রসঙ্গে স্ট্রিন্ডবার্গের A Dream Play নাটকটির উল্লেখ করেছেন। একটি প্রবন্ধের নাম 'সংগত প্রতিমা,' আর একটি 'রক্তকরবী, ক্রিসেন্থিমাম'। প্রথম প্রবন্ধটিতে রক্তকরবী নাটকের সংলাপের চিত্রময়তা প্রসঙ্গে শঙ্খ বলছেন ''স্ট্রিন্ডবার্গের 'স্বপ্ননাটক' [A Dream Play] মনে করিয়ে দেয় বটে 'রক্তকরবী' -র নাট্যবিষয়, দুয়ের সাদৃশ্য অনেকটাই।' স্ট্রিন্ডবার্গের নন্দিনীর সঙ্গে নাটকের আর একটি চরিত্র রাজকর্মচারীর একটি সংলাপ ও রবীন্দ্রনাথের নন্দিনীর সঙ্গে রাজার একটি সংলাপ পরপর রেখে শঙ্খ বলছেন 'খুবই সদৃশ, কিন্তু প্রভেদ এই যে 'স্বপ্ননাটকে' এদের পারস্পরিক সংলাপ ঐ একবারই উদ্বেল হয়ে ওঠে প্রতিমাবিন্যাসে, 'রক্তকরবী'তে এ -উদাহরণ অনেকের একটি মাত্র।' শঙ্খ ঘোষের এই মন্তব্যগুলি থেকে বোঝা যাচ্ছে তিনি স্ট্রিন্ডবার্গের A Dream Play ও রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকের বিষয়ের মধ্যে অনেকটা সাদৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন এবং একটি সংলাপের মধ্যেও দুটি নাটকের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা লক্ষ করছেন। 'রক্তকরবী, ক্রিসেন্থিমাম' প্রবন্ধটি মূলত রক্তকরবী নাটকের অভিনয় সম্পর্কে লেখা। কিন্তু তারই মধ্যে শঙ্খের মনে পড়েছে A Dream Play নাটকের মূল প্রতীক দুর্গ ও ফু লের সঙ্গে রক্তকরবী নাটকের প্রতীক দুর্গ আর ফু লের সাদৃশ্যের কথা 'তারও প্রতীক গ'ড়ে ওঠে এক দুর্গ আর এক ফু লে।' রবীন্দ্রনাথের নন্দিনীর সঙ্গে স্ট্রিন্ডবার্গের নায়িকার মিলও তিনি লক্ষ করেছেন, যেমন লক্ষ করেছেন দুটি নাটকের বক্তব্যের সাদৃশ্যও 'এ নাটকও দেখাতে চায় জড় বস্তুপিণ্ড থেকে চেতনার মুক্তি, অহংময়তা থেকে নির্গলিত হবার পথ।' রক্তকরবী নাটকের সঙ্গে A Dream Play -র অন্য কোনো সাদৃশ্যের উল্লেখ করেননি শঙ্খ ঘোষ, তবে তাঁর দুটি প্রবন্ধ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে A Dream Play ও রক্তকরবী নাটকের বিষয়, দুর্গের পটভূ মি, দুর্গ ও আবর্জনা থেকে উঠে এসে আলোর দিকে ফু টে ওঠা ফু লের প্রতীক, নায়িকার নাম চরিত্র ও কার্যকলাপ, এবং অন্তত একটি সংলাপ, খুবই সদৃশ। প্রাচ্য দেশের সহজ সরল গ্রামজীবন, মেলা ও পথের উপাদান নিয়ে লেখা বাংলা নাটক রক্তকরবী -তে কেন এবং কীভাবে একটি সুইডিশ নাটকের এতগুলি উপাদান এসে গেল এ সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষ কোনো মন্তব্য করেননি। A Dream Play নাটকের আবর্জনা থেকে উঠে আসা আলোর দিকে ফু টে ওঠা চন্দ্রমল্লিকা কেন আবার রবীন্দ্রনাথের ঘরের পাশে জালজঞ্জালের মধ্যে রক্তকরবী হয়ে ফু টল বা ওই আশ্চর্য গল্পটি মৃত্যুর আগে রবীন্দ্রনাথকে কেন ক্ষিতিমোহন সেনকে বলে যেতে হলো, এ সম্পর্কেও কোনো আলোচনা করেননি শঙ্খ ঘোষ তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধটিতে। আমার মনে

হয়, A Dream Play নাটকের সঙ্গে রক্তকরবী -র অন্যান্য কয়েকটি সাদৃশ্য লক্ষ করলে প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়া কিছুটা সহজ হবে। আট A Dream Play নাটকের প্রস্তাবনার পরেই মূল নাট্যকাহিনির প্রথম দৃশ্যে আমরা দুটি চরিত্রকে কথা বলতে দেখছি-নন্দিনী আর একজন কাচমিস্ত্রি, মূল নাটকে যাকে বলা হয়েছে Glas -master, ইংরেজি অনুবাদে Glazier। তারা কথা বলছে নাটকের কেন্দ্রীয় প্রতীক আবর্জনা থেকে উঠে আসা আধফোটা চন্দ্রমল্লিকা ফু ল সম্পর্কে। কাচমিস্ত্রি বলছে ফু ল ধুলো ভালোবাসে না, তাই সে আলোর দিকে উঠে যায় যত তাড়াতাড়ি পারে ‘They don’t like the dirt, so thay shoot up as fast as they can into the light-to blossom and to die '। রক্তকরবী নাটকও শুরু হয়েছে কিশোরের সঙ্গে নন্দিনীর ফু ল নিয়ে কথাবার্তার মধ্যে। কিশোরও জঞ্জালের মধ্যে ফু ল খুঁজে পেয়েছে। ‘dirt’ ও ‘light’ -ও রয়েছে দু'চার লাইন পরে। অধ্যাপকের কথায় 'আমাদের যা কিছু ধন সব এই ধুলোর নাড়ীর ধন-সোনা। কিন্তু সুন্দরী, তু মি যে সোনা সে তো ধুলোর নয়, সে যে আলোর।' A Dream Play -তে অহংবোধের দুর্গে বন্দি রাজকর্মচারী সম্পর্কে নন্দিনী বলেছে ‘I believe there is a Prison inside waiting for me to set him free '। রক্তকরবী -র নন্দিনীও যক্ষপুরীর দুর্গে বন্দি রাজা সম্পর্কে বলছে 'ইচ্ছে করে ঐ বিশ্রী জালটাকে ছিঁড়ে ফেলে মানুষটাকে উদ্ধার করি।' একটু পরেই স্ট্রিন্ডবার্গের নন্দিনী দুর্গের মধ্যে ঢু কে রাজকর্মচারীকে বলবে ‘you are a prisoner in your own room, I have come to set you free’, যেমন রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী রাজাকে বলবে তু মিতো নিজেকেই জালে বেঁধেছ'... 'তু মিও বেরিয়ে এসো রাজা'। রক্তকরবী -তে রাজা প্রথম থেকেই নন্দিনীকে যেমন নাম ধরে ডেকেছে 'নন্দা' 'নন্দিন' এইসব বলে, রাজকর্মচারীও তেমনি স্ট্রিন্ডবার্গের নন্দিনীকে নাম ধরে ডেকেছে প্রথম দর্শনেই, অর্থাৎ দুটি নাটকের শুরুতেই নন্দিনীর প্রতি আকৃ ষ্ট হয়েছে দুর্গে বন্দি রাজা বা রাজকর্মচারী। A Dream Play নাটকের নন্দিনী -রাজকর্মচারীর যে সংলাপটি শঙ্খ ঘোষ অনুবাদ করে দিয়েছেন সেটি এইরকম : Daughter : What do you see in me? রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী আমার মধ্যে কি দেখছ? Officer : The beautiful, which is the harmony of the universe. There are lines in your form which I have only found in the

movement of the stars, in the melody of strings, in the vibrations of light... ’ রক্তকরবী -র রাজা বিশ্বের বাঁশিতে নাচের যে ছন্দ বাজে সেই ছন্দ।... সেই ছন্দে গ্রহনক্ষত্রের দল...আকাশে আকাশে নেচে বেড়াচ্ছে। সেই নাচের ছন্দেই নন্দিনী, তু মি এমন সহজ হয়েছ, এমন সুন্দর। এই সংলাপটি সম্পর্কেই শঙ্খ ঘোষ মন্তব্য করেছেন-'খুবই সদৃশ'। রক্তকরবী নাটকে শ্রমিকেরা সোনা তু লে আনে মাটির তলা থেকে, A Dream Play নাটকের শ্রমিকেরা কয়লা তোলে খনি থেকে। রক্তকরবী -র সর্দারেরা শ্রমিকদের নামের বদলে নম্বর ধরে ডাকে, স্ট্রিন্ডবার্গের নাটকেও তারা শুধু 1st Coal Heaver, 2nd Coal Heaver, নাম কিছু নেই। A Dream Play নাটকে বুর্জোয়া সমাজের চারটি স্তম্ভ রয়েছে-Theology, Philosophy, Medicine আর Law; রক্তকরবী -তে আছে গোঁসাই, অধ্যাপক, চিকিৎসক ও সর্দার। রক্তকরবী -র সর্দারদের মতো A Dream Play নাটকের ‘Police’ -ও সবসময় নজর রাখে শ্রমিকের ওপর, তাদের পুরীর চারপাশে বেড়া, বাইরের পল্লীপ্রকৃ তির মধ্যে যাওয়ার কোনো উপায় নেই ‘There is no country, it is all fenced in '। ফাগুলালকে চন্দ্র যখন বলেছিল কাজ ছেড়ে দিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যেতে, ফাগুলাল জবাবে ঠিক এই কথাই বলেছে 'ঘরের রাস্তা বন্ধ, জান না বুঝি।' স্ট্রিন্ডবার্গের শ্রমিকদের কাছে এই নগর নরক ‘This is hell, pure hell’; ফাগুলালও যক্ষপুরীকে বলেছে-'অন্ধ নরক'। স্ট্রিন্ডবার্গের নন্দিনী এসেছে পৃথিবীর মানুষের দুঃখের ভাগ নিতে, সবাইকে সে ভালোবাসে। কিন্তু মমতাময়ী নন্দিনীকে মোড়লরা মনে করে ডাইনি। Chancellor ও তার দলবল চেঁচিয়ে উঠেছে ‘Then stone her’, পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলো নন্দিনীকে, ঠিক যেমন রক্তকরবী নাটকে গোকু ল বলেছে 'সবার আগে এই ডাইনীকে পুড়িয়ে মারতে হবে।' বিশু -নন্দিনীর ভালোবাসার সম্পর্কের মধ্যে যে ত্যাগ ও দুঃখ সহ্য করার আদর্শ আমরা লক্ষ করি স্ট্রিন্ডবার্গের নন্দিনী অবিকল ওই আদর্শের কথাই বলেছে ‘Now you understand what love is; supreme joy in the greatest suffering '। বিশু বলছে ফাগুলালকে 'কাছের পাওনাকে নিয়ে বাসনার যে দুঃখ তাই পশুর, দূরের পাওনাকে নিয়ে আকাঙ্ক্ষার যে দুঃখ তাই মানুষের।' জড়জগতের পার্থিব বাসনার দুঃখ থেকে মুক্তির এই পথনির্দেশই করেছে স্ট্রিন্ডবার্গের নন্দিনী ‘in order to be freed from the earthly element, the descendants of Brahma sought renunciation and suffering. And so you have suffering as the

deliverer '। মুক্তিদাত্রী নন্দিনীকে বিশুও ডেকেছে 'দুখজাগানিয়া' বলে 'আমার সেই চিরদুঃখের দূরের আলোটি নন্দিনীর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।' রক্তকরবী নাটকের শেষে নন্দিনী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে সর্দারের হাতে, A Dream Play নাটকের শেষে নন্দিনী আত্মাহুতি দিয়েছে আগুনের শিখায়। স্ট্রিন্ডবার্গের নন্দিনী আসলে দেবরাজ ইন্দ্রের কন্যা, তার ‘Agnes’ নামের ভেতরে লুকোনো আছে 'অগ্নি' শব্দটি। রবীন্দ্রনাথ স্ট্রিন্ডবার্গের এই ইঙ্গিতটু কু ও ব্যবহার করেছেন নন্দিনীর সঙ্গে সর্দার ও রাজার সংলাপে। নন্দিনী বলছে 'বিদ্যুৎশিখার হাত দিয়ে ইন্দ্র তার বজ্র পাঠিয়ে দেন। আমি সেই বজ্র হয়ে এসেছি।' সর্দার নন্দিনীর মধ্যে স্ট্রিন্ডবার্গের 'অগ্নি' -কে চিনতে পেরে বলে উঠেছে 'ওগো, ইন্দ্রদেবের আগুন'। রাজা -ও নন্দিনীর মধ্যে চিনতে পেরেছে স্ট্রিন্ডবার্গের ‘Agnes’ বা 'অগ্নি' -কে 'নন্দিনী, তোমার ভিতরেও আছে আগুন, রাঙা আগুন।' রক্তকরবী নাটকের শেষ মুহূর্তে ফিরে এসেছে প্রতীকী ফু ল রক্তকরবীর উল্লেখ; A Dream Play নাটকও শেষ হয়েছে নাটকের কেন্দ্রীয় প্রতীক চন্দ্রমল্লিকা কুঁড়িটির সম্পূর্ণ প্রস্ফু টিত হয়ে ওঠার সঙ্গে ‘The flower -bud on the roof bursts into a giant chrysanthemum '। নয় প্রমথনাথ বিশীর কাছে আমরা জানতে পেরেছি যে রবীন্দ্রনাথের 'তত্বনাটকগুলির টেকনিকের মূলে কোন বিদেশীয় নাটকের আদর্শ নাই।'১৬ কিন্তু কতরকমের বিদেশি নাটক ও নাট্যধারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ফলে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তার কোনো ইঙ্গিত আমরা পাই না তাঁর রবীন্দ্রনাট্যপ্রবাহ বইয়ের মধ্যে। শঙ্খ ঘোষ রক্তকরবী ও A Dream Play নাটকের বিষয়, নায়িকা, সংলাপ ও কেন্দ্রীয় প্রতীকের মধ্যে সদৃশতা লক্ষ করেছেন, কিন্তু রক্তকরবী -র বিন্যাস বা আঙ্গিকের মধ্যে A Dream Play নাটকের আঙ্গিকগত কোনো বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছেন কিনা এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। তাঁর ধারণা রবীন্দ্রনাথ তাঁর রূপক নাটকগুলির আঙ্গিকগত উপাদানগুলি সংগ্রহ করেছিলেন বাংলার জনজীবন ও লোকসংস্কৃ তি, বিশেষত যাত্রা থেকে। তাঁর এই অনুমানে আপত্তি করার কিছু নেই, তবে A Dream Play নাটকের বিষয়, নায়িকা, প্রতীক বা কোনো কোনো সংলাপের সঙ্গে রক্তকরবী -র সাদৃশ্য লক্ষ করার সময়, দুটি নাটকের আঙ্গিকের মধ্যেও স্পষ্ট ও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ কিছু লক্ষ না করা বেশ কঠিন বলেই মনে হয় আমার। শঙ্খ ঘোষের আর একটি মন্তব্যের অর্থ বোঝাও সহজ হয়নি আমার পক্ষে। শঙ্খ রক্তকরবী নাটকের সঙ্গে A Dream Play -র প্রতিতু লনা করে বলেছেন ''স্বপ্ননাটক'কে

দেখাতে হবে স্বপ্নচ্ছায়ার মতো, সবটা প্রায় একই স্তরে। 'রক্তকরবী'কে নিয়ে আসতে হবে জাগ্রত জগতে। জাগ্রত জগতে, অথচ সম্পূর্ণই আমাদের চেনাজানা চব্বিশ ঘণ্টার সীমানার মধ্যেও নয়।' এই মন্তব্যটি যাঁরা A Dream Play নাটকটি পড়েননি তাঁদের মনে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। A Dream Play নাটকটির নামের মধ্যে ‘Dream’ কথাটি থাকলেও, এ নাটকের টু করো টু করো দৃশ্য বা ‘Station’ -গুলির মধ্যে কোনো স্বপ্নসুলভ ছায়াচ্ছন্নতা নেই, বরং দৃশ্যগুলির বেশিরভাগই যথেষ্ট ন্যাচারালিস্টিক। Maurice Valency এ সম্পর্কে একটি চমৎকার মন্তব্য করেছেন A Dream Play is a play, not a dream. It is a montage of scenes in prose and verse composed in accordance with a conscious artistic aim, and for a wholly rational purpose. The play has therefore the enigmatic character of a work of art, and not at all the enigmatic character of a dream...১৭ স্ট্রিন্ডবার্গ তাঁর নাটকের নাম A Dream Play দিয়েছেন এইজন্যে যে নাটকের দৃশ্যগুলির স্থান ও কালের বিন্যাসের মধ্যে একটা আপাতঅসংলগ্নতা আছে, একই চরিত্রকে টু করো টু করো করে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মধ্যে উপস্থাপিত করা হয়েছে, দৃশ্যগুলির মধ্যে কোনো কালানুক্রমিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। স্থানকালপাত্রের এই আপাত অসংলগ্ন উপস্থাপনা বা বিন্যাসের জন্যেই নাটকটির নাম A Dream Play। পুরো নাটকটি একটি চরিত্র Poet -এর স্বপ্ন, যে Poet আবার নাটকের লেখক স্ট্রিন্ডবার্গেরই পরিবর্ত বা surrogate হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে নাটকে। স্ট্রিন্ডবার্গ নিজেই A Dream Play নাটকের এই আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যের দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন নাটকের ভূ মিকায় : In this dream play, as in his former dream play To Damascus, the Author has sought to reproduce the disconnected but apparently logical form of a dream. Anything can happen : everything is possible and probable. Time and space do not exist...the characters are split, double and multiply; they evaporate crystallise, scatter and converge. But a single consciousness holds sway over them all-that of the dreamer.১৮ A Dream Play নাটকের দৃশ্যবিন্যাসে এই ইচ্ছাকৃ ত বিশৃঙ্খলা থাকলেও প্রত্যেকটি দৃশ্যকেই বাস্তবসম্মত পদ্ধতিতে উপস্থাপিত করা হয়েছে, আলাদা আলাদা ভাবে দেখলে তাদের মধ্যে কোনো স্বপ্নচ্ছায়া দেখা যায় না, যদিও সংলাপের মধ্যে সাংকেতিক ইঙ্গিত বা

গূঢ় অর্থের ব্যঞ্জনা আনা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। তাছাড়া, এই নাটকের বিভিন্ন দৃশ্য বা ‘station’ 'একই স্তরের' বলে মনে হয় না আমার। Officer -এর সঙ্গে তার মা -র সংলাপ যে ধরনের জাগ্রত স্তরে বিধৃত, Billsticker -এর সঙ্গে নন্দিনীর মাছধরা জাল নিয়ে যে রহস্যময় কথাবার্তা রয়েছে তার স্তর অনেকটাই সাংকেতিক, ঠিক জাগ্রত নয়। Lawyer -এর সঙ্গে Daughter -এর কথাবার্তার দৃশ্যে যে স্বাভাবিক প্রাত্যহিক ন্যাচারালিস্টিক ভঙ্গি রয়েছে, গুহার সামনে Poet ও নন্দিনীর কথাবার্তা তার তু লনায় অনেক বেশি গাঢ়, লিরিক্যাল, রহস্যময় ও সাংকেতিক। একটু উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটি বোঝা যাবে Lawyer : We, only we can do it. Do you know, I read in this paper this morning. By the way, where is the paper? Daughter : (Embarrassed) Which paper? Lawyer : (Harshly) Do I take more than one newspaper? Daughter : Smile-and don’t speak harshly! I lit the fire with your newspaper. এই স্বাভাবিক জাগ্রত স্তরের কথাবার্তার সঙ্গে Daughter ও Poet -এর সংলাপ মেলালেই দৃশ্যগুলির স্তরের ভিন্নতা লক্ষা করা যাবে। Poet : What is floating there-a buoy? Daughter : Yes. Poet : It is like a lung with a windpipe. Daughter : It is the watchman of the sea. When danger is abroad it sings. Poet : It seems to me that the sea is rising, and the waves beginning to... Daughter : You are not mistaken. Poet : Alas, What do I see? A ship-on the rocks. Daughter : What ship can it be? Poet : I believe it is the ghost -ship. Daughter : What is that? Poet : The Flying Dutchman.

এ ধরনের আরো উদাহরণ দেওয়া যায় A Dream Play থেকে। স্বপ্ন -নাটককে দেখাতে হবে স্বপ্নচ্ছায়ার মতো আর রক্তকরবীকে নিয়ে আসতে হবে জাগ্রত জগতে-এই প্রতিতু লনা যথেষ্ট সংগত বা সঠিক বলে মনে হয়নি আমার। বস্তুত, রক্তকরবী নাটকের আঙ্গিক বা বিন্যাস সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষ যে -সব মন্তব্য করেছেন তার থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে আঙ্গিকগত দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকগুলি, বিশেষত রক্তকরবী -র সঙ্গে A Dream Play -র সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। শঙ্খ ঘোষ বলেছেন 'তাঁর [রবীন্দ্রনাথ] নাটকের ইতিহাস আমাদের দেখিয়ে দেয় কেমন ক'রে তিনি বর্জন করেছেন চলতি চরিত্রের ধারণা অথবা প্লটগঠনের, কেমন ক'রে স্থানকালের বিন্যাসকে ক্রমে নিবিড় ঐক্যের মধ্যে ধ'রে এনে আবার টু করো করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, কিছু বা এক্সপ্রেশনিস্ট ধরনে।... 'রক্তকরবী' বা এমন -কী 'মুক্তধারা'তেও কখনো মনে হতে পারে যে এপিক ধরনে এখানে মন্টাজের টু করো করে কিছু আসছে, ভিন্ন ভিন্ন টু করোর একত্রগ্রন্থণ...।'১৯ স্থানকালপাত্রের বিন্যাসকে টু করো করে ছড়িয়ে দেওয়া, মন্টাজের ব্যবহার-এক্সপ্রেশনিস্ট নাটকের এইসব বৈশিষ্ট্য-প্রধানত স্ট্রিন্ডবার্গের The Road to Damascus ও A Dream Play থেকেই পেয়েছিলেন Georg Kaiser, Ernst Toller বা Bertolt Brecht -এর মতো নাট্যকারেরা, এবং স্ট্রিন্ডবার্গের এইসব আদি এক্সপ্রেশনিস্ট কৌশলই আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকগুলিতে। তাই শুধু বিষয়, নায়িকার নাম ও চরিত্র, ফু ল ও দুর্গের প্রতীক বা কোনো কোনো সংলাপের ক্ষেত্রে শুধু নয়, বিন্যাসের ক্ষেত্রেও রক্তকরবী নাটকের সঙ্গে A Dream Play নাটকের সাদৃশ্য যথেষ্টই। ফাল্গুনী নাটকের অভিনয় প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ গগনেন্দ্রনাথকে নির্দেশ দিয়েছিলেন-নাটক শুরু হওয়ার পর একবারও যবনিকা পড়বে না। রক্তকরবী -র মঞ্চনির্দেশে রয়েছে'প্রাসাদের সেই জালের আবরণ এই নাটকের একটিমাত্র দৃশ্য। সেই আবরণের বহির্ভাগে সমস্ত ঘটনা ঘটিতেছে।' এই স্থানিক সংহতির আদর্শ রবীন্দ্রনাটকে এসেছে বাংলার যাত্রা থেকেই এইরকম একটি ধারণা করতে আমাদের ভালো লাগে। তবে, এটাও তার সঙ্গে মনে রাখা ভালো যে যেখান থেকে রক্তকরবী নাটকের বিষয়, মূল চরিত্র ও প্রতীক এসেছে, সেখানেও ওই একই মঞ্চনির্দেশ রয়েছে। A Dream Play নাটকেও কোনো যবনিকা পড়বে না, প্রয়োজনে মঞ্চের অর্ধেকটা অন্ধকার রাখা হবে, বা মঞ্চের পেছনের দৃশ্যপট সরে যাবে, কিন্তু মঞ্চসজ্জা অপরিবর্তিত থাকবে পুরো নাটকে ‘On each side of the stage are stylized representations of interior, architecture and landscape which remain unchanged throughout the play '। রাজা ও রানী নাটকের প্রথম রূপান্তর 'ভৈরবের বলি' -র স্টেজ -কপির ভূ মিকায় ঠা

রবীন্দ্রনাথ যখন চিত্রপট ওঠানো নামানোর বদলে 'একবার আলো নিবাইয়া পুনরায় জ্বালাইয়া দেওয়াই যথেষ্ট' লিখছেন, তখন A Dream Play নাটকের ওই একই মঞ্চকৌশল তাঁর মনে থাকারই কথা ‘Blackout, When the lights go up the scene has changed to outside the castle '। মঞ্চে আলোর ব্যবহার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ বিষয়ে অমিতা ঠাকু র ('রবীন্দ্র প্রসঙ্গে নাটক ও অভিনয়', রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ, ১৩৯৫, পৃ. ১৪) জানাচ্ছেন 'পাত্রপাত্রীদের সাজপোষাকে গতানুগতিকতা চলত না, কোন ঝকমকে সাজপোষাক বা ঝকমকে মুকু ট বা গহনা মাথায় দিতে দিতেন না মুখের ভাব ঢাকা পড়ে না যায় তার দ্যুতিতে এই জন্যে'। মুখের ভাবের ওপর ঠিক এই গুরুত্ব দেওয়ার জন্যে স্ট্রিন্ডবার্গও ফু টলাইট তু লে দেবার কথা ভেবেছিলেন ‘Would not the use of sufficiently powerful side lights...afford the actor this new resource-the strengthening of his powers of mimicry by means of the face’s chief asset-the play of the eyes? '২০ স্ট্রিন্ডবার্গ চেয়েছিলেন মঞ্চ হবে একটি ঘর যার চতু র্থ দেয়ালটি নেই ‘a room with the fourth wall missing’, যেটি ইয়েটস একটু ঘুরিয়ে বলেছিলেনদেওয়ালের সামনে যে -কোনো ফাঁকা জায়গাই মঞ্চ হতে পারে। ইয়েটস -এর এই কথার সঙ্গে তপতী নাটকের ভূ মিকায় বারবার দৃশ্যপট তোলা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আপত্তির যে মিল আমরা দেখতে পাই তার কারণ এই যে ইয়েটস যেখান থেকে মঞ্চ সম্পর্কে এইসব নতু ন ভাবনাচিন্তা পাচ্ছিলেন, রবীন্দ্রনাথও সেখান থেকেই মঞ্চ সম্পর্কে নানাধরনের পরীক্ষা -নিরীক্ষা করার প্রেরণা পেয়েছিলেন, অর্থাৎ স্ট্রিন্ডবার্গ থেকে যেমন পেয়েছিলেন জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট নাট্যকারেরা বা আমেরিকান নাট্যকার Eugene O’ Neill । O’Neill -এর Desire Under the Elms নাটকের পুরো ঘটনাই ঘটবে ‘in and outside of, the Cabot Farmhouse in New England in the year 1850 ’, যেমন ঘটেছে রক্তকরবী নাটকে প্রাসাদের জালের 'আবরণের বহির্ভাগে'। যেখানে থেকে নাটকের কনটেন্টের অনেকখানি এসেছে, সেখান থেকেই ফর্মেরও বেশ কিছু খুঁটিনাটি আসবে এটাই স্বাভাবিক। বক্তব্য, প্রতীক, নায়িকার নাম, চরিত্র বা কোনো কোনো সংলাপের জন্যে সেই যখন A Dream Play -তে যেতেই হচ্ছে তখন আঙ্গিকের জন্যে আবার জাপানি জীবনযাত্রা, স্বদেশি যাত্রা বা মেলার হট্টগোলে যাবার বিশেষ কোনো দরকার রবীন্দ্রনাথের ছিল বলে মনে হয় না, বিশেষত যখন এইসব কৌশল A Dream Play -তে পাওয়া যাচ্ছে। দশ

অশ্রুকু মার সিকদার তাঁর রবীন্দ্রনাট্যে রূপান্তর ও ঐক্য (১৩৭৪) বইটির 'রবীন্দ্রনাট্যে ঐক্য' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের নাটকের কোনো কোনো চরিত্রের মধ্যে একটি আত্মগোপন -আত্মপ্রকাশ পরিকল্পনা লক্ষ করেছেন, অর্থাৎ একই চরিত্র নাটকের বিভিন্ন দৃশ্যে ভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়েছে প্রায়শ্চিত্ত নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগী আবার সে প্রজাবিদ্রোহের নায়ক, অচলায়তন -এ দাদাঠাকু র যোদ্ধা হয়ে হাজির হন একটি দৃশ্যে, আবার গুরুও হয়ে যান শেষে; শারদোৎসব -এ সন্ন্যাসী হয়ে যান রাজা বিজয়াদিত্য, ডাকঘর -এ দাদাঠাকু র আবার ফকির সেজে উপস্থিত হন মঞ্চে। রক্তকরবী নাটকে রঞ্জন ও রাজা আত্মপ্রকাশ করে সম্পূর্ণ নতু ন রূপে, মনে হয় রঞ্জনই যেন তার ত্যাগ ও আত্মবিসর্জনের মধ্যে দিয়ে রাজাকে মুক্ত করেছে লোভ ও শক্তিমত্ততার বন্ধন থেকে, রঞ্জনই যেন পুনর্জীবিত হয়ে ফিরে এসেছে বন্ধনমুক্ত রাজার মধ্যে দিয়ে। একই চরিত্রকে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে উপস্থিত করার এই কৌশলটি ঠিক আত্মগোপন -আত্মপ্রকাশ বা এলিজাবেথান নাটকের ছদ্মবেশ -কৌশলের উদাহরণ নয়। একটি চরিত্রকে ভিন্ন একটি চরিত্রে রূপান্তরিত করার ফলে এক ধরনের নতু ন চরিত্র -কাঠামো তৈরি হয় যেটি মূল চরিত্রের মধ্যে একটা পৃথক মাত্রা এনে দিয়ে নাটকের সামগ্রিক বিন্যাসের মধ্যে একটি গভীরতর ঐক্য এনে দেয়। চরিত্রের এই নতু ন রূপ তার আগেকার ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার বা নাকচ করে দেয় না, বরং দুটি বা তিনটি ভিন্ন চরিত্র মিলে গিয়ে মূল চরিত্রের মধ্যে একটা নতু ন জোয়ারি এনে দেয়, নাটকের বক্তব্যের কাঠামোর সঙ্গে চরিত্রের একটা তাৎপর্যপূর্ণ সমন্বয় বা সামঞ্জস্যের ইঙ্গিত দিয়ে। চরিত্র রূপান্তরের এই কৌশলটি স্ট্রিন্ডবার্গের A Dream Play নাটকে একটি বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো বৈশিষ্ট্য, যার কথা স্ট্রিন্ডবাগ নাটকের ভূ মিকাতেই স্পষ্ট করে বলেছেন পাঠকদের ‘The characters are split, double and multiply; they evaporate, crystallise, scatter and converge. But a single consciousness holds sway over them all - that of the dreamer '। নাটকের স্থান ও কালের বিন্যাসের মধ্যে স্ট্রিন্ডবার্গ যেমন ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা আরোপ করেছেন, পাত্রপাত্রী বা চরিত্রের মধ্যেও তেমনি বিভিন্নতা এনেছেন। যে চরিত্র প্রথমে Officer, সেই পরে Lawyer, আবার কিছু পরে সেই চরিত্রই উপস্থিত Poet হয়ে, এবং এইসব চরিত্রই আবার Dreamer বা নাট্যকারেরই পরিবর্ত বা বদলি -চরিত্র। স্থান -কাল -পাত্রের মধ্যে এই আপাত বৈচিত্র্যের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা যোগ করে স্ট্রিন্ডবার্গ A Dream Play নাটকের মধ্যে একটি গাঢ়তর ঐক্য ও সংহতির ব্যঞ্জনা এনেছেন। এই ধরনের বহুমাত্রিক চরিত্রসৃষ্টি সম্পর্কে স্ট্রিন্ডবার্গের একটি সচেতন পরিকল্পনার পরিচয় পাওয়া যায় ন্যাচারালিস্ট নাটকের ‘fixed’ চরিত্র প্রসঙ্গে তাঁর কয়েকটি

উল্লেখযোগ্য মন্তব্য থেকে The word ‘character’ has, in the course of the ages, assumed various meanings. Originally, I suppose, it signified the dominant characteristic of the soul -complex, and was confused with ‘temperament’. Afterwards it became the middleclass expression for the automation...a ‘character’ on the stage came to signify a gentleman who was fixed and finished : one who invariably came on the stage drunk, jesting or mournful. For characterisation nothing was required but some bodily defect-a club foot, a wooden leg, a red nose; or the character in question was made to repeat some such phrase as ‘that’s capital’. ‘Barkis is willin, ’ or the like…২১ ন্যাচারালিস্ট থিয়েটারের এই ধরনের একমাত্রিক চরিত্রকল্পনা স্ট্রিন্ডবার্গকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, তাঁর মত হলো 'সত্যিকারের' বাস্তববাদী বা ন্যাচারালিস্ট নাটকের চরিত্রসৃষ্টি হবে অন্যরকম, আরো জটিল ও বহুমাত্রিক I do not believe in simple characters on the stage. And the summary judgements on men given by authors : this man is stupid, this one brutal, this one jealous, etc., should be challenged by naturalists, who know the richness of the soul complex, and recognise that ‘vice’ has a reverse side very much like virtue…২২ স্ট্রিন্ডবার্গের মতে নাটকের চরিত্র শুধু বিশেষ একটি গুণ বা দোষের চিত্রণ বা ‘portraiture’ নয়, জটিল বহুমুখী এমনকী অনেকসময় বিপরীতধর্মী অভিজ্ঞতাপুঞ্জের সমবায়ে গঠিত একটি গতিশীল নির্মাণ। এই ধরনের চরিত্রনির্মাণই দেখি স্ট্রিন্ডবার্গের The Road to Damascus ও A Dream Play -তে। শারদোৎসব থেকে রক্তকরবী পর্যন্ত লেখা রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকগুলিতে স্ট্রিন্ডবার্গের Redemption বা ‘ ঋণশোধ' থিমটি লক্ষ করার সঙ্গে সঙ্গে A Dream Play নাটকের চরিত্র -রূপান্তরের এই কৌশলটির ব্যাপক ব্যবহারও বোধহয় রবীন্দ্র -গবেষকদের লক্ষ করা দরকার। এগারো

রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকের আঙ্গিকের ক্ষেত্রে আর একটি বহু -আলোচিত বিষয় হলো 'পথ'। প্রায় প্রত্যেকটি নাটকেই পথকে হয় দৃশ্যপট, নয় নাট্যবিষয়ের প্রতীক হিসেবে একটা বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এডওয়ার্ড টমসন রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকগুলি সম্পর্কে বিশেষ ভালো ধারণা পোষণ করতেন না। কিন্তু এই নাটকগুলি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি একটি বেশ মজাদার আবিষ্কার করে ফেলেন। সেটি হলো এই যে রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকে পথ -এর যে ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে সেটির প্রেরণা রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন ‘the drifting pageant of an Indian Road’ থেকে। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষা বা সংস্কৃ তিতেই পথ একটি ব্যাপক রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহু প্রাচীন কাল থেকে। where there is a will there is a way, there’s no way out, যত মত তত পথ, the way of al flesh, the way of the world, নান্যঃ পন্থা, via media, Quo vadis, wayward, the road to happiness, the road to hell is paved with good intentions, এবার পথে এসো, পথে বসা, বিপথে যাওয়া। আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে খেয়া পারাপারের রূপকের মতো পথ -রূপকের ব্যবহারও যথেষ্ট ব্যাপক Pilgrim’s Progress, তীর্থযাত্রা, যাত্রাপথ, মুক্তিপথের পথিক, ধর্মের পথ, ‘Does the road wind up all the way? Yes, to the very end '। রবীন্দ্রনাটকে (গদ্যে -পদ্যে -গানেও) এই বহু -ব্যবহৃত প্রাচীন পথ -ইমেজটির ব্যবহারের মধ্যে টমসন কেন একটি বিশেষ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করলেন ঠিক বোঝা যায় না। ভারতীয় পথের কী এমন পৃথক দৃশ্যগত -নান্দনিক -আধ্যাত্মিক -সাংকেতিক অনুষঙ্গ আছে যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পথের অনুষঙ্গে পাওয়া যায় না? আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের রূপক -নাটকগুলিতে ইয়োরোপীয় প্রতীকবাদী নাট্য -হুজুগের প্রভাবের ইঙ্গিত দিয়ে টমসনের মনে হয়েছিল ‘Tagore’ বা ‘Tagorite’ -রা কেউ -ই এ -ইঙ্গিত ভালো চোখে নেবেন না, তাই রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকে পথের ব্যবহারের ওপর স্বদেশি রাস্তার প্রভাবের এই native তত্বটির অবতারণা করেছিলেন। তাতে অবশ্য টমসন খুব একটা রেহাই পাননি, কিন্তু তাঁর এই আজগুবি তত্বটি রবীন্দ্রসাহিত্য সমালোচনায় ক্রমাগত পল্লবিত হয়ে বর্তমানে একটি শ্রদ্ধেয় তথ্য হিসেবে পরিবেশিত হচ্ছে রবীন্দ্রসাহিত্যের ছাত্র বা সাধারণ পাঠকদের কাছে। টমসনের Indian Road তত্ব সম্ভ্রম অর্জন করতে পারত না যদি প্রমথনাথ বিশী এটিকে বিস্তারিত না করতেন বা শঙ্খ ঘোষ তাঁর 'পথ প্রতীক ও পটভূ মি' প্রবন্ধটি না লিখতেন। প্রবন্ধটিতে শঙ্খ এমন সুন্দরভাবে রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকে দৃশ্য, বিষয় বা প্রতীক হিসেবে পথ -এর ব্যাপক ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করেছেন যে ওই বিশ্লেষণের ভাষাগত লালিত্য ও মাধুর্যের প্রতিফলিত গরিমায় টমসনের Indian Road তত্বটি এক

আশ্চর্য বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছে। শঙ্খ তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন 'রবীন্দ্ররচনায় পথ যে -ভাবে ব্যবহৃত হয় তার ভঙ্গি ত্রিমুখী। কখনো তা আসে নিছক দৃশ্যপট হিসেবে, কখনো তা নাটকের বিষয়ও বটে, আবার কখনো প্রতীক। তাঁর নাট্যচর্চার ইতিহাস অনুসরণ করলে এই তিন ভঙ্গিরই বিকাশ লক্ষ করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এ তিনটিকে একত্র সমন্বিত ক'রে নেবার সম্ভাবনাকেও কতটা তিনি ব্যবহার করেছেন?' রবীন্দ্রনাটকে পথের ব্যবহার প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষ ব্রেশট, লোরকা, ইয়েটস, গ্রিক নাটক, বাংলা যাত্রা-এ সবেরই উল্লেখ করেছেন, কিন্তু স্ট্রিন্ডবার্গের নাটকে পথ -এর ব্যবহার সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকে স্ট্রিন্ডবার্গের 'ঋণশোধ' থিম বা বহুমাত্রিক চরিত্র নির্মাণ লক্ষ করার সময় স্ট্রিন্ডবার্গের Easter, The Road to Damascus, A Dream Play ও A Great Highway নাটকগুলিতে যেভাবে পথকে কখনো দৃশ্যপট, কখনো নাট্যবিষয়, বা কখনো প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, তার কথাও বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। Easter নাটকে যিশুখ্রিস্টের প্রতিরূপ শিশু Eleanora বলছে ‘We ought not to possess anything that binds us to earth. Out on the stony paths and wander with wounded feet, for the road leads upwards, that it way it is so toilsome '। The Road to Damascus নাটকের নামের মধ্যে নাটকের বিষয় অর্থাৎ আধ্যাত্মিক মুক্তিপথের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তাই নয়, নাটকের দৃশ্যকল্পনার মধ্যেও পথ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। পথের ওপরেই নাটক শুরু, তারপর বিভিন্ন দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে নাট্যঘটনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পর আবার সেই পথেই নাটকের শেষ দৃশ্য বিন্যস্ত হয়েছে যেখানে মূল চরিত্র ‘Unknown’ শেষ পর্যন্ত আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছে গির্জার আশ্রয়ে। আরো অনেকরকম পথ বা বিপথ রয়েছে অন্তর্বর্তী দৃশ্যগুলিতেও। পথ -রূপকের এই ব্যাপক ব্যবহার স্ট্রিন্ডবার্গের জীবনের শেষ দিকে লেখা আধ্যাত্মিক নাটকগুলির একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য, বিশেষত The Road to Damascus ট্রিলজির। রক্তকরবী নাটকে সমস্ত ঘটনা ঘটছে দুর্গের জানালার জালের বাহির -বারান্দায়। শঙ্খ ঘোষ লক্ষ করেছেন, এই মঞ্চনির্দেশের ওপর পরিচালক নির্ভর করতে পারেন না। কারণ ক্রমশই এই বারান্দা 'ব্যাপকতর পথের আকার নিয়ে প্রসারিত হয়ে পড়ে'; বিশেষত সর্দার -মোড়লের কথাবার্তার বা নন্দিনীর সঙ্গে ফাগুলাল -চন্দ্রার দেখা হওয়ার দৃশ্যে 'বারান্দা' -র ধারণাটা খুব একটা খাপ খায় না দৃশ্যের সঙ্গে। A Dream Play -তেও অনেকটা এইরকম ঘটনাই ঘটেছে। মঞ্চনির্দেশে আছে মঞ্চসজ্জা সারা নাটকে একই থাকবে, প্রথম দৃশ্যে দুর্গের সামনের পথে নন্দিনী ও কাচমিস্ত্রী কথা বলবে, তারপরেই নন্দিনী ঢু কবে

রাজকর্মচারীকে মুক্ত করতে। তারপরেই ক্রমে ক্রমে পেছনের দৃশ্যপট পালটাবে, কখনো সম্পূর্ণ, কখনো অর্ধেক। রক্তকরবী -তে যেমন দুর্গের সামনের বারান্দাই হয়ে যাবে পথ বা শ্রমিকদের বস্তির কাছাকাছি কোনো স্থান, তেমনি A Dream Play -তেও একই দরজা কখনো হবে Lawyer -এর অফিসের দরজা, আবার কখনো নাটকের গল্পের মঞ্চে ঢোকার দরজা, আবার কখনো কখনো এক রহস্যময় প্রতীকী দরজা, যেটি নাটকের শেষের দিকে খোলার পর দেখা যাবে দরজার ওধারে কিছু নেই, অর্থাৎ জীবনের রহস্য কোনোদিনই মানুষ বুঝতে পারবে না। এই সাংকেতিক দরজার ওপারের ‘Nothingness’ ফাল্গুনী নাটকে রবীন্দ্রনাথ গুহার মধ্যে ব্যবহার করেছেন একটু আলাদা অর্থে ও ব্যঞ্জনায়। The Road to Damascus ও মুক্তধারা (যার প্রথম নাম ছিল 'পথ') নাটকে নাট্যবিষয়, দৃশ্য ও প্রতীক হিসেবে পথ যতটা গুরুত্ব পেয়েছে A Dream Play -তে পথ ঠিক ততটা গুরুত্ব পায়নি, কারণ প্রতীক হিসেবে এসেছে দুর্গ ও চন্দ্রমল্লিকা ফু ল। রক্তকরবী নাটকে পথ ঠিক একই কারণে বিশেষ গুরুত্ব পায়নি প্রতীক বা দৃশ্যপট হিসেবে, যদিও The Road to Damascus -এর মতো রক্তকরবী -ও শুরু হয়েছে দুর্গের সামনের পথে, শেষও হয়েছে ওই একই জায়গায়, পথে। শঙ্খ ঘোষ এটি লক্ষ করে একটি চমৎকার মন্তব্য করেছেন ' 'রক্তকরবী'তে আমরা সবসময় সচেতন থাকি কোনো এক অলক্ষ্য দূরবর্তী প্রাচীর প্রাকারের ধারণায়, যক্ষপুরীকে যা ঘিরে রেখেছে চতু র্দিকে।' রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এই ধরনের কোনো প্রাচীরের ইঙ্গিত দেননি মঞ্চ -নির্দেশে। কিন্তু নাটকের মধ্যে এই প্রাকারের ধারণা সত্যিই আমরা এড়াতে পারি না, বিশেষত যখন ফাগুলাল বলে 'ঘরের রাস্তা বন্ধ, জান না বুঝি।' A Dream Play -তে Foulstrand -এর খনিশ্রমিক ঠিক এই দুর্লঙ্ঘ্য প্রাকারের কথাই বলেছেন ‘There is no country. It’s all fenced in’, এই প্রাকারবদ্ধ নরক থেকে ফাগুলালদের মতো তাদেরও বেরোবার কোনো পথ নেই। শুধু নাটকের চরিত্রে নয়, স্থানের সীমায়িত অস্তিত্বের মধ্যেও ব্যাপকতর মাত্রা যোগ করে খণ্ডের মধ্যে একটা ব্যাপ্তির বা পূর্ণতার আভাস দেওয়ার এই টেকনিক নাট্যশিল্পী হিসেবে স্ট্রিন্ডবার্গের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের রূপক -নাটকের স্থান -বিন্যাসে ওই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করার সময় তাই স্ট্রিন্ডবার্গের কথা না মনে পড়া বেশ কঠিন। বারো A Dream Play নাটকের মূল বিষয় আধ্যাত্মিক মুক্তি- ‘Redemption through suffering and renunciation, salvation through death, ত্যাগ ও

দুঃখবরণের মধ্যে দিয়ে জীবনের ঋণশোধ, মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে মুক্তি। তাই নাট্যবিষয়কে কোনো একটি বিশেষ কালের মধ্যে সীমায়িত না রেখে স্ট্রিন্ডবার্গ নানাভাবে কালের মাত্রার হেরফের করেছেন, খণ্ডকালের মধ্যে নিত্যকালের ব্যঞ্জনা আনার জন্যে। সময় যে থেমে নেই এই ইঙ্গিত নাটকের প্রথম দৃশ্যের প্রথম সংলাপেই আছে। নন্দিনী বলছে ‘The Castle keeps on growing up out of the earth '। সারা নাটক ধরে এই দুর্গের চূ ড়া ক্রমাগত আকাশের দিকে উঠে যাবে চলমান সময়ের ইঙ্গিত বহন করে, ঠিক তেমনি তার ওপরে আধফোটা চন্দ্রমল্লিকার কুঁড়িটিও একটু একটু করে ফু টবে, পুরো ফু টে উঠবে নাটকের শেষ দৃশ্যে। Schoolmaster, Officer ও ছেলেদের সংলাপে এই চলমান অস্থির সময়ের কথা আরো স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যেটি রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকে অমল ও প্রহরীর কথাবার্তার মধ্যেও লক্ষ করার মতো 'ঘণ্টা এই কথা সবাইকে বলে, সময় বসে নেই, সময় কেবলই চলে যাচ্ছে' :: Schoolmaster : What is time? Officer : Time...(considers) I can’t say, Although I know what it is. Can you yourself say what time is? Schoolmaster : Certainly I can. Boys : Tell us then. Schoolmaster : Time?...Let me see...while we speak time flies. Consequently time is something which flies while I am speaking. সময়ের প্রবাহ সবথেকে ভালো করে বোঝানো যায় প্রকৃ তির ইমেজ ব্যবহার করে, বিশেষত দৃশ্যপটে, সংলাপে বা পাত্রপাত্রীর শারীরিক বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন ভিন্ন ঋতু র বৈশিষ্ট্য আরোপ করে। স্ট্রিন্ডবার্গ A Dream Play নাটকে এই নিত্যকালের ব্যঞ্জনা এনেছেন মঞ্চে একটি লেবুগাছ বা Lime Tree রেখে, যেটি ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যে ঋতু অনুযায়ী কখনো থাকবে নির্জীব নিষ্পত্র, কখনো বা পত্রপুষ্পে সজীব, প্রাণবন্ত। একটি দৃশ্যের মঞ্চনির্দেশে বলা হয়েছে ‘a small lime tree with a coal -black stem and a few pale green leaves’ ; আবার একটু পরে মঞ্চনির্দেশ এইরকম ‘the lime tree is bare, the blue monkshood withered, the green plot at the end of the alley has turned brown '। হেমন্তের এই দৃশ্যগত ইঙ্গিতের সঙ্গে সঙ্গে আগের দৃশ্যের যুবক Officer -এর শরীরেও আসবে মধ্যবয়সের ছাপ ‘By all the signs, summer is over and autumn at hand. I can tell that

by the lime tree - and the monkshood. But autumn is my spring।' আবার একটু পরে, ‘lime tree is in leaf, the monkshood is bloom, the sun shines in the greenery '। Officer ইতিমধ্যে বার্ধক্যে পৌঁছে যাবে ‘He is old and white -haired’; লেবুগাছটিও নিষ্পত্র হয়ে গিয়ে কোটটু পি ঝোলাবার স্ট্যান্ড হয়ে যাবে মঞ্চে। পরে আবার মঞ্চের প্রাকৃ তিক দৃশ্যাবলি শীতের তু ষারে ঢেকে যাবে। নাটকের শেষ দৃশ্যে আবার আসবে summer, মঞ্চনির্দেশে থাকবে ‘the ground is covered with the blue monkshood, aconite and other flowers '। পুরো নাটকটিতে স্ট্রিন্ডবার্গ এইভাবে ঋতু চক্রের আবর্তনের ইঙ্গিতের মাধ্যমে নাট্যকালের মধ্যে চিরপ্রবহমান কালের মাত্রা যোগ করে নাটকের বিন্যাস ও মঞ্চসজ্জাকে সমন্বিত করেছেন নাট্যবিষয়ের সঙ্গে। A Dream Play নাটকের এই দৃশ্য ঋতু মণ্ডলই রক্তকরবী নাটকে অদৃশ্য ভাবে চরিত্রগুলির মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। শঙ্খ ঘোষ তাঁর 'ঋতু মণ্ডল ও রক্তকরবী' প্রবন্ধে সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কীভাবে এই অদৃশ্য ঋতু মণ্ডলের পটের ওপর সাজিয়ে দেখলে রক্তকরবী নাটকের কাহিনি একটা স্বতন্ত্র মাত্রা পেয়ে যায়। স্ট্রিন্ডবার্গ A Dream Play নাটকের ভূ মিকায় স্পষ্ট করেই বলেছেন যে The Road to Damascus -এর মতো এ -নাটকেও দেশ বা কালের কোনো অস্তিত্ব নেই ‘Time and space do not exist ; on a slight groundwork of reality imagination spins and weaves new patterns made up of memories, experiences, unfettered fancies, absurdities and improvisations '। Time ও Space সম্পর্কে স্ট্রিন্ডবার্গের এই নাস্তিকতার প্রত্যাশিত প্রতিধ্বনি রয়েছে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তিতে 'দেশই বলো আর কালই বলো, যাতে ক'রে সৃষ্টির সীমা নির্দেশ করে দেয়, দুই -ই আপেক্ষিক, দুই -ই মায়া।'২৩ শঙ্খ ঘোষ লক্ষ করেছেন এই কথাগুলি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন রক্তকরবী রচনার প্রায় সমকালে। খুবই স্বাভাবিক, কারণ A Dream Play নাটকের ভূ মিকাতেই স্ট্রিন্ডবার্গের কথাগুলি ছিল। নাট্যবিষয়, দুর্গ ও ফু লের প্রতীক, নায়িকার নাম চরিত্র ও কার্যকলাপ, সংলাপ, দৃশ্যবিন্যাসে স্থানিক সংহতি, পথ -রূপকের ব্যবহার, একই চরিত্রকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপস্থাপন ইত্যাদির ক্ষেত্রে A Dream Play ও রক্তকরবী নাটকের ঘনিষ্ঠ সদৃশতা লক্ষ করার সময় এই ঋতু মণ্ডলগত সাদৃশ্যের দিকটাও লক্ষ করলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে স্ট্রিন্ডবার্গের সম্পর্কও একটা স্বতন্ত্র মাত্রা ও তাৎপর্য পেয়ে যেতে পারে। স্ট্রিন্ডবার্গের কাছে রবীন্দ্রনাথের গভীর ঋণের অবশ্য একটা উলটো দিকও আছে। স্ট্রিন্ডবার্গের শেষ দিকের সিম্বলিস্ট নাটকগুলির দুঃখবাদ, শূন্যতা ও নির্বাণচিন্তার ওপর

ভারতীয় অধ্যাত্মভাবনার প্রভাবও বেশ স্পষ্ট, বিশেষত বৌদ্ধদর্শনের। এই দুঃখবাদ ও মৃত্যুচিন্তা কতটা তিনি ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ের মাধ্যমে পেয়েছিলেন আর কতটা Schopenhauer বা Eduard Von Hartmann -এর বৌদ্ধদর্শনাশ্রিত নির্বাণচিন্তা থেকে পেয়েছিলেন ঠিক বলা মুশকিল, তবে ভারতীয় অধ্যাত্মচিন্তা ও দর্শনের কাছে তাঁর এই ঋণের অনেকটাই শোধ হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের প্রতীকী নাটক, বিশেষত রক্তকরবী -র মাধ্যমে। এ -ও এক চমৎকার ঋণশোধের কাহিনি। তাই, রক্তকরবী নাটকের সঙ্গে রানু মুখার্জিকে জড়িত করলে স্ট্রিন্ডবার্গ বা রানু মুখার্জি কারো প্রতিই সুবিচার করা হয় না। রানু যখন রক্তকরবী নাটকটি তাঁর নামে উৎসর্গ করার জন্যে রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন, এলমহার্স্টের সাক্ষ্য অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ তখন রানুকে বলেছিলেন ‘You have had nothing to do with it '। কথাটি রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছিলেন। রক্তকরবী নাটকের সঙ্গে সত্যিই রানুর কোনো সম্পর্ক ছিল না। রানুর সঙ্গে যদি রবীন্দ্রনাথের কোনোদিন দেখা নাও হতো, রক্তকরবী নাটক যেভাবে লেখা হয়েছিল ঠিক সেইভাবেই লেখা হতো, এবং আবর্জনা থেকে উঠে আসা ফু লের প্রতীকটিও সেখানে থাকত রবীন্দ্রনাথের ঘরের কাছে আবর্জনার মধ্যে রক্তকরবী ফু লটি ফোটার অপেক্ষা না করেই। তেরো রক্তকরবী নাটকের বিষয়, চরিত্র, সংলাপ, প্রতীক ও আঙ্গিকের ওপর A Dream Play নাটকের ব্যাপক ও গভীর প্রভাব থাকলেও, এটিকে ঠিক অনুকরণ বলা যায় না, যেমন বলা যায় গোরা বা যোগাযোগ উপন্যাসকে। দুটি নাটকের মূল সুর বা আবহ সম্পূর্ণ আলাদা, ঘটনার মধ্যেও যথেষ্ট ভিন্নতা আছে। A Dream Play মূলত ডাকঘর -এর মতো আধ্যাত্মিক মুক্তির নাটক, যদিও সামাজিক সমস্যার কথাও আছে অনেকগুলি দৃশ্যে, যেমন কয়লাখনির শ্রমিকদের কথাবার্তার মধ্যে। রক্তকরবী ঠিক আধ্যাত্মিক মুক্তির নাটক নয়, যদিও কোন মুক্তির নাটক সেটা খুব স্পষ্ট বোঝা যায় না নাটক থেকে। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সমালোচকদের কাছে আমরা শুনেছি যে নাটকটির বিষয় হলো যন্ত্রশক্তির ওপর প্রাণশক্তির প্রতিষ্ঠা। রক্তকরবী নাটকের বিষয় যে যন্ত্রশক্তির সঙ্গে প্রাণশক্তির বিরোধ একথা রবীন্দ্রনাথ প্রথম তোলেন 'যাত্রী' -তে, ১৯২৯ সালে, অর্থাৎ রক্তকরবী নাটক লেখার ছ'বছর পরে 'নারী এল, নন্দিনী এল, প্রাণের বেগ এসে পড়ল যন্ত্রের ওপর।' এই কথাগুলি লেখার সময় রবীন্দ্রনাথ আর একবার রক্তকরবী পড়েছিলেন কিনা জানি না, তবে নাটকের মধ্যে তিনি ঠিক কী লিখেছিলেন সেকথা নিশ্চয় তখন তাঁর মনে ছিল না। রবীন্দ্রনাথ এই

কথাগুলি বলার ফলেই বোধ হয় এই ধারণা রবীন্দ্রসমালোচকদের মনে দৃঢ়মূল হয়ে যায় যে রক্তকরবী নাটকে সত্যিই আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার সঙ্গে প্রাণধর্মের বিরোধের কথা বলা হয়েছে। প্রমথনাথ বিশী মনে করেছেন, 'মানুষের মনের ওপরে যন্ত্রবাদের (Industrialism) আতিশয্যজাত প্রতিক্রিয়াটাই নাটকের লক্ষ্য'।২৪ শঙ্খ ঘোষ তাঁর 'অভিনয়ের মুক্তি' প্রবন্ধে রক্তকরবী নাটকের বিষয় সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন সেখানে একথা কোথাও স্পষ্টভাবে বলা নেই যে যন্ত্রশক্তির সঙ্গে প্রাণধর্মের সংঘাতই এ নাটকের বিষয়। তবে শঙ্খ মনে করেছেন রক্তকরবী লেখার কাছাকাছি সময়ে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ বা চিঠিপত্রে যন্ত্রসর্বস্ব দুঃসমাজের বিরুদ্ধে যে ধিক্কার ধ্বনিত হয়েছে তাই সাহিত্যের রূপ পেয়েছে রক্তকরবী -র মধ্যে। অরবিন্দ পোদ্দার তাঁর রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বইয়ে বলেছেন ''১৯২৬ [?] সনে রচিত নাটক 'রক্তকরবী' -তে তিনি ধনতান্ত্রিক সভ্যতার এক অতি বাস্তব চিত্র এঁকেছিলেন''; ওই একই অনুচ্ছেদে অধ্যাপক পোদ্দার লিখছেন '' 'রক্তকরবী' -তে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ভাবাদর্শের ইঙ্গিত নেই।''২৫ শঙ্খ ঘোষ রক্তকরবী নাটকে 'রাষ্ট্রগণ প্রতিবাদের বাস্তব' দেখতে পাচ্ছেন, অরবিন্দ পোদ্দার এ নাটকে কোনো রাজনৈতিক ভাবাদর্শের ইঙ্গিত খুঁজে পাচ্ছেন না, অথচ তারই সঙ্গে অধ্যাপক পোদ্দার নাটকটির মধ্যে 'ধনতান্ত্রিক সভ্যতার এক অতি বাস্তব চিত্র' দেখতে পাচ্ছেন। এই মন্তব্যের মধ্যে কিছুটা তারতম্য থাকলেও এঁরা সবাই বলতে চাইছেন যে রক্তকরবী নাটকে যন্ত্রসভ্যতা বা আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে বক্তব্য রাখা হয়েছে। 'যন্ত্র' কথাটিকে নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর সমালোচকেরা আক্ষরিক অর্থে অর্থাৎ ‘machine’ অর্থেই ব্যবহার করেছেন, কোনো রূপক -অর্থে নয়। আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে সমস্ত প্রাক -আধুনিক সভ্যতার তফাত এই ‘machine’ ব্যবহারের মধ্যেই নিহিত। প্রাক -আধুনিক প্রায় সমস্ত সভ্যতাতেই বিজ্ঞানচেতনা ছিল, প্রযুক্তি ছিল, tool ছিল, কিন্তু machine বা যন্ত্র ছিল না। যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার ও যন্ত্রের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানাই ধনতান্ত্রিক আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি বা বৈশিষ্ট্য। এই মামুলি কথাগুলি বলে নিতে হচ্ছে একটি বিশেষ কারণে। যে নাটকে রবীন্দ্রনাথ ধনতান্ত্রিক সভ্যতার অতি বাস্তব চিত্র আঁকলেন বলে আমাদের মনে হচ্ছে, যার মধ্যে আমরা যন্ত্রসর্বস্ব সমাজের প্রতি ধিক্কারের 'অনতিগোপন দ্যুতি' দেখছি, বা যে নাটকে যন্ত্রের ওপর প্রাণ এসে আঘাত করে ফেলল বলেছেন রবীন্দ্রনাথ, আশ্চর্যের বিষয় সেই রক্তকরবী নাটকের দৃশ্যে, সংলাপে, ঘটনায়, নেপথ্যে বা মঞ্চনির্দেশে যন্ত্রের বা আধুনিক মেশিন -সভ্যতার কোনো নিদর্শন বা উপকরণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো চিহ্নই নেই কোথাও। রক্তকরবী -তে প্রাণের কোনো অভাব নেই-বিশু, কিশোর, ফাগুলাল, অধ্যাপক, মেজো সর্দার, এমনকী রাজার

মধ্যেও অল্পবিস্তর প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। নন্দিনী তো প্রাণদায়িনী আদ্যাশক্তি। কিন্তু যার ওপর এত সব প্রাণ আঘাত করছে সেই 'যন্ত্র' বা machine কোথায়? মুক্তধারা নাটকে যন্ত্ররাজ বিভূ তি তবু একটা ক্রেনজাতীয় অতিকায় যন্ত্র তৈরি করেছিল নদীতে বাঁধ দেওয়ার জন্য। A Dream Play আধ্যাত্মিক মুক্তির নাটক হলেও সেখানে টেলিফোন, খবরের কাগজ ইত্যাদি আধুনিক বস্তুও আছে। কিন্তু রক্তকরবী নাটকে তাও নেই। অর্থাৎ, কোনো দিক থেকেই বোঝার উপায় নেই যে নাটকটির সঙ্গে আধুনিক ধনতান্ত্রিক যন্ত্রসভ্যতার কোনো সংস্রব আছে। যক্ষপুরীর রাজার যন্ত্রে কোনো বিশ্বাসই নেই। নাটকের শুরুতে মঞ্চনির্দেশে আছে 'এখানকার শ্রমিকদল মাটির তলা হইতে সোনা তু লিবার কাজে নিযুক্ত।' একটু পরে অধ্যাপক বলছে 'আমাদের খোদাইকারেরা পৃথিবীর বুক চিরে দরকারের বোঝা -মাথায় কীটের মতো সুড়ঙ্গর ভিতর থেকে উপরে উঠে আসছে।' এই শ্রমিকেরা শুধু কোদাল দিয়ে খনির ভিতরে কাজ করে তাই নয়, তাল তাল সোনা তাদের মাথায় করে বাইরে নিয়ে আসতে হয়। এ -নাটকের সোনার খনিতে যন্ত্রের সাহায্যে কোনো কাজ করার কোনো ব্যবস্থাই নেই। কোনো কনভেয়ার, পুলি বা লিফট, কিংবা পাথর থেকে খাঁটি সোনা উদ্ধার করার কোনো আধুনিক বা বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত পদ্ধতি-এ সবের সঙ্গে রক্তকরবী -র খনিশ্রমিক বা মালিক বা সর্দারেরা কোনোভাবেই যুক্ত নয়। যক্ষপুরীর রাজা একান্তভাবেই যন্ত্রবিরোধী, খনি থেকে সোনা তোলার কাছে নিযুক্ত শ্রমিকদের যন্ত্র ব্যবহারের বিন্দুমাত্র সুযোগ তিনি দিয়েছেন এমন কোনো নিদর্শন নেই নাটকে, যে নাটকে রবীন্দ্রনাথের মতো আমরাও যন্ত্রের সঙ্গে প্রাণের বিরোধ বা আধুনিক ধনতান্ত্রিক সভ্যতার 'অতি বাস্তব চিত্র' দেখতে পাচ্ছি বলে মনে করছি। খনি থেকে ধাতু তোলা, শ্রমিকদের চাবুক মেরে শাস্তি দেওয়া, রাজার তাল তাল সোনা জমানো- কোন অর্থে আধুনিক ধনতান্ত্রিক যন্ত্রসভ্যতার নির্দশন? খনি থেকে সোনা তোলার প্রযুক্তি তো পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো। আর পেরিক্লিসের সময়ে গ্রিসের খনিগুলিতে দাস -শ্রমিকদের শেকলে বেঁধে বা রোমান সাম্রাজ্যে দাস -শ্রমিকদের চাবুক মারতে মারতে মেরে ফেলার ঘটনার চাইতে যক্ষপুরীর সর্দারদের নিষ্ঠু রতা বেশি আধুনিক নয়। যক্ষপুরীর সর্দারেরা অর্থাৎ bureaucracy রাজার চাইতেও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, রাজার আদেশ অমান্য করছে, রাজার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরছে-এগুলিকেও আধুনিক যন্ত্রভিত্তিক ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিশিষ্ট লক্ষণ হিসেবে ধরা যায় না। রোমান সম্রাট কনস্ট্যানটিন (খ্রিস্টপূর্ব ৩২০) তাঁর রাজধানী কনস্ট্যানন্টিনোপল -এ সরিয়ে নিয়ে যাবার পর আমলারা যা করেছিল, রক্তকরবী -র আমলারা তার থেকে আধুনিক কোনো কাজ করেনি :: The autocracy of the later empeorors was...hampered and even paralysed by the self -willed attitude of its own

executive. The very existence of the rulers was threatened by the chronic insubordination of the Roman armies; their authority was flouted by the equally persistent disobedience of their administrative staff...Thus the emperors’ subordinated ended by becoming their own masters...the bureaucracy became free to misgovern to its heart’s content, and it made full use of its licence. All the usual complaints about a corrupt administration were made against it, sale of offices and of justice, blackmail and...punishments with or without semblance of trial. the emperors showered edict after edict upon them, imploring and threatening in turn...But their honest endeavours were defeated by the well -organised collusion of the staff.২৬ সুতরাং যক্ষপুরীর শিল্পে বা রাষ্ট্রব্যবস্থায় রোমান সাম্রাজ্যের চাইতে আধুনিক কোনো সভ্যতার কোনো লক্ষণ বা চিহ্ন নেই। কালের মাত্রার হেরফের করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ রক্তকরবী নাটকের কালবিন্যাসকে ঠিক কোথায় নিয়ে গেছেন তা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না, তবে এটু কু নিশ্চিতভাবেই বোঝা যায় যে নাট্যকালের সীমার মধ্যে সমকালের কোনো চিত্রই নেই, 'অতি বাস্তব চিত্র' তো দূরের কথা। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সমালোচকেরা রক্তকরবী -র মধ্যে যে যন্ত্রসর্বস্ব সমাজ দেখতে পেয়েছেন তার জন্যে যক্ষপুরী কোনোভাবেই দায়ী নয়, রাজা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে যক্ষপুরীকে machine বা যন্ত্র থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে। মকররাজ primitive mining -এ বিশ্বাস রাখে, machinery সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। একমাত্র জানালার জাল বা গরাদ তৈরি করার জন্যে যেটু কু প্রাচীন ধাতু বিদ্যা বা প্রযুক্তির দরকার তার চেয়ে আধুনিক কোনো প্রযুক্তির কোনো প্রমাণ নেই যক্ষপুরীতে; যক্ষপুরীর রাজা নিজেই যন্ত্রসর্বস্ব আধুনিক সমাজের বিরুদ্ধে এক মূর্তিমান প্রতিবাদ। তাই, রক্তকরবী নাটকের মধ্যে যন্ত্রসভ্যতার সঙ্গে প্রাণশক্তির বিরোধ দেখানো হয়েছে একথা 'যাত্রী' -তে রবীন্দ্রনাথ কেন বলেছেন বোঝা খুবই কষ্টকর। নাটকে যদি সত্যিই সে বিরোধের কথা থাকত তাহলে সেকথা আলাদা করে পাঠকদের জানানোর কোনো দরকার ছিল না, আর যদি সে -বিরোধ নাটকের মধ্যে কোথাও তিনি না রেখে থাকেন, তাহলে 'যাত্রী' -তে হঠাৎ ওই বিরোধের প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ কেন তু ললেন এবং তু ললেও সে ব্যাখ্যা কেন আমাদের গ্রহণযোগ্য মনে হবে এটা বুঝতে পারাও কম কঠিন নয়।

চোদ্দো যন্ত্রের সঙ্গে প্রাণের সংঘাত না থাক, অন্য একটি বিরোধের কথা অবশ্য খুব স্পষ্টভাবেই আছে রক্তকরবী নাটকে-আকর্ষণ সভ্যতার সঙ্গে কর্ষণ সভ্যতার, যার কথা রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট বিস্তারিতভাবে বলেছেন নাটকের প্রস্তাবনায়। এই বিরোধ কর্ষণ অর্থাৎ agriculture -এর সঙ্গে আকর্ষণ অর্থাৎ mining -এর দ্বন্দ্ব। রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল এই দুটি প্রযুক্তির মধ্যে এক 'বিষম দ্বন্দ্ব' বর্তমান, আরাম ও শান্তির প্রতীক নবদূর্বাদলশ্যাম রামচন্দ্রের সঙ্গে শোষণ অশান্তি ও চিৎকারের প্রতীক বহুসংগ্রহী বহুগ্রাসী রাবণের দ্বন্দ্বের মতো। রামায়ণ থেকে রবীন্দ্রনাথ আরো দুটি তত্ব উদ্ধার করেছেন, একটি অর্থনৈতিক আরেকটি নান্দনিক কৃ ষি দানবীয় লোভের টানে আত্মবিস্মৃত হয়ে তার কৃ ষিকার্য ছেড়ে স্বর্ণমারীচের মায়ায় ভু লে টাকার লোভে টিটাগড়ের চটকলে মরতে আসে, আর রত্নাকরের দস্যুতা ছেড়ে রামভক্ত হওয়ার পেছনে যে নান্দনিক তত্বটি রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেয়েছেন সেটি হলো-ধর্ষণবিদ্যা অর্থাৎ খনিবিদ্যা বা mining কু ৎসিত, আর কর্ষণবিদ্যা বা কৃ ষিবিদ্যা সুন্দরের আশীর্বাদধন্য। তাই নন্দিনীর প্রাণের যোগ মাটির ওপরকার প্রেমের, লীলার, সহজ সুখের, সহজ সৌন্দর্যের কৃ ষি -সংস্কৃ তির সঙ্গে, মাটি খুঁড়ে যে পাতালে খনিজ ধন তোলা হয় নন্দিনী সেখানকার নয়। এই তত্বগুলি থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে যন্ত্রসভ্যতা নয়, খনিবিদ্যার বিরুদ্ধেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ধিক্কার ও বেদনা ধ্বনিত করতে চেয়েছেন তাঁর নাটকে। 'ধুলোর ধন' মরা ধানের লোভে আবদ্ধ যক্ষপুরীর রাজা ও সর্দারেরা। অধ্যাপক বলেছে নন্দিনীকে 'এখানকার মরা ধনের মাঝখানে তোমার প্রাণের ধনকে কেন আনতে চাও?' অধ্যাপকের বস্তুতত্ববিদ্যা স্পষ্টতই একধরনের বেশ প্রাচীন ভূ বিদ্যা ও খনিবিদ্যা, যার সঙ্গে আধুনিক machines বা metallurgy -র কোনো সম্পর্ক নেই। তা সত্বেও অধ্যাপক যক্ষপুরী সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে নন্দিনীকে বলছে 'পালাও! যেখানকার লোকে দস্যুবৃত্তি করে মা বসুন্ধরার আঁচলকে টু করো টু করো করে ছেঁড়ে না, সেইখানে রঞ্জনকে নিয়ে সুখে থাকো গে।' অধ্যাপক বলতে চাইছে খনিবিদ্যা মা ধরিত্রীকে নিগৃহীত করার শামিল। নন্দিনীও রাজাকে এই খনিজ সোনার লোভের বন্ধন থেকে মুক্ত করে কৃ ষিজ পাকা ফসলের ওপর রোদের সোনা আর মুক্তপ্রাণের লীলা দেখাতে চাইছে 'তু মিও বেরিয়ে এসো রাজা, তোমাকে মাঠে নিয়ে যাই।' এমনিতেই রাজা ও যক্ষপুরীর বাসিন্দারা একটা যথেষ্ট প্রাচীন সভ্যতার স্তরে রয়েছে, নন্দিনী চাইছে তাদের আরো প্রাচীন একটা সভ্যতায় নিয়ে যেতে যেখানে খনি থেকে তোলা কোনো ধাতু র ব্যবহার থাকবে না। এমনকী কৃ ষিও থাকবে কিনা সন্দেহ, কারণ নন্দিনী রাজাকে যেখানে নিয়ে যেতে চায় সেখানে 'পৃথিবী আপনার প্রাণের জিনিস আপনি খুশি হয়ে দেয়', অর্থাৎ Arcadia -য়, বা কৃ ষি সভ্যতারও

আগেকার food gathering স্তরে। গ্রিক ব্যঙ্গকবিরা এই কাল্পনিক জগতের নাম দিয়েছিল Land of Cockaigne, যেখানে ‘rivers of porridge flowed through the land and roast hams and fish, pigs’ ribs already roasted stood ready to be eaten. '২৭ রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাবনায় বলেছেন তিনি নাকি প্রায়ই বন্ধু মহলে বলতেন যে আকর্ষণজীবী সভ্যতা অর্থাৎ খনি থেকে ধাতু তোলার সঙ্গে কর্ষণজীবী সভ্যতা বা কৃ ষির 'একটা বিষম দ্বন্দ্ব' আছে। নন্দিনীও রাজাকে বলেছে, পৃথিবীর বুক চিরে মরা হাড়গুলোকে ঐশ্বর্য বলে ছিনিয়ে নিয়ে আসার মধ্যে আছে অভিসম্পাত, খুনোখুনি, কাড়াকাড়ি, আর কৃ ষিতে শুধুই রোদের সোনা আর প্রাণের লীলা। কৃ ষিতে যে কী পরিমাণ কাড়াকাড়ি, অভিসম্পাত, খুনোখুনির ঘটনা ঘটে সেটা জমিদার হিসেবে নানাধরনের মামলা -মোকদ্দমার সঙ্গে জড়িত থেকেও রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেননি এটা বিশ্বাস করা শক্ত, বিশেষত হানাহানি, কাড়াকাড়ি ও খুনোখুনির সঙ্গে যখন ঠাকু র -পরিবারের ইয়ুসুফশাহি পরগনার জমিদারি একসময় বেশ ঘোরালোভাবেই জড়িয়ে ছিল। সিরাজগঞ্জের সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট Peter Nolan ম্যাজিস্ট্রেটকে পাবনার কৃ ষকবিদ্রোহ সম্পর্কে যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন তাতে জমিদারদের সম্পর্কে লিখেছিলেন : Judging from cases which came before me judicially, and being regularly proved, it is clear that the zamindars of Esafsahi are a turbulent sort of men, without any respect for law and very little for life, in their dealings with their ryots and with one another ।২৮ Peter Nolan -এর রিপোর্টে ঠাকু র পরিবারের জমিদারদের সঙ্গে অন্যান্য জমিদারদের বিরোধ নিয়ে খুনোখুনি, মেয়ে তু লে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ও ঠাকু র -জমিদারদের পোষা একদল অত্যাচারী শিখ গুন্ডাবাহিনীর কথাও আছে। সুতরাং কৃ ষিতে শুধুই প্রাণের সহজ লীলা আর শোষণ -অত্যাচারহীন সৌন্দর্য, আর যতকিছু অন্যায়, পাপ, শোষণ ও হানাহানি শুধু খনি থেকে ধাতু তোলার মধ্যে-এ সব মজার কথা পদ্যে বা বন্ধু মহলে গল্পগুজব করার সময় মানাতেও পারে, কিন্তু গদ্যে লেখা কোনো সামাজিক -রাজনৈতিক নাটকের প্রস্তাবনায় বোধহয় মানায় না। যাঁদের কাছে রবীন্দ্রনাথ কৃ ষি ও খনিবিদ্যার মধ্যে এই 'বিষম দ্বন্দ্ব'র গল্প বলতেন, তাঁরা সহজেই রবীন্দ্রনাথকে গল্পচ্ছলে বলতে পারতেন এ দ্বন্দ্ব নিতান্তই কাল্পনিক ও বেশ কিছুটা obscurantist। খনিবিদ্যা কৃ ষিবিদ্যারই একটি পরিপূরক ও সহায়ক প্রযুক্তি।

খনিজ ধাতু র ব্যবহার ও ধাতু দিয়ে লাঙলের ফলা বা কাস্তে বানানো না -শেখা পর্যন্ত মানুষ ভালো করে সোনার ফসল ফলাতে বা ঘরে তু লতেই পারেনি। এই অবাস্তব atavistic প্রকৃ তিপ্রেমের বাণী প্রচার করে মানুষের সভ্যতার ও প্রগতির সবথেকে সহায়ক প্রযুক্তি খনিবিদ্যা ও ধাতু বিদ্যাকে অসুন্দর, পাপ, অন্যায় বলে গালাগালি করে কার্যত সভ্যতা, বিজ্ঞান ও প্রকৃ তিকেই হেয় করে তু লেছেন রবীন্দ্রনাথ। এ প্রসঙ্গে বোধহয় স্মরণ করা যেতে পারে যে গান্ধি ১৯০৯ সালে লেখা তাঁর Hind Swaraj প্রবন্ধে এইভাবেই বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির বিরোধিতা করে ও কৃ ষি -জীবনকে মহিমান্বিত করে ভারতবর্ষকে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে নিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন : India’s salvation consists in unlearning what she was learnt during the last 50 years or so. The railways, telegraphs, hospitals, lawyers, doctors and such like have all to go, and the so -called upper class have to learn to live consciously and religiously and deliberately the simple life of a peasant।২৯ এই Nature -mystique -এর সঙ্গে রুশো, ওয়ার্ডজওয়ার্থ, এমার্সন, থোরো, ম্যাথু আর্নল্ড, উইলিয়ম মরিস, টলস্টয়ের মতো বেশ ভালো ভালো নাম যুক্ত থাকলেও বা এই ‘Primitivism’ -এর মধ্যে ধনতান্ত্রিক laissez -faire অর্থনীতি ও সমাজের ভণ্ডামি, লোভ, শোষণ, অমানবিকতা, কু শ্রীতা ও অবিচারের বিরুদ্ধে একধরনের ভাবালু বা aesthetic প্রতিবাদ ধ্বনিত হলেও, কার্যত এটি একধরনের সাংস্কৃ তিক bohemianism, যা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রগতিবিরোধী একটি প্রতিক্রিয়াশীল নান্দনিক ধারণা বা তত্ব মাত্র নয়, সমাজবাস্তবকে অস্বীকার করে বা পাশ কাটিয়ে বুর্জোয়া সমাজের শোষণ ও অবিচারের শক্তিগুলিকে আড়াল করে, irrational প্রকৃ তিবাদ ও প্রাণশক্তির ধোঁয়ায় শোষিত মানুষকে বিভ্রান্ত করে, ধনতান্ত্রিক বা সাম্রাজ্যবাদী শোষণকে অব্যাহত রাখার একটি কৌশলও বটে। আদি -ফ্যাসিস্ট ধ্যানধারণার একজন মুখ্য প্রবক্তা Julius Longbehm তাঁর অত্যন্ত প্রভাবশালী Rembrandt as Educator (1890) বইয়ে তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে যা বলেছিলেন, তার সঙ্গে গান্ধি -রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের খুব বেশি অমিল নেই : ‘To lead men back to natural spontaneity and simplicity, away from the artificial and the artful, that is my true vocation।'৩০ Longbehn -এর মতো গান্ধি -রবীন্দ্রনাথও হয়তো বোঝেননি বিজ্ঞান, সভ্যতা ও যুক্তিবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার বিপদ কোথায়। বস্তুবাদ যুক্তিবাদ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে হেয় করে Irrational নিসর্গলীলা ও প্রাণশক্তিকে মহিমান্বিত করার জন্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের জীবিকাসংগ্রহের উৎস

কৃ ষিকে যুক্ত করেছেন নবদূর্বাদলশ্যাম রামচন্দ্রের সঙ্গে, আর প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান -ভিত্তিক খনিবিদ্যাকে অশান্তি আর চিৎকারেরপ্রতীক রাবণের সঙ্গে। এটা তাঁর সম্ভবত মনে হয়নি যে খনিবিদ্যা বা আকর্ষণবিদ্যা ধরিত্রীকে বিবস্ত্র করে ঠিকই, কিন্তু কৃ ষি বা কর্ষণবিদ্যা ধরিত্রীর শরীরে কর্ষণ করে বীজ বপন করে, এবং সেই কারণেই আকর্ষণ বা mining যদি ধর্ষণবিদ্যা হয়, কৃ ষি বোধ হয় আর একটু বেশি রকমের ধর্ষণ। আসলে এই ধর্ষণ -রূপকের ব্যবহার এখানে আদৌ সুপ্রযুক্ত নয়। মাটির ওপরে প্রকৃ তি সহজ প্রাণের লীলায় কখনোই আপনাকে উজাড় করে দেয় না, কৃ ষকের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফলেই পাকা ফসলে ভরে ওঠে মাঠ, এবং সেই ফসলের ওপর তার ন্যায্য অধিকার থেকে সে বঞ্চিত হয় বলেই তাকে টিটাগড়ের চটকলে আসতে হয়, আত্মবিস্মৃত হয়ে নয়, স্বর্ণমারীচের প্রলোভনে নয়, নিতান্তই বেঁচে থাকার তাগিদে। কৃ ষিকার্য ও কৃ ষি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ রক্তকরবী নাটকের প্রস্তাবনায় যেসব ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন সেগুলি নিতান্তই absentee landlord -এর, একান্তভাবেই ইউটোপিয়ান। এই গরহাজির জমিদারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রবীন্দ্রনাথ সারা নাটক জুড়ে সবাইকে পাকা ফসলের ডাক শুনতে মাঠের মধ্যে যেতে বলেছেন নগরজীবন ছেড়ে, মাটির টানে গ্রামে ফিরে প্রাণের মাধুর্যের আস্বাদ নিতে। হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃ তির সঙ্গে লড়াই করে মানুষ আজ যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক সভ্যতা গড়ে তু লেছে সেই সভ্যতাকে আরো বিকশিত করে, যন্ত্রের ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে বৃহত্তর মানবসমাজের কল্যাণসাধনের জন্যেই শোষণভিত্তিক শাসনের প্রতীক রাজা ও তার রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধ্বংস করাই ফাগুলালদের প্রধান কর্তব্য-এ কথা রবীন্দ্রনাথ বলছেন না রক্তকরবী নাটকে। সেই লক্ষ্য থেকে ফাগুলালদের সরিয়ে দিয়ে সবাইকে 'প্রাণ ও মাটি' -র ডাক শোনানো শুধু শোষণের শক্তির সঙ্গে শোষিতের হাত মেলানোর ডাক নয়, এ ডাক Longbehn -এর ‘Geist and Boden’ স্লোগান, যে স্লোগানটিকে ‘blut und boden’ বা পবিত্র আর্যরক্ত ও মাটির ডাকে পরিণত করে হিটলার জার্মানির গ্রামাঞ্চলের জোতদার -কৃ ষকদের মধ্যেও ফ্যাসিজমের ব্যাপক গণভিত্তি তৈরি করতে পেরেছিল : The slogan ‘Back to the Land’ could easily be converted into an appeal to ‘Blut und boden’, to the dark forces in the blood and the black mysteries of the soil. This was particularly true in Germany where...there was a powerful pressure group, the Agrarian League (Bund der Landwirte) anxious to preserve the economic and social position of the German landowner and farmer, and to keep the preponderence of the counry

over the town by stressing the importance of the land for the conservation of the German society and the maintenance of the true German tradition।৩১ রক্তকরবী নাটক লেখার সময়েই রবীন্দ্রনাথ এই ‘Back to the Land’ স্লোগান ব্যবহার করে গান লিখেছিলেন 'ফিরে চল মাটির টানে' এবং এটি শ্রীনিকেতনের একটি আনুষ্ঠানিক গানে পরিণত হয়েছিল। ১৯২৩ সালে হয়তো রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এই স্লোগানের পুরো তাৎপর্য বোঝা সম্ভব ছিল না, কিন্তু এইসব মানসিকতা ও চিন্তাধারা থেকে কিছুটা বোঝা যায় কেন আর কিছুদিন পরেই তিনি ইয়োরোপের এক বর্বরকে দেখে অভিভূ ত হয়ে লিখবেন ‘His Excellency Mussolini seems modelled body and soul by the chisel of a Michael Angelo, whose every action showed intelligence and force '।৩২ ১৯২৬ সালে অর্থাৎ রক্তকরবী বই হিসেবে প্রকাশিত হবার সময় আত্মার সৌন্দর্য, বুদ্ধি ও শক্তি বলতে রবীন্দ্রনাথ কী বুঝতেন তার একটা স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় এই উচ্ছ্বসিত উক্তিটি থেকে।

পনেরো নন্দিনীও যক্ষপুরীর রাজার মধ্যে এই ধরনেরই এক আশ্চর্য শক্তি দেখেছে 'অদ্ভু ত তোমার শক্তি।...তোমার সোনার তাল দেখে কিছু আশ্চর্য হইনি, কিন্তু যে বিপুল শক্তি দিয়ে অনায়াসে সেইগুলোকে নিয়ে চূ ড়ো করে সাজাচ্ছিলে তাই দেখে মুগ্ধ হয়েছিলুম।' কিসের এই শক্তি দেখে নন্দিনী এত মুগ্ধ হচ্ছে? যন্ত্রের নিশ্চয় নয়, কারণ যন্ত্রের সঙ্গে রাজার কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে কি সঞ্চয়ের, তাল তাল সোনা জমানোর রাবণের শক্তি? নন্দিনী তো সে সর্বসংগ্রহী শক্তিকে ঘৃণা করে, সে শক্তি দেখে তো তার 'মুগ্ধ' হবার কথা নয়। রক্তকরবী নাটকে রাজার শক্তির অন্য কোনো নিদর্শন আমরা পাই না, আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও তার নেই। তার মাত্র একটি শক্তির কথাই রবীন্দ্রনাথ বিশেষ জোর দিয়ে বলেছেন, সেটা তার শারীরিক শক্তি এবং সহজেই মানুষকে মেরে ফেলার ক্ষমতা। কু স্তিগীর ভজনকে সে এমনভাবে মেরেছে যে 'তার লঙোটির একটা ছেঁড়া সুতো কোথাও দেখা গেল না।' তার ভাই গজ্জুকেও রাজা আধমরা করে ছেড়েছে, রঞ্জন ও কিশোরকেও মেরে ফেলেছে। যক্ষপুরীর জল্লাদের কাজ রাজা নিজেই করে। রাজার এই আশ্চর্য শারীরিক শক্তি দেখেই নন্দিনী মুগ্ধ হয়েছে এবং রাজার পৌরুষের শক্তির প্রতি তার এই আকর্ষণের কথা নন্দিনী বেশ অসংকোচেই জানিয়ে দিয়েছে রাজাকে 'কতবার বলেছি, তোমাকে মনে করি আশ্চর্য। প্রকাণ্ড হাতে প্রচণ্ড জোর ফু লে ফু লে উঠছে, ঝড়ের আগেকার মেঘের মতো-দেখে আমার মন নাচে।' রাজার পেশিশক্তি দেখে নন্দিনীর মন -নাচা এই সংলাপের যৌন ইঙ্গিত খুব একটা প্রচ্ছন্ন নয়। এই ইঙ্গিত পরে রাজার কথাতেও ধরা পড়েছে 'দাড়িমের দানা ফাটিয়ে দশ আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে যেমন তার রস বের করে, তেমনি তোমাকে আমার এই দুটো হাতে-যাও যাও, এখনি পালিয়ে যাও, এখনি।' যে প্রকাণ্ড হাতের প্রচণ্ড জোর দেখে একটু আগে নন্দিনীর মন নাচছিল, সেই হাতের মধ্যেই ধর্ষণের ইমেজ ফু টে উঠেছে। কিন্তু নন্দিনী কিছুক্ষণ আগেই রাজার একটু হালকা আদর খেয়ে এসে বলেছে, রাজা যখন তার হাতে হাত বুলোচ্ছিল বা তার খোলা চু লের মধ্যে দুহাত ভরে দিয়ে বসেছিল তখন তার খুব ভালো লেগেছে 'ও যেন হাজার বছরের বটগাছ, আমি যেন ছোট্ট পাখি। ওর ডালের একটি ডগায় যদি একটু দোল খেয়ে যাই, নিশ্চয় ওর মজ্জার মধ্যে খুশি লাগে। ঐ একলা প্রাণকে সেই খুশিটু কু দিতে ইচ্ছে করে।' যে নিজে থেকেই রাজার মতো বটগাছের ডালের 'একটি ডগায়' দোল খেয়ে রাজার মজ্জায় খুশি লাগাতে চায়, রাজার দশ আঙু ল দিয়ে দাড়িমের দানা ফাটানোর হুমকিতে তার ভয় পাওয়ার কথা নয়। নন্দিনী বলেছে 'কী করতে পারো করো। অমন বিশ্রী করে গর্জন করছো কেন?' এইসব আশ্চর্য সংলাপ থেকে মনে হয় রাজাকে তার

সঞ্চয়ের লোভ থেকে মুক্ত করার চাইতে রাজাকে উত্তেজিত করে নন্দিনী যেন তার নিজের tumescence থেকে মুক্তি পেতে চাইছে। রাজার 'দুটো হাতে' দাড়ি ফাটানোর আকাঙ্ক্ষার পেছনে নন্দিনীর প্ররোচনা ও প্রশ্রয় যথেষ্টই কাজ করেছে। নন্দিনীর ধমক খেয়ে রাজা শান্ত হয়ে মুগ্ধ প্রেমিকের মতো নন্দিনীর গুচ্ছ গুচ্ছ কালোচু লের নীচে মুখ ঢেকে ঘুমোতে চেয়েছে, আর নন্দিনী গান গেয়ে গেয়ে যক্ষপুরীর রাজাকে তার মনের কথা খুলে বলেছে 'ভালোবাসি, ভালোবাসি।' নিষ্ঠু র স্বৈরাচারী শোষক রাজার সঙ্গে ফাগুলাল, বিশু, কিশোরদের প্রিয় নেত্রী নন্দিনীর এই দয়া, মায়া, মমতা, আদর -ভালোবাসার সম্পর্ক দেখিয়ে ও সেই সম্পর্কের মধ্যে এত স্পষ্ট যৌন ইঙ্গিত দিয়ে শোষণভিত্তিক দুঃসমাজের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ রক্তকরবী নাটকে কী ধরনের প্রতিবাদ ও ধিক্কার ধ্বনিত করছেন বা শ্রমিকনেত্রী হিসেবে নন্দিনীর চরিত্রকে কিভাবে পাঠক বা দর্শকদের কাছে তু লে ধরতে চাইছেন এটা বুঝতে আমাদের খুব কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ফাগুলাল বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছে 'ডাকিনী, ওর সঙ্গে পরামর্শ চলছে, বিশ্বাসঘাতিনী!' ফাগুলালের তখনো বিশ্বাস রয়েছে নন্দিনী তাদের মুক্তির স্বার্থেই কাজ করছে 'নন্দিন, ভালো বুঝতে পারছি নে। আমরা সরল মানুষ, দয়া করো, আমাদের ঠকিও না। তু মি যে আমাদেরই ঘরের মেয়ে।' তাদেরই ঘরের মেয়ে হয়েও নন্দিনী যে শোষণের সমস্ত দায়িত্ব কৌশলে আমলা -সর্দারদের ঘাড়ে চাপিয়ে শোষণের প্রধান শক্তিকে শ্রমিকশ্রেণির সহযোদ্ধা হিসেবে তাদের সামনে হাজির করছে, এ সন্দেহ ফাগুলালের মনে জেগেছে। কিন্তু সুন্দরী নন্দিনীর বাক -চাতু রীতে সে এতই মুগ্ধ যে সে সন্দেহ মুছে গেছে মুহূর্তেই। নন্দিনী বা রবীন্দ্রনাথের মনের কথা রাজা খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছে ফাগুলালকে 'তোমাতে আমাতে দুজনে মিলে কাজ করতে হবে। একলা তোমার কাজ নয়।' মনে রাখতে হবে রাজা নিজে নন্দিনীকে আনিয়েছে যক্ষপুরীতে। নন্দিনী তার কাজ সমাধা করেছে, রাজা ও প্রজার মধ্যে প্রাণের, প্রেমের -লীলার, সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তু লে, প্রজাদের রাজদ্রোহী চেতনাকে নিস্তেজ করে দিয়ে, তাদের শোষণমুক্তির আন্দোলনকে সম্পূর্ণভাবে বিপথে চালিত করে শোষণের সর্দারের ভিত্তিকে আরো সুদৃঢ় করেছে। এই কোলাবোরেটার -নন্দিনীকে মহিমান্বিত করা হয়েছে সর্দারের বর্শার দিকে নন্দিনীর একা চাপিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে 'দেখো ওর বর্শার আগে আমার কু ন্দফু লের মালা দুলিয়েছে। ঐ মালাকে আমার বুকের রক্তে রক্তকরবীর রঙ করে দিয়ে যাবো', যেন স্বৈরাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের সংগ্রামকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চাইতে শোষক -শোষিতের সহযোগ ও সমঝোতার প্রতীক নন্দিনীর ব্যক্তিগত আত্মত্যাগের মহিমা দেখানোর কাজটি আরো জরুরি।

নন্দিনী শহিদ হয়েছে। কিন্তু রাজা শেষ পর্যন্ত কী করবে নাটকের শেষে সেটা খুব স্পষ্ট নয়। সর্দারদের হারিয়ে রাজা কী ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়বে বা সেই সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থায় বা প্রশাসনে রাজার সঙ্গে ফাগুলালদের সম্পর্কের বিন্যাস বা চরিত্র কেমন হবে তারও কোনো ইঙ্গিত নেই নাটকে। রাজা ইতিমধ্যেই যন্ত্র সম্পর্কে যে বিরূপতা দেখিয়েছে তাতে ফাগুলালের মতো দাস -শ্রমিকদের মুক্ত ও স্বাধীন করে সে যে কোনো প্রগতিশীল যন্ত্রভিত্তিক ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়বে বা বুর্জোয়া বিপ্লব ঘটাবে সে সম্ভাবনারও কোনো আভাস নেই নাটকের শেষে। বরং ফাগুলালের-'রাজা তো ঐ গেল মরতে, সে নন্দিনীর ডাক শুনেছে'-কথাগুলি শুনে মনে হয় রাজাও নন্দিনীর মতো ‘Deliverance through death বা Wagnerian self -immolation’ -এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত বা শ্রেণিগত আত্মত্যাগের মহিমা দেখাবে। রাজা যদি মরেও, ফাগুলালদের মুখে লেগে থাকবে শোষক -শোষিতের সহযোগ ও প্রেমের প্রতীক অতিমানবী নন্দিনীর জয়গান। 'নন্দিনীর জয়, নন্দিনীর জয়' বলে চিৎকার করেছে বিশু -ফাগুলাল, নাটকের শেষে। শেষ সংলাপে বিশু তু লে নিয়েছে কোনো অস্ত্র নয়, নন্দিনীর শেষ দান-তার হাত থেকে খসে পড়া ফু লের কঙ্কন। এই কোলাবোরেশন -কঙ্কনের মধ্যে কোন অনর্থ লুকিয়ে আছে সে সম্বন্ধে আমাদের ধারণা যতই অস্পষ্ট থাক, রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিল না, ১৯২৩ সালের ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। তাই তিনি বারবার নাটকের প্রকাশ্য রসেই সন্তুষ্ট থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলেন পাঠকদের। নন্দিনী কোন শ্রেণির স্বার্থ দেখছে সেটা নাটকে খুব স্পষ্ট বলেই পাঠকদের তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে 'তাঁরা শ্রেণীর কথাটা ভু লে যান।' এই অনর্থের দিক থেকে পাঠকদের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্যেই রামায়ণের গল্প, আকর্ষণ -কর্ষণের কাল্পনিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদির অবতারণা করতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে, রক্তকরবী নাটকের দীর্ঘ ও প্রায় -অপ্রাসঙ্গিক প্রস্তাবনার মধ্যে। ষোলো রক্তকরবী নাটকে রবীন্দ্রনাথ অবশ্য নতু ন কিছু বলছেন না। রাজা -প্রজার মধ্যে একটি মিষ্টি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার স্বপ্ন রবীন্দ্রনাথ দেখতে শুরু করেছিলেন ১৮৯৩ সাল থেকে, অর্থাৎ স্বদেশি আন্দোলনের এক যুগ আগে থেকেই। চৈতন্য লাইব্রেরিতে একটি বক্তৃ তা করেন ১৩০০ সালের ভাদ্র মাসে। প্রবন্ধটির নাম 'ইংরেজ ও ভারতবাসী'। ইংরেজদের সঙ্গে ভারতের মানুষের মনের মিল হচ্ছে না দেখে রবীন্দ্রনাথ যে কতখানি ব্যথিত হতেন প্রবন্ধটিতে তার একটি স্পষ্ট পরিচয় আছে। সে বিরোধ কী করে দূর করা যায় এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কিছু সুচিন্তিত প্রস্তাবও আছে প্রবন্ধটির মধ্যে।

রবীন্দ্রনাথের মতে, এই অসদ্ভাবের জন্যে দায়ী দু'পক্ষই। ইংরেজরা হৃদয় দিয়ে প্রজাদের আপনার করতে পারে না, আর আমরাও 'কাগজে পত্রে অনেক সময় অন্যায় খিটিমিটি করিয়া থাকি এবং অমূলক কোঁদল উত্থাপন করি।...রাজাপ্রজার এই অহরহ কলহ দেখিতেও কিছুমাত্র ভালো হইতেছে না।' এই কলহ যাতে দূরীভূ ত হয় সেজন্যে রবীন্দ্রনাথ রাজাকে উপদেশ দিচ্ছেন 'রাজ্য জয় করিয়া গৌরব এবং লাভ আছে, রাজ্য সুশাসন করিয়া ধর্ম এবং অর্থ আছে, আর রাজা -প্রজার হৃদয়ের মিলন স্থাপন করিয়া কি কোনো মাহাত্ম্য এবং কোনো সুবিধা নাই। বর্তমান কালের ভারত -রাজনীতির সেই কি সর্বাপেক্ষা চিন্তা এবং আলোচনার বিষয় নহে।' রাজ্যজয় বা শাসনের ক্ষেত্রে ইংরেজ শাসকেরা যেসব মহৎ গুণের পরিচয় দিয়েছে, রাজা -প্রজার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সেইসব চমৎকার গুণ ইংরেজরা কাজে লাগাচ্ছে না বলে রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করছেন এই ভারতজয় -ভারতশাসনকার্যে ইংরাজের যে -সকল গুণের আবশ্যক হইয়াছে সেগুলি কি সুলভ গুণ। সে সাহস, সে অদম্য অধ্যবসায়, সে ত্যাগস্বীকার কি স্বল্প সাধনার ধন। আর, পঞ্চবিংশতি কোটি বিদেশীয় প্রজার হৃদয় জয় করিবার জন্য যে দুর্লভ সহৃদয়তা গুণের আবশ্যক তাহা কি সাধনার যোগ্য নহে। ইংরেজ শাসকেরা এই সাধনার উপদেশে কর্ণপাত করবে কিনা এ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত ছিলেন না। তাই দেশবাসীকে তিনি উপদেশ দিচ্ছেন, যতদিন আমরা আমাদের নিজেদের চরিত্র সংশোধন করে সাহেবদের সঙ্গে সমানভাবে না মিশতে পারি ততদিন ইংরেজদের সঙ্গে কোনোরকম সংস্রব না রেখে, আবদার, ভিক্ষাবৃত্তি, আস্ফালন, খিটিমিটি ইত্যাদির মধ্যে না গিয়ে আপনমনে নিজেদের কাজ করে যাব 'সকল দিক পর্যালোচনা করিয়া রাজা -প্রজার বিদ্বেষভাব শমিত রাখিবার প্রকৃ ষ্ট উপায় এই দেখা যাইতেছে, ইংরাজ হইতে দূরে থাকিয়া আমাদের নিকট কর্তব্যসকল পালনে একান্তমনে নিযুক্ত হওয়া।' রাজা -প্রজার মধ্যে বিদ্বেষভাব শমিত রাখবার উপায় হিসেবে এই self -culture বা আত্মচর্চার ফর্মূলাটি প্রায় সারা জীবন ধরেই রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন, একদিকে রাজার মধ্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে, আর অন্যদিকে সবরকমের আবেদন -অসন্তোষ -বিদ্বেষ -বিক্ষোভ -আন্দোলন থেকে প্রজাদের দূরে থাকার পরামর্শ দিয়ে, যাতে রাজা -প্রজার মিলন না ঘটু ক, স্থিতাবস্থার যেন বিঘ্ন না ঘটে। ইতিমধ্যে রাজার হৃদয় পরিবর্তন যদি ঘটে তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু বাস্তবে রাজার মধ্যে প্রাণসঞ্চারের কোনো লক্ষণ তো দেখা গেলই না, বরং বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব এনে রাজা -প্রজার মধ্যে নতু ন করে কলহের সূত্রপাত করল লর্ড কার্জন। বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে যে স্বদেশি আন্দোলন গড়ে উঠল তাতে

বাংলাদেশের বেশ কিছু বড়ো জমিদারও প্রথমটায় অংশ নিলেন, কারণ বঙ্গবিভাগ হলে তাঁদের নানাধরনের অসুবিধে ও আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল। ১৩১১ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথের 'বঙ্গবিভাগ' প্রবন্ধ থেকে জানা যায় যে 'বঙ্গবিভাগ সূত্রে ক্রমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লোপ পাইতে পারে' এরকম আশঙ্কাও জেগেছিল কিছু জমিদারের মনে। অন্যান্য জমিদারদের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকু র, সূর্যকান্ত রায়চৌধুরী, নাটোরের মহারাজা, কাশিমবাজারের মণীন্দ্র নন্দী এঁরা সবাই এগিয়ে এলেন স্বদেশি আন্দোলনের সমর্থনে আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে, যদিও তাঁদের মধ্যে অনেকেই শেষ পর্যন্ত তাঁদের প্রতিশ্রুতি রাখেননি, সরকারি চাপের ফলে-না তাঁদের নিজেদের মানসিক পরিবর্তনের ফলে বলা মুশকিল। আন্দোলনের প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন পুরোভাগে-গানে, বক্তৃ তায়, মিছিলে-আশ্বিন, কার্তিক ও অঘ্রান (১৩১২), এই তিন মাস। তারপরেই হঠাৎ চলে গেলেন শান্তিনিকেতনের নিরালায় স্বদেশি আন্দোলন থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিয়ে। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লিখলেন (২৬ অগ্রহায়ণ, ১৩১২) 'অগ্নিকাণ্ডের আয়োজনে উন্মত্ত না হইয়া যতদিন আয়ু আছে, আমার এই প্রদীপটিকে জ্বালিয়া পথের ধারে বসিয়া থাকিব।' ইংরেজশাসন -বিরোধী আন্দোলনে না গিয়ে তিনি কী ধরনের প্রদীপ জ্বেলে তাঁর বাকি জীবন পথের ধারে বসে থাকার সংকল্প ঘোষণা করেছেন, সেটা রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করে বললেন দু মাস পরে লেখা 'রাজভক্তি' (ভাণ্ডার, মাঘ, ১৩১২) প্রবন্ধে 'ভারতবর্ষের ইংরজে হৃদয়ের কারবার কোনদিন করে নাই। তাহারা এই দেশকে হৃদয় দেয় -ও নাই, এ দেশের হৃদয় চায় -ও নাই, দেশের হৃদয়টা কোথায় আছে তাহার খবরও রাখে না।' রবীন্দ্রনাথ মনে করেন ভারতবর্ষের মানুষের রাজভক্তি প্রকৃ তিগত, কিন্তু রাজার মধ্যে হৃদয় দেখতে পাই না বলেই আমরা পীড়িত ও অপমানিত বোধ করি 'রাষ্ট্রব্যাপারের মধ্যস্থলে আমরা দেবতার শক্তিকে, মঙ্গলের প্রত্যক্ষস্বরূপকে রাজরূপে দেখিতে পাইলে শাসনের বিপুল ভার সহজে বহন করিতে পারি; নহিলে হৃদয় প্রতিক্ষণেই ভাঙিয়া যাইতে থাকে। আমরা পূজা করিতে চাই-রাজতন্ত্রের মধ্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিয়া আমাদের প্রাণের যোগ অনুভব করতে চাই।' এই চমৎকার প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারতভ্রমণ উপলক্ষে। তাই রবীন্দ্রনাথ যুবরাজকে উদ্দেশ করে বলছেন 'রাজপুত্র আসুন, ভারতের রাজতক্তে বসুন...তাহাতেই ভারতের মঙ্গল এবং ইংরেজের স্থায়ী লাভ।' প্রিন্স অব ওয়েলসকে ভারতের জনগণমঙ্গলদায়ক হিসেবে দেখার আকাঙ্ক্ষা রবীন্দ্রনাথ প্রথম প্রকাশ করে এই 'রাজভক্তি' প্রবন্ধেই, স্বদেশি আন্দোলন থেকে সরে আসার দু মাস পরে। এই হৃদয়বান জনকল্যাণকামী রাজপুত্র খুব শিগগিরই ফিরে আসবে প্রায়শ্চিত্ত নাটকের

'উদয়াদিত্য' চরিত্রে। শোষণের কেন্দ্রে ত্যাগের আদর্শ আরোপ করার চেষ্টা বাস্তবে সফল না হলেও সাহিত্যে দীর্ঘকাল ধরে সে চেষ্টা চালিয়ে যাবেন রবীন্দ্রনাথ। রাজা -প্রজার বিরোধ আবার তু ঙ্গে উঠল ১৯০৮ সালের মে মাসে সশস্ত্র আন্দোলনের সময়। সে বিরোধ প্রশমিত করার জন্যে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন 'পথ ও পাথেয়' (জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৫) প্রবন্ধ, ক্ষু দিরাম ও প্রফু ল্ল চাকীর কেনেডি -হত্যা ও মানিকতলা মামলা শুরু হওয়ার পরেই। সেই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ইংরেজরা প্রাণের প্রাবল্যে বিজ্ঞানের কৌতূ হলে পণ্যসংগ্রহের আকাঙ্ক্ষায় বিধাতার আহ্বান বহন করে ভারতে এসেছে এখানকার ঘুমন্ত মানুষদের জাগাতে। ভারতের ঋষিরা বরাবর ঐক্যের সাধনা করেছেন, বিরোধের নয়; অথচ বিপ্লবীরা সেই পুণ্য মিলনযজ্ঞ পণ্ড করেছে বোমা ছুঁড়ে; 'অকস্মাৎ ধৈর্যহীন উন্মত্ততা যজ্ঞক্ষেত্রে রক্তবৃষ্টি করিয়া তাহার বহুদুঃখসঞ্চিত তপস্যার ফলকে কু লষিত করিয়া নষ্ট করিবার উপক্রম করিতেছে।' কবি তরুণদের উপদেশ দিচ্ছেন যাতে তারা সব বিরোধ ভু লে গিয়ে মন থেকে শত্রুমিত্র ভেদ মুছে ফেলে, ইংরেজ শাসন মেনে নিয়ে ঔপনিষদিক ব্রহ্ম ও সত্যকে উপলব্ধি করার সাধনায় মনোনিবেশ করে। অর্থাৎ সেই আত্মোন্নতির উপদেশ, যাতে ইংরেজ শাসন বা শোষণের কোনো বিঘ্ন না ঘটে, স্থিতাবস্থা বজায় থাকে। ওই একই উপদেশ চলবে পরপর লেখা 'সমস্যা', 'সদুপায়', 'দেশহিত', 'পূর্ব ও পশ্চিম' ইত্যাদি প্রবন্ধে, বক্তব্য একটাই জগতের যজ্ঞেশ্বরের দূত ইংরেজদের এ দেশ থেকে তাড়ানোর কোনো অধিকার আমাদের নেই, তাদের সঙ্গে আমাদের মিলন ঘটাতে হবে, ত্যাগের দ্বারা শ্রেয়কে বরণ করে অর্থাৎ সমস্ত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন বন্ধ করে আত্মসমাহিত হয়ে পল্লীমঙ্গলের কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে, শাসনব্যবস্থা ভাঙার কোনো চেষ্টা চলবে না। বিপ্লবীরা 'আমাদের সকলের চেয়ে ভয়ঙ্কর শত্রু' একথাও রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করবেন 'দেশহিত' (১৯০৮) প্রবন্ধে। শোষণভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শোষিত মানুষের ঘৃণা ও ক্রোধ থেকে বাঁচানোর কৌশল হিসেবে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে কিন্তু তার ওপর নির্ভরতা ছেড়ে Self -Help বা আত্মশক্তি অর্জনের এই তত্বটি শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের শ্রেণিগত ব্যক্তিগত গরজ থেকে এসেছিল মনে করলে একটু ভু ল করা হবে। এই Self -Help ভিক্টোরীয় যুগের একটি চালু বিপ্লব -বিরোধী স্থিতাবস্থাকামী স্লোগান। ব্যক্তিকে নিয়েই সমাজ, ব্যক্তির চরিত্র উন্নত হলে তবে সমাজব্যবস্থা উন্নত হবে, ব্যক্তির নিজের অজ্ঞানতা, স্বার্থপরতা ও পাপচিন্তার দাসত্ব রাজনৈতিক দাসত্বের চাইতেও খারাপ। স্বাদেশিকতার মোহে অত্যাচারী রাজাকে বা রাজতন্ত্রকে ধ্বংস করে কোনো লাভ নেই, কেননা সমাজে ব্যক্তির চরিত্রে যেসব ভেদবুদ্ধি অন্যায় অত্যাচারের প্রবৃত্তিগুলো রয়েছে রাজা বা শাসক তারই প্রতিফলন মাত্র, ব্যক্তি -মানুষ উন্নত হলে তবেই সমাজ সুস্থ হবে। সুতরাং কোনো সংঘবদ্ধ আন্দোলন বা বিপ্লব

নয়, শোষণের শক্তির সঙ্গে সংঘাত নয়, ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিচ্ছিন্ন আত্মোৎকর্ষের প্রচেষ্টাই সমাজের উন্নতির একমাত্র পথ। এই আপাতমনোহর অবাস্তব তত্বটির একজন নামকরা ভিক্টোরীয় প্রবক্তা ছিলেন Samuel Smiles, যাঁর বিখ্যাত Self -Help বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬০ সালে, যে বইটির জনপ্রিয়তা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে আমাদের দেশেও খুব কম ছিল না। বইটি থেকে একটু অংশ পড়লেই বোঝা যাবে Self -Help বা আত্মশক্তি -তত্বের আসল তাৎপর্য কোথায়। রবীন্দ্রনাথ বা গান্ধি কেন স্বাধীনতা বা স্বরাজ বলতে ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ থেকে অর্থনীতিক -রাজনৈতিক মুক্তির কথা না ভেবে একটা আবছা, ঘোলাটে নৈতিক -আধ্যাত্মিক মানসিক অবস্থার কথা ভাবতেন বা বলতেন তারও কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে Smiles -এর কথার মধ্যে। উদ্ধৃ তিটি একটু বড়ো হলেও কথাগুলো তাই শোনা দরকার : Indeed, all experience serves to prove that the worth and strength of a state depend far less upon the form of its institutions than upon the character of its men. For the nation is only the aggregate of individual conditions, and civilization itself is but a question of personal involvement... The noble people will be nobly ruled, and the ignorant and corrupt ignobly. Indeed, liberty is as much a moral as a political growth, the result of free individual action, energy and independence. It may be of comparatively little consequence how a man is governed from without, whilst everything depends upon how he governs himself from within. The greatest slave is not he who is ruled by a despot, great though that evil be, but he who is the thrall of his own moral ignorance, selfishness and vice. There have been, and perhaps there still are, so called patriots abroad, who hold it to be the greatest stroke for liberty to kill a tyrant, forgetting that the tyrant usually represents only too faithfully the millions of people over whom he reigns. But nations who are enslaved at heart cannot be freed by mere changes of masters or of institutions; and so long as the fatal delusion prevails, that liberty solely depends upon, and consists in government, so

long will such changes, no matter at what cost they be effected, have as little practical and lasting result as the shifting figures in a phantasmagoria '।৩৩ একটি শোষণভিত্তিক সমাজে এই আত্মশক্তির তত্বপ্রচার যে আসলে স্থিতাবস্থা বজায় রাখারই একটি কৌশল যার মূল উদ্দেশ্য হলো শাসকশ্রেণিকে তার শোষণ অব্যাহত রাখার নিরঙ্কু শ সুযোগ করে দেওয়া, একথাও বেশ স্পষ্টভাবেই ফু টে উঠেছে Smiles -এর বক্তব্যের মধ্যে thus we come to exhibit what has so long been the marvel of foreigners- a healthy activity of individual freedom and yet a collective obedience to established authority।৩৪ মালিকদের জন্যে ‘individual freedom’ অর্থাৎ সবরকমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত অবাধ মুনাফাবাজি ও শ্রমিক শোষণের স্বাধীনতা, আর শ্রমিক ও সাধারণ মানুষদের জন্যে ‘obedience to established authority’, অর্থাৎ 'যথা নিযুক্তোহষ্মি তথা করোমি'শোষণের শক্তির কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ-এই হলো বুর্জোয়া আত্মশক্তি তত্বের থলির আসল বেড়াল। রাজা -প্রজার মধ্যে কলহ প্রশমিত করার উপায় হিসেবে রবীন্দ্রনাথ প্রায় সারাজীবন ধরেই এই আত্মশক্তির বাণী প্রচার করে গেছেন, বিশেষত যখনই বিদেশি ঔপনিবেশিক ও দেশি সামন্ততান্ত্রিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ভারতের মানুষের ঘৃণা ও ক্ষোভ সংঘবদ্ধ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে একটা বিস্ফোরক স্তরে পৌঁছেছে। প্রবন্ধের পর প্রবন্ধে আত্মশক্তিচর্চার ডাক দেওয়া, ঔপনিবেশিক -শাসন -বিরোধী জাতীয় আন্দোলনকে পাশ্চাত্য দেশের পররাজ্যগ্রাসী সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ বা chauvinism -এর সঙ্গে গুলিয়ে দেওয়া, আবার তারই সঙ্গে পূর্ব -পশ্চিমের সহযোগিতা বা বিশ্বমানবতার তত্ব গড়ে তোলা, এবং এ সবের সঙ্গে সঙ্গে নাটকের মধ্যে স্বৈরাচারী রাজার চরিত্রে বা রাজতন্ত্রে প্রেম, প্রাণ ও আত্মত্যাগের আদর্শ আরোপ করা-এই সব কাজগুলিই রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন দীর্ঘকাল ধরে, ইংরেজদের ভালোবেসে নয়, বিদেশি শাসনের সুরক্ষিত কাঠামোর মধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শোষণকে অবিঘ্নিত রাখার কেন্দ্রীয় শ্রেণি -উদ্বেগ থেকে। সতেরো ক্ষু দিরামের ফাঁসি হয়েছিল ১৯০৮ সালের ১১ অগাস্ট তারিখে। ঠিক এই সময়েই রবীন্দ্রনাথের মাথায় এসেছিল শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের শতাধিক ছাত্রের প্রমোদবিধানের জন্যে শারদোৎসব আর রূপকনাটক লেখার চিন্তা। প্রমোদটা ছিল

উপলক্ষ, লক্ষ্য ছিল প্রমোদের মাধ্যমে কিছু আধ্যাত্মিক -রাজনৈতিক শিক্ষাদান করা। চিন্তাটি কাজ করছিল ১৯০৮ সালের মে -জুন মাস থেকেই যখন তিনি প্রায়শ্চিত্ত নাটক লিখেছিলেন ক্ষু দিরাম ও প্রফু ল্ল চাকীর কেনেডি -হত্যার পর আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হওয়ার সময়। প্রভাতকু মার রবীন্দ্রনাথের রূপকনাটকগুলির প্রেরণা দেখতে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ‘education through play’ ভাবনার মধ্যে। এই শিক্ষার জন্যেই সম্ভবত এই সময়ে লেখা সব রাজার পালাতেই রাজা (বা রাজপুত্র) অর্থাৎ শাসকের মধ্যে ত্যাগ, মনুষ্যত্ব, প্রাণ এমনকী দেবত্ব আরোপের চেষ্টা এত স্পষ্ট। ১৯০৮ সালের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে অত্যাচারী শোষক রাজার প্রতি মানুষের ঘৃণা যখন একটা চরম অবস্থায় পৌঁছেছে, তখন রাজার চরিত্রে মহিমা আরোপ করে তার প্রতি প্রজাদের মায়া -মমতার আবেগ সৃষ্টি করার চেষ্টা শুধু শান্তিনিকেতনের প্রমোদচিন্তা থেকেই আসেনি নিশ্চয়ই। প্রায়শ্চিত্ত নাটকে রাজা অত্যাচারী, কিন্তু তার মুখেও শেষপর্যন্ত ত্যাগের আদর্শের বাণী দেওয়া হয়েছে 'তোমার ওই রাস্তাই ভালো-আমার এই রাজ্যটা কিছু না।' রাজা যখন তার রাজত্বকে তু চ্ছজ্ঞান করেছে তখন তার ধনঞ্জয় বৈরাগীর মতো রাজদ্রোহীদের কোনো প্রয়োজন নেই সমাজে, তারা সানন্দে কাশীতে নির্বাসনে যেতে পারে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে 'বাঁচান বাঁচি মারে মরি, বল ভাই ধন্য হরি।' শ্রীহরি এবং তাঁর পার্থিব দূত রাজা যখন প্রজাদের বাঁচামরার নিয়ন্তা, তখন আর প্রজাবিদ্রোহের কোনো সংগত কারণ থাকতে পারে না। ধনঞ্জয় তাই আর কোনোদিনই কাশী থেকে ফিরবে না এই আশ্বাসও রবীন্দ্রনাথ পেতে চেয়েছেন নাটকের শেষ গানটিতে :: 'আমি ফিরব না রে ফিরব না আর ফিরব না রে।' প্রায়শ্চিত্ত নাটক থেকে রবীন্দ্রনাথ আর একটি ধারণাও স্পষ্ট করতে শুরু করেন আশ্রমিকদের কাছে। সেটি হলো-রাজা অত্যাচারী হতেও পারে, সেক্ষেত্রে Prince of Wales বা যুবরাজ হবে দয়ালু, ভাবুক, কবিপ্রাণ ও আত্মত্যাগী, রাজা অত্যাচারী হলেও যাতে রাজতন্ত্রের প্রতি প্রজাদের মনে কোনো বিদ্বেষভাব না জাগে। আর রাজা যদি নিজেই আত্মত্যাগী হয়ে যায় তখন ত্যাগী যুবরাজের আর দরকার হয় না, সে উদয়াদিত্যের মতো ধনঞ্জয় বৈরাগীর সঙ্গে কাশী চলে যেতে পারে, মাধবপুরের প্রজাদের ভাগ্য হরির ওপর ছেড়ে দিয়ে। শারদোৎসব নাটকে নিজেই সন্ন্যাসী, সমস্ত প্রজাদের দুঃখ দারিদ্র্য অত্যাচার থেকে বাঁচানোর জন্যে আকু ল হয়ে আছে। প্রজারা মুক্তকণ্ঠে বড়ো -ইংরেজ বিজয়াদিত্যের জয়গান গেয়েছে। শারদোৎসব লেখা শেষ হয়েছিল ১৩১৫ সালের ৭ ভাদ্র তারিখে, অর্থাৎ ১৯০৮ সালের অগাস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে, ক্ষু দিরামের ফাঁসির বারো -তেরো দিন পরে। সময়টি লক্ষ করার মতো। যখন বাংলাদেশের অখ্যাত কোনো কবি আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে গাইছিলেন 'একবার বিদায় দাও মা ঘুরে আসি', তখন রবীন্দ্রনাথ লিখছিলেন 'আমরা

বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ', 'অমলধবল পালে লেগেছে'। দুটি গানই লেখা হয়েছিল ৩ ভাদ্র (১৩১৫) তারিখে, ক্ষু দিরামের ফাঁসির মাত্র ন -দিন পরে। মাসখানেক পরে রবীন্দ্রনাথ রিহার্সাল দিয়ে নাটকটির অভিনয়ও করিয়েছিলেন পুজোর ছুটির আগে, আশ্রমিকদের প্রমোদবিধানের জন্যে। রাজা নাটকে রাজা আড়ালে থাকে বলেই তার মহিমা আমরা বুঝতে পারি না। ইন্দ্রিয়ের, প্রবৃত্তির, অবিশ্বাসের, ক্রোধের দৃষ্টি দিয়ে দেখলে রাজাকে কু ৎসিত কু রূপ মনে হয়, কিন্তু রাজা আসলে মোটেই খারাপ নয়-একথা কবিপ্রাণ ভক্তিমার্গী সুরঙ্গমা বারবার বলে আসছে, কিন্তু সুদর্শনা তার জড়চেতনা ও অবিদ্যার মোহে সেটা বুঝছে না, বুঝবে নাটকের শেষে অন্ধকারের রাজার কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে 'প্রভু ,...আমি তোমার চরণের দাসী, আমাকে সেবার অধিকার দাও।' এই প্রায় -আধ্যাত্মিক নাটকেও রাজভাবনা জড়িয়ে রাখার সুবিধে এই যে আধ্যাত্মিক রাজার জন্যে মনে যদি একবার আত্মনিবেদন প্রেম ভক্তি ও বিশ্বাসের মনোভাব জাগে, ভগবানের দূত পার্থিব রাজার ক্ষেত্রে সেই আত্মসমর্পণের অভ্যেস রাজা -প্রজার সম্পর্ককেও নিশ্চিন্তভাবে প্রভাবিত করবে। গ্রিক রাজনীতিবিদ Isocrates ব্যাপারটি চমৎকার বুঝেছিলেন 'সাধারণ মানুষের পক্ষে এভাবে মাথা নোয়াতে শেখাটা রীতিমতো কার্যকরী, কেননা মাথা নোয়াতে শেখবার অভ্যাসটা একটু পোক্ত হলে শাসকের পায়েও তাদের পক্ষে মাথা নোয়াবার প্রবণতা থেকে যাবে; মাথা তু লে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাটাই সুদূর পরাহত হবে।'৩৫ অচলায়তন নাটকে রাজা নেই, তবে কর্মচঞ্চল শোনপাংশুরা স্থবির দেশের অচলায়তন ভেঙেছে দর্ভকদের সাহায্যে। কিন্তু ভাঙার পর নতু ন সমাজ গড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ দর্ভকদের কোনো স্থান দেননি নতু ন সমাজের ভেতরে। সেখানে শুধু দুটি দল থাকবেশোনপাংশুদের আর শোনপাংশুদের সহযোগী, কিছুটা আলোকপ্রাপ্ত, একজটা দেবীর (monotheism?) সঙ্গে হাত মেলানো প্রাণশক্তির প্রতীক পঞ্চকের। রক্ষণশীল স্থবির সমাজের তন্ত্রমন্ত্রসর্বস্ব মহাপঞ্চককেও যথেষ্ট শ্রদ্ধা দেখানো হবে 'শাস্তি দেবে! ওকে স্পর্শ করতেও পারবে না। ও আজ যেখানে বসেছে সেখানে তোমাদের তলোয়ার পৌঁছয় না।' মহাপঞ্চকের আধ্যাত্মিক সাধনার সঙ্গে শোনপাংশু বা ফ্যাকাশে -লাল -চামড়া ম্লেচ্ছদের কর্মচঞ্চলতাকে, অর্থাৎ ভারতীয় স্থিতির সঙ্গে ইংরেজদের গতিকে মেলানো হবে। দাদাঠাকু র/গুরু/ভগবানের দূতের এ এক আশ্চর্য লীলা! ম্লেচ্ছ শোনপাংশুরা অচলায়তনের প্রাচীর ভাঙল, কিন্তু স্থবির সামন্ততন্ত্রকে ধ্বংস করল না, সমাজের নিচু তলার মানুষ দর্ভকদেরও কোনো সামাজিক অধিকার দিল না। গুরু যে কাজটি করল সেটি হলো ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে উপনিবেশবাদের গাঁটছড়া বাঁধা, বিদেশি অর্থনৈতিক -রাজনৈতিক শাসন ও শোষণের সঙ্গে দেশি আধ্যাত্মিক শোষণের সমন্বয়

সাধন, দর্ভকদের সমাজের প্রাচীরের বাইরে রাখার জন্যে যে সমন্বয় বা কোলাবোরেশনের একান্ত প্রয়োজন 'এবার আর লাল নয়, এবার একেবারে শুভ্র। নতু ন সৌধের সাদা ভিতকে আকাশের আলোর মধ্যে অভ্রভেদী করে দাঁড় করাও। মেলো তোমরা দুইদলে, লাগো তোমাদের কাজে।' 'দুই দলে' কথাটি বেশ লক্ষ করার মতো। দাদাঠাকু র যিনি সনাতনী হিন্দুর গুরুজি যিনি ম্লেচ্ছ শোনপাংশুদের প্রেমের ঠাকু র অর্থাৎ যিশু, তিনি যে দর্ভকদেরও গোঁসাই সেকথাটি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে শুধু দুটি দলের কথাই মনে রাখলেন নতু ন সমাজে ব্যবস্থা -গড়ার সময়। পরে, অচলায়তন নাটকের এই ব্যাপারটি রবীন্দ্রনাথকে একটু অস্বস্তিতে ফেলেছিল মনে হয়। তাই, ১৯১৭ সালে নাটকটিকে 'গুরু' -তে রূপান্তরিত করার সময় এই 'মেলো তোমরা দুই দলে' সংলাপটি বাদ দিয়েছিলেন এবং নাটকের শেষে যূণকদের (যবন) সঙ্গে দর্ভকদের গলা মিলিয়ে (ভেঙেছো দুয়ার এসেছো জোতির্ময়) Colonialism ও Feudalism -এর গাঁটছাড়ার মধ্যে দর্ভকদের সমর্থন ও সহযোগিতার সূত্রটি যোগ করে দিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনের প্রমোদভাবনায় দাদাঠাকু র অর্থাৎ ভগবানের দূতের এই মধ্যস্বত্বভোগী রাজনীতি দেখে অবাক হবার কিছু নেই; ভগবান কখনো তার সৃষ্টিকর্তার রাজনীতির ওপরে উঠতে পারে না। ডাকঘর নিতান্তই একটি fin de siecle, অবক্ষয়ী, শোপেনহাওয়ারি নির্বাণ -চিন্তার নাটক, যে চিন্তার ভালো নাম আধ্যাত্মিক মুক্তি- ‘Deliverance through death '। এ নাটকেও কিন্তু দু'রকমের রাজচিন্তা আছে-মূর্খ, শাস্ত্র আওড়ানো 'কবিরাজ', আর আসল রাজা ভগবানের দূত 'রাজকবিরাজ', যে প্রকৃ ত মুক্তি অর্থাৎ এই পার্থিব জড়জগতের পীড়ন থেকে মুক্তির খবর দিতে পারে। এ নাটকের আসল তত্ব হলো-এ মায়ার সংসার থেকে যত তাড়াতাড়ি মুক্তি পাওয়া যায় ততই মঙ্গল। এই মায়াবাদের শিক্ষা দেবার প্রয়োজনও রবীন্দ্রনাথ বোধ করেছিলেন শান্তিনিকেতনের বালকদের প্রমোদবিধানের সময়। পার্থিব জগৎ -ই যেখানে মায়া ও অর্থহীন, সেখানে রাজদ্রোহ ও রাজনীতির মতো জড়চিন্তা যে কত বড়ো অবিদ্যা তা সহজেই বোঝা যায়। ১৯০৮ সালে ক্ষু দিরামের ফাঁসির পর থেকে রবীন্দ্রনাথ শুধু ঋতু উৎসব করাই শুরু করেননি, তার সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন আশ্রমের ছাত্রদের অধ্যাত্মবাদের শিক্ষাও দিতে শুরু করেছিলেন ১৩১৫ সালের অঘ্রান মাস থেকে, যেগুলি 'শান্তিনিকেতনের উপদেশমালা' হিসেবে পরিচিত। এইরকম একটি রচনা 'বর্তমান যুগ' (পৌষ, ১৩১৬), যেটি পড়লে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী ধরনের উপদেশ দিচ্ছিলেন আশ্রমিকদের আজ আমরা বাহির হতে দেখছি চারিদিকে একটা তু মুল আন্দোলন উপস্থিত, যাকে আমরা পলিটিকস (Politics) বলি। তাকে যতো বড়ো করেই দেখি না কেন, সে নিতান্তই বাহিরের জিনিস। আমাদের আত্মাকে কিছুতে যদি জাগরিত করছে সত্য

হয়, তবে তা ধর্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ধর্মের মূল শক্তিটি প্রচ্ছন্ন থেকে কাজ করছে বলেই আমাদের চোখে ধরা পড়ে না; পলিটিকসের চাঞ্চল্যই আমাদের সমস্ত চিত্তকে আকর্ষণ করছে। আমরা উপরকার তরঙ্গটাকেই দেখে থাকি, ভিতরকার স্রোতটাকে দেখি না। কিন্তু বস্তুত ভগবান যে মানবসমাজকে ধর্মের ভিতর দিয়ে একটা মস্ত নাড়া দিয়েছেন এই তো বিংশ শতাব্দীর বার্তা। এই ধর্মীয় revivalism -এর শিক্ষাই রবীন্দ্রনাথ আশ্রমিকদের দিয়ে আসছিলেন তাঁর শান্তিনিকেতন উপদেশমালার মধ্যে, যার জের চলছে ডাকঘর নাটকেও 'চু প করো অবিশ্বাসী। কথা কয়ো না।' ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ বিদেশে, ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার, ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে বিশ্বযুদ্ধ, আর তারই সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের প্রস্তুতি। ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতে অগ্নিগর্ভ অবস্থা। মার্চ মাসেই রবীন্দ্রনাথ বসন্তোৎসবের জন্যে ফাল্গুনী নাটক লিখলেন। নাটকের মধ্যে কোনো রাজা নেই, কিন্তু পরে যোগ করা অনাবশ্যক রকমের দীর্ঘ সূচনাতে একজন রাজা আনলেন রবীন্দ্রনাথ, দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের কথা শোনার সময় নেই যে রাজার, নিজের আসন্ন বার্ধক্যচিন্তায় তিনি এতই বিমর্ষ ও বিচলিত। কিন্তু 'কবি' সেই রাজার মধ্যেও প্রাণ সঞ্চার করবে, যাতে মানুষের কান্না শুনে রাজার প্রাণ দুলে ওঠে। রাজার প্রাণ শেষ পর্যন্ত দুলেছে, তিনি মন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছেন যাতে প্রজাদের অন্ন দিয়ে বিদায় করা হয়, সৈন্য দিয়ে নয়। রাজার হৃদয় পরিবর্তন করতে পেরেছে 'কবি'। ঠিক সেই সময় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার সঙ্গে জড়িত বিপ্লবীরা হয় জেলে, না হয় তাদের ধরার জন্যে ব্রিটিশ সরকার সারা উত্তর ভারত তোলপাড় করছে। শুধু ২০ ফেব্রুয়ারি আর ১৩ মার্চের মধ্যে ৮৯৩ জনকে শিখ বিপ্লবী অন্তরীণ বা নজরবন্দি। ২০ মার্চ ছোটোলাট কারমাইকেলকে রবীন্দ্রনাথ সংবর্ধনা জানাচ্ছেন শান্তিনিকেতনে। প্রভাতকু মার বলছেন কবির আন্তর্জাতিক সম্মানলাভের পর হইতে স্থানীয় সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে তাঁহার বিদ্যালয় সম্বন্ধে কৌতূ হল দেখা দিল। এন্ড্রুজ ও পিয়ার্সনের ন্যায় উচ্চশিক্ষিত দুইজন ইংরেজ আশ্রমের কাজে যোগদান করায় রাজপুরুষেরা বুঝিলেন যে কবির বিদ্যালয়টি কোনো প্রকার উগ্র রাজনীতি চর্চার কেন্দ্র নহে।৩৬ এরপর থেকে ছোটোলাটেরা শান্তিনিকেতনে আপ্যায়িত হবেন প্রায় প্রত্যেক বছর, রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়। ছোটোলাটকে সংবর্ধনা জানানোর কয়েকদিন পরেই শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব হলো, ফাল্গুনী নাটকের অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ সাজলেন অন্ধ বাউল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লিখতে শুরু করলেন ঘরে বাইরে উপন্যাস। স্বদেশি আন্দোলনের পটভূ মিতে লেখা এই উপন্যাসের সন্দীপ বিপ্লবী দলের নেতা-চোর, ভণ্ড, মিথ্যাবাদী, স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক, লম্পট, পরস্ত্রীকাতর; কিন্তু স্বদেশি -আন্দোলন -বিরোধী ইংরেজি আদব -কায়দা -ভক্ত নিখিলেশ ভাবুক, শান্ত, চরিত্রবান, বিবেচক, বহুভাষী, প্রজাবৎসল, দেশপ্রেমিক, ক্ষমাশীল ও আত্মত্যাগী। ১৯০৮ সালের পুরোনো স্বদেশি আন্দোলন ও সশস্ত্র আন্দোলন -বিরোধী আক্রোশ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ১৯১৫ সালের সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিবেশে বিপ্লব ও বিপ্লবীদের কু ৎসা শুরু করলেন সবুজপত্র পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে (বৈশাখ -ফাল্গুন, ১৩২২)। চোখের সামনে গদর পার্টির বীর বিপ্লবীদের সাহস, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত দেখেও, বাঘা যতীনের মতো বিপ্লবী যোদ্ধাদের অসমসাহসিক লড়াই ও মৃত্যুবরণ (১০ সেপ্টেম্বর, ১৯১৫) দেখেও, সন্দীপের মতো একটি কাল্পনিক জানোয়ারকে বিপ্লবীদের নেতা হিসেবে চিত্রিত করলেন স্পষ্টতই এই প্রচারমূলক উপন্যাসটির মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ সন্দীপের মধ্যে দিয়ে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে যতগুলি অভিযোগ এনেছেন সেযুগের কোনো কু খ্যাত দারোগা বা পাব্লিক প্রসিকিউটারও একজন বিপ্লবীর বিরুদ্ধে এতগুলি কাল্পনিক অভিযোগ আনতে পারেনি। ব্রিটিশ সরকার যদি লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা চলার সময় ঘরে বাইরে উপন্যাসের একটি কপি বিপ্লবীদের কার্যকলাপ সম্পর্কে ভারতের এবং পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ কবির সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে পেশ করত, তাহলে সব অভিযুক্ত বিপ্লবীদের ফাঁসি হয়ে গেলেও ব্রিটিশ শাসকদের অবিচারের বিরুদ্ধে একটি কথা বলারও মুখ আমাদের থাকত না। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো পরাধীন দেশের শ্রেষ্ঠ কবির হাতে সে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এমন অন্যায় অশ্লীল অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়নি। ক্ষু দিরাম, প্রফু ল্ল চাকী বা বাঘা যতীনদের রাজনৈতিক চিন্তায় বা বৈপ্লবিক কর্মপদ্ধতিতে হয়তো ভু ল ছিল, কিন্তু তাঁরা সন্দীপের মতো ভণ্ড, জোচ্চোর বা লম্পট ছিলেন না। ভূ পেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৯৪৯, পৃ. ৮২ -৮৩) বইয়ে সন্দীপ সম্পর্কে বলেছেন 'আমি অন্তত এ -প্রকার বিপ্লবী বাংলার ভিতর দেখি নাই।' যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া যায় বিপ্লবীদের মধ্যে সন্দীপের মতো চরিত্রের সন্ধান পাওয়া সম্ভব ছিল, সেই বিরল ব্যক্তিটিকে খুঁজে বের করে সর্বসমক্ষে হাজির করার দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথ কেন গ্রহণ করেছিলেন, তার ব্যাখা পাওয়া খুব সহজ নয়। ঘরে বাইরে উপন্যাসে বিপ্লবী নেতৃ ত্বকে ছোটো করে কর্মী অমূল্য ও জমিদার নিখিলেশকে বড়ো করে দেখানোর কৌশলটিও এই প্রসঙ্গে লক্ষ করার মতো। ভারতের বিদ্রোহী জনমানস থেকে রবীন্দ্রনাথকে আরও বিচ্ছিন্ন করার জন্যে ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁকে 'স্যার' উপাধি দিল ১৯১৫ সালেই, ঘরে বাইরে উপন্যাস সবুজপত্র -এ ছাপা শুরু হওয়ার সময়েই, ঠিক যে উদ্দেশ্য নিয়ে আরেকজন পরাধীন দেশের কবি

ইয়েটসকেও নাইটহুড দিতে চাইল ওই ১৯১৫ সালেই, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ -বিরোধী আইরিশ স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে ইয়েটস নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন বলে। বিপ্লববিরোধী হয়েও ইয়েটস বিদেশি শাসকদের হাত থেকে এই মোসাহেবি মুকু ট নিতে অস্বীকার করলেন, কিন্তু তাঁর বন্ধু রবীন্দ্রনাথ সে মুকু ট মাথায় পরলেন। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনায় রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড ছাড়ার কথা আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখব, তবে তার সঙ্গে এটাও বোধ হয় মনে রাখা দরকার কোন পরিবেশে অত্যাচারী বিদেশি শাসকদের হাত থেকে তিনি এই খেতাবটি গ্রহণ করেছিলেন। যে উপঢৌকন নেওয়াটাই যথেষ্ট অসম্মানজনক, সে উপাধি নেওয়ার চার বছর পরে ছাড়ার ঘটনাটিকে খুব একটা স্মরণীয় ও শ্রদ্ধেয় ঘটনা হিসেবে দেখার প্রয়োজন আছে কিনা সেটাও ভেবে দেখা দরকার। রবীন্দ্রনাথ পরে বুঝতে পেরেছিলেন কত শহিদের নীরব অভিশাপ মিশে আছে ওই ঘৃণিত মুকু টের মধ্যে, যেটি খুলে ফেলার সুযোগ এনে দিয়েছিল জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা। এই উপাধিত্যাগের ব্যাপারে ১৯১৬ সালে আমেরিকা ভ্রমণের সময় স্যানফ্রান্সিসকোতে গদর পার্টির সভ্যেরা তাঁকে হত্যা করবে এই গুজবের কোনো অস্বস্তিকর প্রভাব কাজ করেছিল কিনা ঠিক বলা যায় না, তবে গদর পার্টি থেকে এই অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে 'স্যার' উপাধি গ্রহণ করে রবীন্দ্রনাথ বিদেশি শাসক ও শোষকদের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছেন, এবং রবীন্দ্রজীবনীকার কৃ ষ্ণ কৃ পালানি বলেছেন ‘as the tour progressed, the poet was increasingly restless and, hurt and mortified by the san Francisco episode '।৩৭ উনিশ আমরা শুনেছি ১৯২০ -২১ সালে আমেরিকায় গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে অন্তঃসারশূন্য যন্ত্রসর্বস্ব সমাজ দেখতে পান সেই অভিজ্ঞতার ফসলই নাকি মুক্তধারা ও রক্তকরবী নাটক। এটি নিতান্তই গুজব। আমেরিকায় গিয়ে সেবার রবীন্দ্রনাথ খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন এ -কথা সত্যি, তবে আমেরিকার যন্ত্রসভ্যতা দেখে নয়, বিশ্বভারতীর জন্যে পাঁচ মিলিয়ন ডলার দান সংগ্রহ করার কল্পনা ধূলিসাৎ হওয়ার জন্যে, যে ঘটনাটিকে তাঁর বক্তৃ তার ম্যানেজার James Pond বলেছেন ‘a heart breaking tragedy’ এবং তাঁর সঙ্গে আমেরিকানদের অত্যন্ত রূঢ় ব্যবহারের জন্যে। রবীন্দ্রনাথ শ্রীমতী কার্নেগির সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রার্থনা করা সত্বেও, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে রাজি হননি শ্রীমতী কার্নেগি। আমেরিকায় থাকার সময় অবশ্য যে ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ সবথেকে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন সেটি হলো এ্যান্ড্রুজের চিঠি থেকে গান্ধির অসহযোগ আন্দোলনের খবর পেয়ে। প্রভাতকু মার জানাচ্ছেন 'যে শান্তিনিকেতনকে কবি এতাবৎকাল রাজনীতির উত্তেজনা হইতে দূরে রাখিয়া

আসিয়াছিলেন, আজ সেখানে অসহযোগ লইয়া সকলেই উত্তেজিত।' আমেরিকা থেকে রবীন্দ্রনাথ এ্যান্ড্রুজকে লিখলেন Keep Santiniketan away from the turmoils of politics. We must not forget that our mission is not political. When I have my politics, I do not belong to Santiniketan।৩৮ শান্তিনিকেতনে ইংরেজ -শাসনবিরোধী রাজনীতির চর্চা হচ্ছে এই অকল্পনীয় ও মর্মান্তিক ঘটনার সংবাদই সবথেকে বেশি কষ্ট দিচ্ছিল রবীন্দ্রনাথকে। দেশে ফিরে গিয়ে তাঁর সমন্বয়ী, সহযোগী চিন্তাভাবনার সঙ্গে শান্তিনিকেতনের রাজনৈতিক পরিবেশ মিলবে কেমন করে এ দুর্ভাবনাও তাঁকে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন করেছিল ‘I am afraid I shall be rejected by my own people when I go back to India. My solitary cell is awaiting me in my motherland’ (৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯২১)।৩৯ চিঠির পর চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ এ্যান্ড্রুজকে লিখছেন অসহযোগ, স্বাধীনতা, জাতীয়তা, দেশপ্রেম-এসব কত অন্যায়, বিশ্বমানের মিলনের পক্ষে কতবড়ো বাধা এইসব উপদ্রব 'আমাদের সংগ্রাম আত্মার-মানুষের মুক্তির সংগ্রাম, কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা নহে। মানুষ তাহার চারিপার্শ্বে জাতিপ্রেমের অহমিকা -জাল বুনিয়া আপনি বন্দী। আত্মার সেই বন্ধনদশা হইতে তাহাকে মুক্তিদান করাই ভারতের আদর্শ। তাহাই মানুষের স্ব -রাজ।'৪০ Samuel Smiles -এর Self Help -এর স্পষ্ট প্রতিধ্বনি রয়েছে এই সব চিঠিতে-মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব, সেই মনুষ্যত্ব লাভই স্বরাজ, ইংরেজ রাজত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করলেই স্বরাজ পাওয়া যায় না। 'নেশন' শব্দটাই বাজে, ওরকম কোনো শব্দ আমাদের ভাষাতেই নেই, যত সব বিদেশি ধার -করা শব্দ, ভারতীয় সমাজ ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি কিছুতেই অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারছেন না, কারণ তিনি যা চান তা অসহযোগ নয়, সহযোগ ও ঐক্য 'আমাদের একমাত্র প্রার্থনা, ভারত নিখিল মানবের মিলনের জন্য দণ্ডায়মান হউক।'৪১ অসহযোগ মানেই ‘spiritual suicide '। বিদেশ থেকে এ্যান্ড্রুজকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেদনার যে কথাগুলি অজস্র পত্রধারার মাধ্যমে জানিয়েছিলেন এই হচ্ছে সেগুলির মূল কথা। দেশে ফেরার একমাসের মধ্যে এইসব কথা আবার রবীন্দ্রনাথ বিস্তারিতভাবে বললেন 'শিক্ষার মিলন' প্রবন্ধে ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটে (১৫ আগস্ট ১৯২১), পরে অ্যালফ্রেড থিয়েটারে (১৮ আগস্ট ১৯২১) 'স্বাজাত্যের অহমিকা থেকে মুক্তিদান করার শিক্ষাই আজকের দিনের প্রধান শিক্ষা।' তার সঙ্গে 'সত্যের আহ্বান' প্রবন্ধে বললেন ইংরেজ শাসন মায়া, মায়া নিয়ে এত উত্তেজনার দরকার নেই, গান্ধির অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া

দেওয়ার অর্থ হলো বিচারবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে দৈববাণীতে সাড়া দেওয়া। অসহযোগ আন্দোলন তখন তু ঙ্গে। তাই রবীন্দ্রনাথও শুরু করলেন 'বর্ষামঙ্গল' ঋতু উৎসব জোড়াসাঁকোতে। সরলা দেবী আপত্তি জানালেন 'দেশে যখন আগুন লেগেছে তখন বর্ষামঙ্গলের গান করা অকর্তব্য।'৪২ এই প্রতিবাদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ প্রমথ চৌধুরীকে একটি পত্রে যে কথাগুলি লিখেছিলেন (১৮ কার্তিক, ১৩২৮) সেগুলি রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনা ও নান্দনিক চিন্তার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে : মাঝে মাঝে প্রায়ই গান লিখি। যখন লিখি তখন মনে হয় স্বরাজ ব্যাপারটা এমন গুরুতর কিছু জিনিস নয়-মানুষের ইতিহাসে অনেক স্বরাজ বুদ্বুদের মতো উঠেছে আর ফেটে গেছে-কিন্তু যে গানগুলোকে দেখতে বুদ্বুদের মতো তারা আলোর বুদ্বুদ নক্ষত্রের মতই। সৃষ্টিকর্তার খেলনাগুলির সঙ্গে তাদের রঙের মিল আছে। সেইজন্যেই যখন তারা গড়ে উঠতে থাকে তখন কর্তব্য ভু লে যাই। অথচ দেশের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে হুকু ম আসচে যে, 'সময় খারাপ অতএব বাঁশি রাখো, লাঠি ধরো।' যদি তা করি তাহলে কর্তারা খুসি হবেন, কিন্তু আমার এক বাঁশিওয়ালা মিতা আছেন কর্তাদের অনেক উপরে, তিনি আমাকে একেবারে বরখাস্ত করে দেবেন। আমি ভূ গোলের প্রতিমার পাণ্ডাদের যদি আজ মানতে বসি তাহলে আমার জাত যাবে।৪৩ অরবিন্দ পোদ্দার ১৮৯৪ সালে লেখা 'এবার ফিরাও মোরে' কবিতার সমাজচেতনার সঙ্গে এই চিঠির কথাগুলির তু লনা করে বলেছেন : '১৯২১ সালের রবীন্দ্রনাথ যেন অন্য এক চেতনায় আত্মমগ্ন এক মানুষ যিনি স্বদেশের সংগ্রামী গণ -বিস্ফোরণকে তু চ্ছতাচ্ছিল্য করছেন, স্বরাজের আদর্শকে ক্ষণবুদ্বুদ বলে বিদ্রূপ করছেন।'৪৪ যে 'বাঁশিওয়ালা মিতা'র নির্দেশে রবীন্দ্রনাথ কথাগুলি বলছেন তার রাজনৈতিক চরিত্রটি লক্ষ করার সময় তার বাঁশির আওয়াজে কলাকৈবল্যবাদের চড়া সুরটিও চিনে নেওয়া দরকার। ১৯২১ সালের জুলাই মাসে দেশে ফেরার পর থেকেই অসহযোগ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গান্ধির তীব্র বিরোধ ও বিতর্ক হয়। সেপ্টেম্বর মাসে দু'জনের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ ঘটল জোড়াসাঁকোর বিচিত্রাভবনে। গান্ধি অনেক বোঝালেন যাতে রবীন্দ্রনাথ অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে সহযোগিতা করেন, কিন্তু দু'জনের মতের মিল হলো না। একজন স্বরাজ বলতে কী বোঝেন কখনোই স্পষ্ট করে বলেন না, আর একজন স্পষ্টই বলেন স্বরাজ মানে দেশের স্বাধীনতা নয়, আত্মশক্তি ও আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন। আসলে দু'জনে একই পথের পথিক, তবু তাঁদের ঐক্য হলো না এই জন্যেই যে ব্রিটিশ শাসক ও দেশি জমিদারদের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর গণবিক্ষোভকে অহিংস ও নিরীহ রাখার জন্যে গান্ধি যে চেষ্টা বরাবরই করে চলেছেন, তাঁর সেই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার ওপর রবীন্দ্রনাথ ভরসা রাখতে

পারছিলেন না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন গান্ধি কর -বন্ধ আন্দোলনের যতই বিরোধিতা করুন এ -আন্দোলনকে তিনি রুখতে পারবেন না, এবং সেক্ষেত্রে ইংরেজ শাসনের সঙ্গে জমিদারি শাসনও বিপন্ন হবে। তিনমাস পরেই গুন্টু রের খাজনা -বন্ধ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হলো। ১৯২১ সালে ভারতের শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিক অসন্তোষ ও ধর্মঘটের হিসেবটাও মনে রাখা দরকার। সুমিত সরকার বলছেন ‘Labour did seem to be ‘running amok’ throughout 1921, with 396 Strikes involving 600351 workers and a loss of 6,994,426 workdays ।'৪৫ যদিও গান্ধি শিল্পে ধর্মঘটের ঘোর বিরোধিতা করছেন ‘In India we want no political strikes... We seek not to destroy capital or capitalists, but to regulate the relations between capital and labour, (‘The Lesson of Assam, ’ Young India 15 June 1921) । মার্চ মাসে জলন্ধরে ও হোসিয়ারপুরে কিষাণ সিং ও মোতা সিং -এর নেতৃ ত্বে খাজনা -বন্ধ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হচ্ছে। মে মাসে আসামের চা -বাগান থেকে ৮০০০ শ্রমিক গান্ধির আহ্বানের লোকশ্রুতিতে সাড়া দিয়ে আসাম ছেড়ে চলে আসার সময় তাঁদের ওপর গুর্খা পুলিশের আক্রমণের প্রতিবাদে সারা পূর্ববঙ্গ প্রতিরোধে উত্তাল। তিন মাস ধরে স্টিমার ধর্মঘট চলেছে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের নেতৃ ত্বে, প্রায় চার মাস ধরে রেল ধর্মঘট। প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত ভ্রমণ উপলক্ষে গণবিক্ষোভ উঠল চরমে, ১৭ নভেম্বর (১৯২১) সারা দেশে অভূ তপূর্ব উত্তেজনার মধ্যে হরতাল পালিত হলো, বিশেষত বোম্বাই ও কলকাতায়। ডিসেম্বরে বাংলাদেশের প্রায় সাতটি জেলা থেকে পুলিশ অসন্তোষের খবর আসে। দলে দলে মানুষ সত্যাগ্রহ করে জেল ভর্তি করে, শুধু কলকাতাতেই তাদের সংখ্যা ছিল তিন হাজার, যাদের মধ্যে চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবীও ছিলেন। এই ১৯২১ সালের শেষদিকে গান্ধির ওপর আস্থা হারিয়ে কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা সংগঠিত হবার চেষ্টা করছেন, মানবেন্দ্র রায় নলিনী গুপ্তকে পাঠাচ্ছেন মুজফফর আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তার আগেই বোম্বাইয়ে শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে ও তাঁর কিছু সহকর্মী গান্ধি সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মার্ক্সিস্ট চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। অসহযোগ আন্দোলনের এই পর্যায় সম্পর্কে সুমিত সরকার বলছেন : ‘Despite the breaks, however, developments in the fourth phase, between November 1921 and February 1922, very nearly brought the government to its kness '। ৪৬

ডিসেম্বর মাসে (১৯২১) ভাইসরয় রেডিং মন্টেগুকে টেলিগ্রাম করছেন বন্দিদের মুক্তি

দেওয়ার জন্যে। গান্ধি শেষ পর্যন্ত বাধ্য হচ্ছেন খাজনা -বন্ধ আন্দোলন শুরু করতে, যদিও বেশ ছোটো মাপে, বরদৌলিতে। সময় স্থির হলো ফেব্রুয়ারির (১৯২২) দ্বিতীয় সপ্তাহ। স্বদেশি যুগের আন্দোলনে, কম সময়ের জন্যে হলেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পুরোভাগে, ১৯২১ সালের বৃহত্তর অসহযোগ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ কোথাও নেই। গান্ধির সঙ্গে জোড়াসাঁকোর সাক্ষাতের পর রবীন্দ্রনাথ চলে যান শান্তিনিকেতনে। প্রভাতকু মার বলছেন 'তিনি বুঝিলেন দেশের লোকের মানসিক উত্তেজনা যেখানে আসিয়া গিয়াছে, সেখানে কবি -কণ্ঠ পৌঁছিবে না।' রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলন থেকে সরে এসে যেমন খেয়া, গীতাঞ্জলি -র গান, গোরা ও রূপকনাটক লিখেছিলেন, এবারও তেমনি আপনমনে শান্তিনিকেতনে শিশু ভোলানাথ -এর কবিতা লিখলেন। শিশু ভোলানাথ লেখার কারণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে (২৭ বৈশাখ, ১৩২৯) লিখেছিলেন 'এই কবিতা লেখবার একমাত্র তাগিদ ছিল বয়স্ক লোকদের দায়িত্ববোধের জীবনকে ক্ষণকালের জন্য মন থেকে সরিয়ে দেবার ইচ্ছায়।' তারই মধ্যে শারদোৎসব করলেন পুরোনো নাটকটিকে অদলবদল করে 'নূতন কিছু সৃষ্টির আবেগ নাই, তাই শারদোৎসবকে লইয়াই কাটাছাঁটা, জোড়াতালি দিয়া ঋণশোধ লিখিলেন।'৪৭ বালক ও শিক্ষকদের প্রমোদের জন্যে অভিনয়ও হলো ঋণশোধ নাটকের-ত্যাগীরাজার গল্পের। পুজোর ছুটিতে কোথাও গেলেন না। পৌষ উৎসব হলো, সাতই পৌষের ভাষণে স্বাজাত্যের অভিমানকে আর একবার নিন্দে করলেন। তারপরেই চলে গেলেন শিলাইদহ 'মন নির্জন বাস চাহিতেছে। সপ্তাহকাল নদীপথে কাটাইয়া পুনরায় আশ্রমে ফিরিয়া আসিলেন (২১ শে পৌষ, ১৩২৮)।... কয়েকদিনের মধ্যে একটি নাটক রচনায় প্রবৃত্ত হইলেন। ৪ঠা মাঘ, ১৩২৮ লিখিতেছেন 'আমি সমস্ত সপ্তাহ ধরে একটা নাটক লিখছিলুম-শেষ হয়ে গেছে তাই আজ ছুটি।...এর নাম পথ।' পরে ইহার নাম দেন 'মুক্তধারা'।৪৮ ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অর্থাৎ প্রস্তাবিত বরদৌলি সত্যাগ্রহের ঠিক এক মাস আগে লেখা মুক্তধারা নাটকের এই হলো প্রকৃ ত প্রেক্ষাপট, আমেরিকা -ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নয়। চোখের সামনে খাজনা -বন্ধের ডাক দেওয়া ধনঞ্জয় -গান্ধি ও দু'মাস আগে দেখা যুবরাজ (Prince of Wales) থাকতে আমেরিকা থেকে মুক্তধারা নাটকের রসদ সংগ্রহ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না রবীন্দ্রনাথের। শোষণ ও স্বৈরাচারের দায়িত্ব রাজার কাছ থেকে সরিয়ে আমলা বা bureaucracy -র ওপর চাপানোর কৌশল মুক্তধারা -তেও লক্ষ করার মতো। রাজা রণজিৎ ততটা অত্যাচারী নয়, আসল অত্যাচারী আমলা -টেকনোক্র্যাট ছোটো ইংরেজ বিভূ তি। যুবরাজ অভিজিৎ প্রেম, মানবতা, প্রজাবাৎসল্য ও ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ, রাজকু মার সঞ্জয়ও তাই। প্রজারা সবাই যুবরাজকে চায়। এই যুবরাজের আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়েই উপনিবেশ শিবতরাইয়ের মুক্তি ঘটেছে, খাজনা বন্ধ করার হুমকি দেওয়া প্রজাবিদ্রোহের নেতা ধনঞ্জয়

বৈরাগীর আন্দোলনের ফলে নয়। অচলায়তন -এ ইংরেজ শাসকদের বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ রক্তবর্ণ -টু পিপরা ম্লেচ্ছ শোনপাংশুদের অর্থাৎ ফ্যাকাশে -লাল -চামড়াদের এনেছিলেন; এখানে ইংরেজদের বোঝাতে পাহাড়ি উত্তরকূ টের বাসিন্দাদের এনেছেন। আসলে ঠিক উত্তরকূ ট নয়, উত্তর -পশ্চিম কূ ট। ধনঞ্জয় বৈরাগীকে প্রায়শ্চিত্ত নাটক থেকে মুক্তধারা -তে আনা হয়েছে, ঠিক যে উদ্দেশ্যে তাকে প্রায়শ্চিত্ত নাটকে আনা হয়েছিল-এ -কথা বোঝানোর জন্যে যে স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রের মধ্যে প্রাণ, হৃদয়, প্রেম ও মনুষত্ব্যর উদ্বোধন হয়ে গেলে রাজার সঙ্গে অসহযোগ বা রাজদ্রোহী আন্দোলনের আর কোনো সার্থকতা থাকে না। তেজী প্রজাবিদ্রোহের নেতা ধনঞ্জয় যেভাবে প্রায়শ্চিত্ত নাটকের শেষে সত্যিকারের বৈরাগী হয়ে কাশী চলে গেছে, মুক্তধারা নাটকে তেমনি যুবরাজ অভিজিতের মহিমান্বিত আত্মত্যাগ দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিদ্রোহী, খাজনা -বন্ধ করার হুমকি দেওয়া, ধনঞ্জয় -গান্ধিকে সম্পূর্ণ নিষ্প্রভ ও অপ্রয়োজনীয় করে দিয়েছেন নাটকের শেষে। তাই, 'যুবরাজকে কি আর পাব না?' গণেশের মুখে এই আক্ষেপ শুনে ধনঞ্জয় প্রায় বিদূষকের মতো আধ্যাত্মিক রসিকতা করে বলেছে 'চিরকালের মতো পেয়ে গেলি।'-যেন বিদেশি যুবরাজকে চিরকালের মতো পেয়ে যাওয়া বা ভালোবাসতে পারাটাই পরাধীন দেশের শোষিত মানুষের সবথেকে বড়ো প্রাপ্তি। চোদ্দো বছর আগে স্বদেশি অসহযোগ আন্দোলনের পটভূ মিতে লেখা প্রায়শ্চিত্ত নাটকে ধনঞ্জয়কে নিয়তির গান গাইতে হয়েছিল; ১৯২২ সালে গান্ধির অসহযোগ আন্দোলনের পটভূ মিতে লেখা মুক্তধারা নাটকে রবীন্দ্রনাথ ধনঞ্জয় বৈরাগীকে ফিরিয়ে আনলেন, যাতে Prince of Wales বা রাজতন্ত্র এবারেও তাকে নিষ্ক্রিয় ও অবান্তর করে দিতে পারে প্রজাবাৎসল্য ও আত্মত্যাগের মাহাত্ম্য দেখিয়ে। কু ড়ি রক্তকরবী লেখা শুরু হয়েছিল ১৯২৩ সালের মে মাসের শেষ দিকে। ১৯২২ সালের ১৩ জানুয়ারি মুক্তধারা লেখা শেষ করার পর থেকে রক্তকরবী লেখা শুরু করার সময় পর্যন্ত সময়টার একটু হিসেব নেওয়া যেতে পারে, যাতে আমরা বুঝতে পারি এই একবছরের একটু বেশি সময়ের মধ্যে স্বৈরাচারী রাজা ও বহু -সংগ্রহী রাবণদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনে ঠিক কতখানি ক্ষোভ ঘৃণা বা ধিক্কার জন্মেছিল। গান্ধি অসহযোগ ও কর -বন্ধ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন চৌরিচৌরার ঘটনার পর, ফেব্রুয়ারি (১৯২২) মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথম দিকে। ১২ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেস অধিবেশন থেকে ঘোষণা করা হলো জমিদারদের খাজনা বন্ধ করা কংগ্রেসের প্রস্তাবের পরিপন্থী, জমিদারদের আইনসম্মত অধিকারে কংগ্রেস আন্দোলনে হস্তক্ষেপ করবে না। ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে সারা ভারতের জমিদারদের মন খুশিতে ভরে উঠল। ১৭

ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ 'হাস্যরস' সম্পর্কে ভাষণ দিচ্ছেন শান্তিনিকেতনে, মলিয়েরের ৩০০ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে। দিন দশেক আগে আত্মশক্তি বা Self -Help -এর মাধ্যমে ভারতের গ্রামোন্নয়ন তত্বের বাস্তব রূপায়ণের কাজ শুরু হয়েছে শ্রীনিকেতনে, ইংরেজ এলমহার্স্টের নেতৃ ত্বে এবং তাঁর বান্ধবী ও ভাবী স্ত্রী অ্যামেরিকান ডরোথি স্ট্রেটের কাছ থেকে দান হিসেবে পাওয়া পঞ্চাশ হাজার টাকা (বার্ষিক কিস্তি) দিয়ে। মাটির উর্বরাশক্তি কীভাবে নষ্ট হয় বা কীভাবে সেটা ফিরিয়ে আনা যায় এলমহার্স্ট এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথকে জ্ঞান দিচ্ছেন এই সময়। মার্চের প্রথম সপ্তাহে রবীন্দ্রনাথ তাই লিখলেন 'মাটির ডাক' কবিতা :: যাই ফিরে যাই মাটির বুকে, যাই চলে যাই মুক্তি সুখে, ইঁটের শিকল দিই ফেলে দিই টু টে, আজ ধরণী আপন হাতে অন্ন দিলেন আমার পাতে ফল দিয়েছেন সাজিয়ে পত্রপুটে, গানেও বললেন একই কথা ওই দিনই (২৩ ফাল্গুন, ১৩২৮) : 'ফিরে চল মাটির টানে, যে -মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।' দিন চার পাঁচ পর গান্ধি গ্রেপ্তার হলেন (১০ মার্চ ১৯২২)। রবীন্দ্রনাথ গান লিখলেন:: 'ও মঞ্জরী, ও মঞ্জরী, আমের মঞ্জরী' ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন, ২৮ ফাল্গুন। তারপরেই চলে গেলেন শিলাইদহ, ফিরলেন এক মাস পরে, যথারীতি বর্ষশেষ ও নববর্ষ উৎসব করলেন। গান লিখলেন : 'ক্লান্ত বাঁশীর শেষ রাগিণী'। গ্রীষ্মের ছুটিতে কোথাও গেলেন না, শান্তিনিকেতনে বসে তাঁর বিখ্যাত গ্রীষ্মের গানগুলি লিখলেন। বর্ষা এসে গেল, ৭ অগাস্ট বর্ষামঙ্গল উৎসব করলেন শান্তিনিকেতনে। গত বছরের সরলা দেবীর আপত্তি ও প্রতিবাদের কথা মনে রেখে এবার আরো তিন জায়গায় বর্ষামঙ্গলের নাচগানের ব্যবস্থা করলেন, কলকাতায় রামমোহন লাইব্রেরি হলে বিশ্বভারতীর সদস্য ও বন্ধু দের জন্যে, সাধারণের জন্যে ম্যাডানের ভ্যারাইটি থিয়েটারে ও অ্যালফ্রেড থিয়েটারে। শরৎ আসছে, এবার কলকাতায় ত্যাগীরাজার পালা শারদোৎসব অভিনয়ের জন্যে ব্যস্ত হলেন, অর্থসংগ্রহের তাগিদও কিছুটা আছে। শান্তিনিকেতনে খুব হইচই; ছাত্রদের সঙ্গে রিহার্সাল দিচ্ছেন। প্রভাতকু মার বলছেন : 'তাঁহার কি আনন্দ।' কলকাতায় অভিনয়ের আগে একটু সাবধান হয়ে একটা কৈফিয়ত যোগ করলেন নাটকের আগে, রক্তকরবী -র প্রস্তাবনা বা নাট্যপরিচয়ের মতো। সে কৈফিয়তে নাটকের রাজনৈতিক বক্তব্যটি না বলে লিখলেন 'পালায় কাজের কথা নেই, সে -পালায় আছে ছুটির খুসি।' অভিনয় হলো কলকাতায় দু'দিন, যথারীতি রবীন্দ্রনাথ নিজে সাজলেন সন্ন্যাসীরাজা বিজয়াদিত্য। অভিনয়ের মধ্যেই খবর এল রবীন্দ্রনাথের বৃদ্ধ বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথের ছেলে ঠা

দ্বিপেন্দ্রনাথ মারা গেছেন। দিনু ঠাকু র সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলেন শান্তিনিকেতনে; রবীন্দ্রনাথ গেলেন দক্ষিণ ভারত ভ্রমণে। পুনায় রবীন্দ্রনাথ রইলেন লেডি থ্যাকারসের অতিথি হয়ে, অসহযোগ আন্দোলনের বিরোধিতা করে লেখা 'শিক্ষার মিলন' প্রবন্ধের বক্তব্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললেন বিভিন্ন সভায়। মহীশূরে হলেন ভাইস -চ্যান্সেলার ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের অতিথি, ব্যাঙ্গালোরে রামস্বামী আয়ারের। মাদ্রাজে বণিক -সংঘের দান গ্রহণ করে অক্টোবর মাসে পৌঁছোলেন সিংহলে, ডা. সিলভার অতিথি হলেন। তারপর এরনাকু লম, কোচিন; তাতাপুরমে বণিক -সংঘের কাছ থেকে কিছু টাকা পেলেন। তারপর মাদ্রাজ, আবার বোম্বাই, পারসিদের সভায় Indo -Iranians সম্পর্কে বক্তৃ তা করলেন, পারসি -সমাজ কবিকে উদারভাবে অর্থসাহায্য দিলেন। ডিসেম্বরে আমেদাবাদে অম্বালাল সরাভাইয়ের অতিথি ; সাবরমতী আশ্রমে গিয়ে আশ্রমিকদের রবীন্দ্রনাথ বোঝালেন, মানুষের দেহটাই প্রকৃ ত জীবন, মুরগির ছানা যেমন ডিম ভেঙে আলো আনে মানুষ তেমনি আলো আনতে পারে যদি স্বার্থের ডিম ভাঙতে পারে, জড় -জগতের চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারে। গান্ধি তখন জেলে, তাই এই সুযোগে রবীন্দ্রনাথ গান্ধির নিজের লোকজনদেরই অসহযোগের জড়চিন্তা থেকে মুক্ত হবার শিক্ষা দিয়ে এলেন। পৌষ উৎসবের আগে ফিরলেন শান্তিনিকেতনে। পৌষ উৎসবের পরেই এলেন ছোটোলাট লিটন তাঁর বাৎসরিক শান্তিনিকেতন পরিদর্শনে। প্রভাতকু মার বলছেন : 'একদল কর্মী লাটসাহেবকে আমন্ত্রণের বিরোধী এবং এমনকি কয়েকজন কবিকে জানাইয়া দিলেন যে তাঁহারা গভর্নর -অভ্যর্থনা সভায় উপস্থিত হইবেন না।... যে কয়জন তাঁহার সহিত সহযোগিতা করিতে চাহিলেন তাঁহাদের লইয়া সম্মানার্হ অতিথিকে আম্রকু ঞ্জে স্বাগত করিলেন। অতিথির প্রতি অসৌজন্য প্রকাশ কবির কৌলিক আভিজাত্যাদর্শের বিরোধী।'৪৯ বসন্ত আসছে 'কবির সাহিত্যসৃষ্ট এখন বড়ই মন্দা; একমাত্র গান লেখা ও গাওয়া ছাড়া আত্মপ্রকাশের সকল দ্বার যেন অবরুদ্ধ।' বনভূ মি, আম্রকু ঞ্জ, করবী, বেণুবন, মাধবী, শালবীথি, বকু ল, নদী, দখিন হাওয়া ইত্যাদি নিয়ে কিছু গান লিখে বসন্তোৎসব গীতিনাটিকা লিখলেন। ম্যাডান থিয়েটারে অভিনয় হলো ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে নজরুলও তখন জেলে বন্দি, রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে এই বকু ল -পারুল গানের ডালি উৎসর্গ করে আলিপুর জেলে পাঠিয়ে দিলেন। নাটক অভিনয় সেরেই রবীন্দ্রনাথ গেলেন উত্তর ভারত ভ্রমণে। প্রথমে কাশীতে রানু মুখার্জির বাবার অতিথি হলেন, লক্ষ্ণৌয়ে অতু লপ্রসাদ সেনের। বোম্বাইয়ে জাহাঙ্গির পেটিটের বাড়িতে একদিন থেকে আমেদাবাদে এসে অম্বালাল সরাভাইয়ের অতিথি হলেন। করাচিতে আতিথ্য গ্রহণ করলেন জামসেদ মেটার, করাচি ও হায়দ্রাবাদে সিন্ধি বণিকেরা

বেশ কিছু টাকা দিলেন। তারপরে পোরবন্দরে এসে শান্তিনিকেতনে ফিরে এলেন নববর্ষ উৎসবের আগে। 'রতনকু ঠি'র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলো, স্যার রতন টাটার কাছ থেকে ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথ পঁচিশ হাজার টাকার দান গ্রহণ করেছেন। ১৩ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ গেলেন শিলঙ পাহাড়ে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে। সেখানে শুরু করলেন যক্ষপুরী নাটক লেখা, যার নাম পরে দিলেন নন্দিনী, এবং আরও পরে রক্তকরবী। এই নাটক যখন লেখা হচ্ছে তখন (অক্টোবর, ১৯২৩) যুগল কিশোর বিড়লা রবীন্দ্রনাথের চীন ভ্রমণের ইচ্ছার কথা জানতে পেরে রবীন্দ্রনাথকে এগারো হাজার টাকা দিলেন তাঁর ও তাঁর সঙ্গীদের পাথেয় হিসেবে। পুজোর ছুটির শেষ দিকে কবি আবার গেলেন গুজরাট 'সেবার পোরবন্দর ছাড়া অন্যান্য দেশীয় রাজ্যে ঘোরা হয়নি। এবার রাজাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে মোটা টাকা পেলেন, তাই দিয়ে পত্তন হল নূতন কলাভবন বাড়ির।'৫০ এই পশ্চিম ভারত ভ্রমণের সময়েই শেষ হলো রক্তকরবী নাটক লেখা। মুক্তধারা লেখার পর এই একবছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে উত্তর পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন দেশীয় রাজা, বণিক -সংঘ ও অম্বালাল সরাভাই, রতন টাটা এবং যুগল কিশোর বিড়লার মতো ধনকু বেরদের আতিথ্য বা দান গ্রহণ করার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ যে অক্লান্ত ও অকু ণ্ঠ ব্যগ্রতা দেখিয়েছেন বা লিটনকে যে পরিবেশে শান্তিনিকেতনে আপ্যায়িত করেছেন, তাতে মনে হয় না যে রক্তকরবী নাটকের প্রস্তাবনায় বহু -সংগ্রহী রাবণদের সম্পর্কে তিনি যতটা বিরক্তি বা বিরূপতা দেখাচ্ছেন, রক্তকরবী নাটক লেখার সময় বা তার আগে এক বছর সময়ের মধ্যে স্বৈরাচারী শাসক বা আকর্ষণ -সভ্যতার ধর্ষকামী রাবণদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সত্যিই ততটা তিক্ত ছিল। তিন বছর আগে কার্নেগির স্ত্রী রবীন্দ্রনাথকে রাবণদের সম্পর্কে যতটাই বিক্ষু ব্ধ করুক না কেন, আমেরিকার রাবণকন্যা ও আরেক ধনকু বেরের বিধবা ডরোথি স্ট্রেট, লেডি থ্যাকারসে, অম্বালাল সরাভাই, রতন টাটা বা যুগল কিশোর বিড়লা সে ক্ষোভের অনেকটাই ভু লিয়ে দিতে পেরেছিলেন। ১৯২৩ সালে রতন টাটার পঁচিশ হাজার টাকার মূল্য কিছু কম ছিল না। সেই টাকায় তৈরি রতনকু ঠি -র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার মাসখানেকের মধ্যে লিখতে শুরু করা যক্ষপুরী/ রক্তকরবী নাটকে রবীন্দ্রনাথ ধনকু বেরদের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাবেন এটা আশা করাই অন্যায়। কৃ তজ্ঞতার প্রশ্ন যদি ছেড়েই দিই, সৌজন্যের খাতিরেও এ কাজ করা সম্ভব ছিল না রবীন্দ্রনাথের পক্ষে। বস্তুত এইসব ধনকু বের ও নেটিভ স্টেটের রাজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সমকালীন ব্যক্তিগত সম্পর্কের অন্তরঙ্গ মাধুর্যই প্রতিফলিত হয়েছে নন্দিনীর সঙ্গে 'রাজা' -র মধুর মাখামাখিতে এবং বহুগ্রাসী স্বৈরাচারী রাজার হৃদয় পরিবর্তনে। রাজতন্ত্র বা শোষণ -শাসনের মূল শক্তির কেন্দ্রে মানবিকতা, প্রেম ও ত্যাগের যে আদর্শ রবীন্দ্রনাথ ১৯০৮ সাল থেকে স্থিরসংকল্প নিয়ে আরোপ করে এসেছেন তাঁর রূপক

নাটকগুলিতে, মুক্তধারা লেখার এক বছর পরে লেখা রক্তকরবী নাটকেও তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। সেই একই কৌশল আমরা দেখতে পাই যক্ষপুরীর রাজার রাজ্যশাসনে ক্লান্তি, শ্রমিকনেত্রী নন্দিনীর চু লে বিলি কাটা আর ফাগুলালদের সহযোদ্ধা সেজে ছোটো -ইংরেজ সর্দার/আমলাদের সঙ্গে লড়াই করতে যাওয়ার মধ্যে। নাটকের শেষে বিদ্রোহী রঞ্জন মুক্তধারা -র ধনঞ্জয়ের মতোই সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে রাজার হৃদয় পরিবর্তনের ফলে, তার মৃত্যু কারো মনে কোনো দাগ কাটে না। ফাগুলাল -বিশু নন্দিনীর জয়গান গেয়েছে, যে নন্দিনী তাদের শিখিয়েছে রাজাকে দয়া -মায়া -মমতার চোখে দেখতে, যে নন্দিনী রাজতন্ত্রের সঙ্গে প্রজাদের প্রেমের বাঁধনে বেঁধে ফাগুলালের হাতে রাজার হাত মিলিয়ে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন এই স্বপ্নই দেখেছেন হৃদয়বান বড়ো -ইংরেজ আর শোষিত ভারতবাসী একসঙ্গে হাত মিলিয়ে ছোটো -ইংরেজ আমলা/ ফু লারদের হারিয়ে নতু ন ভারত গড়বে। ভারতবর্ষের সেই আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপরতলায় থাকবে প্রাণধর্মে ধর্মান্তরিত সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীরাজা বড়ো -ইংরেজ, নীচে থাকবে ভক্তি ও সেবাপরায়ণ দর্ভকেরা, অর্থাৎ ভারতের মাঠে মাঠে সোনা -রোদে ফসল ফলানো রাজভক্ত কৃ ষক -প্রজারা আর মধ্যে থাকবে জগতের সমস্ত প্রাণ, লীলা, প্রেম, নিসর্গপ্রীতি, কাব্য, পরমার্থ, সংগীত, সৌন্দর্যবোধ, বিশ্বমানবতা, ভাববাদী দর্শন ও অধ্যাত্মচিন্তার মূর্ত প্রতীক ভারতের মধ্যস্বত্বভোগীরা। এই ত্রিস্তর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুরক্ষিত চৌহদ্দির মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন তাঁর সাহিত্যচিন্তা, ধর্মচেতনা ও স্বদেশভাবনাকে। তাই যখনই সেই বন্দোবস্ত বিঘ্নিত হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তখনই তিনি তাঁর বা তাঁর শ্রেণির জীবিকা অর্জনের উৎসের বিঘ্নকে বিশ্বমৈত্রী মনুষ্যত্ব ও ভারতীয় অধ্যাত্মসাধনার পক্ষে এক ভয়াবহ ব্যাঘাত হিসেবে চিত্রিত করেছেন অবলীলাক্রমে। মানুষের জীবনবোধ, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, অধ্যাত্মভাবনা ও শিল্পবোধ তার জীবিকা সংগ্রহের আর্থসামাজিক উৎসের সঙ্গে কত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথের জীবন ও শিল্পসৃষ্টি তার একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত। একু শ রক্তকরবী নাটকের পাপড়ির আড়ালে তিনি কোন অনর্থ লুকিয়ে রেখেছেন বা ভালো করে লুকোতে পারেননি এটা রবীন্দ্রনাথ জানতেন বলেই নাটকের প্রস্তাবনায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে নাটক শেষ হবার পর তাঁর 'ভিখ মিলবে না' দর্শকেরা বা পাঠকেরা তাঁর এই রাজা -প্রজার সহযোগ ও মিলনের নাটক ভালো চোখে নেবেন না, 'কু ত্তা লেলিয়ে দেবেন'। ১৯২৩ সাল থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যেকার রাজনৈতিক পরিবেশে কলকাতার সাধারণ রঙ্গমঞ্চে রক্তকরবী অভিনীত হলে তার কী প্রতিক্রিয়া হতো আজ বলা মুশকিল,

তবে রবীন্দ্রনাথের কথার সুরে বোঝা যাচ্ছে, সে প্রতিক্রিয়া যে খুব আশাব্যঞ্জক বা তাঁর পক্ষে স্বস্তিকর হবে না এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই, তাঁর জীবদ্দশায় এই নাটকের অভিনয় সম্পর্কে তিনি যদি বিশেষ উৎসাহ না দেখিয়ে থাকেন তো তার কারণ শুধু এই নয় যে নন্দিনীর চরিত্রে অভিনয় করার মতো অভিনেত্রী খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঠিক যে কারণে কলকাতার কোনো সাধারণ রঙ্গমঞ্চেপ্রায়শ্চিত্ত নাটকের অভিনয়ের কোনো উদ্যোগ নেননি রবীন্দ্রনাথ, সেই কারণেই তিন রক্তকরবী -র অভিনয়ের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাননি। প্রভাতকু মার প্রায়শ্চিত্ত নাটক সম্পর্কে যা বলেছেন সেটি মনে রাখলেই ব্যাপারটি বোঝা যাবে 'প্রায়শ্চিত্ত নাটকটি সমসাময়িক রাজনীতির ও দেশের জনমতের বিরুদ্ধে যেন রচিত, দেশ তখন কবির আরেকদিনের কথাই মনে মনে আবৃত্তি করিতেছিল, 'অত্যাচারের বক্ষে পড়ি, হানিতে তীক্ষ্ণ ছুরি'। কিন্তু কবির কাছে তাহারা শুনিতেছে 'মারেন মরি বল ভাই ধন্য হরি'। একথা শুনিবার জন্য তাহারা প্রস্তুত নয়। এখন তাহারা চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত চায়।... লোকে কবির এই নাটকখানি গ্রহণ করিল না; উহার অভিনয় কোন পাবলিক রঙ্গমঞ্চে কখনও হইল না।'৫১ রক্তকরবী নাটকের প্রস্তাবনায় 'ভিখ' না মেলার আশঙ্কার পেছনে ১৯০৮ সালে লেখা প্রায়শ্চিত্ত নাটক সম্পর্কে সমকালীন পাঠকদের বিরক্তির স্মৃতি কাজ করেছে বলেই মনে হয়। বাইশ দীর্ঘকাল পরে স্বাধীন ভারতবর্ষে রক্তকরবী নাটক রচনার কনটেক্সট হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাটকের কনটেন্ট -ও পালটে যাবে 'কখনো কখনো এমন হয় যে রচনাকে অতিক্রম ক'রে ওঠে রচয়িতার মুখশ্রী, এই মুখই তখন হয়ে দাঁড়ায় যেন সৃষ্টির পক্ষে মুখোশ। তখন আর কিছুতেই আমরা তাকে দেখতে পাই না সত্য রূপে, ভেঙে যায় রচনার আদি তাৎপর্য।' কথাগুলি শঙ্খ ঘোষ ঠিকই বলেছেন রক্তকরবী প্রসঙ্গে যার আদি তাৎপর্য সত্যিই ভেঙে গেছে স্বাধীন ভারতে। যে নাটকে যন্ত্রের নামগন্ধ নেই, যন্ত্রসভ্যতার চিহ্নমাত্র নেই, যে নাটকে স্বৈরাচারী রাজা নিজেই শ্রমিকশ্রেণিকে ডেকে আনে যক্ষপুরীতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালাতে, যে নাটকে শ্রমিকনেত্রী শ্রমিকদের সঙ্গে কোনোরকম সাংগঠনিক কথাবার্তা না বলে শুধু রসের কথা বলে, শোষকের প্রাণে প্রেমের ঢেউ তোলে 'ভালোবাসি ভালোবাসি' গান গেয়ে বা অত্যাচারী শাসকের পেশিশক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়, যে নাটক শেষ হয় শোষক -শোষিতের মধ্যে প্রেম ও সমঝোতার বন্ধনে, সেই আশ্চর্য নাটকে আমরা যন্ত্রসর্বস্ব ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে ধিক্কার ধ্বনিত হতে শুনব, অনেকে তার মধ্যে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃ ত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবচেষ্টাও দেখতে পাব। নাটকের শেষে 'পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে' গানটি ঠিক শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামের গান হিসেবে চালানো যাবে না

বলে 'বহুরূপী'র প্রযোজনায় বিশু পাগলের রক্তকরবীর কঙ্কণ তু লে নেওয়ার পরেই 'লড়াইয়ে চল' কোরাস লাগিয়ে দেওয়া হবে, এবং তার পরেই শ্রমিকদের হাতিয়ারের ঝলকানিতে নাটকের শেষ দৃশ্য ঝলসে উঠবে। 'বহুরূপী'র দোষ নেই, কারণ লাল রংটি রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে ব্যবহার করেছেন নাটকের মধ্যে, আর লাল রং মানেই আমরা ভাবি শ্রমিকশ্রেণির মুক্তিসংগ্রাম ও সমাজপ্রগতির রং বা প্রতীক। শম্ভু মিত্র তাঁর প্রসঙ্গ নাট্য (১৯৭১, পৃ. ১৪৪) বইয়ের 'রক্তকরবী' প্রবন্ধে বলছেন 'নাটকের শুরুতেই তিনি রাঙা রঙকে দু -একবার খুব স্পষ্ট করেই উপস্থিত করেছেন যাতে ওটা কোনরকমে ভু ল না হয়।' শম্ভু মিত্র ঠিকই বলেছেন, কিন্তু ব্যাপারটি ঠিক তার উলটো-লাল রংটিকে রবীন্দ্রনাথ বারবার ব্যবহার করেছেন যাতে নন্দিনীকে ফাগুলালের মতো আমরাও শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি আন্দোলনের নেত্রী বলে মেনে নিই, নাটকের মালিক -শ্রমিক সহযোগ ও প্রেমের বন্ধনকে শ্রমিকশ্রেণির শোষণ -মুক্তির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। লাল রং কিছুই প্রমাণ করে নাবজরংবলী হনুমানজীর পতাকাও লাল, হিটলারের স্বস্তিকালাঞ্ছিত পতাকার রংও বেশ গাঢ় লাল। শ্রমিকশ্রেণিকে বিভ্রান্ত করার সবথেকে চালু কৌশলই হলো লাল রঙের মুখোশ পরা; জওহরলাল নেহরুর বুকের গোলাপের রং লালই ছিল। রবীন্দ্রভক্তেরা কিছুটা সংগতভাবেই আপত্তি তু লেছিল 'বহুরূপীর' বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের রচনাকে বিকৃ ত করার অভিযোগ এনে। আনন্দবাজার পত্রিকার (১৩ জুলাই, ১৯৫৪) নাট্যসমালোচক লিখেছিলেন :: ...এমনভাবে নাটকখানির ওপরে যবনিকা টানা হয়েছে যা নিতান্তই অরাবীন্দ্রিক। মূলত ঃ নাটকের পরিসমাপ্তি ছিল যন্ত্ররূপী দানব ও দৈত্যপুরী থেকে মুক্তির পথ দেখাবার জন্য নন্দিনীর আত্মত্যাগের ওপরে, কিন্তু বহুরূপীর অভিনয়ে তা শেষ হয়েছে লড়াইয়ে যাবার শ্লোগান তু লে।... এটার মধ্যে শুধু স্থূলত্বই ফু টে ওঠেনি, আগাগোড়া এদের অভিনয়ভঙ্গী ও দৃশ্য পরিবেশ থেকে...এইটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, রবীন্দ্রনাথ যেখানে শ্রেণীবিদ্বেষ পরিহার করে গিয়েছেন এবং যাবার নির্দেশও দিয়েছেন, বহুরূপী তা তো টেনে এনেছেনই অধিকন্তু একটা বিশেষ রাষ্ট্রের প্রতি মানুষকে সংগ্রামী হয়ে ওঠার জন্য উদ্দীপ্ত করারও চেষ্টা করেছেন। শেষ পর্যন্ত তাই অভিনয়টি রবীন্দ্রনাথের ''রক্তকরবী'' না হয়ে বহুরূপীরই ''রক্তকরবী'' -তে পরিণত হয়েছে-রবীন্দ্রনাথে ফু লটাই ছিল বড়ো কথা, বহুরূপীর অভিনয়ে জোর পড়েছে রক্তের ওপরে।...৫২ একটি ফু লের মতো স্নিগ্ধ বা রূপকথার মতো আজগুবি শ্রেণি -সমঝোতার নাটককে সংগ্রামী নাটক হিসেবে মঞ্চে উপস্থাপিত করার প্রয়াসকে আমরা নিন্দনীয় বিকৃ তি বলব না প্রশংসনীয় নবরূপায়ণ বলব এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও, বা প্রশান্ত মহলানবিশের

হস্তক্ষেপের ফলে 'শুদ্ধ রাবীন্দ্রিকেরা' চু প করে গেলেও, এ কথা স্বীকার করা ভালো যে তাঁদের অভিযোগ খুব একটা মিথ্যে ছিল না। হিরণকু মার সান্যাল পরিচয় (শ্রাবণ ১৩৬১) পত্রিকায় লিখেছিলেন 'বহুরূপী যে নন্দিনীর সৃষ্টি করেছেন, সে রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী নয়।' উৎপল দত্তের মন্তব্য প্রশংসাসূচক হলেও হিরণকু মার সান্যালের বক্তব্য থেকে খুব একটা আলাদা নয় 'বহুরূপীর অভিনয়ে যে অধ্যাপক, যে শ্রমিকদের আমরা পাই, তা শম্ভু বাবুর সৃষ্টি বললেও অত্যুক্তি হয় না; অন্তত রবীন্দ্রনাথ -কল্পিত অতি সূক্ষ্ম অমানুষিক চরিত্রের সহজবোধ্য, বাস্তব রূপান্তর তো বটেই' (পাদপ্রদীপ, আশ্বিন, ১৩৬৩)। শঙ্খ ঘোষও সঠিকভাবেই প্রশ্ন তু লেছেন 'রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রায় কি অবিকল ধরা পড়ল অভিনয়ে?'৫৩ অবিকল ধরা পড়া দূরের কথা, রাজা -প্রজা বা শোষক -শোষিতের হৃদয়ের অনাবিল সম্পর্ক ও নিবিড় প্রেমের বন্ধনের মধ্যেই সমাজের মুক্তি ও মঙ্গল নিহিত-রক্তকরবী নাটকের এই মূল বাণী ও রবীন্দ্রনাথের এই সযত্নলালিত দীর্ঘজীবী সংস্কারটিকেই আঘাত করা হয়েছে 'বহুরূপী' -র প্রযোজনায়। রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকলে কখনোই এ অভিনয় তাঁর অনুমতি বা সমর্থন পেত না, আশীর্বাদ তো নয়ই।৫৪ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের বীভৎস বিধ্বংসী রূপ ও ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সাফল্য দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। দু'এক বছর পরে রলাঁর Declaration of Independence of the Spirit ও ক্লার্ত প্রতিবেদনে স্বাক্ষরও দিয়েছেন, এবং রক্তকরবী লেখার সময়েই রথযাত্রা নাটক লিখেছেন যাতে সমাজে শূদ্রদের গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা আছে। এইসব ঘটনা থেকে আমাদের অনুমান করতে ভালো লাগে যে রক্তকরবী লেখার কাছাকাছি সময়ে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা, বিপ্লব ও সমাজগঠন সম্পর্কে বা সাধারণভাবে কমিউনিজম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই বেশ কিছুটা সহানুভূ তিশীল হয়ে উঠেছিলেন। সুখের বিষয়, এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ আমাদের খুব একটা অনুমানের ওপর নির্ভরশীল করে রেখে যাননি। তাঁর সমকালীন কিছু মন্তব্য থেকে আমরা স্পষ্টই বুঝতে পারি ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক কতখানি রুশবিপ্লব বা কমিউনিজমের সপক্ষে ছিল, বা শোষিত মানুষের রক্তপতাকাকে তিনি ঠিক কতটা শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন :: ইদানীং পশ্চিমে বলশেভিজম, ফাসিজম প্রভৃ তি যে -সব উদযোগ দেখা দিয়েছে আমরা যে তার কার্যকারণ তার আকার -প্রকার সুস্পষ্ট বুঝি তা নয়; কেবল মোটের ওপর বুঝেছি যে গুণ্ডাতন্ত্রের আখড়া জমল। অমনি আমাদের নকলনিপুণ মন গুণ্ডামিটাকেই সবচেয়ে বড়ো করে দেখতে বসেছে। বরাহঅবতার পঙ্কনিমগ্ন ধরাতলকে দাঁতের ঠেলায় উপরে তু লেছিলেন, এরা তু লতে চায় লাঠির ঠেলায়।... রাশিয়ার জার -তন্ত্র ও বলশেভিকতন্ত্র একই দানবের পাশ মোড়া দেওয়া।... আজ

তাই যখন শুনে এলুম সাহিত্যে ইশারা চলছে 'মহাজনকে লাগাও বাড়ি', 'জমিদারকে ফেলো পিষে', তখনই বুঝতে পারলুম এই লালমুখো বুলির উৎপত্তি এদের নিজের রক্তের থেকে নয়। এ হচ্ছে বাঙালির অসাধারণ নকলনৈপুণ্যের নাট্য, ম্যাজেন্টা রঙে ছোবানো।৫৫ কথাগুলি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন রক্তকরবী নাটক বই হিসেবে ছাপা হওয়ার বছরেই, ১৯২৬ সালের মে মাসের প্রথম দিকে, ঠিক যে সময়ে তিনি ফ্যাসিস্ট গুন্ডাতন্ত্রের সবথেকে ঘৃণিত গুন্ডা মুসোলিনির আমন্ত্রণ পেয়ে সদলবলে ইতালি যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন। ফ্যাসিজম ও বলশেভিজম সম্পর্কে এই মন্তব্য করার ঠিক এক মাস পরে, ৩১ মে তারিখে রোমে মুসোলিনির চেহারায় ও চরিত্রে মাইকেলেঞ্জেলোর বাটালির অপরূপ কারুশিল্প দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবেন রবীন্দ্রনাথ। আর তার সপ্তাহ তিনেক পরে রবীন্দ্রনাথের মুখে ফ্যাসিজম -প্রশস্তি শুনে ক্ষোভে, দুঃখে, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন রম্যাঁ রলাঁ।

সূত্রনির্দেশ ১. বিদেশি সমালোচকদের এই উদ্ধৃ তি তিনটি নেওয়া হয়েছে A. Aronson, Rabindranath Through Western Eyes (1943) থেকে, পৃ. ৯৮, ১০০, ১১৭। ২. Aronson, পৃ. ১২৩। ৩. Edward Thompson, Rabindranath Tagore-Poet & Dramatist (1926), পৃ. ২২৩। ৪. প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী, ৩য় খণ্ড, ১৩৫৯ পৃ. ৫৯। ৫. Krishna Kripalani, Rabindranath Tagore : A Biography (1980), পৃ. ৩২১ -৩২৩। ৬. প্রমথনাথ বিশী, রবীন্দ্রনাট্যপ্রবাহ, ২য় খণ্ড, ১৯৫৮, পৃ. ১৫৭ -১৫৮। ৭. A. L. Basham, The Wonder that was India (১৯৬৭গ্গ, পৃ. ২৮৩। ৮. Maurice Valency, The Flower and the Castle (1963); ‘The symbol of the flower, rooted in the soil and aspiring to the heavens, was a favourite figure with Strindberg’, Modern Drama, ed. Anthony Caputi, 1966, পৃ. ৪৩৩। ঠা

৯. রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র, 'সাহিত্যবিচার', রচনাবলী, শতবার্ষিক সংস্করণ, ১৪, পৃ. ৩৩৮ -৩৩৯। ১০. নীহাররঞ্জন রায়, 'রবীন্দ্রসাহিত্যের ভূ মিকা', ১৩৬৯, পৃ. ৩১৪। ১১. প্রমথনাথ বিশী, পৃ. ২০; 'রবীন্দ্রসাহিত্য যে অনেকের কাছে দুর্বোধ্য বা অ -ভারতীয় বোধ হয়, তাহার একটা কারণ অপঠিত পাণ্ডিত্য।' ১২. শান্তিকু মার দাশগুপ্ত, রবীন্দ্রনাথের রূপকনাট্য, পৃ. ৫৭। ১৩. C. M. Bowra, The Heritage of Symbolism, 1962, p. 140 : ‘He [Stefan George] had introduced such phrases as ‘der Fiihrer’ and ‘Heil’. He had proclaimed the superiority of instincts to brains, to deep inherited qualities to anything impsoed from without. he had preached...the heroic ideal and the right of the German to lands not his own, the inferior position of women as wives and mothers, the Government of mankind by a select class. ’ ১৪. শঙ্খ ঘোষ, কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক, ১৯৬৯, পৃ. ১৩৫। ১৫. প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস, 'গোরা জর্জ এলিয়ট ও রবীন্দ্রনাথ', অনুষ্টু প পত্রিকা, শারদীয় সংখ্যা, ১৩৯৪। ১৬. বিশী, পৃ. ১৮। ১৭. Maurice Valency, The Flower and the Castle, ‘Modern Drama’, ed Caputi, পৃ. ৪২৯। ১৮.Caputi, পৃ. ৪২৫। ১৯. শঙ্খ ঘোষ, পৃ. ১৯। ২০. Raymond Williams, Drama from Ibsen to Eliot, 1954, পৃ. ১০৯। ২১. Williams, পৃ. ১০৫। ২২. Williams, পৃ. ১০৫। ২৩. শঙ্খ ঘোষ, পৃ. ৯৫। ২৪. বিশী, পৃ. ১৬৭। ২৫. অরবিন্দ পোদ্দার, রবীন্দ্রনাথ-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ১৯৮২, পৃ. ৩০২।

২৬. M. Cary, A History of Western Europe A.D. 1 -455, 1928, পৃ. ৬৮। ২৭. George Boas, ‘Primitivism’, Dictionary of the History of Ideas, Vol. III, 1873, পৃ. ৫৭৯। ২৮. পোদ্দার, পৃ. ২৩ -২৪। Hirendra Mitra, Tagore without Illusions, 1983, পৃ. ৭২। ২৯.Sumit Sarkar, Modern India 1885 -1947, (1948), পৃ. ১৮০। ৩০.James Joll, Europe Since 1870, 1983, পৃ. ১৫২। ৩১.Joll, পৃ. ১৫০ -১৫১। ৩২.Kripalani, পৃ. ৩৪৫। ৩৩.উদ্ধৃ ত করেছেন Crane Brinton, Ideas & Men : The Story of Western Thought (N.J. 1950), পৃ. ৪৩৩ -৪৩৪। ৩৪. Brinton, পৃ. ৪৩৪। ৩৫.দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, 'সিদ্ধ আন্দোলন ও কৈবর্ত বিপ্লব', অনুষ্টু প পত্রিকা, শারদীয় সংখ্যা, ১৩৫৯, পৃ. ২৮৪। ৩৬. রবীন্দ্রজীবনী, ২য়, ১৩৫৫, পৃ. ৩৭৯। ৩৭. Kripalani, পৃ. ২৭১। ৩৮. রবীন্দ্রজীবনী, ৩য়, পৃ. ৬৬। ৩৯. Kripalani, পৃ. ৩০১। ৪০. রবীন্দ্রজীবনী, ৩য়, পৃ. ৬৯। ৪১. রবীন্দ্রজীবনী, ৩য়, পৃ. ৭১। ৪২. রবীন্দ্রজীবনী, ৩য়, পৃ. ৮৪। ৪৩. চিঠিপত্র, ৫ম, পৃ. ৮৭। ৪৪. পোদ্দার, পৃ. ২৪৮। ৪৫. Sumit Sarkar, পৃ. ২০৮। ৪৬. Sumit Sarkar, পৃ. ২০৫। ৪৭. রবীন্দ্রজীবনী, ৩য়, পৃ. ৮৭।

৪৮. রবীন্দ্রজীবনী, ৩য়, পৃ. ৯১। ৪৯. রবীন্দ্রজীবনী, ৩য়, পৃ. ১০৬। ৫০. প্রভাতকু মার, রবীন্দ্রজীবনকথা, ১৩৯২, পৃ. ১২৩। ৫১. রবীন্দ্রজীবনী, ২য়, পৃ. ১৭৫। ৫২. বহুরূপী পত্রিকা, সংখ্যা ৬৯, মে ১৯৮৮, পৃ. ১৮০ -১৮১। ৫৩. শঙ্খ ঘোষ, পৃ. ১২১। ৫৪. গোপাল হালদার, 'রক্তকরবীর রূপায়ণ', পূনর্মুদ্রণ বহুরূপী পত্রিকা, সংখ্যা ৬৯ 'শ্রীযুক্ত শম্ভু মিত্র যা করতে চেয়েছেন তা অনুকরণ নয়, রবীন্দ্রনাথের নকল নয়, রবীন্দ্রানুপ্রেরণায় নতু ন সৃষ্টি। এ জন্যই কবির তিনি আশীর্বাদভাজন হতেন।' অরুণা হালদার 'আমার বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকলে সার্থক শিল্পী হিসাবে শম্ভু মিত্রের শিরে বর্ষিত হতো তাঁর আশীর্বাদের অভিনন্দন', 'রক্তকরবী', পুনর্মুদ্রণ বহুরূপী ৬৯। ৫৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকু র, 'রায়তের কথা', রচনাবলী, শতবার্ষিক সংস্করণ, ১৩শ খণ্ড, পৃ. ৩৪৬। রক্তকরবী লেখার দু'বছর আগে ১৯২১ সালের জুন মাসে জার্মানির Darmstadt শহরে রবীন্দ্রনাথ এক সপ্তাহ ধরে যে সুপরিকল্পিত সংবর্ধনা পেয়েছিলেন তার প্রযোজক ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জার্মান -ভক্ত ও দীর্ঘদিনের বন্ধু কাউন্ট কাইজারলিঙ। বলশেভিজম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যের সঙ্গে রুশ বিপ্লবের ফলে তাঁর বল্টিক প্রদেশের সম্পত্তি হারানোর দুঃখ ভু লতে না পারা, কট্টর কমিউনিজম -বিরোধী ফ্যাসিস্ট -যোগী কাইজারলিঙের একটি উক্তির সহমর্মিতা লক্ষ করার মতো। কাইজারলিঙ কমিউনিজম সম্পর্কে বলছেন ‘But it is clear, nevertheless, that neither the materialism, nor its collectivism, nor, above all its satanism are true to our profoundest and most essential aspirations...The Russian Revolution is a more magnificient confirmation of the truth of the myth of Lucifer than any event of ancient history. ’ [ লন্ডনের Spectator পত্রিকায় ছাপা (১৩ নভেম্বর ১৩৯২) কাউন্ট কাইজারলিঙের South American Meditations (1932) থেকে Aronson উদ্ধৃ ত করেছেন Rabindranath Through Westren Eyes -এ পৃ. ৬৯]। ১৯৩০ সালে রাশিয়া যাবার আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথও কমিউনিজম সম্পর্কে এই ধারণাই পোষণ করতেন। রাশিয়ায় গিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে চাক্ষু ষ পরিচয়ের ফলে সমাজতন্ত্র

সম্পর্কে তাঁর মনে কিছুটা শ্রদ্ধা বা সহানুভূ তির ভাব জাগে, যার পরিচয় আমরা পাই রাশিয়ার চিঠি -তে। কিন্তু রাশিয়া ভ্রমণের মাত্র এক বছর পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃ ষি -বিদ্যার অধ্যাপক নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের জাতীয় ভিত্তি (১৩৩৮) বইয়ের ভূ মিকায় সমবায় প্রথার প্রশংসা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন 'পশ্চিমের মানুষের গায়ের জোরটা বেশি, সেই জন্যই গায়ের জোরের উপর তার আস্থা বেশি-কল্যাণসাধনেও সে গায়ের জোর না খাটিয়ে থাকতে পারে না। তার ফলে অর্থও নষ্ট হয়, ধর্মও নষ্ট হয়। রাশিয়ার সোভিয়েট রাষ্ট্রনীতিতে তার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।' রাশিয়া যাবার চার বছর আগে, ১৯২৬ সালে, রবীন্দ্রনাথ বলশেভিজমকে গুন্ডাতন্ত্র বলেছিলেন; রাশিয়া থেকে ফেরার এক বছর পরে প্রায় সেই একই কথা বললেন সোভিয়েট রাষ্টনীতি সম্পর্কে। তাই, 'রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া সম্বন্ধে যে বিস্ময় লইয়া ঐ মহাদেশে প্রবেশ করেন, তাহা শেষ পর্যন্ত অক্ষু ণ্ণ ছিল, কোনো বিরুদ্ধ বা বিরূপ মনোভাব প্রশ্রয় পায় নাই'-প্রভাতকু মারের (রবীন্দ্রজীবনী, ৩য়, পৃ. ২৮৭) এই মন্তব্য সমর্থন করা কঠিন। এই প্রবন্ধ লেখার সময় আমি যেসব লেখকের রচনা থেকে তথ্য বা মতামত সংগ্রহ করেছি শুধু উদ্ধৃ তির সূত্র উল্লেখ করেই তাঁদের কাছে আমার ঋণের পরিমাণ নির্দেশ করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথের জীবনসংক্রান্ত প্রায় সব তথ্যই আমি নিয়েছি প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনী -র দ্বিতীয় ও তৃ তীয় খণ্ড থেকে, কিছুটা কৃ ষ্ণ কৃ পালানি ও এডওয়ার্ড টমসনের রবিজীবনী থেকেও। ১৯১৫ -১৯২২ সালের ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে তথ্যের জন্যে আমি প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করেছি সুমিত সরকারের Modern India; 1885 -1947 এবং সুপ্রকাশ রায়ের ভারতের জাতীয়তাবাদী বৈপ্লবিক সংগ্রাম (১৯৮৩) বই দুটির ওপর। প্রভাতকু মার ও সুমিত সরকারের দেওয়া বেশ কিছু তথ্য আমি উদ্ধৃ তিচিহ্ন ছাড়াই ব্যবহার করেছি, ভাষা একটু আধটু পালটেছি বলে বা ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে লিখেছি বলে। প্রভাতকু মারের রবীন্দ্রজীবনী -তে সাল তারিখের ব্যাপারে বেশ কিছু ছাপার ভু ল আছে, আমি যতটা সম্ভব সংশোধন করে নিয়ে সাল তারিখের উল্লেখ করেছি, তবে বাংলা সাল তারিখকে ইংরেজি সাল তারিখে পরিবর্তন করার সময় কিছু ভু লত্রুটি থেকে যাওয়া সম্ভব। এ ধরনের কোনো ভু লের সন্ধান কোনো সহৃদয় পাঠক দিলে উপকৃ ত হব। রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকগুলির রাজনৈতিক বক্তব্য সম্পর্কে অরবিন্দ পোদ্দারের (রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব) সংক্ষিপ্ত কিন্তু মূল্যবান আলোচনা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে আমার মতামত গড়ে তোলার ব্যাপারে। শঙ্খ ঘোষের কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক বইটি থেকেই আমি এই প্রবন্ধ লেখার প্রেরণা পেয়েছি, অধ্যাপক ঘোষের কাছে আমি গভীরভাবে ঋণী। রক্তকরবী নাটকের পাণ্ডুলিপি ও অভিনয় সংক্রান্ত কিছু তথ্যের জন্যে আমি রবীন্দ্রভারতী

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শোভন নরেন্দ্রপুর বিদ্যালয়ের দীননাথ দস্তিদারের কাছে কৃ তজ্ঞ আছি। নানাধরনের সাহায্য পেয়েছি তাঁরা

সোম, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সত্যব্রত দে, সেন ও জয়পুরিয়া কলেজের অধ্যাপক হেমোপম অন্যান্য যেসব লেখকের বই বা প্রবন্ধ থেকে আমি হলেন

Rene Wellek, Symbol and Symbolism in Literature, Dictionary of the History of Ideas, 1973, Vol. IV, pp. 337 -345. Raymond Williams, Drama from Ibsen to Eliot, 1952, ch. 2. Ronald Gaskell, Drama and Reality : The European Theatre Since Ibsen, 1972. C. M. Bowra, The Heritage of Symbolism, 1962. Anthony Caputi (ed.) Modern Drama, 1966. Robert Brustein, August Strindburg : A Dream Play, reprinted in Modern Drama, ed. Caputi. Maurice Valency, A Dream Play : The Flower and the Castle, reprinted in Modern Drama. Ulrich Weisstein, Expressionism in Literature, Dictionary of the History of Ideas, Vol. II, pp. 206 -209. Alfred Cobban, In Search of Humanity : The Role of the Enlightmeant in Modern History, 1960, ch. XXII : ‘Idealism and Pessimism’, pp. 211 -221. Jean Wahl, Irrationalism in the History of Philosophy, Dictionary of the History of Ideas, Vol. II. pp. 634 -638. F. W. Chandler, Aspects of Modern Drama, 1922, ch. IV : ‘The Drama of Symbolism’, pp. 77 -100. Stephen Eric Bonner and Douglas Kellner (eds.). Passion and Rebellion : The Expressionist Heritage, 1983. Crane Brinton, Ideas and Men, 1962, ch. 14 : ‘The Twentieth Century : The Anti -Intellectual Attack’, pp. 491 -507.

James Joll, ‘The Industrial Society and its Critics’ in Europe Since 1870, 1983, pp. 143 -168. নিত্যপ্রিয় ঘোষ, 'উষার দুয়ারে পাখির মতন', ডাকঘরের হরকরা, ১৯৮৫, পৃ. ১৯৭ -২২১। ২৪ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ১৯৯০

রক্তকরবী কয়েকটি তথ্য শঙ্খ ঘোষ গোড়াতেই রাগ করিয়া বসিলে অথবা বিরুদ্ধপক্ষের বুদ্ধির প্রতি সন্দেহ করিলে নিজের বুদ্ধিকে হয় তো প্রতারিত করা হইবে । বুদ্ধির তারতম্যেই যে মতের অনৈক্য ঘটে এ কথা সকল সময়ে ঘটে না । অধিকাংশ স্থলে প্রকৃ তিভেদেই মতভেদ ঘটে । অতএব মতের ভিন্নতার প্রতি সম্মান রক্ষা করিলে যে নিজের বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি অসম্মান করা হয় তা কদাচই সত্য নহে । 'সমস্যা', রাজা প্রজা, ১৯০৮ 'রক্তকরবী' নাটকটি নিয়ে 'অনুষ্টু প' পত্রিকায় (বসন্তসংখ্যা ১৩৯৬) সুদীর্ঘ একটি প্রবন্ধ লিখেছেন শ্রীপ্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস । তাঁর সাম্প্রতিক আরো কয়েকটি প্রবন্ধের মতো এখানেও তিনি সযত্নে দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনাসৃষ্টির সবটাই কীভাবে বিদেশ থেকে সমূলে তু লে আনা । 'রক্তকরবী'র বিশেষ এই ক্ষেত্রটিতে তাঁর উপজীব্য হলো সুইডিশ লেখক স্ট্রিন্ডবার্গের একটি নাটক, A Dream Play । নাটকটির সঙ্গে 'রক্তকরবী'র টু করো কিছু সাদৃশ্য নিয়ে আমারও দু'চারটি মন্তব্য ছিল একু শ বছর আগে প্রকাশিত 'কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক' -এর দুটি প্রবন্ধে, প্রতাপবাবু তাঁর লেখায় বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন সেকথা । ভিন্ন ধরণের লেখায় হঠাৎ দু -একটি মিল দেখতে পেলে একধরণের উপমার আনন্দ পাওয়া যায়; সেইভাবে-শুধু স্ট্রিন্ডবার্গ নয়-আরো নানা লেখার প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল আমার সেই প্রবন্ধদুটিতে, যার মূল আলোচ্য ছিল নাটকের প্রতিমাপ্রয়োগ কিংবা নাটকের অভিনয় । কিন্তু তখন, 'শারোদৎসব' থেকে 'রক্তকরবী' পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের সব নাটকেরই বিষয় আর বিন্যাসের উৎস যে স্ট্রিন্ডবার্গের ওই নাটকটি, সেটা ঠিক ধরতে পারিনি । এই সহজ কথাটাও ধরতে পারিনি যে 'রক্তকরবী'র (বা, তাঁর প্রায় সব নাটকেরই) মূল বক্তব্য হলো নির্লজ্জ ইংরেজতোষণের চক্রান্ত । এই অবোধতার জন্য কখনো কখনো প্রতাপবাবু একটু যে কথা শুনিয়েছিলেন সেটা আমার প্রাপ্য বলেই মনে করি । অন্য যাঁরা এতদিন এসব নাটক থেকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তাঁদের জন্য এখন করুণা হয় । সবচেয়ে করুণা হয় অবশ্য রবীন্দ্রনাথের জন্য, কেননা এতটা চেষ্টা করেও শেষপর্যন্ত কোনো পাপই তিনি লুকোতে পারেননি । তবে, প্রতাপবাবুর প্রবন্ধ থেকে প্রচু র তথ্য, যুক্তি এবং সিদ্ধান্ত জানবার পর এই একটি কথা মনে হলো যে, 'রক্তকরবী'-এবং সেইসূত্রে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে আরো দু'চারটি তথ্য পাঠকদের সামনে থাকা বোধ হয় ভালো । তথ্যগুলি যে খুব -কিছু দুষ্প্রাপ্য তা নয়, ঠ

তবে একজায়গায় অনেকটা সাজানো থাকলে কোনো কোনো প্রসঙ্গে পাঠকদের নিজস্ব বিবেচনার হয়তো সামান্য সুবিধে হতে পারে । সেদিক থেকে, এ লেখাটি নিছক তথ্যের একটি সংকলন মাত্র, অসংগতভাবে দীর্ঘ এবং উদ্ধৃ তিবহুল, আর তাই এর পাঠযোগ্যতা খুবই কম । সম্ভাব্য পাঠকেরা একে যেন নিছক সংকলন হিসেবেই গণ্য করেন, এই অনুরোধ জানাই ।

অভিনয় কেন হলো না অনেকেই জানেন, প্রতাপনারায়ণও জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে 'রক্তররবী'র কোনো অভিনয় হয়নি । অভিনয় হয়নি বললে কমই বলা হয়, আমরা আজ আরো -একটু জানছি যে এ নাটকের অভিনয়ের জন্য কোনোদিন আগ্রহই দেখাননি রবীন্দ্রনাথ । নিজের নাটকের অভিনয়ে চিরকালই যাঁর এত উৎসাহ, ১৯২৩ সাল থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আঠারোটা বছর জুড়ে 'রক্তকরবী'কে কখনো তিনি অভিনয়যোগ্য মনে করলেন না কেন, এটা সত্যিই একটু ভাববার মতো কথা । এ সম্পর্কে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকু মার বা কৃ ষ্ণ কৃ পালানি যে কোনো মন্তব্য করেননি, সেকথা জানিয়ে দিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রতাপবাবু, 'রক্তকরবী'র ঘটনা বা বক্তব্যের মধ্যে এমন কিছু কি ছিল যার জন্য নাটকটি মঞ্চস্থ করার ব্যাপারে কোনো অস্বস্তি বা আশঙ্কা কাজ করেছিল রবীন্দ্রনাথের মনে?' প্রশ্নটা তু লেই যে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন তা নয়, তাঁর প্রবন্ধের অনেক সুধীর সিদ্ধান্তের একটি হচ্ছে এই ধাঁধার মোচন । 'সমসাময়িক রাজনীতি ও দেশের জনমতের বিরুদ্ধে' রচিত বলে 'প্রায়শ্চিত্ত' নাটকটির যেমন কোনো অভিনয় করাননি রবীন্দ্রনাথ,* 'রক্তকরবী' নিয়েও তেমনি এক অস্বস্তি নিশ্চয় কাজ করেছিল তাঁর মনে? তিনি বুঝতেই পারছিলেন যে এই নাটকটি অভিনীত হলে এর অন্তর্গত ইংরেজতোষণের রাজনীতিটা ধরা পড়ে যাবে, জনমানসে এর প্রতিক্রিয়া 'খুব আশঙ্কাব্যঞ্জক যা তাঁর পক্ষে স্বস্তিকর হবে না', ও -পথে তাই না -যাওয়াই ভালো । 'রক্তকরবী'র মঞ্চায়নে রবীন্দ্রনাথের সংগুপ্ত এই অনুৎসাহের কারণটি প্রতাপবাবু বেশ প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন । অনুমান এবং বিশ্লেষণে সবারই একটা ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকে, এ নিয়ে আপত্তি করা চলে না । তবে, সেসব অনুমানের আগে একটি তথ্য বিষয়ে সুনিশ্চিত হওয়াটা বোধহয় জরুরি । কেন রবীন্দ্রনাথ এ -নাটকে আগ্রহী ছিলেন না, কেন কোনো চেষ্টাই করেননি এর অভিনয়ের, সে -বিশ্লেষণের আগে জানা দরকার সত্যিই কি করেননি চেষ্টা? অনুমান এবং জনশ্রুতি ছেড়ে দিলে, তথ্য এ -বিষয়ে কী বলে? তথ্যগুলি এইরকম :

১. ১৯২৩ সালের মে -মাস থেকে যে -নাটক লেখা হচ্ছে, পত্রিকায় তা প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৯২৪ সালে । প্রকাশে এতটা দেরি হবার কারণ নিশ্চয় এই যে, নাট্যরূপটি নিয়ে খুশি হতে পারছিলেন না এর লেখক, তাই পালটাচ্ছিলেন বারবার । তবে, আরো একটা কারণ জানা যায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই পত্রাংশ (৫ সেপ্টেম্বর ১৯২৩) থেকে 'যক্ষপুরী নাটকটি প্রবাসীর পূজার সংখ্যায় প্রকাশ না করিয়া ফাল্গুন বা চৈত্রমাসে প্রকাশের যদি ব্যবস্থা করেন তবে ভাল হয় । অভিনয়ের পূর্বে আমি উহা বাহির করিতে ইচ্ছা করি না । '১ ২. ঠিক এই -সময়েই, কাগজে 'বিসর্জন' অভিনয়ের প্রশস্তি পড়ে শ্রীমতী রানু অধিকারীকে লিখছেন তিনি 'আমার ইচ্ছে সেই যক্ষপুরীর অভিনয়টা করে অভিনয়ের আর একরকম ধারা দেখিয়ে দিই । '২ ৩. এর প্রায় এক বছর পর, 'নাচঘর' (১৩ ভাদ্র ১৩৩১) পত্রিকায় লেখা হচ্ছিল 'রসিক সমাজকে আজ আমরা আর একটি আনন্দ -সংবাদ দিতে চাই । রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুগ্রহে শিশিরকু মার তাঁর নূতন ও অপূর্ব নাটক 'রক্তকরবী' অভিনয় করবার অধিকার পেয়েছেন । নাটকখানি শীঘ্রই 'প্রবাসী'র পত্রে আত্মপ্রকাশ করবে; -তা পাঠ করলে সকলেই বুঝতে পারবেন যে, এ শ্রেণীর নাটক বাংলা রঙ্গালয়ে আর কখনো অভিনীত হয়নি এবং শীঘ্র হতও কি না সন্দেহ, কারণ প্রকাশ্য রঙ্গালয়ে এখন এ -রকম নাটক অভিনয় ক'রে সফল হবার শক্তি, সাহস ও প্রতিভা আছে, একমাত্র শিশিরকু মারেরই । পরন্তু, 'রক্তকরবী'র অভিনয়েও শিশিরকু মার যদি তাঁর অসাধারণ যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেন, তবে বাংলার নাট্যজগতে যথার্থই নবযুগের প্রবর্তন হবে । '৩ ৪. কয়েক মাস পরে (২২ ফাল্গুন) আবারও লিখছে 'নাচঘর' 'এবারে সমুদ্রযাত্রা করবার কিছুদিন পূর্বে রবীন্দ্রনাথ বর্তমান বঙ্গের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা শ্রীযুক্ত শিশিরকু মার ভাদুড়ীকে ডেকে তাঁর 'রক্তকরবী' নাটক পড়ে শুনিয়েছিলেন । আমাদের যতদূর স্মরণ হচ্ছে শিশিরকু মার নাটকখানি অভিনয় করবার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন । 'রক্তকরবী' নাটক অভিনয়ের কী হলো?'৪ ৫. শিশিরকু মারের হাতে এ -নাটক হলো না অবশ্য । না হবার কারণ একটা কারণ না কি এই যে 'যথাযোগ্য নন্দিনী পাওয়া যায়নি । নাট্যাচার্যের কাছে শুনেছি কবির কানে এ খবর পৌঁছায় এবং তিনি শিশিরকু মারকে ডেকে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভবানীকিশোরকে নন্দিনীর ভূ মিকায় নামতে বলেন',৫ কিন্তু সে -পরামর্শ শিশিরকু মার কাজে লাগাতে চাননি । ঠা

৬. তখন, ১৯২৭ সালের ৮ নভেম্বর রেবা রায়ের কাছে এইভাবে ডাক পাঠাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ 'এবার রক্তকরবী অভিনয় করা স্থির । নন্দিনীর ভূ মিকা নেবার উপযুক্ত আমি কাউকে দেখচিনে । তু মি যদি এই দায় নিতে রাজি হও তা হলে অভিনয় সম্ভব হবে, নইলে হয় কিনা সন্দেহ । আমাকে রাজা ও দিনুকে বিশু সাজতে হবে । আর সমস্ত পাত্র একরকম জুটিয়ে নিয়েছি, তু মি কি যোগ দিতে পারবে না?'৬ ৭. রেবা রায় ছিলেন অসুস্থ । সে -খবর জেনে কদিন পরে (১৪ নভেম্বর) আবার লিখলেন 'অসুস্থ শরীরকে ক্লিষ্ট করে তু মি অভিনয় করবে এমন কথা আমি কল্পনাও করিনি । তোমার রোগশয্যার মেয়াদ ফু রিয়ে যাক তারপর ডিসেম্বর থেকেই রিহার্সাল সুরু করা যাবে-জানুয়ারির মধ্যে অভিনয় হতে পারলেই চলবে । '৭ ৮. হলো না অবশ্য সেটাও । কিন্তু তারও পর আবার, ১৯২৯ সালে 'তপতী' অভিনয়ের পর (১৩ অক্টোবর) ইন্দিরাদেবীকে জানাচ্ছেন 'তপতীর ঝাঁজ মরবার পূর্ব্বেই দাবী আসচে রক্তকরবীকে স্টেজে চড়াবার জন্যে । আমার বিক্রমের আমলের প্রেয়সী এইখানেই উপস্থিত আছেন বলে মনে ভাবচি আর এক মূর্ত্তিতে তাঁরই সাধনা করবার লীলাটা জাগিয়ে রাখতে দোষ কী?৮ ৯. বিক্রমের আমলের সেই প্রেয়সী সুমিত্রার ভূ মিকায় অভিনয় করেছিলেন শ্রীমতী অমিতা ঠাকু র । তাঁর স্মৃতিচারণে তিনি বলছেন 'তপতী অভিনয় অনুষ্ঠিত হবার [ ১ অক্টোবর ১৯২৯ ] পর আমায় বার বার বলতে থাকেন 'নন্দিনী' করার জন্য । আমার কেমন মনে হয়েছিল ওটা আমি পারব না । উনি অনেক করে বলেন কিন্তু আমি রাজি না হওয়ায় করালেন না । ... উনি বলেন 'আমি তোকে শেখাব তু ই ঠিকই পারবি' ।



তাহলে, এখন একথা বললে বোধহয় খুব অন্যায় হবে না যে, বক্তব্যটাকে লুকোবার যতই ইচ্ছে থাকু ক, 'রক্তকরবী'র মঞ্চায়নে রবীন্দ্রনাথের তেমন বিপুল কোনো অনাগ্রহ ছিল না । অভিনয়টা ঘটে উঠছিল না বলে চু প করে অবশ্য বসেও থাকেননি তিনি । শ্রোতাদের ডেকে বারে বারেই শুনিয়েছিলেন এই লেখা । তার দু'চারটি উদাহরণ সাজালে নাট্যনামের ক্রমিক বদলটাও ওইসঙ্গে ধরা থাকে সহজে ১০. 'এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে পূজনীয় গুরুদেব শিলং বাসকালে একটি নাটক লিখিয়াছেন । সেই নাটকটি তিনি আশ্রমে দুইদিন পড়িয়া শুনাইয়াছেন । নাটকটির নাম 'যক্ষপুরী' ।

১০

১১. 'গত পূজার ছুটিতে বিজয়া দশমীর দিন আশ্রমস্থ সকলকে পূজনীয় গুরুদেব তাঁহার 'যক্ষপুরী' নামে নাট্যটি পাঠ করিয়া শুনাইয়াছেন । '১১ ১২. 'নন্দিনী নাটকটার উপর ক্ষণে ক্ষণে প্রায়ই তু লি বুলচ্চি-তাতে তার রং ফু টচে বলেই বোধ হচ্চে । কাল সন্ধ্যাবেলায় আত্মীয়সভায় ওটা আর একবার পড়বার কথা আছে । আগাগোড়া সবটা একটানে পড়ে' গেলে বুঝতে পারব কোথাও ওর ওজনের বেঠিক আছে কি না । '১২ ১৩. 'কাল সন্ধ্যেয় সেই নন্দিনী নাটকটার একটা পাঠ দিয়েছিলুম । অনেক বদল হয়ে গেছে । জান বোধহয়, তার নাম হয়েছে রক্তকরবী । '১৩ ১৪. 'একদিন কবির কাছ থেকে আমন্ত্রণ এল, তিনি আমাদের রক্তকরবী পাঠ করে শোনাবেন । ... রবীন্দ্রনাথ যখন আবৃত্তি করতে বসলেন, তখন নাটকের তাবৎ বিশেষত্ব ধীরে ধীরে ফু টে উঠতে লাগল ফু লের মত । '১৪

কিন্তু, অভিনয় কি তবে হলোই না শেষ পর্যন্ত? চলতি ধারণাটা সেই রকমই । ১৯৫৪ সালে 'বহুরূপী'ই এর প্রথম প্রযোজনা করেন, এটাই অনেকে জানেন । কিন্তু তথ্য এই যে, 'রক্তকরবী' প্রথম মঞ্চস্থ হয় এর কু ড়ি বছর আগে, নাট্যনিকেতনে, ১৯৩৪ সালের ৬ এপ্রিল, সন্ধে সাতটায় । এটা একেবারে অজানা কথাও নয় । বারো বছর আগে 'মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ' নামে ভারতী -পরিষদের যে চমৎকার সংকলনটি বেরিয়েছিল, তার অভিনয়তালিকাতেও এই সালতারিখ সবই পাওয়া যায় । খবরটা পাওয়া যায় শিশিরকু মার ভাদুড়ী সংক্রান্ত বইপত্রেও, কেননা তিনিও দেখেছিলেন অভিনয় । পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের এই প্রকাশিত পত্রাংশগুলি থেকেও, নির্মলকু মারী বা হেমন্তবালা দেবীকে লেখা ১৫. 'প্রফু ল্ল ঠাকু রদের বাড়ি থেকে নোটিস এসেছে ওদের রক্তকরবীর পালা শুরু হবে ২৬শে মার্চে । আমি সশরীরে উপস্থিত থাকি এই ওদের ইচ্ছে-...' ১৫ মার্চ ১৯৩৪১৫ ১৬. 'রক্তকরবী'র অভিনয় মুসলমান বকরিদ পরবের আশঙ্কায় কোনো একটা অনির্দিষ্ট তারিখে পিছিয়ে গেছে-অর্থাৎ উক্ত তারিখের পরেই যে দিন ওরা স্টেজ পাবে সেই দিনে হবার কথা । ' ২০ মার্চ১৬ ১৭. 'আজ রথীর কাছে শুনলুম রক্তকরবীর অভিনয় পিছিয়ে গেছে । এপ্রিলের ৬/৭ইয়ের পূর্বে হবে না-অতএব ২৬শে তারিখে যাবার সঙ্কল্প ছাড়তে হোলো । ' ২১ মার্চ১৭ ১৮. 'সম্ভবত আগামী সোম কিম্বা মঙ্গলবারে কলকাতা অভিমুখে যাব । সেখানে আমার আত্মীয়বর্গ রক্তকরবী অভিনয়ে প্রবৃত্ত, তাদেরি আহ্বানে আমাকে যেতে হচ্চে । ' ২৯

মার্চ১৮ ১৯. 'কাল রক্তকরবী অভিনয় থেকে শ্রান্ত দেহে ক্লান্ত মনে জোড়াসাঁকোয় ফিরে...' ৭ এপ্রিল১৯ শেষপর্যন্ত তবে হলো নাটকটা । অভিনয় যাঁরা দেখেছিলেন, শিশিরকু মার ('রক্তকরবীও দেখেছিলেন'২০) রবীন্দ্রনাথ ছাড়া তাঁদের মধ্যে আরো একজনের সাক্ষ্য এখন সহজলভ্য । বরানগরের লাহিড়ী পরিবারের মেয়ে শ্রীমতী দেবরানী দেবী লিখেছেন যে তাঁদের বাড়ি থেকে ২০. 'কবি ফিরে গেলেন-সঙ্গে আমার দাদারা, আমরা সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম এবং 'রক্তকরবী' দেখেছিলাম । '২১ বিহার -ভূ মিকম্পে পীড়িতদের সাহায্যার্থে নাট্যনিকেতনের এই অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন 'দি টেগোর ড্রামাটিক গ্রুপ', নেতৃ ত্বে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ, প্রবোধেন্দুনাথ ঠাকু র । মুদ্রিত অভিনয়পত্রীর২২ সূচনায় আঁকা ছিল প্রকাণ্ড এক মাকড়সার জালের সামনে রক্তকরবী ফু ল, ভিতরে ছিল রবীন্দ্রনাথের 'ভূ মিকম্প' কবিতাটির পাণ্ডুলিপির ফ্যাকসিমিলি, ভূ কম্পে বিধ্বস্ত বিহারের দুটি ছবি, অবনীন্দ্রনাথের লিখে -দেওয়া নাট্যপরিচয়, ভূ মিকালিপি, আর এই কটি গান 'পৌষ তোদের' 'মোর স্বপ্নতরীর' 'তোমায় গান শোনাব' 'ও চাঁদ' 'যুগে -যুগে বুঝি আমায়' 'শেষ ফলনের ফসল' এবং ধ্বজাপূজক দলের গলায় আমাদের একেবারে অপরিচিত 'ফু ল দেখি লাগিল আশ/যাব ভোমরা যাব তোমার পাশ । ' প্রতাপবাবু লিখেছেন, 'রক্তকরবী'তে কোন অনর্থ লুকিয়ে রেখেছেন বা ভালো করে লুকোতে পারেননি এটা রবীন্দ্রনাথ জানতেন বলেই নাটকের প্রস্তাবনায়' ভয় পাচ্ছিলেন যে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে, তাই করাতে চাননি এর অভিনয়, আর '১৯২৩ সাল থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যেকার রাজনৈতিক পরিবেশে কলকাতার সাধারণ রঙ্গমঞ্চে 'রক্তকরবী' অভিনীত হলে তার কী প্রতিক্রিয়া হতো আজ বলা মুশকিল' বলেই মনে হচ্ছে তাঁর । তখনকার দর্শকদের বুদ্ধি কিছু অল্প ছিল বলে অভিনয় থেকে তেমন বিপজ্জনক কোনো প্রতিক্রিয়া অবশ্য হয়নি দেখা যাচ্ছে, বরং নাটকটি ছাপা হবার পর জয়গোপাল ব্যানার্জির মতো কেউ কেউ দীর্ঘ নিবন্ধে লিখে বসেছিলেন যে পাঠকদের পক্ষে এ -নাটক ‘will be a momentous landmark in the history of their country’s political regeneration । '২৩

কোথা থেকে এল ফু ল 'যক্ষপুরী' থেকে 'নন্দিনী' হয়ে নাটকটি যে 'রক্তকরবী' নামে পৌঁছল, তার তাৎপর্য বলতে গিয়ে সমালোচকেরা অনেকসময়ে একটা কথা আমাদের জানান । কথাটা প্রমথনাথ বিশী পেয়েছিলেন ক্ষিতিমোহন সেনের কাছে, ক্ষিতিমোহনকে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ । বলেছিলেন যে তাঁর ঘরের কাছে আবর্জনাস্তূ পে ছোট্ট একটা করবী গাছ চাপা পড়ে ছিল । কিছুদিন পর লোহার জালজঞ্জাল সরিয়ে গাছটি জেগে উঠল একটি লাল ফু ল নিয়ে । যেন, 'সে বলল ভাই মরিনি তো, আমাকে মারতে পারলে কই?'২৫ এই দৃশ্য দেখবার পর, রবীন্দ্রনাথ বলছেন, নাটকটাকে আর 'যক্ষপুরী নন্দিনী প্রভৃ তি বলে আমার তৃ প্তি হয় নি । তাই নাম দিলাম রক্তকরবী । ' এতদিনকার জানা এই তথ্যটির বিষয়ে নতু ন করে একটা সন্দেহ জাগালেন প্রতাপনারায়ণ । তথ্যটিকে তাঁর খুবই 'অদ্ভু ত' মনে হয়েছে । কেননা রবীন্দ্রনাথের কথা থেকে এইরকম যেন ধারণা হয় যে 'যক্ষপুরী বা নন্দিনী নাটকটি তিনি রক্তকরবী ফু লটি দেখার আগেই লিখে ফেলেছিলেন । ' সত্যি যদি তাই হবে, প্রশ্ন করেন তিনি, তাহলে 'নাটকের প্রথম দৃশ্য থেকে শুরু করে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত রক্তকরবী ফু লের যে উল্লেখ রয়েছে সেগুলি এল কোথা থেকে? রবীন্দ্রনাথ কি পুরো নাটকটাই আবার লিখেছিলেন রক্তকরবী গাছের ফু লটি দেখার পর ঐ ফু লটিকে নাটকের কেন্দ্রীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে? তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে 'নন্দিনী' বা 'যক্ষপুরী' হিসেবে নাটকটির যে খসড়া রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন, সেখানে রক্তকরবী ফু লের উল্লেখ থাকার কথা নয় । পাণ্ডুলিপি কিন্তু সে কথা বলছে না । ' তাহলে, পাণ্ডুলিপিতে যখন দেখা যাচ্ছে যে প্রথম পাঠেই 'প্রথম দৃশ্য থেকে শুরু করে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত' রক্তকরবী ফু লটির ব্যবহার আছে, তখন আমাদের বুঝতে হবে রবীন্দ্রনাথের বলা গল্পটি আসলে বানানো । লিখবার আগেই ফু লটির হদিশ তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন স্ট্রিন্ডবার্গের A Dream Play থেকে, গোটা নাটকটাই ওখান থেকে অনুপ্রাণিত, আর সেকথাটা প্রচ্ছন্ন রাখবার জন্যই 'নাটকের প্রতীকটির প্রেরণাতেই যেন রবীন্দ্রনাথের ঘরের পাশে লোহার জালজঞ্জালের মধ্যে ফু লটিকে ফু টতে হয়েছিল নাটকের সঙ্গে বেশ মানানসই করে । ' ক্ষিতিমোহন বা রবীন্দ্রনাথ গল্পটিকে যে বেশ মানানসই করে বানিয়েছিলেন, এর সবচেয়ে বড়ো যুক্তি দেখা যাচ্ছে পাণ্ডুলিপি । কেননা পাণ্ডুলিপিতে প্রথম থেকেই রক্তকরবী ফু লটির দেখা মিলছে আদ্যোপান্ত ।

কিন্তু মিলছে তো সত্যিই? এ -তথ্যে কোনো ফাঁক নেই তো? দেখা যাক তাহলে পাণ্ডুলিপি এ বিষয়ে কী বলে । এখনো পর্যন্ত জানা যায় 'রক্তকরবী'র পাঠ আছে দশটি । এর মধ্যে নটির পাণ্ডুলিপি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত, একটি সেখানে নেই । যেটি নেই, সেও এখন সহজলভ্য । 'ঠাকু রবাড়ির কোনো আত্মজনের ব্যক্তিগত সংগ্রহ'২৫ থেকে পাওয়া সেই পাঠ 'বহুরূপী' পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ১৯৮৬ সালে, কু মার রায়ের সম্পাদনায় । সেই মুদ্রণে, কু মার রায় ধরে নিয়েছিলেন যে এইটেই হচ্ছে নাটকের প্রথম পাঠ । সম্ভবত প্রতাপবাবুও তা -ই ভেবেছেন । তবে, নাটকটির নাম যে 'যক্ষপুরী' থেকে 'নন্দিনী' হয়ে 'রক্তকরবী'তে পৌঁছল, এই সুজ্ঞাত তথ্যের পর 'নন্দিনী' -নামাঙ্কিত খাতাটিকে প্রথম ভেবে নিতে সংশয় হবারই কথা । দ্বিতীয় পাঠ, প্রতাপবাবুই উল্লেখ করেছেন, ছাপা হয়েছিল, 'রবীন্দ্রবীক্ষা'র উনিশ নম্বর সংকলনে । সে -সংকলন তিনি ভালোভাবে দেখেছেন বলেই তাঁর জানবার কথা যে 'বহুরূপী'তে পাওয়া খবরটিতে ঈষৎ গোলমাল ছিল । স্পষ্ট ভাষায় বলা আছে 'রবীন্দ্রবীক্ষা'র ওই সংকলনে 'রক্তকরবী নাটক রচনার ইতিবৃত্ত । [ ইতিবৃত্ত ], মুদ্রিত রূপে এর প্রথম প্রকাশ, গ্রন্থাকারে প্রকাশের স্থান -কাল ও বিশ্বভারতী -রবীন্দ্রভবনে এবং অন্যত্র সংগৃহীত উক্ত নাটকের একাধিক খসড়ার উল্লেখসহ প্রথম খসড়াটি (পাণ্ডু, ১৫১/৯) রবীন্দ্রবীক্ষা-ষোড়শ সংকলনে প্রকাশিত...' । এর কিছু পরে, ওই বিবরণে 'রক্তকরবী'র খসড়াগুলির যে -পারম্পর্য সাজিয়ে দেওয়া আছে, তাতে যে -কেউ দেখতে পাবেন 'বহুরূপী' প্রকাশিত পাঠটি হলো এ -নাটকের চতু র্থ খসড়া । তাই, উনিশ নম্বর 'রবীন্দ্রবীক্ষা' যাঁরা দেখেছেন, 'বহুরূপী'র মুদ্রণটিকে প্রথম পাঠ ভেবে নেওয়া তাঁদের পক্ষে কি একটু শক্ত নয়? প্রকাশিত দ্বিতীয় এবং চতু র্থ পাঠদুটিতে 'রক্তকরবী' ফু লের কথা আছে অবশ্য, তবে আছে মাত্র দুবার । একবার নাটকের প্রথম পৃষ্ঠায়, সেখানে রাজাকে নন্দিনী বলছে 'আমাকে মানাবে না, আমি পরেচি রক্তকরবী । ' আর একবার শেষের দুপৃষ্ঠা আগে, নন্দিনীকে বলছে রাজা 'তোমার ঐ রক্তকরবীর মালা দাও আমাকে পরিয়ে । ' আর প্রথম পাঠে? ষোলো -সংখ্যক 'রবীন্দ্রবীক্ষা'য় মুদ্রিত প্রথম খসড়াটি পড়লে দেখা যাবে যে এর ৩৭ পৃষ্ঠায় ১৫৩৭টি লাইনের মধ্যে কোনো -একটি লাইনেও এই ফু লটির কোনো উচ্চারণ নেই, না, একবারও না । এই তথ্যও এখানে স্মরণযোগ্য হতে পারে যে প্রথম সেই খসড়াটি শুরু হয়েছিল চন্দ্রা -ফাগুলালদের সংলাপ দিয়ে, নন্দিনী সেখানে পৌঁছয় ৩৬৫ লাইন পর, ৬৫৪ লাইন পরে রাজা ।

তাহলে, 'রবীন্দ্রনাথ কি পুরো নাটকটাই আবার লিখেছিলেন রক্তকরবী গাছের ফু লটি দেখার পর ঐ ফু লটিকে নাটকের কেন্দ্রীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে,' প্রতাপবাবুর এ -প্রশ্নের উত্তরে বলতেই হয় হ্যাঁ, ঠিক তা -ই, মুদ্রিত এবং সহজলভ্য পাণ্ডুলিপি সেইরকমই প্রমাণ করে । একবার নয়, কয়েকবার পরিমার্জন করতে করতে ফু লটি ক্রমশ কেন্দ্রীয় প্রতীকের মর্যাদা পেতে থাকে আর নাটকের নামটাও যায় পালটে । ফলে ‘A Dream play’ নাটকের আবর্জনা থেকে উঠে আসা আলোর দিকে ফু টে ওঠা চন্দ্রমল্লিকা কেন আবার রবীন্দ্রনাথের ঘরের পাশে জালজঞ্জালের মধ্যে রক্তকরবী হয়ে ফু টলো বা ঐ আশ্চর্য গল্পটি মৃত্যুর আগে রবীন্দ্রনাথকে কেন ক্ষিতিমোহন সেনকে বলে যেতে হলো', এ নিয়ে গুরুভার কোনো গবেষণা হয়তো তত জরুরি নয় । তবে, স্ট্রিন্ডবার্গ থেকেই যে নাটকটির সবকিছু পাওয়া গেছে, এটা প্রমাণ করতে গেলে রবীন্দ্রনাথকে মিথ্যেবাদী প্রতিপন্ন করবার একটা প্রবণতা হওয়া অসম্ভব নয় ।

নাম কেন নন্দিনী কথা উঠেছে নন্দিনীর নামটা নিয়েও । A Dream Play -র নায়িকাকে বলা হয়েছে Daughter, অতএব রবীন্দ্রনাথকে লিখতে হলো নন্দিনী । 'কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক' বইটিতে A Dream Play -র সঙ্গে 'রক্তকরবী'র সামান্য সাদৃশ্য নিয়ে যখন মন্তব্য করেছিলাম, সদৃশ সংলাপ সাজাতে গিয়ে নাট্যাংশটির বাংলা অনুবাদে 'নন্দিনী'ই লিখেছিলাম আমি । টু করো দুই নাট্যাংশকে একেবারে সমীকৃ ত করবার জন্য ‘you are a child of heaven’ -কে 'তু মি স্বর্গের নন্দিনী' বলতেই ভালো লেগেছিল তখন, 'একটু সরে গিয়ে । ' 'একটু সরে গিয়ে' বলছি এইজন্যে যে বাংলায় 'নন্দিনী' একটা নামও বটে, ওই বাক্যের child -এর যথাযথ রূপায়ণ নয় সেটা । কিন্তু এখন জানছি 'রক্তকরবী'র নন্দিনী নামটিতে রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন অনুবাদ । প্রতাপবাবু লিখেছেন 'এই ফু লের প্রতীকটি যুক্ত হয়েছে নাটকের [ A Dream Play ] নায়িকা পরমাপ্রকৃ তি Eternal Feminine -এর সঙ্গে যার নাম ‘Dottern’, যার ইংরেজি অনুবাদ ‘Daughter’, এবং রবীন্দ্রনাথ যার আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন-'নন্দিনী' । কেউ ভাবতেও পারেন তা । তবে, এ -প্রসঙ্গেও অন্য দু -একটা তথ্য মনে রাখা ভালো ।

নন্দিনী নামটা তো তাহলে সহজেই পেয়ে যাবার কথা, নাট্যরচনার সূচনা থেকেই । আগে দেখেছি, লিখতে শুরু করবার সময়ে রক্তকরবী ফু লটার কোনো অস্তিত্ব ছিল না । নন্দিনীরও কি ছিল? পাণ্ডুলিপিতে দেখি, প্রথম দিকের খসড়ার এ -নাটকের নায়িকাটির নাম ছিল খঞ্জনী, নন্দিনী নয় । কখনো খঞ্জনী, কখনো -বা খঞ্জন । দ্বিতীয় পাঠ ছাপা হয়েছে যে -'রবীন্দ্রবীক্ষা'য়, তাতে এই দ্বিতীয় খসড়ার একটা পাণ্ডুলিপিও ছাপা আছে । সে -পৃষ্ঠাটিতেও যে ছ -বার 'খঞ্জনী' কেটে 'নন্দিনী' করেছেন রবীন্দ্রনাথ, সেটা অবশ্য সকলেরই-প্রতাপবাবুরও-চোখে পড়বার কথা । এসব মুদ্রণে যা চোখে পড়বে না, তা হলো, খঞ্জনী থেকে নন্দিনীতে পৌঁছবার পথে অল্পসময়ের জন্য এসেছিল আরো একটি নাম 'সুনন্দা' । চোখে পড়বে না, তবে ষোলো নম্বর 'রবীন্দ্রবীক্ষা'য় ভালোভাবেই জানানো আছে এ -খবরটা । নায়িকানামের এই বিবর্তন থেকে কেউ ভাবতেও পারেন যে 'নন্দিনী' শব্দের কন্যকা -অর্থটাই রবীন্দ্রনাথের মনে প্রবল ছিল না ওখানে । যে চরিত্র তিনি তৈরি করতে চাইছিলেন একটা ‘touch of life, the spirit of joy in life’২৬ দিয়ে, বোঝা যায় যে তার চঞ্চল আনন্দময়তাকে প্রকাশ করবার যোগ্য একটা নামই খুঁজছিলেন তিনি, তাই খঞ্জনী থেকে সুনন্দা হয়ে নন্দিনীতে পৌঁছয় নাম । Proper Name -এর কোনো connotation না থাকলেও রবীন্দ্রনাথ কখনো -কখনো শব্দগত বা আচরণগত একটা নিহিতার্থই ভাবতে চেয়েছেন তাঁর চরিত্রনামে । নাটকটি লিখবার প্রায় সমকালে পালিতা পৌত্রীর নাম হয়েছিল 'নন্দিনী', নাটকটি প্রকাশিত হবার কিছু পরে লিখেছিলেন ওই নামের একটি কবিতাও,২৭ লিখেছিলেন সরল তাহার হাসি, সুকু মার মুঠি যেন শুভ্র কমলকলিকা, আঁখিদুটি যেন কালো আলোকের সচকিত শিখা । অবসাদবদ্ধভাঙা মুক্তির সে ছবি, সে আনিয়া দেয় চিত্তে কলনৃত্যে দুস্তর -প্রস্তর -ঠেলা ফেনোচ্ছল আনন্দজাহ্নবী, বীণার তন্ত্রের মতো গতি তার সংগীতস্পন্দিনী নাম কি নন্দিনী ।

নন্দিনী বলতে তিনি কী বুঝতেন, তার একটা আভাস মিলতেও পারে এর থেকে ।

লেডী রানু কী বলেন শ্রীমতী রানু অধিকারী, এখন যিনি লেডী রানু মুখার্জি, তাঁকে নিয়েই কি তবে লেখা হয়েছিল এই নন্দিনী? এ হলো আরেকটা প্রশ্ন । এ প্রশ্ন অবশ্য প্রতাপবাবুর নয়, কথাটা তিনি পেয়েছেন কৃ ষ্ণ কৃ পালানির রবীন্দ্রজীবনীতে, এলমহার্স্টের স্মৃতিচারণে । নাটকটি রচনার পর্বে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যেই ছিলেন এলমহার্স্ট, সেই সান্নিধ্যস্মৃতি থেকে তিনি জানাচ্ছেন কীভাবে কবি প্রায়ই তাঁকে বলতেন এর একটা বাস্তব ভিত্তির কথা, বলতেন যেন এলমহার্স্ট -রানু -রবীন্দ্রনাথের পারস্পরিক সম্পর্কগত ইশারাই আছে রঞ্জন -নন্দিনী -রাজা পরিকল্পনায় । A Dream Play -কেই সামগ্রিক ভিত্তি ভাবছেন বলে প্রতাপবাবু এলমহার্স্টের এ -কথাটাকে তত নির্ভরযোগ্য মনে করেন না, তিনি বলেন । 'এ সম্পর্কে তাঁর [ লেডী রানুর ] নিজস্ব বক্তব্য শোনার জন্যে রবীন্দ্রগবেষকেরা দীর্ঘকাল অপেক্ষা করে আছেন । ' কিন্তু এখনো কি অপেক্ষা করে আছেন? তা হয়তো আর বলা যাবে না, কেননা এ -বিষয়ে তাঁর 'বক্তব্য' ছাপা হয়ে গেছে বছরচারেক আগে । ১৯৮৬ সালের ১৭ নভেম্বর প্রত্যক্ষ আলাপচারিতে একজন রবীন্দ্রগবেষককে যা তিনি জানিয়েছিলেন তার মুদ্রিত বিবরণটা এইরকম২৮: ...রবীন্দ্রনাথ এই সুন্দর পরিবেশে তাঁর ঘরে জানালার ধারে টেবিলে বসে লিখতেন, মাঝে মাঝে প'ড়ে শোনাতেন । শ্রীমতী রানু সারা বাড়িতে, বাইরে, দৌড়ঝাঁপ লাফালাফি ক'রে বেড়াতেন, কবির কাছে গিয়েও বসতেন । বিকেলে তাঁরা বেড়াতে বের হতেন । ...একদিন রানুকে পাশে নিয়ে, কালো জোব্বা গায়ে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তেমনি এক অনুষ্ঠানে চলেছেন, শ্রীমতী রানুর চু লগুলি খোলা অবস্থায় ছিল, মীরা দেবী সেই চু ল বেঁধে দেবার প্রস্তাব করতেই রবীন্দ্রনাথ বললেন, না । খোলা চু লই থাক, একে মানিয়েছে । ... স্মৃতিচারণ করতে করতে শ্রীমতী মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ কাউকেই তখন এ বিষয়ে [ নাটকরচনা বিষয়ে ] স্পষ্টত কোনো আভাস দেন নি । কিন্তু গভীরভাবে মগ্ন ছিলেন এই লেখার কাজে, তা বোঝা যেত । ... এই খসড়াটির পিছনে কোনো অনুপ্রেরণা আছে কি? এই প্রশ্ন স্বভাবতই ওঠে । নন্দিনীর কথা ভেবে রবীন্দ্রনাথ যে 'মানবীর ছবি' আঁকতে চেয়েছিলেন, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি আছে কি? এই প্রশ্নও উঠতে পারে । এ বিষয়ে শ্রীমতী মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, যা তাঁর মুখ থেকে শুনবার সুযোগ পেয়েছি, সহায়ক হয়েছে । তিনি

বলেছেন, ''রবীন্দ্রনাথ আমাকে বলেছিলেন-নন্দিনী তু ই । ''... রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নন্দিনীর চরিত্র অভিনয় করবার জন্যও বলেছিলেন । ঘটনাচক্রে সেই সময়েই তাঁর বিয়ের কথাবার্তা চলতে থাকে, ফলে তা ঘটে ওঠে নি । চরিত্রের অন্যতম একটা প্রেরণা বিষয়ে এই হচ্ছে লেডী রানু মুখার্জির স্মৃতি । কিন্তু তার মানেই কি এই যে তিনি বা এলমহার্স্ট বা কৃ পালানি ভাবছিলেন, নন্দিনী = রানু? প্রতাপবাবু বলেন, 'নন্দিনী চরিত্র কল্পনার সঙ্গে রানু বা রবীন্দ্রনাথ -রানু -এলমহার্স্টের কল্পিত বা প্রকৃ ত ত্রিকোণ সম্পর্কের কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকার কথা নয়' অথচ কৃ ষ্ণ কৃ পালানির রবীন্দ্রজীবনীতে তথ্যটি না কি 'এমনভাবে পরিবেশিত হয়েছে যে রানু যেন সত্যিই 'রক্তকরবী'র নন্দিনীর প্রেরণা । ' কৃ পালানির বই থেকে এলমহার্স্টের কথার গোটা তিরিশেক লাইন এ -প্রসঙ্গে ব্যবহার করেছেন প্রতাপবাবু, কিন্তু আশ্চর্য যে ছেড়ে দিয়েছেন শিল্পবিবেচনার পক্ষে খুবই জরুরি এবং স্পষ্ট কয়েকটি লাইন । রঞ্জনের ভূ মিকায় অভিনয়ের জন্য আহ্বান করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন এলমহার্স্টকে, ‘...Nandini will bend over you and put a feather on your hair’- এই পর্যন্ত উদ্ধৃ ত করেন তিনি । বলেন না যে এর ঠিক পরেই আছে এলমহার্স্টের বিশেষ এই কথাগুলি২৯ This does not mean that anyone need go to the play to try and discover where or how Tagore draws directly from experience of actual people or actual life. In the mind of a great artist, poet or painter, the inspiration of an actual situation may be so married to the need to express some great idea that the work of art that emerges will have little or no relation at all to the original raw material used. প্রাথমিক প্রেরণার কথা বলতে গিয়ে এই স্বতঃসিদ্ধটাকে এঁরা কেউ ভু লে যাননি, আর সেই কারণে তাঁরা বোঝেন, একইসঙ্গে সত্য হতে পারে আপাতবিরোধী এই দুই কথা যে নন্দিনী রানু ('নন্দিনী তু ই')৩০ এবং নন্দিনী রানু নয় (‘You have had nothing to do with it)৩১ । সূচনামুহূর্ত থেকে সৃষ্টি বিকাশের যে এতটাই প্রভেদ হয়ে যায়, শিল্পে এ তো খুব বিরল অভিজ্ঞতাও নয় । প্রতাপবাবু অবশ্য প্রেরণার এই প্রাথমিক অস্তিত্বটু কু তেই অস্বীকার করতে চান, কেননা তাঁর বিবেচনায় এ -নাটকের সঙ্গে 'রানু মুখার্জিকে জড়িত করলে স্ট্রিন্ডবার্গ বা রানু মুখার্জি কারো প্রতিই সুবিচার করা হয় না,' 'রানুর সঙ্গে যদি রবীন্দ্রনাথের কোনদিন দেখা নাও ঠি

হতো' তাহলেও স্ট্রিন্ডবার্গ -সূত্রে রক্তকরবী ঠিক এইভাবেই লেখা হতো । কেন তা মনে হয় তাঁর? সেটা বুঝবার জন্য নাটকের বক্তব্যটা আগে লক্ষ করা দরকার ।

কাকে বলে ঋণশোধ 'রক্তরকবী'তে বলবার বিষয়টা ঠিক কী? কেবল 'রক্তকরবী' নয়, 'শারদোৎসব (১৯০৮) থেকে শুরু করে 'রক্তকরবী' (১৯২৩) পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ যতগুলি রূপকনাটক লিখেছেন তার সবগুলির যা ধুয়া, স্ট্রিন্ডবার্গের A Dream Play নাটকেরও অবিকল তাই ধুয়াঋণশোধ' বলছেন প্রতাপবাবু । বলছেন, এই ধুয়াসামীপ্য একেবারে দৈবাৎ ঘটেনি, A Dream Play থেকেই তাঁর নাট্যসাহিত্যের গোটা ভাবনাটা সংগ্রহ করেছেন রবীন্দ্রনাথ । ঋণশোধকেই রবীন্দ্রনাথের সবগুলি নাটকের ধুয়া বলা যাবে কি না, সে প্রশ্নটা আলাদা । কিন্তু 'শারদোৎসব' নাটকে এই ভাবনা যে প্রবলভাবেই আছে, রূপান্তরে নাটকটির নামই যে হলো 'ঋণশোধ', এ তো আর লুকোবার উপায় নেই । A Dream Play -র সঙ্গে সম্পর্কের জন্যে কি এতটা হতে পারল? Inferno নামে তাঁর আত্মজীবনীটির মধ্যে নাকি লিখেছিলেন স্ট্রিন্ডবার্গ ‘Let us rejoice in our torments which are so many debts repaid’ এবং তাঁর শেষদিকের নাটকগুলির মর্মার্থও আছে Daughter -এর এই কথায় ‘Surely suffering is redemption and death deliverance’ । এই redemption আর debts repaid -এর মতো শব্দবন্ধ যখন পাওয়াই যাচ্ছে স্ট্রিন্ডবার্গে, তখন বোঝাই উচিত অনুরূপ রবীন্দ্রভাবনার উৎসটা ঠিক কোথায় । ঠিক । তবে এখানে এই একটা জিনিস লক্ষ করবার আছে যে আত্মজীবনীটি থেকে প্রতাপবাবুর উদ্ধৃ ত এই বাক্যটি কিঞ্চিৎ খণ্ডিত । কথাটাকে সম্পূর্ণ করলে এবং এর ঠিক আগের বাক্যটিকে গণ্য করলে স্ট্রিন্ডবার্গের অভিপ্রায়টা বোঝা আরেকটু সহজ হতে পারে । প্রশ্নটা উঠেছিল এইভাবে নির্দোষ শিশুরাও এমন কষ্ট পায় কেন? উত্তর হচ্ছে: None of us can know why, but divine justice makes us suppose that it is because of sins committed before even they arrived in this world. Let us rejoice in our torments which are so many debts repaid, and let us believe that it is out of pure compassion that we are kept in ignorance of the primordial reason for our punishment.৩২ তাহলে দুঃখ হলো আমাদের পাপের শাস্তি, জন্মাবার আগেই ঘটে গেছে যে -পাপ, আর সেইটে জেনেই আমাদের আহ্লাদ করতে হবে-এই হচ্ছে স্ট্রিন্ডবার্গের খ্রিস্ট্রীয় ঋণশোধ ।

অবশ্য, কেবলই খ্রিস্ট্রীয় বলবার বিশেষ মানে নেই, ১৯৩৪ সালে বিহার -ভূ মিকম্প ছিল আমাদের অস্পৃশ্যতা -পাপের শাস্তি, এইরকম বলেছিলেন গান্ধিজি । এই কথারই বিরুদ্ধে সেদিন প্রতিবাদ করতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে । আর, 'শারদোৎসব' নাটকে ঋণশোধ কথাটা ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথ, তিনিও বলেছেন এক দুঃখসাধনার কথা । কিন্তু কী ছিল তাঁর সেই ঋণশোধের ধারণা? 'শারদোৎসব' -এর উপনন্দ পুথি লিখে তার গুরুর ঋণশোধ করছে, ছুটির দিনে কিশোরোচিত খেলার উৎসাহ ছেড়ে দিয়ে সে মেনে নিয়েছে তার কাজের দায়, আর এই 'বালকের ঋণশোধের মতো এমন শুভ্র ফু লটি৩৩ দেখে সন্ন্যাসী বলছেন: আমি অনেকদিন ভেবেছি জগৎ এমন আশ্চর্য সুন্দর কেন । কিছুই ভেবে পাইনি । আজ স্পষ্ট প্রত্যক্ষ দেখতে পাচ্ছি-জগৎ আনন্দের ঋণশোধ করছে । বড়ো সহজে করছে না, নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে সমস্ত ত্যাগ করে করছে । সেইজন্যেই ধানের খেত এমন সবুজ ঐশ্বর্যে ভরে উঠেছে, বেতসিনীর নির্মল জল এমন কানায় কানায় পরিপূর্ণ । কোথাও সাধনার এতটু কু বিশ্রাম নেই, সেইজন্যেই এত সৌন্দর্য ।

৩৪

আনন্দের ঋণশোধ হচ্ছে সৌন্দর্য দিয়ে, ত্যাগের মধ্যে দুঃখের মধ্যে আছে সেই সৌন্দর্য, এই হলো রবীন্দ্রনাথের কথা । এর সঙ্গে কি A Dream Play -র সেই লেখকের কোনো সামঞ্জস্য হতে পারে, যিনি দেখান : We, the winds, the sons of air, bear man’s lamentation. ......... In sickroom, on the battlefield, and most where the newborn lie, screaming, complaining, of the pain of being alive. It is we, we the winds who whine and whistle, woe! woe! woe! বেঁচে থাকা নিয়ে আর্তনাদকারী এই বাতাসকে যদি সান্ত্বনা দিতে চায় ঢেউয়ের প্রলেপ, তাহলে Daughter বলে ‘False waves and faithless. Everything on earth

that is not burned is drowned by those waves.’ এদের ঋণশোধের ধারণা থেকে 'শারদোৎসব' -এর বিষয়সংগ্রহ একটু শক্তই ছিল মনে হয় । কিন্তু redemption আর debts repaid -এর মতো শব্দ? রবীন্দ্রনাথের দিক থেকে সেগুলিই কি যথেষ্ট ঋণের প্রমাণ নয়? সেটা বুঝবার আগে দেখা দরকার, Inferno (১৮৯৭) বা A Dream Play (১৯০২) -নিরপেক্ষভাবে ও -রকম ধারণায় রবীন্দ্রনাথের নিজেরও সামান্য কিছু অধিকার সম্ভব ছিল কি না । এমন -কী ১৮৮৫ সালেও কি এইসব কথা আমরা শুনিনি রবীন্দ্রনাথের লেখায়, জীবনকে বুঝে নেবার জন্য মৃত্যুবেদনাকে সামনে রেখে বলা এইসব কথা : ...প্রকৃ তির মধ্যেই ঋণ এবং পরিশোধের নিয়মের কোথাও ব্যতিক্রম নাই । কেহই এক কড়ার ঋণ রাখিয়া যাইতে পারে না, তাহার সুদসুদ্ধ শুধিয়া যাইতে হয়এমনকি পিতার ঋণ পিতামহের ঋণ পর্যন্ত শুধিতে সমস্ত জীবন যাপন করিতে হয় ।

৩৫

সেই জীবনযাপনেরই নাট্যছবি ছিল উপনন্দে । আর উপনন্দকে দেখে সন্ন্যাসী আর ঠাকু রদাদার এই যে -বোধ জন্মেছিল: একদিকে অনন্ত ভাণ্ডার থেকে তিনি কেবলই ঢেলে দিচ্ছেন, আর একদিকে কঠিন দুঃখে তারই শোধ চলছে৩৬ সেই বোধেরই এক প্রাক -রূপ মেলে 'কড়ি ও কোমল' -এর (১৮৮৬) এইসব কথায়:: ধ্বনি খুঁজে প্রতিধ্বনি, প্রাণ খুঁজে মরে প্রতিপ্রাণ । জগৎ আপনা দিয়ে খুঁজিছে তাহার প্রতিদান । অসীমে উঠিছে প্রেম, শুধিবারে অসীমের ঋণ যত দেয় তত পায়, কিছুতে হয় না অবসান । যত ফু ল দেয় ধরা তত ফু ল পায় প্রতিদিনযত প্রাণ ফু টাইছে ততই বাড়িয়া উঠে প্রাণ । যাহা আছে তাই দিয়ে ধনী হয়ে উঠে দীনহীন, অসীম জগতে এ কি পিরিতির আদানপ্রদান ।

৩৭

এই দেওয়ানেওয়ার, এই অসীমের ঋণ শোধ করবারই নাট্যরূপ আছে 'শারদোৎসব' নাটকে, নাটকটির ব্যাখ্যায় যেমন বলেছিলেন তিনি 'প্রত্যেক ঘাসটি নিরলস চেষ্টার দ্বারা

আপনাকে প্রকাশ করছে, এটি প্রকাশ করতে গিয়েই সে আপন অন্তর্নিহিত সত্যের ঋণ শোধ করছে । ৩৬ আর, সে -নাটকের সন্ন্যাসী 'কড়ি ও কোমল' -এর এই কথাটাকেই বলেছিলেন গদ্যভাষায় কাহারে পূজিছে ধরা শ্যামল যৌবন -উপহারে, নিমেষে নিমেষে তাই ফিরে পায় নবীন যৌবন ।

৩৭

দুঃখ বহন করবার ছবির সঙ্গে ঋণ আর ঋণশোধের ধারণাকে একটু বিপরীত দিক থেকেও মেলানো ছিল কখনো -বা । 'গান্ধারীর আবেদন' -এর (১৮৯৮) মতো নাট্যকবিতার এইসব অংশ মনে পড়বে অনেকের, বনপথযাত্রী পাণ্ডবদের যেখানে বলছিলেন গান্ধারী সেই মহাদুঃখ হবে মহৎ সহায় তোমাদের । সেই দুঃখে রহিবেন ঋণী ধর্মরাজ বিধি, যবে শুধিবেন তিনি নিজহস্তে আত্মঋণ তখন জগতে দেব নর কে দাঁড়াবে তোমাদের পথে ।

৩৮

A Dream Play এসব ঋণশোধের কিছু পরবর্তী ঘটনা । কিন্তু সেকথা ছেড়ে দিয়ে, দুঃখ শব্দটাকে একটু ভিন্নভাবে লক্ষ করা দরকার । কাকে রবীন্দ্রনাথ ভাবছিলেন দুঃখ বা ত্যাগ? স্ট্রিন্ডবার্গের sufferingই -বা কোনটা?

কিসের দুঃখ, কিসের ত্যাগ 'শারদোৎসব থেকে আরম্ভ করে ফাল্গুনী পর্যন্ত যতগুলি নাটক লিখেছি, যখন বিশেষ করে মন দিয়ে দেখি তখন দেখতে পাই প্রত্যেকের ভিতরকার ধুয়াটা ঐ একই । ৩৯ রবীন্দ্রনাথের এই বাক্যটি থেকে 'ধুয়া' শব্দের ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রতাপবাবু ঋণশোধ । বাক্যটির পরে প্রথমেই 'শারদোৎসব' -এর বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথকে বলতে হয়েছে ঋণশোধ, তবে বাক্যের 'ঐ' শব্দটি স্বভাবতই নির্দেশ করছে তার আগের কথাটিকে, যেখানে তিনি লিখেছিলেন 'রুদ্রকে বাদ দিয়ে যে প্রসন্নতা, অশান্তিকে অস্বীকার করে যে শান্তি, সে তো স্বপ্ন, সে তো সত্য নয়'৪০ আর তার পরেই প্রয়োগ করেছিলেন 'গীতাঞ্জলি'র গোটা গানটি 'বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি, সে কি সহজ গান । '

তাঁর সাহিত্যে কেবল শান্তির কথা মাধুর্যের কথা বলা আছে, শক্তির কথা নেই-এই ধারণার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ওপরের ওই শব্দগুলি । তিনি দেখাচ্ছিলেন সেই অশান্তি বা দুঃখবরণটাই তাঁর নাটকের ধুয়ো; 'শারদোৎসব' -এর পর 'রাজা' বা 'অচলায়তন' -এর কথা বলতে গিয়ে যে ব্যথা বা দুঃখ বা রুদ্রের কথা তোলেন তিনি, সেইটেই এর লক্ষ্য । কিন্তু, এই দুঃখসাধনার উচ্চারণ থেকে প্রতাপবাবু বুঝতে পারছেন যে 'শারদোৎসব' লিখবার আগে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই A Dream Play -র সঙ্গে পরিচিতি ছিলেন । Suffering যে redemption আর death deliverance, বা greatest suffering -এর মধ্যে supreme joy -কে বোধ করতে পারা -ই যে প্রকৃ ত ভালোবাসা, এ রকম কথা স্ট্রিন্ডবার্গ আগেই না বলে দিলে কী করে রবীন্দ্রনাথ লিখতে পারেন উপনন্দর সাধনার কথা কিংবা অনেক পরে কীভাবেই বা বিশু বলতে পারে 'কাছের পাওনাকে নিয়ে বাসনার যে দুঃখ তাই পশুর, দূরের পাওনাকে নিয়ে আকাঙ্ক্ষার যে দুঃখ তাই মানুষের'? বিশু যে বলেছিল 'আমার সেই চিরদুঃখের দূরের আলোটি নন্দিনীর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে' সেটাই -বা কী করে বলা সম্ভব স্ট্রিন্ডবার্গ ছাড়া? যুক্তি অকাট্য । তবে, মুশকিল এই যে, রবীন্দ্রনাথের অনুরূপ অজস্র উচ্চারণ থেকে বিক্ষিপ্ত দুচারটি উদাহরণ যে -কোনো সময়েই মনে পড়তে পারে কারো । ইংরেজি অনুবাদ যখনই হোক, সুইডিশ ভাষায় A Dream Play ছাপা হয়েছিল ১৯০২ সালে, সুইডেনের খুবই জনপ্রিয় নাট্যকার হওয়া সত্বেও ১৯০৭ সালে এর প্রথম অভিনয় সমূলে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, ওদেশেই এর আদর আরেকটু পরবর্তী ঘটনা । তাহলেও, এখানে আমরা ১৯০২ সালের সীমারেখাটাকেই মনে রাখব । সেই সীমানার আগে রবীন্দ্রনাথের মন বইত এইভাবে, এইভাবে বলতেন তিনি দুঃখসামর্থ্যের কথা ১. কঠোর দুঃখের তপস্যায় প্রেমের স্বর্গীয় ভাব প্রস্ফু টিত হইয়া উঠে । ফাল্গুন ১২৮৮৪১ ২. পথের মধ্যে কষ্ট আছে, দুঃখ আছে বটে, কিন্তু তবু আমরা ভালোবাসিয়া চলিতেছি । সকল সময়ে আমরা গ্রাহ্য করি না বটে, কিন্তু ভালোবাসা সহস্র দিক হইতে তাহার বাহু বাড়াইয়া আছে । অগ্রহায়ণ ১২৯২৪২ ৩. ছোটো দুঃখের কাছে আমরা কাপুরুষ, কিন্তু বড়ো দুঃখ আমাদের বীর করে তোলে, আমাদের যথার্থ মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করে দেয় । ৩০ মার্চ ১৮৯৪৪৩ ৪. দুঃখের মধ্যে একটা আন্তরিক বন্ধনমুক্তি দেখা যায় । ১২ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪৪৪

৫. ক্ষণিক জীবনটাকে পরাভূ ত করেই একটা আনন্দ পাই, দুঃখকে গলার হার করে নিয়ে প'রেই একটা উল্লাস পাই... । ২৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪৪৫ ৬. আমি জানি তু মি আমার জন্যে অনেক দুঃখ পেয়েছ, এও নিশ্চয় জানি যে আমারই জন্যে দুঃখ পেয়েছ বলে হয়ত একদিন তার থেকে তু মি একটি উদার আনন্দ পাবে । ভালোবাসায় মার্জনা এবং দুঃখস্বীকারে যে সুখ, ইচ্ছাপূরণ ও আত্মপরিতৃ প্তিতে সে সুখ নেই । জুন ১৮৯৮৪৬ কিন্তু উদাহরণের এই সংখ্যাকে আরো অনেক প্রসারিত করে লাভ নেই । বরং দ্বিতীয় জরুরি প্রশ্নটায় আমরা পৌঁছতে পারি । দুঃখ বা ত্যাগ বা মুক্তি বলতে রবীন্দ্রনাথ যা ভাবতেন, সেইটেই কি স্ট্রিন্ডবার্গের ধারণা? কী আছে A Dream Play -র মধ্যে? 'দেবগণের মর্ত্যে আগমন' -ধরণে ইন্দ্রকন্যা অ্যাগনেস পৃথিবীতে নেমে এসেছে এর পরিচয় জানতে, ‘What it is really like for human beings’ । দেখতে দেখতে তার কেবলই মনে হয়েছে, ‘Human beings are to be pitied’ ‘Human life is pitiful’ ‘It is misery to be human’ ‘Men are not angels but pitiable creatures' ! নাটক জুড়ে আরো অজস্র এমন উদাহরণ । ভালোবাসায় মুক্তি আছে ভেবে কন্যকাটি বিয়ে করে বসে Lawyer -কে কিন্তু অল্প পরেই দেখা যায় প্রতিমুহূর্তে তারা লড়াই করেছে যৎ -সামান্য ছুতো নিয়ে, টের পাচ্ছে যে ‘Life together is a torment. One’s pleasure is the other’s pain,’ তারপর এসে যায় বিচ্ছেদ । পরপর তিনজনকে বিয়ে করে তিনজনেরই সঙ্গে অত্যল্পকালের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে অপরা নারীদ্বেষী স্ট্রিন্ডবার্গের যে ধারণা হয়েছিল জীবনবিষয়ে, সমালোচকেরা ধরে নেন যে তার প্রতিফলন আছে ওই দাম্পত্যছবিতে । যে -দাম্পত্যে শ্রীবিলাস -দামিনীর মতো কারো মনে হতে পারত 'দিনগুলি যে গেল সে হাঁটিয়াও নয়, ছুটিয়াও নয়, একেবারে নাচিয়া চলিয়া গেল,৪৭ তার থেকে খানিকটা দূরেরই এই ছবি । চকিত আবির্ভাবে এখানে একবার মাত্র সুখের কথা উচ্চারণ করে এক নবদম্পতি, কিন্তু সে -সুখ অচিরে নষ্ট হতে পারে ভেবে পাঁচটি মাত্র সংলাপেই তারা পৌঁছে যায় এই সিদ্ধান্তে ‘Die! Yes, let us die. For I fear happiness, the deceiver’, আর তার ফলে এখানে কেউ -বা বলে ‘How brief are joy and happiness,’ কেউ বলে ‘we are all to be pitied-all of us’ এবং অ্যাগনেস বোঝে যে ‘Life is evil! mankind is to be pitied!’ মনে রাখতে হবে যে এটা জীবনের বা সমাজের কোনো বিশেষ অবস্থানের কথা নয়, সাধারণভাবেই সামগ্রিক জীবন বিষয়ে স্ট্রিন্ডবার্গের এই গ্লানিবোধ আর ধিক্কার ।

এই হচ্ছে তবে দুঃখের একটা ধারণা, এই হচ্ছে জীবনবিষয়ে একরকমের ধারণা এ -জীবন থেকে মুক্তি পাবার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে স্ট্রিন্ডবার্গের মানুষেরা ‘Deliver us for Thy mercy’s sake’ ‘Save Thy children, O Lord, and be not wrathful against us’ । আজ নাকি আমাদের বুঝতে হবে যে এই ছবি থেকে তাঁর সমস্ত নাটকের জীবনবোধ সংগ্রহ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘Life is evil’ বা ‘Human life is pitiable’ -ধরণের বীভৎস চিন্তার সম্পূর্ণ বিপরীতে যাঁকে বলতে হয়েছে সারাজীবন 'শত দুঃখেরই দলে তাঁর সোনার পদ্ম সংসারে ফু টে উঠেছে'৪৮ কিংবা 'আকাশ একেবারে রাঙা, ফু লগন্ধের অভ্যর্থনায় বাতাস একেবারে পরিপূর্ণ৪৯ আমি সমস্ত দেখতে পাচ্ছি । যতই সে আসছে দেখছি, আমার বুকের ভিতরে ভারি খুশি হয়ে হয়ে উঠছে'৫০ বা 'তু মি এসে আমার মুখের দিকে এমন করে চাইলে, আমি বুঝতে পারলুম আমার মধ্যে এখনো আলো দেখা যাচ্ছে । '৫১ দায়িত্ব বা কর্তব্যের বিষয়ে কী বলে A Dream Play ? কাকে বলে Duty? উত্তর হচ্ছে, Everything you abominate । কিন্তু, প্রশ্ন করে কন্যকা, Are there no pleasant duties? Lawyer. They become pleasant when they are done. Daughter. When they no longer exist. So duty is altogether unpleasant. What they we can enjoy? Lawyer. What one enjoys is sin. এই হচ্ছে সেই নাটক, যার থেকে না কি 'শারদোৎসব' -এর উপনন্দকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল । ‘Men have an instinctive dread of another’s good fortune’, এই বাণী থেকে তৈরি হতে পেরেছিল বিশু -রঞ্জনের 'রক্তকরবী'! তার অভিজ্ঞতায় স্ট্রিন্ডবার্গের মেয়েটি এই বোধে এসে পৌঁছয় যে ‘Earth is not clean, life is not just’ । এ -নাটকে কবির প্রশ্ন ‘Why are we born like animals!’ আর এই হলো তার নৈতিক উত্তর Every pleasure you enjoy brings to all your sorrow, Yet your sorrow gives no gladness So sorrow, sorrow upon sorrow on your way-untill you’re dead and then, alas give other’s bread.

তাহলে, দুর্বোধ্য এই পৃথিবীর এমনতর অভিশাপ থেকে মানুষ মুক্তি পাবে কী ভাবে? প্রশ্ন করে মেয়েটি । মানুষের জগতে সে দেখে ‘each one of them is good, but as soon as they are together they fight and turn into devils’ । ফলে সে এবার শেখায় যে পৃথিবী হলো ব্রহ্মের মায়া, আর ‘this mingling of the divine element with the earthly was the fall from heaven’! তাই গোটা জীবনটা হলো মরীচিকা, প্রতিফলন, স্বপ্নচ্ছায়া । এই বোধ দিয়ে এবং এই বোধ নিয়ে স্বর্গে ফিরে যাবে সে । যাবার আগে কবি যখন জিজ্ঞেস করে তাকে What you suffered most down here’, স্ট্রিন্ডবার্গের ইন্দ্রনন্দিনী তখন অকাতরে জানায় ‘from living!’ নাটকের প্রায় শেষ মুহূর্তে এর পরে যখন আমরা শুনি ‘Surely suffering is redemption and death deliverance,’ দমচাপা গর্ত থেকে উঠতে উঠতে তখন আমরা বুঝতে পারি কাকে -বা বলে suffering আর কাকে deliverance, বুঝতে পারি কেন লুকাসের মতো সমালোচকদের এই নাটক পড়ে বলতে হয় ‘But I frankly confess to finding its long laments rather wearisome, and to doubting whether life is long enough to read such things, at all events more that once ...’৫২ কেনই -বা এই নাটকের অভিনয় দেখে কেনেথ টাইনানের মতো কাউকে প্রশ্ন তু লতে হয় ‘If a man tells me something I believe to be an untruth, am I forbidden to do more than congratulate him on the brilliance of his lying?’৫৩ আর, রবীন্দ্রনাথ, হ্যাঁ, তিনিও বলেছিলেন দুঃখের কথা, ত্যাগের বা মুক্তির কথা । অলজ্জভাবেই আধ্যাত্মিক সাধনার কথা বলেছিলেন তিনি শান্তিনিকেতনের মন্দিরভাষণে, 'শারদোৎসব' রচনার প্রায় সমকালে । কিন্তু কী কথা বলছিলেন তখন? কোন মুক্তি, কিসের থেকে মুক্তি? বলছিলেন- যেন তা বলতে পারতেন স্ট্রিন্ডবার্গের নায়িকাকেই যেমন ঘর দিয়ে কোনো দূরদেশে যাওয়াকে অন্ধকারমুক্তি বলে না, ঘরের দরজা খুলে দেওয়া [ কে ] ই বলে অন্ধকার -মোচন, তেমনি জগৎসংসারকে ত্যাগ করাই মুক্তি নয়; পাপ স্বার্থ অহংকার জড়তা মূঢ়তা ও সংস্কারের বন্ধন কাটিয়ে, যা দেখছি একেই সত্য করে দেখা, যা করছি একেই সত্য করে করা, যার মধ্যে আছি এরই মধ্যে সত্য করে থাকাই মুক্তি ।

৫৪

তাহলে দুঃখের এই পৃথিবী ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে মুক্তি নেই । 'কর্মকে পরিত্যাগ করাই মুক্তি নয়, কর্মকে আনন্দোদ্ভব কর্ম করাই মুক্তি । '৫৪ তাহলে ত্যাগের কথা ওঠে কেন? কী ত্যাগ করব? কেমন করে ত্যাগ করব? 'সংসারের মাঝখানে থেকে অন্তত

একটা মঙ্গলের যজ্ঞ আরম্ভ করে দাও'৫৫, এই হলো রবীন্দ্রনাথের উত্তর । মঙ্গলের যজ্ঞ করতে গেলেই ছাড়তে হয় স্বার্থের সীমা, আত্মকেন্দ্র । এই ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে একটা দুঃখ আছে, কিন্তু সেই দুঃখ বইবার শক্তিই হলো মানবিক, এইরকম ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ । ভেবেছিলেন কেবলমাত্র নিজের মধ্যে নহে, দুঃখকে তাহার সেই বিরাট রঙ্গভূ মির মাঝখানে দেখিতে হইবে যেখানে সে আপনার বহ্নির তাপে বজ্রের আঘাতে কত জাতি কত রাজ্য কত সমাজ গড়িয়া তু লিতেছে;৫৬ এসব সূত্রে কখনো ব্রহ্মেরও কথা তোলেন তিনি, কিন্তু তোলেন এইভাবে । ...এই জগৎ তিনি প্রকাশ করলেন কেন? বাইরে থেকে কোনো প্রকাণ্ড পীড়া জোর করে তাঁকে প্রকাশ করিয়েছে? মায়া নামক কোনো একটা পদার্থ ব্রহ্মকে একেবারে অভিভূ ত করে নিজেকে প্রকাশমান করেছে? সে তো হতেই পারে না । তাই উপনিষৎ বলেছেন, আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি, এই যে প্রকাশমান জগৎ এ আর কিছু নয়, তাঁর মৃত্যুহীন আনন্দই রূপধারণ করে প্রকাশ পাচ্ছে । আনন্দই তাঁর প্রকাশ, প্রকাশই তাঁর আনন্দ ।

৫৭

ইন্দ্রকন্যার ‘Fall from heaven’ জাতীয় দীর্ঘশ্বাসের অত্যন্ত বিপরীত এই ধারণার জন্যই রবীন্দ্রনাথের নাটকে ত্যাগব্রতী চরিত্রগুলি সংসারের জন্যে সমস্ত দুঃখ আত্মস্থ করে নিয়েও বলতে পারে 'সুন্দর জগৎ' (যেমন বলেছিল জয়সিংহ) কিংবা 'সুন্দর এই পৃথিবী' (যেমন বলেছিল অভিজিৎ) । ত্রিপুরার মঙ্গলের কথা ভেবে আত্মবিসর্জন করে জয়সিংহ, শিবতরাই (আর উত্তরকূ টেরও) মঙ্গলের কথা ভেবে প্রাণ দেয় অভিজিৎ । সেই মঙ্গলেরই দিকে যাবার জন্য 'রক্তকরবী'র বিশু কারাবরণ করে নির্ভয়ে, বা রাজাকে বলতে পারে নন্দিনী 'আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার লড়াই । ' লক্ষণীয় যে মৃত রঞ্জনকে দেখবার পরেও নয়, নন্দিনীর মুখে স্পর্ধিত এই উচ্চারণ উঠে এসেছিল কিশোরের মৃত্যুসংবাদ জানবার পর, যক্ষপুরীর এই শেষ পরিচয় জানবার পর । আর, এর পর যখন সর্দারদের উদ্যত বর্শা লক্ষ করে সকলেই ছুটে যেতে থাকে তার দিকে, দুঃখ বা ত্যাগ বা মুক্তির তখন একটা ভিন্ন অর্থ পাওয়া যায়, জীবনকে -ধিক্কার -দেওয়া -ইন্দ্রকন্যার -মুক্তির একেবারে বিপরীত সেই অর্থ । 'রক্তকরবী'র শেষ দিকে শুধু 'নন্দিনীর জয়! নন্দিনীর জয়!' ধ্বনি আছে, বলেছেন প্রতাপবাবু । বিশুর গলায় তার ঠিক আগের উচ্চারণই যে 'আয় রে ভাই, এবার লড়াইয়ে চল' সেটা বলতে অবশ্য ভু লে গেছেন তিনি । ভু লেছেন এই সংলাপটিও 'আমাদের কারিগররা বন্দীশালা ভেঙে ফেলেছে । তারা ঐ চলেছে লড়তে । ' 'নাটকটির যে ঠে

'প্রস্তাবনা' থেকে বহু অংশ তাঁর আলোচনায় উঠে এসেছে বারবার, নাট্যপরিণাম বিষয়ে সেখানকারও একটি বাক্যকে তিনি ভু লে গেছেন কেবলই; ভু লে গেছেন যে নাট্যকারের নিজস্ব ধারণায় এই নাটকে 'কলিযুগের রাক্ষসের সঙ্গে কলিযুগের বানরের যুদ্ধ ঘটবে, এমনও একটা সূচনা আছে । ' সেইজন্যে তাঁর মনে হয়েছে শম্ভু মিত্র একেবারে বানিয়ে বানিয়ে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিলেন তাঁর প্রযোজনায় ; সেইজন্যে উৎপল দত্তের প্রসঙ্গ এনেও তাঁর মন্তব্য* লক্ষ করতে চাননি যে 'রক্তকরবী'তে বায়বীয় সব তাৎপর্য খুঁজে মরুক ভাববাদী পণ্ডিতের দল',৫৮ কিন্তু এ নাটক তু লে ধরেছে 'এ যুগের শ্রেণীসংগ্রামের সারবস্তুটিকে যা শুধু মগজে আঘাত করে না, হৃদয় আলোড়িত করে',৫৮ সেইজন্যে তিনি গণ্য করেন না নাট্যরচনার একেবারে সমকালীন এইসব প্রতিক্রিয়া যে এর মধ্যে কেউ পেতে পারেন ‘Exploitation of the labourer by the capitalist slave driver’,৫৯ পেতে পারেন ‘the entire degrading, demoralising and despicable paraphernalia of government by brute force’ । ৫৯ এই পাশব শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য যে -লড়াইয়ের দুঃখ মেনে নিতে হয় 'রক্তকরবী' নাটকে, A Dream Play -র ‘suffering’ থেকে সেটা নিশ্চয় অনেক অনেক দূরের অভিজ্ঞতা ।

বিন্যাসে কত মিল 'যেখান থেকে নাটকের কনটেন্টের অনেকখানি এসেছে, সেখান থেকেই ফর্মেরও বেশ কিছু খুঁটিনাটি আসবে এটাই স্বাভাবিক' এবং সেই কারণে 'রক্তকরবী'র নাট্যবিন্যাসটাও রবীন্দ্রনাথ স্ট্রিন্ডবার্গের নাটক থেকেই পেয়েছিলেন, এই হচ্ছে প্রতাপবাবুর আরেক সিদ্ধান্ত । সিদ্ধান্তটির অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো এইটে দেখানো যে ওই 'নাটকেও কোন যবনিকা পড়বে না, প্রয়োজনে মঞ্চের অর্ধেকটা অন্ধকার রাখা হবে, বা মঞ্চের পেছনের দৃশ্যপট সরে যাবে, কিন্তু মঞ্চসজ্জা অপরিবর্তিত থাকবে পুরো নাটকে । ' তাঁর কথার প্রমাণ হিসেবে A Dream Play -র নাট্যনির্দেশ থেকে এই উদ্ধৃ তি দাখিল করেন প্রতাপবাবু ‘On each side of the stage are stylized representations of interior, architecture and landscape which remain unchanged throughout the play’ । কাজেই, এ তো বোঝাই যাচ্ছে কোথা থেকে রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন এই বিবরণ যে 'প্রাসাদের সেই জালের আবরণ এই নাটকের একটিমাত্র দৃশ্য । সেই আবরণের বহির্ভাগে

সমস্ত ঘটনা ঘটিতেছে । ' প্রতাপবাবুর ভাষায়, A Dream Play -তেও 'ঐ একই মঞ্চনির্দেশ রয়েছে' । ঠিক, খুবই এক । কিন্তু প্রতাপবাবুর একটি বাক্যাংশ হলো 'মঞ্চের পেছনের দৃশ্যপট সরে যাবে । ' মঞ্চের পেছনের দৃশ্যপট সরে গিয়েও স্ট্রিন্ডবার্গের নাটকে মঞ্জসজ্জা ঠিক একই রকম থাকছে কী করে, এ -প্রশ্নটা উঠতেও পারে । উত্তরের খোঁজে মূল নাটকটির দিকে যদি তাকাই, দেখতে পাব, নাট্যসূচনায় কয়েকটি বাক্যের মধ্যে ‘on each side of the stage’ বিষয়ে উদ্ধৃ ত ওই নির্দেশটি থাকলেও স্ট্রিন্ডবার্গ তাঁর রচনায় পূর্ণ মঞ্চনির্দেশ হিসেবে প্রয়োগ করেছেন আরো প্রায় শ' খানেক লাইন । তার সবটা এখানে তু লে আনা নিতান্ত অন্যায় হবে, নমুনা হিসেবে কয়েকটি মাত্র লক্ষ করতে পারেন পাঠক ১. They go towards the background which slowly vanishes to the sides, disclosing a simple bare room with a table and a few chairs... ২. Voices are now heard from behind the dividing screen, which is drawn aside as the lights go up on the other set : a homely living room... ৩. ...The new scene shows an old derelict wall. In the middle of the wall a gate opens on an alley leading to a green plot where a gaint blue monkshood is growing... ৪. The stage is blacked out and changes to the interior of the Church ...The new background shows only a giagantic organ, with a mirror over the keyboard... ৫. The scene changes to a very simple room adjoining the Lawyer’s office. On the right is a large curtained double bed, close to it a window with double planes; on the left a stove and kitchen utensils... ৬. The scene changes. The bed with its hangings is transformed into a tent, the stove remaining. The new background shows a beautiful wooded shore, with beflagged landing stages and white boats, some with sails set. Among the trees are little Italianesque villas, pavilions, kiosks and marble statues...

৭. A white boat shaped like a dragon, glides into the Strait. It has a light silken sail on a glided yard, and a golden mast with a redrose pennon... ৮. The stage is blacked out and the scene changes. The whole landscape is in winter dress with show on the ground and on the leafless trees... ৯. ...The front wall of the yellow house vanishes. Boys are sitting on forms... ১০. The scene changes to a Mediterranean resort. In the background are villas, a Casino with a terrace, and a blue srip of sea... এবং এইরকম আরো আরো আরো । এখন, এই -যে থেকে -থেকেই নাট্যকারকে বলতে হচ্ছে The scene changes কিংবা The new scene shows বা The new background shows, এই -যে সেসব নতু ন দৃশ্যের খুঁটিনাটি হাজার বিবরণ কেবলই জানাতে হচ্ছে তাঁকে, ওই বিশদ পরিবর্তমান মঞ্চনির্দেশ জানবার পরও আমাদের কি বুঝতে হবে যে 'রক্তকরবী'র 'একটিমাত্র দৃশ্য' জালের আবরণের বহির্ভাগের ধারণাটা পৌঁছতে পেরেছিল ওই নাটকটির জন্যই? স্ট্রিন্ডবার্গের রচনাজীবন যে শুরু হয়েছিল ন্যাচারালিজমের আবহে, তার রেশটা যেন থেকে গেছে নতু ন ধাঁচের নাটকে ওই নির্দেশগুলির মধ্যে । আর, প্রায় যৌবন থেকেই, ওই ধরণের নাট্যনির্দেশ বিষয়ে সম্পূর্ণ ঔদাসীন্যই ছিল রবীন্দ্রনাথের মজ্জাগত । পরে যখন একদিন দৃশ্যাঙ্কবিভাগের চলতি পদ্ধতি ভাঙতে ভাঙতে 'মুক্তধারা' বা 'রক্তরকবী' পর্যন্ত পৌঁছতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ, পৌঁছন প্রায় মঞ্চনির্দেশহীন একটানা ঘটনাপ্রবাহে, তখন স্ট্রিন্ডবার্গের কথা না ভেবে তাঁর চেতনায় যাত্রাপদ্ধতির আভাসের কথা তু ললে সেটা ততখানি পরিহাসযোগ্য বিষয় না -ও হতে পারে, যতটা ভাবেন প্রতাপবাবু । তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধে দেশবিদেশের অনেক লেখারই উল্লেখ করেছেন তিনি, কিন্তু কখনোই গণ্য করেননি মঞ্চবিষয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি অতিখ্যাত প্রবন্ধকে । সুইডিশ ভাষায় A Dream Play ছাপা হয় যে -বছরে, সেই ১৯০২ সালেই রবীন্দ্রনাথ ছেপেছিলেন তাঁর প্রবন্ধ, 'রঙ্গমঞ্চ' । বহু -ব্যবহৃত বহুল -উদ্ধৃ ত ওই লেখাটিকে রবীন্দ্রনাথ বলছিলেন : ভরতের নাট্যশাস্ত্রে নাট্যমঞ্চের বর্ণনা আছে । তাহাতে দৃশ্যপটের কোনো উল্লেখ দেখিতে পাই না । তাহাতে যে বিশেষ ক্ষতি হইয়াছিল, এরূপ আমি বোধ করি না ।

কলাবিদ্যা যেখানে একেশ্বরী সেইখানেই তাহার পূর্ণগৌরব । ... যাহারা বিশ্বাস করিবার জন্য, আনন্দ করিবার জন্য আসিয়াছে, তাহাদিগকে এত ঠকাইবার আয়োজন কেন? তাহারা নিজের কল্পনাশক্তি বাড়িতে চাবিবন্ধ করিয়া আসে নাই । কতক তু মি বোঝাইবে কতক তাহারা বুঝিবে, তোমার সহিত তাহাদের এইরূপ আপোষের সম্বন্ধ । ... মালিনী যখন তাহার পুষ্পবিরল বাগানে ফু ল খুঁজিয়া বেলা করিয়া দিতেছে তখন সেটাকে সপ্রমাণ করিবার জন্য আসরের মধ্যে আস্ত আস্ত গাছ আনিয়া ফেলিবার কী দরকার আছে-একা মালিনীর মধ্যে সমস্ত বাগান আপনি জাগিয়া উঠে । ... ভাবুকের চিত্তের মধ্যে রঙ্গমঞ্চ আছে, যে রঙ্গমঞ্চে স্থানাভাব নেই । সেখানে জাদুকরের হাতে দৃশ্যপট আপনি রচিত হইতে থাকে । সেই মঞ্চ, সেই পটই নাট্যকারের লক্ষ্যস্থল, কোনো কৃ ত্রিম মঞ্চ ও কোনো কৃ ত্রিম পট কবিকল্পনার উপযুক্ত হইতে পারে না ।

৬০

স্ট্রিন্ডবার্গের নাটক থেকে উদ্ধৃ ত নাট্যনির্দেশগুলি রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনার একেবারে বিপরীতেই চলতে থাকে, সেটা বুঝতে আমাদের অসুবিধে হবার কথা নয় । এই ভাবনাসূত্রেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যাত্রার কথা, বলেছিলেন :: আমাদের দেশের যাত্রা আমার ওইজন্য ভালো লাগে । যাত্রার অভিনয়ে দর্শক ও অভিনেতার মধ্যে একটা গুরুতর ব্যবধান নাই । পরস্পরের বিশ্বাস ও আনুকূ ল্যের প্রতি নির্ভর করিয়া কাজটা বেশ সহৃদয়তার সহিত সুসম্পন্ন হইয়া উঠে ।

৬০

বলেছিলেন বাস্তব সত্যকেই একান্ত করে গণ্য করবার কোনো কারণ নেই, কারণ নেই জটিল ভার তৈরি করবার । 'প্রাচ্যদেশের ক্রিয়াকর্ম খেলা -আনন্দ সমস্ত সরল -সহজ'৬০ বলে সেই আদর্শটিকেই লক্ষ্যে রাখা দরকার । এইরকম মনে হয়েছিল তাঁর । এই দৃষ্টিভঙ্গির যাথার্থ্য নিয়ে কেউ প্রশ্ন তু লতে পারেন, সে হলো ভিন্ন বিচার । কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল বলেই একটা সহজ সরল খেলা -আনন্দের পরিবেশ তৈরি হতে পেরেছিল কয়েক বছর পরে লেখা 'শারদোৎসব' নাটকে । 'বিসর্জন' (১৮৯০) -এর পর থেকেই পঞ্চাঙ্কবিন্যাসের নাট্যধারণা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন তিনি, পরের বছরেই যে -'চিত্রাঙ্গদা' লিখেছিলেন তার কাব্যগ্রন্থ সংস্করণে (১৮৯৬) ছিল না কোনো দৃশ্যসংখ্যা, একবার 'অরণ্যে শিবালয়' একবার 'তরুতলে অর্জুন ছাড়া ছিল না অন্য কোনো

মঞ্চ বা পরিবেশ -নির্দেশ । মধ্যবর্তী 'রাজা' -কে (১৯১০) ছেড়ে দিলে, 'শারোদোৎসব' (১৯০৮) থেকে 'রক্তকরবী' (র. ১৯২৩) পর্যন্ত, দৃশ্যসংখ্যা কমিয়ে নেবার দিকে তাঁর ঝোঁকটা স্পষ্টই লক্ষ করা যায়, আর সে ঝোঁকের সূচনা ছিল 'চিত্রাঙ্গদা'তেই । স্থান বা কালের বিন্যাসে 'রক্তকরবী' দাঁড়িয়ে আছে A Dream Play -এর একেবারে বিপরীত বিন্দুতে । 'রক্তররবী'তে একটাই, সুনির্দিষ্টভাবে নাট্যকার -চিহ্নিত একটাই পট প্রাসাদের জালের আবরণের বহির্ভাগ । আর স্ট্রিন্ডবার্গের নাটকে, নির্দিষ্ট করেই বলে দেন নাট্যকার, পটের পর পট পালটায় । তার কয়েকটি মাত্র উদাহরণ আমরা দেখেছি আগে । দুর্গের বাইরে দুর্গের ভিতরে, অপেরা হাউসে, চার্চে, সমুদ্রে, গুহায়, পাতাভরা অথবা পাতাহারা গাছের সামনে-মুহুর্মুহু এই স্থানিক বদলের মধ্য দিয়ে চলছে নাটক । কখনো কখনো সেটা বোঝাবার জন্য হয়তো জিনিসপত্র না পালটালেও চলবে, যেমন, আগে যেটা ছিল ‘lime -tree hatstand’ পরে সেটাই হলো ‘candelabra’ কিংবা ‘The barrier now serves as the chancel rail’ । কিন্তু একই পটভূ মিতে ঘটছে এমন কোনো মায়াই রাখতে চাননি স্ট্রিন্ডবার্গ, যেমন একই কালভূ মি দেখাবারও কোনো গরজ তাঁর নেই । তাই বলেই দেন নাট্যকার, এবার অফিসারের ‘hair is grey’ এবং ‘grey bread’, দুপৃষ্ঠা পরেই বলে ‘He is old and white haired’, কখনো -বা ‘now middle -aged’ । নাটক চলতে চলতে হঠাৎ অফিসার পৌঁছে যায় তার ছেলেবেলায় । তার মা -বাবা তখন বলতে থাকেন সেই পুরোনো দিনের কথা । এইরকমই অনেক, আর 'রক্তকরবী'তে জালের আবরণের বহির্ভাগে একটিমাত্র দৃশ্যের মতো কালপ্রবাহ আছে একটিমাত্র দিনের মধ্যে বাঁধা, ধ্বজাপূজার একটি দিন । তবে, 'রক্তকরবী'তে স্থান বা কালের এই ঐক্য নিশ্চয় আপাত -ঐক্য । ইচ্ছে করলে আমরা এর মধ্যে কল্পনা করে নিতে পারি অনেক টু করো অঞ্চল, অনেক টু করো সময় । কেননা, নাট্যকার যেমনই বলে দিন না কেন, 'ভাবুকের চিত্তের মধ্যে রঙ্গমঞ্চ আছে, সে রঙ্গমঞ্চে স্থানাভাব নাই । সেখানে জাদুকরের হাতে দৃশ্যপট আপনি রচিত হইতে থাকে । ' সেই রচনায় যে বাধা দেয় না 'রক্তকরবী' এইখানেই তার বৈশিষ্ট্য । 'রক্তররবী'তে ঘটনা চলছে স্রোতের মতো, একটানা; A Dream Play কতগুলি খণ্ড খণ্ড ছবির একত্র -সংযোজন । অনেকসময়েই তার একের সঙ্গে অন্যের কোনো 'কাহিনী'গত সম্পর্কই নেই, সম্পর্ক শুধু এইটু কু যে পার্থিব জীবনের নানা ধরণের অভিজ্ঞতার নানা ধরণের দিনযাপনের সঙ্গে পরিচিতি হচ্ছে ইন্দ্রকন্যা । পরিচয় করিয়ে দেবার কাজে 'ভাবুকের চিত্তের' ওপর বড়ো -একটা নির্ভর করতে হচ্ছে না স্ট্রিন্ডবার্গকে, সবটু কু ই তিনি বলে দিচ্ছেন বিস্তৃ ত ব্যাখ্যায় । কেবল, ঝাঁপ দিয়ে এক -টু করো থেকে অন্য -টু করোতে চলে যাচ্ছি কেন, তার কৈফিয়ত হিসেবে তিনি টেনে আনেন 'স্বপ্ন' শব্দটাকে, স্বপ্নের মধ্য দিয়ে ঠা

দেখান বাস্তবকে । স্বপ্নের এই পারম্পর্যহীন কাঠামোটা প্রতিমুহূর্তেই তাই লেগে থাকে তার গায়ে ।

পথের শুরু কোথায় রবীন্দ্রনাথের নাটকে পথের ব্যবহার নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন করা হয় এটা প্রতাপবাবুর আরেক বিস্ময় । নাটকে পথের প্রয়োগে যে দেশীয় জীবনের একটা ছাঁচও উঠে আসে, এ -ধরণের কথা রটানোর জন্য টমসন এবং প্রমথনাথ বিশীর সঙ্গে আমাকেও তিনি অনেকটা দায়ী করে বসেন । লেখেন যে টমসন 'একটি বেশ মজাদার আবিষ্কার করে ফেলেন । সেটি হলো এই যে রবীন্দ্রনাথের রূপকনাটককে পথ -এর যে ব্যাপক ব্যবহার রয়েছেসেটির প্রেরণা রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন ‘the drifting pageant of an Indian Road থেকে' আর, তারপর নাকি আমারই 'পথ প্রতীক ও পটভূ মি' (১৯৬৫) প্রবন্ধটির 'ভাষাগত লালিত্য ও মাধুর্যের প্রতিফলিত গরিমায় টমসনের Indian Road -এর তত্বটি এক আশ্চর্য বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছে । ' অথচ, ওই তত্বের তো সত্যিই কোনো ভিত্তি নেই, রবীন্দ্রনাটকে পথ যতটু কু আসে তাও তো সম্ভব হয় কেবল স্ট্রিন্ডবার্গের কারণেই! A Dream Play -তে নয় বটে, তবে স্ট্রিন্ডবার্গের The Road to Damascus -এর দৃশ্যকল্পনার মধ্যে 'পথ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে', মনে করিয়ে দেন প্রতাপবাবু । স্ট্রিন্ডবার্গ থেকেই যখন পথ -ব্যবহারের কৌশলটা রবীন্দ্রনাথ শিখে যান, অবোধের মতো আমরা তখন ভাষার ছটায় পাঠকদের মন ভু লিয়ে একটা 'আজগুবি তত্ব' তৈরি করি কেন, এই হচ্ছে প্রতাপবাবুর অভিযোগ । 'পথ প্রতীক ও পটভূ মি' নামে আমার সেই লেখাটিতে Indian Road বা ভারতীয় পথ কথাটা অবশ্য একবারও উচ্চারণ করিনি, তবে সংগত কারণেই টমসনের নামটা তু লতে হয়েছিল ওখানে । কী বলেছিলেন টমসন? সচেতনভাবেই রবীন্দ্রনাথ এক দেশীয় ঐতিহ্যের চর্চা করতে চাইছিলেন, এগোতে চাইছিলেন লোকনাট্যের আঙ্গিকের দিকে, আর ‘from this came a great merit, a deeply interpretative quality in his plays which give the drifting pageant of an Indian road’৬১ এই তিনি বলেছিলেন । এতেই অবাক হয়ে প্রতাপবাবু বলেন যে এর মধ্যে 'টমসন কেন একটি বিশেষ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করলেন ঠিক বোঝা যায় না । ভারতীয় পথের কী এমন পৃথক দৃশ্যগত নান্দনিক -আধ্যাত্মিক -সাংকেতিক অনুষঙ্গ আছে যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পথের অনুষঙ্গে পাওয়া যায় না?' প্রতাপবাবু অনুমান করছেন যে তাঁর বইয়ের অনেক জায়গায় ইওরোপীয় প্রভাবের প্রশ্ন তু লে Tagore বা Tagorite -দের বিষয়ে

একটু ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন টমসন, তাঁদের ভোলাবার জন্য তাই অগত্যা 'স্বদেশি রাস্তার প্রভাবের এই native তত্বটির অবতারণা করেছিলেন' তিনি । টমসনের বইয়ের চলতি সংস্করণে ৪৭ পৃষ্ঠায় আছে প্রতাপবাবুর উদ্ধৃ ত বাক্যাংশটি । টমসন ঠিক কী বলতে চেয়েছিলেন তার একটু বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া সম্ভব এর ২৯৫ পৃষ্ঠায়, সেইটে বরং শোনা যাক । একটু দীর্ঘই হবে উদ্ধৃ তি, কেননা টমসনের সেই উপহাস্য 'মজাদার আবিষ্কার'টা পাঠকদের পুরোপুরিই জানা ভালো His indebtedness to Bengal, to something deeper and truer than books, shows in many qualities of his work, and shows especially in one quality which is very rich in all his poetry, but richest of all in his dramas. Let the reader imagine himself at one of those most characteristic focuses of village life, the or religious fairs. The whole countryside has poured out its inhabitants; and still new crowds are making towards the place. There is some religious centre to all this swarm of people; but it is the numerous sideshows that will be remembered longest. Here is a medicant chanting an episode from the vernacularized into a loss of rhymes : over there are Vaishnavas improvizing a hymn : a countryman goes past you, singing one of Ramprasad’s clashing of puns on Kali’s name, something that sounds (and is) very like a Bengali version of ‘Peter Piper picked a peck of pickled pepper’. These are Rabindranath’ people, and they have a great gift of folk -drama, of ready extemporanization, of dialogue which comes straight from the road or the bazaar. This gift, a very living one, was his, and came to him directly from his motherland, out of his soil it seems to spring spontaneously. He has taken the the spirit of Bengal, into poetry. It appears more or less mixed in the sub -plots of his earlier plays; but...this side of his genius reached its highest expression in The Free Current৬২

দেশীয় ঐতিহ্য কথাটাকে এতখানি বোঝাতে হলো কেন টমসনের, বইটির শেষ দিকে? সে কি Tagore বা Tagorite -দের ভয়ে? না কি এইজন্যে যে রচনা শেষ হবার মুখে অ 'রাবীন্দ্রিক' এক বিশিষ্ট পণ্ডিতজনের কাছ থেকে ভর্ৎসনাভরা একটি চিঠি পেয়েছিলেন টমসন? রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করার অপরাধে তর্জন -জানানো সেই চিঠির কয়েকটি লাইন ছিল ...I am sure his fame will fade and in the annals of our literature he will be remembered only as the head of a school that drew its inspiration from foreign sources.৬৩ এঁদের বোঝাতে চেয়েছিলেন টমসন, Tagorite -দের নয় । আমি কী লিখেছিলাম? নাটকে পথের আলোচনা প্রসঙ্গে টমসনের নামটা উল্লেখ করে আমি লিখেছিলাম, তিনিই প্রথমে লক্ষ করেন যে রবীন্দ্রনাথের নাট্যদৃশ্যের মধ্যে আছে একটা মেলার কাঠামো । তবে, 'মেলা শব্দটিতে হয়তো খানিকটা আতিশয্য লাগে'লিখেছিলাম তখন-'আসলে প্রতিদিনের চলচ্ছবিকে তিনি স্পর্শ করছেন কেবল জনচরিত্রের ভিড়ে । ' কিন্তু প্রতাপবাবু বোঝান যে রবীন্দ্রনাটকে পথের বিচারে এসব দেশীয় প্রসঙ্গ একেবারে অলীক, এখানে বরং স্ট্রিন্ডবার্গের ‘Easter, the Road to Damascus, A Dream Play ও The Great Highway নাটকগুলিতে যেভাবে পথকে কখনও দৃশ্যপট, কখনও নাট্যবিষয়, বা কখনও প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, তার কথাও বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার । ' বা, অন্য ভাষায়, রবীন্দ্রনাটকে পথের প্রসঙ্গে 'স্ট্রিন্ডবার্গের কথা না মনে পড়া বেশ কঠিন । ' অন্যত্র অবশ্য প্রতাপবাবু নিজেই বলেছেন ‘A Dream Play’ -তে পথ ঠিক ততটা গুরুত্ব পায়নি, কারণ প্রতীক হিসেবে এসেছে দুর্গ ও চন্দ্রমল্লিকা ফু ল!' কিন্তু The Road to Damascus তো তা নয়, সেখানে 'নামের মধ্যে নাটকের বিষয় অর্থাৎ আধ্যাত্মিক মুক্তিপথের* দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ তাই নয়, নাটকের দৃশ্যকল্পনার মধ্যেও পথ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে । পথের ওপরেই নাটকের শুরু, তারপর বিভিন্ন দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে নাট্যঘটনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পর আবার সেই পথেই নাটকের শেষ দৃশ্য বিন্যস্ত হয়েছে যেখানে মূল চরিত্র ‘Unknown’ শেষ পর্যন্ত আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছে গির্জার আশ্রয়ে । আরো অনেক রকমের পথ বা বিপথ রয়েছে অন্তর্বতী [ অন্তর্বর্তী ] দৃশ্যগুলিতেও । ঠিকই, মূল নাটকটি যদি কেউ না -ও পড়েন, এই বর্ণনা থেকে রবীন্দ্রনাথের কথা মনে হওয়া একেবারেই অস্বাভাবিক নয় । গির্জা বা মন্দিরের 'আশ্রয়ে' মুক্তি খোঁজাটা

রবীন্দ্রনাটকে একটু শক্ত, তবে পথেরই নানা দৃশ্যের মধ্য দিয়ে মুক্তিসন্ধানের এই ধরণটা অনেকসময়েই আমাদের চেনা লাগে, সবচেয়ে বেশি করে এবং সবচেয়ে স্পষ্ট করে যেটা আছে, 'প্রকৃ তির প্রতিশোধ' নাটকটিতে । নাটকটি শুরু হয়েছিল 'গুহা'য়, শেষ হয়েছিল 'গুহামুখে'-আর মধ্যবর্তী পর্বে কেবলই আছে নানা পথ -বিপথের পটভূ মি । ষোলোটি দৃশ্যের ওই নাটক, নাট্যস্থান হিসেবে সেখানে 'গুহা' আসে ঠিক দুবার, প্রথম আর নবম দৃশ্যে, নাটকটিকে ঠিক সমান দুই ভাগে ভাগ করে দিয়ে । পাঁচটি আছে গুহামুখ বা গুহাদ্বারের দৃশ্য, একটি অরণ্য, একটি পথপার্শ্বে কু টির, আর বাকি সাতটিই হলো পথ । স্পষ্টত 'পথ' কথাটি বসানো আছে তার মধ্যে চারটিতে, অন্য তিনটি হলো 'গুহার বাহিরে' অরণ্য হইতে ছুটিয়া বাহিরে আসিয়া' 'পর্বতশিখরে সন্ন্যাসী/পর্বতপথে দুইজন স্ত্রীলোকের প্রবেশ । ' এই হলো নাটকের দৃশ্যকল্পনা, আর দৃশ্যগুলির মধ্যে দিয়ে নাট্যনায়ক সন্ন্যাসী জীবনের মুক্তিপথ খুঁজে বেড়াচ্ছে । প্রথম দৃশ্যেই অবশ্য সে ভেবেছিল যে চরিতার্থ হয়ে গেছে তার সাধনা, কেননা এতদিন যে সে 'জগৎ -কু য়াশা -মাঝে' বা 'প্রকৃ তির মায়াফাঁদে' অসহায় হয়ে বসে ছিল, বুকে চেপে ছিল 'জগতের মহাশিলা', একদিন যে সে 'ছুটিয়াছি পথে পথে', সেসব ভু ল আজ মিটে গেছে । জগৎ আর তার স্নেহমমতাবন্ধন যে নিছক মিথ্যে, এই বোধ প্রচারের জন্য সাধনগুহা থেকে এবার সে বেরোতে চায় পথে । আর বেরিয়ে, এইবার, পায়ে পায়ে তাকে কেবলই জড়িয়ে ধরে তু চ্ছাতিতু চ্ছ জীবনধারা, বিশেষত একটি অচ্ছু ৎ অনাথা মেয়ে । কীভাবে তার মায়াজালে জড়িয়ে পড়ছে সন্ন্যাসী, কীভাবে ছিঁড়তে চাইছে সেই মায়া এবং শেষ পর্যন্ত কীভাবে উপেক্ষিতা পরিত্যক্তা সেই মেয়েটিকে আবার ফিরে পেতে গিয়ে সে দেখে ধুলায় -পড়ে -থাকা তার মৃত্যু, গুহামুখে বসে কীভাবে তখন সে বিলাপ করে 'হায় হায়, এ কী নিদারুণ প্রতিশোধ'-এই নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নাটক । এরই কথা বলতে গিয়ে পঁচিশ বছরের পুরোনো সেই প্রবন্ধটিতে লিখেছিলাম : 'প্রকৃ তির প্রতিশোধে' সন্ন্যাসীর গুহা আশ্রয় স'রে গেলেই তাঁর চোখের সামনে দেখা দিতে থাকে ভিন্ন ভিন্ন জনতাপুঞ্জ, তারা মঞ্চের ভিন্ন ভিন্ন কোণ জুড়ে একই সঙ্গে দাঁড়িয়ে থেকে জ্ঞানচর্চা কিংবা পরচর্চা করে, পরিহাসে কিংবা ষড়যন্ত্রে মাতে । এই আদিকাল থেকে শুরু ক'রে 'শারদোৎসব' 'ডাকঘর' 'মুক্তধারা' প্রায় সর্বত্রই নাট্যপথের দুমুখ থাকে খোলা, যেন জীবনের বিচিত্র অঞ্চল থেকে উঠে -আসা মানুষগুলি চলাচলের মধ্য দিয়ে ক্ষণকালের জন্য এখানে মিলিত হয়ে চ'লে যায় । লিখেছিলাম : রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছেন 'প্রকৃ তির প্রতিশোধে'র সন্ন্যাসী; কিন্তু তিনি বিচ্ছিন্ন বোধ করেন তাঁর পুরোবর্তী জীবনপ্রবাহ থেকে, বলে ওঠেন :

পথ দিয়ে চলিতেছে এরা সব কারা । এদের চিনি নে আমি, বুঝিতে পারি নে কেন এরা করিতেছে এত কোলাহল । কী চায়? কিসের লাগি এত ব্যস্ত এরা? যেন তার উত্তর দেবার জন্যই তখন পরম্পরায় আসে কৃ ষকদের 'হেদে গো নন্দরানী' গান আর জীবনযাপনে মত্ত স্ত্রী -পুরুষের দল । এইভাবে পথপ্রতীকের সূচনা হয়েছিল 'প্রকৃ তির প্রতিশোধ' নাটকে, ধারাবাহিক এর বিবর্তনও ঘটেছে তার পর । কিন্তু এই -যে নাটকটিতে পথকে তিনি একই সঙ্গে প্রতীক ও পটভূ মি করে তু লতে পেরেছিলেন, সেকথার বিচারে বসে তু লনামূলক সাহিত্যপাঠের আনন্দে স্ট্রিন্ডবার্গের কথাও কারো মনে পড়তে পারে নিশ্চয়, মনে পড়তে পারে To Damascus -এরও কথা, কিন্তু তখন কেবল খেয়াল রাখতে হবে যে 'প্রকৃ তির প্রতিশোধ' নামের নাটকটি ছাপা হয়েছিল ১৮৮৪ সালে, আর ১৮৯৮ থেকে ১৯০৪ সালের সময়পর্বে স্ট্রিন্ডবার্গ লিখেছিলেন তাঁর To Damascus ।

কেন বলি স্বপ্ন 'রক্তকরবী, ক্রিসেন্থিমাম' নামে যে প্রবন্ধটি লিখেছিলাম 'কালের মাত্রা'য়, প্রতাপবাবু জানিয়েছেন যে সে -লেখার এই একটি মন্তব্য তাঁর কাছে একটু দুর্বোধ্য ঠেকেছে 'স্বপ্ননাটককে দেখাতে হবে স্বপ্নচ্ছায়ার মতো, সবটা প্রায় একই স্তরে । রক্তকরবীকে নিয়ে আসতে হবে জাগ্রত জগতে । জাগ্রত জগতে, অথচ সম্পূর্ণই আমাদের চেনাজানা চব্বিশ ঘণ্টার সীমানার মধ্যেও নয় । ' যাঁরা A Dream Play নাটকটি পড়েননি, তাঁরা আমার এই মন্তব্যে বিভ্রান্ত হতে পারেন ভেবে প্রতাপবাবু মনে করিয়ে দিয়েছেন যে স্ট্রিন্ডবার্গের নাটকটির নামের মধ্যে Dream কথাটা থাকলেও ওর মধ্যে 'কোনো স্বপ্নসুলভ ছায়াচ্ছন্নতা নেই' । ব্যাখ্যানের সহায়ক হিসেবে এখানে তিনি ব্যবহার করেছেন একজন সমালোচক Maurice Valency -এর 'একটি চমৎকার মন্তব্য' যে ওটা নাটকই, ওটা স্বপ্ন নয়, ওর মধ্যে ‘enigmatic character of a dream’ নেই, আছে enigmatic character of a work of art’ । ওটা যে স্বপ্ন নয়, ওটা নাটক, সেটা বোধ হয় আমিও ধরতে পেরেছিলাম । আমার লেখাটি ছিল 'রক্তকরবী' নাটকের অভিনয় প্রসঙ্গে, 'বহুরূপী'র প্রযোজিত অভিনয় । A Dream Play আর 'রক্তকরবী', এই দুটি নাটকের অভিনয় -উপস্থাপনা রীতি যে একটু ভিন্ন হবার কথা, এইটেই ছিল বলবার । আমার সে ধারণা সবাই যে মানবেন, তা নিশ্চয় বলা চলে না । তবে প্রসঙ্গটা বিবেচনার জন্য সমালোচকদের মন্তব্যের আগে নাট্যকারের

নিজের অভিপ্রায়টাই প্রথমে ভাববার । স্ট্রিন্ডবার্গ তো স্পষ্টই লিখেছিলেন (এবং প্রতাপবাবু এর উদ্ধৃ তিও দিয়েছেন) যে : ...The Author has sought to reproduce the disconnected but apparently logical form of a dream...the characters are split, double and multiply; they evaporate, crystallise, scatter and converge.৬৪ এখন নাট্যকারের এই লক্ষ্যকে সম্পূর্ণ মান দিতে গেলে অভিনয়ে হয়তো এর স্বপ্নচ্ছায়া কাঠামোটা আগাগোড়াই মনে রাখতে হয়, এই ছিল আমার বক্তব্য । Maurice Valency -ও কি এর থেকে অত্যন্ত বিপরীত কিছু ভেবেছিলেন? নাট্যকারের ভাবনা দিয়ে কথাটা তো তিনি শুরুই করেছিলেন এইভাবে : The play, we are told in the foreword, is intended to produce on the stage the effect of a dream. Its shapes arise out of chaos half -formed, with wisps of chaos, so to speak, still clining to them.৬৫ ভ্যালেন্সির লেখা থেকে প্রতাপবাবু যে অংশ ব্যবহার করেছেন, তার শেষ বাক্যটি অবশ্য অসম্পূর্ণ । সেখানে আরো এই একটি বাক্যাংশ ছিল যে ‘...much of its beauty, and its power, are derived from what is suggested by and to the unconscious...৬৬ যদিও, এটা ঠিক যে আলোচনার এই অংশে ভ্যালেন্সির ঝোঁক ছিল ‘rational purpose’ বা ‘intellectual faculty’ বা ‘understanding’ জাতীয় শব্দগুলির ওপর । কিন্তু মাত্র কয়েক পৃষ্ঠা পরেই তাঁকে বলতে হবে ‘A work of this sort might not be expected to convey very much to the mind by way of meaning’৬৭ আর এক দু -পৃষ্ঠা পর আবার এই স্পষ্টোক্তি : The action invovles effects of the sort actually experienced in dreams; it has something of the local color of dreams; and the result is something which is much less precise and more mysterious than allegory.৬৮ নাট্যকার নিজে ‘logical form of a dream’ বললেও ভ্যালেন্সি dream শব্দটা সর্বত্র ব্যবহার করতে চাননি ঠিকই, তাঁকে শুধু বলতে হয়েছে :

The logic of a A Dream Play, which is also not a dream, comes somewhat closer to the logic of revery.৬৯ ফলে, 'স্বপ্নচ্ছায়ার মতো' বললে, অন্তত ভ্যালেন্সির সঙ্গে আমার মন্তব্যের খুব বিরোধ হবে বলে মনে হয় না । এই নাটকের উপস্থাপনায় প্রতিমুহূর্তেই এর স্বপ্নকাঠামোগত চেহারাটা দর্শক বা পাঠককে খেয়াল রাখতে হয়, কেননা টু করো টু করো অংশগুলির মধ্যে একটু বেশি পরিমাণে প্রাত্যহিকতা থাকলেও (স্বপ্নতেও যা থাকে) দুচার পৃষ্ঠা পরপরই এর চলনের লজিকটা যায় ভেঙে, ভেঙেই দেন নাট্যকার, চরিত্রগুলি কেবলই ‘are split, double and multiply; they evaporate, crystallise, scatter and converage’ । স্ট্রিন্ডবার্গ এর পরের বাক্যেই লিখেছিলেন, ‘a single consciousness holds sway over them all-that of a dreamer’ । ৬৯ এই কথাটা বোঝাবার জন্যই বলেছিলাম অভিনয়ের 'প্রায় একই স্তর' । কিন্তু 'রক্তকরবী'তে, মুহুর্মুহু এই ভাঙনের বা একের -সঙ্গে -অন্যে জড়িয়ে যাওয়ার এই ধরণটা নেই, আগাগোড়াই তার আছে একটা আপাতবাস্তব চেহারা । এই 'আপাতবাস্তব' কথাটার মধ্যেই রয়ে গেছে অভিনয়গত দুই স্তরের সম্ভাবনা ।

যন্ত্র তবে কোনটা 'দৃশ্যে, সংলাপে, ঘটনায়, নেপথ্যে বা মঞ্চনির্দেশে যন্ত্রের বা আধুনিক মেশিন -সভ্যতার কোন নিদর্শন বা উপকরণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চিহ্নই নেই কোথাও', অথচ 'রক্তকরবী'তে যন্ত্র কথাটিকে 'নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর সমালোচকেরা আক্ষরিক অর্থে অর্থাৎ machine অর্থেই ব্যবহার করেছেন,' এই আরেক লজ্জাজনক অসংগতির কথা তু লেছেন প্রতাপবাবু । যন্ত্র বা machine -টা তবে কোথায়? A Dream Play আধ্যাত্মিক মুক্তির নাটক হলেও সেখানে টেলিফোন, খবরের কাগজ ইত্যাদি আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার কিছু নিদর্শন আছে, ‘instruments of torture’ -এর মতো কিছু যন্ত্রগোছের বস্তুও আছে । কিন্তু, প্রতাপবাবু লক্ষ করেন, 'রক্তকরবী' নাটকে তাও নেই । অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক যন্ত্রসভ্যতার সঙ্গে নাটকটির যে কোনো সংস্রব আছে, তা বোঝারই কোনো উপায় নেই এখানে । তাহলে? তাহলে, 'যন্ত্র' কথাটিকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটকে 'নিশ্চয়ই' কী অর্থে ব্যবহার করেছিলেন, তার অন্তত একটা ইঙ্গিত দেখা যাক রাজারই একটি সংলাপে । শেষ পর্বে নন্দিনী যখন জালের দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল, রাজা তাকে বলেছে 'রঞ্জনকে চাও বুঝি? সর্দারকে বলে দিয়েছি, এখনি তাকে এনে দেবে । ' এই কথাটা বলবার মুহূর্তে রাজা জানে না যে রঞ্জনকে সে ধ্বংস করেছে এর আগেই । দরজা খুলে যাবার পর এই

খবর যখন সে জানল, যখন সে বুঝতে পারল তার সর্দাররা কাজ করছে তারই ইচ্ছের বিরুদ্ধে, 'দশজনের সঙ্গে মিশিয়ে' রঞ্জনকেও তারা পাঠিয়েছিল তার মৃত্যুশালায়, 'যন্ত্র' শব্দটাকে একবার ব্যবহার করেছিল রাজা । বলেছিল 'ঠকিয়েছে । আমাকে ঠকিয়েছে এরা । সর্বনাশ! আমার নিজের যন্ত্র আমাকে মানছে না । * এই হলো 'রক্তকরবী'র যন্ত্রের ধারণা, গোটা ব্যবস্থার এই যন্ত্র । 'মুক্তধারা'র যন্ত্রের থেকে এর কিছুটা স্বাতন্ত্র্য আছে, একই কথা নেই দুই -নাটকে । তবে, কেউ বলতে পারেন, এ হলো নিছক সংলাপ । এর ব্যাখ্যা নিয়ে কেউ মতভেদ তৈরি করতেও পারেন । তাই, অন্য তথ্যও এখানে খুঁজে নেওয়া ভালো । দেশেবিদেশে নাটকটা নিয়ে দুর্বোধ্যতার নানা অভিযোগ উঠেছিল বলে অনেকবারই এর ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ নিজে, সেসব ব্যাখ্যা থেকে প্রতাপবাবু তাঁর দরকারমতো কিছু কথা সংগ্রহও করেছেন অনেকসময়ে । যা তিনি ব্যবহার করেননি, নাট্যকারের নিজস্ব ব্যাখ্যার সেসব অংশ থেকে দুচারটি মন্তব্য এই প্রসঙ্গে আমরা ভাবতেও পারি ১. This is a world, where, with every available means in this power, the Great King exploits the resources of the underworld, of nature, of the mind, of science and of human physique and intelligence, using all the weapons of organization and the elaborate machinery of a highly centralized bureaucracy in order to add to his wealth. This wealth he measures in gold, or in souls or in facts, or in human bodies, so that men are men no longer but numbers.৬০ ২. ...When men make use of men...they use every variety of machinery to fortify themselves or their selfish ends against the dissolving power of beauty and love,-the trust, the company, stocks and shares, investments, machinery through which they can avoid all human connection and so cut themselves off from their fellows whilst they extract for their benefit the very essence of the lives of their neighbours, organizations are set up with the best of aims and ideals and

of executive machinery...In such organizations men have become merenumbers.৭০ ৩. They accepted their surroundings as King, Priest, Professor and Governor ordered or taught. They took for granted the perpetual domination of the strong, the continued oppression of the weak, and that, in the effort to pile up material wealth, they should, by their own fellows, be transformed from men into machineries ; to the mutilation of their own humanity.৭১ ৪. The world has became (sic) the world of Jack and Giant-The Giant who is not a gigantic man, but a multitude of men turned into a giagantic system.৭২ ৫. It is an organised passion of greed that is stalking abroad in the name of European civilisation...it only assumes a terrifying bigness, its physiognomy blurred through its cover of an intricate network, -the scientific system.৭৩ ৬. I have a stronger faith in the simple personality of man than in the prolific brood of machinery that wants to crowd it out.৭৪ এই হচ্ছে তাহলে 'যন্ত্র' শব্দের একরকম প্রয়োগ । এ প্রয়োগ পছন্দ না -ও হতে পারে অনেকের, তবে রবীন্দ্রনাথ এই কথাটিতে 'নিশ্চয়ই' কী বুঝেছিলেন, এর থেকে তার একটা আন্দাজ পাওয়া সম্ভব ।

আরো মিল কি নেই কথা চলতে পারে আরো অনেক, কিন্তু আপাতত কোনো -একটা জায়গায় থেমে যাওয়াও দরকার । রসিক পাঠক অবশ্য বলতেও পারেন সেটা একটু আগে মনে হলেই ভালো ছিল । স্ট্রিন্ডবার্গের A Dream Play পড়লে দু -একসময়ে 'রক্তকরবী'র কোনো সংলাপ বা কোনো কোনো অবস্থান যে মনে পড়তে পারে কারো, এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই । নেই বলেই অনেকদিন আগে ''কালের মাত্রা''য় তেমন সাদৃশ্যের কথা বলতে আমার

ভালো লেগেছিল । কিন্তু সেই সাদৃশ্যসন্ধানকে অতিরেকে নিয়ে গেলে কিংবা সেইটেকেই রবীন্দ্রচেতনার একেবারে ভিত্তি প্রমাণ করতে গেলে যে সমস্যা হয়, সেইটু কু ই ছিল বলবার । যে -নাটকে কবিকে ঢু কতে হয় এক -বালতি কাদা নিয়ে আর তাকে শুধু বিলাপ করতে হয় 'আমরা জন্তু হয়ে জন্মালাম কেন'; যেখানে 'ন্যায়' 'সখ্য' 'শান্তি' আর 'আশা' নামের জাহাজগুলির একেবারে ভরাডু বি হয়ে গেছে; বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নয়, নাট্যবিষয়ের মধ্যে যেখানে মূল প্রতিপক্ষই হলো এই আমাদের গোটা জীবনযাপন; আস্তাবল সাফ করে মরছে দুর্গস্থ যে অফিসার, তাকে মুক্তি দেবার কথা বললে যেখানে শুনতে হয় ‘Either way I’ll suffer’ ; যেখানে দর্শন ধর্মতত্ব চিকিৎসাশাস্ত্র আর আইনের প্রধানেরা একত্র হলেই শুধু উদ্দাম গর্জনে ‘I believe’ ‘I think’ ‘I know’ ‘I doubt’ বলে বকতে থাকে পরস্পরকে ; ‘Love conquers all’ ঘোষণা করেই যেখানে ইন্দ্রকন্যা প্রতিপদে একথার অসারতা বুঝতে থাকে তার অভিজ্ঞতায়; যেখানে নারীর পরিচয় হলো এই যে সে পাপ আর মৃত্যুর পথ; যে -নাটকের নাট্যকার বিষয়ে সমালোচককে শেষপর্যন্ত বলতেই হয় যে ‘Always ashamed of being human, Strindberg rejected the external world so completely that he often bordered on instanity’৭৫; সেই নাটকের প্রেরণায় তৈরি হয়ে উঠল 'শারদোৎসব' থেকে 'রক্তকরবী' পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের জীবনগর্বিত নাটকগুলি, এরই থেকে রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন তাঁর দুঃখের ধারণা বা ত্যাগের বা মুক্তির বোধ, অতিনিশ্চিত এই সিদ্ধান্তটাকে মেনে নেওয়া কোনো কোনো পাঠকের পক্ষে একটু শক্তই ঠেকতে পারে, বলবার কথা ছিল এই । মিল কি তবু নেই? 'কালের মাত্রা'য় যতটু কু বলেছিলাম, তা ছাড়াও কি এ -দুজনের লেখায় আরো কোনো মিল পাওয়া অসম্ভব? না, বিক্ষিপ্তভাবে তাও নিশ্চয় সম্ভব । যেমন, নিজেদেরই জীবন বিষয়ে কথা বলতে গিয়েও কখনো -বা সমতু ল্য ভাষা প্রয়োগ করেছেন দুজনে, দেখে বেশ চমকই লাগে । Inferno -নামের আত্মজীবনীটিতে স্ট্রিন্ডবার্গ লিখেছিলেন : The fact was that a kind of religion had developed in me, though I was quite unable to formulate it. It was a spiritual state rather than an opinion founded upon theories, a hotch potch of impressions that were far from being condensed into thoughts.৭৬. রবীন্দ্রনাথ পড়া থাকলে এই কথাগুলিও হঠাৎ আমাদের চেনা -চেনা ঠেকতে পারে, কেননা রবীন্দ্রনাথও তো একদিন লিখবেন ওইরকমই ঠি

ঠিক যাকে সাধারণত ধর্ম বলে সেটা যে আমি আমার নিজের মধ্যে সুস্পষ্ট দৃঢ়রূপে লাভ করতে পেরেছি তা বলতে পারি নে, কিন্তু মনের ভিতরে ভিতরে ক্রমশ যে -একটা সজীব পদার্থ সৃষ্ট হয়ে উঠছে তা অনেক সময় অনুভব করতে পারি । বিশেষ কোনো -একটা নির্দিষ্ট মত নয়-একটা নিগূঢ় চেতনা, একটা নূতন অন্তরিন্দ্রিয় ।

৭৭

চোখে পড়েই মিলটা । ‘an opinion founded upon theories’ ‘condensed into thoughts’ বা ‘formulate’ জাতীয় শব্দগুলির সঙ্গে সহজেই মিলিয়ে নেওয়া যায় 'ঠিক যাকে সাধারণত ধর্ম বলে 'কোনো -একটা নির্দিষ্ট মত' বা 'সুস্পষ্ট দৃঢ়রূপে'; ‘a spiritual state’ হয়ে ওঠে 'একটা নিগূঢ় চেতনা, একটা নূতন অন্তরিন্দ্রিয়'; ‘a kind of religion developed in me’ এর সঙ্গে মিলিয়ে পাই 'মনের ভিতরে ভিতরে ক্রমশ যে একটা সজীব পদার্থ সৃষ্ট হয়ে উঠছে' । দুজনের নিজস্ব ধর্মবোধের জাগরণ বিষয়ে দুটি মন্তব্যে এ -ধরণের আশ্চর্য কোনো মিল দেখতে পেলে সবাইকে ডেকে সেটা বলবারই ইচ্ছে হয় । কিন্তু এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় না যে একজন অবশ্যই এর জন্য আদ্যন্ত নির্ভর করছেন আরেকজনের ওপর । তথ্য হিসেবে, এখানে অবশ্য এটাও মনে রাখা ভালো যে সুইডিশ ভাষায় স্ট্রিন্ডবার্গের ওই কথাগুলি ছাপা হয়েছিল ১৮৯৭ সালে, আর বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর কথাগুলি লিখছিলেন ১৮৯৫ সালের ১০ অক্টোবর, ইন্দিরাদেবীর কাছে পাঠানো একটি চিঠিতে ।

সূত্রনির্দেশ উদ্ধৃ তিবহুল এই লেখায় যেসব উদ্ধৃ তির কোনো সূত্রসংখ্যা নেই সেগুলির উৎস হলো 'অনুষ্টু প' (বসন্ত সংখ্যা ১৩৯৬) পত্রিকায় প্রকাশিত শ্রী প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের প্রবন্ধ 'রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী তথ্য ও তত্ব'; Strindberg -এর নাটক A Dream Play, অনুবাদ Elizabeth Sprigge; আমার একটি পুরোনো বই 'কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাট্য' । গৃহবদ্ধ অবস্থায় রচনাটি তৈরি করতে হয়েছে বলে দু -একটি উপাদান সংগ্রহের কাজে কারো কারো সাহায্য নিয়েছি । 'দেশ' পত্রিকা থেকে দুটি পৃষ্ঠার এবং The Visva Bharati Quarterly আর The Calcutta Review থেকে কয়েকটি পৃষ্ঠার ফটোকপি এনে দিয়েছেন যথাক্রমে শ্রীঅভীক মজুমদার এবং শ্রীতারাপদ আচার্য । 'রক্তকরবী'র প্রথম অভিনয়রজনীর অভিনয়পত্রীটি পাওয়া গেছে শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রভবনের সৌজন্যে ।

সূত্রনির্দেশে 'রবীন্দ্ররচনাবলী' থাকলে বুঝতে হবে বিশ্বভারতী -প্রকাশিত রচনাবলী । ১. চিঠিপত্র ১২, ১৩৯৩, পৃ. ৮৬ ২. অপ্রকাশিত, শ্রীমতী রানু মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে ৩. অমল মিত্র, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও নটরাজ শিশিরকু মার, ১৯৭৭, পৃ. ১০ ৫. তদেব, পৃ. ১০ ৫. তদেব, পৃ. ৫৫ ৬. পূর্ব্বাশা, রবীন্দ্রস্মৃতিসংখ্যা, ১৯৪৮, পৃ. ১১৬ ৭. তদেব, পৃ. ১১৫ ৮. চিঠিপত্র ৫, ১৩৫২, পৃ. ৬৯ -৭০ ৯. রবীন্দ্রবীক্ষা, সংকলন ১৬, ১৩৯৩, পৃ. ২৮ ১০. সুপ্তি মিত্র, সাময়িকপত্রে রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ শান্তিনিকেতন, ১৩৮৬, পৃ. ১২৭ ১১. তদেব, পৃ. ১৪১ ১২. চিঠিপত্র ১১, ১৩৮১, পৃ. ৩৬ ১৩. অপ্রকাশিত, শ্রীমতী রানু মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে ১৪. হেমেন্দ্রকু মার রায়, সৌখীন নাট্যকলায় রবীন্দ্রনাথ ১৯৫৯, পৃ. ১২৩ -২৪ ১৫. দেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬১, ৬৯৪ ১৬. তদেব, পৃ. ৬৯৫ ১৭. তদেব, পৃ. ৬৯৫ ১৮. চিঠিপত্র ৯, ১৩৭১, পৃ. ২২৬ ১৯. তদেব, পৃ. ২২৭ ২০. অমল মিত্র, পৃ. ৬০ ২১. রবীন্দ্রনাথের চিঠি পারুল দেবীকে, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশন বিভাগ, ১৩৯৪, পৃ. ৭৩ ২২. শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত ২৩. Jaygopal Banerjee, ‘Red Oleanders : An appreciation’, The Calcutta Review, February 1926, p. 234

২৪. প্রমথনাথ বিশী, রবীন্দ্রনাট্যপ্রবাহ ২, ১৯৫৮, পৃ. ১৫৮ ২৫. বহুরূপী ৬৫, পয়লা মে ১৯৮৬, পৃ. ৬৩ ২৬. Rabindranath Tagore, ‘Red Oleanders : An Interpretation,’ The Visva -Bharati Quarterly, Nov. ‘51 -Jan’52, p. 211 ২৭. 'নাম্নী', মহুয়া, রবীন্দ্ররচনাবলী ১৫, ১৩৬০, পৃ. ৭৮ ২৮. ড. প্রণয়কু মার কু ণ্ডুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার, রবীন্দ্রবীক্ষা, সংকলন ১৬, পৌষ ১৩৯৩, পৃ. ২৫ -২৬ ২৯. Krishna Kripalani, Rabindranath Tagore : A Biography, Calcutta, 1980, p. 324 ৩০. রবীন্দ্রবীক্ষা, সংকলন ১৬, পৌষ ১৩৯৩, পৃ. ২৬ ৩১. Krishna Kripalani, p. 323 ৩২. August Strindberg, Inferno, Modern Drama, ed. Anthony Caputi, New York, 1966, p. 423 ৩৩. শারদোৎসব, রবীন্দ্ররচনাবলী ৭, ১৩৬০, পৃ. ৩৯৫ ৩৪. তদেব, প. ৪০৮ ৩৫. 'পুষ্পাঞ্জলি', গ্রন্থপরিচয়, রবীন্দ্ররচনাবলী ১৭, ১৩৬১, পৃ. ৪৯৪ ৩৬. শারদোৎসব, রবীন্দ্ররচনাবলী ৭, ১৩৬০, পৃ. ৪০৮ ৩৭. কড়ি ও কোমল, রবীন্দ্ররচনাবলী ২, ১৩৬৩, পৃ. ১০৮ ৩৮. আত্মপরিচয়, রবীন্দ্ররচনাবলী ২৭, ১৩৭২, পৃ. ২৩১ ৩৯. 'গান্ধারীর আবেদন', কাহিনী, রবীন্দ্ররচনাবলী ৫, ১৩৬২, পৃ. ৮৩ ৪০. আত্মপরিচয়, রবীন্দ্ররচনাবলী ২৭, ১৩৭২, পৃ. ২৩০ ৪১. 'চণ্ডিদাস ও বিদ্যাপতি', সমালোচনা, রবীন্দ্ররচনাবলী অচলিত -সংগ্রহ ২, ১৩৬৯, পৃ. ১১৭ ৪২. 'পথপ্রান্তে', বিচিত্র প্রবন্ধ, রবীন্দ্ররচনাবলী ৫, ১৩৬২, পৃ. ৪৮২ ৪৩. ছিন্নপত্রাবলী, ১৩৬০, পৃ. ২৫৯ ৪৪. তদেব, প. ৩২৭ ৪৫. তদেব, প. ৩৪৩ ঠি

৪৬. চিঠিপত্র ১, ১৩৭২, পৃ. ৩৮ ৪৭. চতু রঙ্গ, রবীন্দ্ররচনাবলী ৭, ১৩৬০, পৃ. ৪৯৫ ৪৮. শারদোৎসব, তদেব, পৃ. ৪০৯ ৪৯. রাজা, রবীন্দ্ররচনাবলী ১১, ১৩৬৫, পৃ. ২৬৪ ৫০. ডাকঘর, রবীন্দ্ররচনাবলী ১১, ১৩৫৮, পৃ. ৩৯৮ ৫১. রক্তকরবী, রবীন্দ্ররচনাবলী ১৫, ১৩৬০, পৃ. ৩৬৫ ৫২. F. L. Lucas, The Drama of Ibsen and Strindberg, London, 1962, p. 446 ৫৩. Kenneth Tynan, Tynan on Theatre, Penguin, 1964, p. 215 ৫৪. 'মুক্তি', শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্ররচনাবলী ১৪, ১৩৬০, পৃ. ৪৪৫ ৫৫. 'ত্যাগের ফল', শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্ররচনাবলী ১৩, ১৩৫৯, পৃ. ৪৬৪ ৫৬. 'দুঃখ', ধর্ম, তদেব, পৃ. ৪০৫ ৫৭. 'মুক্তি', পৃ. ৪৪৫ ৫৮. উৎপল দত্ত, জপেনদা জপেন যা, ১৯৪৮, পৃ. ৪৫/পৃ. ৪৩ ৫৯. Jaygopal Banerjee, ‘Red Oleanders : An Appreciation’, The Calcutta Review, February 1926, p. 232 ৬০. 'রঙ্গমঞ্চ', বিচিত্র প্রবন্ধ, রবীন্দ্ররচনাবলী ৫, ১৩৬২, পৃ. ৪৪৯ -৫৩ ৬১. Edward Thompson, Rabindranath Tagore : Poet Dramatist, 1979, p. 47

and

৬২. Ibid, p. 295 ৬৩. Ibid, p. 315 ৬৪. August Strindberg, Author’s Note [ to A Dream Play ], Modern Drama, ed. Anthony Caputi, New York, 1966, p. 425 ৬৫. Maurice Valency, A Dream Play : The Flower and the Castle, Ibid, p. 428 ৬৬. Ibid, p. 429 ৬৭. Ibid, p. 436

৬৮. Ibid, p. 438 ৬৯. Rabindranath Tagore, ‘Red Oleanders : An Interpretation’, The Visva -Bharati Quarterly, Nov. ‘51 -Jan’52, p. 210 -11 ৭০. Ibid, p. 212 ৭১. Ibid, p. 216 ৭২. Rabindranath Tagore, ‘Red Oleanders : An Interpretation’, The Visva -Bharati Quarterly, October 1925, p. 284 ৭৩. Ibid, p. 284 ৭৪. Ibid, p. 285 ৭৫. Robert Brustein, August Strindberg : A Dream Play, Modern Drama, ed. Caputi, p. 445 ৭৬. August Strindberg, Inferno, Ibid, p. 420 ৭৭. ছিন্নপত্রাবলী, ১৩৬৭, পৃ. ৪৮৯ । ২৪ বর্ষ, ৩য় -৪র্থ যুগ্ম সংখ্যা, ১৯৯০

প্রসঙ্গ রক্তকরবী : একটি বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে আশিসকু মার চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথ যখন থেকে খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করতে আরম্ভ করেছেন, তখন থেকেই রবীন্দ্র সমালোচনাও শুরু হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে কিছু সমালোচনা যেমন শুধুই রবীন্দ্র -প্রশস্তিতে পূর্ণ তেমনি কিছু আবার রবীন্দ্র -বিদ্বেষে। বস্তুত, উভয় ক্ষেত্রেই একপ্রকার অন্ধত্ব কাজ করেছে বলেই এই মুহূর্তে সর্বাধিক প্রয়োজন নিরপেক্ষ রবীন্দ্র -সমালোচনা। ১৩৯৬ এর বসন্ত সংখ্যার 'অনুষ্টু প' পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের লেখা প্রবন্ধ 'রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী' : তথ্য ও তত্ত্ব' --- আপাতলক্ষ্যে শ্রমসাধ্য প্রয়াস বলে মনে হলেও শেষপর্যন্ত প্রবন্ধকারের যাবতীয় শ্রম ও প্রযত্ন একটি লক্ষ্যবিন্দুর প্রতিই ধাবিত হয়েছে --- রবীন্দ্র বিদূষণ। ফলত, প্রবন্ধটি আর নিরপেক্ষ থাকেনি বরং একদেশদর্শী হয়ে পড়েছে বলা যায়। প্রবন্ধের সূচনায় শ্রীবিশ্বাস বলছেন, 'বহুরূপী' কর্তৃক 'রক্তকরবী' প্রযোজনার আগে পর্যন্ত বাঙালি পাঠক এবং রবীন্দ্রনাথ কেউই বুঝতে পারেননি যে, 'রক্তকরবীকে এখন কত চমৎকার একটি প্রগতিশীল বক্তব্যের নাটক বলে মনে হয় আমাদের, কিন্তু এটি যে একটি বেশ উপভোগ্য বা অভিনয়যোগ্য নাটক...' এ কথায় মনে হতে পারে যে, কোনো নাটক প্রগতিশীল বক্তব্যবাহী হলে বোধ হয় তাকে উপভোগ্য বা অভিনয়যোগ্য হতে নেই। অথবা, যা উপভোগ্য বা অভিনয়যোগ্য, তা প্রগতিশীল নয়। আসলে রবীন্দ্রনাটকের অভিনয়যোগ্যতার অভাব রয়েছে, এ রকম একটি ধারণা চালু আছে বটে, তবে যে প্রবল ধীশক্তি ও নাট্যবোধ এ জাতীয় নাটক -অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজন, শম্ভু মিত্রের আগে পর্যন্ত তা বাংলা নাট্যজগতে দেখা যায়নি। যদিও শিশির ভাদুড়ী 'রক্তকরবী' অভিনয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, তবু যেকালে 'রক্তকরবী' রচিত, সেকালে এদেশে পেশাদারি রঙ্গমঞ্চ -নির্ভর নাটকেরই রমরমা --যখন নাট্যকার নাটক লিখছেন দর্শক রুচি, অভিনেতা -অভিনেত্রীদের দক্ষতা এসবের দিকে তাকিয়ে। অথচ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এইসব পেশাদারি মঞ্চনাটকের ঘোরতর বিরোধী, কারণ অভিনয়যোগ্যতা দিয়ে নাটকের সার্থকতা বিচারে তাঁর সায় ছিল না। 'বিচিত্র প্রবন্ধ' -এর অন্তর্গত 'রঙ্গমঞ্চ' প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন --- 'স্ত্রৈণ স্বামী যেমন লোকের কাছে উপহাস পায়, নাটক তেমনি যদি অভিনয়ের অপেক্ষা করিয়া আপনাকে নানা দিকে খর্ব করে, তবে সেও সেইরূপ উপহাসের যোগ্য হইয়া উঠে। নাটকের ভাবখানা এইরূপ হওয়া

উচিত যে --- আমার যদি অভিনয় হয় ত হউক, না হয় ত অভিনয়ের পোড়া কপাল --আমার কোন ক্ষতি নাই।' ফলে পাবলিক স্টেজের দিকে না তাকিয়ে তিনি নিজেই পারিবারিক মঞ্চে নাট্যপ্রযোজনায় উৎসাহী হয়েছিলেন। পেশাদার মঞ্চে তাঁর নাটক অভিনীত হয়নি তা নয়, কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই তা দর্শক -আনুকূ ল্য পায়নি। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে স্টার থিয়েটারে 'বৌ ঠাকু রাণীর হাট' উপন্যাসের সংশোধিত নাট্যরূপ 'পরিত্রাণ' অভিনীত হয়েছিল, কিন্তু দর্শক -সমাদর পায়নি। একই পরিণতি ঘটেছিল 'তপতী'র ক্ষেত্রে। অথচ 'রাজা ও রাণী' দর্শক -প্রীতি লাভে বঞ্চিত হয়নি। আসলে সাধারণ রঙ্গমঞ্চের দর্শক নাটকে যে আবেগের আতিশয্য সন্ধান করে, তা ছিল না বলেই 'পরিত্রাণ' ও 'তপতী'র এত অনাদর। আতিশয্য শুধু যে আবেগেরই ছিল তা নয়, অভিনয়েও ছিল। এসব লক্ষ করেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন --- 'রঙ্গমঞ্চে প্রায়ই দেখা যায়, মানুষের হৃদয়াবেগকে অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া দেখাইবার জন্য অভিনেতারা কণ্ঠস্বরে ও অঙ্গভঙ্গে জবরদস্তি প্রয়োগ করিয়া থাকে। তাহার কারণ এই যে, যে ব্যক্তি সত্যকে প্রকাশ না করিয়া সত্যকে নকল করিতে চায় সে মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার মতো বাড়াইয়া বলে। সংযম আশ্রয় করিতে তাহার সাহস হয় না। আমাদের দেশের রঙ্গমঞ্চে প্রত্যহই মিথ্যা সাক্ষীর সেই গলদঘর্ম ব্যায়াম দেখা যায়।'১ বলা বাহুল্য নিজের নাটকে এই 'গলদঘর্ম ব্যায়াম' দেখাতে রবীন্দ্রনাথের অনীহা ছিল। 'রক্তকরবী' উপভোগ্য হোক বা না হোক, তার অভিনয়যোগ্যতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের তাই কোনো সংশয় ছিল না। 'অনুষ্টু প' এর গ্রীষ্ম -বর্ষা সংখ্যায় শঙ্খ ঘোষ লিখিত প্রবন্ধটি পড়ার পর তাই শ্রীবিশ্বাসের এই বক্তব্য ভিত্তিহীন বলেই প্রমাণিত হয় যে 'তাঁর জীবদ্দশায় নাটকটি মঞ্চস্থ করার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ খুব একটা আগ্রহ কখনও দেখাননি।'২ নাটকটি যে বাজে ছিল এ ব্যাপারে শ্রীবিশ্বাস কিন্তু যথেষ্ট নিঃসংশয়ী। তদুপরি তাঁর বিশ্বাস, এর ইংরেজি অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ অতিরিক্ত স্বাধীনতা নিয়েছেন, যা বিদেশি পাঠকদের কাছে নাটকটিকে দুর্বোধ্য করে তু লেছে। অ্যালেক্স অ্যারনসন -এর লেখা ‘Rabindranath through western eyes’ গ্রন্থ থেকে কয়েকটি সংবাদপত্রের উদ্ধৃ তি তু লে দিয়ে শ্রীবিশ্বাস 'রক্তকরবী' সম্পর্কে বিদেশি পাঠকবর্গের 'বিরূপ প্রতিক্রিয়া' প্রমাণ করতে চেয়েছেন। এ জাতীয় বিচ্ছিন্ন উদ্ধৃ তি থেকে প্রমাণ হয় না যে সব পাঠকই 'রক্তকরবী' সম্পর্কে বিরূপ ছিলেন। তাছাড়া এ ব্যাপারে যে বইটির সহায়তা তিনি গ্রহণ করেছেন, সেটিও খুব নির্ভরযোগ্য নয়। কেন নয়? এ প্রসঙ্গে একজন প্রথিতযশা রবীন্দ্রগবেষক জানাচ্ছেন --ষ্ঠা

১২৪ পৃষ্ঠার এই বইটি (গ্রন্থপঞ্জী বাদ দিলে) ছয়টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এবং ঐ পরিচ্ছেদগুলিতে পুনরুক্তি এবং নানাবিধ গৌণ এবং অনতি প্রাসঙ্গিক মন্তব্যাদির ছড়াছড়ি থাকলেও লেখকের মুখ্য বক্তব্য ও প্রতিপাদ্য ছিল দুটি : (১) প্রতীচ্যে রবীন্দ্রখ্যাতির অভ্যুত্থানের পিছনে ছিল রাজনৈতিক কলকাঠি -সঞ্চালন ও প্রচার এবং (২) প্রথম আবির্ভাবকালে এবং তার পরেও দীর্ঘদিন রবীন্দ্রনাথ যে অতু লনীয় অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন তার মূলে ছিল প্রাচ্যভূ খণ্ড সম্বন্ধে প্রতীচ্যের অজ্ঞতা এবং মোহ।...রবীন্দ্রসদনে সংরক্ষিত বিরাট উপাদান সংগ্রহের সঙ্গে যাঁদের বিস্তৃ ত পরিচয় নেই, তাঁরা বইটির উদ্ধৃ তি, নামল্খে ইত্যাদির দ্বারা স্বভাবতই এমন অভিভূ ত হয়ে পড়বেন এবং পড়েছেন যে সে সব কাটিয়ে যুক্তি -প্রমাণ -বিন্যাসের মধ্যে যে কারচু পি এবং হাতসাফাই আছে সে সম্বন্ধে সতর্ক এবং সজাগ হওয়া তাঁদের পক্ষে প্রায় অসম্ভবই হয়েছে।৩ সৌরীন্দ্র মিত্র রচিত 'খ্যাতি অখ্যাতির নেপথ্যে' গ্রন্থটি পড়লে জানা যায় কিভাবে অ্যারনসন রবীন্দ্রনাথের প্রতি পাশ্চাত্য প্রতিক্রিয়ার কথা জানাতে গিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের অংশবিশেষ সুবিধেমতো তু লে দিয়েছেন। অ্যারনসন নিজেই বলেছেন, ‘ ...much of the material used in this book is taken from newspapers and periodicals... ’ ৪ এবং এর দ্বারা তিনি ধরতে চেয়েছেন ...‘public opinion moved during these last twenty years’ কে।৫ শ্রী মিত্র তাই সঙ্গত প্রশ্ন তু লে বলেছেন, --- 'বিভিন্ন সংবাদপত্রে যখন একইকালে পরস্পরবিরোধী মন্তব্য প্রকাশিত হয়, তখন কোনটাকে public opinion বলবো এবং কোন যুক্তিতে?'৬ 'অসাধু কারচু পি' আর 'হাত সাফাই' -এ পরিপূর্ণ অ্যারনসনের এই বইটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে শ্রীমিত্র তাই স্মরণ করেন উইন্ডহ্যাম লুইসের একটি বই সম্পর্কে এফ. আর লীভিসের মন্তব্য --- ‘It’s not a book, it’s a bluff.’৭ অথচ শ্রীবিশ্বাস এই বইটির ওপর নির্ভর করেই অনায়াস সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান যে, 'ইংল্যান্ডে নাটকটি সম্পর্কে যথেষ্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল।'৮ এ ব্যাপারে আর যে বইটির সাহায্য তিনি গ্রহণ করেন সেটি Edward Thompson রচিত ‘Rabindranath Tagore-Poet & Dramatist’ -এর। টমসনের এই মন্তব্যটি --‘Red oleanders has been published in England as well as in India, but made no impression’ .৯

টমসনের বইটি সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বইটি পড়ে ক্ষু ব্ধ হয়েছিলেন। তাঁর সেই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছিল উইলিয়াম রদেনস্টাইনকে লেখা একটি পত্রে (২০ এপ্রিল, ১৯২৭)। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন --From your letter it is evident that you have read Thompson’s book about myself. It is one of the most absurd books that I have read dealing with a poet’s life and writings... I am certain he would have been much more careful in his treatment if his subject were a continental poet of reputation in Europe.১০ রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচে এই চিঠিটি পড়েছিলেন। পড়ার পর তাঁর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল এইরকম --- ‘When I came across Tagore’s own reaction to Thompson’s book on 1926, my blood froze. ’

১১

তবু যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে টমসন ও অ্যারনসন --- দুজনের কথাই ঠিক, তাহলেও কি বলা যায় যে, কিছু সংবাদপত্রে প্রকাশিত সমালোচনা দ্বারা কোনো সাহিত্যকর্মের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ নির্ণীত হওয়া সম্ভব? ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে কীটস -এর ‘Endymion’ প্রকাশিত হলে ‘The Quarterly Review’ এবং ‘Black-woodMagazine’ -এ তার কঠোর সমালোচনা হয়েছিল। শেলী ও বায়রন -এর মতো কবিরা এই ঘটনাকেই কীটস -এর অকালমৃত্যুর কারণ বলে মনে করেছিলেন। বায়রন লিখেছিলেন --John Keats, who was killed off by one critique, just as he really promised something great...poor fellow! His was an untoward fate; ‘Tis strange the mind, that very fiery particle should let itself be snuffed out by an article.১২ আর শেলী তাঁর ‘Adonais’ কাব্যে লিখেছিলেন --- ‘Our Adonais has drunk poison’ । শেলীর কাব্যের ‘Adonais’ হলেন আসলে কবি কীটস আর ‘poison’ বা 'বিষ' হল 'কোয়ার্টালি রিভিউ' -এর সমালোচনা। তিরিশের দশকের বাঙালি কবিরা যাঁর কাছে সর্বাধিক ঋণী, সেই এলিয়টও রেহাই পাননি সমালোচকদের হাত থেকে। এলিয়টের বহু পরিচিত কাব্য ‘The Wasteland’ প্রকাশিত হলে ১৯২৩ সালের ৩রা নভেম্বর ‘New Statesman’ পত্রিকায় J. L. Lucas লিখেছিলেন ...‘ ‘a poem that has to be explained in notes is not unlike

a picture with ‘this is a dog’ inscribed beneath. ’ ’ ক্লাইভ বেলও এই কবিতায় 'চিন্তার দৈন্য' লক্ষ করেছিলেন।১৩ কিন্তু তার ফলে কীটস বা এলিয়টের সৃষ্টিকর্মের মালিন্য বাড়েনি, বরং সমালোচকরাই হারিয়ে গেছেন কালের অমোঘ হস্তাবলেপে। 'সৌখীন নাট্যকলায় রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থের প্রণেতা হেমেন্দ্রকু মার রায় ঠিকই বলেছিলেন --- 'মুক্তা বেশ দামী আর সেরা জিনিস, কিন্তু তার সমঝদাররা যে বেনাবনবাসী নয়, প্রবাদ সে কথা আগে থাকতেই বলে রেখেছে।' সুতরাং কয়েকটি সাময়িকপত্রে কি সমালোচনা হল, না হল তার দ্বারা 'রক্তকরবী' নাটকের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ কিছুই প্রমাণ হয় না। শ্রীবিশ্বাস কিন্তু বিদেশি সমালোচকদের এই নাটক সম্পর্কিত ক্ষোভকে 'সঙ্গত' বলেই মনে করছেন, কারণ অনুবাদকালে রবীন্দ্রনাথ এত বেশি স্বাধীনতা নিয়েছেন যে 'সেইসব আশ্চর্য শব্দসম্বলিত বাক্যের অর্থভেদ করা বিদেশি পাঠকদের পক্ষে বেশ কঠিন' হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি তু লে দিয়েছেন নন্দিনীর একটি সংলাপের ভাষান্তর, যেখানে 'ভরা' শব্দটির ইংরেজি করেছেন রবীন্দ্রনাথ ‘fulfil’ । শ্রী বিশ্বাস বলছেন, 'ভরা' ক্রিয়াটির ইংরেজি ‘fil’ লিখলে ইংরেজরা সহজেই সংলাপটির মানে বুঝত কিন্তু '' ‘fulfil leisure’ বলতে রবীন্দ্রনাথ কি বোঝাতে চাইছেন কোন ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠকের পক্ষে সেটা বোঝা কোনমতেই সম্ভব নয়।'' ইংরেজি অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ সফল নাকি ব্যর্থ সেটা দীর্ঘ বিতর্কের ব্যাপার কিন্তু আমাদের মতো বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের পক্ষে যেটা বোঝা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, তা হল, শ্রীবিশ্বাস কোন ইংরেজ পাঠকদের কথা বলছেন যাঁরা 'ভরা' ক্রিয়াটির ইংরেজি ‘fill’ লিখলে 'সহজেই' বুঝে যেতেন কিন্তু ‘fulfil’ লেখার ফলে বুঝতে না পেরে নাটকটিকে ‘absolute nonsense’ ভেবে বসেন?১৪ এমনিতে অনুবাদ কর্ম খুব সোজা নয়। ভাষান্তরীকরণের পরেও মূলভাবটিকে ধরে রাখা সহজসাধ্য নয়। দান্তে অনুবাদকদের যে ‘traitor’ বলেছিলেন তা এই কারণেই। রবীন্দ্রনাথও যদি তা না পেরে থাকেন, তবে তা খুব অস্বাভাবিক নয় কিন্তু 'রক্তকরবী' সম্পর্কে বিদেশি পাঠকদের বিরূপতা কি এই কারণেই? শ্রীবিশ্বাস নিজেই জানাচ্ছেন যে অনুবাদের ব্যর্থতা নয়, আসলে এ ধরনের প্রতীকী নাটক সম্পর্কেই বিদেশি পাঠক -দর্শকদের উৎসাহে ভাঁটা পড়তে শুরু করেছে। এটাই যদি কারণ মনে হয় তাঁর, তাহলে টমসন, অ্যারনসনদের গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃ তি তু লে দিয়ে 'রক্তকরবী'র ইংরেজি অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের ব্যর্থতা প্রমাণের চেষ্টা কিসের জন্যে? সিম্বলিস্ট নাটকের আত্মমগ্নতা, দুরূহতা সম্পর্কে পাঠক -দর্শকের বিরক্তিকে শ্রীবিশ্বাস মনে করছেন 'ন্যায্য বিরক্তি'। Ernest Renan -এর বক্তব্য তু লে ধরে তিনি এইসব

প্রতীকী শিল্পকর্মের স্রষ্টাদের 'সমাজবাস্তব বিচ্ছিন্ন' আখ্যা দিয়েছেন। অথচ প্রকৃ ত সত্য হল এই যে, Symbolist আন্দোলন ছিল জরাজীর্ণ রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে একটি সাহিত্যিক আন্দোলন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে রাজনৈতিক -অর্থনৈতিক সংকট তো বটেই, সেইসঙ্গে বিজ্ঞান ও দর্শনের জগতেও আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব, ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ মানুষের মন থেকে সনাতন বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ভিত্তিটিকে নড়িয়ে দিয়েছিল। ব্যক্তির অহংকে স্বীকৃ তি দিয়েছিলেন ফ্রয়েডই। সার্ত্র -এর অস্তিবাদী দর্শনও এই কথাই শৈখাল --‘Subjectivity must be the starting point. ’ । ঈশ্বর নেই, মানুষ বড়ো অবিশ্বাসী, সভ্যতাও নিষ্ঠু র --- এই তত্ত্ব কবির আবিষ্কার নয়, তা বিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতিরই অবদান। যুগের অস্থিরতা, ক্লান্তি, উদ্বেগ, শূন্যতার বোধ কবিকেও গ্রাস করে নিল। ‘Life is not worth living’ --- শোপেনহাউয়্যার -এর বক্তব্য তাঁদের কাছে মিথ্যে বলে মনে হল না এবং নীৎসের মতো তাঁরাও মনে করলেন, সব জটিলতা ও সংকটের মধ্যে মানুষের মূল্য প্রমাণিত হবে একটি জায়গায় ‘the ability to hold his own’ ।১৫ অস্তিত্বের সংকটে বিহ্বল ও জটিল ব্যক্তিত্বের মুক্তিই প্রতীকী শিল্প -সাহিত্যের জন্ম দিল। এ এক ঐতিহাসিক অনিবার্যতা, যা রোমান্টিকতা পরবর্তী সাহিত্য - আন্দোলনের জন্মদাতা। এলুয়ার আরাগঁ -র মতো কম্যুনিস্ট কবিরাও এই আন্দোলন থেকে সাহিত্যিক -দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্র -পরবর্তী তিরিশের দশকের কবিরাও আধুনিকতার পথে যাত্রা করেছিলেন এই আন্দোলনকে অনুসরণ করেই। রবীন্দ্রনাথ কখনোই সময়ের পদধ্বনি শুনতে ভু ল করেননি বলেই সিম্বলিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত না করলেও আন্দোলনের গতিপ্রকৃ তির খবর রেখেছিলেন এবং সময়ের সাথে সাথে বদলে নিয়েছিলেন নিজস্ব নাট্যরীতি। শ্রীবিশ্বাস এই আন্দোলনকে খুব একটা সুস্থ, জীবনমুখী, প্রাণবন্ত, সমাজসচেতন ও মানবিক বলে ভাবতে পারেননি। বস্তুত, একে তিনি সময়ের প্রেক্ষিত থেকে বিচার করেননি। করলে সাহিত্যের কাছে সময়ের এই অনিবার্য দানকে এভাবে অবজ্ঞা করতেন না। রেনানের ব্যঙ্গোক্তির পাশাপাশি আর্থার সিমন্স -এর কথাও আমরা মনে রাখব, যিনি বলেন ‘Without symbolism there can be no literature’

১৬

প্রতীকবাদে আস্থা রাখলেই তাঁকে 'ফ্যাসিস্ট' হতে হবে এমন নয়। এলিয়টের কাছে বিষ্ণু দে -র ঋণ অপরিসীম, অথচ এলিয়ট রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী আর বিষ্ণু দে সাম্যবাদী। পিকাসো সুর -রিয়ালিস্টদের গোত্রভু ক্ত ছিলেন, পরে কিউবিজমের সূচনা করেন অথচ

তিনিই আবার ফ্রাঙ্কোকে মানবতা ও সংস্কৃ তির শত্রু বলে চিহ্নিত করেন; 'গের্নিকা', চিত্রকলায় রূপ দেন জার্মানদের বোমায় বিধ্বস্ত গের্নিকা শহরের। এ হল সেই ছবি ---‘in which he uses his symbolic technique of expressionistic laceration of the human body to express pain & horror. ’ ১৭ যুদ্ধশেষে এই পিকাসোই যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। কোনো সন্দেহ নেই যে প্রতীকী শিল্পসাহিত্য কিঞ্চিৎ দুরূহ। কিন্তু যা দুরূহ --- -তাই বাস্তববিচ্ছিন্ন 'আত্মকণ্ডূয়ন' নয়। তাছাড়া সুধীন্দ্রনাথ তো বলেই ছিলেন --- 'যে দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে, তার জন্যে কবির উপরে দোষারোপ অন্যায়।''১৮ প্রশ্ন উঠতে পারে, 'রক্তকরবী'র তথ্য ও তত্ত্ব অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রবন্ধকার সিম্বলিস্ট আন্দোলন নিয়ে এত পড়লেন কেন? আন্দোলনের বিকাশ ও বিবর্তনের কথাও বলছেন না, শুধু বিদ্রূপ করছেনই বা কেন? উত্তর হল, আসলে তাঁর লক্ষ্য এক 'গভীর অনর্থ' --- যার সূত্র তিনি পেয়েছেন 'রক্তকরবী' নাটকের প্রস্তাবনায়। কি বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সেই প্রস্তাবনায়? বলেছিলেন, 'ভয় হচ্ছে পালা সাঙ্গ হলে ভিখ মিলবে না, কু ত্তা লেলিয়ে দেবেন। তারা পালাটিকে কু টি কু টি করার চেষ্টা করবে।' শ্রীবিশ্বাস এই মন্তব্যকে 'চড়া রসিকতা' মনে করেছেন। রসিকতাই হয়তো, কিন্তু তার নেপথ্যে অজস্র করুণ অভিজ্ঞতা -প্রসূত আক্ষেপ নেই, একথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। সারাজীবন রবীন্দ্রসাহিত্যের যেসব সমালোচনা কবি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তারপরে ভিখ না মেলার ভয় থাকাই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ 'চিত্রাঙ্গদা' লিখলে তার সমালোচনা হচ্ছে এইভাবে --- ''চিত্রাঙ্গদা! বেচারা মা আমার! বঙ্গের কবিবরের হাতে পড়িয়া তোমার যে এহেন দুর্গতি হইবে, তাহা বোধহয় স্বপ্নেও ভাব নাই...এ পুস্তকখানি দগ্ধ করা উচিত।'' সমালোচক আর কেউ নন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।১৯ রবীন্দ্রনাথের 'শাস্তি' গল্পটি প্রকাশিত হলে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখেছেন --- 'লেখক গল্পটি লিখিয়া কাহাকে শাস্তি দিতে চাহেন, বুঝিতে পারিলাম না। যদি পাঠককে শাস্তি দেওয়াই তাঁর লক্ষ্য হয়, তাহা হইলে সেই উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সিদ্ধ হইয়াছে।'২০ রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার কয়েকটি পঙক্তি ছিল এইরকম --নয়নে ঘুম নিল কেড়ে উঠে বসি শয়ন ছেড়ে মেলে আঁখি চেয়ে থাকি

পাইনে দেখা তার। এই কবিতার সমালোচনা হচ্ছে এইভাবে --- 'কবি যে অবস্থার বর্ণনা করিয়াছেন তাহা ভু ক্তভোগী ভিন্ন আর কেহ বুঝিতে পারিবে না, এ রোগে আঁখি মেলিয়া সারা রাত্রি চাহিয়া থাকিতে হয় কিন্তু ঘুমের দেখা পাওয়া যায় না। ইহা ‘Insomnia’ , অর্থাৎ অনিদ্রা রোগের কথা। আমরা পড়িয়াছি আর কাঁদিয়াছি।'২১ এঁরা হলেন সেইসব সমালোচক, যাঁদের শেলী 'নেকড়ে' আর 'শকু ন' ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথের ভয়ও সম্ভবত সাহিত্যবোধবিবর্জিত এইসব সমালোচকদের জন্য। শ্রীবিশ্বাস আরো জানিয়েছেন যে, '' 'রক্তকরবী'র আগে রবীন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটি রূপক নাটক লিখেছেন; সেগুলি যে খুব ভালো নাটক হয়েছে তা নয়।'' --- এটা একান্তভাবেই লেখকের ব্যক্তিগত রুচি ও পছন্দের ব্যাপার। তবে রবীন্দ্রনাথের এইসব নাটক সম্পর্কে অনেকেরই শ্রদ্ধালু মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘ ‘William Butler Yeats highly praised Tagore’s most widely knwon play for its construction and the ‘emotion of gentleness and peace’ conveyed by Tagore’s portrayal of the delicate little boy’s curiousity and yearnings. ’ ’ ২২ ইয়েটস -এর এই উচ্ছ্বাস রবীন্দ্রনাথের 'ডাকঘর' নাটকের ইংরেজি অনুবাদ ‘The post-office’ সম্পর্কে। মুগ্ধ ইয়েটস নাটকটিকে আইরিশ থিয়েটারে অভিনয় করাতেও উদ্যোগী হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের 'রাজা' নাটকের ভাষান্তরিত রূপ ‘King of the Dark-Chamber’ -ও অভিনীত হয়েছে ইংল্যান্ডের লিটল থিয়েটারে। আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথের প্রতীকী নাটকগুলি অভিনয় করাবার ব্যাপারে শম্ভু মিত্র যে উদ্যোগী হয়েছিলেন, সেও এর নাট্যোৎকর্ষের কথা ভেবেই। এ পর্যন্তের আলোচনায় শ্রীবিশ্বাস 'রক্তকরবী' নাটকের 'অনর্থ' প্রমাণ করতে পারেননি। অতঃপর সেই 'অনর্থ' খুঁজে পেলেন তিনি নাটকের প্রস্তাবনায়। কি বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সেখানে? প্রস্তাবনায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন --- 'পালাটি ঐতিহাসিক দিক থেকে সত্যমূলক নয়, কবির জ্ঞানবিশ্বাসমতে সত্য।' নাট্যপরিচয় দান করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ আবার বললেন -- 'এ নাটকটি একেবারেই পৌরাণিক কালের নয়।' শ্রীবিশ্বাস এর নির্গলিতার্থ করলেন এইভাবে, যেহেতু এটা কবির 'জ্ঞানবিশ্বাসমতে সত্য', এবং তা 'পৌরাণিক কালের নয়' সুতরাং নাটকটির নেপথ্যে রয়েছে কবির ব্যক্তিগত জীবনের কোনো ঘটনা বা অভিজ্ঞতা। কিন্তু জ্ঞানবিশ্বাসমতে সত্য বলতে কি অভিজ্ঞতার সত্যকে বোঝায়? যে সত্য কবির

বিশ্বাসের জগৎ থেকে পাওয়া সে তো তাঁর 'হৃদা -মনীষা - মনসা' উপলব্ধ সত্য। সেই সত্যের প্রতিফলন এ নাটকে ঘটেছে বলেই তা 'কবির জ্ঞানবিশ্বাসমতে সত্য।' পাশাপাশি, নাটকের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে রাম -রাবণের যে প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ উত্থাপন করেছেন, তাতে পাঠকের বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে, একথা ভেবেই তাঁকে জানাতে হল যে 'নাটকটি একেবারেই পৌরাণিক কালের নয়।' শ্রীবিশ্বাস যে সত্যকে সন্ধান করতে চাইছেন, তা হল তথ্য। সেটা নেই বলেই এ নাটক 'ঐতিহাসিক দিক থেকে সত্যমূলক নয়।' 'রক্তকরবী' নাটকের সঙ্গে কবির ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার সন্ধান করতে গিয়ে শ্রীবিশ্বাস লেডি রাণু মুখার্জীর প্রসঙ্গে তু লেছেন। 'অনুষ্টু প' -এর গ্রীষ্ম -বর্ষা সংখ্যায় শ্রীশঙ্খ ঘোষ সে রহস্যের নিরসনও ঘটিয়েছেন। কিন্তু এই প্রসঙ্গের উত্থাপন ঘটল কেন? তবে কি এই অনর্থের জন্যই উদ্বিগ্ন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ? অথচ শ্রীবিশ্বাস নিজেই বলছেন --''এলমহার্স্টের দেওয়া এই তথ্য রবীন্দ্রজীবনীর দিক থেকে কিছুটা প্রাসঙ্গিক হতে পারে, কিন্তু 'রক্তকরবী': নাটকের আলোচনার ক্ষেত্রে খুব একটা উল্লেখযোগ্য তথ্য নয়।''২৩ আমরা তো জানি, প্রবন্ধকার 'রক্তকরবী' নিয়েই আলোচনা করতে চেয়েছেন, রবীন্দ্রজীবনী লিখতে নয়। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি বললেন --- 'রক্তকরবী'র থিম নন্দিনী -রাজা -রঞ্জনের ত্রিকোণ প্রেমকাহিনীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি'২৪ তখন বোঝা গেল লেখক এখনও 'অনর্থের' সন্ধান পাননি বটে কিন্তু এভাবেই নেতি নেতি করে ইতিতে পৌঁছোতে চাইছেন। অতঃপর শ্রীবিশ্বাসের সন্দেহ গিয়ে পড়ল 'রক্তকরবী'র মৌলিকতা বিষয়ে। তাঁর বিশ্বাস স্ট্রিন্ডবার্গের লেখা ‘A Dream paly’ নাটকটির অনুকরণেই 'রক্তকরবী'র সৃষ্টি এবং স্ট্রিন্ডবার্গের নাটকের ক্রিসেন্থিমাম ফু লটি এখানে রক্তকরবীতে রূপান্তরিত। 'রক্তকরবী' নাটকের প্রাথমিক নাম ছিল 'যক্ষপুরী', পরে রবীন্দ্রনাথ এর নাম দেন 'নন্দিনী' এবং শেষে 'রক্তকরবী'। কেন 'রক্তকরবী'? এ সম্পর্কে প্রমথনাথ বিশী যে তথ্য দান করেছেন,২৫ প্রবন্ধকার তাকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন। লোহার জাল -জঞ্জাল ভেদ করে রক্তকরবী ফু লের একটি গাছ তার প্রাণস্পন্দনের অনিরুদ্ধ প্রকাশকে অব্যাহত রেখেছিল। এই দৃশ্যটিই রবীন্দ্রনাথকে নাটকের নামকরণ পরিবর্তনে প্রাণিত করেছিল, ক্ষিতিমোহন সেনের সাক্ষ্য থেকে পাওয়া এই তথ্যটিকেও অস্বীকার করে শ্রীবিশ্বাস বলছেন, 'ঐ গাছ ও ফু লের প্রেরণায় রক্তকরবী প্রতীকটি নাটকে আসেনি, নাটকের প্রতীকটির প্রেরণাতেই যেন রবীন্দ্রনাথের ঘরের পাশে লোহার জাল জঞ্জালের মধ্যে ফু লটিকে ফু টতে হয়েছিল নাটকের সঙ্গে বেশ মানানসই করে।' অস্যার্থ নাটকের নামকরণ যে রক্তকরবী করা হবে, সেটা

আগেই স্থির হয়ে গিয়েছিল। পরে নাম পরিবর্তনের যুতসই অজুহাত হিসেবে এই গল্পটাকে খাড়া করা হয়েছে। তা শ্রীবিশ্বাসের এই সন্দেহের হেতু কী? ১) 'রক্তকরবী' নামকরণ যখন হয়নি, তখনও নাটকে রক্তকরবীর প্রসঙ্গ এসেছে। ২) আবর্জনায় জাত ফু লের আলোকাভিসারের ভাবনা -সম্বলিত প্রতীকটি স্ট্রিন্ডবার্গের নাটকে আগেই ব্যবহৃত হয়েছে এবং রবীন্দ্রনাথ রক্তকরবী ফু লের প্রতীকটিকে ব্যবহারের প্রেরণা এখান থেকেই পেয়েছেন। প্রথম সন্দেহটি শঙ্খ ঘোষের পূর্বোক্ত প্রবন্ধেই২৬ দূর করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় সন্দেহটির কথা পড়লে মনে হয়, দ্বিতীয় শ্রেণির গোয়েন্দাকাহিনির তদন্তকার্যও এর চাইতে বুদ্ধিদীপ্ত হয়। ‘The Ghost Sonata’ -য় হায়াসেন্থ ফু ল আছে; ‘A Dream play’ তে আছে ক্রিসেন্থিমাম আর রবীন্দ্রনাথের নাটকে 'রক্তকরবী'। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ প্রথম দুটি নাটক থেকে ধার করেছেন --- এমন অনায়াস সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠায় যুক্তিশাস্ত্রও লজ্জাবোধ করবে। এরকম অদ্ভু ত আরও কিছু সাদৃশ্য খুঁজে বের করেছেন প্রবন্ধকার। যেমন, স্ট্রিন্ডবার্গের নাটকে আছে ‘dirt’ আর ‘light’ শব্দ দু'টি। রবীন্দ্রনাথে আছে 'ধুলো' এবং 'আলো'। রাজা নন্দিনীকে প্রথম সাক্ষাতেই নাম ধরে ডেকেছে, স্ট্রিন্ডবার্গেও officer নাম ধরে ডেকেছে Daughter -কে। মিল দেখানোই যদি উদ্দেশ্য হয়, তবে এরকম হাজারটা নাটক পাওয়া যাবে, যেখানে এই সব শব্দ খুঁজে পাওয়া যাবে আর একটি চরিত্র অপর চরিত্রের নাম ধরে প্রথম দর্শনেই ডাকবে। নাটকের নামকরণ প্রসঙ্গে অবশ্য একথা বোধ হয় বলা যায় যে, ‘A Dream play’ নাটকের ক্রিসেন্থিমাম আর 'রক্তকরবী' নাটকের রক্তকরবী সমান তাৎপর্যবাহী নয়। লোহার আবর্জনা ভেদ করে যে রক্তকরবী ফু লটি প্রাণের অবাধ উল্লাসে মাথা তু লে দাঁড়ায়, সে তো কেবল একটিমাত্র রক্তকরবীর জীবন সত্য নয়, সে প্রাণের অম্লান প্রকাশবিহ্বলতাকেই প্রতিষ্ঠিত করে; মূর্ত করে তোলে তার মৃত্যুঞ্জয়ী মহিমাকে। 'যক্ষপুরী' বা 'নন্দিনী'তে নামকরণ ব্যক্তিক স্তরেই সীমায়িত থেকে যায় কেননা নন্দিনী তো শুধু শ্রেণিগত মানুষের কথা নয়, তা যে মানুষগত শ্রেণিরও। তাই 'রক্তকরবী' এই নামের মধ্যস্থতায় নাট্যকার বিশেষকে নির্বিশেষে উন্নীত করে তোলেন। শুধু আবর্জনা থেকে আলোয় যাত্রার গুরুত্বহীন সদৃশতায় 'রক্তকরবী' নাটকের নামকরণের কারণটিকে বোঝা যাবে না।

এখানে শ্রীবিশ্বাসের একটি কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি বলছেন যে, ফু লকে প্রতীকরূপে ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্ট্রিন্ডবার্গও মৌলিক সৃষ্টিকর্মের স্বাক্ষর রাখেননি। তিনিও আসলে বৌদ্ধতন্ত্রসাধনায় ব্যবহৃত পদ্মফু লের প্রতীকটিকেই 'সৃষ্টি ও বিশ্বসৃষ্টির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন।'২৭ তাই যদি হয়, তবে প্রমথনাথ বিশী যখন রবীন্দ্রনাথের নাটকে কোনো অভারতীয় আদর্শের প্রভাব খুঁজে পান না, তখন শ্রীবিশ্বাস অবাক হন কেমন করে? উপরন্তু, রক্তকরবী যদিও 'সৃষ্টি ও বিশ্বসৃষ্টির প্রতীক' নয়, তবু যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে রবীন্দ্রনাথ স্ট্রিন্ডবার্গ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন,তবে প্রশ্ন দাঁড়ায় স্ট্রিন্ডবার্গ স্বয়ং যখন ভারতীয় দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত, তখন রবীন্দ্রনাথের ঋণ মূলত কার কাছে? অবশ্য এ প্রশ্ন অবান্তর কেননা রক্তকরবী আদৌ 'সৃষ্টি ও বিশ্বসৃষ্টির প্রতীক' নয়। 'শান্তিনিকেতন' প্রবন্ধমালায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন --- 'এই চঞ্চল সংসারের মধ্যে যেখানে আমাদের প্রেম, কেবলমাত্র সেইখানেই আমাদের চিত্তের স্থিতি।...অথচ সেইখানে তার ক্রিয়াও বেশী।'২৮। এই 'প্রেমের শতদল পদ্ম অহঙ্কারের বৃন্ত আশ্রয় করে আত্ম হ'তে গৃহে, গৃহ হ'তে সমাজে, সমাজ হ'তে দেশে, দেশ হ'তে মানবে, মানব হ'তে বিশ্বাত্মায়, বিশ্বাত্মা হ'তে পরমাত্মায় একটি একটি করে পাপড়ি খুলে দিয়ে বিকাশের লীলা সমাধান করছে।'২৯ রক্তকরবী হল প্রানল্লাসে পূর্ণ প্রেমের সেই রক্তবর্ণ শতদল। দুটি নাটকের মধ্যে অন্যান্য যে মিলগুলি শ্রীবিশ্বাস দেখিয়েছেন, সেগুলিকেও কি সত্যসত্যই মিলিয়ে দেখা সম্ভব? যেমন, স্ট্রিন্ডবার্গের Daughter দুর্গের মধ্যে রাজকর্মচারীকে বলেছে --- ‘You are a prisoner in your own room, I have come to set you free. ’ আর, 'রক্তকরবী'র নন্দিনী বলেছে --- 'তু মিতো নিজেকেই জালে বেঁধেছ...তু মিও বেরিয়ে এসো রাজা।' প্রথমত : স্ট্রিন্ডবার্গের নাটকে Daughter-এর উক্তিটি একটি অখণ্ড বাক্যে পরিবেশিত কিন্তু 'রক্তকরবী'তে নন্দিনীর সংলাপ -রূপে যা দেখানো হয়েছে তা কিন্তু একসঙ্গে উচ্চচারিত একটি অখণ্ড সংলাপ নয়। বরং কয়েকটি খণ্ডিত সংলাপের কৌশলী সমাহার। পৌষের গান শোনা যাচ্ছে দূরে। গানের মধ্যে নন্দিনী রাজাকে বলেছে 'তু মিও বেরিয়ে এসো রাজা, তোমাকে মাঠে নিয়ে যাই।' শুনে রাজা প্রশ্ন করেছে --- 'আমি মাঠে যাব? কোন কাজে লাগব?' এর অনেক পরে রাজা যখন অসহায়ভাবে আক্ষেপ করেছে --- 'আমার যা আছে সব বোঝা হয়ে আছে। সোনাকে জমিয়ে তু লে তো পরশমণি হয়না --- শক্তি যতই বাড়াই যৌবনে পৌঁছল না...এমনি করে বাঁধনের রশিতে গাঁট দিতে দিতেই সময় গেল। হায়'রে, আর সব বাঁধা পড়ে, কেবল আনন্দ বাঁধা পড়ে না।'

এই উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে নন্দিনীর উক্তি 'তু মি তো নিজেকেই জালে বেঁধেছ, তার পরে কেন এমন ছটফট করছ বুঝতে পারিনে।' আলাদাভাবে লেখা দুটি সংলাপের দুটি বিচ্ছিন্ন অংশকে একত্র সন্নিবেশিত করে প্রবন্ধকার দেখাতে চাইছেন স্ট্রিন্ডবার্গের কাছে রবীন্দ্রনাথের ঋণ কত অপরিসীম। আলাদা না থেকে যদি নন্দিনীর সংলাপের ওই দুটি অংশ একসঙ্গেই থাকত, তাহলেও কি মিলের কথা ভাবা যেত? Daughter -এর সংলাপে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে Daughter এসেছে মুক্ত করতে। কিন্তু নন্দিনী রাজাকেই বেরিয়ে আসতে বলছে। রাজা নিজেই নিজের বন্ধনদশা ঘোচাবেন; তাঁর নিজের মধ্যেই তো পাপ আর সেই পাপের মৃত্যুবান সংগুপ্ত রয়েছে; সহাবস্থান করছে রাবণ আর বিভীষণ দুই বিপ্রতীপ সত্তা। 'সে আপনাকেই আপনি পরাস্ত করে।'৩০ আর একটি মিলের কথা বলছেন শ্রীবিশ্বাস --- নন্দিনীর মধ্যে রাজা 'আগুন, রাজা আগুন' দেখেছেন আর স্ট্রিন্ডবার্গের নাটকের Daughter -ও তাঁর মতে ইন্দ্রকন্যা ''তাঁর ‘Agnes’ নামের ভেতরে লুকোনো আছে 'অগ্নি' শব্দটি।'' রবীন্দ্রসাহিত্যের দিকে একটু নজর রাখলেই শ্রী বিশ্বাস দেখতে পেতেন নারীকে 'আগুন' বলে উপমিত করা এই প্রথম নয়। আত্মপরিচয় দিয়ে 'মালিনী' (১৮৯৬) নাটকের মালিনী বলেছিল --- 'যে মোর অন্তরযামী অগ্নিময়ী মহাবাণী, সেই শুধু আমি।' 'চার অধ্যায়' উপন্যাসে ইন্দ্রনাথ কানাই গুপ্তের কাছে এলার মতো সুন্দরী নারীকে আনার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে --- 'আগুনকে যে ভয় করে সে আগুনকে ব্যবহার করতে পারে না। আমার কাজে আমি আগুনকে বাদ দিতে চাইনা।' নারী যেহেতু প্রেরণা জোগায়, শক্তি জোগায় পুরুষের সকল কর্মে ---রবীন্দ্রনাথ তাই তার মধ্যে আগুনকে প্রত্যক্ষ করেন। এলা -নন্দিনী -অপর্ণা সকলেই এই হিসেবে আগুন। নন্দিনী যে 'ইন্দ্রদেবের আগুন' কারণ মালিনীর তো সেও বহন করছে সেই 'অগ্নিময়ী মহাবাণী', যার স্পর্শে নিখিল বিশ্বের সঙ্গে মানবচিত্ত এক যোগে বিহার করতে পারে। তখন 'পরিত্রাণ' -এর ধনঞ্জয় বৈরাগীর মতো রাজাকে 'রাজা' না বলে 'ভাই' বলে ফেলার মতো অবস্থা হয় কিংবা অমল পেয়ে যায় তার প্রতীক্ষিত চিঠি। সেই 'আমির আবরণ' যখন ঘুচে যায়, তখনই রাজা ভেঙে ফেলেন তাঁর লোহার জাল, অমলের আঁধার ঘরে প্রবেশ করে অনন্তের আলো, ভেঙে যায় অচলায়তন, অন্ধকার গুহা থেকে আত্মপ্রকাশ করে নবীন। এ যারা বোঝে না, মাধব দত্তের মতো সেইসব বৈষয়িক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রতিই ঠাকু রদার এই তিরস্কার --- 'চু প করো অবিশ্বাসী! কথা কোয়ো না।'

কেবলমাত্র একটি 'প্রতিমাবিন্যাস' -এর ক্ষেত্র ছাড়া স্ট্রিন্ডবার্গের ‘A Dream play’ -র সঙ্গে 'রক্তকরবী'র আর কোনো সাদৃশ্য চোখে পড়েনি শঙ্খ ঘোষের।৩১ পক্ষান্তরে শ্রীবিশ্বাস মনে করেন 'বিন্যাসের ক্ষেত্রেও রক্তকরবী নাটকের সঙ্গে A Dream play নাটকের সাদৃশ্য যথেষ্টই।'৩২ কতখানি সেই সাদৃশ্য? বিষয়টি নিয়ে শ্রী শঙ্খ ঘোষই আলোচনা করেছেন 'অনুষ্টু প' -এর গ্রীষ্ম -বর্ষা যুগ্ম সংখ্যায়। তাঁর বক্তব্যের সারার্থ --''স্থান বা কালের বিন্যাসে 'রক্তকরবী' দাঁড়িয়ে আছে A Dream play -এর একেবারে বিপরীত বিন্দুতে।''৩৩ চরিত্রনির্মাণের ক্ষেত্রে একই চরিত্রের বহুমাত্রিক রূপান্তর সম্বন্ধে যে কথা বলেছেন লেখক, তা নূতন কিছু নয়। অশ্রুকু মার শিকদার ছাড়াও অনেকে বিষয়টি লক্ষ করেছেন। যেমন এ ব্যাপারে অশোক রুদ্রের মনে হয়েছে পিকাসো প্রবর্তিত cubist চিত্ররীতির কথা।৩৪ এই রীতিতে একই বিষয় যেমন ভিন্ন ভিন্ন কৌণিক অবস্থান থেকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা লাভ করে, রবীন্দ্রনাথের নাটকের বহু চরিত্র তেমনই একাধিক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব লাভ করেছে। শ্রীরুদ্র অবশ্য এর কারণ নিয়ে ভাবেননি তবু বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের পরিচয় তু লে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র নাট্যশিল্পকে যদি ধরে নেওয়া যায় তার এক অখণ্ড যাত্রা, তবে বোঝা যাবে কেন 'প্রায়শ্চিত্ত' -র ধনঞ্জয় বৈরাগী প্রজাবিদ্রোহের নায়ক হয়ে যায়, রাজা হয়ে যান সন্ন্যাসী, ঠাকু রদা আর বিবাগী ফকির এক হয়ে যান, বিশু পাগল হয়ে যায় 'রঞ্জনের ও পিঠ'। আসলে পর্বে পর্বে এই বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সমগ্র মানবের স্বরূপকে অনুসন্ধান করেছেন রবীন্দ্রনাথ। স্ট্রিন্ডবার্গের বহুমাত্রিক চরিত্র বিন্যাসের মধ্যে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। রবীন্দ্রনাটকে পথ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে Edward Thompson লক্ষ করেছিলেন ‘The drifting pageant of an Indian Road’ । টমসনের অন্যত্র প্রযুক্ত মন্তব্য শ্রীবিশ্বাসকে সন্তুষ্ট করলেও, এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে লেখকের মনে হয় তা 'আজগুবি তত্ত্ব' --- যা তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রানুসারীদের খুশি করবার জন্যই বলা হয়েছে। কিন্তু এখানে তিনি যেটি এড়িয়ে যেতে চাইছেন এবং যা শঙ্খ ঘোষের দৃষ্টিতেও ধরা পড়েছিল যে 'টমসনই সম্ভবত প্রথম লক্ষ করেছিলেন যে রবীন্দ্রনাট্যকলায় বাঙলাদেশের একটি নিজস্ব জীবনমান তৈরী আছে...'৩৫। শ্রী বিশ্বাস বলেছেন, রবীন্দ্রনাটকে 'পথ ইমেজটির ব্যবহারের মধ্যে টমসন কেন একটি বিশেষ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করলেন ঠিক বোঝা যায় না।' এরকম একটি ধাঁধা আমাদের মনেও জাগে যে, ভারতীয় জীবন

ভাবনাতেই যখন পথ রূপকটি অঙ্গীভূ ত হয়ে আছে, তখন রবীন্দ্রনাটকে তার ব্যবহার প্রসঙ্গে কেন বিদেশি নাট্য প্রভাবের কথা ভাবা হবে, সেটাও কি ঠিক বোঝা যায়! 'তপতী' নাটকের ভূ মিকায় দৃশ্যপটকে 'উপদ্রব' বলে অভিহিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কেননা, 'অভিনয় ব্যাপারটা বেগবান, প্রাণবান, গতিশীল; দৃশ্যপটটা তার বিপরীত; অনধিকার প্রবেশ ক'রে সচলতার মধ্যে থাকে সে মূক, মূঢ়, স্থানু দর্শকের চিত্তদৃষ্টিকে নিশ্চল বেড়া দিয়ে সে একান্ত সংকীর্ণ করে রাখে।'৩৬ প্রসঙ্গত, তাঁর মনে পড়েছিল যাত্রার কথা --- 'মন যে জায়গায় আপন আসন নেবে সেখানে একটা পটকে বসিয়ে মনকে বিদায় দেওয়ার নিয়ম যান্ত্রিক যুগে প্রচলিত হয়েছে, পূর্বে ছিল না। আমাদের দেশে চিরপ্রচলিত যাত্রার পালাগানে লোকের ভিড়ে স্থান সংকীর্ণ হয় বটে, কিন্তু পটের ঔদ্ধত্যে মন সংকীর্ণ হয় না।'৩৭ দেখা যাচ্ছে বাংলার যাত্রাপালা থেকেই যথেষ্ট প্রেরণা পাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। সমুদ্র পেরিয়ে স্ট্রিন্ডবার্গের কাছে যাবার কোনো প্রয়োজনই পড়ছে না তাঁর। ফলে নিজের নাটককে অনায়াসে 'পালা' বলে চিহ্নিত করতেও পারছেন তিনি, যা দেখে টমসনকে বলতে হচ্ছে, ‘His indebtness to Bengal to something deeper & truer than books, shows in many qualities of his work, and shows especially in one quality which is very rich in all his poetry, but richest of all in his dramas. ’

৩৮

আসলে অঙ্কের গোঁজামিল মেনে সবকিছুকে মিলিয়ে দেখতে চাইছেন প্রবন্ধকার। বিপ্রতীপকে অনায়াসে মিলিয়ে দেওয়ার এই যে সরল সমীকরণ পদ্ধতি --- তারই প্রতিফলন ঘটেছে রবীন্দ্রনাটকে পথ ব্যবহার প্রসঙ্গে তাঁর 'স্ট্রিন্ডবার্গের কথা না মনে পড়া বেশ কঠিন' --- এই মন্তব্যে। অথচ লেখক জানেন যে '' ‘The Road to Damascus’ নাটকের নামের মধ্যে নাটকের বিষয় অর্থাৎ আধ্যাত্মিক মুক্তিপথের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে''; ‘Easter’ নাটকে শিশু Eleanora-র ‘ ...the road leads upwards, that is why it is so toilsome’ বক্তব্যেও আধ্যাত্মিক মুক্তিপথের ইঙ্গিত স্পষ্ট। পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ কি এই আধ্যত্মিক মুক্তিপথের কথাই বলেন? 'মুক্তধারা'য় পথটাই অভিনয়ভূ মি এবং সে -পথও ‘Easter’ বা ‘The Road to Damascus’ -এর মতো কোনো আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ নয়। এখানে মুক্তির কথা আছে কিন্তু তা খণ্ড সত্য থেকে সত্যের সমগ্রতায় উত্তরণের মধ্যে যে মুক্তি --- তার কথা। ফলে পথ একবার হয়ে উঠছে বিষয়, আর একবার উত্তরণের পথ। এই পথেই অভিজিতের পরিণামী যাত্রা কিন্তু সেই যাত্রা মন্দিরে গিয়ে শেষ হয় না, সে যাত্রা করে প্রাণের বিনিময়ে

লব্ধ প্রাণপ্রৈতির অখণ্ড উপলব্ধির সত্যে। শঙ্খ ঘোষ তাই সঙ্গতভাবেই 'মুক্তধারা' ও 'রক্তকরবী' দুটি নাটকেই দৃশ্যপথ আর মুক্তিপথকে এক করে দেখতে চান না।৩৯ ফলে, দৃশ্যত 'রক্তকরবী'র মধ্যে 'অচলায়তনিক রুদ্ধতা'র 'দূরাগত সাদৃশ্য' চোখে পড়লেও শঙ্খ ঘোষ অনুভব করেন, '' 'অচলায়তনে'র রুদ্ধ অন্তর্গৃহের বাস্তবিকতা এ নাটকে নেই, উপরন্তু নন্দিনীর খোলামেলা মুক্তিতে নাট্যপরিবেশ আপনিই যেন ভরে ওঠে প্রত্যহাতীত আলোয়।''৪০ অথচ ‘The Road to Damascus’ -এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখার আত্যন্তিক আগ্রহে শ্রীবিশ্বাস 'রক্তকরবী'তে 'পথ ঠিক ততটা গুরুত্ব পায়নি' মনে করেন। শুধু এইটু কু চোখে পড়ে তাঁর --- ‘The Road to Damascus’ -এর মতো 'রক্তকরবী'ও শুরু হয়েছে দুর্গের সামনের পথে, শেষও হয়েছে ঐ একই জায়গায়, পথে।''৪১ অন্যদিকে শ্রীঘোষ দেখেন '' 'রক্তকরবী'তে চরিত্রের মধ্যেই খোলা মুক্তির যে আভাস''৪২ রয়েছে তাকে। এ নাটকে 'নন্দিনী নিজেই পথ' হয়ে উঠেছে 'বিসর্জন' -এর অপর্ণার মতো। পৌষের আবাহনমণ্ডিত গানের কথা আর সুরই যেন 'নন্দিনী' হয়ে উঠেছে। স্ট্রিন্ডবার্গের নাটকে কি চরিত্র আর পথ এভাবে একাকার হয়ে গেছে? 'মৃত্যুর হোক লয়' --- একথা যিনি উচ্চচারণ করতে পারেন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি আধ্যাত্মিক মুক্তি চাইবেন কেমন করে? তাই শ্রীবিশ্বাস যখন রবীন্দ্রনাটকে বারবার স্ট্রিন্ডবার্গের ‘Redemption’ বা 'ঋণশোধ' থিমটি লক্ষ করেন তখন আমাদেরও বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। আরও বিস্ময়কর হল 'উপনন্দ দুঃখের সাধনা দিয়ে আনন্দের ঋণ শোধ করছে' --- 'আমার ধর্ম' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিটিই শ্রীবিশ্বাসের এ জাতীয় সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার সূত্র। কিন্তু প্রকৃ ত সত্য হল এই যে, রবীন্দ্রনাথ যে ঋণশোধের সৌন্দর্যের কথা বলছেন, সেটা ‘Salvation through death’ নয়। এখানে প্রকৃ তি এবং মানুষ উভয়েই ত্যাগের মধ্য দিয়ে প্রেমের ঋণশোধে ব্যস্ত। 'ঋণশোধ' নাটকে শেখর বলেছে, --- 'ঠাকু র যদি তাকিয়ে দেখ তবে দেখবে, সব সুন্দরই দুঃখের শোভায় সুন্দর। এই যে ধানের খেত আজ সবুজ ঐশ্বর্যে ভরে উঠেছে এর শিকড়ে শিকড়ে পাতায় পাতায় ত্যাগ। মাটি থেকে জল থেকে হাওয়া থেকে যা কিছু ও পেয়েছে সমস্তই আপন প্রাণের ভিতর দিয়ে একেবারে নিংড়ে নিয়ে মঞ্জরীতে মঞ্জরীতে উৎসর্গ করে দিলে।' আর এরই পাশাপাশি 'প্রেমের আনন্দে উপনন্দ দুঃখের ভিতর দিয়ে জীবনের ভরা খেতের ফসল ফলিয়ে তু ললে।'৪৩ এর মধ্যে মৃত্যুর কথা নেই, আছে জীবনেরই কথা; প্রকৃ তির ত্যাগব্রতকে অন্তরে তু লে নিয়ে বালক উপনন্দের প্রেমের ঋণশোধের কথা। ত্যাগটু কু না থাকলে, দুঃখটু কু না সইলে সৌন্দর্য কিংবা প্রেম দুই -ই যে ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন ঋণটু কু ও হয় না শোধা। এ তো ভারতীয় জীবনভাবনারই কথা --- যার বীজ রয়েছে 'শকু ন্তলা'য়,

'কু মারসম্ভব' -এ কিংবা 'কাদম্বরী'তে। এর মধ্যে স্ট্রিন্ডবার্গ আসেন না, আসে না তাঁর ‘Salvation through death’ এবং ‘Redemption’ -এর তত্ত্বও। প্রবল দুঃখ সয়েও প্রকৃ তি শুধছে তার সৌন্দর্যের ঋণ --- তবেই তার মুক্তি। আর উপনন্দও প্রেমের ঋণ শুধছে --- ''পঙক্তির পর পঙক্তি'' লিখছে আর পেয়ে যাচ্ছে 'ছুটির পর ছুটি'। এই তার মুক্তি। এই মুক্তির কি কোনো শেষ আছে? প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত ধরে চলেছে এই ঋণশোধের পালা আর ছুটির পর ছুটি পাওয়া --- যেন প্রকৃ তির বুকে চলেছে ঋতু চক্রের অনন্ত আবর্তন। শুধু প্রমোদভাবনার বশেই তাই ঋতু উৎসব করতে শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, একথা ভাবা ঠিক নয়। উৎসবের আনন্দের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ কর্মসাধনাকেও, যাতে কেবল 'কর্তার ইচ্ছায় কর্ম' না হয়ে তা হয়ে ওঠে আনন্দসাধনাও। বাইরে যখন একদল বিপ্লবী ফাঁসির দড়ি গলায় পরছে, তখন রবীন্দ্রনাথের এই সাধনাকে অনাবশ্যক বলে কিংবা শ্রীবিশ্বাস যেমন ভেবেছেন 'মধ্যস্বত্বভোগী রাজনীতি' অথবা 'মায়াবাদের শিক্ষা' বলে মনে হতে পারে। কিন্তু 'পঞ্চভূ ত' -এর স্রোতস্বিনীর এই কথাটাও ফেলে দেবার নয় যে, --- 'অনাবশ্যক অনেক সময় আমাদের আর কোনো উপকার করে না, কেবলমাত্র আমাদের স্নেহ, আমাদের ভালোবাসা, আমাদের করুণা, আমাদের স্বার্থবিসর্জনের স্পৃহা উদ্রেক করে; পৃথিবীতে সেই ভালোবাসার আবশ্যকতা কি নাই?'৪৪ অন্যে যাই ভাবুক, রবীন্দ্রনাথের কাছে এই 'অনাবশ্যকও আবশ্যক।' যুক্তি -বুদ্ধির আবেদন মানুষের মস্তিষ্কে, কিন্তু ভালোবাসার আবেদন তার হৃদয়ে। 'রক্তকরবী'র রাজার 'বুকের মধ্যে যে বুড়ো ব্যাঙটা সকলরকম সুরের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে আছে, গান শুনলে তার মরতে ইচ্ছে করে' --- সেতো এই জন্যেই। রবীন্দ্রনাথের মতো মানবতাবাদীর এই ভাবনায় বাস্তবতা আছে কি নেই সেটা তর্কসাপেক্ষ কিন্তু ফাঁকি যে নেই সেকথা অনায়াসে বলে দেওয়া যায়। এতসব লেখার পরে কি প্রবন্ধকার শেষ পর্যন্ত বুঝলেন 'রক্তকরবী' আর স্ট্রিন্ডবার্গের নাটককে পাশাপাশি রাখা যাচ্ছে না? প্রবন্ধের ১৩শ পরিচ্ছেদে নইলে তিনি বলবেন কেন -- 'দুটি নাটকের মূল সুর বা আবহ সম্পূর্ণ আলাদা, ঘটনার মধ্যেও যথেষ্ট ভিন্নতা আছে।' এই যদি শেষ কথা হয়,তবে তো 'অনর্থ' পাওয়া যায় না কিছুই। এবার তাই শ্রীবিশ্বাস 'রক্তকরবী' নাটকের বক্তব্য নিয়ে তত্ত্বতালাশ করলেন এবং জানালেন যে, 'কোনো দিক থেকেই বোঝার উপায় নেই যে নাটকটির সঙ্গে আধুনিক ধনতান্ত্রিক যন্ত্রসভ্যতার কোনো সংস্রব আছে।'

ঠি

শ্রীবিশ্বাসের এই সিদ্ধান্ত অংশত সঠিক কেননা 'কোনো সংস্রব নেই' একথা যেমন বলা যায় না, পুরোপুরি আছে একথাও তেমনি বলা যায় না। ১৩৩২ সালে 'প্রবাসী'তে একটি আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য ছিল --- 'আধুনিক সমস্যা বলে কোনো পদার্থ নেই, মানুষের সব গুরুতর সমস্যাই চিরকালের।' এই কথাটা মনে রাখলে বুঝতে সুবিধে হবে কেন শ্রী শঙ্খ ঘোষ 'রক্তকরবী' নাটকে যন্ত্রশক্তির সঙ্গে প্রাণধর্মের সংঘাত আছে, একথা স্পষ্টভাবে বলছেন না। লেখক 'যন্ত্র' শব্দটিকে আক্ষরিক অর্থে দেখতে অভিলাষী কিন্তু 'পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি'তে রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন 'প্রাণের বেগ এসে পড়ল যন্ত্রের উপরে', ঠিক তার আগেই লেখেন 'এমন সময় সেখানে নারী এল, নন্দিনী এল।' নন্দিনীই কি তবে 'প্রাণের বেগ'? তাহলে তো 'যন্ত্র' বলতে machine ভাবা যায় না। নন্দিনী যাদের মুক্ত করেছে, তারা সবাই মানুষ কিন্তু যন্ত্র যেমন নির্বিবেক, নিশ্চেতন ও পরাধীন, এই মানুষগুলির অবস্থা কি ঠিক তেমনি নয়? যন্ত্রের মতোই ব্যক্তি পরিচয়হীন সংখ্যামাত্র, যাদের কাজ শুধু তাল তাল সোনার অঙ্ক বাড়িয়ে চলা, যাদের 'না আছে আকাশ, না আছে অবকাশ।' যে সমস্যার কথাটা রবীন্দ্রনাথ এখানে বলছেন, কখনো -কখনো তা কিন্তু আধুনিক যন্ত্রসভ্যতা প্রসূত ধনতান্ত্রিক সমাজ -ব্যবস্থার সঙ্গে বেশ মিলে যায়। শ্রমিকদের ব্যক্তিপরিচয়ের অবলুপ্তি, পুরাণবাগীশ, অধ্যাপক, গোঁসাই, সর্দার -এর উপস্থিতি, একটি শোষণব্যবস্থায় তাদের শরিক হয়ে ওঠা, মদের ভাঁড়ার, অস্ত্রশালা আর মন্দিরের একত্র সহাবস্থান --- এসবই তার প্রমাণ। হয়তো সমকালীন ধনতান্ত্রিক সভ্যতার নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ, সাম্রাজ্যবাদের নখদন্তবিকাশ দেখেছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথের নাটকের চেহারাটি এরকম হয়ে উঠেছিল এবং সেই ছবিটি ভু ল ছিল না বলেই অরবিন্দ পোদ্দার রবীন্দ্রনাথের এ নাটকে 'ধনতান্ত্রিক সভ্যতার এক অতি বাস্তবচিত্র' দেখতে পেয়েছিলেন।৪৫ কিন্তু তাই বলে 'রক্তকরবী' আধুনিক ধনতান্ত্রিক যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ --এরকম ভাবাটা ঠিক হবে না, যেমন ঠিক হবে না একেবারে এর উলটো ভাবাটাও। আসলে যে সমস্যার ও তার থেকে উত্তরণের পথটিকে রূপায়িত করা নাট্যকারের কাম্য -- তা কোনো বিশেষ দেশকালের নয়, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় 'চিরকালের'। সমস্যাটা কি? রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'নারীর ভিতর দিয়ে বিচিত্র রসময় প্রাণের প্রবর্তনা যদি পুরুষের উদ্যমের মধ্যে সঞ্চারিত হবার পথে বাধা পায় তাহলেই তার সৃষ্টিতে যন্ত্রের প্রাধান্য ঘটে। তখন মানুষ আপনার সৃষ্ট যন্ত্রের আঘাতে কেবলই পীড়া দেয় ও পীড়িত হয়।'৪৬ ঠিক এমনি পরিস্থিতিতে নারী আসছে এবং 'নারীশক্তির নিগূঢ় প্রবর্তনায়' পুরুষ তার স্বরচিত কারাগার ভেঙে 'প্রাণের প্রবাহকে বাধামুক্ত' করতে উদ্যত হচ্ছে। এই যে সমস্যার কথা বললেন কবি, তা তো কোনো এক বিশেষ কালের সমস্যা

নয়, এ তো চিরসময়ের সমস্যা। আর রবীন্দ্রনাথ যখন বলছেন যে ''এই ভাবটা আমার 'রক্তকরবী' নাটকের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে'' তখন সমস্যাটাকে শুধুই যন্ত্রসর্বস্ব ধনতান্ত্রিক সভ্যতার প্রেক্ষাপটে খুঁজতে গেলে শূন্য ছাড়া কিছুই মিলবে না। বস্তুত, রবীন্দ্রচেতনায় 'নারী' শব্দটির এক অন্যতম তাৎপর্য ছিল। বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে অবশ্য সে তাৎপর্য অধরাই রয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব নাটকে কখনো এক নামগোত্রহীনা, অজ্ঞাত কু লশীলা কখনো বা বন্ধন -অসহিষ্ণু এক নারীর আবির্ভাব ঘটেছে। প্রকৃ তির প্রতিশোধ, বিসর্জন, মালিনী, বাল্মীকি -প্রতিভা, রক্তকরবী --- প্রায় সর্বত্র। এর কারণ, 'পুরুষের শক্তি তার অসমাপ্ত সাধনার ভার বহন ক'রে চলবার সময় সুন্দরের প্রবর্তনার অপেক্ষা রাখে। সেই স্থিতির ফু লই হচ্ছে নারীর মাধুর্য, সেই স্থিতির ফলই হচ্ছে নারীর মাঙ্গল্য, সেই স্থিতির সুরই হচ্ছে নারীর শ্রীসৌন্দর্য।'৪৭ রবীন্দ্রনাথের কাছে, নারী ও পুরুষ মিলেই সম্পূর্ণ মানব। বাইরেরটা পুরুষ, ভিতরেরটা নারী। সব মানুষের মধ্যে গুহাহিত এই নারীসত্তাই বাইরের পুরুষটাকে তার প্রেম দিয়ে, সৌন্দর্য দিয়ে, কল্যাণী হস্তস্পর্শে পুরুষের কর্মসাধনাকে সম্পূর্ণ করতে পারে। পুরুষের আছে শক্তি, আছে গতি, নারী তাতে যোগ করে মঙ্গলসৌন্দর্যের স্থিতি। সভ্যতার বুকে সেই ঘটনাটি যখন সত্যিই ঘটে, তখন মানুষ সামঞ্জস্য লাভ করে, এগিয়ে যায় পূর্ণতার দিকে। এই নারী যেমন আছে সব মানুষের মধ্যে, তেমনি বিশ্বসৃষ্টির সব কিছুতেই। কখনো সে বিশেষ কখনো বা নির্বিশেষ। যক্ষপুরীর 'নিরেট নিরবকাশ গর্তের পতঙ্গে'র মতো যে অজস্র শ্রমিক 'ঘন কাজের মধ্যে সেঁধিয়ে' থাকে, নন্দিনীকে দেখে তাদের ডানা তাই চঞ্চল হয়ে ওঠে, তার উপস্থিতিতে তাদের বুকের মধ্যে জেগে ওঠে 'দূরের পাওনা'র দুঃখবোধ। এমনকি যক্ষপুরীর রাজাও শেষ পর্যন্ত 'নন্দিনী' নাম্নী সহজ সৌন্দর্যের ও প্রাণের প্রতিমার হাতে হাত রেখে নিজের বিরুদ্ধে লড়ার সংকল্পবদ্ধ হয়। এইভাবে রাজা অভিব্যক্ত হন বিভীষণ সত্তায়, পরাভব ঘটে রাবণের। আনন্দের স্পর্শে, মঙ্গলসৌন্দর্যের স্পর্শে অহং -এর বিনাশ ঘটিয়ে দিতে উদ্যত হন --- কারণ তাতেই তাঁর আত্মস্বরূপের বন্ধনমুক্তি। নন্দিনীকে বলেন --- 'আমারি বিরুদ্ধে লড়াই করতে, কিন্তু আমারি হাতে হাত রেখে।...এই আমার ধ্বজা, আমি ভেঙে ফেলি ওর দণ্ড, তু মি ছিঁড়ে ফেলো ওর কেতন। আমারি হাতের মধ্যে তোমার হাত এসে আমাকে মারুক, মারুক, সম্পূর্ণ মারুক, তাতেই আমার মুক্তি।' সুতরাং এই যে Paradise Lost আর Paradise Regained -এর মধ্যে দিয়ে পুনর্জন্ম ঘটছে রাজার, তাতো অসীমকালের সত্য। একইসঙ্গে তা বিশেষ আবার

নির্বিশেষও; ব্যক্তিক অথচ নৈর্ব্যক্তিক --- দুয়েরই লীলা। এবং এই হিসেবে তা যেমন ব্যক্তিগত মানুষের কথা, তেমনি 'মানুষগত শ্রেণী'রও। এইজন্যই 'রক্তকরবী'তে বিশেষ স্থানকালের বিন্যাসকে খুঁজলে মরীচিকায় পথ ভু লতে হবে। 'মুক্তধারা'কে বরং দেখা যায় রক্তকরবীকে কিছুতেই নয়। শঙ্খ ঘোষ এই সত্যটি উপলব্ধি করেন বলেই বলতে পারেন --- '' 'মুক্তধারা' সময়বদ্ধ, 'রক্তকরবী' সময়হারা।'' আর এভাবে না দেখলে 'রক্তকরবীর পাপড়ির আড়ালে অর্থ খুঁজতে গিয়ে' 'অনর্থ' ঘটতেই পারে এবং সে 'দায়' নিশ্চিতভাবেই 'কবির নয়'। শুধু যে নাটকটি বুঝতেই ভু ল করেছেন প্রবন্ধকার তাই নয়, অনর্থের সন্ধানে পাড়ি দিয়ে শেষমেশ নাটকটির মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের 'জমিদারী দৃষ্টিভঙ্গী', 'বস্তুবাদ, যুক্তিবাদ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি' বিমুখতা। বিজ্ঞান চেতনা যুক্তিবাদ --- এসবে রবীন্দ্রনাথ কতখানি প্রাগ্রসর ছিলেন সেটা তাঁর সারাজীবনের সাহিত্যসাধনা ও কর্মসাধনার ধারাটিকে অনুসরণ করলেই বোঝা যায়। যিনি 'বিশ্বপরিচয়' লেখেন, লেখেন 'স্ত্রীর পত্র', 'হৈমন্তী', 'ত্যাগ' -এর মতো গল্প, 'যোগাযোগ', 'গোরা'র মতো উপন্যাস --- -তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই যুক্তির বিরুদ্ধে ছিল না। ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে তাঁর মুক্তচিন্তার প্রকাশও ঘটেছে নানা প্রবন্ধে, গল্পে, উপন্যাসে। রবীন্দ্রনাথের এই আধুনিক মনস্কতার জন্যই চন্দ্রনাথ বসু তাঁর মধ্যে 'য়ুরোপীয় ছাঁচের প্রকৃ তি' লক্ষ করেছিলেন। আর জমিদারি দৃষ্টিভঙ্গি? 'ভারতী' পত্রিকায় ১৩০৫ সনের ভাদ্র সংখ্যায় 'মুখুজ্জে বনাম বাঁড়ু জ্জে' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন রবীন্দ্রনাথ। সেই প্রবন্ধে জমিদারদের খেতাব লাভের উদ্দেশ্যে ইংরেজ তোষণ, মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, প্রজাদের ওপর জুলুমবাজি --- এসবের কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। ১৯৩০ সালের ৩১ অক্টোবর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এক পত্রে কবি লিখছেন --- 'জমিদারির অবস্থা লিখেছিস। যেরকম দিন আসছে তাতে জমিদারির উপরে কোনোদিন আর ভরসা রাখা চলবে না। ও জিনিসটার উপর অনেককাল থেকেই আমার মনে মনে ধিক্কার ছিল, এবার সেটা আরও পাকা হয়েছে।'৪৮ নমুনা খুঁজলে এরকম অজস্র উদ্ধৃ তি পাওয়া যাবে, যেখানে জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা রয়েছে। সব বাদ দিয়েও আমরা মনে রাখতে পারি 'দুই বিঘা জমি'র উপেনের যন্ত্রণাকে। এই যন্ত্রণাবোধ যে বিক্ষোভের জন্ম দেয় 'গোরা'য় তারও রূপায়ণ ঘটেছে মনে রাখব এটাও। যক্ষপুরীর রাজা আকর্ষণ -বিদ্যায় বিশ্বাসী। মাটির তলা থেকে তাল -তাল সোনা 'লোভীর মতো কেড়ে' এনে জমিয়ে রাখেন তিনি। এতে নেই সহজ সৃষ্টির আনন্দ, নেই

'প্রাণের যাদু'। সঞ্চয়ের পরিমাণ এতে শুধু বেড়েই যায় কিন্তু অহং -এর এই চূ ড়ান্ত প্রকাশ পরিণামী শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না, কারণ, সৌন্দর্য ও মঙ্গলের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। অহং -বেষ্টিত মানুষ ক্ষু দ্র, খণ্ড, অপূর্ণ; বাইরের ঐশ্বর্য নিয়েই মত্ত সে। যক্ষপুরীর রাজাও পাতালে সঞ্চিত মরা ধনের সংগ্রহে ব্যস্ত, ফলে নিখিল বিশ্বের সঙ্গে তাঁর যোগ বিচ্ছিন্ন। কিন্তু মাটির বুক যখন সবুজ শস্যে হিল্লোলিত হয়, তখন সেখানে থাকে এক মুক্ত, সহজ ও স্বতঃস্ফূ র্ত আনন্দের বিস্তার। সে তো কারুর একলার সঞ্চয়ের ধন নয়, সবার সৃষ্টিসুখের উল্লাস জড়িয়ে আছে তার সঙ্গে। শস্যরিক্ত ধনের সংগ্রহে লোভ চরিতার্থ হয় বটে, কিন্তু ক্ষু ধা মেটে না। অথচ মাটি যখন পাকা ফসলে ভরে ওঠে --তখন তাতে ক্ষু ন্নিবৃত্তির জৈবিক প্রয়োজন যেমন মেটে, তেমনি রয়ে যায় সৃজনের এক স্বার্থশূন্য, অনাবশ্যক আনন্দও। মঙ্গল -সৌন্দর্য আর আনন্দের সংস্পর্শে তা এক পরম পূর্ণতা দান করে। শ্রীবিশ্বাস একে 'ইউটোপিয়ান' বলে তাচ্ছিল্য করতে পারেন কিন্তু এই তাঁর জ্ঞান ও বিশ্বাসমতে সত্য, উপলব্ধির সত্য। আসলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন টলস্টয়ের মতোই একজন উদারনৈতিক মানবতাবাদী। কৃ ষিই হোক আর খনিজ সম্পদ সংগ্রহ --- সবক্ষেত্রেই মানুষের কল্যাণ তখনই সম্ভব, যখন মানুষের তৈরি বণ্টনব্যবস্থা ঠিক থাকে। কিন্তু একজন উদারনৈতিক মানবতাবাদী তো কখনো মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারান না, তিনি বিশ্বাস করেন রূপান্তরে। 'রক্তকরবী'র রাজা আসুরিক সত্তাকে অতিক্রম করে দৈবীসত্তায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছিল, মানুষ তেমনিভাবে নিজেকে বদলাবে; অন্তরশায়ী শ্রী ও সৌন্দর্যের গুহাহিত অতু ল সম্পদের সঙ্গে মেলাবে নিজের শক্তিকে। বীর্যবান পুরুষ আর কল্যাণী নারীর সেতু বন্ধন ঘটবে। তখনই মানুষের মঙ্গল, সমাজের, সভ্যতার মঙ্গল। টলস্টয়ের ‘Resurrection’ উপন্যাসে প্রিন্স নেখল্যুদভের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছিল। তবু লেনিন টলস্টয়কে ভণ্ড, লোভী, শোষক, অমানবিক কিছুই বলেননি বরং অকৃ পণ শ্রদ্ধাই ব্যক্ত করেছিলেন, বিপরীত বিশ্বাসের মেরুবিন্দুতে অবস্থান করা সত্ত্বেও। বাইরের শক্তির সঙ্গে অন্তরের মঙ্গলসৌন্দর্য যখন মেশে, তখন তা হয়ে ওঠে মানবতার পূর্ণরূপ। নন্দিনী রাজার মধ্যে অতু ল বীর্য দেখেছে --- 'অদ্ভু ত তোমার শক্তি।...তোমাকে মনে করি আশ্চর্য। প্রকাণ্ড হাতে প্রচণ্ড জোর ফু লে ফু লে উঠছে, ঝড়ের আগেকার মেঘের মতো। দেখে আমার মন নাচে।' নন্দিনীর এই সংলাপের মধ্যে 'প্রচ্ছন্ন যৌন ইঙ্গিত' খুঁজে পেয়েছেন শ্রীবিশ্বাস। সরাসরি অর্থ করলে ফল যে কত মারাত্মক বিপত্তি ঘটাতে পারে এ তারই একটা নমুনা। আগেই বলা হয়েছে, নন্দিনী রাজারই এক অংশ, যে অংশে রয়েছে শ্রী ও কল্যাণ, 'পৃথিবীর প্রাণভরা খুশী'। রাজার যে অহং তাঁকে স্বর্ণসঞ্চয়ে উদ্যোগী করে, সেই অহং -ই

আত্মসাৎ করতে চায় মাটির পৃথিবীর খুশিটাকে। 'শান্তিনিকেতন' প্রবন্ধমালার এক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন --- 'ওই যে একটা ক্ষু ধিত অহং আছে, যে কাঙাল সব জিনিসই মুঠো করে ধরতে চায়।'৪৯ রাজা সেই কাঙাল --- যিনি আপন অন্তরশায়ী প্রাণদায়িনী, কল্যাণময়ী সত্তাটিকে চেনেন না। ফলে 'চার -অধ্যায়' -এর অতীনের মতো নিজের স্বভাবকেই হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন। তাঁকে ঘিরেছে একরাশ অন্ধকারের মতো বিচ্ছিন্নতার বোধ। নন্দিনী তাই সেই অজ্ঞান অসচেতন অথচ অমেয় শক্তির আধারটিকে পূর্ণ করে তু লতে চেয়েছে; নিঃসঙ্গ খণ্ড মানব --- 'রাজা'র 'একলা প্রাণ'কে খুশিতে ভরিয়ে দিতে চেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র বলেছিলেন --- 'বীর্য এবং সৌন্দর্যের মিলনেই যথার্থ সম্পূর্ণতা। উভয়ের বিচ্ছেদ অর্ধসভ্যতা।'৫০ রাজার মধ্যে এই সৌন্দর্যের বড়ো অভাব। 'নন্দিনী' রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় আসলে যে 'বৃহৎ গোপন অচেতন অন্তরংশ নারী', যে চেয়েছে 'চঞ্চল বহিরংশ পুরুষ' -এর দমিত প্রাণের শিখাটিকে জ্বালিয়ে দিতে। অথচ প্রবন্ধকার এর মধ্যে 'স্পষ্ট যৌন ইঙ্গিত' খুঁজে পেয়ে যান কত সহজে। আসলে রাজার যে লড়াইটাকে প্রবন্ধকার বাইরের লড়াই ভেবেছেন, সেটা তো তাঁর ভেতরের লড়াই। অন্তর আর বার --- দুয়ের আক্রমণেই সেই বন্দিশালার আগল ভাঙা সম্ভব। এই লড়াই তাই রাজা ও ফাগুলাল দুজনেরই। নাটকের শেষে নন্দিনীর জয় ঘোষণা তাই অস্বাভাবিক নয়, কেননা তার জন্যেই লড়াইটা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়েছে। কিন্তু অস্ত্র দিয়ে নয়, রক্তকরবীর কঙ্কন দিয়ে, প্রেমের, প্রাণের বলয় দিয়ে সে দানবের অন্তর্লীন আত্মাটিকে জাগিয়েছে। অথচ 'রক্তকরবী'কে গোটা রবীন্দ্রসাহিত্যের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার ফলে 'নন্দিনী'কে শ্রীবিশ্বাস 'সমঝোতার প্রতীক' ভেবে নিয়েছেন এবং সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তু লেছেন। শ্রীবিশ্বাসের বক্তব্য হল, স্বদেশি আন্দোলনের প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথ আন্দোলনের পুরোভাগে থাকলেও পরে নিজেকে গুটিয়ে নেন নাকি 'বিদেশী শাসনের সুরক্ষিত কাঠামোর মধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শোষণকে অবিঘ্নিত রাখার কেন্দ্রীয় শ্রেণী উদ্বেগ থেকে।'৫১ স্বদেশি আন্দোলনের প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথ যে কিঞ্চিৎ অত্যুৎসাহী ছিলেন তা সত্য। রাখীবন্ধন উৎসবে অংশ নেওয়া, জাতি -ধর্ম -নির্বিশেষে সকলকে রাখী বেঁধে দেওয়া, 'বাংলার মাটি বাংলার জল' রচনা --- উত্তরকালে যে কাজকে তিনি বলেছেন 'উত্তেজনার আগুন পোহানো'। যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, জীবনতারা হালদার প্রমুখের স্মৃতিচারণ থেকে এও জানা যায় যে 'অনুশীলন সমিতি'র মতো বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গেও তাঁর যোগ ছিল।

'অনুশীলন সমিতি' কি ধরনের কাজে লিপ্ত ছিল, রবীন্দ্রনাথ তা জানতেন না এমন নয়, তবু কেন যোগ রেখেছিলেন? এই কারণে যে, বিপ্লবীদের কর্মপন্থা তাঁর পছন্দ না হলেও তাদের নিঃস্বার্থ মনোভাব ও নিষ্ঠা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। 'ছোট ও বড়' পুস্তকে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন --- 'ইহারা ক্ষু দ্র বিষয়বুদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিয়া প্রবল নিষ্ঠার সঙ্গে দেশের সেবার জন্য সমস্ত জীবন উৎসর্গ করিতে প্রস্তুত হইয়াছে।'৫২ ফলে দেখা যাচ্ছে বিপিনচন্দ্র পাল সম্পাদিত 'বন্দেমাতরম' পত্রিকার তিনি একজন মুগ্ধ পাঠক হয়ে উঠছেন এবং পুত্র রথীন্দ্রনাথকে 'স্টেটসম্যান' -এর পরিবর্তে 'বন্দেমাতরম' পত্রিকা পাঠানোর কথা ভাবছেন।৫৩ চিন্মোহন সেহানবীশের লেখা 'রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবীসমাজ' গ্রন্থে উল্লেখিত একটি সরকারি নির্দেশের প্রতিলিপি থেকে এও জানা যাচ্ছে যে, সরকারের সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তালিকায় রবীন্দ্রনাথেরও নাম ছিল।৫৪ অথচ এই একই সময়ে বিপ্লবীদের চরমপন্থার সমালোচনা করতে ছাড়ছেন না কবি এবং 'ঐক্যের সাধনা'য় মনোনিবেশ করতে পরামর্শও দিচ্ছেন। রবীন্দ্রকথিত এই ঐক্যসাধনাকেই শ্রীবিশ্বাস স্থিতাবস্থা বজায় রাখার কৌশল বলেছেন, কিন্তু সত্যিই কি তাই? রবীন্দ্রনাথ তো বারবার মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মীয়সম্বন্ধ স্থাপনের কথাই বলেছেন। জাতি -ধর্ম -বর্ণ ও সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উত্তরণ, দেশের অন্তঃকরণকে জাগানো, মনুষ্যত্বের উদ্বোধন --- এই তাঁর ঐক্যসাধনার স্বরূপ। 'সমস্যা', 'পথ ও পাথেয়' প্রবন্ধগুলিতে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকাশ পেয়েছে। আগে নিজেদের সংকীর্ণ ভেদবুদ্ধি দূর করে মানুষের সঙ্গে মানুষের একটি অকৃ ত্রিম ঐক্যসূত্র গড়ে তোলা, পরে স্বরাজসাধনা। নইলে স্বরাজের ভিত্তি কখনো পাকা হতে পারে না। এই যে স্বদেশ ভাবনা, তার থেকেই 'স্বদেশী সমাজ' গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি, চেয়েছিলেন পল্লী- সংগঠন। প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন --রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী সমাজে গ্রামের সমস্যা ও তাহার সমাধান সম্বন্ধে যেসব কথা বলিয়াছিলেন, তাহার কয়েকটি কার্য স্বয়ং গ্রহণ করিলেন; প্রজাদের মধ্যে মিতব্যয়িতা, সংঘকর্ম ও সঞ্চয় অভ্যাস শিক্ষা দিবার জন্য জমিদারিতে সমবায় ব্যাঙ্ক স্থাপন করিলেন, সেই সমবায় ব্যাঙ্ক পতিসর কৃ ষিব্যাঙ্ক নামে পরিচিত হয়। এছাড়া কৃ ষক প্রজাদের মধ্যে আত্মসম্মান ও আত্মশক্তি উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য লোকসভা স্থাপন করা হইল।...তখন বাংলাদেশে সরকারী কো -অপারেটিভ আন্দোলন আরম্ভ হয় নাই।৫৫ ঠি

রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'স্বদেশী সমাজ' লিখছেন ঠিক তখন, যখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠেছে এ দেশে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সন্তর্পণে সরিয়ে রেখেছেন নিজেকে সেই উত্তাল তরঙ্গোচ্ছ্বাস থেকে। তাঁর কথা --- 'দেশের লোক রোগে মরিতেছে, দারিদ্র্যে জীর্ণ হইতেছে, অশিক্ষা ও কু শিক্ষায় নষ্ট হইতেছে, ইহার প্রতিকারের জন্য যাহারা কিছুমাত্র নিজের চেষ্টা প্রয়োগ করিতে প্রবৃত্ত হয়না তাহারা বিদেশী সাহিত্য -ইতিহাসের পুঁথিগত পেট্রিয়াটিজম নানাপ্রকার অসংগত অনুকরণের দ্বারা লাভ করিয়াছে বলিয়া কল্পনা করে।'৫৬ বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথের এসব কথায় ইংরেজ -বিরোধিতার নামগন্ধ নেই ফলে এর গুরুত্ব টের পাননি তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃ বৃন্দ। তাঁরা চান স্বরাজ। কিন্তু মানুষকে বাদ দিয়ে, মানবকল্যাণকে উপেক্ষা করে, জনসমাজকে বিচ্ছিন্ন রেখে যে স্বরাজ আন্দোলন, তা 'চার -অধ্যায়' -এর অতীনের ভাষায় 'কু মিরের পিঠে চড়ে পার হবার খেয়া নৌকো।' রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বরই যেন ধ্বনিত হয়েছে অতীনের কণ্ঠে --- 'দেশের আত্মাকে মেরে দেশের প্রাণ বাঁচিয়ে তোলা যায় এই ভয়ংকর মিথ্যে কথা পৃথিবী সুদ্ধ ন্যাশনালিস্ট আজকাল পাশব -গর্জনে ঘোষণা করতে বসেছে, তার প্রতিবাদ আমার বুকের মধ্যে অসহ্য আবেগে গুমরে গুমরে উঠেছে।' নিজের দুঃখ নিয়ে, অসহায় আক্ষেপ সম্বল করে বাধ্য হয়ে কবিকে একলা চলতে হয়েছে। 'অগ্নিকাণ্ডের আয়োজনে উন্মত্ত না হইয়া' আপন ধ্যানের প্রদীপটিকে জ্বেলে পথের ধারে বসে থাকতে হয়েছে। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লেখা এই চিঠিটিতে শ্রীবিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের ইংরেজ শাসনপ্রীতি ও স্বদেশি আন্দোলনের বিরোধিতা খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু কোন অবস্থায় কবির এই একলা বসে থাকার সংকল্প? সে যুগের কংগ্রেস সংগঠন ও তাহার সভা সম্মেলনগুলির সঙ্গে কিছুমাত্র জনসংযোগ ছিল না। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, উচ্চচপদস্থ কিংবা অবসরপ্রাপ্ত সিভিলিয়ানগণ, উকিল -ব্যারিস্টার -ডাক্তার --- -ইঁহারাই তখন কংগ্রেসে ভিড় করিতেন, এমন কি নিম্নমধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ও তখনও পর্যন্ত কংগ্রেসে যোগ দেন নাই। দেশের গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পথঘাট প্রভৃ তি সম্পর্কে কংগ্রেস নেতৃ বর্গ ছিলেন উদাসীন। কংগ্রেসের এই জনসংযোগহীনতা --- গ্রামসমস্যা ও লোক -সংস্কৃ তি সম্পর্কে তাঁহাদের এই ঔদাসীন্য ও অবজ্ঞা রবীন্দ্রনাথকে অত্যন্ত পীড়িত ও ক্ষু ব্ধ করিয়া তু লিতেছিল। সম্ভবত সেই সব কারণেই তাঁহার এই রাজনীতি -বিমুখতা।৫৭ রবীন্দ্রনাথের 'স্বদেশী সমাজ' গঠনের ভাবনা কিন্তু একদল বিপ্লবীকে যথেষ্ট আকৃ ষ্ট করেছিল। ভূ পেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি সমাজ পরিকল্পনা ''পড়িয়া

বুঝিলাম, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে হাঙ্গারীয় জাতীয়তাবাদী ডিক (Deak) হাঙ্গারিতে অস্ট্রিয়ার ক্ষমতা বিলোপসাধন কল্পে এইরূপ 'স্বদেশীয়ানা' করিয়াছিলেন এবং কিঞ্চিৎপূর্বে আয়ার্লণ্ডে সিন -ফিনেরা তাহা করিয়াছিল। তদনুরূপ ইহা 'স্বদেশী' হইবার একটি কর্মপদ্ধতি মাত্র।''৫৮ এই কর্মপদ্ধতি ভূ পেন্দ্রনাথকে এতটাই অনুপ্রাণিত করেছিল যে তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন -এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সংযুক্তভাবে 'কর্ম' করতে চেয়ে চিঠিও লেখেন। কিন্তু সেই উদ্যম শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি। চিন্মোহন সেহানবীশ তার কারণ ব্যাখ্যা করে জানাচ্ছেন, '' 'সহযোগিতার উদ্যম এই স্থলেই শেষ' হওয়ার কারণ সম্ভবত, ১৯০৬ থেকে ভূ পেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ বিপ্লবীদের 'যুগান্তর' পত্রিকা প্রকাশনা, সেইসূত্রে পরের বছর ভূ পেন্দ্রনাথের কারাদণ্ড এবং মুরারীপুকু র বাগান সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে উত্তরোত্তর জড়িত হয়ে পড়া।''৫৯ অথচ শ্রীবিশ্বাস কত অনায়াসে রবীন্দ্রনাথের আত্মশক্তি অর্জনের তত্ত্বটিকে 'আপাতমনোহর, অবাস্তব' বলে নস্যাৎ করে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন স্থিতাবস্থা বজায় রাখার কৌশল এবং 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শোষণকে অবিঘ্নিত রাখার কেন্দ্রীয় শ্রেণী উদ্বেগ'। যে সব কর্মভীরু তাত্ত্বিকের দল রবীন্দ্রনাথের আচরণে বুর্জোয়া মানসিকতার প্রকাশ দেখেন, তাঁদের কথা ভেবেই কি রবীন্দ্রনাথের এই আক্ষেপ ব্যক্ত হয়েছিল --...আজ যারা সাহিত্যের আসরে প্রোলেটারিয়েট, সর্বহারা --- এসব কথা বলে চেঁচাচ্ছে, তাদের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে --- কোনখানে তোমরা কাজ করছ। ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলা নয়; তোমরা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছ?... আমাকে করতে হয়েছে এই কাজ। নিজের জমিদারিতে একদিন আমি তাদের মাঝখানে গিয়ে কাজ করেছি। আমি দূরে থাকিনি --- থাকতে পারিনি। কারণ আমি একটা পরিপূর্ণতাকে ভালোবেসেছিলুম। এই দারিদ্র্য বিচ্ছিন্নতা মলিনতা --- দেখা যায় না; তা আমার কবিত্বকে আঘাত করেছিল। আমাকে নামতে হল অবশেষে।...এটা অহংকার করে বলতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু যখন চারদিক থেকে এইরকম খিচিমিচি করে ওঠে, তখন বলতে ইচ্ছে হয় --- আমি করেছি এই কাজ। যদিও তা যৎসামান্য তবুও তো আমি করেছি এবং তাতে ক'রে কী করেছি --নিজের ক্ষতি করেছি। আমাকে বুর্জোয়া বলে --- আমি তো করেছি এইসব কাজ; কিন্তু যারা তা নয়, তারা কী করছে।৬০

বস্তুত, সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের মানসিক গতিপ্রকৃ তির ধারাটিকে খেয়াল না করলে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যও ভু লভাবে ব্যাখ্যাত হবার সম্ভাবনা থেকে যাবে। রবীন্দ্রনাথ যে বিপ্লবীদের কোন চোখে দেখতেন সেকথা আগেই বলা হয়েছে। তিনি স্বীকার করেছেন যে বিপ্লবীদের মধ্যে শুধু 'চোর ডাকাত' নয়, 'বীর' কেও দেখেছেন; দেখেছেন 'মহৎ আত্মত্যাগের দৈবী শক্তি'র সমুজ্জ্বল প্রকাশকে। কিন্তু এদের পথটাকে তিনি সমর্থন করতে পারেননি। সখেদে বলেছেন --- 'আমাদের ভাগ্যে এ কী হইল। দেশভক্তির আলোক জ্বলিল, কিন্তু সেই আলোতে এ কোন দৃশ্য দেখা যায় --- এই চু রি ডাকাতি গুপ্তহত্যা?'৬১ 'ঘরে বাইরে'র সন্দীপ এদেরই প্রতিনিধি। ভূ পেন্দ্রনাথ দত্ত 'এ প্রকার বিপ্লবী বাংলার ভিতর দেখি নাই' বলেছেন ৬২ বাস্তবিক কি তাই? স্বয়ং ভূ পেন্দ্রনাথ দত্তই স্বীকার করেছেন, 'পাঞ্জাবী বিপ্লবীরা বলেন যে, যুদ্ধের সময় বিপ্লবোদ্যমের চেষ্টায় পাঞ্জাবীরা প্রাণ দিয়েছে আর বাঙালীদের মধ্যে কেহ কেহ টাকা চু রি করিয়াছে। কথাটা অস্বীকার করা যায় না।'৬৩ বোঝাই যাচ্ছে বিপ্লবীদের মধ্যেও নৈতিক স্খলন, পতন ঘটেছিল। আবার সন্দীপের পাশাপাশি অমূল্য -র উপস্থিতি এটাও প্রমাণ করছে যে বিপ্লবীদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গিও পুরোপুরি নঙর্থক ছিল না। বরং শ্রীবিশ্বাসের দৃষ্টিভঙ্গিই কিঞ্চিৎ একপেশে বলেই জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর রবীন্দ্রনাথের 'নাইট' উপাধি বর্জনের ঘটনাটির নেপথ্যে তিনি গদর পার্টি কর্তৃক কবিকে হত্যার হুমকি -জনিত প্রভাব কাজ করেছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। গদর পার্টির সভ্যরা রবীন্দ্রনাথকে হত্যা করবে এরকম একটা ভিত্তিহীন গুজব ছড়িয়েছিল ঠিকই। প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন --- 'এইসব ব্যাপারের মূলে ছিল সামান্য একটা ঘটনা। স্টকটন নামে একটি সহর হইতে বিষণ সিং মুণ্ডু নামে একজন লোক রবীন্দ্রনাথকে সেই সহরে লইয়া যাইবার জন্য নিমন্ত্রণ করিতে আসিতেছিল। হোটেলের কাছে দুইজন লোক তাহাকে বাধা দেয়; তাহারা চায় না রবীন্দ্রনাথ স্টকটনে গিয়া বক্তৃ তা করেন। এই মারামারির পর রবীন্দ্রনাথকে হত্যার গুজব রাষ্ট্র হয়।'৬৪ কিন্তু 'এই গুজবের কোন অস্বস্তিকর প্রভাব' যে রবীন্দ্রমানসে কাজ করেনি তার প্রমাণ এই খবরটি যেদিন বেরোয়, তার পরের দিন অর্থাৎ ৭ই অক্টোবর Saint Barbara শহরে ‘Los Angeles Examiner’ কে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের একটি সাক্ষাৎকার, যাতে কবি বলেছিলেন --As for a plot to assassinate me, I have the fullest confidence in the sanity of my countrymen and shall fulfil my engagements without the help of police protection. I take this

opportunity emphatically to assert that I do not believe that there was a plot to assassinate me, though I had to submit to the force of being guarded by the police, from which I hope to be relieved for the rest of my visit to the country.৬৫ গোটা সাক্ষাৎকারটিরই উল্লেখ রয়েছে কৃ ষ্ণ কৃ পালানীর ‘Rabindranath Tagore : A Biography’ গ্রন্থে। শ্রীবিশ্বাস তাঁর প্রবন্ধে নানা প্রসঙ্গে কৃ পালানীর গ্রন্থটি ব্যবহার করেছেন, গদর পার্টিকে ঘিরে গড়ে ওঠা গুজবটি রবীন্দ্রনাথকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল কিনা সত্যিই, তা এই সাক্ষাৎকারের মধ্যেই জানা যাচ্ছে। অথচ শ্রীবিশ্বাস এই তথ্যটি দিব্যি চেপে গেলেন, সেকি তাঁর অভিনব তথ্য প্রতিষ্ঠার সুবিধে হবে না বলেই? এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে লর্ড চেমসফোর্ডকে যে চিঠিটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, প্রভাতকু মারের 'রবীন্দ্রজীবনী' (২য় খণ্ড) তে তা উদ্ধৃ ত হয়েছে। সেই চিঠির প্রতি অক্ষরে ঝরে পড়েছিল কবির ক্ষোভ, যন্ত্রণা এবং বুকের মধ্যে জমে ওঠা দুঃখের ভার। চিঠি লেখারও আগে কবি কলকাতায় প্রতিবাদসভা ডাকার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানতে পারা যাচ্ছে যে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃ বৃন্দ এ ব্যাপারে ঔদাসীন্য দেখিয়েছিলেন। কিন্তু ওই অবস্থায় কবির মানসিক যন্ত্রণা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা জানা যাচ্ছে এন্ড্রুজের লেখা থেকে --- ‘‘Night after night was passed sleeplessly...for a time it seemed as though ‘Amritsar’ had shattered all his hopes and aims. ’’

৬৬

প্রতিবাদের মাশুলও গুনতে হয়েছিল কবিকে। ১৯২০ সালে ইংলন্ড ও আমেরিকায় গিয়ে দেখেছিলেন তাদের বরফশীতল ঔদাসীন্য। বিশ্বভারতীর জন্য অর্থসংগ্রহের প্রচেষ্টাও সফল হয়নি। সফরের একমাত্র সাফল্য ছিল লেনার্ড এলমহার্স্টের বন্ধু ত্ব ও সহযোগিতা লাভ। এইসময় শান্তিনিকেতনে রাজনীতি চর্চার সংবাদ কবিকে উদ্বিগ্ন করেছিল। কবির যা স্বপ্ন, সাধ তাকে ফলবতী করার লক্ষ্যেই শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠা। গান্ধিজির প্রতি রবীন্দ্রনাথের যথেষ্টই শ্রদ্ধা ছিল কিন্তু সমর্থন ছিল না তাঁর চরকাকাটা নীতিতে বা অসহযোগ আন্দোলনে। 'ঘরে বাইরে'তে চন্দ্রবাবু বলেছিলেন --- 'দেশ বলতে মাটি তো নয়, এই সমস্ত মানুষই তো। তা তোমরা কোনোদিন একবার চোখের কোণে এদের দিকে তাকিয়ে দেখেছ? আর আজ হঠাৎ মাঝখানে পড়ে এরা কী নুন খাবে আর কী কাপড় পরবে তাই নিয়ে অত্যাচার করতে এসেছ, এরা সইবে কেন, আর এদের সইতে দেব কেন?' চন্দ্রবাবুর এই অভিযোগ বস্তুত রবীন্দ্রনাথেরও অভিযোগ। তাই শান্তিনিকেতনে

অসহযোগ রাজনীতির চর্চা হচ্ছে, এ সংবাদে কবির উদ্বেগ খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু শ্রীবিশ্বাস যেমনটি ভেবেছেন যে, 'ইংরেজ শাসনবিরোধী রাজনীতির চর্চা হচ্ছে' এই সংবাদ রবীন্দ্রনাথকে 'কষ্ট দিচ্ছিল' ব্যাপারটা তা নয়। দেশের মানুষকে বাদ দিয়ে দেশোদ্ধারের যে রাজনীতি, কবির স্বপ্নের লালনক্ষেত্রই তার আখড়া হয়ে উঠছে --- -এখানেই কবির ভয় এবং যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণার কারণ জানা নেই বলেই লেখক রবীন্দ্রনাটককে বিশেষ সময় দিয়েই বিচার করেন। ফলে 'শারদোৎসব' নাটকে বুদ্ধি, শক্তি ও ধর্মের চারিদিক ঘিরে গড়ে ওঠা 'সমস্ত দেশব্যাপী বন্দীশালা'কে ভাঙা এবং ভাঙনের মধ্য দিয়ে 'প্রশস্ত করিয়া' গড়ে তোলা তাঁর কাছে গুরুত্ব পায় না, বরং নাটকটি যে 'ক্ষু দিরামের ফাঁসির বারো তেরো দিন পরে' লেখা এটাই বড়ো হয়ে দেখা দেয়। 'ডাকঘর' নাটকে 'শোপেন -হাওয়ারি নির্বাণ চিন্তা'ই খুঁজে পান শুধু তাই নয় ''এ মায়ার সংসার থেকে যত তাড়াতাড়ি মুক্তি পাওয়া যায় ততই মঙ্গল'' --- এই ভূ �ইফোড় তত্ত্বও আবিষ্কার করে ফেলেন। 'রাজা' নাটকে 'আধ্যাত্মিক রাজা'র প্রতি আত্মনিবেদন প্রেম ভক্তি বিশ্বাস পার্থিব 'রাজা -প্রজার সম্পর্ককেও নিশ্চিতভাবে প্রভাবিত করবে' --- এই আশঙ্কায় বিধুর হন। সমকালে বিপ্লবীরাও কি এই নাটকগুলি সম্পর্কে এই ভাবনাই পোষণ করতেন? 'বাংলায় বিপ্লববাদ' গ্রন্থে বিপ্লবী নলিনীকিশোর গুহ -র স্মৃতিচারণা থেকে জানা যাচ্ছে যে 'শারদোৎসব' -এর 'অমলধবল পালে লেগেছে মন্দমধুর হাওয়া' গানটি থেকে বিপ্লবীরা অনুপ্রেরণা লাভ করতেন। এ তথ্য অবশ্য তত গুরুত্বপূর্ণ নয় কেননা রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবীদের কথা ভেবেই গানটি লিখেছিলেন, একথা সম্ভবত ঠিক নয়। যেটা লক্ষণীয় তা হল প্রবন্ধকার রবীন্দ্রনাটকের মধ্যে সরাসরি সমকালকে খুঁজতে চাইছেন; চাইছেন বিপ্লবপন্থার প্রতি রবীন্দ্র সমর্থন। কিন্তু বিপ্লবপন্থাকে সমর্থন করার প্রশ্নই ওঠে না যেহেতু কবির পথ আর বিপ্লবীদের পথ আলাদা। দ্বিতীয়ত, এই পর্বে নাটক নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এক অনলস নিরীক্ষায় মেতে উঠেছিলেন। আর সর্বোপরি নাটক হল নাটক, প্রচার পুস্তিকা নয়। বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিবৃতি দান করা তার কাজ নয়, তা ধরতে চায় সত্যের সামান্য রূপকে। এই ব্যাপারে Northrop Frye যা বলেছেন তা প্রণিধানযোগ্য --The Poet in dramas & epics at least also imitates actions in words like historian, But the poet makes no specific statements of fact, & hence is not judged by the truth or falsehood of what he says. The Poet has no external model for his imitation & is judged by the integrity or consistency of

his verbal structure. The reason is that he imitates the universal, not the particular.৬৭ কিন্তু প্রবন্ধকার এসব দেখবেন না কারণ তাঁর লক্ষ্য এক গভীর 'অনর্থ'কে খুঁজে বের করা এবং তা তিনি অবশেষে পেলেন 'রক্তকরবী' নাটকে নন্দিনী আর নেপথ্যবাসী রাজা সম্পর্কের মধ্যে যা তাঁর ভাষায় 'মধুর মাখামাখি'। খুব আপত্তিকর সন্দেহ নেই এইসব শব্দ কিন্তু তার চেয়েও আপত্তিকর প্রবন্ধকারের এই সিদ্ধান্ত --- রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর জন্য দেশীয় রাজা -রাজড়াদের কাছ থেকে অর্থসংগ্রহ করেছেন আর ''এইসব ধনকু বের ও নেটিভ স্টেটের রাজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সমকালীন ব্যক্তিগত সম্পর্কের অন্তরঙ্গ মাধুর্যই প্রতিফলিত হয়েছে নন্দিনীর সঙ্গে 'রাজা'র মধুর মাখামাখিতে এবং বহুগ্রাসী স্বৈরাচারী রাজার হৃদয় পরিবর্তনে।'' এই তবে সেই 'অনর্থ', যার জন্য রবীন্দ্রনাথ ভয় পেয়েছিলেন দর্শকেরা বা পাঠকেরা 'কু ত্তা লেলিয়ে দেবেন?' তবে তো রবীন্দ্রনাথ এ নাটক না লিখলেও পারতেন, কোনো অনর্থের সম্ভাবনাই থাকত না তাতে। বাস্তবিক বিশ্বভারতীর জন্য অর্থসংগ্রহ করা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম দায়। কিন্তু বিশ্বভারতীর অর্থাভাব ঘোচানোর জন্য এইভাবে দানগ্রহণ, শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে অভিনয়ের আয়োজন ভালো লাগেনি রবীন্দ্রনাথের। দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন --- 'আমি ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি; হাতে নিয়ে বললে ঠিক হয় না, কণ্ঠে নিয়ে! এ বিদ্যা আমার অভ্যস্ত নয়, তৃ প্তিকরও নয়। সুতরাং দিনগুলি যে সুখে কাটছে তা নয়।'৬৮ ১৯৩০ সালে বরোদার মহারাজার কাছ থেকে আমন্ত্রণ এলে কবি লিখেছিলেন, 'বাঁধা আছি রাজদ্বারে রূপোর শৃঙ্খলে --- বিশ্বভারতীর খাতিরে মাথা বিকিয়ে বসেছি। ...একটু ও ভালো লাগছে না।'৬৯ শুধু বিশ্বভারতীর কথা ভেবে কবি ১৯৩৬ সালে বৃদ্ধবয়সে অভিনয়ের দল নিয়ে উত্তর ভারত সফরে গেছেন। তারও আগে ভূ পালে গেছেন, গেছেন হায়দরাবাদে। এবং বিষণ্ণচিত্তে বহন করেছেন এক দুর্নিবার হীনম্মন্যতা। অথচ একটু আপোস করলেই কবিকে এতটা পরিশ্রম করতে হত না। ১৯১৬ সালে জাপানে বসেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে চীনের প্রতি জাপানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের নিন্দা করে ভাষণ দিয়েছেন। অথচ এটা না করলেও পারতেন এবং তাতে নগদবিদায়ও ভালোমতো পেতে পারতেন। তবু কি আশ্চর্য! শ্রীবিশ্বাস তাঁকে 'সমঝোতাপন্থী' বলে বসেন। এইসব তথ্য শ্রীবিশ্বাসের জানা ছিল না এমন নয়। প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায়ের 'রবীন্দ্রজীবনকথা' থেকে বহু উদ্ধৃ তিই তিনি সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে এই তথ্য গোপন করা তাঁর পক্ষে বড়ো

প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল নইলে যে 'রক্তকরবী' নাটকের অনর্থের জোরদার ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। তথ্য গোপন অবশ্য শ্রীবিশ্বাস এই প্রথম করছেন না। মুসোলিনীর আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথের ইতালি ভ্রমণ প্রসঙ্গেও তা করেছেন। একথা সত্য যে, ১৯২৬ সালের ৩১ মে রবীন্দ্রনাথ ও মুসোলিনীর যে সাক্ষাৎ ঘটে, তারপর মুসোলিনী ও ফ্যাসিস্টদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসাসূচক কথা বলেন কিন্তু সেই ভু ল ভাঙতে কবির দেরি হয়নি। 'কয়েকমাস পরেই প্রমাণ হইল, রবীন্দ্রনাথ অসত্যের সহিত আপোষ করিতে অসমর্থ; যত বড় রাষ্ট্রশক্তি তাঁহাকে আদরে যত্নে অভিভূ ত করিতে চেষ্টায়িত হোক, শেষপর্যন্ত তিনি অসত্যের আবরণ ভেদ করিয়া নির্গত হইবেনই।'৭০ ফলে 'যত শীঘ্র তিনি প্রশংসা করিলেন, ইতালি ত্যাগ করিয়া তেমনি দ্রুত তাহার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করিলেন।'৭১ ২২শে জুন রবীন্দ্রনাথ ইতালি ত্যাগ করে সুইটজারল্যান্ডে যান। সেখানেই তিনি জানতে পারেন মুসোলিনীর স্বরূপ। এখান থেকে এন্ড্রুজকে এক চিঠিতে লেখেন যে ফ্যাসিজমের প্রশংসা তিনি করেননি। ইতালির কাগজগুলি তাঁর বক্তব্যকে অতিরঞ্জিত করে ছাপলেও তিনি তার প্রতিবাদ করতে পারেননি কারণ এই ভাষা জানা না থাকায় তিনি জানতেও পারেননি কাগজে কি লেখা হয়েছে। ১৯২৬ সালের ১০ জুলাই কবি ভিয়েনায় পৌঁছোন। ইতোমধ্যে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনীর আরও অত্যাচারের কাহিনি তাঁর কর্ণগোচর হয়েছে। ভিয়েনাতে এঞ্জেলিকা বালবানোভা নামে এক কম্যুনিস্ট মহিলার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। বালবানোভাকে কবি জিজ্ঞেস করেন ---‘Are you the person who gave the interview about Mussoloni that was published a few months ago? ’ কবি যখন জানতে পারেন ইনিই সেই মহিলা তখন গোটা পরিবেশটাই বদলে যায়। বালবানোভা লিখছেন ---‘The whole atmosphere changed and Tagore became an understanding and even apologetic human being. ’ অতঃপরে কবি বলেন: Your interpretation of Mussolini’s Character’’ he said ‘‘coinicides with the impression he made upon me-a coward and an actor. When I asked the English ambassador if he thought my impression was correct, he said it was not-that Mussolini was a great and courageous man. However he did not convince me and I was glad to have a confirmation in

your interview, of my impression. I should like you to tell me more. তাঁকে যেন না ভু ল বোঝা হয় এই অনুরোধ জানিয়ে কবি আরও বলেন: when I came to Italy, I knew nothing about the situation nor could I touch in reality. You are the second person who has given me any idea of what Facism is. The first one I met also after had left Italy. You may be sure that I will make a statement of what I think about the Facist regime. কবি তাঁর কথা রেখেছিলেন। বালবানোভা জানাচ্ছেন ---‘‘One of the next issues of the Viennese Daily ‘Nene Freie Presse’ contained a long article by Tagore dealing with this subject. ’’

৭২

এই ব্যাপারে রম্যাঁ রঁলারও ক্ষোভ ছিল কিন্তু ভিলেন্যুতে পারস্পরিক মত বিনিময়ের পর রঁলার পক্ষে বুঝতে অসুবিধে হয়নি কোন অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিজমের প্রশস্তি করেছিলেন। কিন্তু সবকিছু শোনার পর রঁলা জানাচ্ছেন, 'রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে বিচলিত হইলেন' এবং 'যে ফ্যাসিজম তখন তাঁহার নাম ভাঙ্গাইতেছিল তাহার সহিত তিনি খোলাখুলিভাবে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করিলেন।'৭৩ এই প্রসঙ্গে এন্ড্রুজকে যে চিঠিটি কবি লিখেছিলেন তার মধ্যেও ঝরে পড়েছিল তাঁর বেদনামথিত ধিক্কার --If Italy has made even a temporary gain through a ruthless politics, she may be excused for such an obsession-but for us outsiders who believed in idealism, there can be no such excuse. চিঠিটি ইংলন্ডের 'ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান' -এ ছাপা হয়েছিল। অতঃপর 'সেই পত্র পাঠ করে মুসোলিনী ও তাঁর উপগ্রহের দল রবীন্দ্রনাথের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন --- চলল গালিবর্ষণ।'৭৪ আসলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক গতিময় পুরুষ। কোনো Ism -এর সীমায় তাঁকে বাঁধা অসম্ভব কেন না আশি বছরের জীবনে তিনি সীমা অতিক্রম করে গেছেন বারবার। একদা 'বলশেভিজম'কে 'গুণ্ডাতন্ত্র' বলেছেন কিন্তু ১৯৩০ সালে রাশিয়া সফরের পর সেই ভু ল

শুধরে নিয়ে বলেছেন 'আপাতত রাশিয়ায় এসেছি --- না এলে এ জন্মের তীর্থদর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত।'৭৫ কম্যুনিজমের এই প্রশস্তির মধ্যেও কিন্তু ভু লে যাননি তার বিপদের দিকটি --- 'এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই, তা বলিনে --- গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে --- কিন্তু ছাঁচে ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না --- সজীব মনের তত্ত্বর সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চু রমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে কিংবা কলের পুতু ল হয়ে দাঁড়াবে।'৭৬ রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'উৎসর্গে'র ২১ সংখ্যক কবিতায় বলেছিলেন --বাহির হইতে দেখোনা এমন করে আমায় দেখোনা বাহিরে। এই নিষেধবাণীর অবশ্যই কিছু সারবত্তা আছে। বাইরে থেকে দেখলে কি ফল হয়, শ্রীবিশ্বাসের লেখায় তার কিছু নিদর্শন রয়েছে। 'রক্তকরবী'র মতো নাটক যেকালে শঙ্খ ঘোষের কাছে বয়ে নিয়ে আসে 'এক পূর্ণ জটিলতার, এক সম্পূর্ণতার বোধ'৭৭, তাই শ্রীবিশ্বাসকে দেয় এক গভীর অনর্থের সন্ধান। যদিও সেই অনর্থের স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা তাঁর কাছে থাকে না। কখনো তাকে খোঁজেন ত্রিকোণ প্রেমে, কখনো বিদেশি নাটকের অনুকরণের ভাবনায়, কখনো বা রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রদর্শনে। রবীন্দ্রনাথ নন, কিন্তু তাঁর এক পূর্বসূরি কি এইকারণেই 'অরসিকেষু রসস্য নিবেদনে'র ফল নিয়ে বিচলিত বোধ করেছিলেন?

তথ্যপঞ্জি ১. 'অন্তর বাহির' : পথের সঞ্চয়। ২. প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের প্রবন্ধ : 'রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী; তথ্য ও তত্ত্ব'। ৩. খ্যাতি -অখ্যাতির নেপথ্যে : সৌরীন্দ্র মিত্র। ৪. Preface : Rabindranath through Western eyes : A Aronson ৫. Ibid. ৬. খ্যাতি অখ্যাতির নেপথ্যে : সৌরীন্দ্র মিত্র। ৭. তদেব। ৮. প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের প্রবন্ধ।

৯. তদেব। ১০. Preface : Rabindranath Tagore : Selected Poems by William Radice. ১১. Ibid. ১২. Don Jnan XI 60 : Byron ১৩.T. S. Eliot : The Waste Land, ed. by C.B. Cox & Arnold P. Hinchliffe ১৪. প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের প্রবন্ধ। ১৫. Arthur Symons : Symbolist Movement in Literature. ১৬. Sidney Finkelstein : Realism in Art. ১৭. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : কাব্যের মুক্তি : স্বগত। ১৮. জ্যোতির্ময় রবি ও কালো মেঘের দল : সুজিত কু মার সেনগুপ্ত। ১৯. তদেব। ২০. তদেব। ২১. Modern World Drama : An Encyclopedia : Myron Matlaw. ২২. প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের প্রবন্ধ। ২৩. তদেব। ২৪. রবীন্দ্রনাট্য প্রবাহ (২য় খণ্ড) : প্রমথনাথ বিশী। ২৫. শঙ্খ ঘোষের প্রবন্ধ 'রক্তকরবী : কয়েকটি তথ্য' অনুষ্টু প গ্রীষ্ম -বর্ষা। ২৬. প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের প্রবন্ধ। ২৭. কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক : শঙ্খ ঘোষ। ২৮. প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের প্রবন্ধ। ২৯. রক্তকরবী : কয়েকটি তথ্য : শঙ্খ ঘোষ। ৩০.হে বন্ধু হে প্রিয় : অশোক রুদ্র। ৩১. কালের মাত্রা ও রবীন্দ্র নাটক : শঙ্খ ঘোষ। ৩২. ভূ মিকা : তপতী।

৩৩.তদেব। ৩৪. Rabindranath Tagore : Poet & Dramatist : E. Thompson. ৩৫. কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক : শঙ্খ ঘোষ। ৩৬. তদেব। ৩৭. প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের প্রবন্ধ। ৩৮. কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক : শঙ্খ ঘোষ। ৩৯. ঋণশোধ। ৪০. পরিচয় : পঞ্চভূ ত। ৪১. প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের প্রবন্ধে উদ্ধৃ তি। ৪২. পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি। ৪৩. তদেব। ৪৪. চিঠিপত্র ২। ৪৫. (১ম খণ্ড) শান্তিনিকেতন। ৪৬. পল্লীগ্রামে : পঞ্চভূ ত। ৪৭. প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের প্রবন্ধ। ৪৮. রবী ও বিপ্লবীসমাজ থেকে গৃহীত তথ্য। ৪৯. রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবীসমাজ : চিন্মোহন সেহানবীশ থেকে গৃহীত তথ্য। ৫০. তদেব। ৫১. রবীন্দ্রজীবনী (২য়)। ৫২. স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধ। ৫৩.ভারতের জাতীয়তা আন্তর্জাতিকতা ও রবীন্দ্রনাথ : নেপাল মজুমদার। ৫৪. 'রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবী সমাজ' থেকে গৃহীত তথ্য। ৫৫. তদেব। ৫৬. আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ : রাণী চন্দ। ৫৭. ছোটো ও বড়ো : কালান্তর। ৫৮. ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম : ভূ পেন্দ্রনাথ দত্ত।

৫৯. 'রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবীসমাজ' --- চিন্মোহন সেহানবীশ থেকে গৃহীত তথ্য। ৬০. রবীন্দ্রজীবনী (২য়) : প্রভাত কু মার মুখোঃ ৬১. Rabindranath Tagore : A Biography : Krishna Kripalani. ৬২. Letters to a Friend : ed. C.F. Andrews. ৬৩. Fables of Identity : Northrop Frye. ৬৪. রবীন্দ্রজীবনকথা : প্রভাত কু মার মুখোঃ ৬৫. তদেব। ৬৬. রবীন্দ্রজীবনী (২য়) : প্রভাত কু মার মুখোঃ ৬৭. তদেব। ৬৮ .রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবী সমাজ : গ্রন্থে সাক্ষাৎকারটি উদ্ধৃ ত হয়েছে। ৬৯. শিল্পীর নবজন্ম : রম্যাঁ রঁলা, সরোজ দত্ত অনূদিত। ৭০. রবীন্দ্রজীবন কথা। প্রভাত কু মার মুখোঃ ৭১. রাশিয়ার চিঠি। ৭২. তদেব। ৭৩. কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক : শঙ্খ ঘোষ। অনুষ্টু প ৪৫ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা

'রক্তকরবী' প্রসঙ্গে বিতর্ক প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস ১৬.৭.৯০ 'অনুষ্টু প' সম্পাদক সমীপেষু, আপনার পত্রিকার বসন্ত সংখ্যায় (১৩৯৬) প্রকাশিত আমার 'রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী তথ্য ও তত্ব' প্রবন্ধ সম্পর্কে লেখা অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের বিশেষ প্রবন্ধ 'রক্তকরবী কয়েকটি তথ্য' পড়লাম গ্রীষ্ম -বর্ষা (১৩৯৭) যুগ্ম -সংখ্যায় । এই আলোচনা আমার প্রবন্ধের বেশ কিছু দুর্বল বা ত্রুটিপূর্ণ অংশ সম্পর্কে আমাকে নতু ন করে ভাবার সুযোগ দিয়েছে শুধু তাই নয়, রক্তকরবী নাটক সম্পর্কে প্রচু র জ্ঞাতব্য তথ্য একত্র সন্নিবেশিত করে অধ্যাপক ঘোষ সাধারণ পাঠক ও গবেষকদেরও উপকৃ ত করেছেন । তাই, শঙ্খবাবু তাঁর স্বাভাবিক বিনয়বশত লেখাটিকে নিছক একটি তথ্য -সংকলন বললেও এটি আদৌ তা নয়, এবং এর পাঠযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই । আপনি সঠিকভাবেই আলোচনাটিকে একটি বিশেষ প্রবন্ধের বিরল মর্যাদা দিয়েছেন । রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর রচনা বিষয়ে শঙ্খ ঘোষের দেওয়া তথ্য সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করা সুবিবেচনার কাজ হয় না সাধারণত । তবে, আমার রচনা সম্পর্কে অধ্যাপক ঘোষ তাঁর আলোচনার শুরুতেই যে তথ্য দিয়েছেন তাতে সামান্য অত্যুক্তি আছে বলেই আমার মনে হয় । তিনি জানিয়েছেন আমার সাম্প্রতিক কিছু প্রবন্ধের মতো রক্তকরবী সম্পর্কে লেখা প্রবন্ধেও আমি সযত্নে দেখিয়েছি 'রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা সৃষ্টির সবটাই কীভাবে বিদেশ থেকে সমূলে তু লে আনা । ' গত পাঁচ -সাত বছরে আমি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মাত্র চারটি প্রবন্ধ লিখেছি-'গোরা জর্জ এলিয়ট ও রবীন্দ্রনাথ' (১৩৯৪), 'যোগাযোগ গলজওয়ার্দি ও রবীন্দ্রনাথ' (১৩৯৫), 'অধ্যাপক ওয়াশিংটন আরভিঙ ও রবীন্দ্রনাথ' (১৩৯৬), আর 'রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী তথ্য ও তত্ব' (১৩৯৭) । প্রথম তিনটি প্রবন্ধের মধ্যে আমি অবশ্যই দেখিয়েছি রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'গোরা' ও 'যোগাযোগ' উপন্যাস দুটি এবং 'অধ্যাপক' গল্পটি কীভাবে বিভিন্ন বিদেশি রচনার ঘনিষ্ঠ অনুকরণে লিখেছেন, কিন্তু 'রক্তকরবী' সম্পর্কে লেখা প্রবন্ধে আমি বলেছি 'রক্তকরবী নাটকের বিষয়, চরিত্র, সংলাপ, প্রতীক ও আঙ্গিকের ওপর A Dream Play নাটকের ব্যাপক ও গভীর প্রভাব থাকলেও, এটিকে ঠিক অনুকরণ বলা যায় না, যেমন বলা যায় 'গোরা' বা 'যোগাযোগ' উপন্যাসকে । দুটি নাটকের মূল সুর বা আবহ আলাদা, ঘটনার মধ্যেও যথেষ্ট ভিন্নতা আছে । ' বিদেশ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন রচনার জন্যে যেমন যেমন চিন্তাভাবনা তু লে আনেন, আমিও ঠিক

তেমন তেমন দেখাই, সমূলে তু লে আনলে সেইভাবেই দেখাই, আর যখন শুধু কিছু ডালপালা আনেন তখন তাই দেখাই । তাও আজ পর্যন্ত দেখিয়েছি রবীন্দ্রনাথের মাত্র পাঁচ -ছটি গল্প, দুটি উপন্যাস আর একটি বা দেড়টি কবিতার ('প্রথম দিনের সূর্য শঙ্খ -আইয়ুব বিতর্ক') । এই ধরনের উৎস -সন্ধান অধ্যাপক ঘোষের পছন্দ না হতে পারে, আমার প্রবন্ধের মধ্যে হয়তো ভু লত্রুটিও থাকে, তাই বলে আমার সাম্প্রতিক সব প্রবন্ধেই আমি দেখিয়েছি রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনাসৃষ্টির 'সবটাই' কীভাবে বিদেশ থেকে সমূলে তু লে আনা-এ কথা বললে কিছুটা সচেতন তথ্যবিকৃ তি ঘটে কিনা অধ্যাপক ঘোষ একটু বিবেচনা করে দেখবেন আশা করি । 'নির্লজ্জ ইংরেজতোষণের চক্রান্ত' এই শব্দগুচ্ছটিও অধ্যাপক ঘোষের নিজের, আমি আমার প্রবন্ধে এই শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করিনি । আমার কথার জন্য আমি তিরস্কৃ ত হতে রাজি; কিন্তু এ ধরনের overstatement করলে আলোচনার খুব অসুবিধে হয়, কথার কাটান দিতেই সময় চলে যায় । আমার প্রবন্ধ পড়ার আগে রবীন্দ্রনাথের রূপকনাটকগুলির মধ্যে স্বৈরাচারী শাসন ও শোষণের মূল কেন্দ্র বা রাজতন্ত্রের ওপর প্রাণশক্তি, ত্যাগ ও মহত্ব আরোপের চেষ্টা লক্ষ না করে যাঁরা এতদিন নাটকগুলির থেকে প্রাণিত হয়েছিলেন তাঁদের করুণা করারও বিশেষ প্রয়োজন ছিল না, কারণ এই স্পষ্ট ইঙ্গিতগুলি ধরার চেষ্টা না করে অন্যভাবে নাটকগুলি থেকে প্রাণিত হওয়া ততটা দোষের নয়, যতটা দোষের ওই ইঙ্গিতগুলি এতদিন ধরতে না পারা এবং এখনও ধরতে না চাওয়ার জন্যে তৃ প্তি বোধ করা, যে তৃ প্তির সুর খুব একটা প্রচ্ছন্ন নয়, অধ্যাপক ঘোষের আলোচনার ভূ মিকায় । 'রক্তকরবী' নাটক প্রসঙ্গে একটি জরুরি বিষয়ের অবতারণা করেছেন অধ্যাপক ঘোষঅভিনয় কেন হলো না-এই প্রশ্ন তু লে । তিনি লিখছেন 'অনেকেই জানেন, প্রতাপনারায়ণও জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে 'রক্তকরবী'র কোনো অভিনয় হয়নি । ' রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনেক তথ্যই আমার অজানা, রক্তকরবী নাটক সম্পর্কেও অধ্যাপক ঘোষের কাছে যত তথ্য আছে তার তু লনায় আমার কাছে প্রায় কিছুই নেই, তবে, সৌভাগ্যবশত নাট্যনিকেতনে রক্তকরবী নাটকের চ্যারিটি শো ও শিশিরকু মার ভাদুড়ি এবং শ্রীমতী রেবা রায় সংক্রান্ত তথ্যগুলি আমি সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সত্যব্রত দে ও আমার সহকর্মী অধ্যাপক অশোক পালিতের কাছ থেকে, এবং হেমন্তকু মার রায়ের 'সৌখিন নাট্যকলায় রবীন্দ্রনাথ', শান্তিদেব ঘোষের 'গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য' আর হেমন্তবালা দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি থেকে । সেই কারণেই আমার প্রবন্ধে আমি কোথাও জানাইনি যে রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে রক্তকরবীর 'কোনো' অভিনয় হয়নি, আমি লিখেছি 'সাধারণ মঞ্চে' এ নাটকের অভিনয় হয়নি । আমার ধারণা হয়েছিল, এবং এখনও সে ধারণা

রয়েছে যে বিহারের ভূ মিকম্প -পীড়িত মানুষদের সাহায্যের জন্যে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন রক্তকরবী নাটকের যে অভিনয় করেছিলেন, সেটি একটি পারিবারিক প্রাইভেট চ্যারিটি শো ছিল, পাবলিক থিয়েটার বা সাধারণ রঙ্গমঞ্চের অভিনয় বলতে আমরা যা বুঝি তা নয় । শুধু এটু কু ভেবেই আমি সাধারণ রঙ্গমঞ্চে নাটকটির অভিনয় হয়নি-একথা লিখিনি । তার আগে এটাও খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছিলাম কী ধরনের অভিনয় ছিল সেটা, অর্থাৎ ওই প্রাইভেট শো ঠিক কতটা প্রাইভেট ছিল । অভিনয়টি হয়েছিল ১৯৩৪ সালের ৬ এপ্রিল তারিখে । ১৯৩৩ -৩৪ সালে অভিনীত রবীন্দ্রনাটক সম্পর্কে প্রভাতকু মার বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন তাঁর রবীন্দ্র -জীবনীতে । ১৯৩৩ সালে লেখা 'তাসের দেশ' ও 'চণ্ডালিকা' সম্পর্কে বিশদ তথ্য দিচ্ছেন, শান্তিনিকেতনে মহড়ার খবর দিচ্ছেন, কলকাতার ম্যাডান থিয়েটারে পরপর তিনদিন অভিনয়ের সংবাদ জানাচ্ছেন, দর্শক -প্রতিক্রিয়ার কথাও বলেছেন । প্রায় তিন পৃষ্ঠা ধরে এইসব তথ্য দিচ্ছেন প্রভাতকু মার । ১৯৩৩ সালের নভেম্বর মাসে বোম্বাইয়ের একসেলসিয়র থিয়েটারে 'শাপমোচন' -এর অভিনয়ের এবং তার দুদিন পরে 'তাসের দেশ' নাটকের অভিনয় ও দর্শক -প্রতিক্রিয়ার সংবাদ দিচ্ছেন । ১৯৩৪ (জানুয়ারি) সালের বিহারের ভূ মিকম্প সম্পর্কে গান্ধির মন্তব্য ও রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদের খবর দিচ্ছেন, দেশ -বিদেশ থেকে সাহায্যের জন্যে রবীন্দ্রনাথ অ্যান্ড্রুজকে টেলিগ্রাম করছেন এ তথ্যও দিচ্ছেন, এবং ১৯৩৪ সালের মে মাসে, অর্থাৎ নাট্যনিকেতনে রক্তকরবী অভিনয়ের এক মাস পরে নাটকের দল নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সিংহলে যাচ্ছেন, কলম্বো ও জাফনায় কয়েকরাত্রি ধরে শাপমোচন -এর অভিনয় হচ্ছে, এইসব খবর প্রভাতকু মার দিচ্ছেন প্রায় তিন পৃষ্ঠা ধরে । ১৯৩৪ সালের ৩ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কয়েকটি খবরও আমরা পাচ্ছি প্রভাতকু মারের কাছে । ৩ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা এসেছিলেন, ৭ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় সেনেট হলে International Relation Club -এর আয়োজনে বক্তৃ তা দেবার জন্যে । ৩ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ কলকাতা এলেন, ৭ এপ্রিল বক্তৃ তা দিলেন-এ সবেরই খবর দিচ্ছেন প্রভাতকু মার । কিন্তু ৬ এপ্রিল রাত্রে যে রক্তকরবী নাটকের প্রথম অভিনয় হলো নাট্যনিকেতনে এবং রবীন্দ্রনাথ সে -অভিনয়ে উপস্থিত রইলেন, সে খবর প্রভাতকু মার জানাচ্ছেন না, অথচ তার পরের দিনের বক্তৃ তার খবর ভালো করেই দিচ্ছেন । এর একমাস পরে ৫ মে তারিখে অভিনয়ের দল নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সিংহল যাওয়ার খবরও রয়েছে, নেই শুধু ৬ এপ্রিল তারিখের চ্যারিটি শো -র কোনো উল্লেখ । এতটাই গোপন ছিল রক্তকরবী নাটকের প্রাইভেট চ্যারিটি শো -টি । কৃ ষ্ণ কৃ পালানির Rabindranath Tagore : A Biography (1980) বইয়ের মধ্যেও এ -অভিনয়ের কোনো উল্লেখ নেই । সম্প্রতি প্রকাশিত অধ্যাপক উজ্জ্বলকু মার মজুমদার

সম্পাদিত (আনন্দ পালবিশার্স, ১৩৯৫) রাতের তারা দিনের রবি বইটিতে বাংলা থিয়েটার বিশেষজ্ঞ সুশীলকু মার মুখোপাধ্যায়ের 'নাট্যকার প্রযোজক অভিনেতা' প্রবন্ধটিতে রক্তকরবী নাটকের অভিনয় সম্পর্কে একটি বাক্য আছে, সেটি (পৃ. ১৩৫) হলো 'রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় অভিনীত হযনি । ' প্রভাতকু মার কৃ পালানির রবীন্দ্রজীবনী থেকে শুরু করে অধ্যাপক উজ্জ্বলকু মার মজুমদারের সতর্ক সম্পাদনায় প্রকাশিত সুশীলকু মার মুখোপাধ্যায়ের অতি -সাম্প্রতিক প্রবন্ধে কোনো উল্লেখ নেই ১৯৩৪ সালের ৬ এপ্রিল তারিখের ওই অতি গোপন রহস্যময় অভিনয়ের । অথচ অভিনয় যে হয়েছিল এ তথ্যও তো ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না । তাই আমি লিখেছি-'সাধারণ রঙ্গমঞ্চে' রক্তকরবী নাটকের অভিনয় হয়নি রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়, 'কোনো অভিনয় হয়নি' একথা লিখিনি । ওই প্রাইভেট চ্যারিটি শোটিকে যদি শঙ্খ ঘোষ সাধারণ রঙ্গমঞ্চের অভিনয় হিসেবে স্বীকৃ তি দেন ও অন্যান্য নাট্য -ঐতিহাসিকেরা যদি এই স্বীকৃ তি সমর্থন করেন, আমি অবশ্যই মেনে নেব তাঁদের সিদ্ধান্ত । রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে 'সাধারণ রঙ্গমঞ্চ' -এ রক্তকরবী নাটকের অভিনয় হয়নি-এ কথা লিখে আমি ভু ল করেছি না ঠিক করেছি তার থেকে আরও জরুরি প্রশ্ন হলো এ অভিনয়ের তথ্য এতটা গোপন রইল কেন যার জন্যে অধ্যাপক ঘোষকে সে -অভিনয়ের অভিনয়পত্রীর ছবি ছাপিয়ে এতদিন পরে ঘটনাটির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে হচ্ছে, যে তথ্য শান্তিনিকেতনে থাকা সত্বেও প্রভাতকু মার, কৃ ষ্ণ কৃ পালানি বা সুশীল মুখোপাধ্যায় কারও গোচরে আসেনি বা আনা হয়নি । রক্তকরবী -র মতো অসাধারণ নাটকের প্রথম অভিনয় হলো, রবীন্দ্রনাথ, শিশিরকু মার সে -অভিনয়ে উপস্থিত রইলেন, অথচ এই অভিনয়ের খবর প্রায় অজানা রয়ে গেল বাংলাদেশের রবীন্দ্রঅনুরাগী মহলে, এমনকী থিয়েটার -বিশেষজ্ঞদের কাছেও । ঘটনাটি প্রায় অবিশ্বাস্য । শঙ্খ ঘোষকে ধন্যবাদ এই অভিনয় সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করার জন্যে । শঙ্খ এ -অভিনয়ের দর্শক -প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে একটি ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করেছেন 'তখনকার দর্শকদের বুদ্ধি কিছু অল্প ছিল বলে অভিনয় থেকে তেমন বিপজ্জনক কোনো প্রতিক্রিয়া অবশ্য হয়নি দেখা যাচ্ছে । ' কিন্তু এই মন্তব্য থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না সত্যিই কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল দর্শকদের মধ্যে যার জন্যে শুধু রবীন্দ্রনাথ অভিনয় দেখে 'শ্রান্ত দেহে ক্লান্ত মনে' বাড়ি ফিরলেন তাই নয়, এ অভিনয়ের স্মৃতি প্রায় মুছে গেল বাঙালির মন থেকে । তাই, সেই অভিনয়ের দর্শকদের বুদ্ধি কম ছিল না বেশি ছিল এ নিয়ে রগড় না করে আরও তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন আছে কেন এ নাটকের অভিনয় দেখার পরও রবীন্দ্রনাথের মনে এ আশঙ্কা রয়েই গেল যে তাঁর এই নাটকের অভিনয় দেখে দর্শকেরা তাঁকে 'ভিখ' দেবেন না, 'কু ত্তা লেলিয়ে দেবেন' । এই অভিনয়ের পরেও রবীন্দ্রনাথ কথাগুলি তু লে নেননি

নাটকের প্রস্তাবনা থেকে । এই অভিনয়ের দর্শক -প্রতিক্রিয়া খুব আশাব্যঞ্জক হয়েছিল এমন কোনো সমকালীন তথ্য শঙ্খবাবু পাননি বলেই কি সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে ১৯২৬ সালে লেখা জয়গোপাল ব্যানার্জীর একটি প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃ তি দিতে হলো তাঁকে? জয়গোপাল ব্যানার্জীর মুগ্ধ মন্তব্য থেকে অবশ্য এটা স্পষ্ট হয়েছে যে নাটকটি ছাপা হওয়ার সময় কলকাতার ইংরেজিশিক্ষিত বাঙালির মধ্যে 'কেউ কেউ' ছিলেন যাঁরা রক্তকরবী নাটকে স্বৈরাচারী রাজার হাতে হাত মিলিয়ে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাওয়ার মধ্যে ভারতের রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবনের পথনির্দেশ খুঁজে পেতেন এবং পেয়ে মুগ্ধও হতেন । রক্তকরবী নাটক সম্পর্কে সমকালীন পাঠক -প্রতিক্রিয়া বিষয়ে বিশেষ অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে, যাতে আমরা আরও ভালো করে জানতে পারি ১৯২৬ সালের ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শিক্ষিত শহুরে বাঙালির কোন কোন অংশের রাজনৈতিক চিন্তা ঠিক কোন খাতে বইছিল এবং রবীন্দ্রনাথ সেই চিন্তাই প্রতিফলিত করেছিলেন কিনা তাঁর এই রাজা -প্রজার মিলন ও সমঝোতা দেখানো নাটকটিতে । এইসব ঘটনা ও তথ্যের মধ্যেই পাওয়া যাবে ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত এ নাটক অভিনয়ের ব্যাপারে কেন ইতস্তত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কেন এ নাটক -প্রযোজনায় 'খুব একটা আগ্রহ কখনো দেখাননি । ' আমি কথাটা বলেছিলাম আমার কাছে তাঁর আগ্রহের যেসব তথ্য ছিল তার ভিত্তিতেই । শঙ্খবাবু তার অনেকগুলি সাজিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রবন্ধে, সেখান থেকেই বলি । রবীন্দ্রনাথ অভিনয়ের আগে নাটকটি ছাপাতে চাননি প্রবাসী -তে, কিন্তু ছাপিয়েছিলেন অভিনয়ের কোনো ব্যবস্থা করার আগেই । শিশিরকু মারকে অধিকার দিয়েছিলেন রক্তকরবী অভিনয় করার, শিশিরকু মার সে অধিকার প্রয়োগ করেননি । অসুস্থ রেবা রায়কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন তিনি সুস্থ হয়ে উঠলে ডিসেম্বরে রিহার্সালের আয়োজন করবেন । রেবা রায় সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন নিশ্চয়ই, তার পরে ডিসেম্বর মাসেও এসেছিল অনেকবার, রবীন্দ্রনাথ রিহার্সালের ব্যবস্থা করেননি । অমিতা ঠাকু রকে বলেছিলেন নন্দিনীর ভূ মিকায় অভিনয় করার জন্যে, বলেছিলেন 'আমি তোকে শেখাবো তু ই ঠিকই পারবি । ' কিন্তু অমিতা ঠাকু রকে শেখাননি । বারবার নাটকটি পড়ে শুনিয়েছিলেন অনেককে, কারও কারও ভালো লেগেছিল, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অভিনয়ের আয়োজন করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেন না । যেটু কু আগ্রহ দেখিয়ে তাঁরই আত্মীয়স্বজন নাট্যনিকেতনে রক্তকরবী নাটকের অভিনয় করলেন, রবীন্দ্রনাথ সেটু কু আগ্রহও দেখাতে পারেননি জীবনে । অথচ, সিংহলে গিয়ে কলম্বো আর জাফনায় 'শাপমোচন' অভিনয়ের আয়োজন করলেন অনায়াসে । সত্যিই রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ থাকলে তাঁর কোনো নাটকের প্রযোজনা সম্ভব হতো না তাঁর জীবদ্দশায়, একথা বিশ্বাস করা খুবই শক্ত । নন্দিনীর ভূ মিকায় অভিনয় করার মতো অভিনেত্রী পাওয়া যায়নি

বলে এ নাটকের অভিনয় প্রযোজনা করা সম্ভব হয়নি, এ যুক্তি আমি গ্রহণযোগ্য মনে করি না । কোনো অভিনেতা দিয়েও ওই চরিত্রে অভিনয় করানো যেত, যেমন রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন শিশিরকু মারকে । তাই 'অভিনয় কেন হলো না' শঙ্খ ঘোষের এই প্রশ্নের জবাব এখনও পর্যন্ত আমাদের খুঁজতে হবে প্রস্তাবনার 'ভিখ মিলবে না' এই আশঙ্কার মধ্যেই । আমার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে, কিন্তু এ সিদ্ধান্ত 'অধীর' বলে আক্রান্ত হবার যোগ্য নয় বোধ হয় । কোথা থেকে এল ফু ল? ক্ষিতিমোহন সেনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী রক্তকরবী নাটকে ফু ল এসেছে রবীন্দ্রনাথের ঘরের পাশের জালজঞ্জাল থেকে, যে ফু লটি নাকি রবীন্দ্রনাথকে বলেছিল-'আমায় মারতে পারলে কই?' আমি এই গল্প বিশ্বাসযোগ্য মনে করিনি, কারণ নাটকের খসড়া থেকে আমি এ গল্পের সমর্থন পাইনি । প্রথমেই বলে রাখা ভালো, বহুরূপী পত্রিকায় প্রকাশিত খসড়াটিকে আমি আদৌ প্রথম খসড়া বলে ধরে নিইনি । এটি প্রথম না চতু র্থ খসড়া এ প্রশ্নও খুব জরুরি নয় । আমি একটি খুব সহজ প্রশ্ন করেছি । ক্ষিতিমোহনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথের ঘরের পাশে অনেকদিন জালজঞ্জালে চাপা থাকর পর বেড়ে ওঠা রক্তকরবী গাছ ও ফু লটিকে দেখে রবীন্দ্রনাথ তাঁর যে নাটকের নাম 'নন্দিনী' বা 'যক্ষপুরী' দিয়েছিলেন, তাতে আর তৃ প্তি পেলেন না, তাই নাম দিলেন 'রক্তকরবী' । তাই যদি হয়, তাহলে শিলঙ থেকে ফিরে তাঁর ঘরের পাশে অনেকদিন ধরে চাপা থাকা ও তারপর বেড়ে ওঠা রক্তকরবী গাছ ও ফু ল দেখার আগে শিলঙে লেখা অন্তত প্রথম দুটি খসড়ার একটিতেও রক্তকরবী ফু লের উল্লেখ থাকার কথা নয়, কারণ তখনও রক্তকরবী ফু লটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা বা কথাবার্তা হয়নি । প্রণয়কু মার কু ণ্ডুর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী (রবীন্দ্রবীক্ষা ১৬) প্রথম খসড়াটির কোনো নাম নেই, 'নন্দিনী' -ও নয় 'যক্ষপুরী' -ও নয়, এবং এ নাটকে 'নন্দিনী'র উল্লেখ নেই, 'রক্তকরবী' -রও নেই । কিন্তু দ্বিতীয় খসড়াতে- যেটি শ্রীকু ণ্ডুর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী 'শিলঙে বসেই লেখা' এবং যেটি রবীন্দ্রবীক্ষা ১৯ সংকলনে ছাপা হয়েছে-নন্দিনী নামটি আছে, এবং রক্তকরবী গাছ আর ফু ল দেখার দরকার ছিল না রবীন্দ্রনাথের, ওটির খবর তিনি আগেই পেয়ে গিয়েছিলেন যেখানে তিনি নন্দিনীর সন্ধান পেয়েছিলেন । আবার, 'বহুরূপী' ৬৫ সংখ্যায় ছাপা (ধরে নিলাম এটি চতু র্থ খসড়া এবং এটি রবীন্দ্রনাথ শিলঙ থেকে ফিরে তাঁর ঘরের পাশে জালজঞ্জাল থেকে উঠে আসা ফু লটিকে দেখার পর 'নন্দিনী' নামে আর তৃ প্তি না পেয়ে লিখেছিলেন) খসড়ার মধ্যে রক্তকরবী ফু লের উল্লেখ থাকা সত্বেও খসড়াটির মলাটে তাঁর সুন্দর হস্তাক্ষরে (দ্র, বহুরূপী ৬৫) 'নন্দিনী' লিখে রবীন্দ্রনাথ তৃ প্তি পেলেন কী করে? যখন তিনি রক্তকরবী ফু লটি দেখেই ফেলেছেন এবং খসড়ার মধ্যে রক্তকরবী ফু লের উল্লেখও করছেন, তখন তো আর নাটকের 'নন্দিনী' নামে তাঁর তৃ প্ত

হওয়ার কথা নয়? সব থেকে বড়ো কথা, রক্তকরবী দেখার আগে 'নন্দিনী' নাম দিয়ে যে খসড়াটি রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন এবং যার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই রক্তকরবী ফু লের উল্লেখ থাকার কথা নয়, সেই খসড়া কোনটি এবং কোথায় রক্ষিত আছে? আমি যতগুলি খসড়া দেখেছি তার মধ্যে দেখেছি, যে -খসড়াতে নন্দিনী আছে, সেখানেই রক্তকরবী আছে । অর্থাৎ নন্দিনী এসেছে, ফু ল আসেনি এমন কোনো খসড়া আমি পাইনি । তাই আমি ক্ষিতিমোহনের সাক্ষ্যকে গ্রহণ করতে পারিনি । সেই খসড়ার সন্ধান পেলেই আমি তাঁর বক্তব্য সমর্থন করব, তার আগে নয় । এইসব কারণেই আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে যখন রবীন্দ্রনাথ 'নন্দিনী' নামটি নাটকে এনেছেন বা নাটকের নাম হিসেবে ব্যবহার করেছেন তখনই তিনি রক্তরকবী ফু লের সন্ধানও পেয়েছিলেন, এবং এটি ঘটেছে শিলঙেই, ফিরে এসে ঘরের পাশে রক্তকরবী ফু লের সঙ্গে দেখা বা কথাবার্তা হবার আগেই ; এ ফু ল আসল ফু ল নয়, নিতান্তই একটি literary ফু ল । ক্ষিতিমোহনের দেওয়া তথ্যকে আমি আরও সন্দেহের চোখে দেখেছি এই কারণে যে 'গোরা' উপন্যাসের সঙ্গে নিবেদিতার সম্পর্ক নিয়েও তিনি এমনি একটি গোলমেলে তথ্য দিয়েছিলেন একবার (নিত্যপ্রিয় ঘোষ, 'বলবান আক্রমণের বাধা', গাঙ্গেয়, আশ্বিন, ১৩৯৪) । এখানে রবীন্দ্রনাথকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, কেননা রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহনকে ঠিক কি বলেছিলেন বা আদৌ কিছু বলেছিলেন কিনা, সে সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই । একটি তিনহাত বা দু -হাত -ফেরত সন্দেহজনক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রবীন্দ্রনাথকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করার মতো নির্বুদ্ধিতা আমি দেখাতে যাব কেন, যেখানে এ -ব্যাপারে নাটকের মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাব নেই, বা তাঁর রচনার উৎস সম্পর্কে উক্তি করার সময় রবীন্দ্রনাথ যে সবসময় প্রকৃ ত তথ্য দিতেন না এর প্রত্যক্ষ প্রমাণও এমন কিছু দুর্লভ নয় । আমাকে বিরুদ্ধপক্ষ ভেবে নিয়ে আমার বুদ্ধির প্রতি অধ্যাপক ঘোষ যে এতটা অনাস্থা জ্ঞাপন করলেন, সে কি একান্তই অগ্রজের অধিকারে, না গোড়াতেই রাগ করে বসার ফলে? এ প্রশ্নের উত্তর কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে অধ্যাপক ঘোষের 'নাম কেন নন্দিনী' অংশে । আমি বলেছি রবীন্দ্রনাথ স্ট্রিন্ডবার্গের Dottern বা ইংরেজি অনুবাদের Daughter থেকে আক্ষরিক অনুবাদ করে এনেছেন 'নন্দিনী' নামটি । একু শ বছর আগে ছাপা কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক বইয়ের মধ্যে A Dream Play থেকে একটি সংলাপ বাংলায় অনুবাদ করে দেখাতে গিয়ে, শঙ্খ ঘোষও, খুব স্বাভাবিকভাবেই, স্ট্রিন্ডবার্গের Daughter -এর কথা মনে রেখে ‘child of heaven’ -এর অনুবাদে 'নন্দিনী' কথাটি ব্যবহার করেছিলেন । এর ফলে অধ্যাপক ঘোষ স্ট্রিন্ডবার্গের 'নন্দিনী'কে রবীন্দ্রনাথের নন্দিনীর খুবই কাছাকাছি এনে ফেলেছিলেন । শঙ্খ বলছেন, তাঁর তখন ভালো লেগেছিল ও

স্ট্রিন্ডবার্গের নাট্যাংশদুটিকে সমীকৃ ত করতে । তারপর অধ্যাপক ঘোষ বলছেন ''কিন্তু এখন জানছি 'রক্তকরবী'র নন্দিনী নামটিতে রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন অনুবাদ । '' সত্যিই কি কথাটা এতদিন পরে জানছেন অধ্যাপক ঘোষ? যখন Daughter ও Officer -এর সংলাপটি সম্পর্কে লিখেছিলেন 'আমাদের নিশ্চয় এর সঙ্গে মনে পড়বে 'রক্তকরবী'র সমান্তরাল সংলাপটি', যখন সেই সমান্তরাল সংলাপটির সঙ্গে স্পষ্ট অনুবাদের ছাপ দেখে মন্তব্য করেছিলেন 'খুবই সদৃশ', তখনও কি তাঁর মনে হচ্ছিল না যে এ সাদৃশ্যের ছাপ রয়েছে দুটি সমান্তরাল চরিত্রের নামেও, এবং এ সাদৃশ্য এসেছে অনুবাদের মাধ্যমেই? নাকি, আমি আমার প্রবন্ধে A Dream Play থেকে সচেতন অনুকরণের অংশ হিসেবে অনুবাদগত যেসব সাদৃশ্য দেখিয়েছি, সেগুলি অনুকরণ বা অনুবাদের মাধ্যমে আসেনি, আপনা আপনিই এসেছে একথা প্রমাণ করার জন্যেই এখন অধ্যাপক ঘোষকে অনুবাদের ভূ মিকাটিকে অগ্রাহ্য করতে হচ্ছে, বলতে হচ্ছে Redemption-ঋণশোধ কি এক? Renunciation -Suffering আর ত্যাগ -দুঃখ কি এক? তাই তাঁকে খুঁজে দেখতে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ স্ট্রিন্ডবার্গের আগে কোথায় ঋণশোধ, কোথায় ত্যাগ -দুঃখের কথা বলেছেন, যাতে A Dream Play -র সঙ্গে রক্তকরবী -র সাদৃশ্য মুছে ফেলা যায় । প্রশ্ন করছেন 'দুঃখ বা ত্যাগ বা মুক্তি বলতে রবীন্দ্রনাথ যা ভাবতেন, সেইটিই কি স্ট্রিন্ডবার্গের ধারণা?' এ প্রশ্ন অধ্যাপক ঘোষ অবশ্যই করছেন একথাটা বলার জন্যে A Dream Play ও রক্তকরবী নাটকের থিম বা বলবার বিষয়ে কোনো সাদৃশ্য নেই, কেননা ত্যাগ দুঃখ বা ঋণশোধ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের যেসব নিজস্ব ধারণা ছিল তার সঙ্গে এসব বিষয়ে স্ট্রিন্ডবার্গের ধারণার কোনো মিল নেই । কিন্তু একু শ বছর আগে এসব বিষয়ে স্ট্রিন্ডবার্গের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মিল বেশ ভালোই তো ছিল, যখন শঙ্খ লিখেছিলেন ''স্ট্রিন্ডবার্গের 'স্বপ্ননাটক' মনে করিয়ে দেয় বটে 'রক্তকরবী'র নাট্যবিষয়, দুয়ের সাদৃশ্য অনেকটাই । '' ধারণার তফাত থাকা সত্বেও দুটি নাটকের বিষয়ের মিল তো 'অনেকটাই' ছিল তখন, এবং মাত্র পাঁচ বছর আগে ১৯৮৫ সালে কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক বইটির তৃ তীয় সংস্করণ ছাপার সময়েও । আজ সে সাদৃশ্য থাকছে না কেন, কেনই বা অধ্যাপক ঘোষকে এখন আলতো করে বলতে হচ্ছে-'কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক' বইটিতে A Dream Play -র সঙ্গে 'রক্তকরবী'র সামান্য সাদৃশ্য নিয়ে'' মন্তব্য করেছিলেন তিনি? তখন কিন্তু সত্যিই সাদৃশ্য অতটা 'সামান্য' মনে হয়নি তাঁর, যখন তিনি 'রক্তকরবী', ক্রিসেন্থিমাম' প্রবন্ধে লিখেছিলেন :: তু লনীয় একটি রচনা মনে পড়ে এখানে, স্ট্রিন্ডবার্গের 'স্বপ্ননাটক' । তারও প্রতীক গড়ে ওঠে এক দুর্গ আর এক ফু লে, আত্মকারায় বন্দী অফিসার আর তাকে মুক্ত করবার যোগ্য এক স্বর্গচ্যুত ইন্দ্রকন্যা, অ্যাগ্নেস । নন্দিনীর মতো এ চরিত্রও প্রথমে ঠে

দেখা দেয় অপাপবিদ্ধ সারল্যে, কিন্তু ক্রমেই বিধুর হয়ে ওঠে অভিজ্ঞতায় । এ -নাটকও দেখাতে চায় জড় বস্তুপিণ্ড থেকে চেতনার মুক্তি, অহংময়তা থেকে নির্গলিত হবার পথ । সেখানেও শুনতে পাই 'কেন আবর্জনা থেকে বেরিয়ে আসে ফু ল? আলোর দিকে উঠে ঝরে যায়, এই তাদের আনন্দ' । আর অন্তিমে, যখন জ্বলে যাচ্ছে একটু ক'রে সমস্ত দুর্গ, তার মধ্যে দেখা দিচ্ছে হতাশ শোকময় প্রশ্নাতু র মুখের ভীড়, তখন এক ফু লের কুঁড়ি আকস্মিক প্রস্ফু টনে হয়ে ওঠে বিশাল এক ক্রিসেন্থিমাম । তাঁর প্রবন্ধের মধ্যে অধ্যাপক ঘোষ একথাও বলেছিলেন 'এই ক্রিসেন্থিমাম আর রক্তকরবী প্রায় সমতু ল্য, কিন্তু বিন্যাসে একেবারে সমান নয় নাটক দুটি । ' একু শ বছর আগে নাটক দুটির বিন্যাসে একেবারে সমান না হলেও ক্রিসেন্থিমাম আর রক্তকরবী ছিল প্রায় সমতু ল্য, আজ আর শঙ্খ ঘোষের সে সমতু ল্যতা ভালো লাগছে না, এখন তিনি ক্ষিতিমোহনের কাছে ফু লের সন্ধান করছেন, প্রশ্ন করছেন-'কোথা থেকে এলো ফু ল । ' ত্যাগ দুঃখ বা ঋণশোধ সম্পর্কে অবশ্য শঙ্খ ঘোষ যে মূল্যবান তথ্যগুলি দিয়েছেন সেগুলি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে এসব বিষয়ে নাটক লেখার সম্পূর্ণ অধিকার রবীন্দ্রনাথের ছিল, অর্থাৎ নিজস্ব ধ্যানধারণা থেকেই তিনি এসব বিষয় নিয়ে নাটক লিখতে পারতেন । রবীন্দ্রসৃষ্টির একটি বিস্ময়কর দিক এটাই, যেসব বিষয়ে নিজস্ব চিন্তা বা উপলব্ধি থেকে তিনি অনায়াসে গল্প উপন্যাস নাটক বা কবিতা লিখতে পারবেন, সেসব ক্ষেত্রেও তিনি কখনো কখনো তাঁর অধিকার প্রয়োগ না করে বিদেশি রচনার ঘনিষ্ঠ অনুকরণে সাহিত্যরচনা করতেন । 'গোরা' উপন্যাসের বিষয়ে এমন কী ছিল যা রবীন্দ্রনাথ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লিখতে পারতেন না? তবুও তিনি George Eliot -এর Felix Holt the Radical উপন্যাস থেকে ঘটনা, চরিত্র, পাত্রপাত্রীর শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য, বর্ণনা, সংলাপ ইত্যাদি কখনো আক্ষরিকভাবে কখনো ভাবানুবাদ করে আহরণ করে 'গোরা' উপন্যাসটি লিখেছিলেন । 'যোগাযোগ' উপন্যাসেই বা এমন কী ছিল যা রবীন্দ্রনাথ Galsworthy -র The Forsyte Saga উপন্যাস থেকে আহরণ না করে নিজের অভিজ্ঞতা বা অধিকার থেকে লিখতে পারতেন না? বিপ্রদাসের ঘোড়ার মুখে কু মুর চু মু খাওয়া পর্যন্ত তাঁকে Galsworthy -র কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হলো কেন? এমনকী কবিতার ক্ষেত্রে, তাঁর নিজের সাম্রাজ্যে, নবজাতকের 'কেন' বা 'প্রশ্ন' কবিতা কেন তাঁকে লিখতে হলো Paradise Lost -এর অষ্টম সর্গে Adam -এর সঙ্গে Raphael -এর কথাবার্তা থেকে শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ধরে ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনুবাদ করে? বিদেশি রচনা থেকে অনুকরণ করে গল্প উপন্যাস বা নাটক লেখার সময় রচনার বিষয়

সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব অধিকার আছে কি নেই এ প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথকে বিচলিত করেনি কখনো । ত্যাগ ও দুঃখ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ আর স্ট্রিন্ডবার্গের ধারণা কি এক-এই প্রশ্ন তু লেছেন শঙ্খ ঘোষ, যেন কোনো বিদেশি লেখকের ধারণার সঙ্গে তাঁর ধারণা না মিললে রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনা থেকে অনুকরণ করতেন না । শবচেতনায় আচ্ছন্ন নেশাভাঙে অভ্যস্ত বিকৃ তমনস্ক Poe, চরম কলাকৈবল্যবাদী Gautier, অতিসজ্জন Galsworthy, অজ্ঞাবাদী George Eliot, ধর্মমনস্ক Milton, সুস্থ অবস্থায় নাস্তিক এবং উন্মাদ হবার পর আস্তিক Strindberg-এইসব বিদেশি লেখকদের ধ্যানধারণা বা জীবনবোধের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মবাদী শুদ্ধ চেতনার মিল হবে তবে তিনি তাঁদের রচনা থেকে কখনো বিপুল পরিমাণ কখনো কিছু কিছু মালমশলা নিয়ে গুপ্তধন, নিশীথে, ক্ষু ধিত পাষাণ, গোরা, যোগাযোগ, নবজাতক -এর 'কেন' বা 'প্রশ্ন' কবিতা, বা রক্তকরবী লিখবেন, এমন ছুৎমার্গ কোনোদিন ছিল না রবীন্দ্রনাথের । ধ্যানধারণার মিল অমিলের প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘস্থায়ী অনুচিকীর্ষাকে দমিত করেনি কোনোদিন । এসব তথ্য অধ্যাপক ঘোষের অজানা নয়, তবু তিনি ত্যাগ দুঃখ ইত্যাদি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণার সঙ্গে স্ট্রিন্ডবার্গের চিন্তার অমিলের প্রশ্ন তু লছেন কি আমি ভু ল বলেছি একথা বোঝাবার জন্যে, নাকি একু শ বছর আগেকার শঙ্খ ঘোষ A Dream Play -র সঙ্গে রক্তকরবী নাটকের ব্যাপক সাদৃশ্য দেখতে পেয়ে যে অন্যায় করেছিলেন তার জন্যে তাঁর অনুতাপের কথা পরোক্ষ ঘোষণা করার জন্যে । আমি তো তাঁরই 'দুইয়ের সাদৃশ্য অনেকটাই'-এই কথায় বিশ্বাস রেখে আমার প্রবন্ধটি লিখতে শুরু করেছিলাম এবং দেখিয়েও ছিলাম যে শঙ্খ ঘোষ ঠিকই বলেছেন, A Dream Play ও রক্তকরবী -র নাট্য বিষয়ের সাদৃশ্য অনেকটাই বটে । আজকের অধ্যাপক ঘোষ আর একু শ বছর আগেকার অনেকটাই সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া অধ্যাপক ঘোষকে মনে রাখতে চাইছেন না । তাই আমি যে সাদৃশ্য দেখিয়েছি সেটা প্রাণপণে নস্যাৎ করার চেষ্টার মধ্যে দিয়ে একু শ বছর আগেকার ভু লের প্রায়শ্চিত্ত করছেন তাঁর দীর্ঘ প্রতিবাদ -প্রবন্ধে । আজ তিনি আমাকে প্রশ্ন করছেন, ত্যাগ বা দুঃখ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ আর স্ট্রিন্ডবার্গের ধারণা কি এক? এ প্রশ্নের উত্তর তো তাঁরই দেবার কথা, এবং সে উত্তর এই-যতটা এক হওয়ার জন্যে একু শ বছর আগে এবং ১৯৮৫ সালে কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক বইটির তৃ তীয় সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার সময়েও অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের মনে হয়েছিল দুটি নাটকের নাট্যবিষয়ের সাদৃশ্য অনেকটাই, ততটাই এক । আত্মখণ্ডনের প্রয়োজন থাকতেই পারে, তার উপায়ও আছে অনেক, প্রতিবাদ -প্রবন্ধ রচনা বোধহয় তার মধ্যে পড়ে না । 'রবীন্দ্রনাটকে পথ যতটু কু আসে তাও তো সম্ভব নয় কেবল স্ট্রিন্ডবার্গের কারণেই'শঙ্খবাবুর এই ব্যঙ্গোক্তিও যতটা রাগী, ততটা প্রাসঙ্গিক নয় । আমার প্রশ্ন ছিল-শঙ্খবাবু

যখন রবীন্দ্রনাটকে পথের ব্যবহার প্রসঙ্গে ব্রেশট লোরকা ইয়েটস গ্রিক নাটক ইত্যাদি বিদেশি প্রসঙ্গ তু ললেন, তখন স্ট্রিন্ডবার্গের A Dream Play বা Road to Damascus নাটকে দৃশ্য নাট্যবিষয় বা প্রতীক হিসেবে পথের যে ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে তার উল্লেখ করলেন না কেন । আমি এ প্রশ্ন তু লেছি এই জন্যেই যে, স্থানের সীমায়িত অস্তিত্বের মধ্যে ব্যাপকতর মাত্রা যোগ করে খণ্ডের মধ্যে একটা ব্যাপ্তি বা পূর্ণতার আভাস দেওয়ার টেকনিক নাট্যশিল্পী হিসেবে স্ট্রিন্ডবার্গের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এবং রবীন্দ্রনাথের রূপকনাটকে, বিশেষত রক্তকরবীতে এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ না করা বেশ কঠিন, বিশেষত তাঁর পক্ষে যিনি A Dream Play ও রক্তকরবী নাটকের বিষয়ে মিল দেখেছেন অনেকটাই, যিনি দুটি নাটকের নায়িকার নাম কার্যকলাপ এবং দুর্গ ও ফু লের মধ্যেও সাদৃশ্য লক্ষ করেছেন এবং একটি সমান্তরাল সংলাপ উদ্ধৃ ত করে মন্তব্য করেছেন 'খুবই সদৃশ' । অধ্যাপক ঘোষ একটি বিস্ময়কর জবাব দিয়েছেন আমার এই প্রশ্নের । রক্তকরবী নাটকের স্থান ও কালবিন্যাস সম্পর্কে শঙ্খবাবুর বর্তমান অবস্থান মাত্র পাঁচ বছর আগে পুনর্মুদ্রিত তাঁর 'পথ প্রতীক ও পটভূ মি' থেকে অনেকখানি সরে এসেছে । এখন তাঁর মনে হচ্ছে '' 'রক্তকরবী'তে একটাই, সুনির্দিষ্টভাবে নাট্যকারচিহ্নিত একটাই পট । প্রাসাদের জালের আবরণের বহির্ভাগ । '' কালবিন্যাস সম্পর্কেও তাঁর এখনকার ধারণা '' 'রক্তকরবী'তে জালের আবরণের বহির্ভাগে একটি মাত্র দৃশ্যের মতো কালপ্রবাহ আছে একটি মাত্র দিনের মধ্যে বাঁধা, ধ্বজাপূজার একটি দিন । '' তাই অধ্যাপক ঘোষ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে ''স্থান বা কালের বিন্যাসে 'রক্তকরবী' দাঁড়িয়ে আছে A Dream Play -এর একেবারে বিপরীত বিন্দুতে । '' অর্থাৎ, রক্তকরবী নাটকের বিন্যাসে স্থানিক এবং কালগত বাস্তবতা বা ঐক্যের ওপর এখন শঙ্খবাবু জোর দিতে চাইছেন, ওই ঐক্যের মধ্যে ব্যাপ্তি বা বৈচিত্র্যের যে ইঙ্গিত রয়েছে তার ওপর জোর দিতে চাইছেন না । স্থান ও কালের বিন্যাসে রক্তকরবী A Dream Play নাটকের একেবারে বিপরীত বিন্দুতে আছে শঙ্খবাবুর এ বক্তব্য আমি মানতে পারছি না এইজন্যেই যে একু শ বছর আগে এবং পাঁচ বছর আগেও তিনি রক্তকরবী -র স্থান ও কালবিন্যাসের আপাত ঐক্যের মধ্যে যে বৈচিত্র্য বা ব্যাপকতার মাত্রার ইঙ্গিত দেখতে পেয়েছিলেন, আমি তা এখনও দেখতে পাই । ১৯৮৫ সালে পুর্নমুদ্রিত শঙ্খবাবুর 'পথ প্রতীক ও পটভু মি' থেকে একটি মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে ''নির্দেশ কি 'রক্তকরবী'তেও নেই, এক অর্থে নেই, অন্য হিসেবে আছে । 'মুক্তধারা'র সময় বাস্তব, স্থানও বাস্তব । 'রক্তকরবী'তে কালের ব্যবহারে যেমন বাস্তবের মধ্যেই লাগে পরাবাস্তবের টান, আপাতবাস্তব কালকে ভেঙে নেওয়া যায়

অন্তহীন কালের মধ্যে-স্থানবিষয়েও তেমনি সেখানে সত্যপট আর চিত্তপট মিলে এক জটিল দৃশ্যসংস্থান তৈরি হয়'' । (পৃ. ৬৫) অধ্যাপক ঘোষ এখন জালের আবরণের বহির্ভাগ বা বাহির -বারান্দার দৃশ্যগত ঐক্যের ওপর খুব বিশ্বাস রাখছেন । কিন্তু পাঁচ বছর আগেও তাঁর মনে হয়েছিল 'বাহির -বারান্দা'? এই মঞ্চ নির্দেশের ওপর পরিচালক কতটা নির্ভর করতে পারেন তা ভেবে দেখতে হবে । নাট্যঘটনা অল্প এগিয়ে গেলে একথাটিকে আমরা খুব একটা গণ্য করতে পারি না আর । এই নির্দেশের প্রতি স্পষ্টত কোনো অভিযোগ আসে না বটে, কিন্তু অলক্ষ্যেই, যা ছিল বারান্দা তা যেন ক্রমে ব্যাপকতর পথের আকার নিয়ে প্রসারিত হয়ে পড়ে । একদিকে জালাবরণের অন্তরালে রাজা এবং অন্যদিকে যক্ষপুরীর মানুষগুলির মধ্যে সংযোগ রচনার সেতু হিসেবে ওই বারান্দায় নন্দিনীর অস্তিত্বকে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু তারপর যখন ফাগুলাল -চন্দ্রার জীবনখণ্ড অথবা সর্দারের চক্রান্ত বা মোড়লদের স্তাবকতা ঘটতে থাকে একই ভূ মিতে, তখন অন্তত বারান্দার 'লজিক'টা নষ্ট হয়ে যায়, মনে আসতে পারে বড়জোর প্রাসাদসমীপে কোন টানা -পথের ছবি । '' (পৃ. ৬৫ -৬৬) ''অনেক টু করো টু করো সময়ের খণ্ড নিয়ে যেমন 'রক্তকরবী'র ঐক্যময় আপাতসময়, তেমনি অনেক টু করো টু করো পট নিয়ে তার ঐক্যময় পথ, আপাতপথ । তাই 'এক' -এর ধারণা মনে রেখেও 'রক্তকরবী'তে আমরা স্থাননির্দেশের লজিক খুঁজি না.... । '' (পৃ. ৬৬) এখন কিন্তু 'প্রাসাদের জালের আবরণের বর্হিভাগ' এই স্থাননির্দেশের লজিককে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন অধ্যাপক ঘোষ, বলছেন '' 'রক্তকরবী'তে পট একটাই, সুনির্দিষ্টভাবে নাট্যকারচিহ্নিত একটাই পট । '' পাঁচ বছর আগেও যে নাটকের ঐক্যময় আপাতপথ তৈরি হয়েছিল 'অনেক টু করো টু করো পট নিয়ে', এখন সেখানে শঙ্খবাবু দেখছেন-'পট একটাই' । দেখতেই পারেন, কিন্তু এ ব্যাপারে আমি তাঁর সঙ্গী হতে পারছি না । রক্তকরবী নাটকের কালপ্রবাহকেও শঙ্খবাবু এখন একটি দিনের মধ্যে বাঁধা দেখতে চাইছেন-'ধ্বজাপূজার একটি দিন । ' একু শ বছর আগে এবং পাঁচ বছর আগেও কিন্তু রক্তকরবীর কালপ্রবাহ একটিমাত্র দিনে বাঁধা ছিল না । 'কালের মাত্রা' প্রবন্ধে শঙ্খবাবু আমাদের জানিয়েছিলেন '' 'রক্তকরবী'র বহিরবয়বে স্থান ও কাল -গত ঐক্যের এক মায়া মাত্র রচিত

আছে, আবার ওই সঙ্গে প্রচ্ছন্ন গড়নে এ -নাটক ছড়িয়ে আছে বৃহত্তর কালের মধ্যে । '' (পৃ. ৮২) রক্তকরবী -র নাট্যকাল যে ঠিক ধ্বজাপূজার একটি দিনে সীমাবদ্ধ নয় একথাও চমৎকারভাবে শঙ্খবাবু ব্যাখ্যা করেছিলেন তাঁর 'কালের মাত্রা' প্রবন্ধে, রঞ্জন সম্পর্কে কিছু সংলাপের উদ্ধৃ তি দিয়ে বা একই দিনকে একবার ছুটির দিন আবার কিশোরের কথা অনুযায়ী কাজের দিন হিসেবে উল্লেখ করে । নাট্যকালের আপাতঐক্যের মধ্যে এই ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্যের সন্ধান পেয়েই শঙ্খবাবু স্পষ্ট মন্তব্য করেছিলেন ''রাজার অস্তিত্ব-অতএব সমগ্র 'রক্তকরবী'র অস্তিত্ব সাম্প্রতিক কাল থেকে চিরন্তন কালে, রূপময় কাল থেকে কালহীনতায় প্রসারিত হয়ে যায়'' (পৃ. ৮৬) । ওই একই প্রবন্ধের শেষের দিকে শঙ্খবাবু বলেছিলেন '' 'মুক্তধারা' সময়বদ্ধ, 'রক্তকরবী' সময়হারা । '' উপসংহারে মন্তব্য করেছিলেন '' 'মুক্তধারা' -য় দেখি আবদ্ধ কালের সংহতি, 'রক্তকরবী'তে আপাতসংহতির মধ্যে প্রসারিত মুক্তি । '' এখন কিন্তু শঙ্খবাবু মুক্তধারার আবদ্ধ সময়ের মতো রক্তকরবীর কালপ্রবাহকেও বেঁধে রাখতে চাইছেন ধ্বজাপূজার একটি দিনের মধ্যে । তাই তাঁর মনে হচ্ছে রক্তকরবী -র স্থান ও কালবিন্যাস রয়েছে A Dream Play -র বিপরীত বিন্দুতে । স্থান ও কালের আপাতসংহতির মধ্যে প্রসারিত মুক্তির আভাস A Dream Play -র মতো রক্তকরবী নাটকেও বেশ স্পষ্টভাবেই রয়েছে এবং সেটি শঙ্খবাবু সঠিকভাবেই লক্ষ করেছিলেন পাঁচবছর আগেও । এখন তিনি সেটা লক্ষ না করতে চান না করবেন, কিন্তু রক্তকরবী -র স্থান ও কালবিন্যাসকে অযথা বারান্দায় বা ধ্বজাপূজার একটি দিনের মধ্যে বেঁধে রাখার জন্যে এতটা জেদ ধরবেন না আশা করি । বিশেষত কালবিন্যাসের ক্ষেত্রে এতটা বাঁধাবাঁধি করলে তাঁর আরেকটি চমৎকার প্রবন্ধ 'ঋতু মণ্ডল ও রক্তকরবী' তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলবে, যেখানে তিনি সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন কীভাবে রক্তকরবী নাটকের সীমিত সময়ের আপতঐক্য প্রসারিত হয়ে আছে, চিরাবর্তনময় ঋতু মণ্ডলে, গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত আর বসন্তে, যেটি আরো স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায় A Dream Play নাটকের কালবিন্যাসে । শেষ করার আগে দু একটি কথা বলা দরকার শ্রীমতী রানু মুখার্জী ও 'যন্ত্র'প্রসঙ্গে । রক্তকরবী নাটকের প্রেরণা হিসেবে A Dream Play -র স্মৃতি মুছে ফেলার জন্যে অধ্যাপক ঘোষ যেমন এখন ক্ষিতিমোহনের কাছে ফু লের সন্ধান করছেন, নন্দিনীর জন্যেও তেমনি স্ট্রিন্ডবার্গের Daughter -এর বদলে শ্রীমতী রানু মুখার্জী সংক্রান্ত তথ্যের ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন । রানু মুখার্জীর কাছে যে তথ্য পাওয়া দরকার সে -তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি । প্রণয়কু মার কু ণ্ডুর দেওয়া তথ্য অর্থাৎ রানু রক্তকরবী নাটক লেখার সময় শিলঙে রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিলেন, রানু দৌড়ঝাঁপ করতেন, তাঁর খোলা চু ল দেখতে

রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগত, বিধান রায় তাঁর সাদা শালটি রানুকে দিয়েছিলেন যাতে তাঁর ঠান্ডা না লাগে, রবীন্দ্রনাথ রানুকে বলেছিলেন-'নন্দিনী তু ই'-এসব কথা সত্য হলেও তথ্য নয়, অর্থাৎ এইসব গালগল্প থেকে বলা যাবে না রক্তকরবী নাটকের প্রেরণা রানু মুখার্জী, বা নন্দিনীর প্রেরণা রানু । এলমহার্স্ট তাঁর মন্তব্যের মধ্যে রানু -এলমহার্স্ট -রবীন্দ্রনাথের ত্রিভূ জ সম্পর্কের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, বিশেষত তিনি Dorothy -কে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন জেনে রবীন্দ্রনাথের মনে একটা ভারী বোঝা নেমে যাওয়ার কথা শুনিয়ে তাঁদের ত্রিভু জ সম্পর্কের মধ্যে যে গভীর ঘনিষ্ঠতার মাত্রা যোগ করেছেন, সেই ত্রিভু জের বাস্তব ভিত্তি কতটা ছিল, এ সম্পর্কে শ্রীমতী মুখার্জীর কাছ থেকে প্রকৃ ত তথ্য না জানা পর্যন্ত আমরা বলতে পারব না রানু -এলমহার্স্ট -রবীন্দ্রনাথের ত্রিভু জের কতটা সমাপতন ঘটেছে রক্তকরবী নাটকের নন্দিনী -রাজা -রঞ্জন ত্রিভু জ প্রেম -কাহিনিতে । রানু মুখার্জীর কাছে যদি আমরা জানতে পারি এই ত্রিভু জের বাস্তব ভিত্তি ছিল, কেবল তখনই 'এ নাটকের কাহিনী কবির জ্ঞানবিশ্বাস মতে সত্য' রবীন্দ্রনাথের এ দাবির কারণ ও রাজা -রঞ্জন -নন্দিনীর পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর রানু -এলমহার্স্ট -রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের ছায়া আমাদের কাছে কিছুটা স্পষ্ট হতে পারে তার আগে নয় । সুতরাং রানু মুখার্জীর কাছে সব তথ্যই পাওয়া গেছে মনে করার কোনো কারণ নেই, এবং যতদিন এই তথ্য না পাওয়া যায়, ততদিন স্ট্রিন্ডবার্গের Daughter -এর আক্ষরিক অনুবাদ থেকে আসা নন্দিনীকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে আমাদের । 'স্বপ্নছায়া'র ব্যাপারটা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে এসেছে এখন । শঙ্খ ঘোষ বুঝতে পেরেছেন A Dream Play -তে 'সবটা প্রায় একই স্তরে' ঠিক নেই, রক্তকরবী -কে যেমন নিয়ে আসতে হবে 'জাগ্রত জগতে', A Dream Play -কেও তেমনি স্ট্রিন্ডবার্গ এনেছেন জাগ্রত প্রাত্যহিক জগতে কখনো কখনো । শঙ্খ ঘোষ তার পরেও বলেছেন তিনি খুব একটা ভু ল বলেননি । এ বিষয়ে তার সঙ্গে আমার কিছুটা মতান্তর রইলই, অন্য অবকাশে এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে, যেখানে রক্তকরবী নাটকের সংলাপ বা দৃশ্য বিন্যাসও কতটা চেনাজানা চব্বিশ ঘণ্টার প্রাত্যহিক বাস্তব জগতের আর কতটা কাব্যিক হেঁয়ালিপনার বা 'তেপান্তরের মাঠে'র (উৎপল দত্ত, 'বহুরূপী ও রক্তকরবী', বহুরূপী পত্রিকা, ৬৯) সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে । শঙ্খবাবুকে অজস্র ধন্যবাদ, রক্তকরবী প্রসঙ্গে 'যন্ত্র' কথাটির মানে যে machine নয়, মনুষ্যত্বহীন আমলাতন্ত্র, সেটি খোলসা করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন । এরপর থেকে আশা করি রক্তকরবী প্রসঙ্গে 'যন্ত্র' কথাটি উল্লেখ করার সময় আর কেউ machine, industrialism, মেশিনভিত্তিক আধুনিক ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ইত্যাদির প্রসঙ্গ তু লবেন না, আগে যা তু লেছেন তু লেছেন । 'যন্ত্র' বলতে রাজা কী বোঝাতে চাইছে রাজা তো স্পষ্ট ঠি

করেই বলেছে 'আমার নিজের যন্ত্র আমাকে মানছে না । ' শঙ্খ সঠিকভাবেই বলেছেন ''এই হলো 'রক্তকরবী'র যন্ত্রের ধারণা, গোটা ব্যবস্থার এই যন্ত্র । '' মুক্তধারা -র যন্ত্র machine; কিন্তু রক্তকরবী -র যন্ত্র bureaucracy । শঙ্খ সংগতভাবেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, 'যন্ত্র' সম্বন্ধে এ -প্রয়োগ পছন্দ না -ও হতে পারে অনেকের । পছন্দ হওয়া মুশকিল । আমরা দীর্ঘদিন ধরে রক্তকরবী নাটকের রাষ্ট্রনৈতিক প্রেক্ষাপটটিকে সমকালীন ভারতের আমলাতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক পরিবেশ থেকে সযত্নে সরিয়ে বহুদূর আমেরিকার industrialized যন্ত্রসর্বস্ব দুঃসমাজের পটভূ মিতে দেখতে অভ্যস্ত হয়েছি, এবং এইসব ভেবে অনেক বইপত্রও লিখে ফেলেছি । এই আমেরিকান গুজবের ফলেই রক্তকরবী প্রসঙ্গে 'যন্ত্র' বুঝতে আমাদের machine, আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এইসব কথা মনে পড়েছে অনবরত, ঔপনিবেশিক ভারতের ব্রিটিশ আমলাযন্ত্রতন্ত্রের কথা মনে পড়েনি, নাটকের মধ্যে মেশিনের চিহ্নমাত্র না থাকা সত্বেও, 'যন্ত্র' বলতে রবীন্দ্রনাথ bureaucracy বোঝাতে চাইছেন একথা জানা সত্বেও । তাহলে রক্তকরবী নাটকে নন্দিনী বা প্রাণ এসে আঘাত করল যন্ত্রকে একথার কী অর্থ দাঁড়াল শেষ পর্যন্ত? নন্দিনীর নেতৃ ত্বে ফাগুলাল -বিশুরা কোন যন্ত্রের ওপর আঘাত করছে এবং কীভাবে? যন্ত্রী রাজাকেই বা কী চোখে দেখছে তাঁরা? নাটক খুব স্পষ্ট করেই দেখিয়েছে কীভাবে যক্ষপুরীর শোষিত মানুষদের নেত্রী নন্দিনী যন্ত্রী -রাজার মজ্জায় খুশি লাগিয়ে, শোষণের মূল শক্তি যন্ত্রী -রাজার হাতে শোষিত ফাগুলালদের হাত মিলিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে যন্ত্র -আমলাতন্ত্র Fuller -ছোটো ইংরেজের ওপর আঘাত হানতে । এই হলো রক্তকরবী নাটকে 'প্রাণ এসে আঘাত করল যন্ত্রের ওপর' কথার তাৎপর্য । যতদূর মনে পড়ছে, এই কথাটাই আমি বলেছি আমার প্রবন্ধে । অধ্যাপক ঘোষ তাঁর প্রবন্ধের শেষে 'আরো কি মিল নেই' অংশে ১৯৮৫ সালে লেখা ধর্মবোধ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কথার সঙ্গে ১৮৯৭ সালে ছাপা স্ট্রিন্ডবার্গের একটি উক্তির ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য দেখিয়ে সঠিকভাবেই বলেছেন যে এ ধরনের মিলের জন্যে সচেতন আহরণের কোনো প্রয়োজন ঘটে না । শঙ্খ বোধ হয় একথা বোঝাতে চেয়েছেন যে রক্তকরবী -র সঙ্গে A Dream Play -র সাদৃশ্যগুলোও এমনি আপনাআপনি ঘটেছে । দুটি নাটকের নাট্যবিষয়ের সাদৃশ্য থাকবে অনেকটাই, দুটি নাটকেই দুর্গ আর আবর্জনা থেকে উঠে আলোর দিকে ফু টে ওঠা ফু লের প্রতীক থাকবে, নায়িকার নামও হবে এক এবং দুজনের মধ্যেই থাকবে ইন্দ্রদেবের আগুন, দুটি নাটকেই নিজের জালে বন্দি রাজা বা রাজকর্মচারীকে মুক্ত করতে আসবে নায়িকা, তাদের অন্তত একটি সংলাপ হবে খুবই সদৃশ, দুটি নাটকেই খনি শ্রমিকেরা থাকবে চরিত্র হিসেবে, অন্যান্য সংলাপেও কিছু কিছু স্পষ্ট মিল থাকবে, দুটি নাটকেরই পটভূ মি হবে দুর্গের সামনের পথ দুটি নাটকেই

ঋতু চক্রের আবর্তনের ইঙ্গিত থাকবে, দুটি নাটকই শেষ হবে নায়িকার আত্মাহুতিতে এবং প্রতীকী ফু লের উল্লেখে-অথচ এইসব সাদৃশ্য ঘটবে অসাড়ে, সচেতন আহরণের মাধ্যমে নয়-এ বিশ্বাস অধ্যাপক ঘোষের থাকতে পারে আমার নেই । আমি যতটু কু জানি, পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে এই ধরনের ডিটেলের সাদৃশ্য সচেতন অনুকরণ ছাড়া ঘটেনি কখনো । তাছাড়া যাঁকে রক্তকরবী লেখার চার বছর পর একজন জীবিত ও জনপ্রিয় লেখক গলজওয়ার্দির The Forsyte Saga -র অবিশ্বাস্যরকমের বিশ্বস্ত অনুসরণে যোগাযোগ উপন্যাস লিখতে হবে, তাঁর পক্ষে A Dream Play -র সঙ্গে রক্তকরবী নাটকের ব্যাপক সাদৃশ্যের জন্যে অসচেতনতার ওপর নির্ভর করে নিশ্চিন্ত থাকা স্বাভাবিকও হতো না । আরও অনেক কথা বাকি রইল, সব কথা এখানেই বলে নিতে হবে এমনও কোনো কথা নেই, অনুষ্টু প পত্রিকার অন্য লেখকদের কথাও তো ভাবতে হবে । অধ্যাপক ঘোষের সঙ্গে কোনো বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়া আমার পক্ষে যথেষ্ট অস্বস্তিকর, নানান কারণে । সব থেকে বড়ো কারণ আমি তাঁর কাছে গভীরভাবে ঋণী । সাম্প্রতিক রবীন্দ্রজিজ্ঞাসার এলাকাকে অধ্যাপক ঘোষ যতটা সমৃদ্ধ ও প্রসারিত করেছেন, আমি তার তু লনায় কিছুই পারিনি, এবং তিনি আমার কাছে কোনোভাবেই ঋণী নন । তাই আমাকে বা আমার প্রবন্ধকে আক্রমণ করে প্রতিবাদ -প্রবন্ধ লেখা তাঁকে যতটা মানায়, তাঁর প্রতি বিরূপতা দেখানো আমাকে ততটা মানায় না । একদিন ছিল যখন অধ্যাপক ঘোষের সঙ্গে আমার কোনো কোনো মতের মিল হচ্ছে দেখে আমার ভালো লাগত ; আজ দেখছি অনেক অমিল হচ্ছে । হতেই পারে । দিনকাল পালটেছে, তার সঙ্গে বদলেছে দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিবেশও, আমাদের দুজনেরই । তবে তার জন্যে আমি অধ্যাপক ঘোষকে আমার প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবতে চাইনি । আলোচনা করতে গিয়ে ভাষার মধ্যে তির্যকতা বা শ্লেষের টান এসে যায় অনেক সময়, যেমন এসেছে শঙ্খবাবু ও আমার দুজনের লেখাতেই, যেটা এড়াতে পারলে ভালো হতো । অধ্যাপক ঘোষকে আর একবার ধন্যবাদ জানাই তাঁর প্রবন্ধের জন্যে, তাঁর মতো তথ্যনিষ্ঠ সূক্ষ্মবোধসম্পন্ন পাঠকের প্রতিক্রিয়া জানতে পারা যে -কোনো রবীন্দ্রগবেষকদের পক্ষেই সৌভাগ্যের, সে -প্রতিক্রিয়া যতই বিরূপ হোক না কেন, কিংবা হয়তো বিরূপ বলেই । তাঁর প্রবন্ধের কিছু কিছু বক্তব্য আমি অবশ্যই আবার বিবেচনা করব এবং গ্রহণযোগ্য মনে হলে ভবিষ্যতে আমার প্রবন্ধে সকৃ তজ্ঞ স্বীকৃ তি দিয়ে ব্যবহারও করব । এই সুযোগে আমার প্রবন্ধের দুটি গুরুতর প্রেসকপির ভু ল সম্পর্কে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি । ১৭ পৃষ্ঠায় ‘things -in -themselves’ হবে ‘thing -in -itself’, এবং ৩৫ পৃষ্ঠায় ‘Foulstrand’ -এর 'খনিশ্রমিক' হবে ‘Lawyer’ । Hanneles -এর শেষের '৪' টিও বাদ পড়ে গেছে ১৫ ও ১৬ পৃষ্ঠায় । শ্রীপ্রণবেশ রায় ও শ্রীআশিসকু মার ঠি

চক্রবর্তী দুটি মূল্যবান প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়েছেন অনুষ্টু প সম্পাদকের কাছে । বর্তমান লেখার মধ্যে তাঁদের বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে আশা করি । শ্রীরায়, শ্রীচক্রবর্তী বা অন্য যেসব পাঠক আমাকে ব্যক্তিগত চিঠি দিয়ে তাঁদের মতামত জানিয়েছেন তাঁদের সবাইকে আমার ধন্যবাদ জানাই । এই ধরনের feedback থেকেই আমরা আমাদের ভু লত্রুটিগুলো বুঝতে পারার ও শোধরাবার সুযোগ পাই । ভবিষ্যতে আমার প্রবন্ধটি সংশোধন করার সময় আমি অবশ্যই তাঁদের কথাগুলি শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখব । শুভেচ্ছা জানবেন ।

'রক্তকরবী' প্রসঙ্গে বিতর্ক শঙ্খ ঘোষ আপনাদের পত্রিকায় (বসন্ত ১৩৯৬) প্রতাপবাবুর প্রবন্ধটি পড়ে আমার মনে হয়েছিল, 'রক্তকরবী' বিষয়ে জ্ঞাতব্য কয়েকটি তথ্য একত্র নথিভু ক্ত থাকলে কোনো -কোনো প্রসঙ্গে নিজস্ব সিদ্ধান্ত গড়ে নিতে পাঠকদের কিছুটা সুবিধে হতে পারে । অনেক পড়াশোনা আর ভাবনাচিন্তা করে যেসব মত প্রতাপবাবু প্রকাশ করেছেন, আমার লেখাটির (গ্রীষ্ম -বর্ষা ১৩৯৭) ফলে তিনি তা প্রত্যাহার করে নেবেন এমন কোনো মূঢ় আশা আমার ছিল না । তাই, তাঁর চিঠিতে অন্তত কোনো -কোনো প্রসঙ্গেও যে নতু ন করে ভেবে দেখার আশ্বাসটু কু দিয়েছেন তিনি, আমার পক্ষে সেটা যথেষ্টের চেয়েও বেশি । অবশ্য, সে -আশ্বাসের পরেও প্রায় সবকটি বিষয়েই তিনি আবার কিছুটা জট পাকানো তর্ক তু লেছেন । এটাও অস্বাভাবিক নয় । প্রাক -প্রস্তুত সিদ্ধান্তকে কোনো তথ্যই টলাতে পারে না, কিছু -না -কিছু নতু ন ওজর বার করতেই হয় । তবে, সিদ্ধান্তকে যুক্তিসিদ্ধ করবার গরজে প্রতাপবাবু কীভাবে অন্য রচনাকে খণ্ডিত করে দেখেন, বা অনুক্ত রাখেন কোনো -কোনো জরুরি তথ্য, তাঁর প্রবন্ধে আর এই চিঠিতে এর বেশ কয়েকটি সুন্দর নিদর্শন আছে । সেসব প্রসঙ্গে দু -একটি কথা আবারও হয়তো বলতে হবে এখানে । এ -বিষয়ে কৌতূ হলীদের শুধু অনুরোধ করি, তাঁরা যেন 'অনুষ্টু প' -এর পুরোনো সংখ্যাও একটু দেখে নেন, তথ্যগুলিকে আরো একবার পূর্ণভাবে বিবৃত করা এ -চিঠিতে সম্ভব নয়, সংগতও নয় । প্রতাপবাবু জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রজীবনকালে 'রক্তকরবী' অভিনয়ের বা রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব অভিনয়েচ্ছার তথ্যগুলি বন্ধু দের সূত্রে তিনি আগেই সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন । পারবারই কথা, কেননা সে তো খুব দুর্লভ তথ্য নয় । কিন্তু নাটকটির অভিনয় হওয়া -না -হওয়া নিয়ে এত গুরুতর আলোচনা চলছে যে দীর্ঘ প্রবন্ধে, সেখানে ওই জ্ঞাত তথ্যগুলির ঠি

কিঞ্চিৎমাত্র উল্লেখ কেন করেননি তিনি, এইটে ঈষৎ বিস্ময়ের । চিঠিতে পরে একবার তিনি ১৯৩৪ সালের চ্যারিটি অভিনয়ের দুটি বিশেষণ ব্যবহার করেছেন 'অতিগোপন' এবং 'রহস্যময়' । অনেকসময়ে তথ্যগুলি যে অতিগোপন আর রহস্যময় থেকে যায়, সে তো এই কারণেই যে প্রত্যাশিত জায়গায় লেখকেরা তাঁদের জানা খবরগুলিকে উহ্যই রেখে যান । তা না রেখে, অভিনয় -প্রসঙ্গে এই চিঠিতে লেখা কথাগুলি প্রতাপবাবু যদি তাঁর মূল প্রবন্ধটিতে আগেই বলে ফেলতেন, এ বিষয়ে কোনো 'আলোচনার সূত্রপাতের জন্য' আমাকে আর তাঁর ধন্যবাদ জানাতে হতো না, সে -ধন্যবাদ নিশ্চয় প্রাপ্য হতো তাঁরই । ভূ কম্পপীড়িতদের সাহায্য করবার জন্য সেকালীন বিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চ 'নাট্যনিকেতন' -এ টিকিটবিক্রিকরা এই বিজ্ঞাপিত চ্যারিটি অভিনয় যে 'অতিগোপন' এবং 'রহস্যময়', তার অকাট্য প্রমাণ হিসেবে প্রতাপবাবু বলেন প্রভাতকু মার বা কৃ ষ্ণ কৃ পালানি তাঁদের জীবনীগ্রন্থে এর কোনো খবর দেননি, এর কথা বলেননি উজ্জ্বলকু মার মজুমদার বা সুশীলকু মার মুখোপাধ্যায় । এ এক প্রকাণ্ড যুক্তি । প্রভাতকু মারে না থাকলেও অন্যেরাও অনেকসময়ে তার উল্লেখ করেন না, কিন্তু তাই বলে তথ্যও কি তার তথ্যত্ব হারায়? প্রভাতকু মারের 'রবীন্দ্রজীবনী' এক সৌধবৎ কীর্তি; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে যাবতীয় মীমাংসার শেষ তথ্য পাওয়া যাবে সেখানে, এটা ধরে নেওয়া একটু কিশোরশোভন প্রত্যাশা । নাট্যনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী' দেখার বৃত্তান্ত প্রভাতবাবু লেখেননি বলে এর গোপনীয়তা বিষয়ে নিঃসংশয় হয়েছেন প্রতাপনারায়ণ । তিনি হয়তো খেয়াল করেননি যে ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে 'স্টার' থিয়েটারে অহীন্দ্র চৌধুরীদের 'গৃহপ্রবেশ' দেখতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, দেখবার পর নাটকটির অনেক বদল করে দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু সেই দিনটির বিষয়ে অন্য অনেক বর্ণনা থাকলেও জরুরি এই তথ্যটি নেই 'রবীন্দ্রজীবনী'তে । ১৯২৭ সালে ফেব্রুয়ারিতে 'শোধবোধ' -এর অভিনয় দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ওই স্টারেই, কিন্তু সে খবরও বলেননি প্রভাতকু মার । ১৯৩৬ সালে শিশির ভাদুড়ীর অনুরোধে 'যোগাযোগ' -এর নাট্যরূপ তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি, নবনাট্যমন্দিরে এর অভিনয় দেখে লিখেওছিলেন যে 'আনন্দ ও বিস্ময় নিয়ে ফিরে এসেছি, এমন সুসম্পূর্ণ অভিনয় সর্বদা দেখা যায় না', কিন্তু 'রবীন্দ্রজীবনী'তে পাওয়া যাবে না সে কথাও । এমন -কী, অচ্ছু ৎদের সাহায্যার্থে 'কালের যাত্রা'র যে টিকিটবিক্রিকরা অভিনয় হয়েছিল শান্তিনিকেতনে, ১৯৩২ সালেই, তারও কোনো হদিশ দেননি প্রভাতবাবু । আরো অনেক এমন উদাহরণ সংকলন করা সম্ভব প্রভাতকু মার মুখোপাধ্যায়ের জীবনীবইটি থেকে । বইটির মর্যাদা কোনোদিন লুপ্ত হবার নয়, কিন্তু তাকে কি ধরে নিতে হবে জ্ঞানের শেষ সীমা? এতদিন ধরে ওইসব কথা বলছেনও যাঁরা, তাঁদের তাহলে কী গতি হবে? যে -বন্ধু দের সূত্রে প্রতাপবাবু নিজেও জেনেছিলেন 'রক্তকরবী' অভিনয়ের

খবরটা, তাঁদের একটা ভর তো ছিলই কোথাও? এ -বিষয়ে যে বই তিনটির উল্লেখ করেছেন প্রতাপবাবু, তার মধ্যে হেমন্তবালাকে লেখা চিঠিতেই শুধু এ -অভিনয়ের উল্লেখ আছে, শান্তিদেবের বইতে আছে রবীন্দ্রনাথের অভিনয়েচ্ছার কথা, হেমেন্দ্রকু মারের বইটিতে অবশ্য এর কোনোটিই নেই, সেখানে হয়তো অন্য কোনো তথ্য পেয়ে থাকবেন প্রতাপবাবু । সে যাই হোক, ১৯৬১ সালে বহুল প্রচারিত 'দেশ' পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল নির্মলকু মারীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলি, হেমন্তবালাকে লেখা তাঁর চিঠিপত্রও বই হিসেবে বেরিয়েছে এর কয়েক বছর পরেই (১৯৬৪), শিশিরকু মার ভাদুড়ীর নিজের অভিনয় -দর্শনের খবরটা ছেপেছিলেন অমল মিত্র (১৯৭৭), দিনক্ষণসুদ্ধ এ -অভিনয়ের উল্লেখ আছে 'মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ' নামের পঞ্জিটিতে (১৯৭৮), কিংবা এই সেদিনও (১৯৮৭) ছাপা হয়েছে শ্রীমতী দেবরানীর মন্তব্য । একেবারে শেষটা ছাড়া, প্রভাতকু মার বা কৃ ষ্ণ কৃ পালানি কারো কাছেই এসব উল্লেখ গোপন থাকবার কথা ছিল না, কিন্তু যে -কোনো কারণেই হোক তাঁদের চোখ এড়িয়ে গেছে এসব । প্রসঙ্গত, বলবার মতো একটা খবর হচ্ছে এই যে, 'মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ' নামের শীর্ণ সংকলনটিতে অল্প দুচারটি প্রবন্ধের মধ্যে সুশীলকু মার মুখোপাধ্যায়েরও লেখা ছিল একটা, তাই 'অতিগোপন' অভিনয়ের তথ্যটি তাঁর অন্তত চোখে পড়লে খুব দোষের হতো না । অথচ এর কয়েক বছর পরেও (১৯৮৮) তিনি জানাতে পারেন যে রবীন্দ্রজীবনকালে এ -নাটকের কোনো অভিনয় হয়নি! তথ্য যে দীর্ঘকাল ধরে কীভাবে গোপন আর রহস্যময় থেকেই যায় শুধু, তার একটা ছোটো ইঙ্গিত পাওয়া যায় এইসব ঘটনায় । রবীন্দ্রনাথ নিজেও যে কয়েকবার এ -নাটক মঞ্চস্থ করবার চেষ্টা করেছিলেন, সে -তথ্যও দেখা যাচ্ছে প্রতাপবাবুর অজানা নয় । আবারও বলি, এ -রকমই হবার কথা, কেননা বহু জায়গায় ছাপা হয়েছে খবরগুলি । কিন্তু, আবারও সেই বিস্ময়কর কাণ্ড, মঞ্চস্থ না করবার পিছনকার অভিসন্ধি খুঁজতে যিনি এতটা তৎপর, অতগুলি খবর জেনেও তার কিছুমাত্র উল্লেখ করতে তাঁর ইচ্ছে হয়নি একবারও । সেটা কি এইজন্যে যে ওসব তথ্যে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহের যতটা প্রমাণ আছে বলে আমরা ভাবছি, প্রতাপবাবুর বিবেচনায় সেটা 'খুব একটা আগ্রহ' নয়? এইটে বোঝাবার জন্যই কি তাঁর প্রবন্ধ থেকে এই শব্দবন্ধ উদ্ধৃ তচিহ্নে ব্যবহার করছেন তিনি? 'খুব একটা'কে চিহ্নিত করবার জন্যে? তা যদি করে থাকেন তো বলি, উদাহরণগুলি সামনে রাখলে পাঠকেরা নিজেরাই বুঝতে পারতেন সে -আগ্রহকে 'খুব একটা আগ্রহ' বলা সম্ভব কি না । উপরন্তু, প্রতাপবাবুকে মনে করিয়ে দিই যে কথাটা তাঁর প্রবন্ধে ওই একবারই মাত্র ব্যবহার করেননি তিনি, বলেছেন একাধিকবার, 'খুব -একটা' -জাতীয় বিশেষণ ছাড়াই বলেছেন পরে '...রক্তকরবীর অভিনয়ের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাননি । ' এসব পরমনিশ্চিত সরল সিদ্ধান্তে পৌঁ

পৌঁছোবার স্বাধীনতা তাঁর আছেই, কিন্তু তার আগে বহু জায়গায় স্পষ্টভাষায় ব্যক্ত রবীন্দ্রনাথের অভিনয়েচ্ছাগুলির কথা বা চেষ্টাগুলির কথা পাঠকদের জানিয়ে দেওয়াটাও দরকার ছিল । প্রতাপবাবু নিশ্চই সবই জানতেন, কিন্তু অন্য কোনো -কোনো পাঠকের নজর এড়িয়ে যেতে পারে ভেবে সেই তথ্যকটাই সাজিয়ে দিয়েছিলাম আমি, যাতে তাঁরা নিজেরাই বুঝে নিতে পারেন এ -বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ -অনাগ্রহের যথাযথ অনুপাত । আগ্রহ থাকলে অভিনয় কেন হবে না, এই হচ্ছে প্রতাপবাবুর প্রশ্ন । প্রশ্ন অবশ্য নয়, এ তাঁর সিদ্ধান্ত যে-তথ্যগুলি যাই বলুক -আগ্রহ থাকলে অভিনয় হতোই, কেননা ইংরেজি কথায় তো আছেই যে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়, কেননা সুদূর জাফনায় গিয়ে 'শাপমোচন' মঞ্চস্থ করতে পারলে নিকট -কলকাতায় 'রক্তকরবী' করতেই -বা বাধা কোথায়! শাপমোচন -তাসের দেশ -চিত্রাঙ্গদা -চণ্ডালিকার মঞ্চায়ন আর মুক্তধারা -রক্তকরবীকে মঞ্চস্থ করবার সমস্যা যে ভিন্ন রকমের, এটা বুঝতে খুব পরিশ্রম হবার কথা নয় । কীভাবে সেই সমস্যা একের পর এক তৈরি হচ্ছে, তথ্যগুলিতে ছিল তারই নানা ইঙ্গিত । কিন্তু সেসব তথ্যে প্রতাপবাবুর মন ভরে না, কেননা আগে থেকেই তৈরি হয়ে আছে তাঁর সিদ্ধান্ত । ফু লপ্রসঙ্গের ভাবনাতেও, দেখা যাচ্ছে, 'বহুরূপী'তে প্রকাশিত খসড়াটিকে প্রথম বলে ধরে নেননি প্রতাপবাবু, আর ওটা প্রথম না চতু র্থ খসড়া এ -প্রশ্নটাও না কি 'খুব জরুরি নয়' । প্রথম পাঠ কোনটা, সে প্রশ্ন জরুরি নয়, অথচ তিনি অনায়াসে লিখতে পারেন '...নন্দিনী বা যক্ষপুরী হিসেবে নাটকটির যে খসড়া তিনি করেছিলেন, সেখানে রক্তকরবী ফু লের উল্লেখ থাকার কথা নয় । পাণ্ডুলিপি কিন্তু সে কথা বলছে না । ' পাণ্ডুলিপি যে তা বলছে না, অর্থাৎ 'যক্ষপুরী'তেও যে রক্তকরবীর উল্লেখ আছে, প্রত্যয় নিয়ে এটা বলতে গেলে তো জানতেই হয় কোনটাকে বলব যক্ষপুরীর পান্ডু লিপি, জানতেই হয় সে -পাণ্ডুলিপিতে রক্তকরবীর উল্লেখ আছে কি না, জানতেই হয় প্রথম থেকে কোন পারম্পর্যের মধ্য দিয়ে কত বদলের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে খসড়াগুলি । আর, এ -ব্যাপারে নতু ন সিদ্ধান্তের জন্য উন্মুখ কোনো গবেষককে এও মানতে হয় যে হাতফেরতা উপাদান নিয়ে কাজ করবার বিপদ আছে অনেক, একেবারে অলভ্য না হলে গোটা প্রক্রিয়াটাকে একবার নিজের চোখে দেখে নেওয়াই ভালো এবং পাঠকদের সামনে সথাসাধ্য সেগুলিকে পেশ করাও সংগত । সেটা করলে প্রতাপবাবু জানতে পারতেন যে 'নন্দিনী' নামে কোনো খসড়া মে -মাসের শিলংবাসকালে তৈরি হয়নি । ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত 'যক্ষপুরী' হিসেবেই এ -নাটকের কথা বলা হয়েছে বারবার, পালটাতে পালটাতে 'নন্দিনী' নামটার উল্লেখ এল

অক্টোবরে । শিলং -এর খসড়াটিতে যে রক্তকরবী ফু লটির কিছুমাত্র ব্যবহার নেই, এ -তথ্য লক্ষ্যে রাখলে প্রতাপবাবুর এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব যে 'রবীন্দ্রনাথ কি পুরো নাটকটাই আবার লিখেছিলেন রক্তকরবী গাছের ফু লটি দেখার পর ওই ফু লটিকে নাটকের কেন্দ্রীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে । ' এর উত্তর 'হ্যাঁ, ঠিক তা -ই । ' কিন্তু এই উত্তর খুঁজতে গেলে খসড়াগুলির পারম্পর্যটা জানা বিশেষ জরুরি, যদি অবশ্য উত্তর খোঁজাটাই কারো মূল উদ্দেশ্য হয় । কিন্তু চিঠিতে এবার একটা নতু ন প্রশ্ন হলো, 'বহুরূপী'র খসড়াটিতে তাঁর 'সুন্দর হস্তাক্ষরে (দ্র. বহুরূপী ৬৫) নন্দিনী লিখে রবীন্দ্রনাথ তৃ প্তি পেলেন কী করে । ' কেননা, ফু লটি যখন দেখেই ফেলেছেন আর তার কথা বলেও ফেলেছেন নাটকে, তখন তো সঙ্গে সঙ্গেই তার নাম হবার কথা 'রক্তকরবী' । এটা বলবার সময়েও প্রতাপবাবু লক্ষ করছেন না (কিংবা হয়তো করছেন, তবু বলছেন না) যে 'বহুরূপী'র খসড়াটিতেও ফু লটির উল্লেখ আছে দুবার মাত্র । খসড়াগুলি পরপর পড়ে গেলে দেখা যায় কীভাবে অনুল্লেখ থেকে উল্লেখ, উল্লেখ থেকে প্রতিমায়, প্রতিমা থেকে প্রতীকে পৌঁছে যাচ্ছে ফু লটি, স্তরে স্তরে । গোটা নাটকের কেন্দ্রীয় প্রতীক হিসেবে যখন তা রূপায়িত হচ্ছে শেষ পর্যন্ত, তখনই আসতে পারছে 'রক্তকরবী' নাম । এইটে বোঝাবার জন্যেই রবীন্দ্রনাথকে বলতে হয়েছিল 'যক্ষপুরী নন্দিনী প্রভৃ তি বলে আমার তৃ প্তি হয়নি । তাই নাম দিলাম রক্তকরবী । ' রক্তকরবীবিহীন প্রথম পাণ্ডুলিপিটি দেখবার পর প্রতাপবাবুর যুক্তিক্রম এবার অনেকটা এইরকম যে প্রথম পাঠে ফু লটির কথাও ছিল না, নন্দিনী নামটাও ছিল না, অতএব ও -দুটো একসঙ্গে আহৃত হয়েছে A Dream Play থেকে । চরিত্রটির পরিকল্পনা আর নাটকের বিন্যাস বিষয়ে স্ট্রিন্ডবার্গ -নির্ভরতা নিয়ে এ -চিঠিতেও যে অনেকগুলি কথা তিনি বলবেন, তার ভিতটাই ধ্বসে যায় সেক্ষেত্রে, কেননা এই সবকিছুরই বনেদ তো ছিল প্রথম পাঠটিতেই । ত্যাগ দুঃখ বা ঋণশোধ নিয়ে 'অনুষ্টু প' -এ আমি এতসব লিখেছি আমার ব্যক্তিগত কোনো পূর্বপাপ বিষয়ে অনুতাপ করবার জন্য, এই দুরভিসন্ধি খুঁজবার সময়ে প্রতাপবাবু হয়তো ভু লে গেছেন তাঁর মূল প্রবন্ধটির কথা, সে প্রবন্ধে বারবার বলা ছিল 'শারদোৎসব' থেকে 'রক্তকরবী' পর্যন্ত সব নাটকেই রবীন্দ্রনাথের ওই ধারণাগুলি নেওয়া হয়েছে স্ট্রিন্ডবার্গ থেকে, কেননা দুজনেরই নাটকের 'ধুয়া' 'অবিকল' এক, এবং 'এই ধুয়া -সামীপ্যের জন্য দৈবকে সম্পূর্ণ দায়ী করা বোধহয় সংগত হবে না । ' তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে ধারণাগুলিকে রবীন্দ্রনাথ দৈবাৎ পাননি, পেয়েছেন A Dream Play থেকে । এ -যুক্তির অসারতা বোঝাবার জন্য এটা দেখাবার দরকার ছিল যে স্ট্রিন্ডবার্গের ওই

নাটকটি লিখবার অনেক আগে থেকে কীভাবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ত্যাগ দুঃখ ঋণশোধ বিষয়ক মূল ভাবনাগুলিকে কেবলই প্রকাশ করছিলেন তাঁর নানারকমের রচনায় । প্রতাপবাবুর এ -চিঠিতে প্রধান অভিযোগ অবশ্য রবীন্দ্রনাথ নিয়ে নয়, এবারকার অভিযোগ আমারই কোনো -কোনো দ্বিচারিতা নিয়ে । তাঁর বক্তব্য এই যে, 'কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক' বইতে বলা আমারই কথায় 'বিশ্বাস রেখে' তাঁর 'প্রবন্ধটি লিখতে শুরু' করেছিলেন তিনি, আর আমি এখন-যে কারণেই হোক-'আত্মখণ্ডন' করে উলটো কথা বলছি । আমার বই থেকে কিছু সূত্র পেয়েছেন প্রতাপবাবু, সেকথা তাঁর প্রবন্ধে তো তিনি বলেইছিলেন । 'অনুষ্টু প' -এ প্রকাশিত আমার লেখাটিতেও 'কালের মাত্রা'র প্রসঙ্গ তাই তু লতে হয়েছে বার বার । বরং সেখানে, অর্থাৎ 'অনুষ্টু প' -এর প্রবন্ধে, স্পষ্ট করেই আমাকে জানাতে হয়েছিল কোথায় তাঁর সঙ্গে 'কালের মাত্রা'র প্রভেদ, লিখতে হয়েছে স্ট্রিণ্ডবার্গের A Dream Play পড়লে দু -একসময়ে ''রক্তকরবী''র কোনো সংলাপ বা কোনো কোনো অবস্থান যে মনে পড়তে পারে কারো, এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই । নেই বলেই অনেকদিন আগে 'কালের মাত্রা'য় তেমন সাদৃশ্যের কথা বলতে আমার ভালো লেগেছিল । কিন্তু সেই সাদৃশ্যসন্ধানকে অতিরেকে নিয়ে গেলে কিংবা সেইটেকেই রবীন্দ্রচেতনার একেবারে ভিত্তি প্রমাণ করতে গেলে যে সমস্যা হয়, সেইটু কু ই ছিল বলবার । এই কথাটাকে তেমন লক্ষ করতে চান না বলেই প্রতাপবাবুর এখন মনে হয় যে সবকথাই আমি উলটে নিচ্ছি আজ, নাটকের স্থান আর কাল বিষয়ে 'পাঁচ বছর আগে পুনর্মুদ্রিত' বইতেও যে -কথা লিখেছিলাম, এখন আর তা মানছি না । সত্যি না কি? অভিযোগটা শুনবার পর নিজেরই বইটা আরো একবার খুলতে হলো তাই । মিলিয়ে দেখতে হলো কী বলেছিলাম তখন আর কী লিখছি আজ । প্রতাপবাবু বলেন যে এখন আমার মনে হচ্ছে 'রক্তকরবীতে একটাই, সুনির্দিষ্টভাবে নাট্যকারচিহ্নিত একটাই পট প্রাসাদের জালের আবরণের বহির্ভাগ । ' কালবিন্যাস প্রসঙ্গেও আমি ভাবছি 'রক্তকরবীতে জালের আবরণের বহির্ভাগে একটিমাত্র দৃশ্যের মতো কালপ্রবাহও আছে একটিমাত্র দিনের মধ্যে বাঁধা, ধ্বজাপূজার একটি দিন । ' অথচ, এই আমিই আগে লিখেছিলাম বইয়ের মধ্যে 'রক্তকরবীতে কালের ব্যবহারে যেমন বাস্তবের মধ্যেই লাগে পরাবাস্তবের টান, আপাতবাস্তব কালকে ভেঙে নেওয়া যায় অন্তবিহীন কালের মধ্যে-স্থান বিষয়েও তেমনি সত্যপট আর চিত্তপট মিলে এক জটিল দৃশ্যসংস্থান তৈরি হয় । ' পাঠককে অন্যমনস্ক এবং বিস্মৃতিপ্রবণ ধরে নিয়ে প্রতাপবাবু এ -কথাটা অবশ্য বলছেন না যে 'অনুষ্টু প' থেকে উদ্ধৃ ত অংশের ঠিক পরবর্তী বাক্যেই আমি লিখেছিলাম

'তবে, রক্তকরবীতে স্থান বা কালের ঐক্য নিশ্চয় আপাত -ঐক্য । ইচ্ছে করলে আমরা এর মধ্যে কল্পনা করে নিতে পারি অনেক টু করো অঞ্চল, টু করো সময় । ' বইয়ের সঙ্গে কোনো বিরোধ তো দেখি না এই কথার, যদি অবশ্য কথাটাকে পাশ কাটিয়ে না যাই । ঠিক ওই বাক্যটিরই পূর্বরূপ ছিল 'কালের মাত্রা' বইটিতে 'অনেক টু করো টু করো সময়ের খণ্ড নিয়ে যেমন রক্তকরবীর একটি ঐক্যময় আপাত সময়, তেমনি অনেক টু করো টু করো পট নিয়ে তার ঐক্যময় পথ, আপাতপথ । ' পরে কখনো মত পালটাব কি না জানি না, কিন্তু এখনো পর্যন্ত অন্তত 'রক্তকরবী'র স্থানকাল বিষয়ে 'কালের মাত্রা'য় ব্যক্ত আমার প্রাক্তন ধারণার কোনো বদল হয়নি, এ -বিষয়ে প্রতাপবাবু নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন । কিন্তু তাহলে তাঁর সমস্যাটা হচ্ছে কোথায়? সমস্যা এই যে, 'রক্তকরবী'র স্থানকালগত আপাত -ঐক্যের মধ্যে বহুবৈচিত্র্যের প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনা থাকলেও এর পরিকল্পনার পিছনে আমি স্ট্রিন্ডবার্গকে দেখতে পাইনি কেন । এখনো -বা লিখছি না কেন -যে এ -ব্যাপারে 'রক্তকরবী' 'দাঁড়িয়ে আছে A Dream Play -র একেবারে বিপরীত বিন্দুতে?' বিপরীত শব্দটাকে মাথায় রেখে নাটকদুটির কথা আরেকবার ভাবলে এর একটা উত্তর পাওয়া একেবারে অসম্ভব হয় না । প্রতাপবাবু দেখাতে চেয়েছিলেন, A Dream Play আর 'রক্তকরবী'তে 'একই মঞ্চনির্দেশ রয়েছে' আর সে নির্দেশ হলো 'মঞ্চসজ্জা অপরিবর্তিত থাকবে পুরো নাটকে । ' 'অনুষ্টু প' -এ আমার লেখাটিতে স্ট্রিন্ডবার্গের শ'খানেক লাইনের মঞ্চনির্দেশ থেকে গোটাতিরিশেকমাত্র উদ্ধৃ ত করে দেখিয়েছিলাম, কীভাবে নিখুঁত বাস্তব পরিবেশ তৈরি করবার নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি এবং কীভাবে বলছেন সে -পরিবেশকে মুহুর্মুহু পালটাবারও কথা, কীভাবে ‘The scene changes’ কথাগুলি প্রায় ধুয়োরই মতো ফিরে ফিরে আসছে তাঁর নাটকে । বিন্যাসের ব্যাপারে 'রক্তকরবী' A Dream Play -র একেবারে বিপরীত এই কারণে যে 'রক্তকরবী'তে নাট্যকারের নিজস্ব স্পষ্ট নির্দেশ হলো 'এই নাটকের একটিমাত্র দৃশ্য’-‘The scene changes’ -এর কিছুমাত্র সুযোগ নেই এখানে । 'অনুষ্টু প' -এর প্রবন্ধে আমি তাই লিখেছিলাম 'সুনির্দিষ্টভাবে নাট্যকারচিহ্নিত একটাই পট' । স্থানকালবিষয়ে দুটি নাটক একেবারে বিপরীত বিন্দুতে এইজন্যে যে A Dream Play -তে এই ঐক্যের কোনো আপাত -সম্ভাবনাও নেই, এবং দর্শকপাঠকদের কল্পনার জন্যে ছেড়েও রাখা নেই কিছু, আর 'রক্তকরবী'তে আপাত -ঐক্যের ভিতরকার সম্ভাব্য বৈচিত্র্যকে নাট্যকার ছেড়ে দিয়েছেন 'ভাবুকের চিত্তের' ওপর, যেখানে 'জাদুকরদের হাতে দৃশ্যপট আপনি রচিত হইতে থাকে' (''রঙ্গমঞ্চ'') । দুটি নাটক বিপরীত এইজন্যে যে বহির্বিন্যাসে 'রক্তকরবী'র ঘটনা চলছে স্রোতের মতো একটানা, আর A Dream Play হলো দৃশ্যতই কতগুলি খণ্ড খণ্ড ছবির একত্র সংযোজন । বাইরের দিক থেকে 'রক্তকরবী'তে প্রতিমুহূর্তেই চলতে থাকে

ধ্বজাপূজার দিনটি, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, আর A Dream Play -র প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিমুহূর্তেই বুঝিয়ে দেওয়া হয় স্থানগত বিচিত্রতা আর সময়গত বিপর্যাস । কোনো 'আপাত' ব্যাপারের সুযোগ নেই সেখানে । একু শ বছর এবং পাঁচ বছর আগেও আমার লেখায় (প্রতাপবাবুর উদ্ধৃ ত) এই লাইন ছিল যে 'রক্তকরবীতে স্থান ও কালগত ঐক্যের এক মায়া মাত্র রচিত আছে, আবার ওই সঙ্গে প্রচ্ছন্ন গড়নে এ -নাটক ছড়িয়ে আছে বৃহত্তর কালের মধ্যে'; 'অনুষ্টু প' -এর লেখাটিতেও (প্রতাপবাবুর অনুদ্ধৃ ত) একথা আছে যে 'রক্তকরবীতে স্থান ও কালের এই ঐক্য নিশ্চয় আপাত -ঐক্য । ইচ্ছে করলে এর মধ্যে আমরা কল্পনা করে নিতে পারি অনেক টু করো অঞ্চল, অনেক টু করো সময় । ' রঙ্গমঞ্চগত দৃশ্যকে ছাড়িয়ে ভাবুকের মনে আপনি যে দৃশ্যপট রচিত হতে থাকে, 'সেই রচনায় যে বাধা দেয় না ''রক্তকরবী'' এইখানেই তার বৈশিষ্ট্য' বলে জানিয়েছিলেন 'অনুষ্টু প' -এর লেখায় । না, এখনো আমি 'বারান্দায় বা ধ্বজাপূজার একটি দিনের মধ্যে' বেঁধে রাখতে চাই না নাটকটিকে, কিন্তু বলতে চাই যে নাট্যকারের স্পষ্টনির্দেশে এর বহির্গঠন ধরা আছে জালের দরজার সামনে আর ধ্বজাপূজার দিনে, 'কালের মাত্রা'তেও যেমন লিখেছিলাম যে এর বহিরবয়বে স্থান ও কাল -গত ঐক্যের এক মায়া মাত্র রচিত আছে । লেডী রানু প্রসঙ্গে কয়েকটি নতু ন কথা শুনবার পর প্রতাপবাবু এবার জানাচ্ছেন 'এসব কথা সত্য হলেও তথ্য নয় । ' সত্য এবং তথ্য শব্দের দার্শনিক বিচারে যাবার বিশেষ সুযোগ নেই এখানে, আমাদের কাছে লক্ষণীয় শুধু প্রতাপবাবুর এই ঘোষণা যে, 'এইসব গালগল্প থেকে বলা যাবে না রক্তকরবী নাটকের প্রেরণা রানু মুখার্জী, নন্দিনীর প্রেরণা রানু । ' প্রবন্ধটিতে তিনি লিখেছিলেন, এই প্রসঙ্গে লেডী রানুর 'নিজস্ব বক্তব্য শোনার জন্যে রবীন্দ্র -গবেষকেরা দীর্ঘকাল অপেক্ষা করে আছেন । ' সেই বক্তব্য শুনবার পর পালটে যায় ভাবনাটা, তাঁর মনোমতো না হলে তথ্য বা সত্যের সবটাই হয়ে যায় গালগল্প, কাজেই রানু মুখার্জী নতু ন করে আরো কিছু কথা বললেও বিশেষ সুবিধে হবে বলে মনে হয় না । কিন্তু রানুর প্রসঙ্গ তু লবার পর কৃ ষ্ণ কৃ পালানি সতর্কভাবেই এলমহার্স্টের স্মৃতিচারণ থেকে এই কথাগুলি লিপিবদ্ধ রেখেছিলেন যে :: This does not mean that any one need to go to the play to try and discover where or how Tagore draws directly from experience of actual people or actual life । তাঁর মূল প্রবন্ধে কৃ পালানির বই থেকে উদ্ধৃ তি দিতে গিয়ে এই বিশেষ অংশটির আগেই থেমে গিয়েছিলেন প্রতাপবাবু, সেটা মনে করিয়ে দেবার পর এ -চিঠিতেও কথাটাকে তেমন গুরুত্ব দিতে চাননি তিনি । গুরুত্ব দিলে দেখতেন, রানু -নন্দিনীর সমীকরণের

বিরুদ্ধে কথা বলা আছে কৃ পালানির জীবনীতেও । 'রক্তকরবী'র নন্দিনী যে রানুর চরিত্র -চিত্রণ নয়, সেটা মনে করিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথও । কিন্তু সেইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এও বলতে চান যে ওই চরিত্রের চঞ্চল প্রাণস্ফূ র্তির কাজে সহায়ক হয়েছে তাঁর রানুকে দেখার অভিজ্ঞতা । A Dream Play -প্রসঙ্গে 'স্বপ্নচ্ছায়া' কথাটাকে নিয়েও আবার সমস্যা ঘটাচ্ছেন প্রতাপবাবু । তাঁর চিঠির ভাষার মানে দাঁড়ায়, 'অনুষ্টু প' -এর লেখাটিতে আমি যেন আমার পূর্বতন বক্তব্য থেকে সরে এসেছি, অথচ স্বীকার করছি না যে আগে কোনো ভু ল করেছিলাম । 'অনুষ্টু প' -এ আমি মনে করিয়ে দিয়েছিলাম যে 'আমার লেখাটি ছিল ''রক্তকরবী'' নাটকের অভিনয় প্রসঙ্গে, বহুরূপীর প্রযোজিত অভিনয় । A Dream Play আর ''রক্তকরবী'' এই দুই নাটকের অভিনয় উপস্থাপনা রীতি যে একটু ভিন্ন হবার কথা, এইটেই ছিল বলবার । ' আর সেইটে বলতে গিয়ে 'কালের মাত্রা'য় আমি লিখেছিলাম 'স্বপ্ননাটককে দেখাতে হবে স্বপ্নচ্ছায়ার মতো, সবটা প্রায় একই স্তরে । রক্তকরবীকে নিয়ে আসতে হবে জাগ্রত জগতে । ' এ -উক্তির 'স্বপ্নচ্ছায়া' নিয়ে প্রতাপবাবু প্রশ্ন তু লেছিলেন তাঁর প্রবন্ধে, আর উত্তর হিসেবে আমি মনে করিয়ে দিয়েছিলাম 'দেখানো'র প্রসঙ্গটা, উল্লেখ করেছিলাম স্ট্রিন্ডবার্গের নিজস্ব এই নির্দেশ যে ‘The Author has sought to reproduce the disconnected but apparently logical form of a dream... ’ কিংবা ভালেন্সির এই মন্তব্য ‘The play, we are told in the foreword, is intended to produce on the stage the effect of a dream’ । এবং সিদ্ধান্ত করেছিলাম যে 'নাট্যকারের এই লক্ষ্যকে সম্পূর্ণ মান দিতে গেলে অভিনয়ে হয়তো এর স্বপ্নচ্ছায়ার কাঠামোটা আগাগোড়াই মনে রাখতে হয়' আর 'রক্তকরবী'র প্রযোজনায় পরিচালককে দেখাতে হয় যে 'আগাগোড়াই তার আছে একটা আপাতবাস্তব চেহারা । ' কাজেই, এক্ষেত্রেও, একই কথা বলা আছে দুই লেখায় । আমার পূর্বতন অবস্থান এবং সাম্প্রতিক বক্তব্যের ভিন্নতা নিয়ে একটু ভু লভাবেই তৃ প্ত হচ্ছেন প্রতাপবাবু । যন্ত্র -প্রসঙ্গটিতেও আরেকবার তিনি উলটো বোঝাবার সুযোগ নিচ্ছেন । আগে তাঁর অভিযোগ ছিল যে -নাটকে কোনোরকম যন্ত্রপাতির কথা নেই, এমন -কী A Dream Play -র মতো 'টেলিফোন, খবরের কাগজ ইত্যাদি আধুনিক যন্ত্র -সভ্যতার কিছু নিদর্শনও নেই, সে -নাটকের বিচারে সমালোচকেরা যন্ত্রসভ্যতার কথাটা তোলেন কোন মূঢ়তায় । ' তখন তিনি জানতেন যে যন্ত্র কথাটাকে 'নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর সমালোচকেরা আক্ষরিক অর্থে অর্থাৎ machine অর্থেই ব্যবহার করেছেন । ' রবীন্দ্রনাথ যে নিশ্চয়ই তা করেননি, এবং তাঁর সমালোচকদেরও কারো কারো যে সেই বোধটু কু ছিল,

এটা দেখাবার জন্য রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলি ব্যাখ্যাংশ 'অনুষ্টু প' -এর লেখাটিকে ব্যবহার করেছিলাম । সেই ব্যবহারগুলির সুবাদে এবার প্রতাপবাবু আমাকে 'অজস্র ধন্যবাদ' জানিয়ে বলেছেন যে 'রক্তকরবী'তে যন্ত্র মানে যে ‘machine’ নয়, মনুষ্যত্বহীন আমলাতন্ত্র', সেটা আমি 'খোলসা করে' বুঝিয়ে দিয়েছি । এরপর তিনি ‘bureaucracy’ শব্দটার ওপর সম্পূর্ণ ভর করে দেখাতে চান, এ -নাটক প্রসঙ্গে ধনতান্ত্রিক দুঃসমাজের কথা তোলাটা কতখানি অবান্তর, কতখানি নির্বুদ্ধিতা । কিন্তু এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময়েও পাঠককে তিনি ভু লিয়ে দিতে চাইছেন যে প্রবন্ধে উদ্ধৃ ত রবীন্দ্রব্যাখ্যানের অংশগুলির মধ্যে ওই শব্দটার ব্যবহার ছিল একটিমাত্র বাক্যে (কেননা আমলাতন্ত্র ওই ব্যবস্থাপনার স্বাভাবিক এক অঙ্গ), ভু লিয়ে দিতে চেয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথ বারে বারেই বলেছিলেন মানুষগ্রাসী একটা সভ্যতার কথা, যেখানে ‘the trust, the company, stocks and shares, investments, machinery through which they can avoid all human connection’, যেখানে ধরে নেওয়া হয় ‘perpetual domination of the strong, the continued oppression of the weak’, যেখানে ‘in the efforts to pile up material wealth, they should, by their own fellows be transformed from men into machineries । ' রবীন্দ্রনাথ এটা বলতে ভোলেননি যে এখনকার পৃথিবী হলো ‘the world of Jack and Giant-the Giant who is not a gigantic man, but a multitude of men turned into a gigantic system । ' 'সিভিলাইজেশন' শব্দটিরও উল্লেখ ছিল রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যে, বলা ছিল যে ‘it only assumes a terrfying bigness, its physiognomy blurred though its cover of an intricate network... ’ । 'রক্তকরবী' প্রসঙ্গে বলা রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলি আমার প্রবন্ধটি থেকেই তু লে আনলাম আবার, বাহুল্য হলেও । কিন্তু প্রবন্ধটিতে বা 'কালের মাত্রা'তেও ব্যবহার করিনি, তাঁর এমন কয়েকটি কথার উল্লেখ করি এখানে । আমেরিকা থেকে ১৯২১ সালের এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ প্রয়োগ করছিলেন সে -দেশ বিষয়ে like the sandy desert’ বা ‘this Sahara is mightily big’ জাতীয় শব্দবন্ধ ; ফিরে এসেই লিখছিলেন এইসব কথা যে 'আমেরিকার ঐশ্বর্যের দানবপুরীতে' ছিলেন তিনি 'অনবচ্ছিন্ন সাত মাস' ; 'যে ঐশ্বর্যের শক্তি প্রবল, আয়তন বিপুল' তার মধ্যে তিনি দেখেছেন 'টাইট্যানিক ওয়েলথ', আর তা দেখে তাঁর মনে হয়েছে 'লক্ষ্মী হলেন এক, আর কু বের হল আর । ' এসব কথার বছর দুয়েক পরে যে নাটকটি তিনি লিখলেন, তার ঘটনাস্থানকে 'লোকেরা যক্ষপুরী বলে । ণ্ঠে

লক্ষ্মীপুরী কেন বলে না? কারণ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বৈকু ণ্ঠে, যক্ষের ভাণ্ডার পাতালে । ' আমেরিকা থেকেই ছবির কার্ড পাঠিয়ে এক স্নেহভাজনকে লিখছেন রবীন্দ্রনাথ ছবিটা ভাল করে দেখ-কেরোসিন তেলের অন্ধকূ প-এর তলায় আছে তেল আর মাথায় উঠচে ধোঁয়া । এখানকার লক্ষেশ্বরদের এই দশা-এরা নিজের ধোঁয়ার মধ্যে নিজে বিলুপ্ত, সূর্য্যের আলো এদের মানসচক্ষে পৌঁছয় না । বলি রাজা পাতালপুরীর রাজা-তার বল হরণ করেছিলেন বামন অবতার । বিষ্ণু ছোট হয়ে বড়কে অভিভূ ত করেন । সময় এসেচে । যারা এতকাল ছোট হয়ে ছিল, তারাই বড়র ধন হরণ করবার জন্যে হাত বাড়িয়েছে-বড় ভয়ে কম্পান্বিত, চারদিকে দুর্গপ্রাচীর শক্ত করে গেঁথে তু লচে -কিন্তু দৈত্যভায়ার পাপের ধন আর টিকবে না । যে -কোনো একটা দেশপরিবেশ থেকে এ হলো এক ধরণের সমাজব্যবস্থার প্রতি ইঙ্গিত । কোনো পাঠক বা সমালোচক ভাবতেও পারেন যে এসবের মধ্যে আছে সেই নাটকের কিছু বীজ, যে -নাটকে ফিরে ফিরে আসে 'প্রকাণ্ড মরুভূ মি' 'মরুর পরিসরই বাড়ছে' 'বিপুল শক্তি দিয়ে অনায়াসে সেইগুলোকে নিয়ে চু ড়ো করে সাজাচ্ছিলে' 'সোনার গর্তের রাহুতে ওকে খাবলে খেয়েছে'র মতো কথাগুলি । 'আহা, এরা তো স্বয়ং কূ র্ম অবতার । বোঝার নীচে নিজেকে চাপা দিয়েছে বলেই সংসারটা টিঁকে আছে' গোঁসাইজির এই কথা শুনে বিশু বলেছিল 'কিন্তু শাস্ত্রমতে অবতারের বদল হয় । কূ র্ম হঠাৎ বরাহ হয়ে ওঠে, বর্মের বদলে বেরিয়ে পড়ে দন্ত, ধৈর্যের বদলে গোঁ । ' ধৈর্যের বদলে গোঁ আর বর্মের বদলে দন্তের এই কথাটাই অন্য ভাষায় দেখা দেয় রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যানে, যেখানে তিনি বলেন যে 'কলিযুগের রাক্ষসের সঙ্গে কলিযুগের বানরের যুদ্ধ ঘটবে এমনও একটা সূচনা আছে' এই নাটকে । আরো একবার মনে করিয়ে দিই যে আমার এসব কথা মূলত সেই পাঠকদের জন্য, প্রতাপবাবুর লেখা যাঁরা পড়েছেন । এমন নয় যে পাঠকদের আমার নিজের চিন্তার বশবর্তী করতে চাই আমি । চিন্তা করবেন তাঁরাই, যুক্তি সাজাবেন তাঁরাই, কিন্তু সেই চিন্তা বা যুক্তির ভিত্তি হিসেবে অপরিহার্য কিছু তথ্যকে শুধু সাজিয়ে দিতে চেয়েছি আমি, আগেকার প্রবন্ধটিতে এবং এই চিঠিতেও । প্রসঙ্গত, আর একটা কথা জানানো দরকার । রথীন্দ্রনাথের পালিতা কন্যা নন্দিনীর বিষয়ে বলতে গিয়ে মূল প্রবন্ধটিতে হঠাৎ আমি 'দৌহিত্রী' শব্দটি লিখে বসেছিলাম । সকলেই জানেন, রবীন্দ্রনাথের 'পৌত্রী' তিনি । নিতান্ত অন্যমনস্ক এবং লজ্জাজনক এই লনটির কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন আমার প্রাক্তন ছাত্রী এবং বর্তমান সহকর্মিণী শ্রীমতী শর্মিলা বসু দত্ত । আশা করি পাঠকেরা তাঁদের কপিতে ওটা নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছেন । শর্মিলাকে আমার সস্নেহ কৃ তজ্ঞতা জানাই । নমস্কারান্তে

শঙ্খ ঘোষ